হতে পারি বৃষ্টি পর্ব-৪০+৪১

0
499

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪০

অবাকের শীর্ষে পৌঁছে তাকিয়ে আছে মিমি। সে ভাবতেও পারেনি যে কিং আসবে। তবে রায়হান এতক্ষণ যা বলল তা কি ঠিক? কিন্তু তার সাথে কিং এর কি সম্পর্ক? সে তো কিং এর মুখই কোনোদিন দেখেনি, আর না বলেছে কোনোদিন কথা। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিং কে দেখে রায়হান যেন উচ্ছাসে ফেটে পড়ল। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল–

— কিং! ওয়েলকাম কিং! আমার ডেরায় তোমাকে স্বাগতম।

কিং নির্লিপ্ত। তার দৃষ্টি মিমির দিকে, যাকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারের সাথে। এতো শক্ত করে বাঁধা হয়েছে যে তার হাত ভেদ করে দড়ি ঢুকে যেতে চায়ছে। রায়হান নিজের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল–

— আরে আরে! দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো বসো।

কিং শীতল কন্ঠে বলল–

— আমি এখানে গল্প করতে আসিনি রায়হান। কি চায় তোর? কেন ধরে এনেছিস ওকে?

রায়হান শব্দ করে হেসে উঠল। অতঃপর হাসি থামিয়ে বলল–

— এই তো কাজের কথায় এসেছ। আচ্ছা? তুমি কি এই মেয়েকে চেনো? কি হয় ও তোমার?

— ছেড়ে দে ওকে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। কেন নয়? ওকে একেবারের জন্য ছেড়ে দেব। দুনিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে দেব। আমার তো তোমাকে দরকার ছিল। এখন এই মেয়ের কোনো প্রয়োজন নেই আমার। এই কে আছিস? মেরে দে ওকে।

রায়হান গলা উঁচিয়ে নিজের লোককে হুকুম দিল। তৎক্ষণাৎ বন্দুক তাক হলো মিমির দিকে। মিমি চোখ বন্ধ করে ফেলল। আজই বুঝি তার শেষ দিন? আর দেখা হবে না তার মিস্টার খানের সাথে? তানিয়ার সাথে? তার মা বোনের সাথে? চোখের সামনে কাইফের চেহারা ভেসে উঠতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে তার নোনা জল। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়। কিন্তু মিমির কিছুই হয় না। মিমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে কালো পোশাক ধারি লোকজন রায়হানের সকল লোকদের মাথায় পেছন থেকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। রায়হান আর জেসি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে জেসির মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে কিং ছোট খাটো কেউ নয়। কিং এবার আরাম করে চেয়ারে বসে। তাচ্ছিল্য করে বলল–

— কি রায়হান? তোর সব হাওয়া ফুশ? এই ক্ষমতা নিয়ে কিং এর সাথে লড়তে এসেছিলি তুই! কি ভেবেছিলি? তোর এসব হাবলু গাবলু দেখে কিং ভয় পেয়ে যাবে?

কিং শব্দ করে হেসে উঠল। গা ছমছম করা হাসি তার। হাসি থামিয়ে বলল–

— খুব ভুল করলি রায়হান। তোর বাবা তো শুধরে গেল। কিন্তু তুই ঠিক হলি না। একবার পালিয়ে যদি ভেবে থাকিস আবার পালিয়ে যাবি তাহলে তুই খুবই ভুল ভাবছিস।

কিং তার লোকদের ইশারা করল। তার ইশারা অনুযায়ী তার লোকজন রায়হানের লোকদের নিয়ে বাইরে চলে গেল। ঘরে বর্তমানে রয়েছে রায়হান, জেসি, কিং এবং মিমি। মিমি কেবল ড্যাব ড্যাব করে সবটা দেখে যাচ্ছে। কোনো মারামারি কিছু না, পরিবেশ ঠান্ডা। সুযোগ বুঝে রায়হান নিজের কাছে থাকা বন্দুক টা নিয়ে মিমির কপালে গিয়ে রাখল। কিং চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। রায়হান বিজয়ের হাসি হেসে বলল–

— আমি জানি তুই আমাকে বাঁচতে দিবি না। আর এ ও জানি এই মেয়ের সাথে তোর কিছু না কিছু তো আছে। আমি মরবো যখন একে সাথে নিয়েই মরবো।

কিং হুংকার দিয়ে বলল–

— খবরদার রায়হান! ওকে তুই কিচ্ছু করবি না। আমি ছেড়ে দেব তোকে। কিন্তু তুই ওকে কিছু করবি না।

রায়হান হেসে বলল–

— এটা বুঝি কিং এর দূর্বল জায়গা? যে কিং এর কোনো দূর্বলতা নেই। সেই কিং এর দূর্বল জায়গা এই সামান্য মেয়েটা! তাহলে তো একে মরতেই হবে।

রায়হান ট্রিগারে চাপ দেওয়ার আগেই দ্রুত গতিতে গুলি এসে লাগে তার হাতে। হাত থেকে বন্দুক পড়ে যায় তার। ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সে। বন্দুক হাতে নিয়ে রাগে ফুঁসছে কিং। বন্দুকে পর পর দু’বার চাপ দিয়ে গুলি রায়হানের বুকে বিঁধিয়ে দেয় সে। রায়হান ঢলে পড়ে নিচে। জীবনাবসান ঘটে তার। জেসি মুখ চেপে এক কোণে ঘেঁষে যায়। ইতোমধ্যে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও তার দলবল প্রবেশ করে। রায়হানের দেহ নিচে পড়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ইন্সপেক্টর। পাপের ফলটা সে এভাবেই পেল। কিং ইন্সপেক্টরের দিকে না তাকিয়েই বলল–

— জেসিকে নিয়ে যান অফিসার। তার মানুষ মারার খুব শখ হয়েছিল। আর সে কিং এর সাথে পাজ্ঞা নিতে এসেছিল। সেই শখ আশা করি আপনারা মিটিয়ে দেবেন। আর এই নর্দমার কীট কেও নিয়ে যান।

ইন্সপেক্টরের পরিচিত কিং। ইন্সপেক্টর কিছুই বলল না। জেসি ও রায়হানের বডি নিয়ে চলে গেল তারা। কিং এর দু’জন লোক প্রবেশ করে। রায়হানের বাকি লোকদের ও পুলিশ নিয়ে গিয়েছে। কিং গম্ভীর কণ্ঠে বলল–

— দড়ি খুলে দাও তার।

তারা মিমির হাতের পায়ের দড়ি খুলে দেয়। জীবনে প্রথম বার নিজের চোখের সামনে খু/ন হতে দেখে মিমির হাত পা কাঁপছে। সে কোনো রকম উঠে দাঁড়ালো‌‌। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল–

— কে আপনি? আমার সাথে কি সম্পর্ক আপনার?

কিং কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই নিজের পায়ের কাছে পড়ে থাকা রায়হানের বন্দুকটা তুলে নেয় মিমি। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে তেজি কন্ঠে বলল–

— হয় আজ আপনি আমাকে নিজের পরিচয় দেবেন নাহয় আমি আজ নিজেকে শেষ করে দেব।

কিং থমকে দাঁড়ায়। কিং এর লোক মিমিকে বাঁধা দিতে গেলে মিমি দু পা পিছিয়ে বলল–

— কেউ আসব না আমার দিকে। কেউ না।

কিং তাদের ইশারা করে চলে যেতে বলল। তারা চলে গেল। কিং শান্ত স্বরে বলল–

— ওটা ফেলে দাও।

— না আগে বলুন আপনি কে? কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন? আপনার সাথে বোঝা পোড়া করার জন্য রায়হান আমাকে কেন তুলে নিয়ে আসলো? মুখোশ খুলুন আপনার মুখ দেখতে চাই আমি। এই রহস্যের বোঝা আর বয়ে বেড়াতে আমি পারছি না।

কিং ধীরে ধীরে মুখ থেকে মুখোশ খুলে ফেলে। উন্মুক্ত হয় তার মুখোমন্ডল। মিমির হাত থেকে বন্দুক পড়ে যায়। মুখে দু হাত চেপে দু কদম পিছিয়ে যায় সে। তার মনে হচ্ছে পুরো দুনিয়া ঘুরছে তার। পড়ে যেতে নিয়েও চেয়ার ধরে নিজেকে সামলালো সে। বিস্ময়ের সাথে বলল–

— মিস্টার খান!

চোখে পানি টলটল করছে মিমির। চিনচিন করে ব্যথা করছে বুকে। মিস্টার খান! তার মিস্টার খান খু/নি, একজন খু/নি। জড়ানো গলায় সে বলল–

— আপনি কিং! আপনি খু/ন করেছেন মিস্টার খান! আপনি একজন খু/নি। আপনি একজন মাফিয়া!

কাইফ এগিয়ে যেতে নিল মিমির দিকে। মিমি হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল তাকে। বলল–

— এগোবেন না আমার দিকে। আপনি একজন খু/নি। আপনি অপরাধী মিস্টার খান।

চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। কাইফ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল–

— আমার কথা শোনো মিমি। উত্তেজিত হয়ো না। শান্ত হও।

মিমি চেঁচিয়ে বলল–

— কোনো কথা শুনতে চাই আপনার। আপনি চলে যান আমার সামনে থেকে, চলে যান।

মিমির মাথা ঘুরে উঠল। শরীর ছেড়ে দিল তার। কাইফ ছুটে গিয়ে আগলে নিল তাকে। চেপে ধরল বুকের সাথে। যেন মিমিকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে চায়ছে সে। মিমি তাকে খু/নি বলছে। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে খু/নি শুনতে হচ্ছে তাকে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার। সে মিমিকে কোলে তুলে বের হয়ে গেল।
——-

মিমিকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল কাইফ। মিসেস রিতা তাদের দেখে ছুটে তাদের কাছে গেলেন। তানিয়া এখনও হাসপাতালে আছে। মেঘ এবং তানিয়ার মা তার সাথে আছে। মেঘ তো ছেলেকে ছেড়ে এক পাও নড়তে রাজি নয়। মিসেস রিতা উদ্যিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–

— কাইফ! মিমির কি হয়েছে? কোথায় ছিল ও?

কাইফ তার কথার উত্তর দেয় না। মিমি কে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। মিসেস রিতা পিছু পিছু ছুটলেন। আফজাল খান এবং আজমল খান বর্তমানে অফিসে আছেন। দুই ছেলের অবর্তমানে তাদেরই অফিস সামলাতে হয়। কাইফ রুমে প্রবেশ করে খুব সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দেয় মিমিকে। মুখটা তার শুকিয়ে আছে। চোখের জলের দাগ বসে আছে মুখে। এমনকি জেসির দেওয়া থাপ্পড়ের দাগও আছে। কাইফ তার দিকে ঝুঁকে খুব যত্ন সহকারে এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে কানের পিঠে গুজে দেয়। এলোমেলো শাড়ির আঁচলে তাকে ভালো করে মুড়িয়ে দেয়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল–

— ছোট মা, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। তুমি ওর কাছে থাকো।

সে লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয়ে গেল। মিসেস রিতা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলেন না। তিনি মিমির মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন।

আধ ঘন্টার মধ্যেই ডাক্তার নিয়ে হাজির কাইফ। মিসেস রিতা তাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কাইফ ডাক্তার কে চেয়ার টেনে দিল। মধ্য বয়স্ক ডাক্তার চশমাটা চোখে একটু ঠেলে দিয়ে বসে পড়লেন। মিমি তখনও জ্ঞানহীন। ডাক্তার তার পার্লস রেট মাপলেন। প্রেশারটাও মাপলেন। কিছুক্ষণ গভীর পর্যবেক্ষণ করে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন। কাইফ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। মিসেস রিতা ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন–

— ডাক্তার সাহেব কি বুঝলেন? কোনো গুরুতর কিছু?

ডাক্তার কাইফের দিকে তাকালেন। কাইফ তার পূর্ব পরিচিত। তিনিই তাদের ফ্যামেলি ডাক্তার। তিনি মিমির হাতে একটা ইনজেকশন পুশ করতে করতে বললেন–

— কোনো কিছু কি হয়ে ছিল? সিরিয়াস কিছু? খুব বড় ক্ষতি হতে হতে বেঁচে গিয়েছে দুজনে।

কাইফ নড়ে চড়ে দাঁড়াল। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে তার। এমনিতেও সে তো অপরাধী। মিসেস রিতা বললেন–

— কি হয়েছে বলুন না ডাক্তার? দুজনে মানে? আমার খুবই চিন্তা হচ্ছে। ও ঠিক হয়ে যাবে তো?

ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন–

— মিসেস খান! আফসোস আমার ডায়াবেটিস আছে। নাহলে মিষ্টি মুখ না করে আমি এক পাও নড়তাম না। কংগ্রাচুলেশান! আপনি আবারও দাদু হতে চলেছেন।

মিসেস রিতা আনন্দের সাথে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলেন। কাইফের মনে হচ্ছে মাটি কাঁপছে, না না মাটি কেন কাঁপবে? তার পুরো শরীরে ভূমিকম্প হচ্ছে। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। তীব্র অনুভূতিতে সে কথা বলতেই ভুলে গিয়েছে। ডাক্তার আবারও বললেন–

— তবে একটু খেয়াল রাখবেন। উনি খুব স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। ওনাকে সম্পূর্ণ স্ট্রেস মুক্ত রাখতে হবে। হাসি খুশি রাখতে হবে। নাহলে দুজনের ক্ষতি হতে পারে। আর ওনাকে একবার হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। কিছু চেকআপ করতে হবে।

একটানা বলে তিনি থামলেন। কাইফ তখনও নির্বাক। মিসেস রিতা ডাক্তারকে ইশারা করে নিজের সাথে যেতে বললেন। তাদের একটু একা থাকা দরকার।

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ।}

#হতে_পারি_বৃষ্টি
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪১

শ্রেষ্ঠতম সুখের অনুভুতি বার্তা বুঝি বাবা হওয়ার সংবাদ? কাইফের তো তাই মনে হচ্ছে। এমন সুখানুভূতি কখনও কোনো সংবাদ শুনে হয়নি। মেঘের ও বুঝি এমন অনুভব হয়েছিল? কাইফের চিৎকার করে সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করছে যে সে বাবা হবে! বাবা হবে সে! কাইফ কাঁপা কাঁপা পা ফেলে মিমির দিকে এগিয়ে গেল। বসলো তার পাশে। অপলক দৃষ্টিতে তাকালো মিমির দিকে। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। নিজে না থাকলেও সব সময় তার লোক মিমির আড়ালে তার পেছনে থাকতো। আর সব খবর কাইফকে দিতো। যাতে কোনো বিপদ হলে কাইফ তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে পারে। কিন্তু কীভাবে যেন রায়হান মিমিকে তার চোখে ধুলো দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেল। একটু সাবধান হলে বোধহয় এমনটা হতো না। যদি কিছু হয়ে যেত? ভাবতেই কাইফের বুক কেঁপে ওঠে। লম্বা শ্বাস নিয়ে কাইফ হাত বাড়িয়ে উন্মুক্ত করল মিমির পেটের অংশ। এখানেই ছোট্ট প্রাণটা আছে। কাইফের দোষেই যার বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছিল। কাইফ আলতো স্পর্শ করে সেখানে। অনুভব করার চেষ্টা করে ছোট্ট প্রাণকে।
—-

মিসেস রিতা ফোন করে সকলকে খবরটা দিয়ে ফেলেছেন। তানিয়া খবরটা পেয়েই এক প্রকার লাফিয়ে উঠল। মেঘ আঁতকে উঠে ছেলেকে সামলে নিয়ে বলল–

— কি করছ তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি? এই অবস্থায় কেউ এমন করে?

তানিয়া উল্লাসে ফেটে পড়ে বলল–

— মেঘ তুমি বুঝতে পারছ? আরেকটা ছোট্ট বাবু আসবে। ইশ্! আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে! আমার ছেলে আসতে না আসতেই তার খেলার সাথী ও চলে আসছে।

মেঘ তানিয়ার কান্ড দেখে হেসে ফেলল। ছেলেকে নিজের কোলে তুলে বলল–

— হ্যাঁ ভালোই হয়েছে। ভাইয়া আমার উপদেশটা কাজে লাগিয়েছে। এসবই আমার ক্রেডিট বুঝলে? নাহলে ভাইয়া সারাজীবন ব্যাচেলার থেকে যেত তার আর বাবা ডাক শোনা হতো না। আর না আমার চাচ্চু ডাক।

দুজনে শব্দ করে হেসে ওঠে। মেঘের কোলে থাকা ছোট্ট তাহির পিটপিট করে তাকায়। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘তোমরা এতো আওয়াজ করছ কেন? আমার ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।’

মেয়ের সংবাদ শুনে তৎক্ষণাৎ হাজির হলেন মিসেস মুক্তা। সাথে এসেছে রিহা। মিসেস রিতা খুবই আন্তরিকতার সাথে তাদের বসালেন। আফজাল খান এবং আজমল খান ও চলে এসেছেন। ঈশানি হাসপাতালে আছে। একটু পর সেও চলে আসবে। সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে মিমির সাথে দেখা করবে বলে। মিসেস রিতা তাদের আটকে রেখেছেন। তিনি বললেন–

— কাইফ আর মিমিকে একটু একা ছেড়ে দিয়েছি। ওরা একটু একা থাকুক। তারপর আমরা সবাই মিমির সাথে দেখা করব।

সকলে মেনে নিল। মিসেস রিতা নাস্তার ব্যবস্থা করে , সকলের সাথে গল্পে মেতে উঠলেন।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল মিমি। আলোটা তার চোখে বিধল। সে চোখ বন্ধ করে পুনরায় তাকায়। হাতে পায়ে প্রচুর ব্যথা করছে। হঠাৎ অনুভব করল পেট উষ্ণ জলে ভিজে যাচ্ছে। কেউ মাথা রেখে আছে সেখানে। মিমি নিচের দিকে তাকায়। কাইফ তার পেট শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথা রেখে আছে। মিমির বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কাইফ কাঁদছে? কিন্তু কেন? মিমির পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল। কাইফ-ই কিং আর কিং খু/নি। মিমি নড়ে চড়ে উঠল। কাইফ মাথা তুলে চোখ মুছে তার দিকে তাকায়। কখন যে চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করেছে সে নিজেও বোঝেনি। কাইফের তাকানো দেখে মিমি মুখ ঘুরিয়ে নিল। কাইফ এগিয়ে তার গালে হাত রেখে বলল–

— তুমি ঠিক আছ? কোথাও কষ্ট হচ্ছে তোমার?

মিমি কথা বলে না। সে নির্বাক। কাইফ তাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। হুট করেই মিমিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। শক্ত করে যেন মিমি কোথাও যেতে না পারে, কোথাও না। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল–

— তুমি আমাকে এ কেমন সুখ দিলে মিমি? আমি যে তোমার কাছে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম। তুমি জানো তুমি কি দিচ্ছ আমায়?

একটু থেমে কাইফ আবারও বলল–

— বাবা হওয়ার সুখ দিচ্ছ তুমি আমায়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দিচ্ছ তুমি আমায়। উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস্।

মিমি কিছু মূহুর্তের জন্য থমকে গেল। সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে মা হতে যাচ্ছে! তবুও মিমি কথা বলে না। কাইফ তার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল–

— ভালোবাসি। সারাজীবনের জন্য ভালোবাসি।

মিমি চোখ বন্ধ করে নেয়। গড়িয়ে দু ফোঁটা জল। কাইফ তাকে ছেড়ে দিয়ে এলোমেলো চুল কানে গুজে দিয়ে বলল–

— তুমি একটু বসো। আমি নিচ থেকে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি। সবাই তোমার সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছে।

কাইফ নিচে গিয়ে সবাইকে ওপরে পাঠিয়ে দিল। সকলে এসে এক এক করে মিমির মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। রিহা তো মিমির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল–

— আপুউউ! আমি খালামনি হবো! আমি এত্তো এত্তো খুশি।

মিমি হাসে। মিসেস মুক্তা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন–

— আমার সেই ছোট্ট মিমি দেখতে দেখতে কবে যে এতো বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর সে আজ মা হবে। তোর জন্য দোয়া করি রে মা। তুই খুব সুখী হ।

মিমির কি হলো সে জানে না। নিজের মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সব কষ্ট সে মায়ের বুকে কেঁদে বিসর্জন দিতে চাচ্ছে। মিসেস মুক্তা স্মিত হেসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন–

— কাঁদছিস কেন? পাগলি মেয়ে। জানিস? তোর আসার খবর যখন তোর বাবা পেল তখন সে কি খুশিটাই না হয়েছিল। পুরো পাড়াতে মিষ্টি বিলিয়ে ছিল। আর তুই যখন হলি তখন পুরো হাসপাতালের লোকদের মিষ্টি খাইয়েছিল।

বাবার কথা মনে পড়তেই মিমির কান্নার বেগ বেড়ে গেল। কাইফের কিং রূপ দেখে সে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। কাইফের আশে পাশে যেতেও মন চায়ছে না। কাইফ কেন কিং হলো? অন্য কেউ কেন কিং হলো না? মিসেস রিতা বললেন–

— কেঁদো না মিমি। ডাক্তার তোমাকে হাসি খুশি থাকতে বলেছে। আর না জানি তুমি কতক্ষন না খেয়ে আছ? আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।

তিনি চলে গেলেন। মিসেস মুক্তা মেয়ের মুখ শাড়ির আঁচলে মুছে দিয়ে বললেন–

— এমন করলে হবে না, মা। সব সময় মনে রাখতে হবে এখন তুই আর একা নোস। তোর মধ্যে একটা প্রাণ আছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে আর ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। তুই বিশ্রাম কর, আমি নিচে যাচ্ছি।

মিসেস মুক্তা ও চলে গেলেন। রিহা বোনের পাশে বসে বলল–

— আপু! তুমি ভাবতে পারছ? ছোট্ট একটা বাবু হবে তানিয়া আপুর মতো। আর সে খালামনি খালামনি করে আমার গলা ধরে ঝুলে থাকবে।

মিমি মলিন হাসে। তানিয়ার কথা মনে পড়তেই সে চিন্তিত কন্ঠে বলল–

— তানি কেমন আছে রে? তুই দেখা করতে গেছিলি ওর সাথে? ওর বাবু কেমন আছে? আর কি হয়েছে? ছেলে না মেয়ে?

রিহা বোনের কথা শুনে অবাক হলো। বিস্মিত কন্ঠে বলল–

— কি বলছ তুমি আপু? তুমি কিছুই জানো না? তানিয়া আপুর ছেলে হয়েছে এবং তারা দু’জনই একদম সুস্থ আছে। তুমি যাওনি হাসপাতালে?

মিমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিহার কথার জবাব না দিয়ে বলল–

— তুই নিচে যা রিহু। আমি একটু রেস্ট করব।

রিহা তার কথার পিঠে কোনো কথা বলল না। চুপচাপ চলে গেল। রিহা চলে যাবার পর পরই খাবার হাতে প্রবেশ করল কাইফ। মিমির সামনে রেখে বলল–

— তুমি এগুলো খেয়ে নাও। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। খুব অস্বস্তি লাগছে।

কাইফ টি শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। মিমি চুপ করে বসে থাকল, খাবারে হাত লাগালো না। প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে বের হলো কাইফ। বের হয়ে দেখলো খাবার যেমন ছিল, তেমনই আছে। কাইফ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল–

— খাওনি কেন?

মিমি কথা বলে না। কাইফ চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেলে। মিমির পাশে গিয়ে বসে তার হাত নিজের হাতে মধ্যে নেয়। মিমি ছাড়াতে চায়লে কাইফ শক্ত করে ধরে ফেলে। কাইফ শান্ত কন্ঠে বলল–

— কথা বলবে না আমার সাথে? একটুও না?

মিমি বলে না। কাইফ আবারও বলল–

— আচ্ছা বেশ। বলতে হবে না। খেয়ে নাও অন্তত? না খেলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর যে তোমার মধ্যে আছে, তার কথাও তো ভাবতে হবে নাকি? একটু খানি খেয়ে নাও? ওষুধ খেতে হবে।

কাইফ তার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে। না চায়তেও মিমি তা মুখে নেয়। এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তার সব কিছু জুড়ে তো শুধুমাত্র এই মানুষটারই বাস।
—–

পরদিন ঈশানি এলো। তার সাথে এলো নিশান। ঈশানি প্রথমে এসেই মিমিকে জড়িয়ে ধরল। আবেগপ্লুত হয়ে বলল–

— একজন আসতে না আসতেই আরেকজন আসার খবর পেলাম। খান ম্যানসন এবার ভরে উঠবে গো মিমি।

কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল–

— তোমার জন্য আমার ভাইয়া সন্যাসী হতে হতেও হয়নি। ভাইয়াকে নিজের আঁচলে বেঁধে সংসার মুখো করেছ তুমি। আমরা সবাই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

মিমি মনে মনে ভাবলো ‘সত্যিই কি তাই? আমার জন্য উনি সংসার করছেন? আমি যদি না থাকতাম তাহলে কি করতেন উনি? উনি তো একজন মাফিয়া! মাফিয়ারা কি বিয়ে শাদি করে? নাকি সারাজীবন খু/ন খারাবি করে বেড়ায়?’

নিশান এসে মিমির কোলের মধ্যে বসে পড়ে মিমি গলা জড়িয়ে ধরল। বলল–

— রসমালাই! কেমন আছো তুমি? তুমি এখন আর আমাকে পড়াতে যাও না। আমি খুব রাগ করেছি।

মিমি হেসে তার গাল টেনে দেয়। ঈশানি মেকি রাগ দেখিয়ে বলল–

— নিশান! এখন এভাবে যখন তখন রসমালাই এর কোলে ওঠা যাবে না।

— কেন যাবে না?

— কারণ তোমার রসমালাই এর পেটের মধ্যে ছোট্ট বেবি আছে।

নিশান গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল–

— রসমালাই এর এইটুকু পেটের মধ্যে বেবি কীভাবে আছে?

— তুমি বুঝবে না। যখন হবে তখন দেখো। তানিয়া মামির বেবি হয়েছে দেখেছ না?

— হ্যাঁ। রসমালাই জানো? ছোট্ট বেবি দেখেছি আমি। একদম এইটুকু! আবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিল জানো?

মিমি হেসে বলল–

— তাই বুঝি? বেবি যখন বাড়িতে নিয়ে আসবে তখন তুমি সব সময় তার সাথে খেলতে পারবে।

— কবে আসবে বেবি?

— এই তো কদিন পরেই চলে আসবে।

— তাহলে খুব মজা হবে বলো? আমি পাপাকে কল করে বলে আসি যে আমি এখানে থেকে বেবির সাথে খেলব। বাড়িতে আর যাব না।

নিশান দৌড়ে বের হয়ে গেল। ঈশানি হেসে বলল–

— দেখেছ ছেলের কান্ড? সে এখন আর বাড়িতে যাবে না। এখান থেকে এক পাও নড়বে না। এই ছেলেকে নিয়ে যে কি করি আমি? দিন দিন জেদি হয়ে যাচ্ছে।

মিমি শুধু হাসে। ছোট ছেলে একটু আধটু জেদ তো করবেই। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।

চলবে?
{ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ।}