হে দুঃখি চোখ ৪র্থ এবং শেষ পর্ব

0
980

#হে_দুঃখি_চোখ
#৪র্থ_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আব্বা ঠিক করেছিলেন নিতুর মামার বাড়ি যাবেন। তিনি চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন না জানি কী বিপদ হলো ওদের!নয়তো কাঁদবে কেন ফোন করে আম্মা।আর কথা না বলে ফোনের সুইচ ই বা কেন বন্ধ করে দিলো!
কিন্তু আব্বার আর যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। পরদিন দুপুর বেলা আম্মা নিজেই ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি এলেন একা।নিতু আসেনি।
তার চোখ মুখ কেমন ফোলা ফোলা। চেহারা মলিন হয়ে আছে। আম্মা ঘরের বারান্দায় পা রেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।আর ডাকলেন আমাকে। বললেন,’বিথী,মারে মা তুই কই?আয়,একটুক এইদিকে আয়!’
আমি দৌড়ে গেলাম আম্মার কাছে।কাছে গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন।তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আম্মা আমাকে দেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তারপর আমার কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে ফেললেন। আমার যতটুকু মনে আছে বোঝ হওয়ার পর আম্মাকে কোনদিন আমায় জড়িয়ে ধরতে দেখিনি। এমনকি আদর করে এভাবে ডাকতেও দেখিনি কোনদিন। কিন্তু আজ আমায় তিনি জড়িয়ে ধরলেন।
আম্মা আমায় জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা গলায় বললেন,’বিথীরে বিথী,ও মা বিথী, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে রে মা!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী হয়েছে?’
আর এদিক ওদিক তাকিয়ে নিতুকে না পেয়ে বললাম,’নিতু কোথায়?’
আম্মা তখন আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠে বললেন,’নিতু নাই মা।নিতুরে জোর কইরা নিয়া পালাইছে হাসান!’
আমি আরো বেশি অবাক হয়ে বললাম,’মানে?’
‘হ মা। আমি বিরাট বড় ভুল কইরা ফেলাইছিলাম মা।তোর সব্বোনাশ করতে গিয়া আমার নিজের সব্বোনাশ আমি করে ফেলাইছি রে মা।’
আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। কেন জানি গলা বেয়ে কান্না আসছে। আমি অনেক কষ্টে কান্না লুকিয়ে রেখে বললাম,’আম্মা, নিতুকে নিয়ে ও এখন কোথায় আছে?’
‘জানি না রে মা জানি না। হাসানের আগে থাইকাই আমার মাইয়ার প্রতি লোভ আছিলো। আমি ভাবছিলাম হের সাথে যদি তোর বিয়া দিতাম পারি তাইলে আর হে আমার মাইয়ার দিকে নজর দিবো না। কিন্তু কাজ হইলো না রে মা। রাগে বাড়িত গিয়া হাসানরে কইলাম হে যেন তোর ইজ্জত মারে। কিন্তু হারামজাদা আমার নিজের ইজ্জতই মাইরা দিছে রে মা। আমি ভুল কইরা ফেলাইছি মা। আরেকজনের লাইগা গর্ত করলে সেইখানে নিজের পা-ই আগে পড়ে রে মা। নিজের পা-ই আগে পড়ে!’

আম্মার কথাগুলো শুনে আমি বড়ো অবাক হলাম।আর ভাবলাম কী অসম্ভব ধুরন্ধর মহিলা তিনি।কী ভয়ংকর চতুর! কিন্তু এইসব কিছু করে কী লাভ হলো তার? এই যে মানুষ অন‍্যকে ঠকিয়ে সব সময় নিজে জিতে যেতে চায় কিন্তু সে কী এভাবে আদৌ জিতে যেতে পারে?
কিছুতেই পারে না।সে হেরে যায়। সৃষ্টিকর্তা তাকে জিতে যেতে দেন না।আপাত দৃষ্টিতে আমরা হয়তোবা দেখি সে জিতে গেছে। তাকে নিয়ে তার সামনে আমরা দু চারটা প্রশংসা বাক্যও বলি। কিন্তু বাস্তবে তো সে হেরেই যায়!
আমি বললাম,’নিতুকে কী উদ্ধার করার কোন ব‍্যাবস্থা নাই?’
আম্মা বললেন,’নারে মা নাই।কী জানি কই গেছে এরে নিয়া হাসান!’
তারপর আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো আম্মা। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সান্ত্বনা দিলাম। তবুও তার কান্না কোন ভাবেই থামলো না।

আব্বা বাজার থেকে ঘরে ফিরলেন সন্ধ্যা বেলায়।
আব্বা উঠোনে পা রাখতেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আব্বার কাছে গেলেন আম্মা। তারপর একেবারে আব্বার পায়ের কাছে বসে আব্বার পা ধরে কাঁদতে লাগলো আম্মা। আব্বা বললেন,’কী ব‍্যাপার?কী হইছে?’
আম্মা সবকিছু ভেঙে ভেঙে বললো।
আব্বা তখন বললেন,’আমি আগেই বলছিলাম নিতুরে রাইখা যাওয়ার জন্য। তুমি মুখের জোরে, তোমার ভাতিজার পাওয়ারের জোরে নিয়া গেলা! আমার মাইয়াটারে নিয়া এর জীবনটা নষ্ট করে দিলা!’
আব্বার চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। তারপর আব্বা এক হাতের পিঠ দিয়ে তার চোখের জল মুছে নিয়ে আম্মার কাছ থেকে পা ছাড়িয়ে ঘরে ফিরলেন। ঘরে ফিরে বাজারের ব‍্যাগটা রেখে বারান্দায় এসে একটা চেয়ারের উপর বসলেন। তারপর আম্মাকে বললেন,’তোর পাপ আমার মেয়েটাকে গ্রাস করে ফেলছে। সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার! তুই একটা খুনি! তুই একটা দুশ্চরিত্রা মহিলা।তোর হিংসা,তোর হৃদয়হীনতা আমার মেয়েটাকে আজ ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে।যা তুই এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যা!’
আম্মা তখন কেমন বেকুব বনে গেলেন। তারপর ধীর স্থির ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় মাথায় হাত চাপড়ে শুধু এই কথাই বলতে লাগলেন,’আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে! আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে!’
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গেলাম আম্মাকে ফেরাতে। কিন্তু আম্মাকে আটকে রাখা গেলো না কিছুতেই। তিনি হাত চাপড়াতে চাপড়াতে,’আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল রে আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল!’ এই কথা বলে বলে চলে গেলেন কোথায় যেন!

চার বছর পর—

আমার বিয়ে হয়েছে।বর খুব লক্ষ্মী!নয় নয়বার বিয়ে ভাঙার পর আব্বা যখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে আমার বুঝি আর বিয়েই হবে না! চিরদিন আব্বার গলার কাঁটা হয়ে ঝুলে থাকতে হবে আমার!
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু।দশমবারের বেলা আর বিয়ে ভাঙলো না।বর তার মাকে নিয়ে এসে সরাসরি আমায় পছন্দ করলেন। তারপর এর দুদিন পরই বিয়ে পড়ানো হলো। এখন আমার এক মেয়ে। মেয়ের বয়স দুই। মেয়েও তার বাবার মতন খুব লক্ষ্মী!
আব্বা এখন আমার কাছেই থাকেন।সব মিলিয়ে এখন আমি অনেক সুখি। কিন্তু একটা গোপন দুঃখও আছে আমার।দুঃখটা হলো আমার সৎ মা এবং ছোট বোন নিতুর জন্য। হাসান নিতুকে নিয়ে পালানোর মাস খানেক পরেই সে বাড়িতে চলে এলেও নিতু তার সাথে এলো না। আম্মা গিয়ে তার কাছে বললেন,’নিতু কই আমার?’
হাসান বললো,’নিতু কই এটা কী করে আমি জানবো? আমি কী নিতু কে নিয়ে কোথাও গিয়েছিলাম নাকি?’
এরপর আম্মা পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রভাব থাকার কারণে হাসানের নামে কোন কেসই লিখেনি পুলিশ। আব্বা নিজেও চেষ্টা করেছিলেন পুলিশের কাছে গিয়ে। কিন্তু পুলিশ জানালো,’ প্রমাণ ছাড়া কিছুই করা যাবে না। তাছাড়া হাসান সাহেবের মতো এমন সমাজ সেবকের নামে অপবাদ রটানোর জন্য আপনার নামে সে যদি মানহানির মামলা করে তখন কিন্তু আপনার নিজেরই বিপদ হবে!’
আব্বার পিঠ তখন আপনা আপনিই দেয়ালে ঠেকে গেল। তাই তিনি এ নিয়ে আর খুব একটা বাড়াবাড়ি করতে পারলেন না।
আর আম্মা ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘোর পাগল বণে গেলো। কিছুদিন তিনি বাজারে বাজারে ঘুরাফেরা করলেও এক সময় পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। আমি এখনও নিতুকে মনে মনে খুঁজে বেড়াই। খুঁজি আম্মাকেও।বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে রাস্তার দু পাশে তাকাই এই আশায় যে যদি হঠাৎ করে চোখের সামনে আম্মা কিংবা আমার বোনটি পড়ে যায়!
কিন্তু দুঃখজনক হলো দুজনের কাউকেই কোনদিন এক পলকের জন্যও চোখের সামনে পাইনা আমি!

___সমাপ্ত___