৩.২০ মিনিট পর্ব-০২

0
965

#৩.২০ মিনিট
#রাবেয়া_সুলতানা
#২

__দুই দিন হয়ে গেলো জেবা এখনো কিছু মুখে তোলেনি। জিসানের চাচাতো বোন মারিয়া খাবার নিয়ে জেবার রুমে এসে খাবার টা টেবিলে রেখে, জেবার পাশে বসে, ভাবী ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসতো তাইনা? জানো আমাদের পরিবারের সবাই ভাবতো ভাইয়া এতো রাগী আর সেই রাগী মানুষটা যে প্রেম করবে এইটা আমরা কেউ কখনো ভাবিনি।কেনো ভাবিনি জানো?

জেবা মারিয়ার মুখের দিকে তাকালো।

মারিয়া আবার বলতে লাগলো,ভাই কোনো মেয়ে মানুষ কে পছন্দ করতো না।এই যে আমরা চাচাতো বোন ফুফাতো বোন আছি ভাইয়া আমাদের সাথেও তেমন কথা বলতো না।জানো, যেইদিন ভাইয়ার রুমে দেওয়ালে তোমার ছবি দেখলাম সবাই অবাক।সেইদিন তো বড় মা আর মায়ের আনন্দের সীমা ছিলো না।যেই আসতো সবাইকে বলতো এই জানো আমাদের জিসান প্রেমে পড়েছে। এই শুনছো আমাদের জিসান একটা মেয়েকে ভালোবাসে।
আর জিসানের ভালোবাসা যে পায় সেই মেয়ে ভাগ্যবতী। কারন জিসান যাকে ভালোবাসবে জীবন চলে যাবে তাকে কখনোই কষ্ট দিবেনা।

মারিয়ার কথা গুলো শুনছে আর জেবা চোখের পানি গুলো চোখ বন্ধ করে টিপ টিপ করে গাল বেয়ে পড়ছে।

-ভাবী তুমি এইরকম চুপচাপ না থেকে সবার সাথে কথা বলো।কতো দিন তুমি এই রকম এক ঘরে হয়ে থাকবে? শুনেছি তোমার বাবা নাকি তোমাকে নিয়ে যাবে।তুমি কি সত্যি সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?

জেবা কিছু বলছে না।জিসানের চাচা এসে বললো মাসুদ সাহেব এসেছেন।জেবাকে নিয়ে আয়।

-কিন্তু বাবা ভাবী তো কিছু খায়নি।

-পরে এসে খেতে পারবে।তুই নিয়ে আয়।উনি ড্রইংরুমে বসে আছেন।

জেবাকে এনে মাসুদ সাহেবের সামনে এনে বসানো হলো।
মাসুদ সাহেব অনেকক্ষন জেবার দিকে তাকিয়ে থেকে,আপনাদের না রাত ৩.২০ মিনিটে বিয়ে হয়ে ছিলো?
কথাটা শুনে জেবা নিচের দিক থেকে মাথা উঠিয়ে মাসুদের দিকে তাকালো।

-আচ্ছা রাত ৩.২০ মিনিট কেনো বিয়েটা হয়েছিলো?
আমরা জিসান সাহেবের ব্যাপারে যতটুকু খবর নিয়েছি উনি খুব কঠোর একজন মানুষ। উনার অফিসে প্রতিটি স্টাফ বললেন উনি বাহিরের দিকটা যেমন খুব কঠোর
তেমননি মনটাও খুব নরম। এখন বলুন বিয়েটা কেনো ৩.২০ এ হয়েছিলো?

জেবা কিছু বলছেনা।পাশে ফিরে নিজের বাবার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

-মিসেস জেবা আপনি কথা বলুন।চুপ করে থাকবেন না।আপনি কি চান না আপনার স্বামীর খুনিরা শাস্তি পাক? কে বা কারা খুন করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে?

জিসানের বাবা মাসুদ সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বললো, বিয়ে যখনি হোক না কেনো মৃত্যুর সাথে সম্পর্ক কি?

মাসুদ জিসানের বাবার কথায় মুচকি হেসে, কারন উনাকে সেই টাইমে হত্যা করা হয়েছে যে টাইমে উনার বিয়ে হয়েছে।মানে দিনের ৩.২০ মিনিটে উনাকে মারা হয়েছে।বিয়ের বারো ঘন্টা পার না হতেই একজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।এখন আপনারা বলুন এইটা কি রহস্যময় মৃত্যু নয়?

জিসানের বাবা চুপ করে গেছে।আর কিছু বলছেনা।

মাসুদ আবার জেবার দিকে তাকিয়ে, আপনি কথা বলুন।আমার প্রশ্নের আনসার দিন।সত্যি করে বলুন জিসান সাহেব ছাড়া আপনার সাথে আর কারো সাথে রিলেশন ছিলো?এখন হামেশাই এইসব ঘটে থাকে।হয়তো আপনার পুরোনো প্রেমিক উনাকে হত্যা করেছে।

জেবার বাবা মাসুদের কথা শুনে, কি আজগুবি কথাবার্তা বলছেন আপিনি?আমার মেয়ের কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।আপনি বললেন না আমার মেয়ের রাত ৩.২০ মিনিট কেনো বিয়ে হয়েছে? সেটা আমি বলছি।আমার মেয়ের জিসানের সাথে রিলেশন এইটা আমরা সবাই জানি।কিন্তু সত্যি বলতে জিসানকে আমার মোটেও পছন্দ ছিলোনা।কারণ জিসানের সাথে আমার কথাবার্তা বনতো না। আমি কখনো চাইনি এইরকম উগ্রমেজাজী একটা ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হোক।তাই আমি আমার মেয়ের বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করেছি।আমার নিজের বোনের ছেলের সাথে।বিয়ে রাতে হওয়ার কথা ছিলো।কিন্তু জিসান সেই বিয়েটা হতে দেয়নি সেসব ঝামেলা মিটাতে গিয়েই বিয়েটা হতে হতে রাত ৩.২০ মিনিট।

মাসুদ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বুজালো।
জিসানের মা মাসুদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, ও আমার ছেলে চলে যাওয়ার পর থেকেই কথা বলেনা মিস্টার মাসুদ।চুপচাপ হয়ে থাকে।আপনি ওকে কিছু বলবেন না প্লিজ।আমার ছেলের ভালোবাসা ও। আমার ছেলেটা কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকায়নি।কিন্তু এই মেয়েটার ভালোবাসায় আমার ছেলে অন্ধ ছিলো।
আমার ছেলে নিজের বাড়িতেও কারো সাথে তেমন কথা বলতো না আমার সাথে ছাড়া।জেবার সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে, আমার সাথে কথা বলতে গেলেও জেবাকে নিয়ে বেশি কথা হতো।আপনি যা ভাবছেন জেবা সেইরকম মেয়ে নয়।

মাসুদ উঠে দাঁড়িয়ে, জিসানের মায়ের কাঁধে হাত দিয়ে, আপনি আমার মায়ের বয়সী, কিন্তু মা দেখুন যদি জিজ্ঞাসা বাদ না করা হয় তাহলে আপনার ছেলেকে কে খুন করেছে সেটা জানা কষ্টকর হয়ে যাবে।

কথাটা বলে মাসুদ সাহেব চলে গেলেন।জেবার বাবা উঠে দাঁড়িয়ে, আপনাদের সবাইকে আমি বলতে চাই,আমার মেয়েকে আমি আজকেই নিয়ে যাবো।আমি এইখানে এক মূহুর্তের জন্যও আমার মেয়েকে রাখতে চাইনা।

জিসানের মা টলমল চোখ নিয়ে জেবার বাবার সামনে হাত জোড়ো করে, আপনি একটু দয়া করুন।আমার ছেলের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিবেন না।আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি কিছুদিন গেলেই আমি আপনার মেয়েকে নিজে নিয়ে দিয়ে আসবো।আপনি যদি আপনার মেয়েকে নিয়ে যান আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে না।

জেবার বাবা আর কিছু বললো না। মেয়েকে না নিয়েই চলে গেলেন জেবার মাকে নিয়ে।

জেবা তুমি এখনো ঘুমিয়ে আছো? উঠো”তুমি না বললে সকালের কাকেরা যখন কা কা করে ডাকবে আর তুমি আমার কাঁধে মাথা রেখে তাদের দেখেবে। সকালে সূর্য যখন পূর্ব আকাশে উঁকি দিবে তখন সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি তোমায় বলবো ভালোবাসি,ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।

জেবা ঘুম ঘুম চোখে জিসান তুমি এসে গেছো? কোথায় ছিলে তুমি এতোটা দিন আমাকে ছেড়ে? তুমি জানোনা তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়?
কথাটা বলেই জিসানকে জড়িয়ে ধরে,জিসান সেইদিন খুব ভোরে যখন তুমি তোমাদের বাড়িতে আমায় নিয়ে এসে ছিলে,তখন নিজেকে সবছেয়ে সুখি মানুষ মনে হয়েছিলো।আমি সেইদিন ভেবেছিলাম আমাদের ৩ বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা পেয়েছে।তুমি যখন আমাকে তোমার রুমে এনে বলেছিলে আজ থেকে এইটা তোমার ঘর জেবা।হ্যাঁ জিসান” দেখো তুমি ছিলেনা কিন্তু আমি আজও আমার ঘরই মনে করি।সকালে সবার সাথে যখন আমায় পরিচয় করিয়ে দিলে তখন সবাই আনন্দে মেতে ছিলো। আমাকে সেকি আদর যত্ন,সবার ভালোবাসা নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়ে ছিলো জিসান।তখন ভেবেছিলাম কোনো এক পূন্যের কাজ করছি হয়তো তাই এমন একটা পরিবার পেয়েছি। মূহুর্তের মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলাম আমারও একটা পরিবার আছে।ভুলেই গিয়ে ছিলাম তোমার বাবা মা ছাড়া আমারও বাবা মা আছে। সকাল ৯.০০ টা তুমি আমাকে আবার তোমার রুমে নিয়ে এসে যখন জড়িয়ে ধরে আলতো করে কপালে তোমার ভালোবাসা এঁকে দিলে তখন বুকের ভিতর তোমার ছোঁয়া পেয়ে উতালপাতাল শুরু হয়ে গিয়েছিলো।যখন আমি তোমাকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমার নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছিলো তখন তুমি বলেছিলে, জেবা”আমি এইভাবে তোমার ভালোবাসা চাইনা। আমি চাই চাঁদের আলোতে স্পষ্ট ভাবে আমার ভালোবাসাকে নিজের করে নিতে।৩ বছর যখন ধৈর্য্য ধরেছি আর না হয় কয়েকটা ঘন্টা ধরলাম।

তখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো।তুমি যখন আমার ঠোঁটে তোমার ঠোঁট ডুবাতে ছেয়ে ছিলে তখন হঠাৎ মারিয়া এসে পড়ে।তুমি লজ্জায় আমাকে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে চলে গেলে।জানো জিসান” আমারও খুব লজ্জা হয়েছিলো।কথাটা বলেই জেবা জিসানের বুকে নিজেকে আরও গুটিয়ে মুখ লুকিয়ে, আর যাবে নাতো আমাকে একা রেখে?

জানো জিসান তুমি চলে যাওয়া পর আমি আর মারিয়া তোমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলাম।মারিয়া আমাকে বললো ভাবী চলো তোমাকে আমি আমার নিজের হাতে সাজিয়ে দিবো। দেখবে ভাইয়া এসে তোমায় দেখলে চোখ ফিরাতেই পারবেনা।

আমিও মারিয়ার কথায় সায় দিয়ে সুন্দর করে তোমার পছন্দ মতো সেজে নিলাম।মারিয়াও কোথায় সেই সময় চলে গেলো আমায় রেখে।তুমিও আর ফিরে আসলে না জিসান।আজ ৬ মাস পর তুমি আবার ফিরে এলে। কথাটা বলেই জেবা চোখ খুলে উপরে দিকে তাকালো। মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে ধড়পড় করে উঠে বসে কে আপনি?

চলবে,,,,,,