ক্যামেলিয়া পর্ব-০১

0
1

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
#সূচনা_পর্ব (১)

পাত্র হিসেবে সয়ং নিজ ভার্সিটির লেকচারার ধ্রুব আহসানকে দেখে রীতিমতো চমকে উঠলো ইনায়া। ভড়কালো বেশ। নাক বেয়ে ঘাম ছুটে গেলো তার। আড় চোখে তাকালো ধ্রবর দিকে। ধ্রুব বেশ নির্বিকার বসে আছে। তার তিক্ষ্ণ চোখ সামনে বসা মেয়েটার মুখের দিকে। ইনায়া বুঝলো না, ধ্রুব এতো নির্বিকার কেন। সে কি ইনায়াকে চেনে নি? না চিনুক, তারই ভালো। সে যে কি চরম অস্বস্তিতে পড়েছে তা শুধু সেই বুঝছে। ইনায়া বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কিছু বলার বা করার মতোন কোনো পরিবেশ নেই। বিয়ে পাকাপোক্ত হয়েছে আগেই। কাজিও এসে গিয়েছেন। কাগজ-পত্র গোছাচ্ছেন তিনি। কিছু সময়ের মধ্যে বিয়েও পড়ানো শুরু হবে। ইনায়া ভেবে পেলো না কিছু৷ ধ্রুবর বাবা আফতাব সাহেব আর ইনায়ার বাবা রহমান সাহেবের সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো। বন্ধুত্বের সম্পর্ক তাদের বেশ মজবুত। সেই বন্ধনকে আরো মজবুত করতে ছেলে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে তারা বহু আগেই। ইনায়ারও বাঁধা ছিলো না। পাত্র না দেখেও বাবার পছন্দের উপর না করার সাহস পায়নি। উপরন্তু কিছু কারণও আছে মানা না করার। তবে সে কি জানত, পাত্র ধ্রুব হবে? জানত না। জানলে কোনোভাবে হলেও আঁটকে দিতো বিয়েটা। ইনায়া মায়ের দিকে তাকালো। ধ্রুবর মা নাসিমা বেগমের সাথে খোশগল্পে মেতে আছে সুমিতা।

ইনায়া বুঝলো না কি করবে। তখনই কানে এলো কাজির কন্ঠস্বর। বিয়ের খুতবা শুরু হলো। পুরো ঘরে নিস্তব্ধতা। নিকাহনামায় সাক্ষর করতে বলা হলো দুজনকে। ধ্রুব কোনো কথাই বললো না, একদম নিঃশব্দে কলম চালালো। ধ্রুব ধীরস্থির হাতে কলম নামিয়ে রাখলো। কোনো উচ্ছ্বাস নেই, হাসি নেই, এমনকি কোনো ভাবান্তরও নেই তার চোখে-মুখে। একবারও ইনায়ার দিকে তাকালো না সে। ইনায়া কাঁপা হাতে সাক্ষর করলো। সকলের ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ধ্বনি কর্ণধার হতেই সে শ্বাস ফেললো। কি করে কি হলো এখনও যেন বুঝে উঠতে পারছে না সে।

আড় চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালো ইনায়া। ছেলেটা এতোটা নির্লিপ্ত কেন? আজব! সে কি সত্যিই তাকে চিনতে পারেনি? নাকি চিনলেও না চেনার ভান করছে? ইনায়া বুঝলো না। বিরক্ত লাগছে সব কেমন। ত্যক্ত মেজাজে পাশে তার বসা বড়ো বোন ইশিতাকে বললো তাকে ঘরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। ইশিতা ব্যবস্থা করালো বাবাকে বলে।

_____
“বিয়ে করে অনুভূতি কি দুলাভাই?”

ধ্রুব তাকালো তার সামনে বসা ছেলেটার দিকে। ছেলেটার বয়স করতো হবে? ১২-১৩ হয়তো। সে জানে না। ছেলেটা ইনায়া আর ইশিতার ছোট ভাই হয়। তার নাম ইশমাম। ধ্রুব হাসলো হালকা। হাত বাড়িয়ে ইশমামকে ডেকে পাশে বসালো। ইশমাম তার দিকে তাকালো। ধ্রুব তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল—“আমাকে দেখে কি তোমার দুলাভাইয়ের মতো লাগছে?”

ইশমাম বোকা বনে গেলো যেন। হতবুদ্ধি হয়ে তাকালো ধ্রুবর দিকে। তার বোনকে বিয়ে করে জিজ্ঞেস করছে, তাকে তার দুলাভাইয়ের মতোন লাগছে কি না! ছেলেটা কি পাগল? না মাথায় গণ্ডগোল? শেষমেষ বাবা একটা পাগলের সাথে খুঁজে ইনায়া আপাইয়ের বিয়ে দিলো? ভেতরে জন্ম নেওয়া এতো এতো কথা চেপে গেলো ইশমাম। ধ্রুবর কথা হালকা হেসে মাথা ঝাকিয়ে বলল—“আলবাত লাগে!”
“আচ্ছা!”

ধ্রুব হেসে ফেললো। গালের নিচটাও ডেবে গেলো সামান্য।

_____
ইনায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছিল। বাইরে থেকে হাসির শব্দ আসছে, কথা বলার গুঞ্জন। ধ্রুব নিশ্চয়ই এখন ডাইনিংয়ে বসে সবাইকে নিজের স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর অথচ মুগ্ধকর ভঙ্গিতে কথা শোনাচ্ছে।

সে আয়নার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধ্রুব তার স্বামী। কাগজে-কলমে, সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে। কিন্তু তার কাছে? সে কি মানিয়ে নিতে পারবে আদৌ? কে জানে! আপাতত সে ভাবতে চায় না এই নিয়ে। নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়ার দরকার। ইনায়া আয়নার দিকে তাকালো আবার।

হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ হলো। ইনায়া দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দরজা খুললো। ইশিতা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল—“কি ব্যাপার? নতুন বউ খেতে আসবেন না?”

ইনায়া বিরক্ত হলো। জবাব দিলো—“ক্ষুধা নেই আপু।”

ইশিতা বড়ো বোঝদারের মতেন ভান করে বলল—“ওহ, বুঝেছি! নতুন বর পাশে বসে থাকবে, এজন্য আপনি লজ্জা পাচ্ছেন?”

ইনায়া কপাল চাপড়ালো। এই মেয়ে সবসময় দু’লাইন বেশি বুঝবেই! সে চোখ উল্টে বিরক্ত গলায় বললো—“আপু!”
“আচ্ছা, আচ্ছা। মা ডেকেছে, যেতেই হবে।”

ইনায়া বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে বললো—“চাইছি না যেতে।”
“শরীর খারাপ লাগছে?”
“কিছুটা।”

ইশিতা চিন্তিত মুখে তাকালো। বলল—“নিচে সবাই আছে। না যাওয়াটাও খারাপ লাগছে। একটু খেয়ে চলে আসিস। প্লিজ সোনা।”

ইনায়া উঠে বসলো এবার। শাড়ি বদলে থ্রি পিস পরেছে সে। সেটা ঠিকঠাক করে, ওরনাটা মাথায় ঘোমটার মতোন করে দিয়ে নিচে নামলো। পিছু পিছু ইশিতাও এলো।

ডাইনিংয়ে পৌঁছাতেই সকলের চোখ ঘুরে গেল ইনায়ার দিকে। নতুন বউ, সেটাও একদিকে বিষয় বটে। তাছাড়া ইনায়া এমনিতে একটু চুপচাপ স্বভাবের, সবার সামনে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়। ইনায়া ধ্রুবর দিকেও চাইল একবার। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খেতে ব্যস্ত। যেন এখানে তার বিয়ে-শাদির কিছুই হয়নি, সে বরাবরের মতোই ধীরস্থির, শান্ত!

ইনায়া এগিয়ে টেবিলের দিকে এলে সুমিত বেগম তাকে ধ্রুবর পাশে বসালেন। শত অস্বস্তি নিয়ে সে বসলো চুপচাপ। মাথা নুইয়ে প্লেট সামনে চুপচাপ বসে ছিলো ইনায়া। তখন খেয়াল করলো কেউ তার পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। হাতটা একটি পুরুষ হাত। ইনায়া সেই হাতের মালিকের খোঁজে তাকালো। ধ্রুব! সে তার পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ইনায়া অবাক হলো কিছুটা। নাসিমা বেগম ইনায়ার পাতে গরুর মাংস দিতে গেলে ধ্রুব আচানক বাঁধা দিয়ে বলল—“দিয়ো না। ইনায়ার এলার্জি আছে বিফে।”

এবার ইনায়া কেন, উপস্থিত সকলে চমকালো শুধু আফতাব সাহেব আর নাসিমা বেগম ছাড়া। নাসিমা নিজের জায়গায় বসে পড়লেন চুপচাপ। মৃদু হাসলেন। এই বিষয় নিয়ে আর কথা উঠল না। তবে ইনায়া ওড়ে রইলো অস্বস্তি আর বিস্ময়ের মধ্যে। ধ্রুব কি করে এই ব্যাপারে জানলো? তার এলার্জির ব্যাপারে তার ফ্যামিলি বাদে কেউই তেমন জানে না। তবে ধ্রুব কি করে? তার চিন্তিত মুখের দিকে ধ্রুবর নজর গেলো। সে আলগোছে হাসলো ক্ষীণ—“বোকা ফুল!”
#চলবে…