ক্যামেলিয়া পর্ব-১৩

0
16

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৩] {প্রথম অংশ}

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

রাতের নিকোষ আঁধারের মাঝে তীব্র গতিতে ছুঁটে চলছে কালো রাঙা মার্সিডিজটি। ধ্রুব কোনোমতে মাথা ঠান্ডা রেখে গাড়ি চালাচ্ছে৷ বুকটা কাঁপছে সমানে। বোধহয় এখনই মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে তার হৃদপিণ্ডটা। ইনায়াকে শত খুঁজেও না পেয়ে যখন বেচারার প্রাণ যায় যায় অবস্থা, তখন বন্ধুরা তাকে সামলায়। ইনায়া যে কিডন্যাপড্ হয়েছে তা বুঝতে আর বাকি রয় না। নয়তো দিনে দুপুরে এমন জলজ্যান্ত একটা মেয়ে মানুষ কোথায় হাওয়া হয়ে যাবে? ধ্রুবর মনে পড়ে সেদিনকার ভার্সিটির ঘটনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ইনায়া আর আরাফকে দেখেছিলো কথা কাটাকাটি করতে। সেদিনই ছেলেটার সমস্ত খবরা-খবর নিতে শুরু করে সে। ফোন নাম্বারও জোগাড় করে ফেলে। তা-ই এখন বন্ধুদের দিয়ে ট্রেস করিয়েছে। ইনায়া নিখোঁজ হওয়ার পর ধ্রুবর সন্দেহের বেশির ভাগই গিয়ে পড়েছে আরাফের উপর। ভাগ্যবশত লোকেশনটাও পেয়ে যায়। কিছুটা নির্জন জায়গাতেই অবশ্য। সেখানেই আপাতত যাচ্ছে ধ্রুব। গাড়িতে মাহিনও আছে তার সাথে। ধ্রুবর পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে তাকে একা ছাড়ার মতো দুঃসাহস বন্ধুরা করতে পারেনি। সবাই একসাথে যেতে চাইলে ধ্রুবর ধমকা-ধমকি শুনে তাই মাহিনকেই সাথে পাঠায়। ছেলেটা বুদ্ধিমান। যেকোনো বিপদে মাথা খাঁটিয়ে সাহায্য করতে পারবে। ধ্রুব গাড়ির স্পিড বাড়ালো। গতির অবস্থা দেখে মাহিন তাকালো ধ্রুবর দিকে। রাগে না কিসে সে জানে না, ধ্রুবর কান- নাক লাল হয়ে আছে। শ্যাম মুখে গাম্ভীর্যতা। হাস্যজ্জ্বল ছেলেটার হুট করে এমন রূপে মাহিন অবাক হলো খুব। ধ্রুবকে একপ্রকার স্বান্তনা দিতেই বলল—“ভাই, চিন্তা করিস না। ভাবির কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা যাচ্ছি তো। পুলিশরাও যাচ্ছে।”

মাহিন পেছনে তাকালো। পুলিশের দুটো গাড়ি আসছে তাদপর পিছু। মাহিন আসার আগে তাদের ফোন করেই এসেছে। মাহিনের কথায় ধ্রুব তাকায় তার দিকে। পরক্ষণেই সামনে তাকিয়েই ক্ষিপ্ত গলায় বলল—“আমার বউকে পাচ্ছি না, আর তুই বলিস চিন্তা করিস না? ভাই, ওর খেয়াল রাখার, সেইফটির সবকিছুর দায়িত্ব আমার। ওর ফ্যামিলিতে আমি কি বলব ভাব একবার।”

মাহিন কথার পিঠে কি বলবে খুঁজে পেলো না। তখনই সজোরে ব্রেক কষলো ধ্রুব। মাহিন ঝুঁকে পড়লো সামনে। সিটবেল্ট থাকায় সমস্যা হলো না। পাশে তাকিয়ে দেখলো ধ্রুব তস্ত্র পায়ে গাড়ি থেকে নামছে। মাহিন ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকায়। অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় হলো। ঝটপট সে নিজেও গাড়ি থেকে নামল।

_______
জনমানবহীন রাস্তায় ইনায়া দৌঁড়াচ্ছে। প্রচন্ড অন্ধকারে আশেপাশে কেউ নেই। কোনোমতে জান বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যে একটা গাড়ির আলো চোখে পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো সে। গাড়িটা চেনা তার। আরেকটু কাছে এলেই হাত নাড়ালো সে। গাড়িটা থামলো। ভেতর থেকে ধ্রুব বেরিয়ে এলো। ইনায়াকে দেখা মাত্র ছুঁটে এলো তার কাছে। ইনায়া ধ্রুবকে দেখে রাগলেও তা চেপে গেলো। বিধ্বস্ত ইনায়াকে দেখেই ধ্রুব জড়িয়ে ধরলো তাকে আচমকা। মুখে চুলে শতাধিক চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরেই বিরবির করে বলল—“ইনায়া, আ’ম স্যরি সোনা। আ’ম স্যরি!”

ইনায়া চমকালো আকস্মিক জড়িয়ে ধরায়। ধ্রুব ছাড়লো তাকে। পুলিশদের লোকেশন বলে ইনায়াকে গাড়িতে বসালো। মাহিনকে ড্রাইভ করতে বলে নিজে ইনায়ার পাশে বসলো। ইনায়া কথা বললো না তেমন। চুপচাপ বসে রইলো। ধ্রুব পানির বোতল এগিয়ে দিলো তার দিকে। ইনায়া এক পলক চাইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর পানির বোতলটা নিলো নিজের হাতে। কিছুটা পানি খেয়ে পাশের গাড়ির জানালা থেকে মুখ বের করে মুখে পানি ছেটালো। ভেতরে এসে বসতেই ধ্রুব টিস্যু্ এগিয়ে দিলো তাকে। ইনায়া চোখ মুখ মুছে টিস্যুটা বাইরে ফেললো। ধ্রুব কিছু জিজ্ঞেস করলো না তাকে। ইনায়া মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। ক্লান্ত লাগছে খুব। চোখের সামনে ভাসছে তখনের ঘটনা।
°
°
°
°
আরাফ তাকে ছোঁয়া মাত্রই পাশে টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি দিয়ে সোজা আরাফের মাথায় মারে ইনায়া। আকস্মিক এমন ঘটনায় আরাফ হতভম্ব। মাথায় চিনচিনে ব্যথা টের পেতেই চেঁচিয়ে উঠলো। ইনায়াকে ছেড়ে মাথা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে ছাড়তেই ইনায়া দৌড়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই আরাফাত আবারও চেঁচিয়ে উঠলো—“প—পলাশ! ধর ওরে!”

আরাফের চিৎকারে তারা ছুটে এলো। ততক্ষণে ইনায়া দৌড়ে বাড়ির গেটের কাছে এসেছে। পলাশসহ তার কিছু ছেলেরা তার পিছু দৌড়ে গেলো। গেটে তালা লাগানো থাকায় সেখানেই থেমে গেলো ইনায়া। নিজেকে বাঁচানোর সব আশা যেন খুইয়ে বসলো। পিছু ফিরে দেখলো পলাশরা ততক্ষণে এসে গেছে তার কাছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ইনায়ার। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ যেন কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। থেমে যাওয়া মানেই ধরা পড়ে যাওয়া, ধরা পড়ে যাওয়া মানেই… শেষ! কিন্তু আর দৌড়ানোর উপায় নেই। তালাবদ্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দিশেহারা হয়ে যায় সে। চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া। পলাশ ও তার দলবল দ্রুত এগিয়ে আসছে। ইনায়া দিক-বেদিক হারিয়ে কি করবে বুঝতে না পারলে তখন পলাশ এসে তার সামনে দাঁড়ালো। ইনায়া ভীত হলো। তটস্থ হয়ে চাইলো। অনুনয় করে বলল—“ভাইয়া, প্লিজ আমাকে যেতে দেন।”

পলাশ বলল—“আপু, ভয় পাবেন না। আমি তালা খুলে দিচ্ছি আপনি বেরিয়ে যান।”

ইনায়া অবাক হলো প্রচন্ড। ফ্যালফ্যাল করে তাকালে পলাশ বলল—“আমার বোন আছে আপু। আপনার জায়গায় সে হলে আমি ভাইয়ের এসব কাজে সায় দিতাম না। আপনার বেলায় কেন দিবো? আপনি আমার বোন না হন, বোনের মতো তো। ভাইয়ের সব কাজে সাথে থাকলেও, এসবে আমি সায় দিতে পারবো না আপু। আপনি যান প্লিজ৷ দেরি করবেন না।”

বলে সে তালা খুলে দিলো গেটের। ইনায়া কৃতজ্ঞ চোখে চাইলো—“ধন্যবাদ।”

বলে গেটের থেকে বেরিয়ে ছুটলো প্রাণপণে।

______
ইনায়া নিজের বাসায় এসে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। সুমিতা আর রহমান সাহেব ড্রইংরুমেই বসে ছিলেন। মেয়েকে ওভাবে চলে যেতে দেখে চমকালেন। আরে বেশি চমকালেন মেয়ের গায়ে শাড়ি দেখে। সে তো শার্ট-প্যান্টে গিয়েছিলো, তাহলে এভাবে শাড়ি পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়ে বাড়ি এলো কেন? সুমিতা ইনায়ার পিছু ছুটলেন৷ ধ্রুবকে দেখে রহমান সাহেব তাকে ডাকলেন। সে কাছে এসে দাঁড়াতেই রহমান জিজ্ঞেস করলেন—“কিছু হয়েছে?”

ধ্রুব লুকালো না। বলল সবটা। ধ্রুবর মুখে সমস্ত কথা শুনে রহমান সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মুখের মধ্যে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু চোখদুটো লাল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ধ্রুব তার দৃষ্টিতে গিলে যাচ্ছিলো যেন। হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে রহমান সাহেব বললেন—“ইনায়াকে সময় দাও ধ্রুব।”
“জ্বি।”

ছেলেটার গলা কাঁপলো। সে রহমানের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল—“আপনি রেগে আছেন আমার উপর আব্বু?”

রহমান হাসলেন—“রাগার মতোন কিছু করেছো কি তুমি?”
“আমার কাছে আমি নির্দোষ নই।”
“কেন?”
“ইনায়াকে ফুল সেইফটি দেওয়া আমার দায়িত্ব। সেটা আমি ঠিক করে ফুলফিল করতে পারিনি। তারপরেও নিজেকে নির্দোষ কি করে বলি!”

রহমান সাহেব নিজের পাশের সোফায় ইশারা করে ধ্রুবকে বললেন—“বসো।”

ধ্রুব একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখলো। তারপর বসলো। রহমান তার দিকে তাকিয়ে বললেন—“ধ্রুব। যদি ইনায়ার জন্য কিছু করো, মন থেকে করো। ভালোবেসে করো। দায়িত্ব-কর্তব্যের খাতিরে এসব করলে সম্পর্কটা দায়িত্বের উপরই থেকে যাবে। তুমি বুঝছো তো আমি কেন এগুলো বলছি?”

ধ্রুব মাথা দোলালো উপর-নিচ। রহমান সাহেব বললেন—“ইনায়াকে সময় দাও। ওর সাথে থাকো। সব ঠিক হবে ইনশাল্লাহ।”
“ইন-শাল্লাহ!”

#চলবে…

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৩] {শেষ অংশ}

{📌পর্ব ডিলিট হওয়ায় নতুন করে আপলোড করা হলো}

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

ইনায়ার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ধ্রুব ভেতরে ঢুকলো। সুমিতা বেগম শব্দ পেয়ে তাকালেন সেদিকে। ধ্রুবকে একবার দেখে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে রেখে যেতে মন না চাইলেও উঠে দাঁড়ালেন বিছানা ছেড়ে। দরজার কাছে গিয়ে ধ্রুবর সামনে গিয়ে থামলেন। নরম কন্ঠে বললেন—“ওকে একটু সামলাও বাবা। মেয়েটার অবস্থা ভালো না। আমি চা করে আনি তোমাদের জন্য। খেলে ভালো লাগবে।”

ধ্রুব মাথা দোলালো—“জ্বি।”

সুমিতা মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। ধ্রুব সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো। ঘরের ভেতরে এসে দরজা চাপিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ইনায়ার কাছে। ইনায়া বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। পরনে সেলোয়ার-কামিজ। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে। ফ্রেশ হয়েছে হয়তো। মেয়েটার ফ্যাকাসে মুখ দেখে মায়া হলো৷ সে এগিয়ে গিয়ে বলো মেয়েটার পাশে। মাথায় হাত রাখতেই ইনায়া চমকে উঠলো। ছিটকে দূরে সরে গেলো। তার এমন ছিটকে সরায় বিহ্বল হয়ে তাকালো ধ্রুব। ইনায়া দূরে বসেই তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। আচমকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইনায়াকে কাঁদতে দেখে ধ্রুব অস্থির হলো। প্রচন্ড অসহায় বোধ করলো সে। ইনায়ার মতোন একজন মেয়েকে এভাবে সে কাঁদতে দেখবে কল্পনাও করেনি। ধ্রুব অসহায় অনুভব করলো। এগিয়ে গিয়ে ইনায়ার হাত ধরে তাকে শান্ত করতে চাইলো। ইনায়া ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে। ক্রন্দনরত ক্ষিপ্ত গলায় বলল—“আপনারা ছেলেরা এমন কেন? সবসময় ছুঁতে চান কেন?”

ধ্রুব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ইনায়ার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলল—“ই-না-য়া!”

ইনায়ার চোখ যেন আগুন হয়ে জ্বলছে। কান্নার সাথে মিশে আছে রাগ, ঘৃণা আর অসহায়তা। ধ্রুব যেন শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। ধ্রুব বুঝলো মেয়েটার সিচুয়েশন। এমন পরিস্থিতি সে ফেস করেছে যা ট্রমাটিক। ধ্রুব কি বলবে, করবে বুঝে পেলো না। সে এগিয়ে বসলো। নরম গলায় বললো—“প্লিজ কেঁদো না। আ’ম স্যরি, সোনা।”

ইনায়া তাকিয়ে রইলো—“স্যরি ফর হোয়াট ধ্রুব? আমাকে রেসের নাম করে ওখানে নিয়ে যাওয়া, নাকি আরাফের কাছে আমাকে দিয়ে আসা? আপনি সব জানতেন না? আপনার সাথে আরাফের কনট্যাক্ট আছে? ধ্রুব কথা বলেন!”

ধ্রুব স্তম্ভিত। বাকরুদ্ধ। ইনায়া কিসের সাথে কি মেলাচ্ছে? সে কেন আরাফের সাথে যোগাযোগ রাখবে? ও কোনোমতে নিজেকে সামলায়। তারপর ইনায়ার হাত ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল—“এমন কিচ্ছু না ইনায়া। আমার কথা শোনো—”

ইনায়া ঝটকায় হাত সরালো। আঙুল তুলে হিঁসহিঁসিয়ে ক্ষোভ জারি করলো—“ডু নট টাচ মি! আই ওয়ার্ন ইউ।”

ধ্রুবর হাত থেমে রইলো। গলার কাছটা শুকিয়ে এলো। ইনায়ার ভাঙা গলার স্বরে সে যেন স্থবির হয়ে গেলো। মুখ তুলে চেয়ে দেখলো মেয়েটার চোখে শুধু ঘৃণা নয়, একটা ভয়ও কাজ করছে। এমন ভয়, যেন সে নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে পারছে না এখন।

ধ্রুব ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেলো। কাতর গলায় বলল—“আমি ছুঁবো না তোমায়। বাট ট্রাস্ট মি ইনায়া, তুমি যা ভাবছো তা সত্যি না। আমি আরাফের সাথে কেন যোগাযোগ রাখব? ওকে আমি চিনিও না তেমন। হয় ও তোমায় মিথ্যা বলেছে, নয়তো তুমি নিজ থেকে ভুল বুঝছো।”
“আপনি প্লিজ যান ধ্রুব। আমায় একা থাকতে দিন। সময় মতো আমি ঠিক হয়ে যাবো। প্লিজ!”

ধ্রুব কিছু বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মেয়েটার মুখের দিকে। কতো ব্যথা! কতো ব্যথা! ইনায়া অনুনয় করলো—“প্লি-ই-জ!”

ধ্রুব এগিয়ে বসলো। ইনায়াকে জড়িয়ে ধরলো আচমকা। শক্ত করে। ইনায়া রেগে গেলো। ছটফটিয়ে উঠলো। ছাঁড়াতে চাইলেও পারলো না। ধ্রুব হাতের জোড় বাড়ালো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। এক পর্যায়ে ইনায়ার ছটফটানি কমলো। শান্ত হলো। ধ্রুব বিড়বিড় করে বলল—“তোমাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না। এটলিস্ট এই অবস্থায় না। কাঁদতে চাইলে কাঁদো। ইটস্ ওকে।”

ইনায়া সত্যিই কেঁদে ফেললো। ধ্রুবর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো। ইনায়ার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো ঘরের বাতাস। ধ্রুব নিশ্চুপ, শুধু বুকের গভীরে সেই কান্নার শব্দ গিলে নিচ্ছে যেন। এক হাতে মেয়েটাকে আগলে রেখেছে, অন্য হাত দিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর ইনায়া চুপ করলো। ধ্রুব চুপ। প্রকৃতি চুপ। সময় চুপ। ধ্রুব নিরবতার ভগ্ন ঘটালো—“আমায় কিছু বলতে হবে না। জাস্ট এটা বলো, ও তোমায় ছুঁয়েছে?”

ইনায়া থমকালো। সেভাবেই থেকে থেমে থেমে বলল—“আমি নিজেকে বাঁচিয়েছি ধ্রুব।”

ধ্রুব শ্বাস ফেললো। ইনায়ার কপালে চুমু খেলো। ইনায়া মুখ তুলে চাইলো। চোখ মুছে তাকালো ধ্রুবর দিকে। জিজ্ঞেস করল—“আমায় ভালোবাসেন?”
“তোমার কি মনে হয়?”

ইনায়া প্রশ্নের জবাব দিলো না। বরং নিজে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো—“আজ যদি আমার রেপ হতো, আপনি কি আমাকে আগের মতোন ভালোবাসতেন ধ্রুব?”

ধ্রুব দু’হাতে ইনায়ার মুখ আগলে ধরলো। ক্ষীণ স্বরে প্রত্যুত্তর করলো—“যদি তুমি ভাবো, তোমার শরীরের জন্য আমি তোমায় ভালোবাসি তাহলে ভুল৷ ইনায়া ভালোবাসা বলো বা প্রেম, কোনোটাই শরীরের তাড়নায় আসে না। আজ যদি এমন কিছু হতো-ও, না আমি তোমায় ছাড়তাম; আর না আমার ভালোবাসা কমতো। আমি শেষ পর্যন্ত তোমার পাশে, কাছে থাকতাম।”

ইনায়া ফ্যাকাসে হাসলো—“অথচ কেউ শেষ অবধি থাকেই না।”
“আমি থাকতাম।”

ইনায়া হালকা হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস করল—“প্রেম আর ভালোবাসা কি একই?”
“মোটেও না। প্রেমকে বলতে পারো কিশোরের আবেগ, যুবকের প্রথম অনুভূতি।”
“আর ভালোবাসা?”
“ভালোবাসা মানে প্রতিশ্রুতি। তার খারাপটুকুকে সাদরে, নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করে নেওয়া। তাকে ভালোবাসা। তার কষ্টের সঙ্গী হওয়া। তার সমস্ত ভুলকে ফুল ভেবে ক্ষমা করে দেওয়া। তার সামান্য যন্ত্রণায়ও ছটফট করা। ভালোবাসা সমুদ্রের মতো গভীর, অতল। যা জলতরঙ্গের মতো ঢেউ তোলে বুকে।”

ইনায়া তাকালো ছেলেটার চোখে। জিজ্ঞেস করল—“আমি কি আপনাকে ভালোবাসি?”
“বাসো।”
“কি করে বললেন?”
“তোমার চোখ।”
“লেখা?”

ধ্রুব হেসে ফেললো—“না ম্যাডাম! আমি মনোবিজ্ঞানী। আপনার মনের কথা ধরে ফেলেছি।”

ইনায়া তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর চোখে। তারপর ঠোঁটে। ধ্রুবর হাসি থামলো। মেয়েটার দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকালো সেও। ইনায়া ধ্রুবর গাল ধরলো একহাতে। ধ্রুব তাকিয়ে দেখলো। ইনায়া আচমকা দূরত্ব ঘুঁচালো। ছেলেটার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। চুমু খেয়েই সরে আসতে নিলেই ধ্রুব বাঁধ সাঁধলো। ঘাড় চেপে ধরলো স্ব বেগে। ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। ইনায়া চোখ বুঁজে নিলো। অনুভব করলো প্রতিটা স্পর্শ। একপর্যায়ে মেয়েটা হাঁপিয়ে ওঠে। ধ্রুবর বুকে হাত ঠেলে তাকে সরাতে চায়। ধ্রুব থামলো। মাথা তুলে মেয়েটার মুখ দেখলো। ইনায়া জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ক’সেকেন্ডের মাথায় ধ্রুব পুনরায় ওষ্ঠাগত হলো। ইনায়া চমকে গেলো এবার। চোখ বড় বড় করে চাইলো। পরক্ষণেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। দু আঙুলে খাঁমচে ধরলো ধ্রুবর পরনের সাদা শার্টটা। তারপর দীর্ঘ সময়ের আশ্লেষের চুম্বন শেষে ইনায়া যখন হাঁপিয়ে উঠল, ধ্রুব গলা ও কাঁধে ছোট ছোট চুমুতে ইনায়ার অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে লাগল। ইনায়ার হাত উঠে এলো ধ্রুবর চুলে, মুঠো করে খাঁমচে ফেলল। কোথাও থেকে ভেসে আসছে ক’লাইন গান৷ যা ঝংকার তুললো ইনায়ার কানে। প্রশান্তিময় ঢেউ তুললো বুকে—

❝যদি আকাশের গানে কান না পাতি,
তোমার কথা শুনতে পাব না।
যদি বাতাসকে আমি, ছুঁয়ে না দেখি;
তোমার শরীর স্পর্শ পাব না…❞

#চলবে….