ক্যামেলিয়া পর্ব-১৫

0
15

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৫] {শাস্তি…}

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

ঘরে এসে ইনায়াকে নামিয়ে দিতেই মেয়েটা ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলো। তবে যাওয়ার আগেই ধ্রুব আটকে ফেললো তাকে। ডান হাতে কোমড় জড়িয়ে পাশে থাকা স্টাডি টেবিলের উপর থেকে সবকিছু নিচে ফেলে ইনায়াকে শুন্যে তুলে সেখানে বসালো। ঝুঁকে এসে নিজের দু’হাত মেয়েটার দু’পাশে রাখল। ইনায়া গুঁটিয়ে গেলো। নিজের অপ্রস্তুত ভাব ঢাকতে রাগী গলায় বলল—“কি করছেন? এভাবে নিয়ে এলেন কেন?”

ধ্রুব তার কথা গায়েও মাখলো না। পিছলে যেতে দিলো। নিজে জিজ্ঞেস করল—“তখন হাসছিলে কেন? মা কি দেখাচ্ছিলো তোমায়?”

ইনায়া থতমত খেলো সোজাসাপটা প্রশ্নে। বলল—“ক-কই? কখন হাসছিলাম?”

ধ্রুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিঃশব্দে হেসে ফেললো। ইনায়া তাকালো তার দিকে। ছেলেটাকে হাসতে দেখে তাকিয়ে রইলো। মারাত্মক রকম না হলেও ছেলেটার হাসি সুন্দর। স্নিগ্ধ খুব! ইনায়াকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো খানিকটা। ইনায়া চোখ তুলে চাইলো। ধ্রুব ভ্রু নাচালো। ইশারায় জিজ্ঞেস করল—“কি হয়েছে?”

ইনায়া দু’পাশে মাথা নাড়ায়। বোঝায় কিছু হয়নি। ইনায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসফাস করে উঠলো। বলল—“এতো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন কেন?”

ধ্রুব ফটাফট জবাব দিলো—“আদর করবো বলে।”

ইনায়া মাথা তুলে তাকালো ত্বরিতে। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে মুখ হাতে চেপে অস্পষ্ট স্বরে বলে বসলো—“আসতাগফিরুল্লাহ!”

ধ্রুব তাজ্জব বনে গেলো—“আসতাগফিরুল্লাহ? এখানে আসতাগফিরুল্লাহর কি হলো?”
“আপনি যেমন নির্লজ্জের মতো কথা-বার্তা, ইভেন কাজকর্মও করছেন; তাতে আর কি বলবো?”

ধ্রুব কাছে এসে দাঁড়ালো আরেকটু। ফিচেল হেসে বলল—“অপবাদ যখন দিয়েছোই, তাহলে সেই অনুযায়ী কাজও করে ফেলি? তাহলে না তোমার অপবাদ খাটবে!”

ইনায়া কিছু না বুঝে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ধ্রুব এবার আর সাবধান বাণী দিলো না। অতর্কিতভাবে হামলে পড়লো মেয়েটার ঠোঁটে। ইনায়া চোখ বড়বড় করে চাইলো। ধ্রুবর সেদিকে খেয়াল নেই। ধ্যান নেই। একেরপর এক ওষ্ঠাঘাতে সে পিষ্ট করলো মেয়েটার নরম তুলতুলে ঠোঁট। ইনায়া চোখ খিঁচে নিলো। খামচে ধরলো ধ্রুবর বাহু। একপর্যায়ে ছটফটিয়ে উঠে সরে যেতে চাইলে শুনতে পেলো ছেলেটার কাতর স্বর—“জান প্লিজ!”

ইনায়া লজ্জায় হতবিহ্বল। বাকহারা! তখনই পাশে থাকা ধ্রুবর ফোন বেজে উঠলো স্বশব্দে।ধ্রুব চোখ কুঁচকে নিলো। মেজাজ খিঁচড়ে গেল চরমভাবে৷ ইনায়া ততক্ষণে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একপলক ধ্রুবর দিকে চেয়ে বাইরে ছুটে গেলো। ধ্রুবর সামনে এখন আর থাকলে ও বেচারি লজ্জায়, অস্বস্তিতে আজই ভূমিষ্ট ত্যাগ করবে!

ইনায়া যেতেই ধ্রুব কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে লোকটা সালাম দিলো তাকে। ধ্রুব গলা ঝেড়ে সালামের জবাব দিয়ে বলল—“বলো।”
“ভাই, আপনি ওই ছেলেকে আনতে বলছিলেন না? আনছি। আপনি আসবেন কখন ভাই?”

মুহুর্তেই মুখের আদলে পরিবর্তন ঘটলো। স্বর হলো অত্যন্ত গম্ভীর—“আমি আসছি এখন। তার আগে ওর খাতিরযত্ন করো।”

ওপাশে রেজা নামে ছেলেটা খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠলো—“আইচ্ছা ভাই।”

_____
চোখ বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে আরাফ। অবস্থা তার করুণ। মুখ থেকে রক্ত পড়ছে। চোয়ালে কালশিটে দাগ বসে গেছে। চোখে একপাশ ফুলে আছে। এতক্ষণ বেধড়ক মারধরের ফলাফল এসব। পুলিশ স্ট্যাশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে কতগুলো লোক তুলে এনেছে তাকে। তারপর এভাবে আটকে রেখে বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে মারধর শুরু করলো। একপর্যায়ে থেমে গিয়ে তাকে এভাবেই ফেলে চলে গেছে।

কারোর পায়ের আওয়াজে ভাবনাচ্যুত হলো আরাফ। ছটফটিয়ে উঠলো। হাত-পা ছুঁড়তে চাইলেও পারলো না। আচমকা কেউ তাকে তুলে ঠিক করে বসালো। চোখে বাঁধা কালো কাপড় খুলে দিলো। চোখ খুলতেই সামনের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে উঠলো আরাফ। বিস্ময়ে স্তব্ধ সে৷ ধ্রুব! আরাফ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। সমস্ত শরীর তার কাঁপছে। ধ্রুব আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখে স্থিরতা, ঠোঁটে নির্মম এক হাসি।

“অ-আপনি?”—কাঁপা গলায় বলল আরাফ।

ধ্রুব মৃদু হাসল—“হ্যাঁ, আমি। অবাক হলে? অবশ্য না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। তারপর বলো, কেমন আছো?”

আরাফ তেঁতে উঠলো—“আটকে রেখেছেন কেন আমাকে? ছাড়ুন!”

ধ্রুব হেসে উঠলো। আরাফ ভড়কে গেলো। আশে পাশে চাইলো। খানিকটা অন্ধকার ঘরটা। তবুও আলো আসছে উঁচু জানালা থেকে। পাশের দুটো টেবিল জুড়ে বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র। দেয়ালে কায়দা করে বন্দুক ঝোলানো। সে ভয়ার্ত ঢোক গিললো৷ ধ্রুব চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশে থাকা টেবিলের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। একটা একটা ছুরি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। আরাফ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল—“আপনি নিজেই আমাকে জেলে পাঠিয়েছেন, আবার নিজেই সেখান থেকে ছাড়িয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। কেন?”

ধ্রুব কিছু বলল না। চুপচাপ এগিয়ে এসে দূর্বল শরীরে পড়ে থাকা আরাফের সামনে বসলো হাঁটু মুড়ে। আরাফ মুখ তুলে চাইলো। চোখে এক আকাশসম ভীতি। ধ্রুব তার হাতের দড়ি খুলতে লাগলো। কামরুল, রেজাসহ মাহিন, রাহাত রাফি সবাই দরজার কাছে দাড়ানো। মাহিন দলের মধ্যে বুদ্ধিমান হলেও ভীতুও। এরপর কি কি হবে তা তার জানা। সব ভেবেই তার রীতিমতো হাঁটু কাঁপছে। ইনায়ার বেলায় ধ্রুব কতোটা পজেসিভ তা শুধু তারাই জানে। তার কাঁপাকাঁপি দেখে পাশ থেকে রাহাত চাপা গলায় ধমক দিলো ওকে—“সমস্যা কি তোর? চুপচাপ দাঁড়া!”

মাহিন কিছু বলতে নিলে রাফি বলল—“চুপ কর শালা! এটুকুতেই কাঁপাকাঁপি করলে এরপর তো অ্যাটাক-ফ্যাটাক করবি।”

মাহিন মুখ কুঁচকে নিলো৷ কামরুল পাশ থেকে বলল—“আজকে এডাও শ্যাষ এক্কেরে! ভাইয়ের হাবভাব সুবিধার না। যেকোনো টাইমে কোপ বসাবে নে।”

ওদের ফিসফিসানি থামলো। ধ্রুব আরাফের হাতের দড়ি খুলে তাকালো তার হাতের দিকে। মুচকি হাসলো—“কতো সুন্দর তোমার হাত আরাফ! আচ্ছা, কোন হাতে ওকে ছুঁয়েছিলে বলো তো?”

বলে ডান হাতটা টেনে ধরলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—“এই হাতে?”

আরাফ কিছু বলতে পারলো না। গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। ধ্রুব হাতের চাকুটা চেপে ধরলো আরাফের ডান হাতের তালু বরাবর। আরাফ চেঁচিয়ে উঠলো। চাকু ডেবে যাওয়ার রক্ত বেয়ে পড়ছে। ধ্রুব হাসলো। মজা লাগছে তার। একটা আত্মিক শান্তি পাচ্ছে খুব৷ সে ফিসফিস করে জিজ্ঞস করলো—“কেটে দেই হাতটা?”

“না! না প্লিজ!”—আরাফ চিৎকার করে উঠলো। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, শরীর তার কাঁপছে থরথর করে।

ধ্রুব থেমে গেল। উঠে দাঁড়ালো। চাকু হাতেই সরে এসে দাঁড়ালো দূরে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাইলো কি কি করেছে আরাফ ইনায়ার সাথে। নিজমনে ভেবেই রাগ তড়তড়িয়ে বেড়ে গেলো। গা যেন জ্বলে যাচ্ছে। রক্ত যেন টগবগিয়ে উঠলো। পিছনে ঘুরে শ্বাস ফেললো।

“ভাই, ছ-ছেড়ে দিন। প্লি-প্লিজ! আ-আমি আর জীবনেও ইনায়ার আশেপাশেও আসবো না। প্রমি—”

আরাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধ্রুব পিছনে ঘুরে আরাফের ঘাড় চেপে চাকু উঁচিয়ে পরপর লাগাতার আরাফের চোখে আঘাত করতে লাগলো। একেরপর এক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করলো তার চোখ। আরাফ জ্ঞান হারিয়েছে ততক্ষণে। ধ্রুব চোখ থেকে চাকু বের করে পাশে ফেলে রাখা কুড়াল হাতে নিলো। দুহাতে কুড়াল তুলে আরাফের কপাল বরাবর কোপ বসালো। এক, দুই, তিন! তিন তিনটে লাগাতার কোপ বসিয়ে হাত নামালো ধ্রুব। রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। আরাফের নিস্তেজ শরীর মাটিতে পড়ে আছে। চোখ রক্তাক্ত হয়ে আছে। মগজের প্যাঁচানো অংশ আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ধ্রুবর গায়ের সাদা শার্ট রক্তে মেখে আছে। তার হুশ নেই সেদিকে। ও আরো কয়েকবার কোপ বসালো আরাফের হাতে, বুকে, পায়ে। এইপর্যায়ে রাহাত ছুটে এসে ওকে সরাতে চাইলো। সবকিছু চোখের পলকে ঘটেছে। কিছু করারও সুযোগ পায়নি তারা।

কামরুল, রাফি সবাই হতবাক। কারো মুখে শব্দ নেই। কামরুলের গলা শুকিয়ে গিয়েছে। মাহিন ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বমি করছে। মাথা ঘুরছে তার।

কামরুল আরাফের শরীরের টুকরোগুলোকে একটা বস্তায় ভরলো৷ রেজার সাথে তা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। নদীতে গিয়ে ফেলে আসবে এসব। তারপর সব প্রমাণ সরাতে হবে।

ধ্রুবকে সরিয়ে আনলে সে শান্ত হয়ে বসে রইলো এক কোণায়। শার্টসহ জামাকাপড় রক্তে ভিজে চুপচুপে। মুখে, গলায়ও রক্ত ছিটিয়ে লেগে আছে। সে আয়েশ করে পা ছিটিয়ে বসলো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে চেপে আগুন জ্বালালো তাতে। সরিয়ে এনে ধোঁয়া ছাড়লো। সিগারেট সে সাধারণত খায় না। ক’মাস হলো ধরেছে। প্রচুর বাজে ভাবে নেশা চেপে বসেছে এ’কদিনে! রাফি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল—“ভাই, এ-এটা কি করলি? এ-এভাবে কি করে মারলি?”

ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো। রাহাতের গা ছমছম করে উঠলো। কতো ভয়ানক লাগছে তাকে! ধ্রুবর চোখেমুখে বিন্দুমাত্রও অনুশোচনাবোধ নেই। আছে এক ঝাঁক শান্তি। সে রক্তাক্ত মুখে হেসে বলল—“আমার প্রিন্সেসের দিকে কেউ তাকিয়েছে, ছুঁতে চেয়েছে; আর তাকে আমি জ্যান্ত ছেড়ে দিবো? হাউ কুড ইউ ইভেন থিংক দ্যাট?”

#চলবে….