ক্যামেলিয়া পর্ব-১৭

0
14

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৭]

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

“ইনায়া? মা, একটু ধ্রুবকে ডেকে দেবে?”

ইনায়া বসে ছিলো ড্রয়িংরুমের সোফায়। তাকে কোনোরূপ কাজ করতে দিচ্ছেন না নাসিমা। বেচারি চুপচাপ বসে থেকে বিরক্ত। ইনায়ার পাশে বসা উদয়। ছেলেটা ধ্রুবের ছোট ভাই৷ ইনায়ার কয়েক বছরের ছোট হবে৷ ইশমামের থেকে তিন বছরের বড়। মায়ের কথা কানে যেতেই পাশে বসা ইনায়াকে বলল,
-“যাও, যাও। তোমার প্রাণপ্রিয় পতীদেবকে ডেকে আনো৷”

অত্যন্ত বাজে কথা। সবার সামনে এমন বাজে কথা শুনলে অপ্রস্তুত হতে হয়। ইনায়াও অপ্রস্তুত হলো ঢের! সে উদয়কে চোখ রাঙিয়ে উঠে দাঁড়ালো জায়গা ছেড়ে। ধীর পায়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেলো।

নিজেদের ঘরের সামনে এসে থামলে হালকা হাতে ঠকঠক আওয়াজ তুললো দরজায়। ভেতর থেকে সাড়া-শব্দ না এলে সে সামান্য দরজা খুলে উঁকি দিলো। তখনই হাতে টান খেলো জোরে। হিঁচড়ে টানে তাল মেলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে এসে পড়লো কারো গায়ের উপর। পুরুষালী ঘ্রাণটা তার চেনা। বড্ড আপন আপন। খট করে দরজা লাগানোর শব্দে ইনায়া পিছে তাকালো একবার। পরক্ষণেই সামনে তাকালো দণ্ডায়মান পুরুষটির দিকে। নিজের অসংযত দৃষ্টি এদিক-সেদিক ঘুরছে দেখে ইনায়া চোখ সরালো। নির্লিপ্ত ভাবে হেঁটে গিয়ে বসলো বিছানার উপর। ঘরটা একটু বেশিই ঠান্ডা। ইনায়া আশপাশ চাইলো। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটার উপর নজর পড়তেই সেটা হাতে নিলো৷ রিমোটের সাহায্যে এসির পাওয়ার বাড়ালো কিঞ্চিৎ। কাজ শেষে তা আগের জায়গায় রেখে পাশের টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে তাতে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো।

অদূরে দেয়াল ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্রুব বুকে হাত গুঁজে সবটাই দেখলো শান্তভাবে। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। মেয়েটার এতো চুপচাপ থাকার কারণ কী? অবশ্য কবেই বা চঞ্চল ছিলো সে? ধ্রুবের মনে পড়ে না। কাল রাতে কিছুটা অশান্ত হয়েছিলো। নিজের সংযম হারিয়েছিলো এই যা। গতরাতের কথা ভেবে হাসি পেলো তার।

ইনায়া চোখ তুলে তাকালো ধ্রুবের দিকে৷ হাসছে কেন এমন? সে বিছানায় উঠে বসে বলল,
-“আন্টি নিচে ডাকছে আপনাকে।”

ভ্রম কাটলো। তাকালো ইনায়ার দিকে। বলল,
-“কেন?”
-“খেতে সম্ভবত।”
-“আচ্ছা, চলো।”
-“আমি যাবো না। আমার ক্ষিদে নেই। আপনি যান।”
-“সকালে খেয়েছো?”
-“না।”
-“তবে ক্ষিদে থাকবে না কেন?”
-“নেই ক্ষিদে। আপনি যান না!”

ধ্রুব দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরপর ন্যানো-সেকেণ্ডের মাথায় কোলে তুলে নিলো ইনায়াকে। মেয়েটা হকচকিয়ে গেল। চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে বলল,
-“আরে, পাগল নাকি? কি করছেন? নামান!”

ধ্রুব জবাবে কিছুই বলল না। শীতল চোখে চাইলো তার দিকে। ইনায়া দমলো না। ধীরস্থির গলায় বলল,
-“নামান না, ভাই! সবার সামনে এসব কি? ওরা কি বলবে?”

ধ্রুব ইনায়ার শেষ দুটো বাক্য কানেও নিলো না। প্রথম বাক্যেই ধ্যান-জ্ঞান, লিভার, কিডনি, ফুসফুস সব দিয়ে দিলো৷ চরম আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বলল,
-“স্বামীকে ভাই ডাকছো? পাপ লাগবে তোমার!”

ইনায়া কটমট করে তাকিয়ে বলল,
-“বউকে কোলে নিয়ে নির্লজ্জের মতোন বাপ-মার সামনে ঘুরলে আপনার কি পূণ্য হবে? নিচে নামান অসভ্য লোক!”

ধ্রুব সোজা তাকে নিচে নিয়ে গিয়ে নামালো। উদয় পানি খাচ্ছিলো। ওদের অবস্থা দেখে পানি মুখে বিষম খেলো। পানি ছিটকে উঠলো। ইনায়া অপ্রস্তুত হলো খুব। ধ্রুব চোখ রাঙিয়ে তাকালো তার দিকে। মৃদু ধমকে উঠলো,
-“সমস্যা কি তোর? ঠিকঠাক ভাবে খেতে পারিস না?”

নাসিমা বিরক্ত হলেন ছেলের উপর। এমন সময় কাঁশতে হলো? ধুর! উনি বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠলেন,
-“বাপের স্বভাব পাইছে! পুরো বাপের মতো ভুল জায়গায় ভুল কাজ করে। অসহ্য!”

বেচারা! বিষমের সাথে ধমক ফ্রী। ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’ অফার চলছে যেন। ইনায়ার মায়া হলো। এগিয়ে দাঁড়িয়ে উদয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“থাক দেবরজি। কেঁদো না। মা-ভাইয়ের ধমক মাঝেমধ্যে খেতে হয়। নয়তো বদহজম হয়। কেঁদো না, কেঁদো না।”

উদয় মুখটাকে দ্বিগুণ উদ্যমে কাঁদো কাঁদো বানিয়ে বলল,
-“আমি তো কাঁদছি না ভাবিজি। আপনার এমন স্বান্তনা বাণীতে এমনিতেই আমার বদহজম শুরু হয়ে গিয়েছে।”

মাঝ থেকে বসে রইলেন আফতাব সাহেব। নাসিমের ধমক গিলে চুপচাপ বসে থাকলেও এখন মুখ খুললেন। ইনায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুমি খেতে বসো মা। এই উদয় একটা চরম ফাজিল!”

উদয় বেকুব বনে গেলো। আশপাশ চেয়ে নিজের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-“আমি ফাজিল? কি করলাম ফাজিলের, বাবা?”

উদয় আর ইনায়ার কথায় ধ্রুব হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না। কত বড়ো বেয়াদব হলে ভাই আর স্বামীর সাথে এমন করতে পারে? কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে সে ইনায়াকে বলল,
-“খেতে বসো ইনায়া।”

ইনায়া চমকে তাকালো ধ্রুবর দিকে। পরপর বড়ো দুঃখী মুখ করে বলল,
-“আপনি আমাকে ধমকালেন স্বামী?”

সকলে চকিতে মাথা ঘোরালো ধ্রুবর দিকে। সমস্বরে বলে উঠলো,
-“আপনি ইনায়াকে ধমকালেন স্বামী?”

ধ্রুবর মুখের ভাব বদলে গেলো। রীতিমতো ভড়কে গেলো সে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সবাইয়ের দিকে। যেন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তাকে! হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
-“এই… এইসব শুরু হলো আবার কবে থেকে?”

উদয় মুখ চেপে হাসি আটকাতে চাইলেও ব্যর্থ হলো। ইনায়ার চোখে জল টলটল করছে। সে ভীষণ দুঃখী গলায় বলল,
-“আমার জীবনে আর কিচ্ছু নেই। স্বামীও এখন ধমকায়।”

ধ্রুব হতবাক হয়ে তাকালো। তার বউও এমন রঙ-ঢঙ কবে থেকে দেখানো শুরু করলো? বয়লার মুরগীর মতো চাল না দিলে পেছন দেখিয়ে চলে যাওয়ার মতো রঙ-ঢঙ। ধ্রুব জোরপূর্বক হাসলো। এগিয়ে চেয়ার টেনে কুর্নিশ জানানোর ভঙ্গি করে বলল,
-“ধমকাচ্ছি না তো বৌ। আসুন, খেতে বসুন।”

ইনায়া ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আপনি আমার সাথে মশকরা করছেন?”

ধ্রুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“মশকরা? ছিঃ! ছিঃ! আপনার সাথে কি না আমি মশকরা করবো? এ কথা জিহ্বে কেন মন-মস্তিষ্কে আনার সাহসও কি এই অধমের আছে? প্রাণের ভয় নেই নাকি আমার!”

নাসিমা হেসে ফেললেন। আফতাব সাহেব মাথা ফিরিয়ে তাকালেন। গা কাঁপলো মৃদু। দম ফাঁটা হাসি আটকানো আপাতত তার মূল উদ্দেশ্য। উদয় ঠোঁট চেপে হাসি আটকাতে চাইলো। সে এখন টুঁ-শব্দটিও করলে ভাবি তার গর্দান কনফার্ম করে দেবে। ইনায়া সবার গতিবিধি পরখ করে তাকালো ধ্রুবর দিকে। বেচারা নিষ্পাপ চোখে চেয়ে। ইনায়া সরু চোখে চেয়ে বলল,
-“বড্ড ঢং করছেন!”
-“ওভার হয়ে গেলো? আচ্ছা স্যরি৷ এবার তো বসুন ম্যাডাম?”

ইনায়া হাসলো এবার। চুপচাপ চেয়ারে বসলো। নাসিমা একটা প্লেট ইনায়ার সামনে রাখলেন। ধ্রুব তাতে ভাত তুলে বেড়ে দিলো। সবজি ইনায়া খায় না। মুরগীর মাংস একটু-আধটু খায়। তাও লেগপিস। ধ্রুবের ঠোঁটস্থ তা। সে তাই তাই দিলো, যা যা ইনায়া খায়। মেয়েটা মৃদু হাসলো। ধ্রুবর দিকে তাকালো আড়চোখে। ওকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও বসলো চুপচাপ খেতে। ইনায়া খেয়াল করলো, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে মুখে খাবার তুলেছে ধ্রুবও খায়নি। ইনায়ার এতো ভালো লাগলো ব্যাপারটা। এরপর যখন তাকালো তখন দেখলো সে চুপচাপ খাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি! যেন একটু আগেও ও কাউকে কোলেপিঠে করে নামায়নি।

উদয়, মানে সেই “ভিক্টিম নম্বর ওয়ান”, পাশের চেয়ারে বসে আছে রীতিমতো কোরবানি ঈদের গরুর মতো অভিমানী মুখ করে। ডাকলো,
-“ভাবিজি…”

মুখটা গলায় চিপে এনে বললো সে,
-“আপনার ওমন স্নেহ-সান্ত্বনা পেয়ে আমি এখনো মানসিকভাবে অবশ। খাওয়া তো দূরের কথা!”

ইনায়া অত্যন্ত দুঃখ নিয়ে বলল,
-“আহা! আমার জন্য এতো কিছু হয়ে গেলো। থাক, তোমার বরং খেতে হবে না। তুমি আমাদের খাওয়া দেখো। এতেই তোমার পেট ভরে যাবে। আফটার অল তোমার মন খুব বড়?”
-“আমার মনের সাথে সাথে পেটটাও বড়ো। সেদিকেও একটু নজর দিন। এভাবে বললে তো খেতে পারবো না।”

ধ্রুব অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো দুপাশে। বলল,
-“তোরা অডিশন দে। ফর শিওর কোনো কমেডি সিনেমার জন্য তোদের সিলেক্ট করবে। তোদের যা গুণ!”

ইনায়া চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো,
-“আপনি আমাদের অপমান করছেন?”
-“আসতাগফিরুল্লাহ! কি বলো বউ? সেই সাহস আমার আছে? তোমাদের সুনাম করছি আমি।”

ইনায়া বড়ো ভাবসাব নিয়ে বলল,
-“আহা! থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ!”

এদের এতো রঙ-ঢঙে নাসিমা আর আফতাব হেসে চললেন পুরোটা সময়। সময়টা যদি এখানে থেমে থাকতো তবে খুব একটা ক্ষতি হতো না!

(চলবে…)