#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৮]
❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌
-“ইনায়া? মা, আমরা ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাবো। তুমিও যাবে সাথে সোনা। ধ্রুবর দাদি তোমাকে দেখতে চাইছেন।”
নাসিমার কথায় খাওয়া থেকে মুখ তুললো ইনায়া। কিছু বলার আগে উদয় বলে উঠল,
-“ভাবিজি? চলুন না! আমরা গেলে আমাদের সব কাজিনরা আসবে ওখানে। মজা হবে।”
ইনায়া ইতস্তত করে বলল,
-“আম্মু-আব্বুর পারমিশন নিতে হবে। ওনাদের বলে তো দেখি।”
নাসিমা হাসলেন,
-“সেটা নিয়ে ভেবো না অতো। আমি আর আফতাব সেটা ম্যানেজ করে নিবো।”
ইনায়া আর কি বলবে খুঁজে পেলো না। যখন বাবা-মাকে মানিয়েই নেবে তাহলে তার তো আর না করার সুযোগ নেই। সে মাথা দুলিয়ে বলল,
-“আচ্ছা।”
তারপর চোখ তুলে পাশে চাইলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আগে থেকেই তাকিয় ছিলো। দৃষ্টির সন্ধিক্ষণে ছেলেটা হাসলো। ইনায়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিলো। আঁঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখলো খাবারের প্লেটে। লজ্জা পেয়েছে সে ঢের! আজকাল বেশিই লজ্জা পায় সে। প্লেটের এখান থেকে আর চোখ সরাবে না। সব কিছুর পরও তার ঠোঁটের কোল ঘেঁষে ছুঁলো মিষ্টি এক হাসির রেখা।
______
এরপর যে যার বাড়ি ফিরলো। নিজেদের মতো করে ব্যস্ত হলো আগের মতোন। সব আগের মতোই রইলো। তবে এর মধ্যে পরিবর্তন এলো ধ্রুব-ইনায়ার। তাদের সম্পর্কের। আগের থেকেও বড্ড বেশি সহজ-স্বাভাবিক হলো। ধ্রুবের কি যে ভালো লাগে! সে ভেবেছিলো এতো তাড়াতাড়ি তাদের সম্পর্ক এতোটাও সহজ হবে না। সেই তুলনায় যা হয়েছে, তা ঢের!
দু’দিন আগে ধ্রুবের বাবা-মা আর উদয় চলে গিয়েছে ধ্রুবের দাদু বাড়িতে। আজ ধ্রুব আর ইনায়ার যাওয়ার কথা। ইনায়ার বাবা-মাকে গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে বললে প্রথমে তারা খুব দ্বিমত প্রকাশ করলেও পরে ধ্রুবের কথা বলার পর আচমকা রাজি হয়ে গেলেন। শুধু রাজি নয়, বরং গদগদ হয়ে হওয়া রাজি। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে শুধু তাকিয়ে ছিলো বাবা-মায়ের দিকে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করার বড্ড শখ জাগছিলো,
-“ধ্রুব কি তোমাদের মেলায় হারিয়ে যাওয়া পুত্র? ওর কথায় এতো সায় কিসের তোমাদের? আমি বললে তো কিছু কানেও নাও না। মানে, কেন?!”
তার অগোচরের এতো আহাজারি কারো কানেও গেলো না। আজ তারা রওনা হবে। ধ্রুবের দাদুবাড়ির ব্যাপারে আগেও বেশ কয়েকবার শুনলেও যাওয়া হয়নি কখনো। এ-ই প্রথম।
রাত তখন ১০:০৭। ইনায়াদের বাড়ির কলিংবেল বাজলেই মেয়েটা দরজা খুললো। ধ্রুব দাঁড়িয়ে বাইরে। ইনায়া তাকে দেখে সরে দাঁড়ালো। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে হাত ভেতরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“আসুন জনাব।”
ধ্রুব হেসে ফেললো। ভেতরে ঢুকেই ইনায়ার গাল টেনে বলল,
-“ম্যাডামের খবর কি? পড়াশোনা কেমন চলে?”
ইনায়া অত্যন্ত দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
-“আর পড়াশোনা! বই খুললেও মাথা ঘোড়ায়।”
-“তারমানে পড়াশোনা চাঙ্গে তুলে ফেলেছেন?”
ইনায়া বড্ড অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
-“আসতাগফিরুল্লাহ! কিসব কথা বলেন? পড়াশোনা চাঙ্গে কেন উঠবে? এমন খিটখিটে স্বামী থাকলে পড়াশোনা কি আর চাঙ্গে ওঠে?”
বলতে বলতেই বেক্কলের মতো হাসলো। ধ্রুব হতাশ শ্বাস ফেললো। এই মেয়ে আগেই ভালো ছিলো। ইদানীং যা শুরু করেছে! সে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমি খিটমিটে?”
-“আজব! আজকে জানলেন নাকি?”
এবার তাল মেলালো সে-ও। বড়ো দুঃখ নিয়ে ধ্রুব বলল,
-“আমায় অপমান করছো ইনায়া?”
-“ছিঃ, ছিঃ, স্বামী! এমন কথা মুখে কেন কিডনি ফুসফুসেও আনা পাপ। আমি কি না আপনায় অপমান করবো, ছিঃ!”
-“ইনায়ায়ায়ায়া!”
-“বলুউউউউন!”
ধ্রুব দু’পাশে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। বলল,
-“তুমি আর ভালো হলে না!”
-“আপনি কি বলতে চাইছে আমি খারাপ? ছিঃ, স্বামী! ছিঃ! এসব আপনি বলতে পারলেন নিজের স্ত্রীকে? এরজন্য আমি, ইনায়া হায়াত আপনাকে কক্ষনো ক্ষমা করবো না। কদাপি নহে!”
-“এবার থামেন। এক্সট্রিম হচ্ছে এবার ম্যাডাম।”
-“তাই না? আচ্ছা, থামলাম।”
ধ্রুব হেসে ফেললো। এই মেয়ে যে সেই মেয়ে যে আগে উঠতে বসতে তাকে সহ্য করতে না পেরে ঝাঁঝের বাণ ছুঁড়তো; তা কি কেউ বিশ্বাস করবে? করবে না বোধহয়। বোধহয় টোধহয় না। করবেই না। কক্ষনো না!
____
গাড়িতে প্যাসেন্জার সিটে বসে আছে ইনায়া। মাথা ঠেকানো জানালার কাঁচে। এক হাত মুখে ঠেঁকে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। অবশ্য কেবলই ঘুম থেকে উঠলো। তারউপর মাতা ব্যথা, বমি বমি লাগছে। চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা ঠেঁকিয়ে বসে রইলো ইনায়া।
ধ্রুব স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে তাকালো ইনায়ার দিকে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কি হয়েছে ইনায়া? খারাপ লাগছে সোনা? গাড়ি থামাবো? কিছু খাবে? খাও? পানি খাবে?”
ইনায়া চোখ খুললো ধীরে ধীরে। ধ্রুবর চিন্তিত মুখটা দেখে ওর বুকের ভেতর কেমন যেন ধুপধাপ শব্দ তুলে উঠলো। এমনভাবে কেউ ভাবে ওর জন্য? ভাবতেও ভালো লাগে। সে কিছুটা হেসে বলল,
-“এমনি একটু মাথা ব্যথা করছে। তেমন কিছু না।”
-“শিওর? পানি খাও একটু?”
-“কিচ্ছু হয়নি তো।”
-“তাও খাও। ভালো লাগবে।”
ইনায়া হাসলো। এই ছোটখাটো বিষয়গুলো যে ধ্রুব নোটিস করে, তার কেয়ার করে, তার যত্ন নেয়, সে না খেলে নিজেরও খাবার না ছোঁয়া, তার সামান্য চুপ থাকাতে উদগ্রীব হওয়া, তথাকথিত ‘মেইল ইগো’ না দেখিয়ে তাকে রেসপেক্ট করা; এসব যে ইনায়ার কতটা ভালো লাগে তা সে বলেও বোঝাতে পারবে না। কেউই পারফেক্টলি পারফেক্ট নয়। ধ্রুবও না। তবুও ইনায়ার অদ্ভুতভাবে মনে হয় ছেলেটা পার্ফেক্টলি পার্ফেক্টের কাতারেই পড়ে। কথাটা ভাবতেই মস্তিষ্ক জিজ্ঞেস করল,
-“কেন? কেউই যখন পার্ফেক্টলি পার্ফেক্ট নয়, তবে ধ্রুব কেন হবে? সেও ইম্পার্ফেক্ট। তারও খুঁত রয়েছে। তবে তোমার কেন ধ্রুবকে পার্ফেক্টলি পার্ফেক্ট মনে হচ্ছে?”
মন অপর পাশ থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলো,
-“কেন মনে হবে না? ছেলেটার আমার প্রতি যত্ন দেখেছো? কতটা ভালোবাসে আমায়, কতোটা কেয়ার করে আমার। আমি আজেবাজে যা-ই বলি আমার উপর কখনো রাগ ঝাড়ে না ও। না তো গলা উঁচিয়ে কখনো কথা বলে। যেই ছেলেটা আমাকে এতো ভালোবাসে, যেই ছেলেটা এমন একটা জেন্টালম্যান; তাকে আমি পার্ফেক্টলি পার্ফেক্ট বলবো না?”
মন-মস্তিষ্কের হাজারো বাক-বিতন্ডায় অতিষ্ঠ হয়ে ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কতো বড় ঝামেলার মাঝে যে সে রয়েছে, বলতে আর বাকি রয় না!
ইনায়া খানিকটা এগিয়ে বসলো ধ্রুবর কাছে। মাথা রাখলো তার কাঁধে। ধ্রুব বাম হাতে আগলে ধরলো তাকে। পিঠ থেকে হাত গলিয়ে কাঁধ জড়িয়ে রাখলো। ডান হাতে পূর্ণ দক্ষতার গাড়ি চালালো। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বড্ড নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“বেশি খারাপ লাগছে?”
ইনায়া তার বাহুতে মুখ গুঁজে রেখে মাথা দোলালো। ধ্রুব অস্থির হলো। হাতের বাঁধন জোরালো করলো,
-“সামনে একটা রেস্টুরেন্ট পড়বে। কিছু খাবে? ভালো লাগবে।”
-“উহু। ইচ্ছে করছে না।”
নিশুতি রাত, সড়কের পাশে গা ঘেঁষে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে। বাতাস কেবল হালকা একটা শিস দিয়ে যায়, যেন কোনো গোপন কথা বলছে পথচারী রাতের সাথে। ধ্রুবর গাড়ির হেডলাইট গিলে নিচ্ছে অন্ধকার। সেই আলোয় ইনায়ার মুখটা আলতো ঝিমিয়ে আসে, কখন যেন কাঁধে মাথা রেখেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। ধ্রুব তার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলো। কপালে চুমু খেলো। ঠিক চুমু নয়, কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“যেখানে তোমার সামান্য চুপ থাকায় আমার বুক পোঁড়ে, সেখানে তোমার অসুস্থতা তো আমার কাছে স্বয়ং গোলাপের কাঁটার মতোন। স্নিগ্ধ গোলাপে এমন কাঁটা বড়ই বেমানান ইনায়া।
আমার কল্পনার সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে তুুমি,
পৃথিবীর সকল ভালো তোমার হোক
তোমায় ছুঁতে আসা মন্দরা,
আমায় তাদের নিশানা করুক।”
(চলবে…)