ক্যামেলিয়া পর্ব-১৯

0
15

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১৯]
[🚫ভায়োলেন্স এলার্ট🚫]

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

দো’তলা একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো ধ্রুব। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকা ইনায়ার দিকে তাকালো। ধীর গলায় ডাকলো,
-“ইনায়া?”

প্রথম ডাকে সাড়া না দিলে আবারও ডাকলো সে। এবার ইনায়া হালকা নড়েচড়ে উঠলো। পরক্ষণেই বেশ আয়েশ করে ধ্রুবের বাহু জড়িয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। ধ্রুব হাসলো। চেয়ে রইলো মেয়েটার মুখের দিকে। কি মিষ্টি! এতো আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে! ধ্রুবের মোটেও মন চাইলো না তাকে জাগাতে। তবুও জাগাতে হবে। বেচারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও ডাকলো ইনায়াকে। বড্ড মৃদুস্বরে, নরম গলায়,
-“ইনায়া?”

ইনায়া পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। ধ্রুবের মুখের দিকে চেয়ে অবচেতন মস্তিষ্কে ডাকের প্রত্যুত্তর করল,
-“হু?”
-“একটু উঠতে পারবে? আমরা চলে এসেছি। ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার ঘুমিয়ো?”

তার কথায় ইনায়া ছোট ছোট চোখ করে আশেপাশে চাইলো। ঘুমুঘুমু গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“চলে এসেছি?”

ধ্রুবর হৃদপিণ্ডটা যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো। তবে পারলো না। গলায় এসে আটকে রইলো, এমন অবস্থা। কোনো মানুষের সদ্য ঘুম থেকে ওঠা গলা এতো সুন্দর হয়? কেন হয়? আহা! সে আলগোছে মাথা দুলালো। সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো,
-“হু।”

ইনায়া বের হতে গাড়ির দরজায় হাত দিলে ধ্রুব তাতে বাঁধ সাধলো। নিজে গাড়ি থেকে নামলো। ওপাশে ঘুরে এসে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো ইনায়ার দিকে। প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট! বাহ! হাসলো ইনায়া। ধ্রুবর হাত ধরেই নেমে এলো গাড়ি থেকে।
তাকে পাশে দাঁড় করিয়ে ধ্রুব গাড়ি পার্ক করলো। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে লাগেজ নামালো। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো অলমোস্ট রাত দু’টো বাজে। এতোক্ষণে সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। ধ্রুব এসে ইনায়ার পাশে দাঁড়ালো। ইনায়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাড়িটা দেখছে। বাড়ির দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে আছে। হালচাল দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরোনো বাড়ি। রংটাও কেমন চটে গেছে। দেখে মনে হবে এখানে বহুবছর কেউ থাকে না, যার ফলে বাড়ির এই অবস্থা। অথচ সবাই-ই থাকে এখানে। তবুও এমন অবস্থা বাড়ির!

-“ইনায়া?”

ধ্রুবর ডাকে ইনায়া তাকালো তার দিকে। ধ্রুব ইনায়ার ব্যাগ আর লাগেজ হাতে নিয়ে বলল,
-“চলো?”
-“অনেক রাত এখন। সবাই জেগে নেই বোধহয়। দরজা কে খুলবে?”
-“চাবি আছে আমার কাছে। চলো।”

ইনায়া ধ্রুবর কথায় মাথা নেড়ে চুপচাপ তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। রাতের নিস্তব্ধতা চারপাশে যেন একটা মোহ তৈরি করে রেখেছে। শুধু দু’জনের পায়ের শব্দ, আর মাঝে মাঝে দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। ধ্রুব সামনে গিয়ে দরজার তালা খুললো। তারা ভেতরে ঢুকলে তারপর পুনরায় দরজা লাগিয়ে ইনায়াকে নিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে গেলো। সুইচবোর্ড চেপে লাইট জ্বালালো। ব্যাগ-পত্র সব রেখে ইনায়াকে বলল,
-“সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। কিছু খাবে? নিয়ে আসবো?”
-“না। আমি ঘুমাবো একটু।”
-“আচ্ছা। ব্যাগ এখানে আছে, তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি দেখি আম্মু-আব্বু ঘুমিয়েছে কি-না। নাহলে কথা বলে আসি।”

ইনায়া মাথা দোলালো,
-“আচ্ছা।”

_____
ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ রাত হলেও ঘুম ভাঙলো খুব সকালেই। চেঁচামেচির আওয়াজ শুনেই ইনায়ার ঘুম ভাঙলো। উঠে বসতেই বুঝলো বাইরে থেকে শব্দ আসছে। সে কোনোমতে চোখ খুলে আশেপাশে চাইলো। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়েও ধ্রুবকে পেলো। ইনায়া মুখ ঢেকে ঝুঁকে বসে রইলো। মাথা ধরেছে খুব। তার মধ্যে এই চেঁচামেচি বিষের মতো লাগলো। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এলো। উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। চুল আঁচড়ে বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে দরজা খুলে নিচে নামলো। নিচে বেশ কিছু লোকজন। যাদের মধ্যে অধিকাংশকেই ইনায়া চেনে না। বিয়েতে একজন, দুজনকে দেখলেও চেহারা ঠিক করে মনে পড়ছে না। এতো লোক দেখে সে বিরক্ত হলো। অভিব্যক্তিতে না ফুটিয়ে এদিক-সেদিক তাকালো।

ইনায়াকে নামতে দেখে নাসিমা এগিয়ে এলেন তার কাছে। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“ঘুম হয়েছে সোনা?”

এতোক্ষণে পরিচিত মুখ দেখে ইনায়ার বিরক্তি কমে এলো শতাধিক। সে হেসে বলল,
-“হ্যাঁ আন্টি।”

নাসিমা বললেন,
-“ধ্রুব ওদিকে আছে। সবাই ওকে টেনে ওদিকে নিয়েছে। তুমিও যাও। আমি তোমার খাবার পাঠাচ্ছি ওখানে কেমন?”

ইনায়া মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। ধ্রুবকে দেখতে পেয়ে সেদিকে গেলো। সোফার একপাশে ধ্রুব বসে। আশেপাশে তার চৌদ্দপুরুষের সব কাজিন ভাই-বোন। ইনায়ার অস্বস্তি হলো। ইনায়াকে দেখে ধ্রুব ডাকলো তাকে,
-“ইনায়া? এদিকে এসো।”

একযোগে সকলের চোখ মেয়েটার উপর পরলে সে চরম অস্বস্তিতে নুইয়ে পড়লো। উদয় দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“ভাবি! আসুন না!”

ইনায়া চোখ রাঙিয়ে তাকালো। উদয় যদি সেদিকে তোয়াক্কা করতো! সে আবারাও ডাকলো তাকে। ইনায়া এগিয়ে এসে বসলো ধ্রুবর পাশে। ধ্রুবর কোলে একটা বিড়াল। সাদা রঙের। বড্ড মিষ্টি দেখতে। ধ্রুব বিড়ালটাকে আদর করছে। কখনো চুমু খাচ্ছে মুখে, তো কখনো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গায়ে। বিড়ালটার মিশে আছে তার সাথে। মাথা হেলিয়ে দিচ্ছে কাঁধে। ইনায়া সেদিকে তাকিয়ে রইলো। ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বিড়ালটা সুন্দর খুব। প্রচন্ড মিষ্টি, কিউট! তবে ইনায়ার তাকে পছন্দ হলো না। তাকে ওমন তাকিয়ে থাকতে দেখে উদয় বলল,
-“ভাবি, এটা ভাইয়ার বিড়াল। ওর নাম কোকো। এখানে সবার কাছে থাকে। তবে ভাইয়া এলে, ওর কাছ থেকে নড়েও না। আমাদের তখন পাত্তাই দেয় না।”

বড়ো দুঃখ নিয়ে কথাগুলো বললো উদয়। ইনায়া জোরপূর্বক হাসলো। মাথা দুলিয়ে বলল,
-“আচ্ছা! সুন্দর।”

ধ্রুব তার দিকে তাকালো,
-“তুমি কোলে নিবে? অনেক শান্ত ও। কিছু করবে না।”

ইনায়া প্রায় সাথে সাথেই মানা করে দিলো,
-“না। আমি বিড়াল কোলে নিতে ভয় পাই।”

বাকিরা এটা স্বাভাবিক নিলেও ধ্রুবর স্বাভাবিক লাগলো না মোটেও। যেই মেয়ে মানুষ মারার ছবি-ভিডিও দেখেও ভয় পায় না উল্টো হাসে, ইন্স্ট্রাকশন দেয় এমন করে না মেরে ওমন করে মারলে ভালে হতো; সেই মেয়ে কি না সামান্য বিড়াল কোলে নিতে ভয় পাবে? আজব! যদিও তার এতশত ভাবনার মাঝে ইনায়া কথা ঘুড়িয়ে ফেললো। সকলের সাথে টুকটাক এটা-ওটা নিয়ে কথা বলতে লাগলো। সবকিছুর মাঝেও তাকালো কোকোর দিকে। চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে আছে ধ্রুবর বুকে। ধ্রুব একহাতে তার গায়ে হাত বুলিয়ে সবার সাথে কথা বলছে। ধ্রুবর কোকোকে নিয়ে এতো আহ্লাদ ইনায়ার পছন্দ হলো না। একবার সেদিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

____
তখন রাত। ধ্রুবের দাদাবাড়িতে একটা বাগান রয়েছে। বাগানটা উপরে ধ্রুব-ইনায়ার ঘর থেকে দেখা যায়। যদিও সেখানে কেউ আসে না বললেই চলে। উদয় ইনায়াকে এদিক-সেদিক ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিলো। বাগানে আসতেই ইনায়া জিজ্ঞেস করল,
-“এমন পরিত্যক্ত ধরনের কেন বাগান?”

উদয় জবাবে বলল,
-“কেউ তেমন একটা আসে না এদিকে। কারোরই বাগান তেমন পছন্দ না। শুনেছি দাদু শখ করে বাগানটা করেছিলেন। তার মারা যাওয়ার পর কেউ আর তেমন যত্ন নেয় না। দাদি নিতো যদিও। এখন তারও বয়স হয়েছে, উনিও বা কি করবেন।”

ইনায়া ‘খুব বুঝেছে’ এমন মাথা দোলালো। কিছু একটা ভেবে তাকালো আশেপাশে। তারপর উদয়ের দিকে,
-“একটা হেল্প করতে পারবে?”
-“কি হেল্প?”
-“কিছুক্ষণ পর সবাই ঘুমিয়ে গেলে তুমি খেয়াল রাখবে, যেন এদিকে কেউ না আসে। আর তুমিও নিজের ঘরে থাকবে। শুধু একটা জিনিস পাঠাতে হবে তোমার। কোকো। পারবে না?”
-“কেন?”
-“আমার কোকোকে খুব পছন্দ হয়েছে। ওর সাথে একা একটু থাকবো। প্লিজ উদয়!”

উদয় অবাক হলো। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও মুখে কিছু বললো না। কেমন যেন চুপচাপ থেকে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো। তা দেখে ইনায়া বেশ মিষ্টি করে হাসলো।

____
তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ইনায়া বাগানে এসে দাঁড়ালো। ধ্রুব ঘুমোচ্ছে। এতোক্ষণ তার ঘুমেরই অপেক্ষায় ছিলো ও। যদিও তার জেগে থাকায় খুব একটা সমস্যা হবে না। তবুও!

বাগানে এসে উদয়কে মেসেজ করলো ইনায়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাগানে এসে হাজির হলো সাদা ছোট্ট কোকো। কোকো এসে গা ঘষলো তার পায়ের সঙ্গে। নরম দেহটা যেন এক ফালি তুলোর মতো। মিউ মিউ করে ডাকল। একবার, আরেকবার।

ইনায়া তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ঝুঁকে বসলো। কাঁধের কালো পলিথিনের ব্যাগটা পাশে রাখলো। মুচকি হেসে কোকোকে কোলে তুলে নিলো। আদুরে বিড়াল ছানাটা একদম মিশে গেলো তার গায়ের সঙ্গে। ইনায়া কিছুসময় তার গায়ে হাত বুলালো৷ মাথার কাছটায়। ধীরে ধীরে নেমে গলার কাছটায়৷ হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই আচমকা চেপে ধরলো গলা। খুব শক্ত করে। কোকোর চোখ বুঁজে এলো। তার শ্বাস আটকে আসছে। ইনায়া ছাড়লো কিছুক্ষণ বাদে। কোকো আতঙ্কিত হয়ে তার কোল থেকে ছুটতে চাইলে ইনায়া চেপে ধরলো। পাশের ব্যাগ খুলে বের করলো ছুরি। রান্নাঘর থেকে নিয়েই এসেছিলো। ছুরিটা নিয়ে চেপে ধরলো কোকোর গলার কাছটায়। বিড়ালটা সরে যেতে চাইলো। দু’পায়ে ঠেক দিয়ে ইনায়াকে সরাতে চাইলো। ইনায়া হাতের চাপ বাড়ালো। ফিনকি রক্তের দেখা দিতেই কোকোর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আরো গভীর ভাবে ছুরি ডাবতেই ইনায়াকে বিড়ালটাকে নিচে নামিয়ে রাখলো। ছুরি সরাতেই কোকো ছটফটিয়ে উঠলো। ক্রমাগত হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। চোখ থেকে পানি পড়ে গায়ের সাদা পশম ভিজে চুপচুপে। গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না। ইনায়া ছুড়িটা তুলে কোপ বসালো বিড়ালের গলায়। এক, দুই। দুই কোপে আলাদা হয়ে গেলো কোকোর মাথা।
বড়ো তৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইনায়া। কোকোর ছটফটানো থেমেছে। বুঝতে বাকি রইলো না প্রাণ ত্যাগ করেছে সে। ইনায়া নিচে বসলো। ছুড়ি চালালো গায়ে। একপাশের পশম কেটে, টেনে ছিঁড়তে লাগলো তা। অনাবৃত করলো পুরো শরীর। তার গা-হাত রক্তে মাখামাখি অবস্থা। আবারো ছুরি চালালো চামড়ায়। জোরেশোরে ছুরির কোপ বসাতে লাগলো গায়ে। একেক অঙ্গ একেক পাশে ছড়িয়ে পড়লো। ইনায়া সবক’টা অঙ্গ একত্রে এনে একজায়গায় রাখলো। উঠোনের একপাশ থেকে সাথে আনা কুড়ালটা দিয়ে মাটি খুঁড়লো। বিড়ালটার প্রত্যেক অংশকে একে একে মাটির নিচে চাপা দিলো। একপ্রকার কবর দেওয়া যাকে বলে। সব কাজ শেষে এক পাশে বসে পড়লো ইনায়া। রক্তে মাখামাখি জামা টার দিকে একপলক তাকালো। হেসে ফেললো শব্দ করে। সামনের কোকোর কবরের দিকে তাকালো। হাসি নিভে এলো। চোয়াল শক্ত হলো। চোখে-মুখে হিংস্রতা ফুঁটে উঠলো নিমিষেই। গমগমে গলায় আওড়ালো,
-“আই ডু নট এলাউ এনি সিঙ্গেল পারসোন নিয়ার মাই ম্যান হু ট্রাইস্ টু ইমপ্রেস হিম—এক্সেপ্ট মি। ইভেন ইফ ইট ইজ আ ফা’কিং ক্যাট!”

(#চলবে…)