#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১১|
স্মৃতি কফি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই জুভান তার ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল। স্মৃতি অবাক হলো তাতে। জুভান তিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এটা কার নাম্বার, স্মৃতি?’
স্মৃতি ভয় পেয়ে গেল তখন। ঐ নাম্বার থেকে আবার কল আসছে না তো? সে কফির গ্লাস টা সাইডে টেবিলে রেখে তার ফোনটা হাতে তুলে নেয়। লক স্ক্রিনে সেই নাম্বার টা দেখেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে তার। ইশ, কী বিচ্ছিরি ভাগ্য তার। সারাদিন একটাও কল এলো না অথচ এখনই কলটা আসতে হলো। এখন সে জুভান কে কী জবাব দিবে?
জুভানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। স্মৃতির হাতে টান দিয়ে বলে,
‘কী হলো, চুপ করে আছো কেন? বলো কার নাম্বার এটা?’
স্মৃতি নিরব। চোখ মুখ নিমজ্জিত। কথা বলার সাহস বা শক্তিই কিছুই এই মুহূর্তে পাচ্ছে না সে। কী জবাব দিবে? আবারও কি একটা মিথ্যা বলা ঠিক হবে? কিংবা আগের মতো এখনও কি সেই মিথ্যা জুভান বিশ্বাস করবে? স্মৃতি ভেবে পায় না। জুভান স্মৃতির হাতের পেশিতে তার সুঠাম হাতের শক্তি প্রয়োগ করতেই স্মৃতি চোখ মুখ খিঁচে ধরে। করুন চোখে তাকায় জুভানের দিকে। জুভানের মায়া হয় না, তার শক্ত হাতের মুঠো নরম হয় না। স্মৃতি এবার মৃদু সুরে বলে,
‘এটা জিহাদের নাম্বার।’
জুভানের শক্ত অক্ষিযুগল ক্রমশ আরো শক্ত হয়। সেই কঠিন নির্মম চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস স্মৃতির নেই। তাই সে চোখ নামিয়ে ফেলে। কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বলে,
‘আমাকে ভুল বুঝবেন না, জুভান। ঐ লোকটাকে আমি আরো আগে থেকেই চিনি। বলেছিলাম না আমার বাবার সাথে কাজ করেছে। উনাকে এখন আমার একটু প্রয়োজন ছিল। সেই জন্যই আমি উনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। তাছাড়া আর কিছু না, বিশ্বাস করুন।’
জুভানের হাতের বাঁধন কিছুটা আলগা হলো। তবে চোখ মুখের কঠোরতা এইটুকুও কমলো না। সে ঠান্ডা গলায় স্মৃতি কে বলল,
‘আজকাল তোমার কর্মকান্ডে না চাইতে তোমার উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে, স্মৃতি। তুমি আসলে কী করতে চাইছো সেটা আমার জানা নেই। তবে আমার সংসার ব্যতীত অন্য কিছু নিয়ে না ভাবাই তোমার জন্য শ্রেয়। নয়তো আবার হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই বি কেয়ারফুল।’
তার এই নরম শীতল সুর স্মৃতির শরীরে ঘাম ছুটানোর জন্য যথেষ্ট। সে ঢোক গিলল। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলল না। জুভান তার কফি নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। স্মৃতি তখন ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিভিং রুমে গিয়ে বসে সে। মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে হচ্ছে। মন অসুস্থ মানে শরীরও অসুস্থ। মা’র চিন্তায় আজকাল তার বড্ড অস্থির লাগছে। অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোও তাকে শান্তি দিচ্ছে না। এত অশান্তি নিয়ে কেউ কীভাবে ভালো থাকবে। স্মৃতি চোখ বুঁজে সোফায় হেলান দিয়ে বসে। মনে মনে ভাবে তখন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসবের সমাধান তাকে করতে হবে। আর অশান্তি আর সহ্য করতে পারছে না সে। বাবার খুনি কে খুঁজে বের করে, তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিয়ে তবেই সে দম ফেলবে, তবেই এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে সে। এর আগে না।
স্মৃতি আর পরে রুমে যাওয়ার সাহস করল না। সে ঠাঁই নিচে সোফায় বসে রইল। কেউই তখন আর রুম থেকে বের হলো না। নয়টা বাজার পর সে উঠে রান্নাঘরে যায়। রাতের খাবার বানানোর প্রস্তুতি নেয়। তখন জুভান রান্নাঘরে আসে। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘রুমে যাচ্ছো না কেন?’
স্মৃতি চমকে পেছনে ফিরে। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘রান্না বসিয়েছি তাই।’
‘সেটা তো মাত্র বসিয়েছ। এতক্ষণ যাও নি কেন? ঝিম মেরে লিভিং রুমেই বসে ছিলে।’
‘আমি তো রান্না…’
‘স্মৃতি, তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছো যে আমাদের লিভিং রুমে সি সি ক্যামেরা লাগানো। আর সেটা আমার ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করা, তাই এখন আর কথা ঘুরিও না।’
স্মৃতি নতমস্তিষ্কে বলল,
‘আসলে আপনি রেগে ছিলেন তাই..’
জুভান হাসল। স্মৃতির চোখে সেই হাসি পড়ল না। জুভান বলল,
‘তোমার উপর কি রেগে থাকা সম্ভব?যদিও তোমার এইসব আজগুবি কাজের জন্য মাঝে মাঝে একটু রাগ হয় তবে সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পড়ে যায়। আচ্ছা যাকগে এসব, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। কাল আমি নিধি কে ডিভোর্স দিচ্ছি, স্মৃতি।’
স্মৃতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জুভানের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না। সে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
‘এসব কী বলছেন জুভান? আপনি সত্যিই নিধি কে ডিভোর্স দিবেন?’
‘কেন, দিলে তুমি খুশি হবে না?’
‘আমার খুশি আর অখুশি তে কিছু আসে যায় না। আমার খুশির কথা ভাবলে তো শুরুতেই আপনি বিয়েটা করতেন না। অযথাই আপনি এই বিয়েটা করে আমাকে আর নিধি কে আমাদের দুজনকেই কষ্ট দিয়েছেন। এখন আবার বলছেন ডিভোর্স দিবেন। এত ঝামেলা না করলেও পারতেন, জুভান।’
জুভান স্মৃতির কথার বিপরীতে যেন প্রচন্ড অপ্রসন্ন হলো। চোখে মুখে ফুটে উঠল তার বৈরাগ্যপনা। সে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘আমার যা ভালো মনে হয়েছে আমি তাই করেছি। আর ভবিষ্যতেও আমি তাই করব যেটা আমার কাছে ঠিক মনে হবে।’
স্মৃতি তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
‘হ্যাঁ, করতেই পারেন। আপনার জীবন, আপনার খুশি সেখানে আমি তো কেবল একটা পরগাছা। দেখা যাবে দুদিন পর নিজের ভালোর জন্য আবার আরেকটা বিয়ে করে চলে এলেন। তারপর যখন তার প্রয়োজন মিটে যাবে তখন তাকেও ছেড়ে দিবেন। আচ্ছা, আমার প্রয়োজন কবে ফুরাবে, জুভান?’
জুভান রেগে গেল এবার। গরম দেখিয়ে বলল,
‘বাজে বকো না তো। এসব কথা আর বলবে না, মাথা খুব গরম হয়ে যায়। তুমি সবসময়ই বেশি বেশি বুঝো, আর এত বুঝতে হবে না। বেশি বুঝলে মাথা কাজ করবে না। তাই যত কম বুঝবে ততই ভালো। এখন তাড়াতাড়ি কাজ সেরে রুমে এসো, আমার কিছু শার্ট আইরন করতে হবে।’
জুভান তার কথা শেষ করে বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে যায়। তার অনুপস্থিতে স্মৃতি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সময়ের সাথে সাথে লোকটাকে যেন আরো অন্যরকম লাগছে তার কাছে। সেই যখন তাদের প্রথম পরিচয়। একটা ছোট্ট কাপড়ের শো রুমে, যেখানে স্মৃতি পার্ট টাইম জব করত। বাবাকে হারিয়ে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তখন সে’ই নেয়। অসুস্থ মা, কলেজ পড়ুয়া ভাই, বাবার অস্বাভাবিক মৃত্যু সব মিলিয়ে তখন তার পাগল প্রায় অবস্থা। আর সেই মুহুর্তেই সে জানতে পেরেছিল তার বাবাকে শুধু খু/ন করা হয়নি তার শেষ সম্বল ছয় শতক জমিটাও সেই কালপ্রিট কেড়ে নিয়েছে। মূলত এই ছোট্ট একটা জমি আর এই জমির লোভে কেউ তার বাবাকে খু/ন করেছিল। কিন্তু স্মৃতি সেই লোককে এখনও খুঁজে পাইনি। যেই লোক এতসব চাল করেছে, তার বাবাকে বোকা বানিয়ে জমি হাতিয়ে নিয়েছে সেই জিহাদ এখনও পলাতক। তাকে খুঁজে বের করতে পারলেই সেই নির্দয় ব্যাক্তিটাকেও খুঁজে বের করতে পারতো। আর এই সবকিছুর মাঝে সবথেকে অদ্ভুত সত্য কথাটা হলো যে, তার বাবা তার শ্বশুরের কম্পানিতে এক সময়কার স্বল্প বেতনের কর্মচারী ছিলেন। অথচ স্মৃতি তার শ্বশুরের কাছে তার বাবার নাম বলায় তিনি তাকে চিনতে অস্বীকার করেন। তখন থেকেই স্মৃতি তার বাবার পুরো পরিচয় তাদের কাছে গোপন রাখে। তখন তাদের সাথে তার বাবা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় তারই বাবার এক কলিগ কে।
জুভানকেও বলেনি কিছু। স্মৃতি কে প্রথমবার সেই শপে দেখেই জুভান তাকে বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে উঠে। আর সে যখন জুভানের পুরো পরিচয় পায়, তখন সেও রাজি হয়ে যায়। তার মন বলছিল ঐ কম্পানি আর কম্পানির লোকেরাও তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। কারণ তার বাবার মৃত্যুর আগে সেই কম্পানি থেকে মাঝে মধ্যেই তাদের বাড়িতে লোক আসতো। স্মৃতি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখত তাদের। তবে বুঝতো না তারা কেন আসে, বাবাও কিছু বলতো না তাকে। আর এসবের মাঝেই হুট করেই একদিন তার বাবা উধাও হয়ে যায়। পরদিন তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় শহরের খুব ভেতরে কোনো এক জঙ্গলে। সেই কী ভয়ানক মুহূর্ত, কী ভয়ানক কান্না। শোকে পাথর হয়ে যায় তার মা। ভাই কেঁদে কেটে অস্থির। স্মৃতি নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকে বাবার লাশের পাশে। আর সেদিনই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাবার খু/নির শাস্তি সে নিজ হাতে দিবে।
চলবে…
#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১২|
স্মৃতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। রাতের আকাশ দেখছে। আর জুভান ভেতরে ল্যাপটপে কাজ করছে। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্মৃতি রুমে গেল। জুভানের পাশে বিছানায় গিয়ে বসল। কিছু প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু মুখ ফসকে কিছু বলতে পারছে না। জুভান রেগে গেলে ভয়ানক হয়ে উঠে। তাই সে তাকে কোনোভাবেই রাগাতে চায় না। কিন্তু প্রশ্ন গুলো না করেও থাকতে পারছে না সে। ব্যাপারটা মাথার ভেতর ঝট পাকিয়ে ফেলছে তার। সে বসে বসে হাঁসফাঁস করতে লাগল। জুভান পাশ থেকে বলল,
‘কিছু বলবে?’
স্মৃতি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘জিহাদ কে আপনি কীভাবে চিনেন?’
জুভান তার দিকে তাকাল। স্মৃতি চোখের পলক ফেলল না। জুভান বলল,
‘আমাদের কম্পানির একজন কর্মচারী। এতদিন যোগাযোগ ছিল না। কাল নিজেই আমাকে কল দিয়েছিল। কিন্তু তোমার তাকে কী প্রয়োজন?’
স্মৃতি মাথা নিচু করল। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলল,
‘লোকটা ভালো না। আমার বাবার জমি নিয়ে লোকটা ঝামেলা করেছিল।’
জুভান এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কথাটা ঠিক মেলাতে পারল না। জিহাদ তো তার হয়ে কাজ করে। আজ পর্যন্ত সে যতটা জমি নিয়ে কাজ করেছে সবগুলো সে তার কথাতেই করেছে। সে নিজ থেকে তো কোনো জমি নিয়ে ঘাটাঘাটি করেনি। তাহলে এখানে স্মৃতির বাবার জমি কীভাবে এলো? জুভান তাকে প্রশ্ন করল,
‘তোমার বাবার জমি মানে? কোন জমির কথা বলছো?’
‘আমাদের একটা জমি ছিল। আমার দাদা বাবাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেটার বর্তমানে অনেক দাম। বাবা এটা কোনদিনই বিক্রি করতে চাননি। কিন্তু ঐ জিহাদ আমার বাবার কাছ থেকে জোর করে জমিটা কেড়ে নিয়েছে। তার বিনিময়ে আমাদের কোন টাকাও দেয়নি। অনেক বছর যাবত আমি লোকটা কে খুঁজছি, আপনি কি উনার সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন?’
সবকিছু শুনে জুভান বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল যেন। সে তো এত জমি নিয়ে কাজ করেছে, কই কখনো তো কোনো জমির মালিককে তার পরিচিত বলে মনে হয়নি। পরিচিতদের মধ্যে কেবল নিধির বাবার জমিটাই ছিল। কিন্তু এখানে স্মৃতির বাবার জমি কীভাবে এলো সে বুঝতে পারছে না। তাহলে কি জিহাদ তাকে না জানিয়েই নিজ থেকে কোনো জমি নিয়ে কাজ করেছে? জিহাদের তো এমন বেইমানী করার কথা না। এইদিকে স্মৃতিও নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছে না। ব্যাপারটা তে এত গরমিল লেগেছে যে কোনোভাবেই জুভান সেটা মেলাতে পারছে না। সে স্মৃতিকে তখন জিজ্ঞেস করল,
‘এটা ঠিক কত বছর আগের কথা, স্মৃতি?’
স্মৃতি সময় নিয়ে বলল,
‘পাঁচ বছর আগের।’
‘আমাদের বিয়ের আগের?’
‘হ্যাঁ।’
জুভান এবার চিন্তায় পড়ে গেল। বিয়ের আগে হলে, হতে পারে সে জিহাদ কে দিয়ে এমন কিছু করিয়েও থাকতে পারে। কারণ তখন তো তার স্মৃতির সাথে কোনো পরিচয় ছিল না। কিন্তু সে যাদের জমি নিয়েছে সেই সব জমির মালিককেই সে দেখেছে। সেখানে তো স্মৃতির বাবাকে সে কখনও দেখেনি। নাকি দেখেছিল, এখন মনে পড়ছে না? উফফ, মাথা কাজ করছে না জুভানের। সে স্মৃতিকে বলল,
‘তুমি আমাকে জমির ডিটেইলস বলো। কত শতক জমি ছিল, এক্সেক্ট কোন জায়গাটা ছিল আর মালিক কে ছিল এইসব ডিটেইলস বলো আমাকে।’
স্মৃতি মনে মনে ভাবল, আপাতত সত্যিটা বলা যাবে না। মিথ্যে বলেই ব্যাপারটা আগাতে হবে। সে বলল,
‘পাঁচ শতক জমি ছিল, আমার বাবার নামে। জমিটা ছিল আমাদের বাড়ির ঐদিকেই।’
‘তোমার বাবার পুরো নাম কী?’
‘আশরাফুল ইসলাম।’
এই নামটা জুভান চিনে। খুব ভালো ভাবেই চিনে। কিন্তু এই নামের যেই মানুষটাকে সে চিনে তার সাথে স্মৃতির বাবার কোনো মিল নেই। আর নামে নামে মিলতেই পারে। নাম মিললেই যে মানুষ মিলবে সেটার কোনো মানে হয় না। জুভান বলল,
‘জমিটা কি রানীর বাজারের ঐদিকে? তোমাদের বাড়ি তো ঐদিকেই তাই না?’
স্মৃতি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। জুভান মনে মনে ভাবল, ঐদিকের কোনো জমির ফাইল তার কাছে নেই। তাহলে জিহাদ নিশ্চয়ই একাই সবটা করেছে তাকে না জানিয়ে। সে এবার জিহাদের উপর রেগে গেল প্রচন্ড। তাকে না জানিয়ে জমি নিয়ে একা কাজ করার সাহস হলো কী করে তার। সে চোখ মুখ শক্ত করে স্মৃতি কে বলল,
‘তুমি কি জিহাদের সাথে দেখা করতে চাও।’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক আছে, কাল তোমাকে জিহাদের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবো।’
এত বছর পর স্মৃতি যেন এবার কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পেল। এই জিহাদ কে সে কম খুঁজেনি। কম অপেক্ষা করেনি তার জন্য। অবশেষে সে তার দেখা পেতে চলছে। এবার সব সত্য বেরিয়ে আসবে। যদি এই সবকিছুর মূলে কেবল জিহাদই থাকে তবে তাকে নিজ হাতে সে খু/ন করে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে।
লাইট অফ করে জুভান এসে স্মৃতির পাশে শু’ল। স্মৃতির তখন আরেকটা ব্যাপার নিয়ে খটকা লাগল। সে জুভানের দিকে ঘুরে বলল,
‘আমার আরেকটা জিনিস জানার ছিল, জুভান।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘জিহাদ তো আপনার কম্পানিতে কাজ করে। সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই আপনার আর বাবার কথাতেই সব জমি নিয়ে কাজ করে। তাহলে তো আমাদের জমিটাও আপনাদের কথাতেই সে..’
‘কী বলছো স্মৃতি? আমি তোমার বাবার জমি কেন নিব? আর নিলেও আমি তো সেটা জানতাম। রানীর বাজারের ঐদিকে আমাদের কোনো জমি কেনা হয়নি। বিশ্বাস না হলে তোমাকে আমি আমাদের সব জমির ফাইল দেখাতে পারবো।’
জুভান ভেবেছিল স্মৃতি এইটুকুতেই বুঝে যাবে। কিন্তু হলো তার উল্টো। স্মৃতি শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
‘আমি ফাইলগুলো দেখতে চাই।’
জুভান অবাক হলো। স্মৃতি তাকে অবিশ্বাস করছে। জুভান উঠে বসে বলল,
‘আমাকে তুমি অবিশ্বাস করছো, স্মৃতি?’
স্মৃতি শুকনো মুখে বলল,
‘না, কেবল নিজের বিশ্বাসটাকে আরো চওড়া করতে চাইছি।’
জুভান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ঠিক আছে, বসো; আমি ফাইল নিয়ে আসছি।’
রুমের লাইট জ্বালিয়ে জুভান আলমারির ভেতরে তার লকারটা খুলল। সেখানে অনেক ফাইল। সবগুলো ফাইলই সে সেখান থেকে নিয়ে বিছানায় এনে রাখল। স্মৃতি কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘নাও, সবগুলো একটা একটা করে চেক করে দেখো, তোমাদের জমির ফাইল আছে কিনা।’
স্মৃতি তাই করল। একটা একটা করে ফাইল গুলো দেখতে লাগল। জুভান চোখ মুখ শক্ত করে তার পাশে বসে রইল। সব ফাইল দেখা প্রায় শেষ। স্মৃতি যেই ফাইটাকে উদ্দেশ্য করে খুঁজছে সেটা সে এখনও পায়নি। অবশেষে লাস্ট ফাইল। স্মৃতি ভেবে নিয়েছিল এটাও সেই ফাইল হবে না। অন্তত এটা ভেবে শান্তি পাচ্ছিল যে জুভান এসবের মাঝে নেই। কিন্তু তার শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। ফাইল খুলেই জায়গার নাম দেখে বুকে মোচড় দিয়ে উঠল তার। তার পাশে জমির মালিকের নাম “আশরাফুল ইসলাম” দেখে আরো বেশি বুক কাঁপতে লাগল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা জুভানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এখানে আমার বাবার নাম।’
জুভান সেটা দেখে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমার বাবার নামে আমার একজন ক্লায়েন্ট ছিলেন। তবে উনি তোমার বাবা নন। আর এই জমিটাও তোমাদের না। জায়গার নাম দেখো, আলীনগরের ঐদিকে।’
স্মৃতি চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করল। সে জুভান কে কীভাবে বলবে যে ঐ আলীনগরের জায়গাটাই তাদের। আর এই ফাইলটাও তাদেরই জমির। যেখানে জোর কর তার বাবার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে তারা জমিটা হাতিয়ে নিয়েছে। স্মৃতি কে চুপ থাকতে দেখে জুভান বলল,
‘কী হলো, এখনও বিশ্বাস হয়নি। আরে বাবা তুমি মিলিয়েই দেখো না। তোমাদের জমি তো পাঁচ শতক ছিল আর এটা ছয় শতক আর তাছাড়া জায়গারও মিল নেই। শুধু মালিকের নামের মিল আছে। একই নামের তো দুই মানুষ হতেই পারে, তাই না?’
স্মৃতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘হ্যাঁ পারে, অবশ্যই পারে। নিন, এইগুলো রেখে দিন। আর সরি আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।’
জুভান ফাইলগুলো গুছাতে গুছাতে বলল,
‘তাও যে তোমার সন্দেহ দূর হয়েছে সেটাই অনেক। আর তুমি চিন্তা করো না, জিহাদ যদি তোমাদের জমি জোর করে নিয়ে থাকে তবে আমি নিজে ঐ জমি তোমাদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করব, প্রমিস।’
স্মৃতি প্রত্যুত্তর করল না। চুপচাপ পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জুভান সব গুছিয়ে তার পাশে এসে শু’ল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে একসময় তদ্রাচ্ছন্ন হলো। কিন্তু স্মৃতি আর দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বুকের ব্যাথায় পুরোটা রাত সে ছটফট করল। নিম্নবিস্তারীনিবিড় নিশিতে তার নিউরনগুলো সতর্ক হয়ে উঠছিল। তারা তার দিকে বার বার প্রশ্ন ছুড়ছিল,
“স্মৃতি, তুই আবার তোর বাবার খু/নির সাথেই সংসার করছিস না তো?”
চলবে…