#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
৩
ইলার চিৎকার শুনে সকলে খাবার রেখেই ছুটে এলো। অন্যদিকে আওয়াদ নিজ উদ্যোগে ফোনটা কেটে দিলো। তার যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। তোহফা রেস্টুরেন্টে নিজেকে সামলে নিলেও এবার নিজেকে সামলে নিতে পারেনি। সে জ্ঞান হারিয়েছে। আওয়াদ ভাবুক হয়ে শুধু বললো,
“কাজল চোখের মেয়ে এভাবে কেনো জ্ঞান হারালে? সামনে গেলে নিশ্চিত তোমার পরিবার আমাকে জেলে ঢুকাবে। এই ব্যাকুল হওয়া হৃদয় নিয়ে আমি এখন কোথায় দাঁড়াবো? ভাবছি দক্ষিণা বাতাসে নাম ঠিকানা বিহীন একটা চিঠি পাঠাবো।”
গটগট আওয়াজ তুলে মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যানে শব্দ হচ্ছে। পিটপিট করে তোহফা চোখ খুলে তাকাতেই তার বুকে ভারি কিছু অনুভব হলো। ভালো করে লক্ষ করে দেখতেই বুঝলো তার মা তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এই মূহুর্তে সে কোথায়। খেয়াল করলো নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। উত্তরের জানালা গলে সূর্যের তেজি রশ্মি চোখে মুখে আছড়ে পরছে । ফুরফুরে বাতাসে জানালার পর্দা তিরতির করে কাঁপছে। ঘড়ির কাঁটা এখন কোথায় থেমেছে সেটা তোহফা জানে না। ঘরের সাদা রঙের দেয়ালের চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে সময় দেখার জন্য দেয়াল ঘড়িটা খুঁজলো। অবশেষে না পেয়ে তার মনে পরলো ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে দু’দিন আগেই! ছোট ভাই তৌহিদ বলেছে শুক্রবার একটা নতুন ঘড়ি কিনে নিয়ে আসবে। তোহফার মাথা প্রচন্ড পরিমাণে ভারি হয়ে আছে। কোনোমতে ডান হাতটা সরিয়ে মাথায় দিতেই জাহানারা বেগমের ঘুম ছুটে গেলো। তিনি চোখ খুলে তাকাতেই দেখলেন তোহফা জেগে আছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলে তোহফার মাথায়, গলায় হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পর বুকে মমতার সাথে জড়িয়ে নিলেন তোহফাকে। মায়ের বুকের সাথে তোহফা মিশে গেলো ছোট্ট বাচ্চাদের মতো করে। জাহানারা বেগম নরম সুরে গরম কিছু কথা বললেন,
“কতোবার বলেছি বৃষ্টিতে তুমি ভিজবে না। কিন্তু আমার কথা কে শোনে? তুমি কেনো বোঝো না, তোমার কিছু হলে এই বাড়িতে পুরো অন্ধকার নেমে আসে। এতো ছোট হলে কীভাবে হবে তোহফা? আমায় বলবে একটু। গতকাল বিকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ঘরের প্রতিটা সদস্য কীভাবে সময় কাটিয়েছে তুমি জানো সেটা? একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে সেন্স হারিয়ে ফ্লোরে পরে গেলে। গোটা একটা রাত তুমি বেহুঁশ হয়ে এই বিছানায় পরে ছিলে জ্বরের জন্য। আর কবে বড়ো হবে একটু বলো আমায়?”
মায়ের কথায় তোহফা অবাক হলো। সে কাল বিকালে জ্ঞান হারিয়ে ছিলো আর আজ সকালে তার জ্ঞান ফিরেছে? আল্লাহ! এতোটা সময় সে সেন্স হারিয়ে পরে ছিলো। এসব ভাবার কিছুক্ষণ পরই তোহফার বুকটা ধক করে উঠলো আওয়াদের কথা মনে করে। ওই লোকটার জন্যই তোহফা জ্ঞান হারিয়ে ছিলো তখন। লোকটার সাথে তার কোন জন্মের শত্রুতা যে ওভাবে দেখা হলো। হে আল্লাহ বেছে বেছে এমন সুপুরুষের সাথেই কেন আমার দেখা করালে যে তাকে দেখলেই হার্টবিটের গতি বেড়ে যায়। দুনিয়ায় অন্ধকার নেমে আসে। মনে হয় পুরো পৃথিবী নিয়ে আমি ঘুরছি।”
তোহফাকে অন্যমনস্ক দেখে জাহানারা বেগম বলেন,
“কি ভাবছো?”
“হু।”
“কি ভাবছো সেটা জিজ্ঞেস করেছি?”
“কিছু না।”
“ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
জাহানারা বেগম হাই তুলতে তুলতে চলে গেলেন ঘর থেকে। ওদিকে তোহফা মগ্ন হয়ে শুধু আওয়াদের কথাই ভাবতে রইলো। ইসস! মানুষটা কি ভাবলো কে জানে? আচ্ছা সে যখন জ্ঞান হারিয়েছিলো তখনও কি আওয়াদ ফোনকলে ছিলো? কিছু বুঝতে পারেনি তো? যদি ভুল বুঝে তার জন্যই তোহফার এই অবস্থা হয়েছিলো, কেমন হবে তখন? ধূর কি হবে! তার সাথে কি তোহফার দেখা হচ্ছে নাকি? দেখা করার কথা ভাবতেই তোহফা লাফিয়ে উঠে বসলো। তার অতি শখের মোবাইল ফোনটা যে তার কাছেই রয়ে গেছে। এবার উপায়? ফোনটা যতোই তার কাছে থাকুক সে ভুলেও যোগাযোগ করবে না ওই লোকটার সাথে। তাহলে মোবাইল? মোবাইল পাবে কীভাবে? আচ্ছা কুরিয়ার করতে বলবে, না হোমডেলিভারি করতে বলবে ফোনটা৷ না, না কিছু করা যাবে না। লোকটা তাহলে বাড়ির ঠিকানা পেয়ে যাবে। তাহলে কি করবে? নিজের ফোনটা তো তার চাই, চাই। আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়, লোকটাকে কোথাও ডেকে তার কোন বান্ধবীকে লোকটার কাছে পাঠিয়ে ফোনটা নিয়ে নিবে। ব্যস তাহলেই তো কাজটা হয়ে যাবে। এ মা না, যদি তার বান্ধবী আওয়াদকে দেখে তার মতোই পুরো পৃথিবী ভুলে যায়। জ্ঞান হারিয়ে আওয়াদের বুকে ঢলে পরে? যদি আওয়াদ তার বান্ধবীর প্রেমে পড়ে যায় তখন? না, না এসব কিছু করবে না সে। কাউকে নিবেও না, আর কুরিয়ার করতেও বলবে না। সে সরাসরি আওয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কোনো রকম কথা না বাড়িয়েই ফোনটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চলে আসবে। আচ্ছা তার দেওয়া ছাতাটাও তোহফার কাছে আছে, সেটা কি নিয়ে যাওয়া উচিত? নিজের ফোন নিয়ে এসে আর উনার ছাতা ফেরত দিয়ে ওখানেই সমস্যার সমাধান করা উচিৎ। কিন্তু সমস্যা তো অন্য কোথাও। যদি হাতের সাথে স্পর্শ লেগে যায় তখন উপায়? আল্লাহ! তোহফা পাগল হয়ে যাবে এসব ভাবতে ভাবতেই। নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে রইলো ঠিক তখনই খাবার হাতে ইলা ও লিমা ঘরে প্রবেশ করলো। লিমা তোহফার গা ঘেঁষে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বললো,
“এখন কী খবর তোমার?”
তোহফা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“ভালো।”
ইলা টি-টেবিলে খাবার রেখে নিজেও তোহফার গা ঘেঁষে বসে বললো,
“এভাবে ভয় দেখাতে আছে পঁচা মেয়ে! সবাই তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো।”
তোহফা মন খারাপ করে উত্তর দিলো,
“আমি ইচ্ছে করে করেনি ভাবি। বিশ্বাস কর।”
তোহফার আহ্লাদী কথায় দুই জা একসাথেই হেসে দিলো। তারা এই বাড়িতে পা রাখার পর বুঝতে পেরেছেন তোহফা এই বাড়ির প্রাণ। তোহফার কিছু হলে পরিবারের প্রতিটা সদস্য পাগল হয়ে যায়৷ কারো নাওয়া খাওয়ার ঠিক থাকে না। সময়ের কাঁটা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থামে তারও কোনো দিক থাকে না। পরিবারের প্রতিটা মানুষ দিকবিদিকশুন্য হয়ে ঘুরতে থাকে। তারা শুনেছিলো একদিন তোহফা পরে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিলো কোনভাবে। সে কি কান্না! সেই কান্না সহ্য করতে না পেরে তৌসিফ আর তৌহিদ দু’দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে বোনকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করেছে, শুধুমাত্র তার কান্না থামানোর জন্য । তোহফা কান্না করায় বাড়িওয়ালা বিরক্ত প্রকাশ করেছিলো। সেই বিরক্ত একসময়ে কথা কাটাকাটি পর্যায়ে চলে যায়। বাড়িওয়ালা সেদিন রাগের বসে বলেছিলো “এতোই যখন মেয়ে নিয়ে আহ্লাদে আটখানা, তাহলে নিজের বাড়ি বানিয়ে সেখানে গিয়েই থাকুক। ভাড়া বাড়ি থাকে কেনো?” বাড়িওয়ালার কথা শুনেই তার শ্বশুর এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা টিনের ঘর বানিয়ে এখানে উঠেছিলো নিজের স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে। আজ সেই টিন শেড বাড়ি তিনতলা হয়েছে। তাদের খুব বেশি সম্পদ না থাকলেও যা আছে, আলহামদুলিল্লাহ অনেক। জমজমাট বাজারের মধ্যে তাদের একটা চালের ব্যবসা আছে। তৌসিফ আর তৌহিদ বড় হয়ে নিজেদের পছন্দের পেশা বেছে নিয়েছে। সকলের জীবনের গতিপথ পাল্টে গেলেও মেয়ের প্রতি বা বোনের প্রতি ভালোবাসা তাদের একচুল পরিমাণও কমেনি! বরং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে। এমন ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য লাগ্ কথাটা ভেবেই লিমার চোখের কোণে জল জমলো। তারও একজন বড়ো ভাই ছিলো। এক্সিডেন্টে মারা গেছেন তিনি। অবশ্য এই বাড়িতে এসে বড়ো ভাইয়ের মতো একজন ভাসুর পেয়েছে। তবুও বুকের মাঝে মৃত ভাইটার জন্য এখনো ব্যথা অনুভব হয়। লিমার চোখের কোণে জল দেখে ইলা সযত্নে সেই চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো,
“ভাইয়ের কথা মনে পরছে?”
লিমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইলা লিমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
“দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।”
ইলার কথায় লিমা বললো,
“আমিন।”
ইলা লিমাকে জড়িয়েই তোহফাকে বললো, ফ্রেশ হয়ে এসো। মা এসে যদি দেখে তুমি এখনো ফ্রেশ হওনি তাহলে রাগ করবে।”
ভাবির কথায় তোহফা একটু ভাব নিয়ে বললো,
“তুমি ছোট ভাবিকে এমন ভাবে জড়িয়ে আছো মনে হচ্ছে আমি না সে অসুস্থ। এই মুহূর্তে আমি হিংসা, হিংসা অনুভব করছি।”
তোহফার কথায় দুই জা হেসে দিলো। দু’জনেই এগিয়ে এসে তোহফাকে বুকে জড়িয়ে নিলো পরম আদরে। তোহফা দুই ভাবির গালেই টুকটুক করে দু’খানা চুমু দিলো। তিনজনই একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠলো। তাদের হাসির ঝংকার ছড়িয়ে পরলো পুরো ঘরময় । সেই শব্দে দুই ভাইও চলে এলো তোহফার ঘরে। এমন সুন্দর পরিবেশে নিজেদেরও সামিল করতে ভুললো না তারা। সবাই মিলে তোহফাকে ঘিরে ধরলো। মধ্যমনি হয়ে তোহফা জ্বলজ্বল করে উঠলো হিরার মতো। একসাথে তাদের দেখে জাহানারা বেগম এবং আরিফুল ইসলামের চোখ জুড়িয়ে যায়। মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট শুকরিয়া আদায় করতে বলে উঠলেন “আলহামদুলিল্লাহ”। তাদের সংসারের মধ্যমনি যেনো সব সময়ই এমন হাসি খুশি থাকে। স্ত্রীর নিকট কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আরিফুল ইসলাম তাকালেন। চোখের কোণে খুশির জল। পর্দার আড়ালে থেকে তার সুখী সন্তানদের দেখে স্ত্রীকে বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে বললেন,
” কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি আল্লাহর নিকট। আলহামদুলিল্লাহ তিনি তোমায় আমার জন্য নির্বাচন করেছেন। এমন স্ত্রী হলে ইনশাআল্লাহ এমন একটা সুখী পরিবার সবাই পাবে।”
স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকারে জাহানারা বেগমের চোখে অশ্রু জমলো। তবে চোখের জল আড়াল করে তিনি বললেন,
“হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। খেতে দিচ্ছি আসো।”
আরিফুল ইসলাম বেজায় মুখ কালো করে বললো,
“এই হচ্ছে মহিলা মানুষের রোগ। বদনাম করলে রেগে যায়, সুনাম করলে ঢং দেখায় যত্তসব।”
রাগ দেখিয়েই আরিফুল ইসলাম চলে গেলেন। জাহানারা বেগম নিজের চোখের জল আড়াল করে ছেলে ও বউদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বোনকে আদর করা হলে সবাই খেতে এসো। এই মেয়ের আদর খাওয়া একটা বদঅভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত শীঘ্রই পারি বিয়ে দিয়ে বিদায় করবো। এই এক মেয়েই আমার সংসারে ঝড়ের তান্ডব তোলার জন্য যথেষ্ট। এই মেয়ের জন্য যতো ক্ষতি সব বক্ষঃস্থলের ভেতরেই হয়। বাহিরে তো সাজানো গোছানো শো-পিস হয়ে রয় সবাই।”
মায়ের অভিযোগে তোহফা মুখ ভার করে ভাইদের দিকে তাকালেই তারা একসাথে বলে উঠে,
“ওই আকাশের শুভ্র হাসি, আমরা বড্ড বেশি ভালোবাসি। রাগ করে না চাঁদের কণা, আনবো কিনে রাজপুত্র সহ তিমির রাতের চাঁদের জোছনা।”
ভাইয়ের কবিতায় এবার খিলখিল করে হাসলো তোহফা। একসাথেই দুই ভাইয়ের বুকে পরম আদরে মিশে গেলো। এমন ভাই বোনের বন্ধন দেখে ইলা, লিমাও হাসে। তাদের এই বন্ধন দেখতে ভালোই লাগে। সংসারের খুশি ধরে রাখতে তারা চা্ তোহফা সারাজীবন এমন আদরেই থাকুক সবার মাঝেই।
পড়ন্ত বিকেল। কাঠফাটা রোদের তাপমাত্রা কিছুটা কম। উত্তরের জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভাবুক মনে তোহফা কিছু ভাবছে। তার ভাবনায় এই মুহূর্তে কে জায়গা দখল করে আছে বোঝা মুশকিল। পিরপির হাওয়া ছুঁয়ে যায় ক্ষণেক্ষণে তার মুখমন্ডলে। এলোমেলো করে যায় তার লালচে-সোনালি চুলগুলো। জানালার কাঁচ পুরোপুরি সরিয়ে দিতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে পড়ন্ত বিকেলের শীতল পরশ। তোহফা হাসে, আবারও মন খারাপ করে আনমনা হয়ে যায়। আবারও কিছু একটা ভেবে লজ্জা পায় তো কখনো বিরক্ত। হঠাৎ সে অনুভব করে কেউ তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তোহফা পিছন ঘুরে তাকায়, দেখতে পায় ইলা দাঁড়িয়ে। ভাবিকে দেখে তোহফা মুচকি হাসে। ইলা তোহফার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলে,
“মন খারাপ?”
তোহফা উত্তর দেয়,
“উঁহু।”
“তুমি কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করছো কী?”
“না।”
“তোমার অসুস্থতার কথা শুনে একজন মেহমান তোমায় দেখতে এসেছে। তাঁকে ভেতরে আসতে বলবো?”
“বলো।”
“আচ্ছা।”
ইলা তটস্থ ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। তোহফা আবার সামনে ঘুরে নিজের অবস্থান আগের ন্যায় করে ফেলে৷ কিছুক্ষণ পর ইলা মেহমান নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে “তোহফা” বলে ডেকে উঠে। তোহফা পিছন ঘুরে তাকাতেই তার হার্টবিট আবারও থেমে যায়। কারণ মেহমানটা অন্য কেউ না, স্বয়ং আওয়াদ যে। আওয়াদকে দেখে তোহফা আবারও নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পর্দার কাপড় হাতের মধ্যে মুঠো করে ধরে নিজেকে সামলে নেওয়ার অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে ভাবির সামনে তার কিছু হলে আওয়াদের রক্ষে নেই। হয়তো তার পরিবার মনে করবে আওয়াদ খারাপ লোক তাই তোহফার এমন হয়েছে। তবে সত্যি বলতে তোহফার এমন করুণ পরিণতির জন্য তো আওয়াদ দায়ী নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেকে স্থির রাখা কোনো মতেই হয়ে উঠছে না। ওদিকে তোহফাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলা বলে,
“তোহফা, উনি তোমাকে দেখতে এসেছে। বসতে বলো।”
তোহফা কীভাবে তার ভাবিকে বলবে, “ভাবি এই লোক আমার বিছানায় বসলে নির্ঘাত আমার আরামের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। তাকে দেখে যদি আমার হার্টঅ্যাটাক হতে পারে। আমি নিশ্চিত এই বিছানায় সে বসলে আমার অবস্থা হার্টঅ্যাটাকের থেকেও ভয়াবহ হবে।” অন্য দিকে তোহফাকে জড়বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলা চোখ গরম করে তাকালো। তাতে কাজ হলো না। তাই ইলা বাধ্য হয়ে তোহফার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস আওয়াজে বললো,
“তোহফা কি হচ্ছে এসব? তিনি তোমার ফোনটা দিতে এসেছেন। এমন ভালো মানুষ হয় না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার জন্য হলেও তোমার উনাকে বসতে বলা উচিত। ”
ইলার কথায় তোহফা চোখ তুলে একবার ভাবির মুখপানে তাকালো। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে ঝটপট বললো,
“বসুন।”
তোহফার এমন আচরণে ইলা ভারি অবাক হলো। সাধারণত তোহফা এমন তো করে না। তাহলে আজ কি হলো? কোথাও অসুস্থ বোধ করছে বলেই এমন করছে না তো? ইলা চটজলদি তোহফার মাথায় গলায় হাত ছোঁয়ায়। ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই তোহফা লাফিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। ইলা বললো,
“কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে কী? তুমি বসো আমি মা’কে ডেকে আনছি এখনি। আর দয়া করে একটু ভালোমন্দ কথা বলো উনার সাথে। আমি এখনি যাবো আর আসবো।”
ইলা চলে যেতেই তোহফার অস্বস্তি দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। আওয়াদ তখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইলা বেরিয়ে যেতেই পকেট হাতড়ে আওয়াদ ফোন বের করলো। হাত বাড়িয়ে তোহফার নিকট এগিয়ে দিতেই তোহফা ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালো। তোহফার এমন আচরণে আওয়াদ শুধু হাসলো। ফোনটা বিছানার উপর রেখে ধীর পায়ে তোহফার দিকে এগিয়ে গেলো। তোহফা পুরোপুরি নিজেকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে ততোক্ষণে। পারলে সে দেয়াল ভেদ করে ঢুকে যায়। আওয়াদ আবার স্মিত হেসে বললো,
“দয়া করে ভুল করে হলেও মেয়ে তুমি জ্ঞান হারিয়ো না। তাহলে জেল ফাঁসি থেকে আমাকে আজ কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আচ্ছা, তুমি আজ চোখে কাজল দাওনি কেন? কাল কি তবে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেই চোখে কাজল দিয়েছিলে? তবে আজও খুন হলাম তোমার ওই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া দেখে। মেয়ে তুমি বড্ড বেশিই সুন্দর। সুন্দর তোমার হাসি, সেই সাথে সুন্দর তোমার এলোমেলো কেশের বেণীখানি। তবে বেণীর গোড়ায় কিছু একটা নেই। কি নেই, কি নেই! ও মনে পড়েছে একটা টকটকে লাল গোলাপ নেই। টকটকে লাল গোলাপ বেণীর গোঁড়ায় না দিয়ে আমার সামনে এলে আমি তোমার নামে জরিমানা দাবি করবো। সেই জরিমানা হয় ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা, না হলে মনের বদলে মন। মনে রেখো জরিমানার অর্থটা।”
আওয়াদ আর কথা বাড়ালো না, সে চলে গেলো। তার যাওয়ার পথে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তোহফা। আওয়াদের বলে যাওয়া প্রতিটা শব্দ গোছানোর চেষ্টা করলো। তবে সবটাই এলোমেলো হয়ে শৈথিল্যের হাওয়ায় ভেসে গেলো বুঝি।
ইন শা আল্লাহ চলবে…..