অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-১৩+১৪

0
341

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৩
#তাশরিন_মোহেরা

আমি মুখরের দেওয়া শাস্তিটা মাথা পেতে নিতেই মুখর একগাল হাসলো। সেই অনেকক্ষণ যাবৎই হাসছে সে। প্রাণখোলা হাসি। আর আমি তার এই অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা দেখছি অপলকভাবে। এমন সুন্দর হাসিটা লুকিয়ে না রাখলেও তো পারে মুখর!

কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝপথে খেয়াল করলাম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রূপন্তী। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে মুগ্ধ-মুখর দুজনেই পেছন ফেরলো। মুগ্ধ বিরক্তিতে পাশ ফিরলো তবে মুখরের মাঝে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। শুধুমাত্র চোখ মুখ আগের মতো কঠিন করে পাশে পানির পাত্রটা রাখলো সে। আমার দিকে তাকিয়েই ইশারা করলো কান ছেড়ে দাঁড়াতে। আমিও তাই করলাম। তবে মুগ্ধের মতো আমিও খুব বিরক্ত হলাম। মেয়েটা আবারো নক না করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। আশ্চর্য! এটা কি ওর বাসা নাকি যে যখন মন চায় ঢুকে পড়বে!
রূপন্তীও আমাকে দেখে কিছুটা চটলো। মুখরের সাথে ঢলাঢলি করতে এগোলেই মুখর এক হাত দিয়ে থামিয়ে বলে,

‘সামনে চলো, রূপন্তী!’

এই বলে মুখর হাত-মুখ ঝেড়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যায়। রূপন্তীও পেছন পেছন এসে ন্যাকামির সুরে বলে,

‘মুখর, আমি এতোদিন এখানে আসিনি বলে কি একটা ফোনও করতে পারলে না তুমি? আমাকে কি একদমই মিস করো না?’

আমি ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করলাম,

‘না রে কু”মিরে’র বা’চ্চা! তোকে মিস করার মতো সময় মুখর সাহেবের নেই।’

মুগ্ধ ব্যাগ নিয়ে আমার কাছে এসে বললো,

‘ম্যাম চলুন, এবার বের হই।’

আমিও আমার ব্যাগটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে রূপন্তী আরও পাশ ঘেঁষলো মুখরের। মুখর একবার আমার দিকে আড়চোখে চাইলো। তার মুখশ্রী দেখে মনে হলো সে বিরক্ত হচ্ছে! এবার আমার রাগ সব গিয়ে পড়লো মুখরের উপর। ছেলেটা কি মেয়েটাকে সরাসরি কিছু বলতে পারে না? বিরক্ত হলে বলবে, ‘আমার পাশ থেকে সরে বসো!’
ব্যস! কিন্তু তিনি বিরক্ত হচ্ছেন আবার কিছুই বলছেন না!

রূপন্তী বড় করে বলতে লাগলো,

‘শোনো না! আমি না পাপাকে বলে মুগ্ধ সোনার জন্য অন্য একটা টিচার ঠিক করেছি। ছেলেটা বুটেক্সে পড়ছে, বেশ ভালো। আমি নিজে তার সাথে কথা বলেছি। আগামীকাল থেকে প্রতিদিন বিকালে পড়াতে আসবে সে।’

একথায় আমি আর মুগ্ধ দুজনেই থমকালাম। পেছন ফিরে দেখি মুখরও ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে রূপন্তীর দিকে। এরপর সে বলে,

‘টিচার ঠিক করেছো মানে? মুগ্ধের জন্য তো টিচার অলরেডি আছেই।’

‘হ্যাঁ আমি জানি একটা টিচার আছে। তবে টিচারটা ঠিক নেই। আমাদের মিনি ডেভিলকে বেয়াদব বানাচ্ছে পড়ার বদলে। তুমি বরং মেয়েটাকে বিদেয় করে দাও।’

মুখর এবার চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। কঠিন গলায় বলে,

‘আর ইউ সিক, রূপন্তী? তোমাকে আমি একবারো বলেছি আমি মুগ্ধের জন্য নতুন টিচার রাখতে চাই? এসব আগ বাড়িয়ে কাজ করা বন্ধ করো, প্লিজ!’

রূপন্তী এবার ঘাবড়ালো। সে মুখরের হাত ধরতে গেলেই মুখর তা ছিটকে ফেলে দিলো। রূপন্তী এরপরও নরম সুরে বললো,

‘আমি আসলে মিনি ডেভিলের কথা ভেবেই এটা করেছি। তুমি বুঝছো না মেয়েটা কতো বড় বেয়াদব!’

মুগ্ধ এবার ফুঁসে উঠে সামন্র এগিয়ে মুখরকে বলে,

‘ভাইয়া, আপুটাকে বলো আমাকে মিনি ডেভিল না ডাকতে। আর আমি অন্য কারো কাছে পড়বো না। শুধু ম্যাম থাকলেই হবে।’

এই বলে মুগ্ধ এসে আমার হাত জড়িয়ে ধরে। আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো হঠাৎ। অদ্ভুত এক মায়া কাজ করলো ছোট ছেলেটার প্রতি। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

মুখর এবার দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বলে,

‘আমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া বন্ধ করো, রূপন্তী। তুমি ভেবো না এর জন্য দ্বিতীয়বার আমি তোমাকে সুযোগ দেবো। মুগ্ধের জন্য মিস.তিথিয়া-ই যথেষ্ট। আমি চাই না মুগ্ধের টিচারকে নিয়ে তুমি ফারদার আর কোনো বাজে কথা বলো। মিস.তিথিয়ার প্রতি রাগ, ক্ষোভ সবটাই ঘরের বাইরে দেখাবে। আমাদের পরিবারের মাঝে আর এসো না তুমি! নেক্সট টাইম আমি তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো না, মাইন্ড ইট!’

এটুকু বলেই মুখর থমথমে পায়ে চলে যায় ভেতরে। তার চোখে আগুন ঝরছে যেন। রূপন্তী এটুকুতেই ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দিলো। আমার দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো সে। তবে আমি ওসবে পাত্তা না দিয়ে পেছন ফিরে বেরিয়ে আসি। রূপন্তীকে বলা মুখরের কথার প্রায় অর্ধেকই আমি বুঝিনি। তবে এটুকু বুঝেছি শুধু মুগ্ধই নয় বরং মুখরও একজন টিচার হিসেবে আমায় বেশ পছন্দ করেছে। আজ আমি একটু বেশিই খুশি! অন্যরকম এক খুশি উপচে পড়ছে পুরো শরীর জুড়ে। বাইরে বেরিয়েই মন ভরে একটা শ্বাস নিলাম। চোখ বন্ধ করতেই মনে মনে ভীষণ ধন্যবাদ জানালাম কিছুক্ষণ আগের সেই কঠিন মানুষটাকে। যে কিনা নিজের অজান্তেই আমায় খুশি করে দিয়েছে! বারবার পানি ছুঁড়ে মারা লোকটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তার রাগ, দুঃখ সবটাকেই আমি অদ্ভুতভাবে ভালোবাসি। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়েই মন মাঝে প্রতিজ্ঞা করলাম,

‘আমার প্রেমে না পড়া অবধি আপনার নিস্তার নেই, মুখর সাহেব।’

আকাশের মাঝ থেকেও যেন গুনগুনিয়ে শুনলাম,

‘আমিও আজীবন আপনার বেড়াজালে বন্দি থাকতে চাই, মিস.তিথিয়া।’

পরক্ষণেই আমার গালটা কেমন যেন গরম হয়ে উঠলো। দু’হাতে মুখটা ধরে লজ্জাটা ঢাকতে চেষ্টা করলাম, হলো না। উল্টো মুখরের মুখশ্রী ভেসে উঠায় আরও লালরঙা হয়ে উঠলাম। এ কেমন উথাল-পাতাল অনুভূতি? এ কেমন অগোছালো আমিকে টের পাচ্ছি দিন দিন?

.

রাতে ব্রাশ করে ফোন নিয়ে বসলাম। হালকা ফেসবুক চালিয়েই শুয়ে পড়বো, এমন সময় ফোনের শব্দে চমকে উঠলাম। একবার চোখ বুলিয়েই বুকটা কেঁপে উঠলো। সাথে সাথেই বিছানায় রেখে দিলাম ফোনটা। ভাইব্রেট হয়ে সারা বিছানা কাঁপাচ্ছে ফোনটা। তবে এই কাঁপুনি আমার শরীরের কাঁপুনি থেকে বেশি নয়! কয়েকবার রিং হয়েই ফোনটা কেটে গেল। আমি কাঁপা হাতে ফোনটা আবারো নিলাম, দেখি মিসড কল হয়ে গেছে। নাম্বারটা আরেকবার চেক কর‍তেই দেখি একই নাম্বার থেকে আবারো কল আসছে। আমি ফোনটা হাতে নিয়েই চুপচাপ বসে রইলাম। অতিরিক্ত ভয়ে আমার ঘাম ছুটলো। তখনি দেখলাম দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। বিরক্ত হয়ে ফোনটা পাশের টেবিলে রেখে দিলাম। দরজা খুলতেই দেখি আব্বা এসেছেন। ইনি প্রায় সময়ই ঘুমানোর আগে আমার রুমটা একবার পর্যবেক্ষণ করে যান। মা’কে সরাসরি সন্দেহ করলেও আমায় ঠিক তেমনটা সরাসরি কিছু বলতে পারেন না। তবে আমি বুঝি, বেশ বুঝতে পারি যে আব্বার পুরোনো অভ্যাস বদলায়নি। এতো সহজেই কি কেউ কারো অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে? ঠিক যেমন মুখরের এই রাগ, এই কোমলতা! সে যতই খুশি থাকুক তার চেহারায় তা কখনো প্রকাশ পায় না। সর্বক্ষণ লোকটা মুখটাকে কঠিন করে রাখে। এতো সুন্দর হাসি দিব্যি লুকিয়ে রাখে গাম্ভীর্যে!
হঠাৎ করেই মাথায় মুখরের ভাবনা উদয় হওয়ায় জিভ কাটলাম আমি। এ মুহুর্তে তার ভাবনা কিংবা অভ্যাস মনে করার কোনো কথা-ই নয়! অথচ আমি এখানেও ছেলেটাকে নিয়ে ভাবছি! একে কি নিজের অবনতি বলবো না উন্নতি, বুঝতে পারলাম না!

ফোনটা টেবিলের উপর শব্দ করেই বেজে উঠলো আবার। আমি ফের চমকালাম। সাথে চমকালো আব্বাও! আব্বা পেছনে দুইহাত মুট করে চারপাশে ঘুরে দেখছিলেন। ফোনের শব্দে টেবিলের উপর চোখ রাখলেন তিনি। আমি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম আগের নাম্বারেই কল এসেছে আবার। চিন্তিত ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে একবার আব্বার দিকে দেখলাম। তিনিও আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন। হয়েছে রে! কলটা আব্বার সামনেই আসতে হলো! আব্বা আর ফোনের মাঝে পড়ে নিজেকে বেসামাল মনে হলো। এটা ওটা ভাবতেই মিসড কলের লিস্ট আরও একধাপ বাড়লো। আব্বা সেদিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,

‘কে ফোন দিয়েছে?’

আমি ইতস্তত করে বললাম,

‘কই? কেউ না!’

আব্বা আবারো জহুরি চোখে দেখলেন। আমি চোখ সরিয়ে ফোনের দিকে দেখে বললাম,

‘ও-ওইযে! রবি অফিস থ-থেকেই কলটা এসেছিলো আব্বা, হাহা!’

অপ্রস্তুত হেসে নিজের ভয়টা দূর করতে চাইলাম। কিন্তু তা বোধহয় হলো না! আব্বা কঠিন গলায় বললেন,

‘ইদানীং তুই রুমে কি করিস বল তো? আগে খানিকক্ষণ পর পর এসে আমাকে দেখতি! আর এখন খুব কমই বের হোস রুম থেকে। ঐ রূপক ছেলেটার সাথে কিছু চলছে না তো তোর?’

রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো। মানুষটা কি আজেবাজে বলছে! এতোদিন পরীক্ষা থাকার কারণে অনেকটা সময় আমার রুমেই কাটাতে হয়েছে। আব্বাকে আমি একথা বলেছিলাম ক’দিন আগে। কিন্তু আজ তো সেকথা একেবারে ভুলতে বসেছেন তিনি। আর তাতে জড়াচ্ছেন রূপক ভাইকে! আশ্চর্য তো!

আমি কপট রাগ নিয়ে বললাম,

‘আব্বা আপনি যা ভাবছেন এমন কিছুই হচ্ছে না! আর রূপক ভাই আমার বড় ভাইয়ের মতোই! আজেবাজে চিন্তা ভাবনা বাদ দিন, আপনার জন্যই ভালো হবে।’

আব্বা আমার রাগে ঘি ঢেলে আরো বললেন,

‘সে যে কেমন ভাই তা আমার জানা আছে! আমি তোর এ বয়স অনেক আগেই পার করে এসেছি রে! উল্টাপাল্টা কিছু করে আমার সম্মানহানি করিস না।’

আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,

‘আব্বা আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। সন্দেহ জিনিসটা মা’কে আপনার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে। এখন আমাকেও দূরে যেতে বাধ্য করবেন না।’

এই বলে হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমি। ফ্রিজ থেকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে তা ঢকঢক করে পুরোটাই পান করলাম। মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। যে ভুল আমি করিনি তা নিয়ে কথা শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগলো না।
সোফায় ধপাস করে বসে টিভিটা ছাড়লাম। তাতে গান চলছে আর আমি একধ্যানে তা দেখতে লাগলাম। গানটা আমার ভীষণ অপছন্দের। তারপরও তা দেখছি আমি। পলকহীন দেখছি! কেননা এ মুহুর্তে মন আমার অন্য ভাবনায় ডুবে আছে। আমি মনে মনে বিড়বিড় করলাম,

‘নিজের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার ভয়ে আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন না। কাউকে ভালোবাসাটাও নিষিদ্ধ! আমিও যে একটা মেয়ে, আব্বা। প্রেম অনুভব করার যোগ্য আমিও! তবে কেন এতো নির্দয় হচ্ছেন আপনি? এতোটা নিষ্ঠুর নিজের মেয়ের সাথে কোনো বাবা-ই কি কখনো হয়েছে?’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৪
#তাশরিন_মোহেরা

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই শুনছি রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। কিছুটা সন্দেহ হলো আমার। এই সকালবেলা সুমির তো আসার কথা না! আর আব্বা ঘুম থেকে উঠেনই বেশ বেলা করে। তবে? এই সকালবেলা কে এমন টুংটাং ধ্বনি তুলছে? হাত-মুখ না ধুয়েই দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে দৌঁড় দিলাম। রান্নাঘরে পা রাখতেই দেখি আব্বা চুলোর ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। বেসিনে হাত ধুচ্ছেন, তাও চোখ মুখ খিঁচে। আমি তড়িৎ এগিয়ে দেখি তিনি হাতটা পুড়ে ফেলেছেন চায়ের পাত্র ধরতে গিয়ে। ধমকে আব্বাকে বললাম,

‘কি করছেন আপনি, আব্বা?’

আমি ব্যস্ত পায়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে এক টুকরো বরফ এনে হাতে লাগিয়ে দেই। এমন সময় আব্বা গদগদ হয়ে বললেন,

‘তোর জন্য সকালবেলা উঠে নাস্তা বানাচ্ছিলাম। অনেকদিন তো বানাই না, তাই হাত পুড়ে ফেললাম।’

আমি রাগ নিয়ে বললাম,

‘কেন আব্বা? আমি কি বলেছি আপনাকে নাস্তা বানাতে? আমি নিজে উঠেই বানিয়ে খেয়ে যেতাম।’

আব্বা মুখটা তৎক্ষণাৎ মলিন করে বললেন,

‘রাগটা একদম মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিস। তাই তো সবসময় ভয় পাই কখন আমাকে একা ফেলে চলে যাস!’

আমার ঈষৎ রাগ লাগলেও কিছু বললাম না। মানুষটার কষ্টও বুঝি আমি। মা চলে যাওয়ার পর অনেকটা বছর আমরা দুজন একা কাটিয়েছি। তারপরও একাকিত্বটাকে আপন করে নিতে পারিনি আমি কিংবা আব্বা কেউই। উল্টো একাকিত্বের ভয়ে দিনের পর দিন আরো চুপসে গিয়েছিলাম। অন্ধকার আর একাকিত্বে একপ্রকার ভীতি জন্মে গিয়েছে আমাদের। তাই তো আব্বা স্ত্রী চলে যাওয়ার পর আর কাউকেই হারাতে চান না। আমি এসব ভেবে কিছুটা নরম হলাম। আব্বাকে বললাম,

‘আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না, আব্বা। কাল রাগের মাথায় ওসব বলে দিয়েছি। ভয় পাবেন না।’

আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম আদরে। মানুষটা ঈষৎ পাগল হলেও মনটা ভীষণ ভালো তার। যাকে ভালোবাসেন তাকে শক্ত হাতে শেষ অবধি আগলে রাখতে চান। কিন্তু এই ঢালটাই তাকে সবার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেন।
আমি চুলগুলো হাত খোপা করে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিলাম। আব্বাকে আসতে বলে আমিও চেয়ার টেনে বসলাম। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরতে যাবো এমন সময় আব্বা আমার হাতটা ধরে থামিয়ে বললেন,

‘আজ আমি খাইয়ে দেই, মা?’

আব্বার এই ছোট্ট অনুরোধটা আমি না করতে পারলাম না। হাসিমুখে সম্মতি জানালাম। আব্বা রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে আবারো গম্ভীর হয়ে যান। আমার দিকে রুটিটা এগিয়ে দিয়ে বলেন,

‘ভালোবাসা বড্ড ভয়ংকর রে। মাঝে মাঝে এটি দানবাকৃতির রূপ ধারণ করে মানুষকে গিলে খায়। অন্ধকার সাগরে চুবিয়ে মারে।’

আমি এবার বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘তো এসব আপনি এখন আমাকে কেন বলছেন?’

আব্বা আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

‘আমি বুঝতে পেরেছি তুই রূপক ছেলেটাকে পছন্দ করিস। কিন্তু তাই বলে আমার চাঁদের টুকরো মেয়েটাকে তো আমি পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারি না। ছেলেটা তোর যোগ্য নয় রে, তিথি। এ পৃথিবীতে কোনো ছেলে-ই তোর যোগ্য নয়। ছেলেটাকে তুই ছেড়ে দে।’

রাগে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়ালো। আব্বার হাতটা ছিটকে উঠে দাঁড়ালাম। অতিরিক্ত রাগে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা-ই বেরুলো না। থমথমে পায়ে মুখে কিছু না দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আব্বা পেছনে অনেকবারই আমাকে ডেকেছেন, কিন্তু আমি শুনিনি! লোকটা একটা বদ্ধ পাগল। হাতের উল্টোপিঠে চোখ জোড়া মুছে মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

‘এই পাগল লোকটাকে ছেড়ে তুমি মুক্ত, মা! সাথে কি আমাকেও নিয়ে যেতে পারলে না? তখন তোমার হাত ধরে চলে গেলে আজ এই দিন আমার দেখা লাগতো না, তাই না?’

.

আব্বার উপর রাগ দেখিয়ে কাল রাতেও ভালো মতো ঘুম হলো না। আর এদিকে সকালেও লোকটা আমায় রাগিয়ে দিয়েছে। তার এমন কান্ডে মুগ্ধকে পড়াতে আসতেও তাই দেরি হয়ে গেল। মুখে কিছু দিয়ে না আসায় ক্ষিধেটাও পেয়েছে বড্ড। ঘুমঘুম চোখে বসে আছি। মুগ্ধ সকালের নাস্তা বানাতে ভাইকে সাহায্য করছে। মুখরের রান্নার হাত আগে থেকে বেশ উন্নত হয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু না পারলেই দৌঁড়ে আমার কাছে ছুটে আসে। রান্নাবান্নায় বেশ আগ্রহ তার! ভাবছি, বিয়ের পর বেশ মজা হবে। আমি দুপুরের খাবার রাঁধলে, মুখর রাঁধবে রাতের খাবার। আবার কোনো সময় এ নিয়মের বাইরে গেলে যে দু’বেলা রেঁধে খাইয়েছে তাকে অপরজন স্পেশাল কিছু বানিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। বাহ! জম্পেশ এক সংসার হবে আমাদের।

‘ছিঃ এসব কি ভাবছিস, মুখপুড়ি! তোর আব্বা না তোকে এতো কিছু শুনিয়েছে? তারপরও শিক্ষা হলো না তোর?’
‘প্রেম তো এ জীবনে একবারই এলো। আর প্রথম প্রেমকে কি এতো সহজে ভোলা যায়? যায় না গো!’
‘আবেগের বশে নিজের প্রিয়জন হারালে তো আজীবন দুঃখই কপালে জুটবে। এমন অনেকেই বাবা-মা’র মনে পাথর মেরে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে পালিয়ে যায়, একটু ভালো থাকার আশায়। কিন্তু তাদের ভালো থাকাটা কি আদৌও হয় এরপর?’

মনটা আমার এবার চুপসে গেল। মুখরের প্রেমে পড়েছি অবধি আমার মন আর মস্তিষ্কের প্রায় সময়ই দাঙ্গা লাগতে শুরু হয়েছে। বেপরোয়া মনটা সবকিছুতেই মুখরকে ধরে টেনে আনে। এদিকে সজাগ মস্তিষ্ক বারবার ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দিতে চায় মুখরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় কার হবে তা-ই ভাববার বিষয়!

ঘাড়টা এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে ঢুলুঢুলু শরীর নিয়ে মাথাটা রাখলাম টেবিলের উপর। যেন এখনি আমার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নামবে। তবে এ অবস্থাটা আমার জন্য ভীষণ অস্বস্তির হওয়ায় ঘুম এলো না। তবে চোখের তন্দ্রাটাও এখনো যায়নি। মাথাটা তুলে ঘাড়টা আবারো ম্যাসেজ করলাম কিছুক্ষণ। বেশ ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা! ভালো ঘুম না হওয়ায় এমনটা হচ্ছে।

মুগ্ধকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়িয়েছি আজ। সারাটাক্ষণ আমি ঘাড়টা এদিক ওদিক করেছি। একদিন ঘুম না হওয়ায় শরীরটাও কেমন ভেঙে পড়েছে। ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছি, তখনি দেখলাম মুখর পাশে এসে আমায় বললো,

‘কাল আপনাকে তিনবার কল দিয়েছি, ধরেননি যে?’

গতকাল মুখরের ফোন পেয়ে আমি যে পরিমাণ ভয় পেয়েছি তা এ মুহুর্তে মুখরকে বলা সম্ভব নয়। আমি খানিক ইতস্তত করে বললাম,

‘ইয়ে, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।’

অপ্রস্তুত হেসে বিষয়টা উড়িয়ে দিলাম। মুখরও এ বিষয় নিয়ে তেমন প্রশ্ন করলো না আর। মুখর এবার কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললো,

‘পরশু মুগ্ধের জন্মদিন। কিছু কেনাকাটাও বাকি ছিলো তাই কল দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি কি আজ ফ্রি আছেন?’

আমি মুখরের কথা শুনেছি, তবে কিছু বলতে পারছি না। ভীষণ দূর্বল লাগছে আমার। ভাঙা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছি আমি। এমন সময় কিছু না ভেবেই মুখরের বাহুতে আমার মাথাটা কাত করে রাখলাম। এতে মুখর কিছুটা কেঁপে উঠে বললো,

‘মিস.তিথিয়া?’

আমি ক্ষীণ স্বরে অনুরোধ করে বললাম,

‘প্লিজ মুখর সাহেব। কিছুক্ষণ এভাবেই থাকুন।’

মুখর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

‘আপনি ঠিক আছেন, মিস.তিথিয়া?’

আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছি মুখরের বাহুতে মাথা রেখেই। অন্য সময় হলে বোধহয় এ মুহুর্তটা আমি বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে উপভোগ করতাম! কিন্তু এখন মাথাটা ভীষণ ধরেছে। তাই কিছুই ভালো লাগলো না।

সে মুহূর্তেই মুগ্ধ চিৎকার করতে করতে আসে,

‘ভাইয়া, আমার টিফিনটা দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’

চিৎকার করতে করতে সে ড্রয়িংরুমের দিকেই আসছে। আর মুখরের বাহুতে আমার মাথা রাখার দৃশ্যটা মুগ্ধের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে মুখর ছটফট করতে থাকে হঠাৎ। এরপর চট করে মুখর তার বাহু দিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দূরে দাঁড়ায়। তবে তার ধাক্কায় আমি টাল সামলাতে পারলাম না। শরীরের সবটুকু ভর নিয়েই নিচে পড়ে যাই। মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে সিলিংফ্যানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এরপর গুনগুন করে বললাম,

‘এমনটা না করলেও পারতেন, মুখর সাহেব! আমার ভাগ্যটাই আসলে পোড়া।’

এই বলে আমি চোখ বুজলাম। আর কানে ভাসছে মুগ্ধ-মুখরের চিৎকার,

‘মিস.তিথিয়া? মিস.তিথিয়া, ঠিক আছেন? ম্যাম! ম্যাম!’

(চলবে)