#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৫
#তাশরিন_মোহেরা
দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ঘুমের পর আড়মোড়া ভেঙে উঠলাম। চোখ জোড়া বন্ধ করেই ডান বাহুটা বাম পাশে ফিরিয়ে এবং বাম বাহুটা ডান পাশে ফিরিয়ে হালকা সহজ হলাম। এই অভ্যাসটা আমার বেশ পুরোনো। এরপর চোখ ঢলে তা খুলতেই দেখলাম মুগ্ধ আর মুখর আমার সামনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ জোড়া তখনও সম্পূর্ণ খুলিনি। আর এর মধ্যেই ভাবছি, ঘুম থেকে উঠেই সচরাচর সর্বপ্রথম আমি আব্বা কিংবা সুমিকে দেখি। কিন্তু এখন সামনে মুগ্ধ-মুখর কি করে? তখনই হঠাৎ মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। চোখ দুটো ভালোমতোন কচলে আমি চারপাশটা একবার দেখলাম। এই মুহুর্তে আমি মুখরের রুমে অবস্থান করছি। মুখরের নরম বিছানায় আমার শুইয়ে দিয়েছ কেউ। কিছুক্ষণ আগেই মুখর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ায় আমি চিৎপটাং হয়ে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। এরপর? এরপর আমি মুখরের রুমে কিভাবে এলাম? তবে কি আমাকে কোলে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে? কিন্তু মুখর ছাড়া তো আমাকে কোলে নেওয়ার মতো শক্তি কারও নেই। তবে কি? তবে কি আমার স্বপ্নের মুখর সাহেবই আমাকে কোলে করে রুমে এনে শুইয়ে দিয়েছে?
নাহ! আমি আর ভাবতে পারছি না। কিছুই ভাবতে পারছি না। আমার হৃদপিণ্ডটা যেন এখনই লাফিয়ে আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সবটাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। মুগ্ধ আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
‘ম্যাম, আপনি হঠাৎ তখন পড়ে গিয়ে বেহুশ হয়ে গিয়েছিলেন। আর এখন উঠলেন। কি হয়েছিলো আপনার?’
আমি বোকা বোকা চোখে মুগ্ধের দিকে চেয়ে আছি। বেহুশ হয়েছি মানে? আমার তো শুধু একটু ঘুম পেয়েছিলো। কেন আমি শুধু শুধু বেহুশ হতে যাবো? আমার ছাত্র এসব আমায় কি বলছে?
তখনই মুখর সামনে এসে গম্ভীরমুখে বললো,
‘সকালে কিছু খেয়ে এসেছিলেন আপনি?’
আমি তার কথা শুনে দু’দিকে মাথা দুলালাম। অর্থাৎ আমি কিছু খেয়ে আসিনি। আমার এই উত্তরে হঠাৎই মুখর রেগে যায়। আমার সামনে পায়চারি করে বলতে থাকে,
‘ঠিক! আমার ধারণা-ই ঠিক। কেন আপনি কিছু না খেয়ে আসতে গেলেন, বলুন তো? এজন্যেই তো সকালে দূর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন!’
আমি চমকে তার দিকে চেয়ে আছি। কিসব ভাবছে দুইভাই? সকালে আমার দূর্বল লাগছিলো ঠিক তবে তা খাবারের জন্য নয়। রাতে ঘুম না হওয়ার দরুন আমার প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছিলো বলেই তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
মুখর আমার মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লো। এরপর আমায় বললো,
‘যখনই আপনাকে কোলে নিয়ে এখানে এনেছি তখনই বুঝেছি খাবারের প্রতি আপনার একটুও মন নেই। তাই তো এতো শুকনো, আস্ত একটা ক’ঙ্কা’লে’র মতো!’
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে শূন্য মস্তিষ্কে বললাম,
‘কিন্তু মুখর সাহেব, আমি তো আগে কখনো ভেজা ছিলাম না। মাঝে মাঝে আপনি পানি মারেন বলেই তো ভিজে যাই।’
মুখর সাহেব তার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠে সাথে সাথে,
‘আর ইউ কিডিং মি অর আর ইউ ডাম্ব? আমি বলতে চাইছি আপনি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই চিকন আর ছোট!’
নিজের ভুলে নিজেই জিভ কাটলাম। আসলে ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছে আমার। কি বলছি কি শুনছি যেন নিজেই জানি না।
মনে মনে বিশাল এক অঙ্ক কষলাম। বড্ড ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে এ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। প্রথমত, এই বোকা দুইভাই ভাবছে আমি কিছুক্ষণ আগেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছি। তাদের চোখমুখ জুড়ে আমার জন্য ভীষণ আ’ত’ঙ্ক কাজ করছে। যা দেখে মনে মনে কিছুটা খুশিই হলাম আমি। এখন যদি তাদের আ’ত’ঙ্কে জল ঢেলে আমি ফাঁস করে দেই আমি আসলে জম্পেশ এক ঘুম দিয়েছি তবে সবটাই ভেস্তে যাবে। চিন্তার বদলে এরা আমাকে নিয়ে বিরক্ত হবে। এই ভুলটুকু আমি কিছুতেই হতে দেবো না। তাই চরম এক মিথ্যা আমার বলতে হবে যেকোনো মতেই।
দ্বিতীয়ত, আসলে দ্বিতীয় ব্যাপারটা বলতে আমার কেমন লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে! মুখর সাহেব আমায় কোলে নিয়েছে! ইশ! ভাবতে পারছিনা আমি। ভাবতেই মুখ দুটো লাল হয়ে উঠছে আমার। আচ্ছা মুখর আমাকে কিভাবে কোলে তুলেছিলো? নিশ্চয়ই সিনেমার হিরোর মতো পাজাকোলে আমায় বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। হায়! যদি আমার চোখটা খানিকক্ষণের জন্য খোলা রাখতাম! পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, মুখর যখন আমায় কোলে তুললো আমার শরীর থেকে কোনো বাজে স্মেল আসেনি তো? কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটেনি তো? এই যেমন ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে কথা বলার অভ্যাস আছে আমার। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বলে ফেলিনি তো আমি? মুহুর্তেই লজ্জার বদলে একরাশ ভয় জমা হয়েছে।
মুখর ফোনে ব্যস্ত হয়ে রুম ছাড়লেই আমি মুগ্ধকে টেনে আমার পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমি ঘু.. মানে বেহুশ হয়ে যাওয়ার পর কি হয়েছিলো আমায় একটু বিস্তারিত জানাও তো বাবা!’
মুগ্ধ নড়েচড়ে বসে বললো,
‘যখন আপনি বেহুশ হয়ে গেলেন তখন আমি আর ভাইয়া অনেক ডাকাডাকি করার পরও আপনি উঠলেন না। ভাইয়া তখন ভয়ে পেয়ে আপনার নিশ্বাস আছে কিনা দেখলো, যদি আবার মরে টরে যান তাই। যখন বুঝলো আপনি বেহুশ হয়েছেন ঠিক তখনই…’
আমি অতিরিক্ত উত্তেজনায় তাকে থামিয়েই বললাম,
‘ঠিক তখনই?’
মুগ্ধ এবার বললো,
‘জ্বি বলছি। ঠিক তখনই সিনেমার ভি’লে’ন’দে’র কি’ড’ন্যা’প করার মতো আপনাকে তুলে ভাইয়া রুমে এনে শুইয়ে দিয়েছে।’
এটুকু শুনেই আমি আবারো প্রশ্ন করলাম,
‘ভি’লে’ন’দে’র মতো মানে বুঝলাম না! কি’ড’ন্যা’প করে ওভাবে তুলেছেন উনি?’
মুগ্ধ উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বললো,
‘জ্বি ম্যাম! ভাইয়া আপনার পা দুটো ধরে এইভাবে তুলেছিলো আর আপনার হাত আর মাথা দুটোই ভাইয়ার পিঠে ঝু’ল’ছি’লো। আমার খুব হাসি পেয়েছিলো তখন। কিন্তু আমি একদমই হাসিনি তখন।’
এই বলে মুগ্ধ ঠোঁট টিপে ভীষণ হাসলো। এদিকে তার এই বিবরণ শুনে মনের ইচ্ছেরা ভে’ঙে চু’র’মা’র হয়ে গেল আমার সঙ্গে সঙ্গেই। সাথে মুখরের উপর চরম রাগ করলাম। এরপর মুগ্ধ আমায় প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কিন্তু ম্যাম! আপনি বেহুশ হয়েও ওরকম আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন কিভাবে?’
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মানে? কেমন আরাম করে?’
মুগ্ধ বললো,
‘যখন ভাইয়া আপনাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয় তখনই আপনি ঘুমের মধ্যে ভাইয়ার কোলবালিশটা নিয়ে তার উপর পা তুলে দিলেন আর বালিশটা জড়িয়ে ধরে অনেক আরামে ঘুমালেন।’
আমি ক্ষণিকেই ধরা পড়ে গেলাম। কোলবালিশ নিয়ে শোয়ার অভ্যাস আছে আমার। যেখানেই যাই কোলবালিশ আমার নিয়ে যেতেই হয়! না হয় আমার ঘুমটা ভালোমতো হয় না। এবার মুগ্ধকে কি বলা যায়? বেচারাদের কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না আমি আসলে ঘুমুচ্ছিলাম। মুগ্ধকে বললাম,
‘আসলে এটিও বেহুশ হওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য বুঝলে? বেহুশ হয়ে গেলে আমরা কিছু একটা জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে পো’ষ’ণ করি। এজন্যই আমি অজান্তে তোমার ভাইয়ের বালিশটা জড়িয়ে ধরেছিলাম আরকি। হাহা!’
অপ্রস্তুত হেসে মুগ্ধকে বোঝালাম ব্যাপারটা। যার সম্পূর্ণটাই মি’থ্যে! মুগ্ধ বোঝার মতো করে বললো,
‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি!’
আমি মনে মনে খোদার কাছে বারবার মাফ চাইতে লাগলাম। এমন একটা মিথ্যা কথা বলতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। তখনই মুখর রুমে ঢুকে কিছু মনে পড়ার ভান করে বললো,
‘ওহ হ্যাঁ! আপনাকে গরু ফোন দিয়েছিলো।’
তার এমন অদ্ভুত কথায় আমি আর মুগ্ধ একে অপরের দিকে তাকালাম। কি বাজে বকছে ছেলেটা? ভ্রু কুঁচকে দুজনেই একসাথে বললাম,
‘মানে?’
মুখর আমার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘মানে কিছুক্ষণ আগে আপনার ফোনে ‘গরু’ নামের একজন কল করেছিলো।’
আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ও তাই বলুন!’
মুখর সাহেব মুগ্ধের পাশে বসেই বেশ গম্ভীর হয়ে বললো,
‘প্রথমে ভেবেছি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গরুর ডাকের মতো মু মু শব্দ শুনবো। পরেই দেখলাম ওপাশে একটা ছেলে আমায় ‘তিথু, তিথু’ করছে।’
আমি আর মুগ্ধ মুখরের কথায় হো হো করে হেসে উঠলাম। সেকেন্ড খানেক আমাদের হাসি থামলোই না। এ হাসিতে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলো। আমি একগাল হেসে বললাম,
‘মুখর সাহেব, আপনিও মজা করতে পারেন! বিশ্বাস হলো না। যাই হোক, জোকসটা কিন্তু ফা’টা’ফা’টি ছিল।’
এই বলে আমি আবারো হেসে দিলাম। আমার হাসিতে মুখর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিন্তু অন্যবারের মতো আমি আজ তার দৃষ্টিতে হাসি থামালাম না। সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
‘এটা মজা ছিলো না, অভিয়াসলি!’
এরপরই সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘একটা ছেলের নাম ‘গরু’ দিয়ে সেভ করলেন ফোনে, নিশ্চয়ই অনেক ক্লোজ আপনারা, তাই না?’
আমিও মুচকি হেসে বললাম,
‘জ্বি, ভার্সিটির এক বড় ভাই। গতবছরই পরিচয় হলো।’
মুখর রুমটা ত্যাগ করতে করতে কঠিন গলায় বললো,
‘এক বছরেই এতো ক্লোজ? বাহ! ভালোই তো!’
মুখরের মুখভঙ্গি আমার চোখে পড়লো না। তবে তার কথার সুরটা কেমন যেন ঝাঁ’ঝা’লো শোনালো আমার কানে। একরাশ অভিমান নিয়ে কথাটুকু বলে গেল যেন!
(চলবে)
#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_১৫ (বোনাস পর্ব)
#তাশরিন_মোহেরা
আমি হিজাবটা ভালোমতো ঠিক করে বাসায় রওনা দেওয়ার কথা ভাবছি। তখনই পেছন হতে ডাক পড়লো,
‘মিস.তিথিয়া, কোথায় যাচ্ছেন? কাজ আছে, বসুন।’
আমি পেছন ফিরে বললাম,
‘জ্বি বলুন। আমি বেশিক্ষণ বসতে পারবো না। রূপক ভাইয়ের সাথে কিছু কাজ বাকি আছে।’
মুখর কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘কাজটা কালও তো করতে পারেন, তাই না? ঐ গরুটা তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না।’
আমি দু’হাত কোমরে গুঁজে তার সামনে এগিয়ে এসে বললাম,
‘তার তো একটা নাম আছে, রূপক। বারবার গরু গরু করছেন কেন বলুন তো!’
মুখরও ঠিক একইভাবে কোমরে হাত গুঁজে বললো,
‘আমার তাকে গরু ডাকতেই ভালো লাগছে, বুঝলেন?’
আমি বাম হাতটা আমার থুতনিতে রেখে বেশ ভাব নিয়ে বললাম,
‘আচ্ছা, মুখর সাহেব? আপনি কি রূপক ভাইকে নিয়ে জেলাস?’
ঠিক তখনি মুখর সাহেব যথারীতি একগ্লাস পানি এনে আমার মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারলেন। আমি রাগ নিয়ে বললাম,
‘আজব তো! আপনি বারবার আমাকে এভাবে পানি ছুঁড়ে মারেন কেন, মুখর সাহেব?’
সে ডাইনিং টেবিলে জগ আর গ্লাসগুলো ঠিক করে রাখতে রাখতে বললো,
‘আমার ভালো লাগে তাই।’
আমার রাগ এবার সীমা ছাড়িয়েছে। ভালো লাগে বলে কি ছেলেটা যাচ্ছেতাই করবে? আমি রাগটা দৃশ্যমান রেখে বললাম,
‘সব ভালো লাগার কাজ তো সবসময় করা যায় না! আমি কিভাবে এখন ভার্সিটি যাবো এই ভেজাভাব নিয়ে?’
মুখর এবার বাঁকা হেসে বললো,
‘বেশ হয়েছে! এবার গরুটাকে বলুন যা কাজ আছে তা কালকের জন্য রেখে দিতে। আজ আর আপনি আসতে পারছেন না। তাছাড়া আপনার সাথে আমার কাজ আছে, বললামই তো।’
আমি তার কথায় অবাক হয়ে পারলাম না। আমিও তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
‘আপনার সাথে আমার কি এমন কাজ আছে যে রূপক ভাইকে আমার নিষেধ করতে হবে?’
মুখর আমার সামনে কিছুটা ঝুঁকে বললো,
‘আপনি আজ আমার সাথে একটু বেরোবেন। পরশু মুগ্ধের জন্মদিনের কারণে কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।’
‘আপনি এসব কি বলছেন? আমি কি করে আপনার সাথে কেনাকাটা করতে যাবো? আশেপাশের মানুষ কি বলবে বুঝতে পারছেন?’
‘ওতোসবের ধার ধারি না আমি। আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন, ব্যস!’
‘আমায় নিয়ে গেলে তো আবার রূপন্তী আপু রাগ করবে। আপনি বরং আমায় নিয়ে না গিয়ে রূপন্তীকে নিয়ে যান।’
কথাটা বলে আমি পাশ ফিরলাম। আমায় কথায়ও বেশ একটা ঈর্ষা কাজ করছিলো। মুখর আমায় ধমকের সুরে বলে,
‘এক কথা বারবার বলাটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। আমি যখন বলেছি আপনাকে নিয়ে যাবো তার মানে আমি আপনাকেই নিয়ে যাবো। আর আপনি ঐ রূপক না গরু তার সাথে সময় নষ্ট না করে বরং আমার সাথে চলুন, কাজে লাগবে।’
আমি বেশ বুঝতে পারছি লোকটা আগুনের অনলে জ্বলছে। ভীষণ জ্বলছে! আমি তাই খুশিতে গদগদ হয়ে তার দিকে ফিরে বললাম,
‘আপনি কিন্তু সত্যিই এখন ঈর্ষান্বিত, মুখর সাহেব।’
মুখর আমার দিকে ফিরে আমার চোখে চোখ রাখলো। আমি আঁতকে উঠলাম কিছুটা। সে চোখে চোখ রেখেই বললো,
‘আপনি কি চান আমি আপনাকে আরও একগ্লাস পানি ছুঁড়ে মারি? হুম?’
আমি হালকা কেঁশে চোখ নামিয়ে বললাম,
‘দেখুন, পানি অপচয় করা কিন্তু খুব গুনাহ্। একদিন দেখবেন পানি না পাওয়ায় কষ্ট পাবেন।’
মুখর ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
‘অভিশাপ দিচ্ছেন?’
আমি মাথা দুলিয়ে বোঝালাম হ্যাঁ অভিশাপ দিচ্ছি। তখনই মুখর হেসে বলে উঠলো,
‘কিন্তু শকুনের অভিশাপে গরু মরে না।’
একথা শুনে রাগে আমি ফুঁসতে লাগলাম। অগ্নিদৃষ্টিতে মুখরের দিকে চেয়ে আছি। এতো বড় অপমান মেনে নেওয়া কঠিন। আমার দৃষ্টিতে বাঁকা হেসে মুখর ভেতরে চলে গেল।
অতঃপর, কিছুক্ষণ পর মুগ্ধকে নিয়ে অর্কের বাসায় পৌঁছে দিলো সে। সাথে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম শপিংয়ের উদ্দেশ্যে।
ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে মুখরের সাথে হাঁটতে। যদিও সে আমার কয়েক কদম আগে আগেই হাঁটছে। আর আমি তার পেছনে বেশ জড়তা নিয়ে হেঁটে চলছি। বারবার এদিক ওদিকে তাকাচ্ছি, কেউ আমাদের সন্দেহ করছে কিনা! নাহ! কারোরই বোধহয় সে সময় নেই। কিছুদূর হেঁটে এবার গাড়ি নেওয়ার পালা। মনে মনে দোয়া পড়ছিলাম মুখর যাতে রিকশা না ডাকে। আমার দোয়া বোধহয় সৃষ্টিকর্তা শুনেছেন। মুখর সাহেব ডাকলেন একটা সিএনজি। আর আমায় ভেতরে বসতে দিয়ে সে বসলো সামনের সিটে অর্থাৎ ড্রাইভারের পাশে। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মানুষটাকে। কিন্তু ভেতরে বসতেই সিগারেটের একটা বাজে গন্ধ পেলাম। ড্রাইভারটা মনের সুখে সিগারেট টানছে। নাক চেপে বসে আছি ভেতরে। ঘ্রাণটা সহ্য করা যাচ্ছে না আর। কিন্তু এতোদূর আসার পর গাড়ি থেকে নেমে যাওয়াটাও ভালো দেখাবে না। মুখর সাহেবকে বিরক্ত করাটা মোটেও উচিৎ না। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে মুখর নিজেই বলে উঠলো,
‘ভাই, সিগারেটটা এবার ফেলে দিন। ঘ্রাণটা ভালো লাগছে না।’
ড্রাইভার এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
‘আপনের সমইস্যা হইলে পিছে বউয়ের পাশে গিয়া বহেন।’
ড্রাইভারের কথা শুনে ভীষণ চমকালাম আমি। বউ? কার বউ? কে আমার স্বামী? এভাবে অবিবাহিত একজন মানুষকে সাথে সাথেই বিবাহিত বানিয়ে দিলো লোকটা?
মুখরও দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
‘সামনে ভেতরে সবখানেই সমস্যা হচ্ছে। সিগারেটের ঘ্রাণ কারোরই সহ্য হয় না। দয়া করে সিগারেটটা ফেলুন।’
ড্রাইভারটা এবার জেদ করে বলে উঠে,
‘বেশি সমইস্যা হইলে নাইম্মা যান। অইন্য গাড়ি দেহেন গিয়া মিয়া।’
মুখর সাহেব কিছুটা চটলো মনে হলো। আমার দিকে ফিরে সে নরম সুরে বললো,
‘বেশি অস্বস্তি হচ্ছে? অন্য গাড়ি দেখবো।’
আমি হিজাব দিয়ে নাকটা চেপেই বললাম,
‘না না, অযথা ব্যস্ত হবেন না। ঠিক আছি আমি!’
ড্রাইভার মুখর সাহেবের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো,
‘ভাইজান কি নতুন বিয়া করছেন নি? লজ্জায় ভিত্রে বইতাছেন না! আরে আমিও এমন আছিলাম, নতুন বউরে পাইয়া সে কি লজ্জা পাইছিলাম আমি। কি আর কমু!’
ড্রাইভার ফিসফিসিয়ে কথাটা বলার ভান করলেও তার প্রত্যেকটা শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মুহুর্তেই লাল হয়ে উঠলাম আমি। এদিকে মুখর খুব বিরক্ত হলো। কিন্তু কিছু বললো না। বাইরে তাকিয়ে আছে সে। এতে ড্রাইভারটা আরও সাহস পেলো। তার আর তার বউয়ের কাহিনি জুড়ে দিলো। সাথে মুখরকেও হালকা পরামর্শ দিচ্ছে। আমার এবার খুব বিরক্ত লাগলো। তার প্রত্যেকটা কথায় সিগারেটের গন্ধটা আরো গাঢ়ভাবে নাকে আসতে লাগলো আমাদের। অতিষ্ঠ হয়ে বললাম,
‘গাড়ি থামান। থামান বলছি!’
ড্রাইভার আর মুখর দুজনেই আমার কথায় চমকে উঠলো। ড্রাইভারটা বলে উঠলো,
‘এইহানেই থামবেন আপনেরা?’
আমি বললাম,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এখানেই থামবো। মুখর সাহেব, নামুন!’
আমরা দুজনেই নেমে পড়লাম। টাকা দেওয়া হলে আমি ড্রাইভারের সামনে গিয়ে বললাম,
‘প্রথমে বলে রাখি আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। দ্বিতীয়ত গাড়িতে কোনো প্যাসেঞ্জার নিলে সিগারেটটা ফেলে দিবেন। অন্য কোনো সময় যদি আপনাকে গাড়িতে সিগারেট খেতে দেখি তবে এই সিগারেটটা দিয়েই আপনার মুখটা ঝলসে দেবো, মনে রাখবেন!’
এইটুকু বলে আমি মুখরকে নিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম। মুখরকে ধমকে বললাম,
‘ড্রাইভারটা যে এতো কিছু বললো, আপনি বিপরীতে কিছু বললেন না কেন?’
মুখর হালকা হেসে বললো,
‘আপনিই তো সব বলে দিলেন। আমি আর কি বলবো বলুন?’
আমি তার বাহুতে একটা চাপড় মেরে বললাম,
‘মজা করছেন?’
মুখর আবার গম্ভীর হয়ে বললো,
‘এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। উল্টো মেজাজটাই খারাপ হবে অযথা।’
পরক্ষণেই ভাবলাম আসলেই তো! তবে আমি কি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি?
.
মলে গিয়ে বেশ কিছু ছোটখাটো জিনিস কিনলাম আমরা। মুগ্ধের জন্মদিন উপলক্ষে খেলনা গাড়ি, ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট-বল এসব কিছুই কিনেছে মুখর। ছোট ভাইয়ের সকল পছন্দের জিনিসই তার জানা আছে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো আমার। তাছাড়া ঘর সাজাতেও টুকটাক বেশ কিছু কিনলাম।
শপিং থেকে বেরোতেই প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘড়িতে সময় দেখেই জিভ কাটলাম। আব্বা বোধহয় বাসায় এতোক্ষণে অস্থির হয়ে পড়েছেন। আব্বাকে ফোন করতেই দেখলাম তিনি সাথে সাথে কল রিসিভ করেছেন। আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,
‘মা, তুই কি বাসায় পৌঁছে গেছিস? আসলে আমি একটু বের হয়েছি আজকে। আমার জন্য চিন্তা করিস না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘বেরিয়েছেন মানে? আপনার কি এখন একা বেরোনোর বয়স আছে? আব্বা, আপনি কোথায় বলুন, আমি আসছি।’
আব্বা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন,
‘একটু মার্কেটে এসেছি, মা। এখনই চলে আসবো। তুই ভাবিস না!’
এই বলে আব্বা ফোনটা তড়িৎ কেটে দিলো। আব্বা আমার কথা উপেক্ষা করেই ফোনটা কেটে দিলো। মুখর আমার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোনো সমস্যা, মিস.তিথিয়া?’
আমি তার দিকে না ফিরেই সামনে তাকিয়ে বললাম,
‘তেমন কিছু না।’
এটুকু বলতেই দেখলাম দূর থেকে আব্বা এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। বুকটা কেঁপে উঠলো তৎক্ষণাৎ। আব্বা হাঁটতে হাঁটতে এতোদূর চলে এসেছেন? ভয়ে আমি জড়সড় হয়ে আছি। এ মুহুর্তে আব্বা আমায় আর মুখর সাহেবকে একসাথে দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি পেছন ফিরে মুখর সাহেবের হাত ধরেই মলের পাশের গলিতে চলে গেলাম। হঠাৎ এভাবে টেনে আনায় মুখর বারবার আমাকে বলছে,
‘কি হয়েছে, মিস.তিথিয়া? কোথায় চললেন আপনি?’
সরু গলিটার মাঝ দিয়েই অবিরাম হেঁটে চলছি আমি। শূন্য মস্তিষ্কে কিছু ভাবার অবকাশ নেই আমার। দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই এগোচ্ছি। উদ্দেশ্য আব্বার নাগাল হতে নিস্তার পাওয়া! কেননা এ মুহুর্তে যদি আব্বার হাতে ধরা পড়ে যাই তবে আর কখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। উল্টো আম্মার মতো বন্দী জীবন কাটাতে হবে বছরের পর বছর। এ আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না। কেননা আব্বা বহু কষ্টে আগে থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। দমবন্ধ হয়ে হাঁটার মাঝপথে হেঁচকা টান পড়লো আমার হাতে। এই টানে টাল সামলাতে না পেরে কারো বুকের উপর গিয়ে পড়লাম। মানুষটার অপর হাত আমার মাথা ছুঁয়েছে। বুকটা দ্রিমদ্রিম গতিতে লাফাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটছে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি মুখর আমায় দু’হাতে তার বুকের মাঝে চেপে ধরেছে। পরক্ষণেই আমার দু’বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
‘কি করছিলেন আপনি? আরেকটু হলেই তো ম্যানহোলে পড়ে যেতেন।’
আমি পাশে তাকাতেই দেখলাম বিশাল এক ম্যানহোল, যার মুখে কোনো ঢাকনা নেই। পা ফসকে পড়লেই নির্ঘাত মৃত্যু! আমি অতিরিক্ত ভয়ে দু’হাত মুখে গুঁজে দাঁড়িয়ে পড়ি। কান্না পাচ্ছে আমার ভীষণ! মৃত্যুকে এতো কাছ থেকে দেখে যেন শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মনে তুমুল ঝড় বইছে! আচ্ছা? আমি যদি পা ফসকে পড়ে যেতাম তবে মুখর সাহেব কি করতেন? ম্যানহোলের উপর আঁচড়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতেন? আর আব্বা? আমার শোকে কি পাথর হয়ে যেতেন তিনি?
এমন অশুভ চিন্তার মাঝে মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। ঠোঁটে আমার কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটলো। এই হাত আমি চিনি! এই হাত আমার জীবন রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে আজ! আর এখন? পরম আদরে আমার সকল উদ্ভট চিন্তা আর ভয়দের দূর করছে! চোখ বেয়ে এক ফোঁটা আনন্দাশ্রু পড়লো আমার কপোল জুড়ে। মুখর আমার এই অশ্রুটুকু দেখে পাশ ফিরে বললো,
‘কেঁদে ভয়টুকু বের করে দিন। আমি দেখছি না, তাই নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারেন!’
এই কান্নার মাঝেও আমার খুব করে হাসি পেল। আমি মন মাঝে বললাম,
‘এতো ভালো হবেন না সাহেব! আরও গাঢ়তর প্রেমে পড়তে বাধ্য করছেন যে।’
(চলবে)