অন্যরকম ভালোবাসা ২ পর্ব-১০+১১

0
724

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১০

— “ইশরা সামান্য কিছুদিনের ব্যবধানে ভুলে গেলে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে। তবে কি জানো, বিয়ে আল্লাহ দেওয়া একটা পবিত্র সম্পর্ক। আমি চাই না, সেই সম্পর্কটা নষ্ট হোক। সেদিনের বলা হাজারো মিথ্যা কথা বলার মাঝে, এটাই সত্যি। আর সেটা হচ্ছে, আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি। রাতগুলো নষ্ট করে তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি! মেঘালয় ডাকটার শোনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি। কিন্তু আমার সেই অপেক্ষার প্রহর জীবনেও শেষ হবে না।”

কথন গুলো থামিয়ে ইশরার দিকে সরু চোখে অবলোকন করলো মেঘ। ইশরা ক্রমাগত কেঁপে চলেছে। কাঁপা কাঁপা হাত জোড়া ইশরার কাঁধে ঠেকালো। তড়িৎ গতিতে ধাক্কা দিয়ে অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো ইশরা। পূর্বের চেয়ে কম্পন আরো বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। সেপ্টে গেল লিফ্টের সাথে। যেন লিফ্টের অন্যপ্রান্তে কোনো অদৃশ্য দরজা লুকিয়ে আছে। যেটা সকলের অগোচরে ইশরা খুঁজে পেয়েছে। পরমুহূর্তেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁয়তারা শুরু করে দিলো সে। দুহাতে ক্রমাগত লিফ্টের বাটন চেপে চলেছে। প্রতিটা বাটনে ক্লিক করছে সে। ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে আলো নিভে গেল ভেতরের। ইতিমধ্যে লিফ্ট কাঁপতে কাঁপতে মাঝ পথে থেমে গেছে। তীব্র অন্ধকারে নেতিয়ে পড়লো ইশরা। দুহাতে মুখ মন্ডল ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মনে হচ্ছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি তার চরম সর্বনাশ করে ফেলবে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। সফল হলো না তার চেষ্টা। পিঠ ঘেঁষে বসে পড়লো নিচে। ক্ষীর্ণ আলো এসে ধরা দিলো লোচনে। মেঘ টর্চ জ্বালিয়ে ইশরা বলে ডাকছে। কিন্তু সেসব শোনার মতো মস্তিষ্কে নেই ইশরা।

ইশরা কষ্ট এবার হয়তো উপলব্ধি করতে পারল। দরজা খুলে গেল থার্ড ফ্লোরে। তপ্ত শ্বাস ত্যাগ করলো ইশরা। সময় অবিলম্ব না করে এক ছুটে বেরিয়ে গেল সে। লিফ্ট থেকে বের হতেই মুখ থুবড়ে পড়লো। সাথে সাথে হাতের কনুই পায়ের হাঁটু জ্বরে উঠলো ইশরার। পড়নের জিন্স অতিক্রম করে ভেতরটা ছিলে গেছে খানিকটা। হাত ফোসকে ইতিমধ্যে শার্টসহ মুঠোফোন টা মাটিতে পড়ে গেছে। ব্যাথায় ভেতরের শক্তিগুলোর ক্ষয় হয়ে গেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো ইশরা। মেঘ তার দিকে এগিয়ে আসছে। দ্রুত হাত ফসকে পড়ে যাওয়া জিনিস পত্রগুলো তুলে নিলো সে। ব্যাথার্থ পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালালো বেশ কিছুক্ষণ। কোনো রকম এলোমেলো পা ফেলে দৌড় এগিয়ে গেল ওজানার উদ্দেশ্য। তদানীং পেছনে ছুটে আসছে মেঘ।

আসতে আসতে এসে পৌঁছেছে থার্ড ফ্লোরের একদম অন্তিম প্রান্তে। সামনে যাওয়া মতো রাস্তা নেই। পেছনে ঘুরে অবলোকন করলো ইশরা। একপা একপা করে পিছুতে লাগলো সে। ভেসে এলো মেঘের কর্কট কন্ঠস্বর..

— “ইশু আর এগিও না, পড়ে যাবে।”

ইশরা মেঘের কথন কর্ণপথে নিলো না। মেঘের পায়ের গতির সাথে তার মিলিয়ে পিছুতে লাগলো। রেলিং এ ধাক্কা লেগে উল্টো হয়ে পড়ে গেল সে। তট জলদি হাত ধরে সামলে নিল মেঘ। ভেতরে চিপকে রাখা ভয়টা দ্বিগুণ হয়ে এলো ইশরার। ধমকের স্বরে বলল..

— ইশরা পাগল হয়ে গেছ তুমি? হাত কেন ছাড়াচ্ছো?

হুস ফিরলো ইশরার। নিচের দিকে তাকালো সে। তবে জীবনের সমাপ্তি ঘটবে না তার। জ্ঞানশূন্য হয়ে কি করতে চলেছে সে। এখান থেকে পড়লে কি হতে পারে ধারণা নেই তার। মেঘের স্পর্শে গাঁ গুলিয়ে উঠলো ইশরার। কোনো এক সময় এই স্পর্শটা গভীরভাবে মিস্ করত সে। আর আজ সেই সংস্পর্শ-টা ঘৃণায় গাঁ গুলিয়ে উঠছে। মনের কোণে আয়ান ছাড়া দ্বিতীয় কারো প্রতি ফিলিং নেই। উপরের দিকে তাকিয়ে নিভু নিভু গলায় বলল..

— “হাত ছাড়ো আমার। মেঘালয় হাত ছাড়ো বলছি..

নয়ন যুগল গ্ৰথণ হয়ে গেল মেঘের। শরীরের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হলো হিম শীতল ধারা। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল ধীরে ধীরে। ঘটে গেল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি। বিকট শব্দে নিচে পড়ে গেল ইশরা। কালো কুচকুচে দুটো কাক, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেছে অজানার উদ্দেশে। শরীর কাঁপানো শব্দে ধ্যান ভাঙলো মেঘের। দুকদম পিছিয়ে বসে পড়লো নিচে। ফিরে তাকানোর মতো সাহস খুঁজে পেল না সে। হার্ট দ্রুত গতিতে বিট করতে শুরু করেছে। হঠাৎ -ই ভেতরে ম্যাজিকের মতো সাহস ভড় করলো মেঘের ভেতরে। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। উঁকি দিল নিচের দিকে। নজরে এলো পরিচয় মানুষটার কিছু অংশ। হাতে থাকা প্যাকেটা-টা বক্ষের সাথে জড়িয়ে চাপা আর্তনাদ করছে সে। পুনরায় সেদিকে নজর দেওয়ার মতো সাহস খুঁজে পেল না। ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাওয়ার উদ্ধেগ হলো সে। সম্ভব হলে লাফ দিয়ে ইশরার কাছে চলে যেত।

_________________
সূর্যের রশ্মি বিদায় নিয়েছে আকাশের কোণ থেকে। অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে শহর। সূর্যহীন আকাশ হলেও লাল রঙের আভা গুলো রয়ে গেছে। খানিকক্ষণ পর তারাও বিদেয় হবে। ফিরবে আবার সূর্যের সাথে। আভা-গুলো যখন আকাশের বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো অভিজ্ঞ ডাক্তার। তমোনা আর রৌদ্র এগিয়ে গেলেন সেদিকে। সাথে শেফাও যোগ হয়েছে। ডা. সাহেব মুখে পরিধিত গাঢ় সবুজ রঙের মাক্স খুলে বলল.

— “আপনাদের ডাক হয়তো তিনি কবুল করেছেন! সিরিয়াস কোনো ইনজুরি ছিলো না। সারা দেহে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তবে মাথার আঘাতটা মারাত্মক ছিল। এখন পেসেন্ট ভালো আছে। একটু পর কেবিনে সিফ্ট করা হবে। তখন দেখা করবেন কিন্তু জাগাবেন না। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার কারণে শরীরটা প্রচুর দূর্বল। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ঘুমাতে দিন।”

হেঁটে চলে গেলেন তিনি। ভেতরে আঁটকে রাখা অসহায় শ্বাস ফেললেন ইশরার বাবা মা। অতিশয় চিন্তায় ব্যাপার-টা আয়ানের বাড়ির কাউকে জানানো হয়নি। ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রৌদ্র জুবায়ের। বেঞ্চিতে বসে পড়লেন তমোনা। শেফাও যেন প্রাণ খুঁজে পেল। তার ভুল সিদ্ধান্তে কি হতে চলেছিল ধারণা করা যায় নি।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করতে করতে রাত দশটার কাঁটার ছাড়িয়েছে। আয়ানের বাবা মা-সহ সকলে এসেছে। কেবিনে সিফ্ট করা হয়েছে ইশরাকে। জ্ঞান ফিরেছে তার। হাতে স্যালাইনের ক্যানেল লাগানো। নার্স খবর দিয়েছে প্রিয়জনদের। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সকলে। নিজের প্রিয় জনদের দেখে দূর্বল হাসি দিলো ইশরা। উঠে বসার চেষ্টা করতে ধমক দিলো তিথি। পুনরায় গাঁ হেলিয়ে দিলো। শেফা পাশে বসে কৌতূহলী কন্ঠে বলল.

— “কি এমন হয়েছিল। কি এমন ঘটেছিল যে, তুই ঝাঁপ দিতে গেলি। মেঘ যখন ফোন করে আমাকে সবটা জানিয়েছে, আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। সেই তোকে এখানে নিয়ে এসেছে। একদম সুপার-ম্যান স্টাইলে।”

কিছু বললো না ইশরা। তখন শরীরের ভেতরে অদৃশ্য যন্ত্রনা করছিল, যে করেই হোক তাকে মেঘের থেকে দূরে যেতে হবে। কিন্তু মেঘকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে বুঝতে পারল না।

বেশ টুকিটাকি কথা হলো সকালের সাথে। এবার সবার ফেরার পালা। সকলে যেতে চাইলেও তমোনা যাবে না। তার এক কথা, সে মেয়ের সাথে থাকবে। তার সাথে যোগ হয়েছে তিথি। সেও যাবে না। মায়ের এমন কথা শুনে, কষ্ট হলো খুব। এতো দিন এই মাকে তার প্রয়োজন ছিলো। মুখের ভঙ্গিমা সুচালো করে বলল..

— “বাবা তুমি মাকে নিয়ে যাও তো? আমার এখানে কাউকে থাকতে হবে না।”

— “তুই বললেই আমি চলে যাবো। যেদিন তুই হসপিটাল থেকে বাড়িতে যাবি, সেদিন আমিও একসাথে বাড়িতে ফিরবো। তার আগে নয়।”

উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল.

— “ঠিক আছে! তাহলে বাড়িতে চলো। বাড়িতে গেলে যদি আমি অসুস্থ হয়ে যাই, তাহলে যাবো। তোমাকে তবুও থাকতে দিবো না।”

তমোনা, তিথি দ্বিমত পোষণ করলেন না। মুখ গোমড়া করে বাড়িতে যেতে রাজি হলেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ইশরা। ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন তারা। এক্সিডেন্টের কথা আয়ানকে জানাতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে আয়ানকে ব্যাপারটা জানাতে চাইছে না। আদোও আয়ান জানলে, আসবে কি-না, জানা নেই তার। নয়ন গ্ৰথণ করে নিদ্রাচ্ছান্ন হওয়ার চেষ্টা চালালো। তার ঘুম আসবে না, সেটা‌ জানা কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।

ড্রয়ারের দ্বিতীয় তাকে ক্রমাগত ফোন বেজে চলেছে। সেই আওয়াজে বেষ্টিত নয়নজোড়া খুলে তাকালো ইশরা। ক্যানেল বিহীন হাত দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো চির পরিচিত কষ্ঠস্বর! কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নয়ন বেয়ে। এই মানুষটার জন্য এতোক্ষণ তার সবকিছু অস্তিত্ব হীন লাগছিলো। শিতলতি মেশানো কন্ঠে বলছে..

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓 [২]
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১১

— “ইশরা কি হয়েছে তোর, সারাদিন ফোন করেছি। কিন্তু তোকে পাইনি। ফেরার পথে তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি। বাড়িতে ফিরে দেখছি, এখানেও কেউ নেই। সবাই কোথায়?”

দাঁত কামড়ে ভেতরের কান্নাগুলো গলায় পেঁচিয়ে নিল ইশরা। এতোক্ষণ এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল.

— “এতো চিন্তা করার কি আছে আয়ান। আজ সবাই মিলে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। এতোক্ষণে হয়তো আঙ্কেল আন্টি বাড়িতে চলে গেছে।”

একটু মনযোগ স্থাপন করলো বাইরের দিকে। বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। কর্ণের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে বেরিয়ে গেল আয়ান। করিডোরে থাকা রেলিং এ হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। পা জোড়া গতিশীল করে রুমে প্রবেশ করলো। বেডের উপর সমস্ত শরীর হেলিয়ে দিল। ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল..

— “হ্যাঁ তারা পৌঁছেছে। আমাকেও বলতি, তোদের সাথে একটু ঘুরতে যেতাম।”

— “তুই তো কাজের মাঝে ব্যস্ত থাকিস তাই বলা হয়নি।”

দরজা খোলার শব্দে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো ইশরা। নীল ড্রেস পরিধিতা নার্স এগিয়ে আসছে তার দিকে। ইশরার পাশে বসলেন তিনি। তুলো দিয়ে কাঙ্খিত জায়গাটা পরিস্কার করে নিল। সিরিজে পর্যাপ্ত মেডিসিন নিয়ে নিলেন। ইশরার দিকে তাকিয়ে বললেন..

— “আপনার মাথায় আঘাত ম্যাম। কথা বলার ফলে মাথার টিস্যুতে পেসার পড়ে। বেশী কথা বলবেন না।”

ইনজেকশন টা ধীরে ধীরে ইশরার হাতের ঢুকিয়ে দিলেন। সিরিজটা ডাসবিনে রেখে পাতলা চাদরটা ইশরার বুক পর্যন্ত তুলে দিলেন। বললেন.

— “ম্যাম, মিনিট বিশেক পরে এসে দ্বিতীয় ডোস দিলেই আজকের মতো শেষ আবার কালকে। তারপর বাড়িতে চলে যাবো। ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করে কখন হসপিটাল থেকে বাড়িতে যাবো।”

জবারে শুধু হাসলো ইশরা। তদানীং অপর পাশ থেকে ভেসে এলো সূচালো কন্ঠস্বর..

— “ইশরা তুই হসপিটালে কি করছিস? দ্বিতীয় ডোস দিবে মানে কি? কোথায় তুই।”

নয়নজোড়া বেষ্টিত করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল ইশরা। নার্সের কথার ছলে সে যে আয়ানের সাথে কথা বলছিলো, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল..

— “কই না-তো? আমি হসপিটালে থাকতে যাবো কেন? আমি বাড়িতে।”

শ্বাস ছাড়ার আগে লাইন কেটে গেল। বুকে হাত রেখে হাঁফ ছাড়ল ইশরা। পরক্ষণেই ভয়টা তীব্র হয়ে এসেছে। আয়ান ফোন করেছে। তবে ভিডিও। চেয়ে রইল স্ক্রিনের মাঝে। বাজতে বাজতে কেটে গেলো ফোনটা। নিভে গেল স্ক্রিনের আলো। পুনরায় বেজে উঠলো ফোনটা। অডিও কল করেছে আয়ান। সংকোচ কাটিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো ইশরা। কর্ণের কাছে নিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলো । আয়ানের কর্কট কন্ঠস্বরে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আমতা আমতা করে বলল..

— “আমি এখন অপ্রস্তুত হয়ে আছি! এখন কথা বলতে পারব না।”

দাঁত কিরমির করে জবাব দিলো..– “তুই কোনো রুপসী সুন্দরী নয় যে, তোকে দেখতে কল করবো। রিসিভ করে রুমটা দেখা। নাহলে আন্টিকে ডেকে ফোনটা দে.। আমি তার সাথে কথা বলবো।”

অগোছালো কথাগুলো হারিয়ে গেল অজানায়। শূন্য হয়ে গেল মিথ্যা শব্দগুলো। ফট করে ফোন কেটে বন্ধ করে রাখল। বন্ধ ফোনের দিকে তাকিয়ে ড্রয়ারের উপর রেখে দিলো।

মিনিট বিশেক পর সয়ং আয়ান এসে হাজির হলো কেবিনের ভেতরে। আয়ানকে দেখে চমকে উঠলো ইশরা। বুকের ভেতরে অদৃশ্য ভয় ছড়িয়ে গেল। এই বুঝি কিছু একটা করে ফেললো। পড়নের ঘামার্থ শার্টটা এলোমেলো হয়ে আছে‌। টাই টা ঝুলে আছে কাঁধের পেছনে। উস্কোখুস্কো চুলে নজরকাড়া লাখছে তাকে। কিন্তু সেই অপলক দৃশ্য দেখার মতো সাহস হলো না ইশরার। মুখশ্রী ঘুড়িয়ে নিল অন্যদিকে। কিন্তু কোনো লাভ হলো বলে মনে হলো না। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এলো সে। একদম নেশাগ্ৰস্থ মানুষের মতো। বেডের একপাশে সামান্য পরিমাণে জায়গা করে অনায়াসে দখল করে নিল। গালে হাত রেখে ইশরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। ফিরল ইশরা। তদানীং নয়ন যুগল বেষ্টিত অতিশয় অন্ধকারে। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আরো প্রকট হলো সেই শব্দ। ঠান্ডা হাত ছোঁয়ালো ইশরার কুঁচকে যাওয়া ললাটে। অতঃপর সেই স্পর্শ এলো হাতের কাছে। নেমে গেল পায়ের পাতায়। এবার পূর্বের ন্যায় নয়ন গ্ৰথণ করে রাখার মতো ক্ষমতা পেল না। মেলে তাকালো সে। তার থেকে স্বল্প দূরে আয়ান। ঝুঁকে কাছে তার মুখশ্রীর উপর। হাহাকার ছড়ানো আঁখি যুগল তার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হলো দুজনার। চোখের মাধ্যমে ভেতরের না বলা ভাষার আদান প্রদান হলো দুজনের।
ভরে এলো আয়ানের চোখ। অম্বধারা আয়ানের চোখ থেকে গড়িয়ে ইশরার চোখে পড়লো। ঘনঘন পলক ফেললো সে। চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়লো বালিশে। আয়ান মুছিয়ে দিল সেই চোখ।

একহাত ইশরার কোমড়ে চেপে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল প্রিয়শ্রীকে। অসংখ্য বার অধর ছুয়ে দিল সেই মোটা ব্যান্ডেজ গুলোর উপর। হুহু করে কেঁদে উঠলো ইশরা। শব্দময় সেই কান্না। আয়ানের এলোমেলো শার্ট টা আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল..

— “কেন? কেন এলি না তুই। আমি কতোবার তোকে ডেকেছি তার হিসেব নেই, তখন কেন আসলি না। চোখে অন্ধকার ধরা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত পাখির মতো হাপিত্যেশ করছি।”

হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো অনেকটাই। উপরের শার্ট পেরিয়ে সেই বাঁধনের দাগ স্পষ্ট হলো পিটে। ইশরার নখের দাগ পিঠের সর্বোত্ত ছড়িয়ে পড়েছে। শার্টের কারণে দেখা যাচ্ছে না।
ইশরার পিঠে হাত রাখলো আয়ান। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল.

— “ইশু; এই ইশুপাখি। কাঁদছ কেন? বলো আমাকে কি হয়েছিলো। কিভাবে এতো আঘাত পেয়েছ তুমি?”

আয়ানের শিতল কন্ঠস্বর পৌঁছালো না ইশরার কর্ণেপথে। সে নিজের মতো বলে চলেছে। হাতের দৃঢ় বন্ধন ছাড়িয়ে ইশরাকে সামনে নিয়ে এলো। অশ্রু ধারা মুছিয়ে দিয়ে বলল..– “কেঁদো না, আমি আছি তোমার সাথে। আজকের পর থেকে এক মুহুর্তের জন্যও তোমাকে চোখের আড়াল করবো না।
শান্ত হও। বলো কি হয়েছে তোমার।”

ইতিমধ্যে কান্নার বেগ কমে এসেছে ইশরার। আয়ানের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা তৈরি হলো না তার ভেতরে। বালিশে মাথা হেলিয়ে দিলো। মুখশ্রী অন্যদিকে ঘুরিয়ে বিরবির করে বলল..

— “আমার ক্ষুধা লেগেছে আয়ান। প্রচন্ড ক্ষুদা। পেটের সবকিছু বেরিয়ে আসার উপক্রম।”

জ্ঞানশূন্য হয়ে জামা ভেতর দিয়ে ইশরার উন্মুক্ত পেটে হাত ঠেকালো আয়ান। পেটে অবস্থান করা হাতের উপর হাত রাখলো ইশরা। বাচ্চাদের মতো করে বলল..

–” হ্যাঁ! এই জায়গাটায় খাবার চাইছে!”

সাথে সাথে নেমে গেল হাত। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আয়ান। সংকোচ নিয়ে বলল..
— “মা আন্টি খাবার দিয়ে যাননি?”

আমতা আমতা করে বলল.. — “আসলে তখন ক্ষুধা লাগেনি, তাই খাইনি। এখন পেয়েছে। তুই এনে দিতে পারবি কি-না সেটা।”

ইশরা চায়না আয়ান তার পাশে থাকুক। আয়ানকে অগোছালো রুপে মেনে নিতে পারছে না সে। সাথে আয়ানের প্রশ্ন। তাই বাড়িতে পাঠানোর চেষ্টা করছে।

আয়ান পকেট থেকে ফোন বের করলো। কিছুক্ষণ ফোন টিপে কানের কাছে ধরে বলল..

— “মা কিছু হালকা খাবার বানিয়ে ড্রাইবার-কে দিয়ে পাঠিয়ে..

ফোন কেড়ে নিল ইশরা। আঁখি দিলো স্ক্রিনে, তিথির কাছে ফোন। লাইন কেটে আয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,.

— “এতোরাতে আন্টি কেন খাবার বানাতে যাবে? তাছাড়া ড্রাইভার কেন আসবে। তুই এখন বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে ঘুম দিবি। সকালে রিলেক্স মুডে আসবি।”

মুগ্ধ নয়নে ইশরাকে মন ভরে দেখে নিল আয়ান। অসুস্থতার মাঝেও তার জন্য মেয়েটা চিন্তা করছে। কিছুক্ষণ আগে ইশরার জন্য যখন উতলা হয়ে উঠেছিল, তখন তিথির কাছে জানতে চেয়েছিলো সে। ব্যর্থ হলো সেখানে। এদিকে তমোনাও আয়ানের ফোন রিসিভ করছে না। বাধ্য হয়ে লোকেশন চেক করে ছুটে এসেছে। এতো রাতে হসপিটালের দরজা বন্ধ ছিল। পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকেছে সে।

শার্টের কলার ঠিক করে হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল..

— “এতো রাতে হসপিটালে কেউ এলাউড নয়। একবার বেরুলে ঢুকতে দিবে না। (একটু থেমে আবার)
আমি জানি, তোর ক্ষুধা লাগেনি। শুধু শুধু অভিনয় করে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি না।”

এলে মেলো পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল আয়ান। কদাচিৎ হাঁসির রেখা দেখা গেল ইশরার অধর জুড়ে। মিনিট দশেক পর ফিরে এলো আয়ান। পড়নে হসপিটালের ঢিলেঢালা জামা কাপড়। এসে বসলো ইশরা পাশে। ইশরা চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো মুছিয়ে দিলো একহাতে। বেডের একপাশে সেঁটে গেল। জায়গা করে দিল আয়ানকে শোয়ার। আয়ান শুলো না, তাকিয়ে রইল ইশরার দিকে। রহস্যময় হেঁসে বলল..

— “ইশু আমার শোয়া ভালো নয়, সেটা তোর অজানা নয়। পড়ে যাবি নিচে!”

— “আমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়। পড়বো না।”

দ্বি-মুহুর্ত অতিক্রম হওয়ার আগেই কোনোরকম ইশরার বাহুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আয়ান। ইশরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল অতিশয় তুলতুলে হাতে। না চাইতেও ধীরে ধীরে নেতিয়ে গেল আয়ান। পাড়ি জমালো গভীর নিদ্রার অতলে।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)