#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১৮।
প্রথম চুমু… প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ইজহান খুব খুশি, মুখে তার মুচকি মুচকি হাসি লেগেই আছে।
কখন থেকেই ড্রাইভিং সিটে বসা অধিরাজ অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে এই ভোতা অনুভূতিহীন মানুষটিকে… ইজহান দু আঙুলে তার ঠোঁট স্পর্শ করছে, আনমনে হাসছে। অধিরাজ তার অবাকতা ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার মনে হচ্ছে আপনি আজ অনেক খুশি?”
ইজহান কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,
“হ্যাঁ খুব..!”
অধিরাজ বলল,
“ম্যামের সাথে আপনার সব ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে বলে-ই কি?”
ইজহান চুপ হয়ে গেলো। মুখে ফিরে এলো পুরোনো অভিব্যক্তি। গম্ভীর শীতল উদাসীন দৃষ্টি। মুহূর্তে ছেয়ে গেলো নিস্তব্ধতা। অধিরাজ ভয় পেলো কিছুটা। সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে? বুঝতে পারছেনা। তার মাথা লম্বা এক চিন্তার ভাজ। অদৃশ্য ঘাম যেনো বিন্দু বিন্দু মাথা ভর্তি হচ্ছে। তখনি ইজহান তার চিন্তা দূর করে বলল,
” তোমার ম্যামের বাবা তো ঠিক ছিলো অধিরাজ, তাহলে মারা গেলো কিভাবে? তাউ হুট করে? তার উপর এত টাকা কোথায় পেলো শ্যামা?”
অধিরাজ চুপ করে শুনে যাচ্ছে। ইজহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ঘড়ির কাঁটা দেখে নিয়ে আবার বলল,
“খবর নাও । এই তিন দিন কি হয়েছিলো। তাও ১ ঘন্টার মাঝে সব আপডেট চাই। আর হ্যাঁ তোমার মেডামের আশেপাশে লোক লাগিয়ে দাও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে বিপদে আছে, আর বলছে না আমাকে,আত্মসম্মান বেশিতো কিনা!”
বলেই আবারো হাসলো ইজহান। চোখে চশমা লাগিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলো সে… আজ কষ্ট পেয়েছিল খুব ইজহান, যখন শ্যামা তার হাতে ডিভোর্স পেপার দিয়ে ছিলো। কিন্তু সে তো আজ শ্যামাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিলো। শ্যামাকে ছাড়া তার দম বন্ধ লাগে। যদিও শ্যামাকে সে অনেক টর্চার করেছে। তবে এবার সে নিজেও ক্লান্ত। সে সব কিছু শেষ চায়। কিন্তু তাই বলে, ডিভোর্স? অসম্ভব!
এদিকে শ্যামা বেগপত্র গুছিয়ে বোনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে। কোথায় যাবে কি করবে? জানা নেই। তারা একটি সি এন জিতে উঠে পড়লো। শ্যামা জায়েদের কথা মনে পড়তেই সেদিকেই যেতে বলল সি এন জি ওয়ালাকে। সি এনজি ওয়ালাও চলছে তাদের ডিরেকশন অনুযায়ী। শহর থেকে সি এন জি বের হতেই শ্যামা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। জান্নাত তখন বোনের বুকে মুখ লুকিয়ে। শ্যামা চলতি সি এন জি থেকে রাস্তায় তাকিয়ে আছে, চোখ ভর্তি জল নিয়ে। মনে পরছে, তিন দিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো।
তিন দিন আগে…..
শ্যামা হসপিটালে তার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। সাথে এসেছে জান্নাত-ও। আজ তাদের বাবার জ্ঞান ফিরেছে। খুশিতে আত্মহারা। আজিজুল হসপিটালের বেডের উপর বালিশে ভর দিয়ে বসে আছে। শ্যামা আর জান্নাত বাবাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে পেট জড়িয়ে ধরেছে। আজিজুল হকের কথা বলতে এখনো অনেক সমস্যা হচ্ছে, থেমে থেমে কথা বলছিলেন তিনি। তারা অনেক সময় অতিবাহিত করার পর যখন চলে আসবে? তখনি শ্যামা প্রশ্ন করেছিলো তার বাবাকে,
“পাপা… সানিয়া আন্টি মারা যাওয়ার পিছনে কি মায়ের কোনো হাত ছিলো?”
আজিজুল হক মেয়ের মুখের কথা শুনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। হটাৎ করে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলেন। থেমে থেমে অনেক কষ্ট বললেন,
” তুমি.. তুমি.. সানিয়ার কথা কিভাবে জানলে?”
শ্যামা মাথা নত করে ফেললো। অপরাধী সুরে বলল,
“পাপা তোমাকে একটা কথা বলি নি..!”
আজিজুল হক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
” কি কথা?”
শ্যামা অস্বস্তি বোধ করলো। এদিক ওদিক চোখে ঘুরাতে লাগলো। হাতের আঙ্গুল গুলো খুঁটতে খুঁটতে বললো,
” পাপা তোমার চিকিৎসার টাকা টা.. মি. ইজহান দিয়েছে!”
আজিজুল হক এবার হাঁপাতে লাগলেন। বুকে মাঝে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। একটা পুরোনো অপরাধ বোধে দগ্ধ হতে লাগলো তার বুক। শ্যামা বাবার এই হাল দেখে হন্তদন্ত হয়ে পিঠের মাঝে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“পাপা কি হয়েছে! কষ্ট হচ্ছে শ্বাস নিতে? ডাক্তার ডাকবো? জান্নাত… জান্নাত ডাক্তারকে ডাক…!”
বলতেই জান্নাত মাথা নেড়ে বেড়িয়ে গেলো। এদিকে খু্ব কষ্টে আজিজুল হক বলল,
” মেহতাবের ছেলে..!”
শ্যামা বাবার এমন প্যানিক করতে দেখে চোখে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সামান্য হেল্প করার কথা শুনে বাবা প্যানিক করছে? আর যদি শ্যামা বলে দেয়, বিয়ের কথা! তাহলে? তাহলে কি হবে??? শ্যামা বলল,
” পাপা তুমি হাইপার হচ্ছো কেন? আমি.. আমি সব টাকা ফিরত দিয়ে দিবো চিন্তা করো না!”
আজিজুল হক বুকের বা-পাশে হাত বুলিয়ে বলল,
” ওদের সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি আমি, আমি চাইনি তাদের সামনে যেতে। তুই তুই কেন গেলি? ইজহান… ইজহান তোকে কিছু করেনি তো মা?”
শ্যামা বিস্ময় বিমুঢ়। একটা অজানা ভয় মনের মাঝে ঘর করতে লাগলো । বাবাকে কি বলবে সে? কিভাবে বলবে? ইজহান তার বর? আর.. আর বিগত ব্যবহার গুলো? যা ইজহান তার সাথে করেছে? কিভাবে বলবে? যে ইজহান তাকে বিয়ে করেও, বউ নয় বরং রক্ষিতা করে রেখেছে!
এদিকে আজিজুল হকের মনে পড়ছে বার বার ১২ বছর আগের সেই রাতটির কথা। সে তো চায়নি এমন কিছু হোক। সে চায়নি সানিয়া আত্মহত্যা করুক। সে তো তাই করেছিলো, যেটা রিদের বাবা করতে বলেছিলো। রিদের বাবার কথা ভাবতেই এবার উনি কাঁপতে লাগলেন। নিজের করা ভুল গুলোকে কিভাবে শুধরাবে। এবার যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে আজিজুল হকের। এর মাঝেই ডাক্তার এসে হাজির হয়েছে। তাড়াতাড়ি করে আজিজুল হককে একটি ইনজেকশন পুশ করে বললেন,
“রোগীকে এভাবে প্যানিক করলে তো.. উনার জীবনের ঝুঁকি হতে পারে। খেয়াল রাখবেন। ”
শ্যামা শুধু মাথা নাড়লো। আজিজুল হকের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে চেয়ে রইলো শুধু।আজিজুল হক আধো আধো চোখ জোড়া খুলে আছে, বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ছে। শ্যামা শুধু এত টুকুই বুঝতে পাড়লো,
“পালিয়ে যা শ্যামা.. ওরা ছাড়বে না তোকে!”
শ্যামা মাথায় কিছুই ডুকছিলো না। কি করবে সে? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। সেদিন কোনো রকম দিনটি পার করে বাসায় চলে আসে তারা। সেদিন ভোর রাতে হসপিটাল থেকে ফোন আসে আজিজুল হক আর নেই। শ্যামার পুরো পৃথিবীই উল্টে গেছিলো সেদিন। আজিজুল হকের মৃত্যুর দু দিন পরেই যখন রিদের বাবা হুমায়ুন চৌধুরি আগমন ঘটলো, তখনি যেন আস্ত আকাশটা ভেঙে পড়লো শ্যামার মাথায়। শ্যামা যখন বিগত দিন গুলোর কথা ভাবছিলো, তখনি জোরে ব্রেক কসলো সি এন জি। এবং ভাবনা থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হইছে মামা? ”
সি এন জি লোক কিছু না বলে উল্টো পথে দৌড় দিলো। শ্যামা আর জান্নাত আবাক। তারা সামনে তাকিয়ে দেখলো কত গুলো কালো পোশাক পরিহিত নিগ্রো লোক তাদের বিশাল দেহী শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায় তাল গাছের মতো। হাতে তাদের অস্ত্র। যা দেখে জান্নাত ঝাপটে ধরলো শ্যামাকে। ভয় হাত পা জমে যাচ্ছে মেয়েটার। তাদের মাঝে একটি লোক এগিয়ে শ্যামার উদ্দেশ্য বলল,
“ম্যাম স্যার আমাদের সাথে যেতে বলেছেন!”
শ্যামা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কোন.. স্যার!”
“গেলেই দেখতে পারবেন!”
“আমি যাবো না আপনাদের সাথে!”
লোকটি হেসে বলল,
“স্যার বিকল্প পথ বলে দিয়েছেন?”
“মানে?”
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে শ্যামার, কে এই স্যার? যে এত এত লোক পাঠিয়েছে? রিদ নয় তো? শ্যামা শুকনো ঢুক গিললো। লোক গুলো তাদের বাক্য ব্যয় না করে, শ্যামা আর জান্নাতের মুখে স্প্রে করে দিলো। সেকেন্ডের মাঝেই লুটিয়ে পড়লো তারা।
বড় এক ক্লাবে বসে আছে রিদ, তার কোলে বসে আছে এক রমণী। আদুরে আহ্লাদে ঢলে পড়ছে বার বার রিদের বুকে। রিদ নিজেও লুফে নিচ্ছে রমণীর দুষ্ট মিষ্টি ভালোবাসা। হেসে হেসে করে চলছে ড্রীংকস। বড় বড় পা ফেলে গ্রে কালার সুট পরা, মাঝ বয়সি লোক এসে দাঁড়ালো রিদের সামনে। মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে লোকটির জড়িয়ে ধরলো রিদ। বলল,
“বাবা! থ্যাঙ্কু ইউ!”
হুমায়ুন চৌধুরী হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তোমার জন্যই তো সব কিছু। বলো আর কি চাই?”
রিদ হেসে বলল,
“আর কিছুই না, আমার যাষ্ট শ্যামাকে চাই, যে কোনো মূল্য। যা তুমি ওল রেডি করে দিয়েছো!”
বলেই হাসলো রিদ। বাবার হাতে একটি বিয়ারের গ্লাস ধরিয়ে দিলো তারপর। কিন্তু হুমায়ুন চৌধুরী তখন অন্য কিছু ভাবছে। সে বলল,
“ইজহান আমাদের ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। এত সহজে সে শ্যামাকে ছাড়বে না!”
রিদের হাসি মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। ছোট থেকেই ইজহানের সাথে লড়াই লাগে তাদের পছন্দের সব কিছু নিয়ে। সেটা কাপড় হোক, খাবার হোক, বা মানুষ। কিন্তু বরাবরই ইজহান সব পেয়েই যায়। যদিও রিদ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো, কিন্তু মনে মনে ক্ষোভ ছিলো বেশি। ইজহান স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, এমনকি চলচিত্র জগতের মাঝেও ফেমাস। যতবার চেষ্টা করেছে ইজহানকে হারাতে? ততবার ইজহান তাকে বাজিমাত করে চলে গেছে। এমনকি তার ভালোবাসার মানুষটিকে-ও ইজহান কেড়ে নিয়েছে। তবুও কি হয়েছে? শ্যামাকে সে তার করেই ছাড়বে। তাইতো…৷ তাইতো এত এত চাল চেলেছে সে। রিদ বলল,
” বাবা এবার ইজহানকে খুন করে হলেও, শ্যামাকে আমার চাই!”
হুমায়ুন চৌধুরী মাথা নাড়লেন। রিদ ওয়াইনে এক চুমুক দিলো। ভিতরে ক্ষত গুলো আবার তাজা হতে লাগলো। রিদ আর ইজহান একই রকম তো ছিলো, তাহলে? কেন ইজহান আজ সবার প্রিয়? আর রিদ? সেই বা কেন আজ এই অন্ধকার জগতের মানুষ??
রিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, হুমায়ুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কিন্তু বাবা আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না! শ্যামা তোমার কথা বিশ্বাস কিভাবে করলো?”
হুমায়ুন চৌধুরী শয়তানী হাসি হেসে বলল,
” তেরা বাপ, বহাত কামিনা আদমি হে..!”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো দু’জনে…!
—————-
চলবে