#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
২২।
“আমি ডিভোর্স চাই।”
“এসব কি বলছো আফিয়া?”
বাহির থেকে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে সেদিন ফিরে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই, আফিয়া ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালো আজিজুল হকের সামনে। আজিজুল হক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন নিজের স্ত্রীর দিকে। দু এক কথার কাটাকাটির এক পর্যায়, আজিজুল হক কসে চর বসিয়ে দিয়েছিলেন আফিয়ার গালে। চেচিয়ে বলেছিলেন,
” লাজ, লজ্জা কি বিকিয়ে দিয়েছো আফিয়া? তোমার দুটি সন্তান আছে? কিভাবে… কিভাবে তুমি অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখো? যেখানে আমি এখনো জীবিত?? ”
আফিয়া গালে হাত দিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করছিলো। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” দু দিন পর তুমি এমনিতেই কাঙ্গাল হয়ে যাবে? তুমি কি চাও? কি চাও তুমি? আমি-ও তোমার সাথে পথে পথে ভিক্ষা করি?”
আজিজুল এবার আহতই হলেন। চোখে মুখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছিলো মুখ। এই কি সেই তার আফিয়া? যে মেয়ে তাকে ভালোবাসার গল্প শোনাতো? আজিজুল হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল,
” সত্যি এসব আমার পাপের ফল! আমি মেহতাবকে ঠকিয়ে ছিলাম… আর তাই প্রতি পদে পদে আমি ঠকছি…!”
আফিয়া মুখ বাকিয়ে বলল,
” আমার কঁপালের দোস? কেনো যে মেহতাবকে ছেঁড়ে ছিলাম, এই তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে।”
আজিজুল আর কিছু বলল না। চেয়ে রইলো অপলক আফিয়ার দিকে। আফিয়া সময় নষ্ট না করে আবারো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
” হয় সাইন করো? নয়তো.. আমি আমার মেয়েদের নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।”
আজিজুল হক রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললন। অন্তর্ভ্যদি এক চাহনি দিয়ে বললেন,
” তোমার যেতে ইচ্ছে হয়? তুমি চলে যাও, আমার মেয়েদের তোমার মতো মা প্রয়োজন নেই। তারপর আবার টাকার টান পড়লে দেখা যাবে মেয়েদের নিলামে তুলতে পিছপা হবে না।”
আজিজুল হকের এমন কথায় দমে গেলেন আফিয়া। মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে শুধু এতটুকুই বললেন,
” জান্নাতকে তুমি রেখে দাও, আমি শ্যামাকে নিয়ে যাবো!”
আজিজুল হকের ভ্রু কুঞ্চিত হলো,
” আর তোমার মতো নষ্ট মেয়ের কাছে আমার মেয়েকে কেনো দিবো?”
আফিয়া আমতা আমতা করে বলল,
” বারে.. শ্যামা আমার মেয়ে নয়?”
“তাহলে জান্নাত কেন নয়? জান্নাত তো ছোট? তোমার তার বেশিই প্রয়োজন।”
“না না.. আমার শ্যামাকে চাই!”
আজিজুল হক দুহাত বেঁধে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বললেন,
“গেট আউট। আমি আমার মেয়েদের মধ্যে কাউকেই দিবো না তোমার কাছে। নাউ ইউ লিভ!”
বলেই হাটা ধরলো আজিজুল হক উপরের দিকে। আর এদিকে আফিয়া বিচলিত হয়ে বলল,
” আমি শ্যামার বিয়ে ঠিক করেছি, ওকে আমার সাথেই যেতে হবে!”
আজিজুল দাঁড়িয়ে গেলেন,
“আর ইউ ক্রেজি? শ্যামার বয়স মাত্র ১৬। আর তুমি আমার পারমিশন ছাড়া, আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক কিভাবে করো? হাউ ডেয়ার ইউ?”
আজিজুলের ধমকে কেঁপে উঠলো আফিয়া। তবুও কাঁপা স্বরে বললো,
” আমার মেয়ের ভালো মন্দ আমি বুঝি?”
“ওহো তাই? তা সেই গুনি পুত্রটাকে? যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন?”
আফিয়া আজিজুলের চোখে আর চোখ রাখতে পারছে না, এদিক সেদিক তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিললো, বলল,
” সিফাত..!”
নামটুকু শুনতেই আরেটা থাপ্পড় পড়লো আফিয়ার গালে। আফিয়া পরে যেতে নিয়েও সামলে নিলো। আজিজুল হক, ডিভোর্স পেপারটি তুলে সেটিতে সাইন করে বের করে দিলেন বাসা থেকে আফিয়াকে.. এর পর আর আফিয়ার মুখ দর্শন করেনি আজিজুল। এতটাই ঘৃণা করতো তার স্ত্রীকে.. যে শ্যামা টুর থেকে ফিরে আসার পর জানায় আজিজুল হক শ্যামাকে, তার মা এই দুনিয়ায় বেঁচে নেই।
জান্নাত ফ্রিজের ভিতর থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে পুরো স্মৃতি আরেকবার বিচরণ করলো। সেদিন শ্যামা দেশের বাহিরের একটা টুরে গেছিলো ১৫ দিনের জন্য। বাসায় তার -মা-,বাবার মাঝে কি হয়েছিলো এক মাত্র জান্নাত-ই জান্ত সব। জান্নাত সব দেখে ছিলো লুকিয়ে। তার মা তাদের কখনোই ভালোবাসতো না। কোনো কালেই না। উনি ছিলেন স্বার্থপর মহিলা। এসব ভেবেই জান্নাত ছোট শ্বাস ছাড়লো। গ্লাসে পানি ঢেলে যেই পিছনে ফিরতে নিবে ঠিক তখনি তীব্র ধারালো কিছু গিথে গেলো জান্নাতের গলার মাঝে। জান্নাত মার্শালাট জানায় ঘুরিয়ে শক্তপোক্ত একটা হাত মুচড়ে পিছনের আগুন্তকের গলায় চেপে ধরলো। আগুন্তকের মুখ থেকে ” আহ্” শব্দটি বেড়িয়ে আসতেই ভ্রু কুচকে গেলো জান্নাতের। বলল,
” ইউ, চোর? কি চুরি করতে আসচ্ছিলে হ্যা? এত বড় সাহস? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা?”
বলেই জান্নাত সবাইকে ডাকতে লাগলো। আগুন্তক তখনি জান্নাতের হাত দুটো সরিয়ে নিজের মুঠোয় ভরে চেচিয়ে বলে উঠে,
” আমি চোর নাকি তুই চোর? আমার বাসায় এসে আমাকেই চোর বলা? ”
জান্নাত কান খাড়া করে শুনলো, তারপর আবাছা আলোয় দেখার চেষ্টা করলো ব্যক্তিটিকে। আলো আধারের খেলার মাঝে এক জোড়া সবুজাভ চোখ দেখে, ভয়ে ভুত ভুত বলে চিৎকার করে উঠলো! আগুন্তক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো এবার। কিছু বলবে ঠিক তখনি আলো জ্বলে উঠলো। নিপা দৌড়ে আসতে আসতে বলল,,
“কি হয়েছে মেডাম, কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন?”
এদিকে তখনো আরমান তার বাহু ডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে জান্নাতকে। আলো পড়তেই আরমানের মুখ দেখে বিস্ময়ে ফেটে পড়তে চাইলো। ভিতর থেকে ছোট জান্নাত খেলে কুদে চিৎকার করতে লাগলো,,
“ও মাই আল্লাহ , ও মাই আল্লাহ। ইট’স আরমান? পপ সিঙ্গার আরমান?”
জান্নাত বড় বড় পলক ফেলে বিড়বিড় করলো,
” আমি কি সত্যি দেখছি? কেউ আমায় চিমটি কাটো!”
আরমান জান্নাতের কান্ড অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বলল,
” মিস আর ইউ ওকে?”
জান্নাত সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লো, হে ঠিক আছে। আরমান আবার বলল,
“সরি, আমি ভেবেছিলাম চোর তাই… সরি ইট’স মাই মিস্টেক? ”
জান্নাত চুপ রইলো। চোখ দিয়ে গিলতে লাগলো শুধু আরমানকে। জান্নাতকে কিছু বলতে না দেখে নিপাকে ইশরা করলো আরমান, যে এই মেয়েটি কে?
নিপা বলল,
” স্যার উনি শ্যামা মেডামের বোন!”
আরমানের বাচ্চা মুখ আর সবুজাভ চোখ জোড়ায় আঁধারিয়া নেমে এলো। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে “ওহো!” ছোট শব্দ করে পা ফেলে উপরে চলে গেলো। জান্নাত হা হয়ে চেয়ে রইলো! মনে মনে ভাবলো বেটার এমন করার কারণটা কি? কিন্তু কিছুই বুঝলো না। তবে এই পপ সিঙ্গার এখানে কেন? জানার জন্য খুঁতখুঁত করতে লাগলো। না পেরে জিজ্ঞেস করলো নিপাকে,,
“উনি?”
নিপা হেসে বলল,
” আমাদের ছোট স্যার।”
জান্নাত বিস্ময়ে কাঠ,
“যার ফেন সে? সে কি না, আমার বেয়াই? সত্যি??? ”
খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল জান্নাত…..
এদিকে স্টাডি রুমে বসে, একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে ইজহান। মাথার মাঝে ঘুরছে শ্যামার বলা কথা গুলো। ইজহান আর্ম চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। শ্যার প্রশ্নের উত্তর চাইলে সে দিতে পারতো। দেখাতে পারতো, তার মায়ের আসল চেহারা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণেই সে ধেমে গেছে। ইচ্ছে হলেও সে বলতে পারেনি,,
“তোমার মা… সব থেকে স্বার্থপর একজন। যে নিজের স্বার্থে কোনো বৃদ্ধ পুরুষের পোষা কুকুর হয়ে থাকতে পারে…!”
ইজহান ছোট শ্বাস ছাড়লো। টেবিলের উপর থাকা পেনড্রাইভ গুলো তুলে নিয়ে রেখে দিলো গোপন লকাড়ে। তারপর বেড়িয়ে গেলো নিজের বেড রুমের দিকে।
বিছানার উপর শ্যামা শুয়ে আছে। মনে মনে অদম্য ইচ্ছা তার মাকে সে নির্দোষ প্রমাণ করবে। ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতরে পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ বুঝে নিলো শ্যামা। ইজহান শ্যামাকে শুয়ে থাকতে দেখে তাকিয়ে রইলো তার পিঠের দিকে। খোলা সাদা নাইট ড্রেস দিয়ে শুভ্র পিঠের ঘন কালো বড় একটা তীল দৃশ্যমান। ইজহানের চোখে যেন নেশা ধরে গেলো। কালো তীলে নরম চুমু এঁকে দিলো সে। শ্যামা সাথে সাথে কেঁপে উঠলো। ইজহান আলো হাতে কম্বলের ভিতর দিয়ে তার কোমরে ঠান্ডা হাত ছুঁয়ে দিতেই শ্যামার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়ে গেলো। শক্ত করে মুঠ করে ধরলো চাদর শ্যামা। ইজহানের চাওয়া বুঝতে অসুবিধে হলো না শ্যামার। অাদিম খেলা মেতে উঠতে চাইছে সে। কিন্তু শ্যামা? সে পাথর হয়েই রইলো..
না চাইতেও মেতে উঠলো ইজহানের সাথে। সারা দিতে লাগলো স্পর্শে… আঁধারিয়া অম্বরের বুকে তখন এক চিলতে চাঁদে ঝিলিক উঠলো। হাসতে লাগলো যেন খিল খিল করে…..
চলবে,