আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৮.
শ্বাসরুদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে কুহেলী।ভেতরটা ধপধপ করছে।সমারোহ তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে।ভয়ে চোখ মেলে তাকানোর শক্তিটুকু পাচ্ছে না সে। নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে আসছে।হাজারটা জড়তা নিমিষেই যেন চোখের পাতায় এসে ভর করে গ্রাস করে চলেছে কুহেলীর সকল অস্থিরতা!শরীর শীতল হতে শুরু করেছে এতক্ষণে।হাতে থাকা খাবারের ট্রে কাঁপছে,মৃদু ঝণঝণ শব্দে চারিদিক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে।সমারোহ মিষ্টি করে হাসে কুহেলীর অবস্থা দেখে।ভয় পেলে অমোঘ সৌন্দর্য যেন ঘিরে ধরে কুহেলীকে।কুহেলীর ঘন নেত্রপল্লবের দিকে দীর্ঘ সময় যাবৎ চেয়ে থেকে হাত থেকে ট্রে টেনে নিল সমারোহ।কুহেলী মাথা নিচু করেই থাকে।চোখের মনি অশান্ত,এদিক ওদিক পালাবার পথ খুঁজে।সমারহো গোটা দুয়েক পা এগিয়ে এসে মিনমিন কন্ঠে বলে,
‘এটা তোমার জন্য।’
কুহেলী ধীরে মাথা উচুঁ করে সমারোহকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়।ভ্রুঁ কুঁচকে দেখে মাঝারি সাইজের কাঁচের বোয়ামে শ’খানেক জোনাকি!বোয়ামের মাথার কাছটাতে সুতা দিয়ে বুনা নকশি কাপড় দিয়ে বাঁধা।খুশিতে আত্নহারা হয়ে জাড়টা হাতে নেয় কুহেলী।ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ভেতরে তিনটে রঙীন প্রজাপতিও রয়েছে।নিমিষেই পাতলা ঠোঁট প্রসস্ত হয় কুহেলীর। অত্যাধিক প্রফুল্ল চোখে দেখে সমারোহ।অঘোষিত একটা ভালোলাগা সৃষ্টি হয় সমারোহর প্রতি। খুশির চমক ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে চোখে,গালে, ঠোঁটে , সর্বাঙ্গে। সমারোহ সেই মায়াবী হাসি নিজের ভেতর শুষে নেয়।খাবার নিয়ে এসে সোফায় বসে চুপচাপ দেখে কুহেলীকে। বলে,
‘এগুলো দেয়ার জন্যই সকালে ডেকেছিলাম তোমায়।’
‘সরি,,বাট থ্যাংক ইউ।’ সংক্ষেপে কুহেলী।কিন্তু খুশিতে গদগদ হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে।
মেয়ে জাতি হয়ত এরকম ছোট ছোট জিনিসেই অতি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে।সেই হিসাবে কুহেলীও খুশি হবে তার আন্দাজ ছিল সমারোহর।তবে এতটা হবে ধারণার বাহিরে ছিল।এই একটু আগেও যে মেয়ে ভয়ে কাঁপছিল এই সামান্য উপহারেই সে এতো লাফাচ্ছে।তবে সে মোটেই এমনটা ছিল না, আর না এতোটা বড় ছিল তার আনন্দ।সমারোহ বুক ফুঁড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে।মানুষ নিজের খুশির জন্য অন্যের বাঁচা মরার দিকে ফিরেও তাকায় না।
কুহেলী সমারোহকে মিষ্টি হেসে বলে,
‘আবারো ধন্যবাদ।’
সমারোহর ধ্যান ভাঙ্গে কুহেলীর মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ দিয়ে কাজ হবে না। অন্য কিছু লাগবে।’
গম্ভীরর্যপূর্ণভাবে বলে সমারোহ।সমারোহর এহেন কথায় অনেকটা স্থির হয়ে শঙ্কিত হয় কুহেলী।তাজ্জব বনে গিয়ে বলে ,
‘তাহলে কি করতে হবে আমায়?’
কুহেলীর উদ্বেগপূর্বক দৃষ্টি ভালো লাগা সৃষ্টি করে সমারোহর ভিতর।ভাবনায় তলিয়ে সমারোহ বলে,
‘কিছু না।মজা করেছি।’
‘তবে খেয়ে নিন এখন।আন্টি না খেয়ে আছেন আপনার জন্য।’
‘হুম।’
কুহেলী খানিকা সময় নেয়।মনোযোগ দিয়ে দেখে জোনাকিদের।হঠাৎ করে মনে পরে যায় হলদেটে পাখিটার কথা।মাস খানেক আগে দিয়েছিল সমারোহর কাছে।এরপর আর খবর নেয়া হয়নি।কুহেলী চাঞ্চল্য দেখিয়ে বলে ,
‘আচ্ছা,সেই পাখিটা কোথায়?আমি যে দিয়েছিলাম আপনাকে?’
সমারোহ পানির গ্লাস নিয়ে বারান্দায় গিয়ে হাত ধুয়ে এসে সোফায় বসে। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে বসা ভাতের প্রথম লোকমা মুখে তুলে।বেশ আয়েশ করে খায়।তারপর বলে,
‘কারো পোষা পাখি ছিল হয়ত।তিন দিন আমার কাছে ছিল।তারপর সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা!’ দমে যায় কুহেলীর স্বর।
সে ভেবেছিল পাখিটা এই ঘরেই কোথাও আছে।এখুনি সমারোহ বলবে ঐ খাঁচায় আছে দেখো।কিন্তু তেমনটা হলো না।ফিনফিনে পাতলা দেহ হেলিয়ে কুহেলী ওঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘এখানে থাকালে মরে যাবে প্রজাপতি গুলো।ছেড়ে দিতে পারি?’
‘তোমায় দিয়েছি।যা খুশি করতে পারো।’
সমারোহর এহেন কথায় স্বস্তি মিলে কুহেলীর।নকশি কাপড়ে বাঁধা দড়ি খুলে দেয় সে।একেক করে জোনাকি প্রজাপতি বের হয়ে আসে।প্রজাপতিগুলো রঙীন ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায় ঘরময়।জোনাকির আলো কমে এসেছে।তারাও বের হয়ে আসে একে একে।
‘কাল সারারাত এগুলো খুঁজে জাড়ে পুড়েছি।তোমার জন্য।’ অন্তর্ভেদী কলকন্ঠ সমারোহর।
কুহেলী সচকিত।ধক করে ওঠে বুকটা তার।ওর জন্য শীতের রাতে জোনাকী খুঁজে বেড়িয়েছে সমারোহ! কিন্তু কেন?এতো কষ্ট কেনো করলো?শুধু কুহেলীকে খুশি দেখবে বলে?কিন্তু সেদিন কুহেলী এতটুকু তো বুঝেছে যে সমারোহর জীবনে অন্য কোন নারী আছে।প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ সমারোহ।হয় একটু রাগ অভিমাণ হয়েছিল।মিটে যাওয়ার ও কথা এতো দিনে!কুহেলীর জন্য কেন আনবে প্রজাপতি আর জোনাকির সৌন্দর্য্য?জানবেই কেন তার কিসে খুশি।কারণ নেই।থাকলেও এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছেনা কুহেলী।সমারোহকে জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করছে না এখন।তবে আনন্দ হচ্ছে কুহেলীর। অনেকটা আনন্দ।নতুন করে যন্ত্রণাগুলো উপড়ে ফেলার টনিক পেয়েছে যে!
কিন্তু কতো সময়ের জন্য?সমারোহ’র মতো যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলের জীবনে অন্য কেউ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। বরং না থাকাটা হয়ত অবাঞ্চনীয় হতে পারে।ভাবনার অতল গভীরে পৌঁছে যায় কুহেলী।তার কি করা উচিত!কি ভাবা উচিত!ঠাওর করতে পারে না।আবার অনিশ্চয়তার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকে কুহেলী।তাকে হাতটা ধরে টেনে তুলবার কেউ নেই ।সত্যিই কেউ নেই।
মাঝে মাঝে কুহেলীর মনে হয় ও যে এই ডাক্তারবাবুকে এতোটা ভালোবেসে ফেলেছে, এ কথা কি কখনো বুঝবে সে?বুঝলেই কি ডাক্তার থেকে কুহেলীর ডাক্তারবাবু হবে! হাসি পায় কুহেলীর।কি যা তা ভাবছে সে। সমারোহ কেনোই বা পছন্দ করতে যাবে তাকে!
কুহেলীর নিচে আসতে দেরি হচ্ছে বলে উপরে ওঠে আসেন আনরুবা।সেযুঁতি খাবার খাচ্ছে আর শর্মিলা বাগানে গেছে পুদিনা আর তুলসী পাতা আনতে।তাই কাউকে না বলে নিজেই এসেছেন উপরে।সিঁড়ি বেয়ে দুই তলায় পৌঁছে ভালো হাঁপিয়ে ওঠে আনরুবা।বার পাঁচেক জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সমারোহ’র ঘরের কাছে আসেন।যা দেখেন তাতে চক্ষু শীতল হয় আনরুবার।কুহেলী বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছে।টুকটাক কথা বলছে আর প্রাণ খুলে হাসছে।সমারোহকে দেখে মনেই হচ্ছে না,খাবার তার পছন্দ হয়নি।আনরুবা মুচকি হাসেন।শর্মিলা আর সেযুঁতির কথা তিনি শুনেছেন।যদি তেমনটাই হয়,কুহেলী জড়িয়ে যায় সমারোহর সাথে তাহলে তার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।ছেলেকে তিনি প্রচুর কষ্ট পেতে দেখেছেন।অনেক কষ্টে কিছুটা স্বাভাবিক ছিল সমারোহ।শান্ত হয়ে গিয়েছে একদম।তবে আনরুবার মনে পড়ে সেই চঞ্চল সমারোহ’র কথা।সান্দ্রের চেয়ে বেশি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল তার নয়ন মনি।কি হাস্উজ্জ্বল মাধুর্য্যময় চেহারা! দেখলে যে কারো মন শান্ত হতো। দুষ্ট অস্থির চাহনী।দুষ্টমীর জন্য পাগল হয়ে শেষে মারতে যেতেন আনরুবা তাদের দুইভাইকে।কই সেই দিনগুলো? কোথায় আছে তার পুরনো সমারোহ!বুকটা জ্বালা করে আনরুবার।সন্তানের উপর দিয়ে যাওয়া প্রতিটা ঝড় ছেলে-মেয়ের আগে তাদের বাবা-মাকে ক্ষত-বিক্ষত করে।হ্যাঁ,এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম।সন্তানে কষ্টে বাবা-মা‘ই বেশি কাঁদেন।তারা সন্তানের বিপদের দ্বিগুন ভাগীদ্বার হয়।আনরুবাও তার ব্যাতিক্রম নয়! তার মনে পরে সমারোহর দুষ্টমিতে সারা পাড়া টটস্ত থাকতো।এক স্থানে দু’মিনিটের বেশি স্থির থাকতে পারতো না সমারোহ।সেই ছেলে এখন ঘন্টার পর ঘন্টা মুখে বই গুঁজে পড়ে থাকে।গম্ভীর দিন কাটায়।শেষ কবে প্রাণ খুলে হেসেছে সমারোহ তার মনে পড়ে না।চোখ ছলছলে হয় আনরুবার।দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে অজান্তে।
সমারোহ তৃপ্তি নিয়ে খায়।আনরুবা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেন।মন তার খুশিতে জোয়ারের পানি তীড়ে বাড়ি খাওয়ার মতো ছলাৎ ছলাৎ করে।একটা বিষয় তিনি স্থির করে নিয়েছেন।কুহেলীর সাথে সমারোহর বিয়ের ব্যাপারটা খুব দ্রুত সেড়ে ফেলতে হবে।এতো দ্রুত যাতে তার ছেলে টেরও না পায় যে কুহেলীর প্রেমে সে জড়াচ্ছে।তবে সমারোহকে রাজি করাতে পারবে কিনা জানা নেই।কুহেলীর জন্য কি ব্যাপারটা মানানসই? তাও জানা নেই।কুহেলী প্রায় ছয় কি সাত বছরের ছোট হবে সমারোহ’র।বয়সে কি আসে যায়! ঘটনা শেষে গিয়ে কি দাঁড়াবে তাও জানে না আনরুবা।তবে এটা জানে সমারোহকে ঠিক করতে পারার আশা কুহেলী তাকে দিয়েছে গোপনেই।মনে মনে আনরুবা স্থিরও করে ফেলেন রাতে কথাটা জহিরে কানে তুলবে বিষয়টা।
–
ক্লাস শেষে চন্দ্রিমাকে নিয়ে মাঠের সবুজ ঘাসের উপর বসলো কুহেলী।ঘন কুয়াশার দরুণ ঘাসের উপর জমেছে ভারি শিশির স্তর।ভেজা ঘাসের উপরে ছোট কাপড় বিছিয়ে গা ঘেসে বসেছে দুইজন।মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর চন্দ্রিমার সাথেই প্রথম পরিচয় কুহেলীর।তারপর ধীরে ধীরে এখন প্রিয় বান্ধবীতে পরিনত হয়েছে।চন্দ্রিমা এসেছে খুলনা থেকে।সুন্দরবনের ঠিক পাশেই চন্দ্রিমাদের গ্রাম।কুহেলীর বেশখানিক অবাক লাগে যখন শুনে জঙ্গল পেরিয়ে বাঘ কিংবা হিংস্র বন্য প্রাণী প্রায়শই ছুটে আসতো তাদের গ্রাম্য এলাকায়। অনেকসময় মানুষ ধরে নিয়ে যেত।এমনকি একবার চন্দ্রিমাদের বাড়িতেও চলে এসেছিল একটা বুনো শিয়াল।প্রাণীর সাথে মোকাবেলা করে প্রতিমুহূর্ত টিকে থাকে তারা।কুহেলীর বেশ লাগে বিষয়টা।
শীতল ভেজা ঘাসের উপর বসে তেঁতুলের টক আচার খেতে খেতে গল্পে মজে দুই বান্ধবি।চন্দ্রিমা খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। সারাদিন হৈ হুল্লোড় করে বেড়াতে বেশি পছন্দ করে।কুহেলীর চোখে এক নম্বর পড়া চোর।তবে দেখতে বেশ সুন্দরী।টক তেঁতুলের আচার খেতে খেতে সে বলে ,
‘সমারোহ ভাইয়ার মা তো খুব ভালো আচার বানায়রে!তোর কি ভাগ্য কুহেলী!’
কুহেলী মৃদু চমকায় চন্দ্রিমার কথায়। আনরুবা আন্টি ভালো আচার বানায় তাতে ওর ভাগ্য ভালো হওয়ার মতোন কি!চন্দ্রীমার কথা শেষ হতে না হতেই কুহেলীর মুখ ছুটে বেরিয়ে এল,
‘মানে?এতে আমার খুশি হওয়ার কি?’
‘মানে আবার কি!এতো সুদর্শন একজনের বাড়িতে থাকিস যার নাম শুনলে মেডিক্যালের সব মেয়েরা ফিদা হয়ে যায়।তার মা আবার তোকে আচার বানিয়ে খাওয়ায় তুই ভালোবাসিস বলে! আমি কি কিছু বুঝিনা নাকি?’
খুব সহজভাবে কথাটা বলল চন্দ্রিমা।যেন কোন দ্বিধা নেই।কুহেলী রসগোল্লার মতো বড় বড় চোখ করে দেখে চন্দ্রিমাকে।চন্দ্রিমার কোনো কথাই যেন তার ছোট্ট মাথায় ঢুকে না।কুহেলীর কটমটে চাহনি দেখে পেট ফেটে হাসি পায় চন্দ্রিমার। হেসে কুহেলীর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে,
‘তুই আস্তো একটা ভেটকি কহেলী!’
‘কেনো? কি রকম যেন করিস তুই আমার সাথে বুঝিনা বাবা।’
ভ্রুঁ ক্রুটি করে মুখ ছোট করে ফেলে কুহেলী। চন্দ্রিমা যেন হাসির তালে লতার মতো হেলে পড়ে।তারপর থমথমে চেহারা করে বলে,
‘ভেটকি নয় তো কি! সমারোহ ভাইয়ার বাড়িতে থেকেও এতোদিনে তাকে পটাতে পারস না?আমি হলে সেই কবে প্রেম করা শুরু করে দিতাম।’
মুহূর্তেই চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেল কুহেলীর। মেজাজ বিগড়ে বলে,
‘তো ভালো তো,এতো শখ তখন তুই প্রেম কর না,যা!আবল-তাবল কথা যতসব।’
‘আমার মনে হয় সমারোহ ভাইয়া তোকে পছন্দ করে।’
‘কেনো , এরকম মনে হওয়ার পিছনে কারন?’
‘এমনি মনে হয়।উনি একটু কেমন ভাবে যেন তোকে দেখে!আমি দেখেছি।অন্য কোনো মেয়ের দিকে তো তাকায়ই না।’
‘ফালতু কথা।’ ভেংচি কাটে কুহেলী।চন্দ্রিমা চটে গিয়ে বলে,
‘সত্যি বলছি আমি,প্রমিস! দাঁড়া অবিশ্বাস করিস তো, একদিন দেখাবো তোকে।কেমন হা করে তোকে দেখে।তার তুমি তো আগেই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো বাছা!’
বুকেও কোথাও যেন একটা লাগে।মৃদু ব্যাথাও হয়। সমারোহ কেনো ওকে দেখতে যাবে?সে তো তাকে পাত্তাই দেয়না।বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় কুহেলী।চাপা গলায় বলার চেষ্টা করে,
‘তেমন কিছু না ।’
চন্দ্রিমা চোখ বুজে কুহেলীর কাধে ধাক্কা দিয়ে হেঁসে বলে,
‘তাহলে কেমন কিছু?বল বল!’
‘আমার কেন যেন ভাইয়াকে অনেক বেশিই ভালোলাগে।কিন্তু ভাইয়া হয়ত অন্য কাউকে ভালোবাসেন।হয়ত না, ওনার প্রেমিকা আছে, অত কিছু আমি জানি।’
কোহেলীর কথা শুনে আশাহত হয় চন্দ্রিমা।ফোঁস করে শ্বাস ছাড়তে মুখ দিয়ে।
‘তাহলে আর কি করার প্রেম করতে পারবি না।’
‘আমি প্রেম করতে চাইছি?বেশি বকিস তুই।’
চন্দ্রিমা চোখ কুহেলীর দিক থেকে সরিয়ে নেয়।পেছনে দু‘হাত ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে কিছু একটা ভাবতে শুরু করে।কুহেলী চন্দ্রিমাকে খেয়াল না করে বলে,
‘জানিস চন্দ্রিমা! জীবন খুব অদ্ভুত এক খেলা,যেখানে তুই চাইবি এক আর হবে আরেক।তাই সব কিছুতে অত মাথা না খাটিয়ে নিজের কাজে মনদে।’
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে কুহেলী।চন্দ্রিমা তখনো ঠাঁয় বসে থাকে।
‘আমি পড়লাম সেই লেবেলের এক ভাবুক মানুষের পাল্লায়! কিরে আবার কি ভাবিস?তোর বাবার কি আর শেষ হয়না? পড়ালেখা নিয়ে এতো ভাবলে এতোদিনে ডাক্তার হয়ে যেতিস।‘
আড়চোখে তাকায় চন্দ্রিমা।চোখ খোঁচ করে বলে,
‘এহ!ভাবছি পছন্দ তো করতিস!’
চন্দ্রিমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কুহেলী বললো,
‘তো ভালোলাগা আর ভালোবাসা কি এক হলো পাগলী মেয়ে! আমি বলেছি পছন্দ করি ।ভালোবাসি তো বলিনি।চল ওঠ লাইব্রেরিতে যাব একটু।’
‘তো ক্লাস করবি না?’
‘একটা নিয়ে নেই লাইব্রেরি থেকে তারপর যাব।’
‘আচ্ছা আমি বাহিরে দাঁড়াব।তুই নিয়ে আয়।’
লাইব্রেরিতে ঢোকার প্রথমেই কুহেলীর চোখ পরে উত্তর-পূর্ব দিকের কালো কাঠের টেবিলটিতে।চমকে ওঠে কিছুটা সে।সমারোহ সাধারণত কলেজ লাইব্রেরিতে আসে না কখনই।যখন যে বই প্রয়োজন হয় সেটা কিনে নিজের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করাই তার অভ্যাস।সমারোহর সম্মুখীন হওয়া এড়াতে সমারোহর লাইব্রেরি ছেড়ে এই লাইব্রেরিতে আসা শুরু করেছে কুহেলী।কিন্তু এখানেও তার সামনে পড়ে গেল।সমারোহ তখন মস্তিষ্ক ডুবিয়ে রেখেছে খয়েরি মলাটের বইয়ের পৃষ্ঠায়।কুহেলী দেখেছে একবার কিছু পড়তে বসলে সমারোহ অন্য ধ্যানে থাকে। সমারোহকে দেখে কুহেলীর মনে হয় যেন শুধু পড়েছে না,খেয়েই নিবে বইটা।তাই দ্রুত সে লাইব্রেরির বুকসেল্ফ মাঝে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।তাড়াহুড়ো করে খুঁজতে থাকে বই। কিন্তু কথায় আছে না ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।’
হাজার খোঁজার পর কুহেলী তার বইটা খুঁজে পেল।বইটা পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,এখনি বের হয়ে যাবে এখান থেকে আর সমারোহ দেখবেও না।এই ভেবে সমারোহর দিকে তাকাতেই পিল চমকে উঠে কুহেলীর।সমারোহ পলকহীন তাকিয়ে আছে কুহেলীর দিকে।চমকের দরুন কেঁপে উঠে সে।ফলে ধাক্কা লেগে সেল্ফ থেকে পড়ে যায় আরো কিছু বই।কুহেলী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।দ্রুত ঝুঁকে বইগুলো হাতে তুলতে থাকে একের পর এক। চন্দ্রিমার একটু আগে বলা কথাটা মনে পড়তেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে কুহেলী।অনেকগুলো বই একসাথে বুকের সাথে চেপে ওঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারো মেঝেতে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সব।কুহেলী একবার সমারোহর দিকে দেখে।সে তখনও দেখে চলেছে কুহেলীকে।কুহেলীর এবার ভয়ংকর রকম কান্না পায়।কেনো করতে গেল সে তাড়াহুড়ো!সমারোহর চোখে তো পড়লোই তার মাঝে আবার যা তা একটা অবস্থা তৈরি হলো।
সমারোহর এই মুহূর্তে পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে।তাও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করে রেখেছে সে।কুহেলীকে তার কাছে ছোট বাচ্চার মতো মনে হচ্ছে।যে একটা কাজ করতে গিয়ে উল্টো পাল্টা হাজারটা কাজ করে ফেলছে।তার নিখুঁত দৃষ্টিই যে কুহেলীকে এসব কাজ করতে বাধ্য করছে তা সমারোহ ঠিকই বুঝতে পারছে।তবে চোখ সে সরাবে না।কেন যেন মুহূর্তটা উপভোগ করছে সে।
কুহলীকে বই তুলতে দেখে আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসে সাহায্য করতে।ছেলেটার পড়নে সাদা শার্ট আর জিন্স।গায়ে কালো জ্যাকেট জড়ানো।বইগুলো তুলে সে বুকসেল্ফে রাখতে সাহায্য করে কুহেলীকে।কিন্তু কুহেলী শুধুমাত্র ধন্যবাদ টুকু দিয়ে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যায় ছেলেটার।একবার তাকায় না অব্দি।
তবে কুহেলীকে সচকিত করে ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে রাস্তা আটকে দাড়ায় কুহেলীর।কুহেলী ততক্ষণাৎ সমারোহকে দেখে আড়চোখে।সমারোহ ভ্রুঁ’ক্রুটি করে তাকিয়ে দেখছে কুহেলীকে।কুহেলী সে দিকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
‘জি।আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল আমার।’
‘বলুন।’
ছেলেটা আশেপাশে দেখে বলল,
‘পার্সোনাল কথা ছিল।এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে…!’
কুহেলী ঝটপট উত্তর দেয়, ‘আপনাকে আমি চিনি না।’
‘আমি চিনি।প্লিজ একটু সময় হবে আমার জন্য।বেশি না।এই ধরুন বিশ মিনিট।ইটস আর্জেন্ট।’
‘আমার এখান ক্লাস আছে।’
‘ক্লাস শেষে তো বলতে পারবেন!’
কি একটা ভেবে যেন কুহেলী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়।তারপর চলে যাওয়ার উপক্রম হলে ছেলেটা পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘আর দয়া করে চন্দ্রিমাকে এই বিষয়ে বলবেন না।আমি সামনের রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করব আপনার জন্য।’
কুহেলী কিছু না বলে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে যায়।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৯.
ক্যান্টিন থেকে চায়ের ওয়ান টাইম কাপ নিয়ে এলো চন্দ্রিমা।কুহেলী অবচেতন মনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যান্টিনের বাহিরে অডিটোরিয়াম ঘেঁষে।আর ভাবছে ছেলেটা কে!কি এমন জরুরি কথা যে আলাদা করে কথা বলতে হবে।কুহেলীর যেতে তো ইচ্ছা করছে না তবু মন বলছে যদি সত্যিই সিরিয়াস কোন বিষয় হয়! কিন্তু চন্দ্রিমাকেই বলতে নিষেধ কেনো করলো?ওর বিষয়ে কিছু বলতে চাইছে কি!কুড়েলী অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলো সে যাবে।কিন্তু চন্দ্রিমাকে কি বলবে?চন্দ্রিমা এখানে তার চাচির খালাতো ভাইয়ের বাড়িতে উঠেছে।লেট করে আসার কারনে হলে এখনো সিঙ্গেল রুম জুটেনি কপালে।তাই রুম পাওয়ার আগ অব্দি সেখানেই থাকবে।বাড়িটা সমারোহদের এলাকাতেই।তাই চন্দ্রিমার সাথে যাতায়াত করা সহজ।চন্দ্রিমার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা সে করবে কি করে।সেই কথাই ভেবে চলেছে একমনে।চন্দ্রিমা তা নিয়ে এসে ডাকতেই কুহেলী তাড়া দেখিয়ে বলল,
‘তুই বাড়ি যাবি এখন?’
‘হু।চল।’
‘না।তুই যা।আমার কিছু কেনাকাটা আছে আজকে।লেট হবে।’
চন্দ্রিমা কপাল কুঁচকে বলে,
‘ডংগের কথা বলিস না তো।তোর সাথে রাত হয়ে গেলেও যেতে পারি আমি।কোথায় যাবি চল।’
কুহেলী কিছুটা সংকিত হয় চন্দ্রিমার কথা শুনে।ছেলেটা নিষেধ করেছিল চন্দ্রিমাকে নিয়ে আসতে।তাহলে হয়তো আজ যাওয়াই হবে না।চন্দ্রিমাকে নিয়ে চা খেতে খেতে মেইন গেটের দিকে যেতে লাগলো কুহেলী।কলেজ থেকে বের হবার পর কুহেলী আমতা আমতা করে আরো একবার বললো,
‘আমি কিন্তু একাই যেতে পারতাম।’
চন্দ্রিমার কড়া নজর আবার চুপ করিয়ে দিল কুহেলীকে।গেইটে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই হঠাৎ মেডিক্যাল থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে এলো শাহাদ।শাহাদ কুহেলীদের ইয়ার মেট।অন্য ব্যাচ।ওদের দেখে শাহাদ উচ্চস্বরে ডেকে বলল,
‘কুহেলী তোকে সেই কখন থেকে খুঁজতেছি আমি! সমারোহ স্যার তোকে স্যারের সাথে বাসায় যাইতে বলছে।স্যারের কেবিনে যেতে বললেন।যা ভিতরে যা।’
কুহেলী আর চন্দ্রিমা দুইজনই চরম পর্যায়ে অবাক হয় কথাটা শুনে। চন্দ্রিমা কুহেলীর দিকে তাকিয়ে চোখ খোঁচ করে রাগী হওয়ার ভান করে বলে,
‘আচ্ছা!তাহলে এই কাহিনী?ডুবে ডুবে জল দুইজনেই খাচ্ছো না?আর আমার সামনে মত সব টালবাহানা!’
‘সত্যিই আমি জানি না ওনি হঠাৎ আমার সাথে কেন যেতে চাচ্ছে।’
চন্দ্রিমা কুহেলীর কথা মোটেই পাত্তা দেয়না।
‘হো আমি তো বিশাল গাধা না?আমাকে দেখতে গাধার মতো লাগে!তুই এতোক্ষণ ধরে বাহানা করে বলছিলি এটা লাগবে,ওটা লাগবে,কি সব যেন কিনতে যাবি। ভাইয়ার সাথে বাড়ি ফিরবি বললে কি এমন ক্ষতি হতো শুনি?’
‘আরে আজব কথা বলিস তো তুই!আমি কেমনে জানবো যে আমাকে ডাকবে?আমিও তো মাত্র জানলাম না!’
‘হইছে হইছে আর বলতে হবে না হারামি।আমারে বলতেও লজ্জা পাস।যা তোর প্রেমিক আবার অপেক্ষা করতেছে।বেশি ওয়েট করালে আবার এখানেই না এসে পরে,যা।’
কুহেলী যাবে না বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।ভালোই হয়েছে সমারোহ ডেকেছে।এই সুযোগে চন্দ্রিমা চলে যাবে আর সে সমারোহ কে গিয়ে বলবে সে চন্দ্রিমার সাথে যাবে।তারপর ছেলেটার সাথে দেখা করে জানবে চন্দ্রিমার বিষয়ে কি কথা তার বলার আছে।কুহেলী শাহাদের কথা মতো চলে এলো সমারোহর কেবিনে।এসে দরজাতে নক করতে সমারোহ বললো,
‘কুহেলী!’
‘জ্বি।’
‘কামিং।’
কুহেলী নরম পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সমারোহর কেবিনটাও তার ঘরের মতো গোছানো।এসি নেই তাও ঠান্ডা।ঘরের চারকোনায় ছোট ছোট কবে লাগানো ফুল গাছের চারা সৌরভময় করে তুলেছে পরিবেশটাকে।সাথে সমারোহের পারফিউমের ঘ্রাণ মিশ্রিত হয়ে আছে।মোহময় সে ঘ্রাণ কুহেলীকে আড়ষ্ট করে। আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে কুহেলীর চোখ এসে আটকে যায় সমারোহে। কুহেলী লাইব্রেরীতে খেয়াল করেনি তাকে।এখন মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল ঘাটছে সে।সেই সুযোগ মোটেই হাত ছাড়া করে না কুহেলী। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরখ করে নিল সমারোহকে।কালো শার্টে আর সাদা এপ্রোনে দারুন লাগছে।চোখে পাতলা সাদা ফ্রেমের চশমা।চুল অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে কপালের উপর। চোখের বিশালকার পাঁপড়ি গুলো একের পর এক কেঁপে ওঠছে ঢিপঢিপ করে।নৈস্বর্গিক মুগ্ধতা ছেয়ে যায় কুহেলীর অঙ্গে অঙ্গে।মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরের প্রত্যেকটা হাড় কাঁপছে। মেরুদন্ড বেয়ে সোজা শীতল পদার্থ নেমে যায়।দুনিয়া কুহেলীর চোখের সামনেই উলোটপালট হয়ে যাচ্ছে আর সে সমারোহতে ভুবনে আছে। চোখের পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না।মনে হয় জনমের পর জনম সে এভাবে সমারোহ কে দেখে কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত। সমারোহ তার প্রদীপ আর সে!সে প্রদীপের চারদিকে ভনভন করে ঘুরতে থাকা পোঁকা।সমারোহ কে দেখলেই এমনটা হয় কুহেলীর।যা বলতে এসেছিল তা যেন পুরোপুরি ভুলেই বসে সে।কেনো এমন হয় কে জানে!
সমারোহ ফাইল রেখে কুহেলীর দিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিল কুহেলী। সমারোহ মুচকি হেসে বলল,
‘সিট ডাউন হেয়ার।’
কুহেলী অন্য ধ্যানে বসতে গিয়েও বসলো না।এই ডাক্তার ভয়ংকর। লোকটার মায়া থেকে সে যত দূরে থাকতে চায় যেন ততই সে মায়াবী দহন তাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে।রেহাই পেতে দেয়না একদম,দেয় না।কুহেলী তার মোহমেঘ চায় না,আবেগ চায় না,এই ক্ষণিক আলোও চায়না।আর যা চায় তা সে পাবেনা।দিন শেষে তাকেই তো পুড়তে হবে।তখন তার যন্ত্রনার ভাগীদার সমারোহ হবে!না,কেনই হবে।সে তো কুহেলীকে বলেনি আমার বিষাক্ত প্রেমের ছোবল তুমি শুষে নাও!সে তো শুধুই ছোবল দিয়ে গেছে।সে তো আর ভালোবাসে না।কুহেলীর মাথা হিড়হিড় করে। চোখের কার্ণিশ চিকচিক করে ওঠে। সমারোহ কুহেলীকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুঁক্রুটি করে বলে,
‘আমি বসতে বললাম তোমায়।’
কুহেলী মাথা নিচু করে দৃঢ় কোমল গলায় বলে,
‘আমায় চন্দ্রিমার সাথে বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘শাহাদ কিছু বলেনি?’
‘বলেছে। কিন্তু চন্দ্রিমা অপেক্ষা করছে আমার জন্য তাই বলছিলাম…।’
সমারোহ কিছু বললো না।কাল ক্ষণেক ভেবে মোবাইল নিয়ে ফোন করলো কাকে যেন একটা। বললো,
‘কোথায় তুমি এখন?’
ওপাশ থেকে কে কি বললো কুহেলী ঠাওর করতে পারলো না। সমারোহ শুধু একবার কটমটে চোখে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে ফোন কেটে দিয়ে বললো,
‘চন্দ্রিমা অনেক আগেই চলে গিয়েছেএখন আর কোন সমস্যা আছে?’
‘এইয়ে… মানে,না।’
‘আর কেউ অপেক্ষা করছে?’
চমকে ওঠে কুহেলী।খুব সতর্কভাবে বলে, ‘না।’
‘আমার আধ ঘন্টা সময় লাগবে।ততটা সময় বসো এখানে।’
‘এতক্ষন!’ বিড়বিড় করে কুহেলী।
‘কিছু বললে?’
‘না আসলে এতো সময় বসেই থাকবো?এর চেয়ে আমি বাহিরে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করি।পরে নাহয় আপনার কাজ শেষ হলে…।’
সমারোহ একবার দেখলো কুহেলীকে।মেয়েটার সাথে বাড়ি ফিরা কেনো কথা বলার ও মোটেই ইচ্ছা নেই সমারোহর। তখন লাইব্রেরীতে আরশের সাথে কথা বলতে দেখেছে কুহেলীকে।অজানা কারনে প্রচন্ড অসহ্য লেগেছে বিষয়টা তার।আরশ কুহেলীকে আলাদা করে কথা বলতে বলেছে যেটা মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না সমারোহর।আর এখন কুহেলী একটা গিয়ে কথা বলবে আরশের সাথে! কখনোই না। কথাগুলো অবশ্য সমারোহ ভাবছে না,ভাবতে চাইছেও না।তার অবচেতন মন প্রতিক্ষণ ভেবে চলেছে।
সমারোহ জানে না কুহেলীকে নিয়ে তার এতো মাথা ব্যথা কেনো?কেনো এতো মোহ?বিষয়টা আরো বিভ্রান্তিকর।অনেকবার ভেবেছে কুহেলী যার সাথে ইচ্ছা কথা বলুক, না চলেই যাক।ওর কি! কিন্তু শেষে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই পারলো না। অবশেষে কুহেলীর ফ্রেন্ড শাহাদকে দেখে ভুলক্রমে বলেই ফেলল কুহেলীকে তার কাছে পাঠাতে।কেনো বললো তা নিয়ে নিজের উপর যথেষ্ট রাগ হয়েছে।তারপর ভাবলো কুহেলীর এখানে কেউ নেই,সে একা। সমারোহদের বাড়িতে যেহেতু আছে তাই তাকে দেখে রাখার দায়িত্বও তাদের উপর বর্তায়।
সমারোহ কন্ঠে গম্ভীর্যতার ছোঁয়া এঁকে বলে,
‘আমি এক কথা বারবার বলা পছন্দ করি না।বসতে বলেছি বসবে।’
অগত্যা আর কোন উপায় না পেয়ে কুহেলী সমারোহে সামনে থাকা চেয়ারে।ধীরে ধীরে সময় কেটে যেতে লাগলো। লাইব্রেরী থেকে আনা বইটা বের করে পড়তে শুরু করেছে কুহেলী।সমারোহ ও একের পর একেকটা ফাইল দেখে চলেছে।মাঝে মাঝে দুই এক পলক দেখে নিচ্ছে কুহেলীকে।
কুহেলী যখন কোন একটা কাজে নিজের সবটুকু ধ্যান দিয়ে মত্ত হয়ে থাকে, খুব অপূর্ব লাগে তাকে সেই সময়টুকুতে। সেই সৌন্দর্যটাই অগ্রাহ্য করতে পারার ক্ষমতা সমারোহ কেনো কোন ছেলেরই থাকার কথা নয়!
কুহেলীকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে হঠাৎ সমারোহর চোখ চলে যায় কুহেলীর গলার ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কুচকুচে কালো তীলটাতে। ঝলসে দিচ্ছে তা সমারোহর চোখ। সমারোহ ঢোক গিলে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে রুদ্ধশ্বাস সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে। কুহেলী তখনো মুখ গুজে আছে বইয়ের পাতায়। সমারোহ জোরপূর্বক চোখ সরিয়ে নিল নিজের।আবার মন দিল নিজের কাজে। কিন্তু কিযেনো একটা তাকে বারবার টানছে সমারোহ কে সে দিকে। হঠাৎ সমারোহর মুখ ফসকে বের হয়ে এলো,
‘তোমার গলার তীলটা ভয়ংকর কুহেলী। একজন পুরুষকে ঘায়েল করতে শুধুমাত্র এটাই যথেষ্ট।’
নিঃস্তব্ধ পরিবেশে কথাটা বারবার বারি খেয়ে কুহেলীর কানে বাজতে লাগলো। লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিল কুহেলী।মুখ জুড়ে তার ফুটে ওঠে স্পষ্ট গোলাপি আভা।
–
বিকালে সূর্যের কুসুম নরম আলো ছেয়ে পড়েছে চারিদিকে।নিরিবিলি স্তব্দ পরিবেশ। মেঘেদের আজ ছুটি।শীত গিয়ে আসছে বসন্ত বসন্ত আমেজ। পুরোপুরি এখনো বসন্ত না এলেও প্রকৃতিকে তার দখলে ঠিকই নিয়ে নিয়েছে। গাছপালা ফুল ফোঁটার অপেক্ষায়।হালকা শীত মাখা আবহাওয়ায় পাঁকা পিচ ঢালা ফাঁকা রাস্তার উপর রিকশা চলছে আপন গতিতে।বাতাসের উদ্দ্যম ঝাপটা এলোমেলো করে দিচ্ছে কুহেলীর চুল।রিকশায় কুহেলীর পাশের স্থানটা সমারোহর।লজ্জায় নুইয়ে আছে কুহেলী।গত একঘন্টা তাদের মাঝে কোন কথাই হয়নি তবে সমারোহর তখনকার বলা কথাটা বারং বার বেজে চলেছে কুহেলীর মনে।
‘তোমার গলার তীলটা ভয়ংকর কুহেলী। একজন পুরুষকে ঘায়েল করতে শুধুমাত্র এটাই যথেষ্ট।’
কুহেলীর হাত অজান্তেই চলে যায় গলায়।উড়না দিয়ে ভালো করে পেছিয়ে নেয় গলা।মৃদু হাসি ফুঁটে ওষ্ঠে।এ যেন ফাগুনের পূর্বেই ফুটে ওঠা এক প্রস্ফুটিত কনকচাঁপার ইন্দ্রজাল।
সমারোহ পাথরের মতোই বসে আছে।হিসেব কিছুতেই মিলছেনা তার।এমন একটা কথা মুখ ফসকে এলোই কি করে! কি লজ্জাটাই না তাকে পেতে হলো।আর কুহেলীই বা তাকে এখন কেমন ভাববে!ধূর! রাগ হচ্ছে সমারোহর।ভীষণ রকম রাগ।সে মোটেই ঠিক করেনি।মৃদু উজ্জ্বল আকাশে স্বল্পক্ষণে ছেয়ে যায় বেগুনী আভা।বাতাস থমকে গিয়ে আবার জোরে বয়ে চলে।দূর থেকে নিয়ে আসে নাগকেশরের তীব্র সুগন্ধ।তার থেকে তীব্রতর ভাবে মাথায় বারি খাচ্ছে কুহেলীর চুলের ঘ্রাণ।মাথা ধরে যায় তার ঘ্রাণে। এলোমেলো হয়ে সমারোহর মুখেও কয়েকবার উড়ে এসে পড়ছে কুহেলীর চুল।কুহেলীর সেদিকে তেমন একটা খেয়াল নেই। খয়েরি কেশযুগল যে তার অবাধ্য!
সমারোহ একবার ভাবে কুহেলীকে বলবে চুল ঠিক করতে, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা। ওভাবেই ভালো লাগছে। আবার বিরক্তবোধো হচ্ছে।কিছু সময় অতিবাহিত হলে সমারোহ গোমট সুরে বলে,
‘চুল খোঁপা করে নাও।ডিস্টার্ব করছে।’
–
হাত পা ছড়িয়ে উঠানে বসে কাঁদছে কুঞ্জা।তার রোজকার খেলা করার সাথী ছোট্ট বাছুরটা মারা গিয়েছে সে মানতে নারাজ। কিছুতেই তাকে সে কবর দিতে দিবে না।কেউ ছুঁতে আসলেই কেঁদে কেঁদে বলছে,
‘আমি ওরে নিতে দিমু না।কুহেলী আপা জানলে অনেক বকবে তোমাদের।তোমরা অনেক খারাপ।’
বাচ্চা মেয়ের মন বুঝেন খোর্শেদ।তাও কিছু করার নেই। এমন নিষ্ঠুর কাজ কেউ কীভাবে করে! হাসনাহেনা কয়েকবার রাগের বসে বলেছেন জসীম্মার কাজ এগুলি।খোর্শেদ ভাবেন সে করতেও পারে। তাদের দেহ পাষান,মন নিকৃষ্ট।খোর্শেদ গিয়ে জোর করে কুঞ্জার হাত থেকে বাছুরটাকে আলাদা করেন।রজব নিয়ে গিয়ে কবর দেয়।গ্রামের সবার চোখে স্পষ্ট হয় খোর্শেদ মাষ্টারের মতো ভালো মানুষের ও শত্রু আছে। অবশ্য শত্রু তো ভালো মানুষেরই থাকে, খারাপের না।কুঞ্জা সকাল থেকে খায়না, ইস্কুলে যায় না, লাফালাফি দাপাদাপি করে না।রজব তাকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করে,পারেনা।ছোট মনে বিচ্ছেদের জ্বালা বেশি হয়। সামান্য কষ্ট আকাশ সমঃ। এতোক্ষণ কুঞ্জার সাথে তার ঠাকুমা রমলা বসে ছিলেন। নাতনি কে কতো রূপকথা গল্প শুনিয়েও ভুলাতে পারেনি।এখন গিয়েছেন যোহরের নামাজ পড়তে।দপদপ করে জ্বলতে থাকা সূর্যের নিচে সারাদিন গোমট মেরে বসে থাকার পর দুপুরে জ্বর আসে।শরীর পুড়ে যাওয়ার মতো উত্তাপ! অনেক দিন পর ভালো রোদ পেয়ে হাসনাহেনা উঠানে শুঁটকি মাছ আর আচারের বোয়াম শুকাতে গিয়ে দেখেন এক ধারে কুঞ্জা অজ্ঞান হয়ে পরে আছে।
–
বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বড় দীঘির বাঁধানো ঘাটে এক মনে বসে আছে কুঞ্জা।কাল থেকে বিশাল জ্বর তার শরীরে।আজ দুপুরেও হুঁশ ছিল না কোন কিছু।খেলেই সব বমি করে দিয়েছে।অনেক ঔষধ খাওয়ার পর বিকালের দিকে জ্বর কমেছে। হঠাৎ করেই তাজা রুই কিংবা কৈ মাছ ভেজে খেতে ইচ্ছা করছে। বাহিরের হাওয়ায় গিয়ে বসতেও ইচ্ছা করছে খুব। হাসনাহেনা মোটেই মত দেননি তাতে।শুয়েই থাকতে বলেন।
রমলা তখন সবে মাত্র আসর নামাজ পড়েছেন।কুঞ্জা গিয়ে জায়নামাজের পাশে বসলে সালাম ফিরিয়ে দোয়া পড়ে কুঞ্জাকে ফুঁ দেন তিনি।তারপর নাতনির ছেলেমানুষী বায়না ফেলতে পারেনা বলে হাসনাহেনার কাছে সুপারিশ করে।তা নিয়ে যা একটু খুশি হয় কুঞ্জা।রমলা রং তাতেই খুশি।দুই নাতনি যে তাঁর প্রাণ, বেঁচে থাকার টনিক!
বিকালের এই সময়টাতে আপাকে খুব মিস করে সে।পলাশের সাথে ঘটা ঘটনায় খুব বিরক্ত আজ পর্যন্ত।তার নিজের আম্মার বিষয়টাও তাকে ভাবাচ্ছে খুব করে।সেদিনের সেই ঘটনার পর পলাশ আর জসীমের আনাগোনা খোর্শেদ বাড়িতে কমেছে ঠিকই কিন্তু কুঞ্জার জীবনে কমেনি মোটেই।স্কুলে যাওয়ার পথে ইদানিং কয়েকটা উটকো ছেলেপেলে দাঁড়িয়ে থাকে।কুঞ্জাকে ডিস্টার্ব করে না ঠিকই কিন্তু উদ্ভট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।ওগুলো যে পলাশের চেলা তা কুঞ্জা জানে।আম্মাকে বলতে ভয় করে।যদি আবার রামদা নিয়ে গিয়ে খুন করে বসে! আপা থাকলে আপার কাছে কথাটা বলতো কুঞ্জা।কথা পেটে চেপে রাখতে পারে না কুঞ্জা।তাই যত কষ্ট হচ্ছে।আপা ঠিক তাকে কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিত এদের হাত থেকে বাঁচার।
বর্শি পানিতে ফেলে টপাটপ মাছ তুলে রজব আর গুনগুন করে গান গায়।সাথে আছে গায়েরই দুই তিনটে বাচ্চা ছেলে।তারাও মাছ ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।রজবের বর্শিতে দুইটা বিশাল কাতলা,সাত কি আটটা ছোট কৈ আর ভেটকি মাছ ওঠেছে একটা।মাছগুলো বালতিতে রেখে হাসতে হাসতে কুঞ্জার দিকে তাকিয়ে ডাকলো,
‘ছুডু (ছোট) আপা?’
কুঞ্জার ভ্রম ফিরলো না।গম্ভীর দৃষ্টি একচুল না নড়িয়ে সে ঠায় বসে রইলো।রজবের হাসি মিলিয়ে গেলো নিমিষে।চিন্তিত হয়ে রজব আরেকবার ডাকলো,
‘ছুডু আপা গো!কি হইছে তুমার?মুখডা এহনো কালা কইরা বইয়া আছো ক্যান?’
কুঞ্জার হন্তদন্ত হয়ে একবারের জন্য তাকায় রজবের দিকে।কপাল কুচকে আছে রজব।কুঞ্জা কিছু না বলে হুট করে ওঠে দৌড়ে চলে যায় ঘরের ভিতর। শরীর দুর্বল।ঠিক মতো দৌড়াতেও পারেনা।রজব অবাক ভাবে চেয়ে দেখে কুঞ্জার চলে যাওয়া।কুঞ্জা বাড়িতে গিয়ে ধুম করে কুহেলীর ঘরের তক্তার উপর বসে কুহেলীর বালিশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কান্নার দরুন শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে।হিচকি তুলে বিড়বিড় করে বলে,
‘আপা তুমি যাওয়ার পর সব খারাপ হচ্ছে,সব। তুমি আমাকে রেখে কেন গেলা? কেন!’
–
আলিসান চেয়ারে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে বড় খাতায় হিসাব কষছেন জহির।কিছুদিন পর তার জমির শাকসবজি,মাছ আর চাল শহরের আড়তে যাবে।সেই সব কাজ নিয়ে ভীষণ চাপ যাচ্ছে তার উপর দিয়ে।বাড়ির কাজ কর্ম সেরে ঘরে ডুকে জহিরকে দেখে খুশি হন আনরুবা।রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে ঠাওর করতে পারেননি জহির কখন এসেছেন।গায়ের ঘামযুক্ত কাপড় বদলে নতুন শাড়ি পড়ে হালকা সাজলেন।গায়ে মাখলেন আতর।বছর খানেক পর আজ চোখে সুরমা লাগিয়েছে আনরুবা।যৌবনে আনরুবার সুরমা মাখানো চোখ দেখেই বারংবার প্রেমে পড়তেন জহির।আনরুবার মনে পড়ে তার শ্বাশুরি ছিলেন বিশাল কঠিন মানুষ।বাড়ির আদুরে দুলালি হয়েও শ্বশুর বাড়ির মাটির ঘর লেপা থেকে ফসল তোলার সব কাজ তাকে করতে হয়েছিল একা হাতে।বাড়ির একমাত্র বউ যে সে!তারপরেও শ্বাশুরির অসন্তুষ্টির মাত্রই ছিল বেশি।এই সব কিছু পেরে উঠেছিল আনরুবা শুধুমাত্র জহিরের ভালোবাসার জোরে।জহির রোজ আনরুবার কাজের ফাঁকে মায়ের কাছে লুকিয়ে তাজা ফুল,তেঁতুল,কাঁচা আমের আচার আর সুরমা চোখে মেখে দিয়ে যেত।আনরুবার কি যে খুশি লাগতো!
চোখে গাঢ় করে সুরমা মেখে বিছানায় পানের বাক্স নিয়ে বসেন আনরুবা।চুলের খোঁপা খুলে আবার বাঁধতে বাঁধতে বলেন,
‘আগের দিন সব মরছে।এখন তো বুড়ি হইতাছা।তাই কারোর সময়ই হয় না আমার দিকে তাকানোর।’
জহিরের কানে কথাখানি গেলেও তিনি না শোনার ভান ধরে থাকেন।এতে আনরুবা রাগবে,ফুলবে।মুখ লাল টকটকে হবে।ঝগড়া করবে।তখন বেশি ভালোলাগে জহিরের আনরুবাকে।এই অভ্যাস জহিরের অনেক আগে থেকেই। জহিরের কোনো ভাবান্তর নেই দেখে আনরুবা ফের বলেন,
‘সুরমা আতর শেষ আমার।আনতে হইবো।’
তাও জহির কিছু বলেন না।তাকায় না অব্দি।আনরুবা রেগে যান এবার।রাগ যেন তার নাকের ডগায়।রাগে কটু কথা বলতে নিয়েও বলেন না।মাথা ঠান্ডা করে আবার বলেন,
‘শুনো,মিষ্টি পান খাবা?বানায় দিব?’
‘না।’
আনরুবার মেজাজ তরতর করে বেড়ে যায়।রাগে গিজ গিজ করতে করতে তিনি বলেন,
‘আমার সাথে তো কথাই বলতে ইচ্ছা করবে না এখন!বিয়ে করার সময় তো কত কথা, বিয়ের পর সারা জীবন আমার চেহারা দেখতে দেখতে কাটাইয়া দিবা।এখন সব ভালোবাসা উধাও! উধাও হইবোই তো।এখন কি আমার মন ভোলানো রূপ আছে নাকি!’
ফোঁস ফাঁস করছেন আনরুবা।জহির এবার হেসে ফেলেন।হেসে চেয়ার ছেড়ে ওঠে আনরুবার কাছে এসে আনরুবার মাথায় হাত রাখেন।আনরুবা মাথা সরিয়ে নেন।জহির হো হো করে হাসতে থাকেন এবার।হাসতে হাসতে বলেন,
‘তুমি বুড়ি হচ্ছো আনা।তবে পাগল সেই বিয়ের আগের মতোই আছো।’
আনরুবা ভেঙচি কাঁটেন।জহির পরম স্নেহে স্ত্রীর কপালে চুমু খান।তারপর চিবুক ধরে বলেন,
‘আমার প্রেমময় স্ত্রীকে ভালো না বেসে আমি যাব কোথায় শুনি?আমি যে তোমার আত্তাকে ভালোবাসি আনা।বাহ্যিক সৌন্দর্যকে নয়।’
আনরুবা মিষ্টি হাসেন।জহির আবার বলেন,
‘তোমার হাসি আমার সুখের টনিক আমার আনা। আমার চাঁদ সুন্দরী!’
আনরুবার ভেতরটা খুশিতে গদগদ করে ওঠে।মনে মনে তিনি দোয়া করেন তার সন্তানরাও যেন তার মতোই সুখি হয়।আনরুবা হেসে বলেন, ‘আমার একখানি আবদার আছে।’
জহির আড়চোখে আনরুবাকে দেখে বিড়বিড় করেন,
‘আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল ঘাপলা আছে!’
আনরুবা শুনতে পেয়ে বলেন,
‘কি?কি বললা তুমি? ‘
জহির ভয়ে বলেন,’না না।কিছু না।বলো তুমি কি আবদার।’
‘আমি কুহেলীকে সমারোহর বউ করে আমার ঘরে রাখতে চাই।আমার অনেক প্রিয় মেয়েটা। আমার সমারোহকে ও ভালো রাখবে।’
সচকিত হন জহির।মুখের রঙ পাল্টে যায় তার।যেন আনরুবা তার কাছে আকাশের চাঁদের চেয়েও বেশি কিছু চেয়ে বসেছেন আর সেটা দেয়া অসম্ভব।জহির স্থির গতিতে গিয়ে চেয়ারে বসেন।কথা বলেন না।আনরুবা আশাহত হন।তিনি ভেবেছিলেন জহির কথা বলবে সমারোহর সাথে।কিন্তু এখন তেমনটা মনে হচ্ছে না।এদিকে আনরুবার ও তত সাহস নেই যে সমারোহকে বুঝায়।
আনরুবার পান খাওয়া শেষ হয়।জহির বলেন,
‘আমাকেও দাও।’
আনরুবা পান বানিয়ে দেন।জহির পান মুখে পুড়ে বলেন,
‘সমারোহ রাজি হবে না।’
‘তুমি বুঝাইবা।’
‘বুঝবো না।রাগ করবো অনেক।কষ্ট পাইবো অনেক ছেলেটা।’
‘ছেলে আমার কুহেলীর প্রতি দুর্বল হইতেছে।’
জহির চকিতে তাকায় আনরুবার দিকে।আনরুবা সেদিকে খেয়াল না করে বলেন,
‘আমার ছেলে।ওর মন ও বুঝার আগেই আমি পড়তে পারি।’
জহির চোখ যেন জ্বলে উঠে।বলেন,
‘কুহেলী কম হলেও ছয় বছরের ছোট ওর। বয়সের একটা বেপার আছে না?যায় নাকি!’
‘তো কি?আমি তোমার এগার বছরের ছোট।ভালোবাসার কি কমতি আছে আমাদের মধ্যে?’
চিন্তায় পড়ে যান জহির।আনরুবা যা ভাবছে তা কোন কালে কি হবে!জহির দৃঢ় গলায় বলল,’আমাদের বিষয় ভিন্ন। তখন এমন বয়সেই বিয়ে হইতো,এর চেয়েও বয়স্ক লোকের সাথে হইতো।’
‘না ভিন্ন না।’ আনরুবার গলার জোর বারে। ‘আমি আমার ছেলেকে সারাটা জীবন কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখতে পারবো না।’
‘ওদের আরো সময় দাও।’
আনরুবা আর কিছু বলার জন্য খুঁজে পান না এবার।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
১০.
ঘুম ঘুম চোখে বেলকনির তাজা বাতাসে এসে বসে কুহেলী।সমারোহর কথার ঝাঁঝালো রেশ এখনো রয়ে গেছে মনে-প্রাণে, মস্তিষ্কে-উপশিরায়।যে কথা এখনো কুহেলীতে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে অদ্ভুত অন্তর্লীন ভালোলাগা।যে অনুভূতি একই সাথে প্রেম,আনন্দ,যন্ত্রনা সব দেয়।মোহময় অনুভূতি ঢেলে দেয় সর্বাঙ্গে।যার অবশ্যই কোন প্রকাশ নেই।ফলে অস্বস্তির সৃষ্টি করে নিমিষেই।অস্বস্তি শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে সকালের আকাশ দেখে মন পুরে কুহেলী।মাঘের তৃতীয় সপ্তাহ, আকাশ ফকফকে পরিষ্কার।পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত প্রকৃতি।দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়।পাহাড়ের গা ঘেষে ডিমের হলুদ কুসুমের ন্যাশ ম্লান কোমল সূর্য উঁকি দেয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ।গাছের প্রতিটা পাতা সতেজ হয়ে ওঠেছে শিশির শুষে।রোমাঞ্চকর পরিবেশ কুহেলীকে মুহুর্তেই খুশি করে তোলে।কুহেলী সময়টাতে খুব করে মিস করে আব্বাকে।
শহুরে জীবনযাত্রা থেকে গ্রাম্য জীবনযাত্রা খুব বেশি চাঞ্চল্যকর মনে হয় কুহেলীর।শহরে যে সময়টাতে মানুষ তাদের আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে ওঠবার জন্য যুদ্ধ করে, গ্রামে তখন সকলে খাওয়া শেষে গৃহস্থালির অর্ধেক কাজও সেরে ফেলে।শহরের মানুষের আনন্দটা কেবলই নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করে আর গ্রাম তা সীমিত নয়, সবার।শহরের মানুষের জীবন খাঁচা বন্ধি ঈগলের মতো।তাই এদের জীবনে হতাশা নামক বস্তুটাও নেমে আসে খুব দ্রুত।কুহেলী ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আবার দীর্ঘনিশ্বাস নেয়।কুঞ্জার বোকা ভোলা চেহারাটার কথা মনে পড়ছে খুব।আম্মার কন্ঠটাও শুনা হয়নি অনেকদিন।বাড়িতে ফোন দিয়ে কথা বলার জন্য মোবাইলটা ঘরের ভেতর থেকে চট করে নিয়ে আসতেই মনে পড়লো মোবাইলে রিচার্জ নেই।গ্রামে নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায় না।আর নির্দিষ্ট সময় পর টাকা নম্বরে থাকে না বলে কুহেলীই রিচার্জ করে ফোন দেয় সবসময়।মাস শেষ হতে আরো চৌদ্দ দিন বাকি।আগের মাসে হাত খরচের পর বেশ ভালো টাকাই বেঁচে গিয়েছিল।তাই আব্বাকে টাকা পাঠাতে নিষেধ করে দিয়েছিল।এখন সামান্য কিছুই অবশিষ্ট আছে।রিচার্জ মোটেই করা যাবে না।আর না করলে কথাও হবে না!মনটা খারাপ হয়ে গেল কুহেলীর।
মোবাইলে মেসেজের আওয়াজ শুনে তাকাতেই অনেকটা চমকে ওঠে সে।মোবাইলে কেউ রিচার্জ করে দিয়েছে।খানিকটা সময় ভাবলো কুহেলী, কেই বা রিচার্জ করবে!হয়ত কেউ ভুল করে পাঠিয়ে দিয়েছে।পরে আবার নিশ্চই ফোন করবে।
ততক্ষণাৎ কুহেলী বেশ খুশিই হলো। তবে বাড়িতে অনেকবার কল করার পরও নেটওয়ার্ক পেলনা।হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল।তারপর টেবিলে বসে বইয়ে চোখ বুলায় ঘন্টাখানেক। শর্মিলার ডাকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য চলে আসে নিচে।
অন্যদিনের চেয়ে সবাইকে আজ একটু বেশি ব্যস্ত লাগছে।সেযুঁথি আর শর্মিলা দৌড়ে দৌড়ে ঘর গোছাচ্ছে।নয়না আনরুবার রান্নার কাজে সাহায্য করছে।জহির টেবিলে বসে সকালের পত্রিকা পড়ছিলেন।কুহেলীকে দেখে হেসে বললেন,
‘আসো মা,আমার কাছে এসে বসো।সবাই এতো কাজ কাজ করতেছে আমিই খালি অলসের মতো বইসা আছি বুঝলানি!’
কুহেলী হাসে।টেবিলে বসতে বসতে বলে,
‘কিসের আয়োজন চলছে কাকাই?’
‘সারিকা মা আসতেছে আমেরিকা থেকে।কাল রাতেই জানাইলো।তাই সামান্য আয়োজন।মা’টারে কতদিন দেখি নাই!’
‘বাহ খুব ভালো হবে তো তাহলে।আমি তো আপুকে এর আগে দেখিনি কাকাই।এবার দেখবো।’
‘তা ঠিক।মেয়েটা আমার বড়ই দুষ্টু।আগে কিন্তু বলে নাই আসবে।কাল রাতে আনরুবার মোবাইলে মেসেজ এসেছে ওরা আসছে।সকালে দেখলাম। এজন্যই এতো তাড়াহুড়ো।’
‘আচ্ছা!’ একসাথে হাসে কুহেলী আর জহির।
জহির, কুহেলীর সাথে বৈশাখীও খেয়ে নিল।সমারোহ সকাল সকাল গিয়ে বাজার করে সারিকার সব পছন্দের মাছ নিয়ে এসেছে। সকাল বেলা হালদা নদীর টাটকা মাছে আসে এখানের বাজারে।সান্দ্র এখনো হসপিটালে।নাইট ডিউটি ছিল আজ,তাই সারিকা আসার বিষয়টা ও এখনো জানেই না।
সমারোহর আসতেই তার আনা বাজার সদাই দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন জহির আর আনরুবা।সেই সুযোগে সমারোহ চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে।গরম না পড়ার পরও সে ঘামছে।শার্টের উপরের কয়েকটা বোতাম খুলে শান্ত হয়ে বসে বলে,
‘এক গ্লাস পানি দাও কুহেলী।’
সমারোহর মুখে নিজের নাম শুনে মৃদু কেঁপে ওঠে ত্রস্ত হাতে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় কুহেলী। রুদ্ধশ্বাস ঢকঢক করে পুরো পানি সাবার করে দিয়ে বলে,’আবার দাও।’
কুহেলী এবার পানির জগটাই এগিয়ে দেয়।পানি খাওয়া শেষ হলে মুখ গোমট করে জোর গলায় বলে,
‘আম্মা আমার নাস্তা দাও।খেয়ে বের হতে হবে আমাকে।’
সমারোহর কথা মাটিতে পড়ার আগেই বৈশাখী হেসে কোমরে দুই হাত রেখে বলে,
‘সে কি কথা সমারোহ!আপু ভাইয়াকে নিয়ে আসছে।আর তুমি কিনা এখন কাজ করতে যাবে?মোটেই চলবে না কিন্তু।’
মুখ কালো হয়ে কপাল কুঁচকে আসে সমারোহর।রাজ্যের সকল বিরক্তি নিয়ে সে বলে,
‘তো!আপু আপু আসলে কি আমার কাজ সব শেষ হয়ে যাবে?যে রোগীগুলো আমার আন্ডারে আছে তাদের চিকিৎসা বাদ দিয়ে দেব?’
সমারোহর উত্তরে থতমত খেয়ে যায় বৈশাখী।সেও জানে সমারোহ যখন ভালো তো খুবই ভালো।আর যখন রেগে থাকে তখন যমের মতো।বৈশাখী তো যমের চেয়েও বোধহয় বেশি ভয় পায় সমারোহর রাগ।তাই কাঁপা গলায় বলে,
‘না সমারোহ আমি আসলে এ…।’
বৈশাখীর কথায় পাত্তা না দিয়ে সমারোহ বলে,
‘আম্মা খাবার দিবা নাকি আমি বের হবো?’
আনরুবা আহ্লাদি সুরে বলেন,
‘আচ্ছা আব্বা,দাঁড়াও আমি দিতেছি।’
আনুরুবা নয়নাকে ডেকে বলেন মাছগুলো কেটে ভালো করে ধুয়ে ভেজে এরপর যেন রান্না চড়ায়।সারিকা কাঁচা মাছের তরকারি খেতে পারে না।নয়না মাছ নিয়ে যায়।তারপর আনরুবা হাত ঝেড়ে ওঠতে নিলে জহির তাকে আটকায়।দাম্ভিকতার সাথে বলেন,
‘তুমি যাইয়ো না।কুহেলীরে কও তো!’
আনরুবার উত্তরের অপেক্ষা না করে জহির নিজেই বলেন,
‘কুহেলী তোমার আন্টির হাত ময়লা।তুমি একটু কষ্ট করে খাবার বারোত মা।আর সান্দ্রর জন্য গরম খাবার তুলে রাইখো হটপটে।’
কুহেলী মাথা নারিয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দেয়।হাজার জড়তা নিয়েও খাবার নিয়ে আসে সমারোহর জন্য।সমারোহর সামনে প্লেট রাখতেই সমারোহ ভেজা ক্লান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
‘আচ্ছা শুনো, আজ থেকে আমার সাথে কলেজ যাবে তুমি।’
হতভম্ব হয়ে গেল কুহেলী সমারোহর কথা শুনে!যে মানুষটার পাশে দুমিনিট দাঁড়ালে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে,পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়।তার সাথে এতটা সময় বসে থাকবে কি করে ভেবেই শঙ্কিত হয়!সমারোহর এতটা সঙ্গ কলিজায় কুলাবে তো?
বৈশাখীর ভ্রুঁ জোড়া কুচকে আসে।কুহেলীকে সে দেখে বিষ নয়নে।মনে মনে গভীর কটাক্ষ করে।রাগ যেন বৈশাখীর মাথায় চড়ে হিড়হিড় করে।সমারোহ সামনে না থাকলে এই ফালতু মেয়েটার সব চুল টেনেটুনে ছিড়ে ফেলে টাক বানিয়ে একটা শিক্ষা দিয়ে ফেলতে।নয়তো দশ-বারোখানা থাপ্পড় মেরে দিতে পারলে হয়তো রাগ মিটতো।
সমারোহ খাওয়ার ফাঁকে ফোঁকরে দুই’চারটে কথা বলে কুহেলীর সাথে।যা একেবারেই অশোভনীয় মনে হয় বৈশাখীর।বাইরের একটা মেয়ের সাথে অত মাখামাখি কিসের?
চোখ জ্বলে উঠে বৈশাখীর।অনেক অপেক্ষা করেছে সে সমারোহর জন্য।আর কত?সত্যি আর কতো?সেই ছোট থেকে মনে একমাত্র একজনকেই রেখেছে।না,মনে নয় শুধু।বৈশাখীর সবটাতে ঘিরে রেখেছে তাকে।হারিয়েই তো ফেলেছিল!এখন যখন আরেকটা সুযোগ জীবন তাকে দিচ্ছে সমারোহ এবার বৈশাখীর হবে।শুধুই বৈশাখীর।সমারোহকে আগলে নিজের কাছে বন্ধি করে রাখবে বৈশাখী।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খেয়াল করে তার চোখের কার্ণিশে জমা হয়ে শতশত অশ্রুকণা।ঝাপসা হয়ে আসছে সমারোহর মুখখানি।
কুহেলী তৈরি হয়ে নিচে এসে দেখে সমারোহ আগে থেকেই নিচে অপেক্ষা করছে।সান্দ্র কিছু সময় পূর্বেই ফিরেছে।আজ সকালে সান্দ্রর পছন্দের ভুনা খিচুড়ি,গরুর কালা ভুনা আর রসুনের চাটনি করেছেন আনরুবা।সান্দ্র তাই ফিরেই খাবার খেতে বসে পড়েছে।কুহেলীকে দেখে চটকরে বলল,
‘হেই পিচ্ছি,কেমন আছো?’
‘ভালো ভাইয়া।তুমি?’
‘ভালো ভালো।সান্দ্র দ্যা গ্রেট অলওয়েজ ভালোই থাকে।শুধু জাম্পস ক্ষুধা লাগছে আরকি।’
কুহেলী হাসে।সান্দ্রকে তার চরম ভালো লাগে।কি সুন্দর সব সময় প্রাণবন্ত।এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের হাসির টনিক সান্দ্র।সান্দ্র আবার বলল,
‘খাওয়া কমপ্লিট?’
‘জি।’
‘তুমি ডাক্তারিতে কেন ভর্তি হইতে গেলা কুহেলী?জীবনময় খালি প্যাড়া।যখন আমি আর সমারোহ ভর্তি হইছিলাম,ভাবছি যতদিন ডাক্তার না হই ততদিন শুধু কষ্ট।সকাল সকাল ক্লাস করতে যেতে হবে।সকালে আরামছে ঘুমাতে না পারলে তো জীবনটাই ত্যানা ত্যানা।নাহ!এখন দেখি সকালের ঘুম তো দূর রাতেই ঘুম নাই।আবার মাইশার আতংক তো আছেই।’
কুহেলী হো হো করে হেসে ওঠে সান্দ্রের কথা শুনে।শর্মিলা পেছন থেকে বলল,
‘ঠিক হইছে।তোর শাস্তি আল্লাহ নিজেই দেয় আমাদের জ্বালাস দেখে।’
সমারোহ কুহেলীর হাসি দেখে মৃদু হাসে সবার অগোচরে।মেয়েটার হাসি মায়াবী।অথচ ওর কাছে থাকলে যে কেনো হাসেনা কে জানে!হাসি নিমিষেই লুকিয়ে মুখ শক্ত করে কড়া গলায় বলে,
‘মার খাবি সান্দ্র মেয়েটার মাথায় এসব বাজে কথা ঢুকালে।’
সান্দ্র চোখ বড়বড় করে বলে,
‘দেখো কুহেলী আমার দূর্দশার জন্য এই ব্যাক্তি দায়ী।এই অভদ্র লোক আমাকে জোর করে ভুলভাল বুঝাইয়া ডাক্তারি পড়াইছে।’
কুহেলী আবার হাসে খিলখিলিয়ে।সমারোহ সেসব পাত্তা না দিয়ে উরুতে চাপ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।শার্টের হাত ফোল্ড করতে করতে বললো,
‘আম্মা আমি কুহেলীকে নিয়ে বেরোলাম।’
বৈশাখী দৌড়ে এসে একটা ব্যাগ সমারোহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এটা নিয়ে যাও প্লিজ প্লিজ।তোমার টিফিন।’
সমারোহ চমকে ব্যাগখানি নিতে নিতে বললো,
‘এর কোন দরকার ছিল না।’
‘কিছু জিনিস দরকার ছাড়া করাই ভালো।চলো না আজ আমরা দুজন আপুকে গিয়ে রিসিভ করি।’
সমারোহ রুডলি বলে,
‘আমার সময় নেই।আম্মা আসি।চলো কুহেলী।’
বৈশাখীর কান্না পেল।এমন ব্যবহারে সে অভ্যস্ত নয়।তবে সহ্য করবে।কারন সমারোহ মন থেকে করছে না এমনটা,সবটা অভিমান।
রাস্তায় জ্যাম থাকাতে মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছাতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে।কুহেলী রিকশা থেকে নেমে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে কলেজের ভিতরে ঢুকতেই সমারোহ খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।বিশাল রকম অবাক হয় কুহেলী, সাথে ভয়ও পায়।ওর অবস্থা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আবার হাত ছেড়ে দেয় সমারোহ।বলে,
‘নেমেই কথা না শুনে অমন চোরের মতো পালাচ্ছো কেনো?’
কুহেলী কাঁপা ভয়ার্ত চেহনীতে বলে,
‘পালাবো না।বলুন।’
‘পড়তে এসেছো পড়বে।অযথা ক্যাম্পাসে ঘুরে টাইম নষ্ট করলে আর ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখলে পা ভেঙে দেব একদম।ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে ওয়েট করবে,পড়তে থাকবে।আমার সাথে ফিরবে।’
কুহেলী মনে মনে খুশি হয়।মাথা ডানে কাত করে সম্মতি জানায়।সমারোহ হেসে বলে,
‘স্মরণ থাকে যেন।যাও।’
কুহেলী দৌড়ে পালিয়ে যায়।সমারোহ ওর কান্ডে হো হো করে হেসে ওঠে।
–
ক্লাস শেষ প্রায় মিনিট কুড়ি হয়েছে।কলেজের মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কুহেলী।সমারোহ ঠিক এখানটাতেই অপেক্ষা করতে বলেছিল তাকে।একটু আগ অব্দি চন্দ্রিমা ছিল।সমারোহর সাথে যাবে বলে তাকেও চলে যেতে বলেছে।চন্দ্রিমা কিছুতেই যেতে চাইছিল না।এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে চন্দ্রিমার সাথে চলে গেলেই ভালো হতো।লোকটার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই।এতটা সময় বসিয়ে রাখে কিভাবে!আকাশে মেঘের পরিমান ধীরে ধীরে বাড়ছে।সাথে বাড়ছে ঠান্ডা হাওয়া।অস্থির সৌন্দর্যে ঘিরে যাচ্ছে আকাশ।কুহেলীর এই তাক লাগানো সুন্দর আবহাওয়ায় ও বিরক্ত লাগছে।এপাশ ওপাশ কিছু পায়চারি করে মাঠের এক কর্ণারে পরে থাকা পরিত্যক্ত বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো সে।কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পেছন থেকে একটা সুমধুর পুরুষালি কন্ঠ কানে বাজে কুহেলীর।
‘হ্যালো ম্যাম!’
কন্ঠের উৎস খুঁজতেই পেছনে লোকটা বলে ওঠলেন,
‘মানুষকে অপেক্ষা করানোর দেখিই ভালোই চর্চা আছে আপনার!তা, আজ নিজে কার জন্য অপেক্ষা করছেন?’
সেদিন যে ছেলেটা তার সাথে চন্দ্রিমার বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিল সেই ছেলেটা!ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে ফেললো কুহেলী।এমুহূর্তে লোকটার সাথে ঠাট্টা করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে তার নেই।কথা বলার ও নেই।তবু বোধ হয় ভদ্রতার খাতিরে বলতে হবে ভেবেই আরো খারাপ লাগছে।কুহেলীকে নিশ্চুপ দেখে হালকা হাসলো ছেলেটা।বললো,
‘বড়ই ব্যাক্তিগত ব্যাপার বোধ হচ্ছে।থাক তাহলে বলতে হবে না।তো সেদিন আসেন নি যে?’
‘ইচ্ছা করেনি।’
‘তবে আগেই বলতে পারতেন।’
‘যাব ও তো বলিনি!’
‘হুম তা ঠিক।তবে আজ কি একটু সময় হবে?’
‘না।’
‘এখনো বলবেন ক্লাস আছে!’
‘বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।’
‘ভালো তো,চলুন তাহলে নাহয় আজ আপনাকে পৌঁছে দেই।কাজের কথাটাও সেরে ফেলতে পারবো পথে।’
‘ধন্যবাদ।তার দরকার নেই।’
কুহেলী হাটা শুরু করলো।ছেলেটাও দৌড়ে এসে কুহেলীর পাশ ধরে হাটতে লাগলো।কুহেলীর কাছে বিষয়টা তেমন পছন্দ না হলেও চুপচাপ হাটছে।আরশ দেখে কুহেলী আবার কলেজ ভবনের ভিতরে ঢুকছে। মুচকি হেসে সে বলে ওঠে,
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? সমারোহ স্যারের সাথে বাড়ি ফিরার কথা নাকি?’
কুহেলী ততক্ষণাৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিকে।আরশ ভড়কে গিয়ে বলে,
‘না মানে,আজ রিকশা থেকে নামতে দেখেছিলাম সকালে,তাই বললাম আরকি।’ হাসার চেষ্টা করে আরশ। কিন্তু পারেনা।
‘জ্বি।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর কুহেলীর।
‘কিন্তু উনি তো চলে গেলেন আরো দু’ঘন্টা আগেই।’
থমকে যায় কুহেলী। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আরশের দিকে।এই অতর্কিত ধাক্কার জন্য কুহেলী মোটেই প্রস্তুত ছিল না।কুহেলীর চাহনিতে মন ঝলসায় আরশের।
‘তুমি চাইলে দেখে আসতে পারো হরতাল কেবিন কিংবা অপারেশন থিয়েটারে নেই।’
আরশ ভাবে কুহেলী তার কথা মেনে নিবে। সমারোহ সত্যিই আছে কি নেই দেখতে যাবেনা। কিন্তু সে ভুল ছিল।কুহেলী সমারোহর কেবিনে গিয়ে দেখে আসে। কেবিনটা দোতলায়। কেবিনের দরজা খোলা অব্দি কুহেলী একমনে চেয়ে গেছে যাতে আরশ মিথ্যা বলে। সমারোহ যায়নি।
কিন্তু কেবিনে গিয়ে দেখে সে নেই। বাহিরে নার্সকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে সমারোহ সত্যিই চলে গিয়েছে।মন খারাপ করে নিচে চলে আসে কুহেলী।এটা হওয়ার ছিল। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে তাই গিয়েছে সমারোহ। কিন্তু ওকে কি বলা যেতো না?বলে গেলে হয়তো খারাপ লাগতো না।নিচে আরশ অপেক্ষা করছিল কুহেলীর জন্য।ও আসতেই বলে ওঠলো,
‘চন্দ্রিমার সাথে আপনার বন্ধুত্ব কতদিন?’
কুহেলী আড় চোখে তাকালো ছেলেটার দিকে।বললো,’ আপনার নাম?’
‘ আরশ।ইবনে আরশ রহমান।’
‘ ওহ! মেডিক্যালে আসার পর থেকেই ও আমার ফ্রেন্ড।সময়টা বড় নয়।চন্দ্রিমা অল্পতেই আমার খুব কাছের হয়ে ওঠেছে।ওর বিষয়ে কি বলতে চাইছিলেন আপনি?’
‘তুমি করেই বলি?আমার ভাই আবির।অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে চন্দ্রিমাকে।আই থিংক ও একা না চন্দ্রিমাও ভালোবাসে তাকে।কিন্তু স্বীকার করতে চায় না।ভর্তি পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল দুজনার।এখন চন্দ্রিমা বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসেছে।আর তুমি ওর ভালো ফ্রেন্ড।তাই হ্যাল্প দরকার তোমার কাছ থেকে।’
আরশের কথা শুনে গুরুতরভাবে আহত হয় কুহেলী।চন্দ্রিমা এতো বড় কাহিনির কিছুই বলেনি তাকে!কত পাঁজি মেয়েটা।এরপর দেখা হলে আর কথাই বলবে না।নিজে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর এদিকে কুহেলীকে পাগল বানিয়ে ফেলছে সমারোহর সাথে প্রেম করাতে।কুহেলী মন এবার কিছুটা নরম হলো আরশের প্রতি।ছেলেটা তার বান্ধবীর সাহায্য করতে এলো আর ওই কিনা কথা বলতে চাইলো না! কিন্তু আরশ মে সত্য বলছে তা বুঝবে কি করে? মিথ্যাও তো বলতে পারে। এরকম কিছু হলে চন্দ্রিমা অবশ্যই তাকে বলতো।মেয়েটার পেট পাতলা।কুহেলীকে দেখলে গড়গড় করে যা সব মনে আছে ঠোঁটের আগায় চলে আসে।আর এতো বড় বিষয়টা বলবে না তা কি হয়!
কুহেলী সোজাসুজি বলে,
‘আপনি যে মিথ্যা বলছেন না তার প্রমাণ?
আরশ হো হো করে হেঁসে উঠে কুহেলীর কথা শুনে।যেন কুহেলী এই মাত্র দুনিয়ার সবচেয়ে হাস্যকর জোকস তাকে বলেছে।ভ্রুঁক্রুটি করে ফেলে সে।মুখ-চোখ সংকুচিত করে বলে,
‘হাসছেন কেনো এভাবে?’
‘হাসির কথা বললে হাসবো না?’
‘ ভনিতা করবেনা একদম।’
‘এমা আপনি রাগছেন কেনো?দুইটা মেয়ে,তাও বেস্টফ্রেন্ড, একে অপরের সাথে এই বিষয়ে শেয়ার করবে না তা কি হয়?ভেবে দেখুন হয়তো বলতে চেয়েছিল। মেয়েরা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে পাতলা পেটের মানুষ।কাছের বান্ধবী কেনো যে কারো সাথে দশ মিনিট কথা বললেই ঘরের সব খবর অব্দি দিয়ে দেয়।হা হা হা।’
কুহেলীর মেজাজ খারাপ হয় আরশের কথা শুনে। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পানির তৃষ্ণাও পেয়েছে খুব, আবার ক্লান্তও লাগছে। কুহেলীর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। সত্যিই এমন অনেকবার হয়েছে চন্দ্রিমা তাকে কিছু বলতে নিয়ে বলেনি।কুহেলী ক্লান্তিমাখা নরম কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘চন্দ্রিমা বলতে চেয়েছিল হয়তো তবে বলেনি।কিন্তু কথা হচ্ছে ও যদি সত্যিই আপনার ভাইকে ভালোবাসে তবে আমি সাহায্য করবো।নয়ত না।’
‘ভালোবাসে।’
‘কিভাবে বুঝবো?’
‘তোমাকে বলবে।’
কুহেলী কিছু একটা ভেবে বললো,
‘আমি ওর সাথে কথা বলে জানাবো।আজ আসি।’
আরশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
‘এই তুমি এখন আবার এখানে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজবে?’
‘হু।’ বড় সহজ গলায় বলে কুহেলী।
আরশ কপাল কুঁচকে বলে,
‘তা হচ্ছে না ম্যাডাম।আমার গাড়ি ভেতরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে।আমি পৌঁছে দেব আজ।এক মিনিট দাঁড়াও।’
‘না না।আমি চলে যেতে পারবো।আমার জন্য কষ্ট করতে যাবেন না দয়া করে।’
‘আরে এতে কষ্টের কি আছে?একটু দাঁড়াও হে!জাস্ট এক মিনিট লাগবে।এসে যেন এখানেই দেখি তোমাকে।’
কলেজের মেইন গেট দিয়ে দৌড়ে ভিতরে যেতে বললো আরশ।কুহেলী যেন এক মুহূর্তের জন্য বোকা হয়ে গেল।দুই বার রিকশা বদল করে তারপর কিছুপথ পায়ে হেঁটে বাড়ি যেতে হয়।এখনো রাস্তাঘাট ঠিক করে চিনেনা সব।আর কদিন পর বাসে যাতায়াত করবে।এতোটা রাস্তা আরশ ওকে কষ্ট করে দিয়ে আসবে।তা কি হয়!আর তাছাড়া আরশকে ও এখনো ভালো করে চিনেনা।উল্টো কোন পথে নিয়ে গেলে ফিরেও আসতে পারবে না।তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরশের গাড়িতে ওঠতে হলো।
সূর্য মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে।তাই প্রকৃতি তার নিজ রং নিজেই বেছে নিয়েছে।শীত শেষ হয়ে এলো বলে!পাতা ঝড়া শুকনো গাছগুলোতে ফকফকে সবুজ পত্র পুঞ্জ গোঁজানো শুরু করেছে।বসন্তটা এই এলাম এলাম করেও আসছে না।ফুল ফুটছি ফুটছি করে ফুটছে না।রাস্তায় তেমন একটা যানবাহন নেই।খুব স্পিডে গাড়ী চলছে।মাঝে মধ্যে দু’একটা রিকশা, অটোকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।কুহেলী জানালা দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে।কখনো ধেয়ে আসা সা’ সা’ বাতাস এক ঝাপটায় খোঁপার বুনন খুলে দিয়ে তুলারাশির মতো উড়িয়ে দিচ্ছে কুহেলীর কেশযুগল।খুব কষ্ট করেও সামলানো যাচ্ছে না তাদের।তারা যেন আজ স্বইচ্ছার অধিকারী।
কুহেলীর সামলাতে ইচ্ছাও করছে না।মনটা আজ ভীষণ পাঁজি হয়েছে।কালো মেঘে আচ্ছাদিত করে রেখেছে নিজেকে।মন খারাপ এরা সব গলা চেপে ধরেছে।একটাই অযুহাত, সমারোহ কেনো করলেন এমনটা!চলেই গেলে বললেন কেনো কুহেলীকে থাকতে?খুব কষ্ট হচ্ছে কুহেলীর।
সমারোহ নামক পাজেলটা কি তার জীবনে অমীমাংসিত থেকে যাবে!কিচ্ছু জানে না কুহেলী।শুধু জানে এই মুহূর্তে এমন একটা মানুষের প্রতি তার ঘোর অভিমান হচ্ছে যে কখনোই তার অভিমানের কারণটুকুও খুঁজে দেখবে না।
রাস্তা জুড়ে কোন কথাই কুহেলী বলেনি।আরশ একা একা বলে গিয়েছে।চন্দ্রীমার বিষয়ে আর কুহেলী শুধু শ্রোতার কাজটুকু পালন করেছে।বাসার একদম সামনে এসে গাড়ি থামালে কুহেলী গাড়ি থেকে নেমে মুখ জুড়ে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘মাই প্লেজার।’ মুচকি হাসে আরশ।
কুহেলীর হঠাৎই খেয়াল হয় আরশের মৃদু হাসিটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।যেকোনো মেয়ের সহজেই নজরকাঁড়ার অধিকার রাখে তা।কুহেলী ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নেয় নিজের।ভেজা কন্ঠের অনুনয়ে বলে,
‘আমার বাড়ি হলে এখন অবশ্যই ভিতরে আসতে বলতাম।’
‘তখন না বললেও যেতাম।’ ঠাট্টা করে বলে আরশ।আরশের কথা শুনে হেসে ওঠে কুহেলী।আরশ খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
‘তোমার পাতলা ঠোঁটের হাসি মোহনীয়।’
আরশের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ সামান্য সময়ের জন্য ভরকে যায় কুহেলী।মুখের হাসি মুহূর্তেই বিলুপ্ত হয়।আরশ হেসে বলে ওঠে,
‘ বিদায় দিবে না! আজ আসি?’
কুহেলী জোরপূর্বক হেসে বলে,’ সাবধানে যাবেন।’
কুহেলীকে বাড়ির ভিতরে আসতে দেখে সেযুঁতি এগিয়ে গিয়ে বলে,
‘কুহু,এতো দেরি হলো কেনো?আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করেই যাচ্ছি।ভাইয়াও এসে কয়েকবার খোঁজ করলো তোমার!’
সেযুঁতির কথায় সচকিত কুহেলী বললো,
‘ভাইয়া?’
‘সমারোহ ভাইয়া।কয়েকবার নিচে এসে জিজ্ঞেস করল তুমি এসেছো কিনা।’
‘আচ্ছা!’
‘কি আচ্ছা?বলো এতো লেইট হলো কেন?আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করতেছি?’
‘একজনের জন্য ওয়েট করছিলাম।কেন কিছু হয়েছে?’
‘হুম।আপু আর বাবুরা আসছে একটু আগে।দিদার ভাইয়ার নাকি কিছু দরকারি কাজ আছে।সেগুলো শেষ করে তারপর আসবে।তাই ভাইয়া আর বৈশাখী গিয়ে নিয়ে আসছে আপু আর বাবুদের।’
বৈশাখীর কথা শুনে মুহূর্তেই তিক্ত হয়ে গেল কুহেলীর চাহনি।চরম বিরক্তির আবির্ভাব হলো ভিতরে।মনে মনে উচ্চারিত হতে লাগলো “এই মেয়ে চায় কি!সমারোহর চারপাশে ওর এতো কি?যখন দেখি খালি চিপকুর মতো লেগে থাকে।”
মনের বিরক্তি মনেই রেখে ঠোঁটে মলিন ফিনফিনে হাসির রেখা তুলে কুহেলী বলে,
‘তা তোমার ভাইয়ের আমি আসছি কিনা তা এতো খোঁজ করার কি আছে?রোজ একাই তো আসি।’
সেযুঁতির হাসি পায়।বড্ড বেশি হাসি পায়।হাসি লুকিয়ে বলে,
‘আমি আবার এসবের কি জানি!তোমাকে খুঁজে তুমি ভালো বলতে পারবে।’ বলেই মুচকি হাসে সে।
তারপর আবার বলে,
‘আচ্ছা তোমাকে তুই করেই বলি আমি।এতো সৌজন্যতা আমার আবার পুশায় না।’
কুহেলী হাসে।সেযুঁতি বলে,
‘চল এবার।গোসল করে আপুর সাথে দেখা করবি।কতো বেলা হলো খাওয়া হয়নি।’
‘হুম।যাই।’
দোতলার ঘরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি পাড় করার পরই কুহেলীর ভ্রুঁযুগল সংকুচিত হলো।সমারোহ সিড়ির মাথায় দাড়িয়ে দেখছে কুহেলীকে।কুহেলীর ঠিক তখনটায় খুব রাগ হয়।আসলে রাগ নাকি কষ্ট তা বুঝাই দায় হয়ে যায়।ইদানীং কুহেলী নিজেই ঠাওর করতে পারে না তার রাগের পাল্লা ভারী?নাকি তার চেয়ে কষ্টের পাল্লাটাই বেশি বেদনাদায়ক।কুহেলীকে সাথে না আনলে অথবা বৈশাখীর সাথে গেলেই সকালে অত বড়বড় কথার দরকারটাই ছিল কি!
কুহেলী গভীর অভিমানে চোখ সরিয়ে নেয় সমারোহর থেকে।ভ্রুক্ষেপহীন চলে যায় সমারোহর পাশ কেটে।সমারোহ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কুহেলীর চলে যাওয়া দেখে।
চলবে.
®সাইমা ইসলাম প্রীতি