আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
১১.
আর কিছু দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা।পরপর ঘটা ঘটনাগুলো কুঞ্জার পড়ালেখাতেও বাজে প্রভাব ফেলেছে।আজ ভোরে ওঠেই খোর্শেদ মেয়েকে ঠেকে দিয়ে মসজিদে যান নামাজ পড়তে।তারপর বাড়ি ফিরে কুঞ্জাকে বলেন বইখাতা নিয়ে তার কাছে পড়তে বসতে।কুঞ্জাও আসে।খোর্শেদ জানেন কুঞ্জা কুহেলীর থেকেও ভালো ছাত্রী।কোনো পড়া একবার পড়লে আর ভুলে না।অধ্যায়ের একটা অংক দেখিয়ে দিলে বাকি সব টপাটপ করে ফেলে।সকাল চারটা থেকে ছয়টা অব্দি তিন চার চ্যাপ্টার অংক বুঝিয়ে দিয়ে তিনি রজবের সাথে বাজারে যান।কুঞ্জা একা বসে বাকি অংশগুলো শেষ করতে থাকে।
রমলার ঘরের পিছনে জঙ্গল, তারপরে বিশাল নদী। নদীর এইপাশে ঘাট বাঁধানো ছিল অনেক আগে, এখন অবশ্য ভেঙে গিয়েছে স্রোতের জোরে।জঙ্গলের পাশে বলে কেউ একদিকের পায়ে তেমন একটা যায় না।রমলার ঘরের পাশের ঘরে বসেই কুঞ্জা অংক কষছিল। হঠাৎ ঘরের পেছন জানায় দুবার জোরে আঘাত করে কেউ তাকে ডাকে।একটা মেয়েলী গলা।
‘কুঞ্জা তাড়াতাড়ি আয়,আমি টুম্পা।’
কুঞ্জার খুব ভালো বান্ধবী টুম্পা কিন্তু এতো সকালে সে কেনো ডাকছে?আর বাড়ির ভেতরে না এসে পেছন দিয়েই কেনো আসছে ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে হারিকেন সাথে নিয়ে বের হয় কুঞ্জা। বাহিরের তখনো কুয়াশা, গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে এসেছে কুঞ্জা।ঘরের ভেতরে বসে স্পষ্ট টুম্পার গলার আওয়াজ পেয়েছে সে। কিন্তু এখানে টুম্পার চিহ্নটুকুও নেই।ঘাবড়ে যায় কুঞ্জা। জোরে ডাকলে ভিতর থেকে আম্মা আমরা শুনে বের হয়ে আসবে।না ডেকে যাওয়াও যাবে না যদি এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে!কুঞ্জা নিচু গলায় কয়েকবার ডাকে,
‘টুম্পা,ও টুম্পা?আছিস এখানে? বাড়ির ভিতরে না গিয়া এতো সকালে বাড়ির পিছন থেকে ডাকোস কেন?’
টুম্পা কোন সারা শব্দ দেয় না।কুঞ্জা হেঁটে আরেকটু সামনের দিকের যায়।প্রায় অনেকটা পথই সে এসেছে হারিকেন হাতে।এর চেয়ে ভেতরে যাওয়ার সাহস হয়না।ঘন জঙ্গল, আঁধারে ঢাকা।এমন মনে হয় যেন কড়কড়া রোদেও সেখানে আলো পৌঁছায় না।কুঞ্জা শুনেছে এখানে নাকি অনেক জ্বীনেরা থাকে।তার দাদীমা যখন বিয়ে করে এই বাড়িতে আসে,অনেকবার দেখেছে তেনাদের।তার দাদা মশাই আলেমদ্বার মানুষ ছিলেন।জ্বীনেদের সাথে কথা বলতে পারতেন।জ্বীনরা নাকি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এসে কথা বলতেন তার দাদার সাথে। গ্রামের মসজিদে গিয়ে নামাজও পড়তেন তেনারা।এসব কথা ভাবতেই গা কাঁপিয়ে ভয় পায় কুঞ্জা।তেনাদের কথা মনেও আনা উচিত না।এটা আবার তেনাদের কাজ না তো! ছোট মনে ভয় বেশি।কুঞ্জা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে।ভাবে জ্বীন আবার তাকে ডাকতে যাবে কেনো! তাদের নিজেদেরও তো কাজ কর্ম আছে নাকি!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে টুম্পা কিছু দূরে একটা ছোট্ট পাখি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কুঞ্জার ভয় কাটে মনে মনে সে নিজেকেই দোষারোপ করে,কি সব সে ভাবে! অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কুঞ্জা টুম্পাকে ডাকে,সে শুনতে পায়না।এবার কুঞ্জা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে টুম্পার কাছে যায়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে, গ্রামের সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত;কেবল হাসনাহেনা ছাড়া।বাড়ি, বাড়ির পেছনে গোয়ালঘর, পুকুরপাড় সব জায়গাতেই খোঁজা হয়েছে কুঞ্জাকে,কোথাও নেই সে। সকাল থেকেই নিরুদ্দেশ।হাসনাহেনা একবার কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। খোর্শেদ আর রজব এখনো খোঁজ চালাচ্ছে।রমলা খাতুন ঘরের দুয়ারে মোড়া পেতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।কুঞ্জা এমন না মোটেই, কাউকে না বলে কখনো কোথায় যায় না,ঘর থেকে এক পাও নড়ে না।পাশের দুই তিন বাড়ি খোঁজার দরুণ গ্রামে জানাজানি হয়ে গেছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।কেউ কেউ বাড়ি বয়ে এসেছেন আবার স্বান্তনা দিতে।হাসনাহেনার আবার তা পছন্দ না,তাকে জোর করে শুইয়ে রাখা হয়েছে বিছানায়; রিভুর মা আছেন পাশে।তিনি পাশের বাড়িরই।অমৃতার সম্পর্ক এই বাড়ির সাথে।
দুপুর থেকে বিকাল, তারপর সন্ধ্যা হয়।রজব, খোর্শেদ বাড়ি ফেরে একে একে। এলাকার কেউ দেখেনি কুঞ্জাকে,বড়ই আশ্চর্য বিষয়!
সকালে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসার পর হালকা নাশতা খেতে বসেন খোর্শেদ।হাসনাহেনা কুঞ্জাকে ডাকতে ঘরে গিয়ে দেখেন কুঞ্জা ঘরে নেই,ভাবেন হয়তো আশেপাশেই আছে। কিন্তু সময় অতিবাহিত হয়,কুঞ্জাকে আর পাওয়া যায় না। রমলা মাগরিবের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসেই কাঁদেন গুনগুনিয়ে।সময় কাটে, হাসনাহেনা স্থির হতে পারেন না এবার। নামাজ পড়ে বের হয়ে যান ঘর থেকে।তার ধারণা, কুঞ্জা গায়েব হওয়ার পিছনে জসীম কিংবা পলাশের হাত আছে।রাম’দা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে না হতেই রমলা আটকাতে মান ছুটে,পারেননা।খোর্শেদ আটকানোর চেষ্টা করলেও থামানো দায় হয়ে যায় তাকে।সবার কথা অগ্রাহ্য করে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখেন দুইটা লোক ছুটে আসছে তাদের দিকে।
এসে হাসনাহেনার সামনে পড়ে হাঁপায়।খোর্শেদ আর রজব আসেন পেছন পেছন,।রজবের হাতে কুপি জ্বালানো, অন্ধকারে লোক দুইটার মুখ দেখা যায় না।লোকদুটোর মাঝে একজন বলে উঠে,
‘আমি নদীর উপারের, রাব্বি।চিনছেন নিশ্চয়ই খোর্শেদ মাস্টার?’
‘হো, রাব্বি জেলে নাকি?রজব বাত্তিটা মুখ বরাবর ধর দেখি।’
রজব বাতি উঁচিয়ে ধরে।রাব্বি জেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘মাস্টার’সাব রাত্তিরে মাছ ধইরা আমরা পাঁচজন বাড়ি ফিরতাছিলাম,দেখি কুঞ্জা আপা অজ্ঞান হইয়া পইড়া আছে ওইহানে নদীর ধারে।ওই দিকে কেউ ডড়ভয়ে যায়না।লইয়া আইতাছে আমার লোকেরা,মাইয়্যাডার শইলে (শরীরে) জ্বড়!’
–
গোসল করে এসেও নিজের মনকে খুব একটা ঠান্ডা করতে পারেনি কুহেলী। কষ্ট হচ্ছে, ক্ষোভ-জিদ সব একসাথে হচ্ছে। মনের মধ্যে একটা বিশ্রী পরিবেশ তৈরি হয়েছে,তবুও সে হাসিমুখে বের হয়ে আসলো ঘর থেকে।বাড়ির মধ্যে আনন্দমুখর পরিবেশ তার মাঝে গোমরামুখো হয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। নিচে গিয়ে দেখে সেঁজুতি ওর জন্য খাবার বেড়ে রেখেছে।ওকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘নাও, খেয়ে নেও চট করে।’
কুহেলি কথা বাড়ালো না, টেবিলে হাজারটা তরকারি থাকলেও শুধু আলু ভাজি, লাউ-শাক তরকারি আর ডাল দিয়ে খেয়ে উঠলো।খাবারগুলো কেমন যেন পানসে মনে হলো ওর কাছে।সেঁজুতি আনরুবাকে সাহায্য করছে, নয়নাকে দেখা যাচ্ছে না। কুহেলী খাওয়া শেষ করতেই সেঁজুতি দৌড়ে এসে বলে,
‘চলো,আপুর ঘরে চলো। তুমিতো তাকে দেখোই নি এখনো?বাবুগুলো যা কিউট না আপুর!আমি এই প্রথম দেখলাম,ভিডিও কলে কথা হতো অবশ্য। ওরা হওয়ার পর আপু এই প্রথম এসেছে বাংলাদেশে।’
সেঁজুতির এক্সাইটমেন্ট দেখে কুহেলীর হাসি পায়। সারিকার রুমের সামনে গিয়ে সেঁজুতি চেঁচিয়ে বলে,
‘ভেতরে আসি আপু্?’
ভেতর থেকে মখমলের মত মসৃণ একটা কন্ঠে ভেসে আসে, ‘আয়!’
সেঁজুতি কুহেলীকে নিয়ে ভেতরে যায়,সারিকাকে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় কুহেলির।কোমর অব্দি লম্বা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে ছড়িয়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে অতীব সুন্দরী এক রমণী, রুপ যেন তার ঠিকরে পড়ছে।সারিকাকে রুপকথার কোনো রাজকন্যা মনে হয় কুহেলীর।নয়না বা সেঁজুতি ওর ধারে কাছেও না।কুহেলীর অবচেতন মন ভাবে সমারোহের সাথে সারিকার চেহারার অনেক মিল। ওদেরকে দেখে সারিকা ওঠে বসে।হাসি মুখে বলে ওঠে,
‘তুমি কুহেলী না?সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম তোমাকে, দেড় বছরের বাবু ছিলে, এখন কত বড় হয়েছো।এসো বসো,কেমন আছো?’
কুহেলি মিষ্টি হেসে সারিকার সামনে গিয়ে বলে,
‘ভালো আছি আপু। আপনি?’
‘ভালো, তো কেমন লাগছে এখানে, খারাপ নাতো!পড়ালেখার কি খবর?’
‘ভালো চলছে। আপনারা সবাই যা ভালোবাসা দিচ্ছেন ভালো না লেগে খারাপ লাগার তো প্রশ্নই আসে না।’ হাসে কুহেলী।
‘তুমি বেশ মিষ্টি দেখতে!’
কুহেলি লজ্জায় নুইয়ে যায় সারিকার কথা শুনে। অতীব সুন্দরী কিনা কুহেলীর প্রশংসা করেছে!টুকটাক কথা বলতে বলছে বেশ ভালোই গল্প জমে তাদের মাঝে।কুহেলী এদিকওদিক দেখে বলে,
‘আপু বাবুরা কোথায়?’
‘নয়না বাবুদের গোসল করাতে নিয়ে গেলো একটু আগে।’
‘নাম কি ওদের?’
‘ বড়জন সুহা আর ছোটজন নুহা।’
‘ চমৎকার নাম।’
‘এদের বাবা রেখেছে।’ হেসে বলে সারিকা।
‘ভাইয়ের এখনো আসেননি না?’
‘রাত হবে হয়তো আসতে।’
নয়না এর মাঝেই সুহা আর নুহাকে নিয়ে আসে,ওরা দুজন সারিকার জমজ মেয়ে। কুহেলী আশ্চর্য হয় তাদের দুজনের চেহারার এত মিল দেখে।একই খাবার পছন্দ,একই জামা পড়ে এমনকি দুজনের চুল ও একইভাবে বাঁধতে হবে!
দুজনের কোন পার্থক্যই সে খুঁজে পায়না।কুহেলীর মনে পড়ে তাদের গায়ের পাশের পশ্চিম পাড়ায় এমন দুই জমজ ভাই ছিলো।ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কুহেলিদের সাথেই পড়তো।কিন্তু তাদের দুজনের বৈশিষ্ট্য একদম বিপরীত ছিলো, চেহারার মাঝেও মিল ছিলো কম।
গল্পের মাঝেই সারিকার ওয়াশরুম থেকে আরেকটি মেয়ে বেড়িয়ে আসে, কুহেলি তাকে চিনতে পারে না।সারিকা তাকে দেখে হেসে বলে,
‘ক্লান্ত লাগছে?
‘বেশ খানিকটা।’
নির্মল কন্ঠ মেয়েটির। চেহারায় হতাশার ছাপ। চুলগুলো অল্প হলেও হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে।দেখে যে কারোর মনে হবে যত্ন নেয়া হয়না বহুবছর। তারপরও দারুন লাগে কুহেলীর চোখে।
সারিকা মেয়েটির কথা শুনে আহ্লাদি গলায় বলে ওঠে,
‘ওষুধ খেয়েছো?ভাত খাবে না এখন, নাকি বিশ্রাম নিবে?’
‘একটু শুই, ঘুম পাচ্ছে।’
‘আচ্ছা আসো, আমার পাশে এসে শুয়ে থাকো,শরীরটা তাল পাক একটু।তারপর নাহয় খেয়ো।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ে সারিকার পাশে।সেখানকার সবাইকে যেন সে অগ্রাহ্য করছে।কে আছে কে নেই তাতে কিছু আসে যায় না তার! একমাত্র ঘুমই তো আপন। সারিকা ক্লান্তি নিয়ে সেঁজুতিকে বলে,
‘সুহা,নুহাকে তোদের ঘরে নিয়ে যা।ওরা থাকলেই হৈচৈ, তোলপাড় শুরু করবে।মেয়েটা অসুস্থ, ঘুমাতে পারবে না।’
কুহেলী তাড়াহুড়ো করে বলে উঠে,
‘আপু আমি নিয়ে যাচ্ছি আমার ঘরে। খাইয়ে দিয়ে গল্প করবো। তুমি রেস্ট নাও।’
সারিকা হেসে সম্মতি জানায় কুহেলীকে।
সমারোহর ভেতরটা অস্থির লাগে। বুকের বাঁ পাশটা যেন জমে গেছে। নিজের ঘরে বসেও শান্তি পাচ্ছে না।বই নিয়ে এসেছিল একটা।পড়ছে কিন্তু মাথায় ঢুকছে না কিছু। সারিকা আপু একটা আসলেই পারতো!এই সময় আসতেই গেলো কেনো?এটা বিরক্তির কারণ বটে তবে এটার চেয়েও বড় কারণ হয়তোবা কুহেলী!
হ্যা,কুহেলী আজ যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছে।মেয়েটা তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে দ্রুত গতিতে।কুহেলীর রাগ কমানোর আগে পর্যন্ত তা শান্ত হবে না।বৈশাখীর প্রতি মাথা প্রচুর গরম হচ্ছে।মেয়েটার জন্য আজ একটা বাজে পরিস্থিতিতে পরতে হলো তাকে।আজ সমারোহর ভয় হচ্ছে। কিন্তু কেনো?কি করেছে সে? চুরি,ডাকতি, ছিনতাই কিছুই তো না।তাহলে কিসের ভয়? নিজের অতীতের?দোষ তো তার ছিল না, বরং ওর ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা সব টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল অন্য কেউ, তাহলে ভয় কিসের? কুহেলীর অভিমান ভাঙ্গাবে কি করে তা নিয়ে?নাকি অন্য কিছু? সমারোহ শুধু ভেবে চলে,এই ভাবনার শেষ কোথায়! জীবনটা জটিল কিন্তু তার সমাধান তো আছেই। সমারোহ বিছানা থেকে ওঠে যায় লাইব্রেরীতে।একটা ফাইল বের করে পড়তে পড়তে নিজের ঘরে চলে আসে।
সুহা বেশ পরিপাটি থাকতে ভালবাসে আর নুহা অগোছালো প্রকৃতির। ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে একদম ভালোলাগে না তার।ক্লাস ফোরে পড়ে দুজন।পড়ালেখায় নুহাশ বেশি ভালো, অংকে সবসময়ই ফুল মার্ক পায় আর সুহা বিজ্ঞানে।এটা সেটা নিয়ে বেশ গল্প জমে ওঠে।কুহেলীর সাথে আছে শর্মিলা আর সেঁযুতি।নুহা খুব চঞ্চল প্রকৃতির বলে গল্প করেই চলেছে।দেখে কেউ বলতেই পারবে না যেন কুহেলী,শর্মিলাদের সাথে এর আগে সে থাকেনি।সুহা চুপচাপ সব শুনে চলে।কথা বেশি বলেনা সে।গল্প করার মাঝেই আনরুবা আসেন তাদের ঘরে। সবাইকে গল্পগুজব করতে দেখে বলেন,
‘তোদের কি আর আক্কেল জ্ঞান হইবো না? বাচ্চা মেয়েগুলো এতো এতো দূর থেকে আসছে একটু ঘুমাইতে দিবি তো!’
নুহা আনরুবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ওফ নানু,খালামনিদের বোকো না তো। আমাদের তো ঘুম পাচ্ছে না! গল্প করতে ভালো লাগছে।’
আনরুবা আদর দেখিয়ে নাতনির কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে চুমু খান।তারপর আহ্লাদ দেখিয়ে বলেন,
‘তা বললে হবে না নানুমনি!এখন ঘুমাতে হবে।নাহলে শরীর খারাপ করবে।’
‘আচ্ছা।’ শান্ত গলায় বলে সুহা।
আনরুবা হাসেন।বলেই, ‘গুড গার্ল। সেযুঁতি নিচে আয় আমার সাথে।’
সেঁযুতি আর শর্মিলা চলে গেলে কুহেলী রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সুহা-নুহাকে।বিকাল সাড়ে চারটায় কুহেলী ছাদে আসে।ছাদে এসে ছোট ছোট টবে ফুল গাছগুলোতে পানি দেয় কুহেলী। অনেকগুলো ফুল ফুটেছে আজ।দেখতে খুব সুন্দর লাগছে ছাদটাকে। ছাদের ফ্লোর মসৃণ।রংও করা ছিল হয়তো।বাড়িটা অনেকদিন পুরোনো হওয়াতে ছাদের রং উঠে গিয়েছে।কুহেলীর মনে হয় নতুন করে রং করলে গাছগুলোতে আরো সুন্দর লাগতো। বাড়ির পেছন দিকে বাগানের মাঝে একটা সুইমিং পুলও আছে। ছাদ থেকে তাকিয়ে সেটা দেখতে পায় কুহেলী।ফকফকা পরিষ্কার পানির মাঝে গাছের শুকনো পাতা পড়ে আছে।কুহেলী পাহাড় বরাবর মুখ করে দাঁড়ায়। ঠান্ডা বাতাস বইছে চারদিক থেকে।মনটা হালকা হয়।একটা ভারী কষ্ট যেন উড়ে যায় নির্মল বাতাসের ছটায়। সমারোহ দু’মিনিট যাবৎ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে কুহেলীর দড়জার সামনে। কয়েকবার টোকা দেয়ার চেষ্টা করেও পারলো না।হাত কাঁপছে।এমনটা হয়না কখনো কিন্তু আজ হচ্ছে। বিরক্তি উঠছে নিজের উপর।বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজের মাঝে কনফিডেন্স জুগিয়ে টোকা দিয়েই ফেলে এবার। ভেতর থেকে সাড়াশব্দ আসে না দেখে বিচলিত হয়।কুহেলী ভয়াবহ রেগে আছে তার উপর। সমারোহ ক্ষীণ স্বরে ডাকে,
‘কুহেলী!’
তাও কোনো উত্তর নেই। সমারোহ বলে, ‘কুহেলী আসবো?’
‘মামা?’
কুহেলীর ঘর থেকে আশা শব্দে টনক নড়ে সমারোহ।চমকে দড়জা খুলে দেখে সুহা বিছানায় শুয়ে মাথা উঁকি দিয়ে দেখছে দরজার দিকে। সমারোহকে দেখে বলে,
‘ঘুমাচ্ছিলাম মামা।’
‘আচ্ছা ঘুমাও পুচকি।এমনি তোমাদের দেখতে আসলাম।’
ততক্ষণাৎ ঘর থেকে বের হয়ে যায় সমারোহ।ভাবে ঘরে নেই তাহলে ছাদেই থাকবে কুহেলী। ছাদে গিয়ে দেখে সত্যিই কুহেলী সেখানে।চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। সমারোহ নিঃশব্দে কুহেলীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।বলে,
‘ফুল ভালোবাসো খুব?’
সমারোহর কথা শুনে চমকে উঠে কুহেলী।তার থেকেও বেশি ভয় পায়।হুট করে আসায়।
‘কেনো বলুন তো?’
‘রোজ ছাদের ফুল গাছে পানি দাও দেখি।’
‘জ্বি।’
কথা বাড়াতে চায় না কুহেলী। সমারোহর প্রতি রাগ কমেনি। সমারোহ চুপ করে থাকে কিছু সময়।চোখ অস্থির রেখে বলে,
‘বৈশাখী আমাকে না বলেই হসপিটালে চলে এসেছিল।দিদার ভাইয়াকে ও বলে দিয়েছিল বাড়ির গাড়ি নিয়ে আমরা তাদের আনতে যাব।আমি না করি, ততক্ষণে ড্রাইভার চাচা চলে গিয়েছিলেন বৈশাখীকে পৌঁছে দিয়ে।তাই বাধ্য হয়ে যেতে হলো।’
কুহেলী অন্য দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমাকে কেনো বলছেন? কোথায় যাবেন না যাবেন আপনার বিষয়।’
সমারোহ মুচকি হাসে।এক আঙ্গুল মানুষটার রাগ যেন আকাশ সমান!রাগলে কুহেলীকে মায়াবী রাজকন্যার মতো দেখায়।কুহেলীর সেই মায়াবী চেহারা দেখতে দেখতে যেন সব কথাই ভুলে যায় সমারোহ। অনেকক্ষণ বাদেও সমারোহ কিছু না বলাতে কুহেলী ফিরে তাকায় সমারোহর দিকে। চার চোখ এক হয়ে যায়।সময় যেন আটকে যায়। সমারোহ হা হয়ে দেখছে তাকে।কুহেলী লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়।সমারোহ তাও তাকিয়ে থাকে।
কুহেলী আরো বেশি লজ্জা পেয়ে যায় এতে। লম্বা চুলের খোঁপা আধ খোলা হয়ে যায় হালকা হাওয়ায়।গলা অব্দি লম্বা সামান্য চুল খুলে এসে পড়ে মুখের উপর। মৃদু বাতাসে বারংবার কেঁপে ওঠে চুলগুলো।সমারোহ এই প্রথমবার খেয়াল করে কুহেলীর বাম পাশের চোখের নিচের পাপড়ি ঘেঁষে খুব সূক্ষ্ম ছোট কালো একটা তিল আছে।এটা চোখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। সমারোহ কন্ঠে সহস্র মোহ ঢেলে বলে,
‘কুহে-লী!’
সমারোহর গলা কুহেলীর সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুলে। কেঁপে ওঠে ঠোঁট।কুহেলী কাঁপতে কাঁপতেই বলে,
‘ব-লু-ন।’
‘ভয় পাচ্ছো কেনো?’
‘পাচ্ছি না তো।’
‘ক্ষেপে আছো আমার উপর।’
‘তেমনটাও না।’
‘অভিমাণ!’
‘অভিমাণ করার সম্পর্ক আপনার সাথে আমার নয়।’
‘অপেক্ষা করিয়ে আগেই চলে এসেছি। কিছু একটা তো করা উচিত।দেখো রাগ করলে চেঁচাতে পারো।’
কুহেলীর একবার মনে মনে ইচ্ছা হয় সত্যিই খুব করে বকে দিতে। কিন্তু পারে না। লোকটার সাথে চাইলেও রাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না।কুহেলী আপন মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মুচকি হাসে।সমারোহ বলে,
‘এবার ভালোলাগছে।’
আলো ছাদে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে সমারোহ দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ের সাথে। টুকটাক কথা বলছে আর হো হো করে ছাদ কাঁপিয়ে হাসছে। সমারোহকে হাসতে দেখে আলোর মনে একটা সূক্ষ্ম ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। সমারোহর হাসি শুধু মায়াবী বললে ভুল নয়, অন্যায় হবে। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য সেখানে আছে।আলো নিজের অজান্তেই হাঁসির রেখা ফুটায় নিজের মনে।আসার পর একবারো সমারোহর সাথে কথা হয়নি আলোর।তাই খাওয়া শেষে সমারোহর ঘরে গিয়েছিল।না পেয়ে সারা বাড়ি চুপচাপ খুঁজে এখন ছাদে এসে পেলো।আলো এগিয়ে যায় এদের কাছে। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকায় কুহেলী বা সমারোহ দেখেনি আলোকে।আলো গিয়ে সজোরে বলে,
‘আমি কি যোগ দিতে পারি তোমাদের সাথে?’
আলোর কন্ঠস্বর শুনে কুহেলী পেছন ফিরে তাকায়। সমারোহ চোখ বুজে দাঁড়িয়েই থাকে।কুহেলী মিষ্টি হেসে বলে,
‘অবশ্যই। কেনো নয়।’
আলো সৌজন্যমূলক হাসে।বলে,
‘আমি আলো।সারিকা ভাবীর একমাত্র ছোট জা। আমেরিকার বেথ ইসরায়েল ভিকোনেস মেডিকেল সেন্টারে ডাক্তার হিসাবে আছি।তুমি?’
‘কুহেলী। চট্টগ্রাম সরকারি মেডিকেল কলেজে এবার প্রথম বর্ষে।’
‘আচ্ছা! বাড়ি কোথায় তোমার?’
‘ রাজশাহী।’
‘এখানে আছো আর কতোদিন?’
আলোর কথায় চুপসে যায় কুহেলী।কিছুই বলার নেই ওর,এমন অবাঞ্ছিত অবস্থায় পড়তে হবে ভাবেনি।কুহেলীর মুখের অবস্থা দেখে আলো আরো উৎসাহিত হয়।ফোড়ন কেটে বলে,
‘না মানে হলে তো উঠবে না?কবে উঠছো হলে? এভাবে অন্যের বাসায় তো আর মাসের পর মাস থাকা যায় না তাই!’
কুহেলী কিছু বলার আগেই সমারোহ এপাশ ফিরে বলে,
‘এই বাসাতেই থাকবে ও।আব্বুর প্রিয় বন্ধুর মেয়ে কুহেলী,আম্মুর খুব আদরের।আমরা থাকতে হলে কেনো থাকতে হবে ওকে?’
‘না আমি ভেবেছিলাম…’
আলোকে একপ্রকার থামিয়ে দিয়েই সমারোহ বলে,
‘এতে ভাবাভাবির কিছু নেই।কুহেলী আমাদের নিজেদের লোক।’
‘হুম।’ চুপসে যায় আলো।মেয়েটার সামনে সমারোহ অপমান করলো তাকে।কি এমন বলেছেসে?
কুহেলীর মনে বারবার বারি খায় কথাটা। ‘কুহেলী আমাদের নিজেদের লোক’।রাশি রাশি প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে মনের মাঝে। সমারোহ তাকে নিজের লোকের মধ্যেই গন্য করে! অদ্ভুত হলেও ভালো লাগলো।
আলো জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘অনেকদিন পর দেশে আসলাম। নিজের দেশের প্রতি আলাদাই একটা টান থাকে। নিজের জিনিস থেকে দূরে থাকলে সেটা হারে হারে টের পাওয়া যায়।’
সমারোহ রক্তিম চোখে দেখে আলোকে। কিছু বলতে নিয়েও পারেনা কুহেলী আছে বলে।কুহেলীর মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানায় আলোর কথার। গভীর ভাবনায় মত্ত হয়ে বলে,
‘আমিও অনেক মিস করি আমার গ্রাম।আব্বা, আম্মা,বোন,দাদীমা,রজবদা সবাইকে। অনেক করে মনে পড়ে তাদের কথা।কান্নাও পায় মাঝে মাঝে।’
মনটা বেজায় খারাপ হয়ে যায় কুহেলীর।বাড়ির কথা মনে পড়লেই খারাপ হয়।আব্বা, আম্মাকে না দেখে এতো দিন কাটায় নি কখনো। সমারোহ কুহেলীর পাশে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করতে পারে কষ্টটা।আবেগী হয়ে পরে বলে,
‘কথা হয়নি আজ-কালের মধ্যে?’
‘নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা হয়।’
‘তাও ঠিক।’
আলোর আর ভালো লাগছে না।মেয়েটার সব কথাই যেন টেনে নিয়ে যায় সমারোহ। একাকি কথা বলা দরকার সমারোহর সাথে।কুহেলীর দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বাজখাঁই গলায় আলো বলে,
‘তুমি একটু নিচে যাবে?সমারোহর সাথে পার্সোনাল কথা আছে আমার।’
কুহেলীর খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারেনা। সমারোহও কিছু বললে আলো অপমানিত হবে তাই সেই চুপ থাকে।কুহেলী ঠোঁট টানটান করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘অবশ্যই।’
কুহেলী ছাদ থেকে যেতেই আলো বলে ওঠলো,
‘সমারোহ তুমি এখনো…।’
আলোর কথা শেষ হওয়ার আগেই আলোর দিকে একধাপ এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত ঘষে সমারোহ বললো,
‘তোমার এই নোংরা মুখ থেকে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা।’
আলোকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেখান থেকে চলে এলো সমারোহ।আলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।এতো অবহেলা কেউ তাকে কখনো করেনি, কখনো না। কিন্তু সমারোহ করছে,তাও আলোকে চুপ থাকতে হবে।কিছুই সে বলতে পারবে না।এটা যন্ত্রণার।
বৈশাখী আর শর্মিলা আজ চলে যাবে,ব্যাগ পত্র গোছানো শেষ।শর্মিলা আরো কয়েকটা দিন থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু বৈশাখী বেঁকে বসেছে।অন্যবার এই বাড়িতে আসলে সে যেতেই চায়না। কিন্তু এইবার কি হলো কে জানে।শর্মিলার অভ্যাস যেকোন জায়গায়ই সে তাকে এতো মায়ায় পড়ে যায় যে আসার আগে দু-তিন দিন শুধু কান্নাই করে।সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার কাছে গিয়ে গিয়ে কান্না করে এসেছে। আনরুবা নরম মনের মানুষ। বৈশাখীকে অনেক করে বলেন থাকতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!আলোকে সে একদম নিতে পারছে না,কুহেলীকেও না।মাথা প্রচুর গরম আছে।সে তাকে পছন্দ করে তার পিছনেই কেন হাজারটা মানুষের পড়ে থাকতে হয় সে বুঝে উঠে না।কুহেলীকে তাও সহ্য করা যায়,আলো মেয়েটাকে যায় না।মেয়েটা গাঁয়ে পড়ে আসে অপমান করতে। বৈশাখী যাওয়ায় খুব খুশি আলো। বৈশাখীর ধারণা সবাই তাদের বিদায় দিচ্ছে আর ঘরে বসে মজা নিচ্ছে আলো।
রাতের খাওয়ার সময় দিদার ছিল বাসায়।সে এক উচ্ছল, হাস্যরসিক মানুষ।সান্দ্র আর দিদির একসাথে হলে তো কথাই নেই, পুরো ঘরটা হাসি-ঠাট্টায় ভরে থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আলো সারিকার ঘরের গিয়ে বলে,
‘ঘুমাবা এখন ভাবী?’
সারিকা লাগেজ থেকে শাড়ি, জামাকাপড় বের করে আলমারিতে রাখছিল।আলোকে দেখে বলে,
‘আরে না।এতো তাড়াতাড়ি কিসের ঘুম?সবে তো মাত্র দশটা বাজে।’
‘ভাইয়া কি?’
‘তার কথা আর বলো না। সারাদিন পরিশ্রম করে এখন আবার আড্ডা দিতে গেল সমারোহ-সান্দ্ররে নিয়ে।নুহাও নাচতে নাচতে গেল ওদের পেছন পেছন।মেয়েটা পুরাই বাপের মতোই হইছে!’
‘বাইরে?’
‘সুইমিংপুলের পাশে বসে আছে গিয়ে।’
‘ও, আচ্ছা শুনো না।কাল একটু শপিং এ গেলে কেমন হবে!একটু ঘুরা-ফেরাও করতাম।’
‘ভুতের মুখে রাম রাম! তুমি ঘুরতে যেতে চাও! নিজেকে তো ঘর বন্ধি করে মেরেই ফেলছিলে।’
‘না মানে আসলে, খারাপ লাগছিল খুব।’
‘আমি সমারোহকে বলবো।নিয়ে যাবে তোমাকে। এবার খুশি?’
‘হুম।’
ঝলমলে হাসে আলো।সারিকার মন প্রফুল্ল হয়।মেয়েটাকে কতকাল সে সামান্য খুশিও হতে দেখেনি।দিদারের ছোটভাই দোহান এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে রেনু মেয়েটা বেঁচে থেকেও মরে গিয়েছিল।মাত্র দুই বছরের সংসার ছিল আলোর।এতো অল্প বয়সেই মেয়েটা বিধবা হয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্যতম কষ্ট ভোগ করেছে। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের ন্যায়-অন্যায়ের বিচার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করেন।মেয়েটা হয়তোবা তার অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছে।এবার একটু সুখ পাক। আনন্দটা তার হোক।
চলবে.
আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
১২.
গতকাল রাত থেকে জ্ঞান ফিরেনি মেয়েটার,গায়ে মাত্রা ছাড়ানো জ্বর।আসর নামাজ পড়ে কুঞ্জার পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়েন হাসনাহেনা।পড়া শেষ হলে কুহেলী আর কুঞ্জার জন্য হাত তুলে দোয়া করেন।কুঞ্জার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে দেন। সন্ধ্যার দিকে জ্বরের মাঝেই বিড়বিড় করে কুঞ্জা। বারবার একই কথা,
‘আমারে নিয়া যাইয়ো না।’
অনেক ঔষধের পর রাতে জ্বর কমে।শরীরে একটু শক্তি আসে।চোখ মেলে তাকায়।রমলা নাতনির সঙ্গেই ছিলেন তখন।কুঞ্জা ক্ষীণ স্বরে পানি চায়। হাসনাহেনা রান্নাঘরে থেকে দৌড়ে এসে পানি দেন। হঠাৎ করেই যেমন জ্বর,শরীরে ক্লান্তি লাগাটা কেটে গেলো!দুই চারটা কথা বলেই উঠে বসে কুঞ্জা। রমলা শুয়ে থাকতে বললে তাদের অবাক করে দিয়ে কুঞ্জা বলে,
‘শুয়ে থাকতে ভালোলাগে না।শরীরে এখন শক্তি আসছে। ক্ষুধা লাগছে খুব।আম্মা আমার না ছোট মাছের ঝোল দিয়া গরম গরম ভাত খাইতে ইচ্ছা করতাছে।’
খোর্শেদ মেয়ের কপালে চুমু খান।কতো শতো সুখ এই ছোট্ট মানুষটার মুখে!খোর্শেদের মনে হয় বাবা-মার সামর্থ্য থাক বা না থাক সন্তানের চাওয়া আবদার যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান চাওয়া।খোর্শেদ প্রফুল্ল হয়ে বলেন,
‘খাইবা তো।আমার আম্মাটা তা চায় তাই খাইবো।হেনা, বাড়িতে ছোট মাছ আছে এখন? থাকার কথা তো না। রজব আর গিয়া পুকুর থেইক্কা টাটকা পুঁটি,ট্যংরা,কাচকি মাছ ধইরা আনমু।লেবু আছে?লেবুও লাগবো।রজব কইরে? ঠেলাজাল আর আন্টা’টা নিয়া আয়। ‘
খোর্শেদ খোশমেজাজে রজবকে সাথে নিয়ে যান মাছ ধরতে। হাসনাহেনা দ্রুত এসে কুঞ্জার পাশে বসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালের চুল সরিয়ে চুমু খান। আহ্লাদী সুরে বলেন,
‘সকালে কই গেছিলা মা তুমি?এমনে কেউ যায়?কত্তো চিন্তা করছে তোমার আব্বা আর আমি?কই গেছিলা?’
কুঞ্জা হালকা ভীতি নিয়ে গুনগুনিয়ে বলে,
‘আম্মা সকালে না টুম্পা আসছিল।আমারে ঘরের পিছনের দরজা দিয়া ডাইক্কা জঙ্গলে নিয়া গেল।আমি ওর পিছে পিছে গেছিলাম।তারপরে অনেকটা যাওয়ার পর ওরে খুঁইজা পাইতাছিলাম না।বাড়ি ফিরতে নিছি তখন শরীরে চাদর জড়ানো একটা লোক আমারে টাইন্না নিয়া যাইতাছিল।আমি চিল্লাইছি।এর পরে আর মনে নাই।’
রমলা চমকে ওঠেন। টুম্পার বাসাতেও তারা কুঞ্জাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন,কিন্তু পায়নি। গত পরশু স্কুল ছুটি হায়দার পর টুম্পার সাথে কুঞ্জার দেখা হয়নি।এতোটুকুন বাচ্চা মেয়ে মিথ্যা বলবে না।বানিয়েও বলতে পারবে না এভাবে।কুঞ্জা আবার বলে ওঠে,
‘অনেক শক্ত হাত জানো!আমি হাতে ব্যাথা পাইছি।এই যে দেখো, এইখানে।’
হাসনাহেনা সংকিত হয়ে কুঞ্জার দুই হাত ভালোমতো দেখেন।কেনো দাগ নেই।ফর্সা মসৃন হাত।রমলার ভয়ে চেহারার রং পাল্টে যায়। ভয়ংকর কিছুর আশঙ্কা নিয়ে থমথমে গলায় বলেন,
‘শইল্লে আর কোনখানে আছে ব্যাথা?’
‘না।’
কলিজায় পানি ফিরে পান।তারপর আবার বলেন,
‘হাতে আছেনি?’
‘না দাদীমা।’
‘আইচ্ছা।শইলডাতে একটুও জ্বর নাই?’
‘জ্বর চলে গেছে।’
খিলখিলিয়ে হেসে উঠে কুঞ্জা। হাসনাহেনা আরো কয়েকবার চুমু খান মেয়ের কপালে গালে। তারপর রান্নাঘরে যান ভাত দেখতে।রমলা জোরপূর্বক হেসে বলেন,
‘দাদুমনিটা, তুমি থাকো আমি অজু করার পানি নিয়া আসি। আমার সাথে এশার নামাজ পড়বা।তারপর সূরা নাস,ফালাক, ইখলাস পড়বা। তোমারে নতুন দূরূদ শিখায় দিমু। শয়তান দূরে থাকবো।আমি যাই।পানি আনি।’
বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন তিনি।বিষয়টা কেমন যেন আজব ঠেকছে রমলার কাছে।তেনাদের নজর পড়লো নাতো আবার তার অবুঝ নাতনি টার উপর।ভয় পান রমলা,ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়।
দুঘন্টা বাদে ঝাঁকি ভর্তি ছোট মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেন খোর্শেদ। হাসনাহেনা বেশি করে কাঁচা মরিচ আর রসুন দিয়ে ঝোল ঝোল করে রাঁধেন।কচি লেবু দিয়ে ধোঁয়া ওঠানো ভাত মেখে খাইয়ে দেন কুঞ্জাকে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। রমলার ভয়ে যেন কমছেই না। সারাদিন অজ্ঞান হয়ে থাকা মেয়েটা হুট করে ওঠেই কিভাবে চঞ্চল হয়ে যায়! খাওয়া-দাওয়া শেষে রমলা খোর্শেদকে ডেকে নিয়ে বলেন যেন মসজিদের হুজুরকে বাড়িতে আসতে বলেন।
–
বিছানায় শুয়ে ‘আ লিটল্ লাইফ’ হানিয়া ইয়ানাগিরাহা’র বিখ্যাত বইটি পড়ছিলো সমারোহ।দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনতেই বললো,
‘আসো।’
সারিকা ঘরের ভেতর ঢুকে সোফায় গিয়ে বসে।সমারোহ বইটা ভাঁজ করে তার বুকের উপর রেখে আধশোয়া হয়ে বসে। ঠোঁট টানটান করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। সারিকা কথায় আদরের ছাপ ফেলে বলে,
‘কি? বই পড়ছিলি ভাই?’
সমারোহ নিশ্চুপ। সারিকা বইটা দেখে নিয়ে মসৃণ হেঁসে বলে ওঠে,
‘এটা ভালো,তা কি ভাবলি নিজের জীবন নিয়ে?’
‘মানে?’
‘মানে সারাজীবন কি এমন সন্ন্যাসীর মতো করে থাকবি নাকি বিয়ে-শাদি কিছু করবি?এসব নিয়ে তো এখন ভাবতে হবে নাকি?আর কতো কাটাবি একা, এখন বিয়ের বয়স হয়েছে।’
‘আপু, এভাবেই বেশ আছি আমি।আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোমাদের।’
‘কি ভাববো না? সমারোহ,আমি তোর বড় বোন।আমি ভাববে না তো কে ভাববে বল?’
সমারোহ নিশ্চুপ থাকে,বইটা পাশে রেখে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে বিশাল জারুল গাছটার দিকে;গাছটাতে ফুলের কুঁড়ি আসছে নতুন।সারিকা হতাশ হয়। চকচকে চোখ নিয়ে আবার বলে,
‘আলোকে কি সত্যিই মাফ করা যায় না,ভাই? মেয়েটা তার জীবনের করা প্রতিটা ভুলের মাশুল দিয়েছে এতোগুলো দিন,এখন ও ক্লান্ত!’
‘আমি তো ওর উপর রাগ করে নেই।আসলে আলো আমার রাগের ও যোগ্য নয়!’
‘মেয়েটা অনেক বদলেছে সমারোহ,নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছে।’
‘তাহলে সেটা ভালো।’
‘এবার আলোকে কি আরেকটা সুযোগ দেয়া যায়না ভাই?দেখিনা আরেকবার নতুন শুরু করে।হতেও তো পারে এবারের পথ চলাটা সুখের হবে!’
‘আমার অতীত এতোটা বাজে যে ভাবতেই ঘৃণা হয়!’
‘ঘৃণা ভিতরে পুষে রেখে ভালো থাকা যায়না তা তো জানিস।’
‘ঘৃণার মানুষটার কাছে থাকলে জাহান্নামের আবেশ তৈরি হয় মনে। অসহ্যকর অনুভূতি হয়।মনে হয় মারা যাচ্ছি।’
‘আসলে তুই অনেক জেদি, সমারোহ!’
‘হ্যাঁ,ছোটো থেকেই।’
‘ও ক্ষমা চেয়েছে তোর কাছে,হাতজোড় করেছে।তুই কি চাস মেয়েটা মরে যাক?’
‘বললাম তো,ও আমার রাগের ও যোগ্য নয়!’
সমারোহ জারুল গাছের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সারিকার দিকে তাকায় এবার। সারিকাকে অনেকদিন পর সমারোহ ভালোভাবে লক্ষ্য করলো।তার বোনটার মনটা চেহারার মতো সুন্দর নয় ভেবে অট্টহাসি পায়।মৃদু হেসে বলে,
‘আপু,তুই আমার নিজের আপু হয়েও আমার কষ্ট এর আগেও দেখিস নি, এখনো না! যেদিন আলো আমার সাথে প্রতারণা করে তোর দেবরকে বিয়ে করলো সেদিন আমার পাগলামি তুই দেখিসনি,আমাকে হেরে যেতে দেখে চুপ ছিলি।তোর দেবরের দিকে তাকিয়ে আমাকে সবার সামনে মিথ্যেবাদী বলে প্রমান করেছিলি, অপমান করেছিলি।
আমার ভালোবাসা তোর আলোর চোখে সেদিন পড়েনি?
ওর বিয়ের পর আমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম জানিস?ঠিকমতো পড়তে পারতাম না, খেতে পারতাম না, এমনকি কথাও বলতে পারতাম না। তিনটা বছর জাহান্নাম ছিল আমার! এখন আমি ঘখন ঘুরে দাঁড়িয়েছি,আবার কেন?’
‘ভাই ভুলে যা সেসব কথা।মেয়েটা তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে? আমিও কৃষ্ণা চেয়েছি, ভুল করেছিলাম। কিন্তু কিছু করারও ছিল না আমার।’
‘আপু,ভুলে যা কথাটা বলা খুব সহজ, কিন্তু ভুলে যাওয়াটা না।ওকে ভুলতে আমার জীবনের তিনটা বছর নষ্ট হয়েছে।এই তিনটা আলো পারবে ফিরিয়ে দিতে?’
‘তিনটা বছর ফিরিয়ে দিতে না পারুক ভাই, আগামী জীবনের সবগুলো বছর তো ভালোবেসে সুন্দর করে দিতে পারবে!’
‘পারবে না,ওর সেই ক্ষমতা নেই।ওর নিজের খুশির দায়িত্ব নেয়ারই সাহস নেই।আর আমার দরকার ও নেই! বলছিতো আমি এভাবেই বেশ আছি।ভবিষ্যতে আল্লাহ আমার কপালে যা লিখেছেন তাই হবে, এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।’
‘যা ভালো বুঝিস কর।তবে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিস না, ভেবে দেখিস আমার সব কথাগুলো। আর আজ আলোকে একটু বাইরে নিয়ে যাস। একটু সময় কাটা ওর সাথে,দেখ ও সত্যিই চেঞ্জ হয়েছে কি না।’
‘আমি পারবো না! আমার নাইট ডিউটি আছে।’
সারিকা আর কিছু বলে না। হতাশ হয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। সমারোহর বড্ড হাসি পায়।বড্ভ বেশি। বিড়বিড় করে সে বলে, ‘বদলে যাওয়া কি এতো সহজরে বোন?কই তুই তো পারলি না!’
রাতে দিদারের সাথেও সমারোহ আর আলোর বিষয়টা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় সারিকার।সারিকা মেয়েটা তার ভাইয়ের মতোই জেদি, অবুঝ।দিদারের সাথে সমারোহর বোঝাপড়া ভালো।তাই সারিকা তাকে আলোর বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে বলে সমারোহ কে।সারিকার ভাবনায় সমারোহ এখনো মনে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আলোকে;শুধু নিজের আত্মসম্মানবোধ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবনের সকল সুখ জলাঞ্জলি দিচ্ছে।কিন্তু দিদারের কথা হলো তাদের নিজেদেরটা নিজেদেরকেই ভাবতে দাও। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাগ দেখিয়েই সারিকা দিদারকে বলে,
‘তুমি আমার কথা শুনবে না তো!’
‘উহু।’
‘যাবে না ? সমারোহকে বুঝাবে না?’
‘বলেছি তো না।ওরা বাচ্চা নয় যে বুঝিয়ে বলতে হবে।’
‘তাহলে আমার কাছে একদম আসবে না।তাও এ ঘর থেকে যাও।’
‘কেনো? আমার ঘর থেকে আমি যাব কেনো?’
‘আমিই যাই তাহলে, তুমি তোমার ঘর জড়িয়ে ধরে বসে থাকো।’
‘আচ্ছা।’
সারিকার মেজাজ এবার তিরতির করে চড়ে যায়।রাগের মাথায় ঘর থেকে সোজা ছাদে এসে দাঁড়ায় সে।লোকটা তার কথা একটু শুনলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! কিন্তু শুনবে না। সারিকা চেঁচিয়ে পৃথিবী উলোটপালট করে ফেললেও শুনবে না। আবার এখন । সারিকা রাগ করলেও রাগ ভাঙাবে না।কারণ দিদারের মতে এটা তার দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি।মতামত অমিল হলে রাগ করার কিছু নেই;তো রাগ ভাঙাতে যাবে কেন।
–
ক্লাস শুরু হবে আটটায়।ফ্রেন্ডদের সাথে এসাইনমেন্ট কমপ্লিট করবে বলে মাকে মিথ্যা বলে সাড়ে ছ’টায় ক্যম্পাসে এসে উপস্থিত হয়েছে সেঁজুতি। এখন বাজে সাতটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ভার্সিটির কিছু দূরে বিশাল বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে জীতুর জন্য।গুনে গুনে পুরো একঘন্টা পনেরো মিনিট অপেক্ষা করেছে।আর এতোক্ষণে দেখে জীতু হলুদ একটা পাঞ্জাবি পড়ে ঢুলতে ঢুলতে আসছে। অগোছালো চুল,মোটা ফ্রেমের চশমা, কাঁধে আবার কাপড়ের ব্যাগ। সেঁজুতির কান্না পায়।জীতুর বুকে মাথা রেখে খুব করে অভিমান করতে ইচ্ছা করে।লোকটা কি মনে করে কি নিজেকে? হুমায়ূন আহমেদের হিমু হবে সে!হিমু তো রূপাকে অসম্ভব রকম ভালোবাসে।তাহলে কি জীতুও চুপিসারে বাসে সেঁজুতিকে!তবে জীতুই তো তাকে অত সকালে আসতে বললো।বেশি সময় একসাথে কাটাবে বলে;নিজেই এলো না।
জীতু চিটাগাং ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগে মাস্টার্স কমপ্লিট করলো এবার। ভালো রেজাল্ট হয়েছে; ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।সেঁজুতিও বাংলা বিভাগের, তৃতীয় বর্ষে।তবে বাংলাতে জীতু যতটা ভালো সেঁজুতি ঠিক ততটাই বাজে।তাই পরীক্ষার কয়েকদিন আগে জীতু দুএকদিন গিয়েছিল সেঁজুতিকে নিজের নোট দিয়ে তা বুঝিয়ে দিতে। সেখান থেকেই পরিচয়।তারপর থেকে ফেসবুকে জীতুর রেগুলার স্টেটাস চেক করা আর মেসেজের জন্য অপেক্ষা করা মে সেঁজুতির দৈনন্দিন কাজ হয়ে উঠেছে। বেখেয়ালি মানুষটাকে বেশ পছন্দও করে ফেলেছে সেঁজুতি।
জীতু ছোট ছোট পা ফেলে এসে সেঁজুতির সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘ঘুম থেকে উঠতেই পারিনি। মাত্র উঠলাম দশ মিনিট হলো।’
হাতের কালো পুরনো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো জীতু। সেঁজুতি না পারতে সংক্ষিপ্ত করে বলে,
‘হুঁ।’
‘সরি। চা খাবে? চলো,আজ আমি খাওয়াই। দুধ চা দিয়ে রুটি।রোজ সকালে আমার নাস্তা।আজ তোমার সাথে শেয়ার করে খাবো।’
জীতু হাঁটা শুরু করে। সেঁজুতির এবার সত্যিই কষ্ট হয়। এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে শুধু ছোট্ট একটা সরি! এতটুকুই? চোখের কার্ণিশ চিকচিক করে ওঠে সেঁজুতির।জীতু দেখে না।হাঁটতে থাকে। পেছন ফিরে তাকায় না একবারো। সেঁজুতির মনে হয় ভুল লোককে মন দিয়ে ফেলছে না তো সে!
–
মাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে। চন্দ্রিমা এখনো এসে পৌঁছায়নি।মেয়েটার উপর বেজায় রাগ হয় কুহেলী। সময়জ্ঞান যেন একদম নেই চন্দ্রিমার।আজকের ক্লাসটা বা.শেফালীর,তার লেকচার কুহেলীর খবু ভালোলাগে।খুব কঠিন মনের মানুষ তিনি, নিয়ম-শৃঙ্খলার বাহিরে একটা কাজ করাও পছন্দ করেন না।ক্লাস শুরু করার দশ মিনিট পর উপস্থিত হয় বলে চন্দ্রিমাকে ক্লাসেই ঢুকতে দিলেন না!পুরোটা ক্লাস বাহিরে দাঁড়িয়ে করেছে সে।ক্লাস শেষে চলে যাওয়ার সময় চন্দ্রিমার মাথায় হাত রেখে বলে যান,
‘জীবনে সময়ানুবর্তিতা খুব প্রয়োজন। সূক্ষ্ম সময়ের নড়চড় হলেও চলবে না।এটা তোমার জন্য শিক্ষা। পরবর্তীতে এই ভুল আর করবে না।’
‘জ্বি ম্যাম।’ চন্দ্রিমা মাথা নুইয়ে বলে।
‘গুড।’
ডা.শেফালী যাওয়ার পর চন্দ্রিমা ভেতরে এসে বসে কুহেলীর পাশের সিটে।কুহেলী তাকায় না।বিয়ে মুখ গুঁজেই থাকে। ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের মাঝে গ্যাপ পনেরো মিনিট। চন্দ্রিমা বসে পানি খেয়ে কুহেলীকে বলে,
‘কি দেরিটাই না হলো! ঘুম থেকে উঠতেই পারিনি সকালে, তাড়াহুড়োতে ব্রেকফাস্টও করতে পারলাম না।এই ছলনা ক্যান্টিন থেকে কিছু নিয়ে আসি।’
কুহেলী কোন উত্তর দেয়না। চন্দ্রিমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছে সে। চন্দ্রিমা কপাল কুঁচকে বাজখাঁই গলায় বলে,
‘কালা হইলি নাকি?চল!’
কুহেলী তাও কথা বলেনা,ফিরেও তাকায় না। চন্দ্রিমা এবার বিরক্তির সুরে বলে,
‘আমি খাবো না?’
‘একা যা,আমি পারবো না।’
চন্দ্রিমা একটু বেশিই অবাক হয়।কুহেলী কখনো এমন করেনা,হয়তো রেগে আছে। চন্দ্রিমা কুহেলীর গা ঘেঁষে বসে হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে ইনোসেন্ট গলায় বলে,
‘রাগ করছিস আমার উপর?’
‘না সর,কথা বলবি না আমার সাথে।’
চন্দ্রিমার ঝারি দিয়ে সরিয়ে দেয় কুহেলী। চন্দ্রিমা এবার ভয়ই পায়। ভয়াবহ পরিমানে রেগে আছে কুহেলী মেডাম। চন্দ্রিমা অনেকবার চেষ্টা করে কুহেলীকে কথা বলানোর।লাভ হয় না,কুহেলী রেগেই থাকে।পরপর তিনটা ক্লাস শেষ হয়। এবার পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্রেক দেখে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসে কুহেলী। পেছন পেছন চন্দ্রিমাও ছুটে এসে কুহেলীর সামনে দাঁড়িয়েই কান ধরে বলে,
‘আমি ভুল করলে বক-মার তা খুশি কর তবে কথা না বলে থাকিস না প্লিজ।’
কুহেলী রেগে দেখে চন্দ্রিমাকে। চন্দ্রিমা নরম কন্ঠে বলে,
‘সরি!’
‘হয়েছে আর ঢং করতে হবে না।আবির ভাইয়ার কথা আমাকে আগে কেনো বলিসনি?’
হতবুদ্ধি হয়ে যায় চন্দ্রিমা কুহেলীর কথায়।কুহেলীকে এই কথা কয়েকবার বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। কলেজের আর কেউই জানে না,তাহলে কুহেলীকে জানালো কে! চন্দ্রিমা কি বলবে বুঝে পায়না। তোতলাতে তোতলাতে বলে,
‘তো-কে কে ব-ল-লো?’
‘যেই বলুক,তুই তো আর বলিসনি! লুকিয়ে গেছিস।’
চন্দ্রিমা তাড়াহুড়ো করে বলে,
‘না, একদম না।আমি বলতাম, কয়েকবার বলতে গিয়েও বলা হয়নি। ভুল বুঝিসনা প্লিজ।’
‘তাহলে এক্ষুনি সব বলবি আমায়।’
‘হুম।’
‘চল কোথায় বসি।’
একটা ফাঁকা জায়গায় নাম না জানা বিশাল এক গাছের নিচে গিয়ে বসলো কুহেলী আর চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমা বেশ চুপসে গিয়ে বলতে লাগলো,
‘আবির ভাইয়ার সাথে প্রথম আমার দেখা হয় মোহিনী আপুর বিয়েতে।সে আমার খালাতো বোন। মোহিনী আপুর বিয়েতে আরো দুই বছর আগে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম পুরো পরিবার নিয়ে। সেখানেই আমাকে দেখে পছন্দ করে ফেলেন আপুর দূরসম্পর্কের দেবর আবির ভাইয়ার আম্মু। আপুর বিয়ের একমাস পর যখন আপু আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন তখন আবির ভাইয়ার পরিবারকেও দাওয়াত দেয়া হয়। তাঁর আম্মু আমার আম্মুর সাথে কথা বলেন।ভাইয়ার পরিবার আমেরিকাতে থাকেন। সেখানেই পড়াশোনা করেছেন।এইবছর ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করলেন।’
‘আবির ভাইয়াও তোকে পছন্দ করেন?’
লজ্জায় লাল হয়ে যায় চন্দ্রিমার মুখখানি।কুহেলীর হাসি পায়।শয়তানি করে করে বলে,
‘কিরে বল বল!’
‘মাইর খাবি কিন্তু কুহেলী।’
‘এমা!আমি আবার কি করলাম?’
চন্দ্রিমা মুখ শুকনো করে বলে,
‘উনি বিয়ে করে আমাকেও আমেরিকা নিয়ে যেতে চান। সেখানে পড়ালেখা করতে বলেন। কিন্তু আমি বাংলাদেশেই থাকতে চাই।সবার থেকে এতো দূরে গিয়ে আমি থাকবো কি করে!’
‘তার মানে তুইও ভালোবাসিস আবির ভাইয়াকে? শুধু বিদেশে চলে যেতে হবে বলে রাজি না,তাই তো?’
চন্দ্রিমা এবার পুরোপুরি লাল হয়ে গেল মুহুর্তেই।হাজারো জড়তা নিয়ে বলল,
‘না তেমনটা না।’
‘তাহলে কেমনটা?’
‘ওফ! ছাড় তো,ক্লাসে চল।’
কুহেলী হাসতে হাসতে কুটি কুটি হয়ে বলে,
‘বাপরে! যে চন্দ্রিমা পড়া থেকে পালায়,আবির ভাইয়ার নাম শুনে সে ক্লাসে যেতে ব্যাকুল!’
‘ব্যাকুল না,ক্লাসে লেখক হলে যদি আবার দাঁড় করিয়ে রাখে তাহলে এবার সত্যিই কান্না করে দেব।’
কুহেলী ভেংচি কাটে।ক্লাসের দিকে যেতে যেতে চন্দ্রিমা হঠাৎ বলে,
‘আচ্ছা,তোকে কি আরশ বলেছে এসব সম্পর্কে?আমি শুনেছি সে এই মেডিকেলেই পড়ে।কিন্তু দেখা হয়নি।’
‘হ্যা,কাল বলেছে।’
‘আচ্ছা!দেখা হোক না একবার, এমন ধোলাই করবো…।’
‘এহ আসছে!তাও তো বললো বলে জানলাম। তুই তো বিয়ে করে কয়েক ডজন বাচ্চা ফুটিয়েও বলতি না যে বিয়ে করছিস।’
‘হুম দেখা যেতো।’
সামনের কিছু দূরে একটা দোকান থেকে আচার কিনে আনে চন্দ্রিমা।দুজনেই খেতে খেতে ক্লাসের দিকে এগোয়। কিন্তু ক্লাসে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না।একজন এসে কুহেলীকে বলে সমারোহ তাকে কেবিনে ডাকছে।চন্দ্রিমা খানিক ঠাট্টাও করে বিষয়টা নিয়ে,কুহেলী তা আমলে না নিয়েই চলে আসে।সমারোহের কেবিনে ডুকতেই সেই সুন্দর ঘ্রাণটা নাকে লাগে আবারো।কুহেলীকে দেখে খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে সমারোহ বলে,
‘আর একটা ক্লাস বাকী না?সেটা করতে হবে না।আমি বুঝিয়ে দেব পরে।এখন আমার সাথে যাবে।’
কুহেলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।সমারোহ উঠে গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে নিতে নিতে বলে ,
‘জানতে চাইবে না কোথায় নিয়ে যাবো?’
জড়তা কাটিয়ে কুহেলী বলে, ‘কোথায়?’
‘আমার ফ্রেন্ড ইভানের সাথে দেখা করতে হবে প্রথমে।আমি একটা এক্সাম দিয়েছিলাম কিছুদিন আগে,স্কলারশীপের জন্য।রেজাল্ট দিয়েছে;সেটা তুলব।আরো কিছু মেডিকেল স্কলারশীপ এক্সামের ফর্ম তুলবো।তারপর তোমার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে বলেছে আম্মু।’
‘আমার জন্য?’ বেশ খানেক অবাক হয় কুহেলী,তার তো কিছু লাগবে না!’
‘হ্যা তোমার জন্য। আচ্ছা, তুমি সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে গেছ কখনো?’
‘না।গ্রামে পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছি সবসময়, কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি কখনো।’
‘আমি আজ নিয়ে গেলে যাবে?’
সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে অনেক বেশি এক্সাইটেড হয়ে যায় কুহেলী।তার ছোটবেলা থেকেই সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটানোর ইচ্ছা ছিল নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতে বসে। সাগরের বুকে সূর্যাস্ত দেখার শখ ছিল,কিন্তু যাওয়া হয়নি।এই প্রথম সে দেখবে। খুশিতে গদগদ হয়ে কুহেলী বলে,
‘অবশ্যই,কেন যাবো না!’
‘ওকে। তাহলে কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি তোমাকে পতেঙ্গা সি বিচে নিয়ে যাবো।’
‘আচ্ছা।’
খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে কুহেলী।এত খুশি সে এইখানে আসার পর প্রথম হলো।চন্দ্রিমাকে কল করে জানিয়ে বের হয়ে যায় মেডিকেল থেকে।
সমারোহ আজ বাড়ির গাড়ি নিয়ে এসেছে,তাতে করেই রওনা হয় দুজন।রাস্তাঘাট ফাঁকাই মোটামুটি।ইভানের বাসায় চলে আসতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি,সান্দ্র মাইশাকে নিয়ে সেখানে আগেই চলে গিয়েছে।ইভান সমারোহ আর সান্দ্রর মেডিক্যাল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড।এখন ইউরোপের এক মেডিক্যালে কর্মরত, সেখানেই সেটেল হয়েছে। দুদিন আগে ফিরেছে বাংলাদেশে।এসেই সমারোহকে বলছে তার সাথে দেখা করতে।কুহেলীকে নিয়ে যাওয়াতে ইভানের বাসার সকলেই খুব খুশি হয়।ইভান খুশির দমকে সমারোহকে জড়িয়ে ধরে বলেই বসে,
‘কিরে ভাই বিয়ে করে ফেললি আমাকে না জানিয়েই?ভেরি ব্যাড।’
কুহেলী হতবুদ্ধি হয় ইভানের কথায়। লজ্জায় টুইটুম্বুর হয়ে যায়। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন সোজা শীতল পদার্থ নেমে যায়। সমারোহ চোখ গরম করে ইভানের পেটে চিমটি কাটে। ইভান চোখ বড়বড় করে তাকায় সমারোহর দিকে।ইভানের মা এগিয়ে এসে কুহেলীর চিবুকে হাত ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে বলেন,
‘ভারী মিষ্টি মেয়ে,নাম কি তোমার?’
‘কুহেলী, হুমায়রা রহমান কুহেলী।’
‘খুব সুন্দর নাম তো!আনরুবা দেখি পুতুলের মতো বউ পেয়েছে দুই ছেলের!কিরে সমারোহ বিয়েটা করলি কবে?নাকি সান্দ্রর মতো লাইন ধরে আছিস?’
সমারোহ হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে ঠাওর করতে পারে না কি বলবে।কুহেলীর দিকে তাকিয়ে দেখে সে অসহায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সমারোহে দিকে। সমারোহ কাচুমাচু হয়ে লক্ষী ছেলের মতো বলে,
‘আন্টি আসলে…।’
সমারোহকে থামিয়ে দিয়ে ইভান বলা শুরু করে,
‘আরে তুই থাম বেটা শয়তান। ভাবী প্রথম আসলো আমাদের বাসায় স্বাগতম তো করতে হবে নাকি!তা ভাবী আপনি বলুন কেমন আছেন? রাস্তায় আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো!’
কুহেলী কিছুই বলে না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইভানের মা তা দেখে হাসেন। বলেন,
‘লজ্জা পাচ্ছো নাকি? লজ্জা পেয়ো না। আমার ওদের সাথে অনেক ফ্রি বুঝলে!’
সবার কথাবার্তা শুনে সান্দ্র হাসতে হাসতে বের হয় ইভানের ঘর থেকে। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
‘আল্লাহ,আন্টি আপনি কি দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন নাকি?ভালোই হবে। আমার আনরোমান্টিক হয়ে যাওয়া ভাইটা রোমান্টিক হবে আর জুটিটা দারুন হবে না?’
ইভানের মা কপাল কুঁচকে তাকান। সান্দ্র আবার বলে,
‘ও কুহেলী। চিটাগাং মেডিক্যালে পড়ে।তোর ভাবী না।’
ইভান জিভ কামড় দিয়ে কানে ধরে বলে,
‘ইশঃ! ভুল হয়ে গেছে।আমি ভাবলাম হয়তো … ।’
সমারোহ রেগে আগুন হয়ে যায়। চোখ থেকে রেনু এক্ষুনি আগুনের হলকা বেড়িয়ে আসবে।লাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সমারোহ বলে,
‘তোদের ভাবনা সব তোদের মতোই।’
বলেই ইভানের ঘরের দিকে চলে যায়।মাইশা এসে কুহেলীকে নিয়ে যায় ভেতরে।সবাই হেঁসে উঠে।কুহেলী তখনো লজ্জায় নুইয়ে থাকে।এক মুহুর্তের জন্য মনের মাঝে খেলে যায় ‘ভাবী’ শব্দটা। সমারোহর বউ; শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু ততটা যোগ্যতা হয়তো তার নেই!একদম নেই! কিন্তু মানুষটাকে তো সে পছন্দ করে, মনের ইচ্ছার কাছে যোগ্যতার মূল্য ঠিক কতোটুকু?
চলবে.