আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-১৬+১৭

0
489

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৬.

অনেকদিন পর আজ রাতের আকাশ মেঘমুক্ত, ফকফকা পরিষ্কার‌।
শহরটার যতো মলিনতা গত দু-তিন দিনের বৃষ্টির সাথে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। প্রকৃতি এখন দারুণ সতেজ স্নিগ্ধ। চাঁদের নিষ্প্রাণ চিকন এক ফালি পড়ে আছে আকাশের একাংশ জুড়ে। অথচ সামান্য আলোয় এতো মায়াকণার জাল বুনা মে সমস্ত পৃথিবীর মন জয় করে নিচ্ছে। কুহেলীর ঘরের জানালা দিয়ে দূরে যে নদীটা দেখা যায় তার জল ফুলে ফেঁপে টলমলে হয়েছে। জানালা বরাবর শিউলি গাছের ফাঁকে অস্পষ্ট দেখা যায় নদীর পানি। চাঁদের আলোয় পানির উৎসব!রাতে নিজের ঘরে চলে এসছে। এসেই চুপচাপ হাঁটু মুড়ে বসেছে জানালার সামনের অতিরিক্ত দেয়ালটাতে। ভেজা কোমর ছাড়ানো সিল্কি চুলগুলো অবহেলায় পড়ে আছে পিঠ ঘেষে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে পেছনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গত-পরশু রাতের কথা ভাবে কুহেলী। পুরো রাতটা সে সমারোহর সঙ্গে কাটিয়েছে। এই প্রথম কুহেলী এতো কাছ থেকে দেখেছে মানুষটাকে।নিজেকে সত্যিই গাধা মনে হয় কুহেলীর। রিসোর্টের বারান্দায় বসে না ঘুমালেই পারতো সে।ঘুমানোর ভান ধরে থাকতো! ভাবতেই আবার লজ্জায় চুপসে যায় নিজে। আচ্ছা!রাতে তো ভয় পেয়ে সমারোহর পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল, বুকে গেল কি করে! সমারোহ ও এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ছিল। সমারোহ কাছে টেয়নি তো আবার!ধূর বাবা রাতে না ঘুমিয়ে পড়েলেই তো অনুভব করতে পারতো সবটা। অসুস্থ হওয়ার আর সময় পায়নি সে।

কুহেলীর খুব জানতে ইচ্ছা করে সমারোহ তার সম্পর্কে কি ভাবে। শুধু কি সে একাই তাকে পছন্দ করে নাকি সমারোহও করে?আবার নিজের মনকেই দোষারোপ করে কুহেলী। এসব সে কি ভাবছে! মনটা বেজায় অবাধ্য হতে চলেছে। মন কুহেলীর, অথচ পড়ে থাকে আরেকজনকে নিয়ে।আজকে সারাদিন দেখেনি সমারোহকে। কাল আব্বার সাথে কথা বলে বের হয়ে গিয়েছিল আর আসেনি কুহেলীর সামনে। একটাবার তো জানতেও এলো না কেমন আছে! অভিমান হয় কুহেলীর। অঘোষিত তীব্র অভিমানে বুক পুড়ে।

সমারোহ কুহেলীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে মিনিট খানেক।কুহেলীকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। অনেক সময় নিয়ে দরজায় আস্তে করে টোকা দেয়। কুহেলী ভেতর থেকে বলে,

‘ কে? ‘

‘ সমারোহ। ‘

কুহেলী ভড়কে ওঠে বুকে ফুঁ দেয়। ভাবতে ভাবতেই চলে এসেছে! লজ্জা মিশ্রিত হাঁসি হাসে কুহেলী। গায়ের উড়না মাথায় হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

‘ আসুন। ‘

সমারোহ ভেতরে এসে কুহেলীকে একবার দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। ঘরটা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে। তবে জানালা গলে চাঁদের আলো আর রাস্তার সোডিয়াম আলো রহস্যজনক ভাবে আলোকিত করে রেখেছে। কুহেলী তার মিষ্টি সুরে বলে,

‘ কিছু বলবেন? ‘

সমারোহ ক্ষীণ কিন্তু শক্ত গলায় বলে,
‘ তোমার “ল্যাংম্যানের মেডিকেল এমব্রোলজি” বইটা দাও লাগবে। ‘

‘ আচ্ছা। ‘

গলার স্বর নেমে আসে কুহেলীর। সে ভেবেছিল সমারোহ তার খবর নিতে এসেছে।এখনি অস্থির হয়ে তার কথা জানতে চাইবে ‘কেমন আছো বলো’। কিন্তু তেমনটা হলো না। কুহেলী জানালার পাশে টেবিল থেকে অন্ধকার হাতরেই বইটা খুঁজতে থাকে। চাঁদের ঢিম আলোতে বইয়ের নামগুলো ভালোই দেখা যাচ্ছে।কুহেলী বইটা পেয়েও যায়। খুশি হয়ে বই হাতে নিয়ে পেছন ফিরতে গেলো অমনি ধাক্কা খেলো সমারোহর বুকে। সমারোহ হঠাৎ এতো কাছে চলে আসায় চমকে মৃদু কেঁপে উঠে কুহেলী। সমারোহ কুহেলীকে ভালো করে, খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। কুহেলীর ভুবন ভোলানো মিষ্টি হাসির দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে জানালার পর্দাটা পুরোপুরি টেনে দেয়‌। কুহেলীর কাঁধের উপর দিয়ে হাত দেয়ালে ঠেস রাখে। সমারোহর চোখ জোড়ার দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই কুহেলীয়।এই চাহনি তার সহ্য হয় না, প্রত্যেক পলকে পলকে সে খুন করে কুহেলীকে। এভাবে চেয়ে থাকে যেন বুকের মাঝখানটাতে ছুড়ি চালায় কুহেলীর।শ্বাস এলোপাথাড়ি হয়ে যায়। সমারোহ মুহূর্তটা উপভোগ করে বেশি।আরো এক পা কুহেলীর দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

‘ এভাবে আঁধারে জ্যোৎস্নায় ভিজো না, চাঁদও লজ্জা পাবে তোমার ঐ চোখ দুটি দেখলে। এই চেহারায় হিংসে করে যদি জ্যোৎস্নার প্রদীপ জ্বালাতে ভয় পায়!তখন তো বিশ্ববাসী তোমায় চাঁদ ভেবে বসবে। ‘

সমারোহর কথা শুনে মূর্ছা যায় কুহেলী। লাজে আড়ষ্টতায় একাকার হয়ে মনে হয় এক্ষুনি যদি পায়ের নিচের মাটি দুভাগ হয়ে সরে যেতো আর কুহেলী মাটির মাঝে আশ্রয় নিতো! সংকোচে চুপসে গিয়ে কুহেলী কাঁপা গলায় বলে,

‘ বই…! ‘

সমারোহ অপর হাত বই সহই কুহেলীর হাত ধরে। কুহেলীর কাঁপুনি খুব ভালো ভাবে টের পায় এবার। তবুও এক চুল পরিমান নড়েনা‌। হয়তো ভালোলাগে কুহেলীকে এভাবে লজ্জার মুখে ফেলতে। সমারোহ হেলদুল নেই অথচ কুহেলী ভেতর ভেতর মারা পড়ছে। এতো কাছাকাছি আর কয়েক সেকেন্ড থাকলে সত্যিই হৃদস্পন্দন থেমে যাবে কুহেলীর। অনেক কষ্টে তোতলাতে তোতলাতে সে বলে,

‘ আ-র আ-র কি-ছু লা-গ-বে? ‘

সমারোহর হাসি পায়। তার মতে লাজেই নারীর সৌন্দর্য পরতে পরতে প্রকাশ পায়। আর কুহেলীর এই লজ্জা মাখা মৃদু হাসি দেখলে সমারোহর তাকে স্বর্গীয় হূর মনে হয়। সমারোহ ফাজলামো করে আরেকটু কাছে যেতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় কুহেলী। দু’হাতে মুঠো করে উরনা ধরে রাখে। সমারোহ কুহেলীর হাতের উপর হাত রেখে ধীরে ধীরে উড়নাটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।কুহেলীর মরে মরে অবস্থা। কিছু সময় স্থির অবশ হয়ে থাকে শরীর, কোনো সারা শব্দ না পেয়ে চোখ খুলতেই দেখে সমারোহ অনেকটা দূরে সরে গেছে।হাফ ছেড়ে বাঁচে কুহেলী। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বইটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে সমারোহ বলে,

‘ শরীর কেমন আছে এখন? ‘

‘ ভালো। ‘

মুখে ভালো বললেও মনে মনে সমারোহ কে ঝাড়ি খায়। ভেঙচি কেটে বলে, ‘ আরেকটু হলেই তো জান নিয়ে নিচ্ছিলেন আমার ‌আবার বলেন শরীর কেমন আছে! ‘

কুহেলীর ভয়াবহ গলার স্বরে আরো হাসি পায় সমারোহের।হাসি কোন রকম থামিয়ে বলে,

‘ কিছু ভাবছো নাকি? ‘

‘ না, ব্যস্ত ছিলেন নাকি খুব? ‘

‘ জ্বি, আজ অনেক বড় একটা অপারেশন ছিলো। মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের ক্লাসও নিতে হয়েছে। একটু বিজিই ছিলাম। কি করছিলে, লাইট অফ কেনো, কি করছিলে? ‘

বড় সহজ গলায় বলে সমারোহর। কুহেলী হেঁসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে,

‘ চন্দ্র বিলাস। ‘

সমারোহ হাসে, দুষ্টু হাসি। কুহেলী লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নেতিয়ে পড়ে। সমারোহ বলে,

‘ ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি? বৃষ্টির পর স্তব্ধ নিঝুম পরিবেশ ভালোলাগে খুব। ‘

সমারোহ আরো কিছু বলতে নিয়েও হুট করে চলে যায়। কুহেলী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সমারোহর কাজগুলো তার কাছে অদ্ভুত ঠেকায়। কখনো মনে হয় লোকটা তার প্রতি দুর্বল আবার কখনো মনে হয় এটা তার একান্তই ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। সমারোহ কুহেলীর ঘর ছাড়তেই লাইট জ্বেলে দেয় সে। অসুস্থতার জন্য আজ ক্লাস মিস গেলো। একদিন মিস গেছে মানে অনেকটা পড়া পিছিয়ে গেল। বই নিয়ে বসা দরকার একটু। বইয়ের কথা ভাবতেই মাথায় আসে সেই চিরকুটটার কথা।নীল খামে ছিল।খুলে দেখাই হয়নি আর। কুহেলী দরজা আটকে এসে ব্যাগ থেকে বের করে নীল খামটা।চিঠিটা খুলে পড়তে সাহস হয় না। তারপরও পড়ে।

পার্কের ময়লা একটা বেঞ্চ হাত দিয়ে ঝেড়ে তাতে বসে রয়েছে জীতু। একা একা বসে থাকতে ভালোই লাগে। কোনো চিন্তা নেই, কাজ নেই,
তাড়াহুড়ো নেই, কারো কথার জবাব দিতেও কষ্ট করে মুখ খুলতে হয়না। জীতুকে‌ সবাই জন্মের অলস বলে। সে আসলেই তাই কিন্তু এই জীবনটা ভালো না? প্যারাহীন লাইফ, যা আছে খাও , খেয়ে ঘুমাও উঠে আবার খাও তারপর ফের ঘুমিয়ে পড়ো। মাঝে মাঝে চাকরি পড়াশোনা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিয়ে হয় এই আরকি। জীতু পার্কে বসে আছে একটানা দেড়ঘন্টা যাবৎ, বিরক্তি নেই। অনেক অনেক প্রেমময় কাপলের টুকটাক আহ্লাদ দেখে দেখে সময় কাটাচ্ছে। আজ তার পড়নে সেই একই পাঞ্জাবি। তবে আজ চোখে চশমা নেই। ঘরে ফেলে এসেছে। চারিদিক তাই ঝাপসা। এই হয়ে থাকাটাই ভালো লাগে।মাঝে মাঝে সবকিছু ঠিক করে দেখতে হয় না। এই যেমন সেঁজুতির মন! মেয়েটাকে কাল দেখা করবে বলে ভুলে গেছিলো, আসেনি জীতু। মেয়েটা অপেক্ষা করেছে। রাতে মনে পড়ে, ফোন দেয় , ধরে না সেঁজুতি। শেষমেষ মেসেজ দিয়েছে আজ দেখা করতে। সেঁজুতি বলেছে আসবেনা। জীতু তাও এসেছে। পুরো দুঘন্টা আগে এসেছে। সেঁজুতির জন্য আসেনি! এসেছে অন্য কারনে। এসে বরং ভালোই হলো সেঁজুতি আসলে বলবে কাল তুমি অপেক্ষা করেছিলে আজ আমি করে দিলাম। হিসাব বরাবর।

অনেকটা সময় পাড় হলে সেঁজুতি আসে। জীতু বাম হাতের পুরনো ঘড়িটাতে সময় দেখে নেয়। ঠিক আট মিনিট তেইশ সেকেন্ড লেট এসেছে সেঁজুতি। মেয়েটা গাঢ় গোলাপী রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। চুলগুলো খোঁপা করা। এসে চুপচাপ বসে থাকে জীতুর পাশে, কথা নেই মুখে। অভিমান হয়তো! জীতু একটা বাচ্চা ছেলেকে ডাক দিয়ে পাঁচটাকার বাদাম কিনে নিজেই খেতে থাকে। সেঁজুতিকে একবার জিজ্ঞেস করে খাবে কিনা। মেয়েটা উত্তর দেয়না। কয়েকটা বাদাম খোসা ছাড়িয়ে সেঁজুতির হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,

‘ গরিবের খাবার, দাম কম কিন্তু খেতে অমৃত। খেয়ে ফেলো রাগ ফুস হয়ে যাবে। ‘

সেঁজুতির ইচ্ছে করে বাদাম গুলো জীতুর মুখেই ছুঁড়ে মারতে কিন্তু মারা হয়ে উঠে না। মুখ শক্ত করে বলে,

‘ আপনার সাথে রাগ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার করে না। ‘

‘ কেনো? ‘ সহজ গলা জীতুর।

‘ রাগ অভিমানের সব কষ্ট শেষে তো আমাকেই পেতে হবে। আপনি তো আর ভাঙ্গাতে আসবেন না। ‘

বাদাম খাওয়া শেষ হলে প্যাকেটটা ফেলে পাঞ্জাবিতেই হাত মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো জীতু। হাসি মুখে বলে,

‘ গ্রেট! চালাক বালিকা। কাল অপেক্ষা করিয়ে ছিলাম তাই আজ আমি আগে এসে অপেক্ষা করে নিয়েছে, শেষ!চলো সামনের রেস্তোরাঁয় যাব।কাল রাত থেকে কিচ্ছু খাইনি। টাকা নাই‌। আচ্ছা তোমার কাছে পাঁচশ টাকা হবে? ধার নেব। ফেরত দেবে পরে, উমম একমাসের মধ্যে। টিউশনির টাকাটা এখনো পাইনি বুঝলা! আপাতত গরুর কালাভূনা দিয়ে খিচুড়ি খেতে খুব ইচ্ছা করছে, শুনেছি এখানে ভালো পাওয়া যায়।’

জীতুর এক কথায় সব রাগ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় সেঁজুতির। লোকটা তার জন্য অপেক্ষা করেছে, মিস করেছে নিশ্চয়ই খুব! মায়া ও হয়, কাল রাত থেকে না খাওয়া। সেঁজুতি জানলে সেও না খেয়ে থাকতো! আহ, জানালো না কেন আগে?

সেঁজুতির কোনো হেলদুল না দেখে জীতু আবার বলে,

‘ কি ম্যাডাম, শপথ নিলেন নাকি সারাদিন বসে বসে অনশন কর্মসূচি পালন করবেন কাল আসিনি বলে? চলুন। ‘

বলেই হাঁটা শুরু করে জীতু, সেঁজুতির জন্য অপেক্ষা করে না। রেস্তোরাঁয় গিয়ে খিচুড়ি খুব তৃপ্তি সহকারে খায় জীতু, দেখে যে কেউ বলবে অনেক দিন খায়নি। সেঁজুতি কেবল ভ্যানিলা আইসক্রিম নেয়, তার প্রিয়। খাওয়া হয় কই! জীতুর খাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এই অগোছালো লোকটাকে কি সবভাবেই ভালোলাগে? প্রেমে পড়লে সে মানুষটার নিকৃষ্টতম বৈশিষ্ট্যটাও ভালো লাগতে শুরু করে হয়তো‌। কে জানে, সেঁজুতির তো লাগে! আইসক্রিম গলে পানি! গলা আইসক্রিম চামচ দিয়ে খেতেও খারাপ লাগে না। আসলে সব জীতু ম্যাজিক‌। খাওয়া শেষে জীতু বলে,

‘আহ, আলহামদুলিল্লাহ। কি যে একটা খাবার ছিল! একদম ফাটাফাটি। মিস করলে যুঁথি। ‘

‘ আমার নাম যুঁথি না। জুতি, সেঁজুতি। ‘

বড্ড অভিমান হয় আবার। লোকটার আমার জানা নেই ঠিক মতো। উফ্, অসহ্য! জীতু যেন কোনো পাত্তাই দেয়না এই কথার। বলে,

‘ ওই একই হলো। পাঁচশ টাকা দাও এবার। ‘

সেঁজুতির কান্না পায়‌।মনে মনে বলে,

‘ না এক হলো না। কিছুতেই হলো না এক। আমার সবকিছু ভিন্ন লাগা উচিত আপনার, যেমনটা আমরা লাগে আপনার সবকিছু। এতো লাপরোয়া কেনো আপনি হে? এতো কেন বেখেয়ালি আমার প্রতি? ‘

সেঁজুতি মুখে কিছুই বলে না। বৃথাই মনে থেকে যায় সব‌। পার্স থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে দেয় জীতুর হাতে‌। জীতু ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

‘ পাঁচশ চাইলাম তো। ‘

‘ নাই। ‘

‘ নাই মানে? ‘

‘ ভাঙতি নাই। বিল দিয়ে বাকিটা নিয়ে নিন। ‘

‘ গুড। ‘

জীতু বিল দিয়ে পাঁচশত টাকা ফেরত দেয় সেঁজুতিকে। সেঁজুতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় জীতুর দিকে। জীতু হেসে বলে,

‘ পাঁচশ টাকা ধার নিলাম‌‌, দুশো দিয়ে খেলাম আর বাকিটা ফেরত দিচ্ছি‌।ধারেরটাও দিয়ে দেব টিউশনির টাকা পেলে। ‘

‘ কেনো আমি খাওয়াতে পারি না? ‘

‘ না। ‘

‘ কেনো? ‘

‘ কারন টাকাটা তোমার বাবার। খেলে তোমার বাপের টাকায় খেতে হবে। সেটা চাইনা। ‘

সেঁজুতির চোখে এবার পানিই চলে আসে। বাপের টাকা ধার নিতে পারলে বাপের টাকায় খাওয়া যায়না নাকি। রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়েই জীতু বলে,

‘ বাড়ি যাবে তো, রিকশা খুঁজে দিচ্ছি। ‘

সেঁজুতি মুখ গোমট করে বলে,
‘ না আমি ঘুরবো আপনার সাথে। মাত্রই তো এলাম‌। ‘

‘ আমার কাজ আছে। ‘

‘ আর আমার জন্য সময় নেই? ‘

‘ দিলাম তো। ‘

‘ ও, তার মানে আপনি ঘুরবেন না এই তো! ‘

‘ বললাম তো কাজ আছে। দুটো টিউশনি করে তারপর আবার ভার্সিটির একটা প্রোগ্রামের জন্য নাটকের রিহার্সাল করতে হবে। ‘

‘ আপনি অভিনয় ও করেন কই বলেননি তো? ‘

‘ করিনি করবো। ‘

‘ আমিও যাব। ‘

‘ পাগল নাকি? অনেকদূর,রাত হয়ে যাবে।বাড়ি যাও। ‘

‘ বললাম না যাবো আপনার সাথে? ‘

‘ আরে বাবা এখনি তো যাচ্ছি না। জেদ ধরো না। এই রিকশা এই , দাঁড়া! ‘

একটা রিকশাও থামিয়ে নিল জীতু। তারপর সেঁজুতিকে বলে,

‘ সাবধানে যাবে, ভাড়া দিয়ে দিও‌। উঠো। ‘

সেঁজুতিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসে। রিকশায় বসে টপটপ করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে সেঁজুতির। তা দেখা হয়ে উঠে না হয়তো জীতুর। প্রিয়মুখটাকে ছেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় রিকশা। সেঁজুতি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

‘ অবশেষে তোমার কাজল কালো চোখেই বুঝি আমার সর্বনাশ লিখা ছিল! কি আছে সেই চোখে? কেন এতো মায়াবী। জানো, ওই চোখে তাকানোর পর থেকে আমার চোখের পাতা বুজতে পারি না। মোহনীয় এই ভুবন মোহিনী ঘুম কেড়ে নিয়েছে আমার খবর কি সে রাখে! ঘুম নাহয় গেল।পড়তে বসলেই মনে কেনো আসো তুমি? এই হরিণী চোখের কথা কল্পনা করতে করতে যে আমি দুইটা পরীক্ষায় লাড্ডু পেয়ে বসে আছি তার ক্ষতিপূরণ কে দিবে তুমি? তুমিতো রোজ আসোই খালি আমাকে তোমার দহনে পুড়াতে। এদিকে যে পুড়তে পুড়তে আমি ক্লান্ত। তোমার টুকটুকে গোলাপী অমায়িক প্রেমমাখা এক চিলতে হাঁসির তৃষ্ণায় আমার বুকে নেমেছে গ্রীষ্মের তীব্র খড়া। শূন্যতায় খাঁখাঁ করে বুকটা। বৃষ্টি হয়ে তৃষ্ণা মেটাবে আমার? পথিকের ন্যায় ক্লান্ত আমিকে থামাও এবার।বেঁধে নাও তোমার আঁচলে। কথা দিলাম, জিতে যাবে। হেরে যাবে তোমার মোহ আমার ভালোবাসার কাছে। ‘

চিরকুটটা পড়ে চন্দ্রিমা বিশাল বড় এক হা করে তাকালো কুহেলীর দিকে।কুহেলী সামান্য ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে অন্য দিকে ফিরে গেলো। চন্দ্রিমা নিজের মাথা চাপড়ে বলে,

‘ এমা, কাকে এমন পাগল বানালিরে কুহু? বেচারার তো দেখি বারোটা বাজিয়ে দিছিস দেখি। আহারে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। যা বাঁচা গিয়ে তোর রাজকুমারকে। ‘

চন্দ্রিমার কথার পাত্তা দেয় না কুহেলী। চিরকুটটা খপ করে চন্দ্রিমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলে,

‘ মেজাজ খারাপ করাবি না একদম। আমার কেন হতে যাবে এটা হে? বললাম তো বইয়ের ভিতর পেলাম, অন্য কারো জন্য হয়তো রেখেছে আমার হাতে পড়েছে ভুল করে, এটা আবার জায়গা মতো রেখে আসবো। ‘

‘ পাগল নাকি তুই? কেউ কেন এমন ভাবে রাখবে রাতে ভুল কারো হাতে যায়? তাছাড়া বইটা তো কয়েকদিন রেগুলার তুই পড়ছিলি। আমার মনে হয় কেউ তুই লাইব্রেরীতে যাওয়ার ঠিক আগেই রেখেছে‌। এমনিতেই তুই যা রূপবতী পুরো কলেজকেই ক’দিনপর নিজের প্রেমে ফেলে দিবি। ‘

‘ তুই খালি ফালতু বকিস। ভালো চিন্তা কি তোর মস্তিষ্ক থেকে নির্বাসনে গেছে? ‘

‘ কেন যাবে? আমি নিজেই তাকে নির্বাসিত করে দিসি। খুশি? ‘

‘ হায় কপাল আমার! চল এটা যেখানে ছিল রেখে আসবো‌। ‘

‘ মোটেই না! ‘

বলেই কুহেলীর হাত থেকে চিরকুটটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল চন্দ্রিমা‌‌।কাগজটাতে হাত বুলিয়ে ভাঁজ ঠিক করতে করতে বলে,

‘ এটা তোর জন্যই লিখেছে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিউর। ‘

‘ এমন মনে হওয়ার কারণ? এখানে তো আমার নাম লেখা নেই। ‘

‘ খুব শিগগিরই আরেকটা চিরকুট পাবি দেখিস! যে দিচ্ছে সে আরো দেবে আর তখনই প্রুভ হয়ে যাবে। ‘

নিরাক পড়া দুপুরে খোর্শেদকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে।অনেকটা সুস্থ এখন তিনি। বাড়ির ফটকে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন, বিকাল গড়াতেই উঠানে বসে জমিয়ে আড্ডা দিলেন সান্দ্র,রজব আর গ্রামের কয়েকজনের সাথে।প্রিতুস সেদিন বিকালে হাঁড়ি ভরা রসগোল্লা, ফলমূল আর পুকুরের জ্যান্ত শিং আর কৈ মাছ নিয়ে হাজির খোর্শেদের বাড়িতে।তার হবু শ্বশুর মশাই অসুস্থ আর সে দেখতে যাবে না তা কি হয়! প্রিতুস এসেই প্রথমে উঠানের এক প্রান্তে বড় গাছের নিচে মোড়াতে বসে থাকা খোর্শেদকে সালাম জানায়।তারপর বলে,

‘কেমন আছেন চাচা?আহারে! মাটির শইলটা কেমন নেতাইয়া পড়ছে,শইল্লের দিকে তাকান যায় না।বয়স হইছে নিজের খেয়াল রাখন লাগবো তো এখন নাকি?আমি মাত্র পুকুর থেইক্কা মাছ ধরাইছি আপনের লাইগ্গা, বেশি কইরা খাইবেন টাটকা মাছ।’

তারপর খোর্শেদের পাশে সুদর্শন এক যুবককে দেখে কপাল কুঁচকে তাকায় প্রিতুস। খুব স্মার্ট যুবকে কুহেলীদের বাড়িতে দেখে মোটেই ভালো লাগে না তার,বিষয়টা বিরক্তিকর।পড়নের লুঙ্গি ঠিকঠাক করে বসতে বসতে বাজখাঁই গলায় বলে,

‘এইডা আবার কেডা চাচা?আগে তো দেখছি বইল্লা মনে হয় না।কুন গেরামের আপনে,খোর্শেদ চাচার আত্নীয় নি?’

খোর্শেদ একে তো বিরক্ত হয়েছেন প্রিতুসের আগমনে,তার উপর এতো গায়ে পরে ভালো সাজার চেষ্টা অসহ্যকর।তার চালচলনে সভ্যতার ছাপ নেই। মুরব্বিদের সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় জানেনা এই ছেলে।খোর্শেদের কথা বলতে ইচ্ছা করে না।
সান্দ্র খোর্শেদের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে থাকে,

‘আমি কোনো গ্রামের নই। চিটাগাং থেকে আসলাম চাচা অসুস্থ বলে। জহির আহমেদ কে চিনেন?এই গ্রামেই থাকতেন আগে, বয়স্কদের সবারই পরিচিত।আমি তার ছোট ছেলে।’

প্রীতুস কপাল মুখ কুঁচকে ফেলে মুহুর্তেই।আড়চোখে সান্দ্রকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বলে,

‘চিনি না।আব্বায় হয়তো চিনবো।তয় কবে আইলেন? জমিজমা ঠিক আছেনি দেখতে আইলেন নাকি?’

‘আরে না‌ না, খোর্শেদ চাচার বাড়িতেই আসছি।চাচা অসুস্থ শুনে আসলাম।’

‘আইচ্ছা, আজকে থাকবেন নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

প্রিতুস মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় সান্দ্রকে। কিন্তু মুখে বিরাট হাঁসি নিয়ে বলে,
‘তা চাচা ঘরে যুবতী মাইয়া রাইখা কি এমন তাগড়া পোলারে বাড়িতে রাখা ঠিক?কত মানুষ কত কথা কইবো!আকাম কুকাম ঘটলে গেরামের মাইনষেরে মুখ দেখাইতে পারবেন?’

সান্দ্রর মেজাজ চটে যায় এবার‌।চিনে না জানে না একটা লোক এসে ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল‌।ক্ষেপে গিয়ে কিছু বলতে নিলে খোর্শেদ সান্দ্রর বুকে হাত দিয়ে তাকে চোখের ইশারায় থামতে বলে। সান্দ্র দমে যায়।খোর্শেদের ও প্রচন্ড রাগ হয়েছে।বাড়ি বয়ে এসে তার বাড়ির মেহমানকে কথা শোনানোর অধিকার প্রিতুসের নেই।রাগে গিজগিজ করতে করতে খোর্শেদ বলেন,

‘আমার বাড়িতে কে কে আসবো না আসবো সেইটা দেখার জন্য আমরা আছি। তোমার মাথা না ঘামাইলেও চলবো।তুমি বরং আমাদের বাড়িতে তোমার নজর না রাইখা নিজের কাজগুলো করো গিয়া।আর হে,সাথে যা যা আনছো ওগুলো ফেরত নিয়ে যাও আমাদের এইসবের দরকার নাই।’

‘পছন্দ কইরা আনলাম নিয়া যামু মানে?’

‘নিয়া যাবা মানে যেমনে আনছো সেমনে নিয়া যাবা।আমি কি তোমাদের কাছে দয়া চাইছি নাকি আমার সামর্থ্য নাই?থাকলেও আমি নিব না।’

প্রিতুস ক্ষেপে যায় এবার।বাড়ির সবার সামনে খোর্শেদ তাকে অপমান করলো। কিছু ত্যাড়া কথা শোনাতে গিয়েও চুপ করে যায় সে।জসীমের কথাগুলো মনে করে।এ বাড়িতে আসার আগে জসীম খুব ভালো করে বলে দিয়েছেন কোনো প্রকার ঝামেলা যেন সে না করে।মুখের কথায় কিছুই হয় না।চুপ করে থেকে উচিত শিক্ষা দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।এতে এলাকার মানুষের কাছে ভালো থাকা যায়।

আজকে শহরে মাদকের একটা বড় চালান আছে। মায়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে যে মাদক বাংলাদেশে ঢুকে তা শহরে চালান করাই জসীমের কাজ।পলাশ কক্সবাজার গেছে, সাথে গেছে আরো অনেকে।আজকে রাতের আঁধারে ট্রাক ভর্তি কোকেন, হেরোইন, কোরেক্স, মারিজুয়ানা, বারবিচুয়েট, ম্যানডেক্স, ইয়াবা আরো অনেক অনেক মাদক আসবে রাজশাহীতে।তাই ব্যস্ত থাকতে হবে প্রিতুসকেও। কিন্তু কাজটা শেষ হলেই খোর্শেদকে সে একটা উচিত শিক্ষা দেবে।দেবেই উচিত শিক্ষা।
খাওয়া-দাওয়ার পর গ্রামের সকল মানুষ তখন ঝিমুচ্ছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। কমলা রঙের উজ্জ্বল আভা এক নতুন মাত্রা দিয়েছে প্রকৃতিকে।ভ্যাপসা গরম পড়েছে গ্রাম জুড়ে।সান্দ্র যে ঘরটায় শুয়ে আছে সেটা বাড়ির দক্ষিণ দিকে পুকুরের পাশে।বাতাসের তাই কমতি নেই,গরম বাতাস।ঘরটা খুবই ছোট।একাংশ জুড়ে চাল আর ভুট্টা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। টিনের ঘর,মাথা থেকে অনেক উপরে একটা ছোট্ট সিলিং ফ্যান, ছোট্ট একটা শক্ত খাট। একাকী মোটেই ভালো লাগেনা তার। মাইশা এখন ভার্সিটিতে।কল দেয়া যাবে না। চারটায় বাড়ি ফিরে ফোন দেয়ার কথা সান্দ্রকে।চারটা বাজতে আর স্বল্প কিছু সময় বাকি।শুয়ে এক দৃষ্টিতে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানোটা বিরক্তিকর।সান্দ্র উঠে বসে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পুকুরপাড়ে একটা মেয়ে বসে পানিতে পা ভিজাচ্ছে।চেহারা অস্পষ্ট।সান্দ্রর সাবকন্সিয়াস মাইন্ড বলে সেটা কুঞ্জা। এলোমেলো চুলে এই রোদের মধ্যে দিব্যি বসে আছে মেয়েটা।হাতের পাশে রাখা পাথর তুলে নিয়ে পানিতে ঢিল দিচ্ছে আর আর দ্রুত পা নেড়ে নেড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।সান্দ্রর হাসি পায় কুঞ্জার এহেন কান্ড দেখে।খুলে রাখা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে কুঞ্জার কাছে যায় সান্দ্র কুঞ্জা খেয়াল করে না তার পিছনে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।কেবল উদাসী হয়ে ঢিল ছুড়ে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ কুঞ্জার পাশে বসে সান্দ্র।কুঞ্জা তাতে বিচলিত হয় না। শান্ত কন্ঠেই বলে,

‘কখন এলেন ভাইয়া?’

‘যখন তুমি অন্যমনষ্ক ছিলে। কিসের এত মন খারাপ আমায় বলো দেখি।চাচা তো সুস্থ হয়ে গেলেন।’

কুঞ্জা সান্দ্রকে একবার দেখে নিয়ে আবার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সান্দ্র বলে,

‘বলবে না তো?আমার কাছে কিন্তু সকল কিছুর সমাধান আছে। তোমার না লাগলে কি করার!’

ভ্রু নাচিয়ে দুই কাঁধ হাল্কা উঁচু করে বলে সান্দ্র।কুঞ্জা দেহ ইষ্ট বাঁকিয়ে সান্দ্রর দিকে ফিরে বসে ।বলে,

‘বলবো?উমমম…। আমার সমস্যার সমাধান আপনার কাছে নেই।’

‘আর যদি থাকে?’

‘সত্যি আছে?’

‘হুম সত্যি, বলো দেখি!’

‘আমি আপাকে মিস করি,খুব বেশি মিস করি।’

কুঞ্জার কন্ঠ কাঁপা, চোখে মুখে তার মৃদু ভয়ের ছাপ।সে কথা লুকিয়ে যায় সান্দ্রর থেকে।সান্দ্র তা বুঝতে পারে।তাও হেসে বলে,

‘কুঞ্জা, আমাদের জীবন সংক্ষিপ্ত একটা সময়। কয়েকজন খুবই প্রিয় মানুষকে ঘিরে আমাদের বেঁচে থাকতে হলেও তাদের ছাড়া আমরা চলতে পারি যদিও মনে হয় তাদের ছাড়া আমরা পঙ্গু।তবুও তারা কাছে না থাকলে আমরা মরে যাই না। আমরা মরতে পারি না। সৃষ্টিকর্তা যে উদ্দেশ্যে আমাদের সৃষ্টি করেছেন তা পূরণ না হওয়া অবদি আমাদের বাঁচতে হয়।তাই আমাদের উচিত যতটুকু সময় আমরা পৃথিবীতে আছি নিজেদের খুশি রাখা,ভালো রাখা। আমাদের নিজের মনটাকে বুঝা, তার চাহিদাটুকু বুঝে পূরণ করা। কারণ আমাদের এই কোমল মনটা একাকি ও খুব সুন্দর, স্বচ্ছল‌।’

‘আমি চেষ্টা করবো।’

‘শুধু চেষ্টা করলেই হবে না,থাকতেও হবে।আর নিজের মাঝে জোর করে কিছু চেপে রেখে কষ্ট দিও না‌‌। চেপে রেখে ভালো থাকা যায় না। মনের মাঝে কথা চেপে রাখার জন্য তুমি এখনো ছোট।বড় হতে হবে। তোমার সমস্যাগুলো বড়দের বলা উচিত।নাহলে সেগুলো কখনো সমাধান হবে না বৈকি আরো গুরুতর খারাপ হবে।আমাকে না বলতে পারো , অতিরিক্ত পার্সোনাল হলে তোমার বাবা-মা বা দাদুমনির সাথে শেয়ার করতে পারো।’

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে মুচকি হাসে সান্দ্র।কুঞ্জার মাথায় আদর করে একবার হাত বুলায়।তারপর ঊরুতে হাত চেপে উঠে দাঁড়াতে নিলে কুঞ্জা হাত চেপে ধরে সান্দ্রর।চোখ উপচে পানি আসে তার।জড়ানো গলায় বলে,

‘ভাইয়া আপনি কাউকে বলবেন না তো?’

‘বলবো না।’ , চমকায় সান্দ্র। বাচ্চা মেয়েটার কিসের এত ভয় , কিসের সংশয়?কুঞ্জা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘রোজ রাতে আমি নিজে থেকে উঠে বাড়ির বাইরে চলে যাই।আমি নিজেই টের পাইনা আমি কখন যাই,কেন যাই।কাল রাতেও এমনটা হয়েছিল।আমি নিজের মধ্যে থাকি না,যখন ধ্যান ভেঙেছে আমি দেখি আমি বাড়ি থেকে অনেক দূরে মহেশ মামাদের পুকুরপাড়ে।আমার সাথে রজব ভাই ছিল,তাকে ডেকেছি।সে আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বাড়ি চলে আসে।আমি তার পিছু পিছু আসি।এসে দেখি দাদুমা এখনো ঘুমাচ্ছেন।টের পাননি আমি কখন গেছি,আমি নিজেই টের পাইনি।এমন কেন হয়?এটা খুব ভাবায় আমাকে,অনেক ভয় লাগে।’

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

১৭.

সেদিন কোনো চিরকুট না পেলেও তার তিন দিন পর সত্যিই আরো একটা চিরকুট পায় কুহেলী।তবে গ্রন্থাগারের বইয়ে নয়, আকস্মিকভাবে সেটা তার নিজের বইয়ের ভেতরেই ছিল।বিষয়টা কুহেলী খেয়াল করে যখন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে পড়তে বসে।বিকালে মেডিক্যাল থেকে বাড়ি ফিরে গোসল করে লম্বা চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ছাদে বই নিয়ে গিয়েছিল একটু চোখ বুলাবে বলে। কারেন্ট নেই, ঘরের ভেতর ভ্যাপসা গরম।ছাদে এই সময় প্রচুর বাতাস থাকে।ছাদে এসে বই খুলতেই টুপ করে একটা কাগজ নিচে পড়ে যায়।কুহেলী কাগজটা তুলতে নিয়ে দেখে এটা ঠিক সেদিনের মতোই একটা খাম,উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
‘আমার কুয়াশার জন্য পুরো একটা আকাশ মোড়ানো চিরকুট’
থমকে যায় কুহেলী।এটা কি করে সম্ভব!এই চিরকুটটা সত্যিই তার জন্য।কুহেলী মানে তো কুয়াশা‌। কিন্তু কেউ চিরকুটটা রাখলো কিভাবে তার বইয়ের ভাঁজে, সে তো মেডিক্যালে ব্যাগ রেখে কোথাও যায়নি?এটা অস্বাভাবিক।

কুহেলী চিরকুট খুলে পড়ার সাহস পায় না।চন্দ্রিমাকে ফোন দেয়া দরকার একবার।ও যা বলেছে ঠিকই বলেছে।চিরকুটটা বইয়ের ভেতরে রেখে উঠে দাঁড়ায় কুহেলী।ভেজা চুল খোঁপা করতে নিলে পেছনে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে স্পষ্ট অনুভব করে।চুল ছেড়ে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখে আলো।মলিন চেহারায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো যেন তার ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।কুহেলীকে দেখে জোড় করে হাসার চেষ্টা করে মেয়েটা,কুহেলীও হাসে। আলো দু কদম সামনে এগিয়ে এসে বলে,

‘কেমন আছো? শরীর ঠিক হয়ে গেল বুঝি?’

কুহেলী চট করে হেসে বললো,
‘আল্লাহর রহমতে।’

‘তুমি আসলেই ভাগ্যবতী কুহেলী!’

আলোর কথায় খানিক অবাক হয় কুহেলী।কপাল কুঁচকে হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আল্লাহ সবার ভাগ্যে ভালোটাই রেখেছেন আপু।কেউ তা উপলব্ধি করতে পারে আর কেউ পারে না।তারা উপলব্ধি করতে পারে তারা বলে ভাগ্য ভালো আর তারা পারে না তাদের জন্য আফসোস!তারা ভালোটা পেয়েও সন্তুষ্ট থাকতে জানে না।’

‘হয়তো।তবে তোমার মত কপাল কার হয় বলো?’

‘ঠিক বুঝলাম না কি বলতে চাও!’

‘না বুঝার মত কি কিছু বললাম আমি?ভাগ্য ভালো না হলে কি এমন অপরিচিত কারো বাড়িতে এসে দিনের পর দিন আরাম আয়েশে থেকে সেই বাড়ির ছেলের সাথে সারারাত বাইরে কাটানো যায় বলো? যায় না তো, তাই না!’

ফোড়ন কেটে কেটে বলে আলো।কুহেলীর চোখ চড়কগাছ হয়ে যায়।একটা ছোটখাটো ধাক্কা খায় কুহেলী আলোর কথায়। মেজাজ চটে গিয়ে কর্কশ গলায় বলে,

‘মুখ সামনে কথা বলো।’

কুহেলীর কথা কেড়ে নিয়ে আলো বলে,
‘তুমি মুখ সামলে কথা বলো কুহেলী।আমার সামনে একদম ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।কি ভাবো কি নিজেকে হ্যা ?সুন্দর চেহারা আছে বলে সমারোহর সামনে দু তিনবার ঘোরাঘুরি করলে সমারোহ তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাবে? তোমার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে?এতো সোজা নাকি! আর সেদিন সমারোহের সাথে রাত কাটিয়ে এসে কি প্রমাণ করতে চাও সমারোহ তোমার সাথে থাকতে পছন্দ করছে! আসলে তুমি তো নিজেকে বেশ্যা ছাড়া আর কিছুই প্রমাণ করতে পারোনি কারো চোখে। সস্তা মেয়ে মানুষ।গায়ের জ্বালা মেটাতে এসেছ এই বাড়িতে। কেন? নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে…।’

আলো কথা শেষ করার আগেই কুহেলী সজোরে একটা থাপ্পড় বসায় আলোর গালে।একটা মেয়ে কি করে আরেকটা মেয়েকে বলতে পারে এত বাজে কথা!আলো ভীষণ পরিমাণ রেগে যায় কুহেলীর আচরণে।গালে এক হাত দিয়ে ক্ষেপা বিড়ালের মতো গর্জে উঠে বলে,

‘থাপ্পড় মেরে আমার মুখ বন্ধ করালেই কি…’

আলোর কথা শেষ হওয়ার আগে আরো একটা থাপ্পড় পড়ে অপর গালে।রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কুহেলী বলে,

‘মনে নোংরা কীট বাসা না বাঁধলে এরকম বাজে কথা বলা যায় না আপু। আমি তোমাকে সম্মান করেছি, সম্মান করে কথা বলেছি কিন্তু তুমি তার যোগ্য না বলে তোমার চেয়ে ছোট একজনের হাতে চড় খেলে। ঠিক যেমনি অসহায় তোমার চেহারা তেমনি নিচু তোমার মনমানসিকতা! তোমার মনটা পচে গলে গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। সংশোধন করো নিজেকে আর নয়তো মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে পারো।’

কথাগুলো বলে চলে যেতে নিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায় কুহেলী।পেছন ফিরে আলোর দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে বলে,

‘আর এই দুটো থাপ্পড়ের কথা মনে রেখো।আমাকে অসহায় ভেবো না আর নরম ভেবেও ভুল করো না।’

কথা শেষে এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি কুহেলী।আলোকে তো কথাগুলো বলে দিয়েছে কিন্তু বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ছিঃ এসব কথা তাকে শুনতে হলো কেন!এর আগে মরে যেতে পারলো না! ঘরে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই চোখের পানি ছেড়ে দেয় কুহেলী।তাকে এভাবে কেউ কোনোদিন অপদস্থ করেনি।সত্যিই কি সে খারাপ!সমারোহকে তার ভালো লাগে সত্যি কিন্তু এই কথাগুলো শোনার মত কাজ কি করেছে সে?কুহেলী বেশ কিছুক্ষণ দুই হাতে মুখ চেপে একটানা কেঁদে যায়। তারপর হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে।মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে কোনো দরকার ছাড়া এখন থেকে সমারোহর সামনেই পড়বে না সে।মানুষটার তো আর কুহেলীর প্রতি কোনো অনুভূতি নেই, ভালো লাগা নেই, কিচ্ছু নেই।তাহলে কুহেলীই বা কেন তাকে পছন্দ করতে যাবে আর তার জন্য কটু কথা শুনবে?শুনবে না তো।একদম না, একদমই না। অপমান বোধে আবার চোখ উপচে জল আসে তার।হাঁটু মুড়ে মুখ লুকিয়ে আরো কিছুক্ষণ কাঁদে।তারপর উঠে লম্বা সময় ধরে গোসল করে।এত সময় পানির নিচে থাকাতে ঠান্ডা লেগে যায়। পাত্তা দেয়না সে।এসে মোটা একটা ডাক্তারির বইয়ে মুখ গুজে বসে থাকে।সমারোহকে ভোলার অস্ত্র এটা!

‘ এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,
শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।
এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।’

মেডিক্যাল থেকে অনেকটা পথ সামনে হাইওয়ে রোডের সামনে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গানটা গাইছে চন্দ্রিমা।কুহেলী পাশে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে বৃষ্টি আর এখন মাথার উপর সূর্যের কড়া রোদ। বৃষ্টির পর সূর্য সৌরমণ্ডলে আছে জানান দিতে উঁকি দিয়ে যে একটা আলো ছড়ায়, তাতে একদম গা জ্বলে যায়।ঢিম রোদ অথচ কড়া তেজ।কি বিশ্রী আবহাওয়া! একদম যাচ্ছে তাই অবস্থা। এই মৃদু তেজি রোদে অল্প সময় দাঁড়িয়ে কুহেলীর মুখের রং পাল্টে টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ফর্সা চেহারায় সূর্যের আলো সয়না।

কুহেলীর মেজাজ আরো খারাপ হয় চন্দ্রিমার গান শুনে। মেডিক্যাল থেকে বের হয়েছে থেকে শুরু করেছে এই কাকের গলায় গান। এতোটা রাস্তা হেঁটে এসেছে বাসে উঠতে, পুরো রাস্তা গাইতে গাইতে এসেছে।ব্যাপক উদ্ভট কান্ড! রাস্তার লোকেরা যারাই গেছে ফিরে ফিরে তাকিয়েছে।মুখ চেপে হেসেছেন ও অনেকে।কুহেলীর মাথা ভনভন করে এই কর্কশ শব্দে। বিরক্তির সুর টেনে বলে,

‘তুই বন্ধ করবি এবার চন্দ্রিমা?নাহলে সত্যি সত্যি থাপ্পড় খাবি আমার হাতে।’

‘আচ্ছা সমারোহ ভাইয়া তোকে আমার সাথে যেতে কেন বললো?’

‘কেন মানে আবার কি? একবার বলসি না লেট হবে উনার?’

‘ সন্দেহ জনক!’

‘ ফালতু বকিস বেশি তুই।’

চন্দ্রিমার হাসি পায়।কুহেলী রাগলে ওকে টমেটোর মতো লাগে‌। টুকুর টুকুর চোখ মেলে চেয়ে থাকা টসটসে পাঁকা টমেটো!গাল দুটোতে চাপ দিলেই ঠুস করে ফেটে যেতে পারে। চন্দ্রিমার মন খারাপও হয় বটে।সে নিজে কেনো এতো সুন্দর হলো না! হলে হয়তো আবির পুরোপুরি ফেঁসে গিয়ে তাকে ছেড়ে যেতে পারতোই না। চন্দ্রিমার হঠাৎ মনে পড়ে সেদিনের চিঠিটার কথা। কয়েকগুণ আগ্রহ নিয়ে বলে,

‘এই কুহু, চিঠি পেলি আর?’

চন্দ্রিমার বিশাল বড়বড় উৎসুক চোখ দুটো দেখে ঘাবড়ে যায় কুহেলী। চন্দ্রিমাকে দিবে বলে চিঠিটা নিয়ে এসেছে সাথে করে কিন্তু দিলেই তো বিপদ। আবার এটা ওটা বলে মাথা খারাপ করে ছাড়বে একদম।কুহেলী চিঠির বিষয়টা নিজের মাঝেই চেপে যায়।বলে,

‘না পাইনি।এই দেখ বাস আসছে।এটাতে উঠতেই হবে।মিস হলে চলবে না।’

‘যে ভীড়!ঠ্যালাঠ্যালি ভাল্লাগে না ভাই।আর উপর দাঁড়িয়ে যেতে হবে যদিও এতো দূর যেতে যেতে বাস প্রায় ফাঁকাই হয়ে যায়।’

‘রাস্তাঘাট চিনিস তো ভালো মতো?আমি এখনো মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলি‌।’

‘আরে চিনি চিনি।এই একটু সামনে একটা ফুচকাওয়ালা মামা বসে, দারুন বানায় খাবি?ভীড়ে উঠতে পারবো বলে তো মনে হয় না।’

কুহেলীও সায় দেয়‌।ঝাল ঝাল ফুচকা খেয়ে নাকের পানি চোখের পানি সব একাকার করে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করে। এদিকে বাস স্টপের ভীড় কমে যায়। রাস্তার পাশে আসতেই ফাঁকা বাস পেয়ে যায় একটা।মাত্র আট-দশজন আছে ভিতরে। সামনে আরো মানুষ উঠবে ভেবে উঠে পড়ে দুজন।বাসে উঠার পর কুহেলীর মোবাইলে সমারোহ কল করে একবার।কুহেলীর সমারোহর সাথেই যাওয়ার কথা ছিল।যাবেনা বলে চন্দ্রিমাকে মিথ্যা বলে চলে এসেছে। অন্যান্য সময় চন্দ্রিমাকে আরশ পৌঁছে দেয় আজ কুহেলীর সাথে যাবে ভেবে আরশের সাথে আসেনি চন্দ্রিমা।

সমারোহকে কল করতে দেখে ফোন সাইলেন্ট করে দেয় কুহেলী।গাড়ি ফুল স্প্রিডে চলতে শুরু করে একটু পর,মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রী নামাচ্ছে, এক-দু জন উঠছে। অনেকদিন পর বাসে উঠেছে বলে গা গুলায় কুহেলীর। খারাপ ভাবটা কাটাতে চন্দ্রিমার কাঁধে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রাখে। চন্দ্রিমা মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।প্রায় অনেকক্ষণ পরে কুহেলী বিরক্ত হয়ে হয়ে চন্দ্রিমাকে বলে,

‘ওফ!আর কতোক্ষণ?গরমে বমি পাচ্ছে আমার।’

চন্দ্রিমা হেসে বলে,
‘এই তো আর অল্প।বিশ মিনিটের রাস্তা।’

এর মাঝেই কুহেলী চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পুরো বাস ফাঁকা তাদের থেকে তিন সিট সামনে দুজন আঙ্কেল বসে আছেন আর তার বরাবর সিটে একজন মহিলা বসা।ড্রাইভারের বাম পাশের লম্বা সিটটাতে দুজন লোক হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি সব কথা বলছেন ড্রাইভারের সাথে, বখাটে ধরনের ছেলে তারা।কথা বলার ফাঁকে একপলক দেখে নিচ্ছে তাদের দিকে।কুহেলী কপাল কুঁচকে চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘সবাই কখন নেমে গেলো?বাস দেখি ফাঁকা!’

‘ ফাঁকা কই, তিন-চারজন তো আছে। এতোটুকু আসতে আসতে রোজই ফাঁকা প্রায় হয়ে যায় বাস।’ সহজ গলায় বলে চন্দ্রিমা‌।

কুহেলীর চোখ মুখ কুঁচকে যায় চন্দ্রিমার সাহস দেখে।তবে কেনো যেনো ভীষণ ভয় লাগে, চারিদিক স্তব্ধ।এই রাস্তাটা কুহেলী এর আগে যায়নি কিন্তু চন্দ্রিমার চেনা।কুহেলী চন্দ্রিমার হাত খপ করে ধরে থমথমে গলায় বলে, ‘চল নেমে যাই।’

‘কি আবল তাবল বকিসরে? এখন নামলে রিকশা পাবো?আর পেলেও দুইশো টাকা চাইবে ভাড়া। খারাপ লাগছে নাকি বেশি?’

কুহেলী ভয় ভয় চোখে আবার সামনের দিকে দেখে‌।বয়স্ক লোকদুটো একটু পর পর পিছনে ফিরে দেখছেন তাদের।বয়স তাদের পঁয়তাল্লিশ কি পঞ্চাশ হবে।কুহেলীর কথা শুনে আরো বেশি বেশি দেখছে।অদ্ভুত চাহনি ভালো ঠেকায় না কুহেলীর কাছে।বসের গতিও অনেক বেশি।কুহেলী ইনোসেন্ট গলায় বলে,

‘না, ফাঁকা বাসে…।ধুর আমি যাব না। রিকশা দুইশো কেন তিনশো নিক, দরকার হলে হেঁটে যাব।তাও চল,নামি প্লিজ। আমার ভয় লাগছে।’

কুহেলীর কথায় চন্দ্রিমার বিরক্তির উদ্রেক হয়‌। ফিসফিসিয়ে বলে,
‘কি যে বলিস আর করিস তুই কোন মাথা মন্ডু নেই!’
উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে,
‘মামা গাড়ি থামান আমরা নামবো।’

সমারোহ তখন আবার কল করে কুহেলীকে।সমারোহ খুঁজছে ভেবে কুহেলী সমারোহকে একটা টেক্সট করে দেয় ‘আমি চন্দ্রিমার সাথে বাড়ি যাচ্ছি।’
এরপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অপেক্ষা করে গাড়ি থামলে নামবে‌‌। অল্পকিছু সময় অতিবাহিত হলেও গাড়ি থামায় না ড্রাইভার। চন্দ্রিমার রাগ এবার মাত্রা ছাড়ায়।আরো জোরে চেঁচিয়ে বলে,

‘কি হইলো মামা?থামান?’

‘এককান সামনে লইজাই সাইড হরতাছি আফা।’
(সামনে সাইড কইরা থামাইতাছি আপা।)

কর্কশ গলা ড্রাইভারের।চন্দ্রিমা আর কিছু বলে না কুহেলীর পাশে বসে বাহিরে তাকিয়ে থাকে‌।ড্রাইভার গাড়ি থামানোর বদলে পাশ কাটিয়ে অন্য একটা রাস্তায় ঢুকে যায়। চন্দ্রিমা কপাল কুঁচকে উঠে দু-তিন কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে,

‘এই রাস্তায় ঢুকলেন কেন মামা?আমি তো গাড়ি থামাতে বললাম না?কথা কানে গেল না?’

কেউ যেন চন্দ্রিমার কথার পাত্তাই দিলো না‌।প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাটাও এবার কথা বলে উঠলো। তাদের কথা কানে না ঢুকিয়ে কন্টেক্টর এবার গাড়ির ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।কুহেলী কিছু আভাস করতে পেরে ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত সমারোহকে আবার মেসেজ করে,

‘ আমার ভয় লাগছে,কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে। জায়গাটা আমি চিনি না, আমার নম্বর ট্রেক করুন।’

আর কিছু লেখার আগেই সেই মহিলার চেঁচামেচি কানে আসে। চিৎকার করে সে বলে,
‘এই কি করছেন আপনারা?গাড়ি থামান। এক্ষুনি থামান বলছি।গাড়ি এই কোন রাস্তায় নিয়ে চললেন আপনেরা?’

কুহেলী ভয়ে মেসেজটা সেন্ড করে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে আবার।ড্রাইভারের পাশে বসা একজন কুচকুচে কালো রঙের অপরিষ্কার দেহের লোক চন্দ্রিমার সিটের দিকে আসতে আসতে বাজখাঁই গলায় ধমক দেয় সেই মহিলাটাকে,

‘অ হালা (খালা) এব্বে চুপ থাকো। টু শব্দ গইল্লেও, হল্লা হাডি ফেযাত ফেলাই দিওম।’
(এই আন্টি একদম চুপ।একটা চিৎকার করবেন তো গলা কেটে ঝোপঝাড়ে ফেলে দিবো।)

মহিলাটা ভয়ে চুপসে যায়।এসব অল্প বয়স্ক ছেলে বড়দের সম্মান দিতে জানে না। তাদের অবাক করে দিয়ে লোকগুলো সব গাড়ির জানালা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।গাড়ি ততক্ষণে সুনসান প্রবেশ করেছে। জায়গাটা পটিয়ায় হাইদাগাঁও গ্রামের শ্রীমাই বুদবুদি ছড়া। পাহাড়ি এলাকা! চারিদিকে শান্ত শীতল একটা ভাব। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুকটা ছ্যৎ করে উঠে কুহেলীর। এমনটা এলাকার দিকে বাস ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে কেউকে মেরে গুম করে দিলে ভুলেও কেউ টের পাবে না।কুহেলীর বুক ধরফর করে একটু পর কি হবে ভেবে।মনে মনে সে ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়া শুরু করেছে। সামনের সিটের আংকেলদের মধ্যেও একজন উঠে জানালা লাগাচ্ছেন।তাজ্জব হয়ে যায় কুহেলী এদের কাজে। ঝাঁঝালো গলায় বলে,

‘আপনারা কিছু বলছেন না কেন? আংকেল।আমরা আপনাদের মেয়ের বয়সী।আপনার মেয়েও বিপদে পড়লে কি আপনারা এভাবে বসে থাকতেন?’

লোকটা হাসলো,বাজে সে হাসির ঝলকানি! কুৎসিত দেখতে লাগে লোকটাকে।কুহেলী যেন বড়ই অদ্ভুত কথা বলেছে। তন্মধ্যে একজন ফিক করে হেসে বলে,

‘ভর হারাফ জাগাত সাইজ্জ চাইও অ ঝি!’
(বড়ই ভুল জায়গায় সাহায্য চাইলে মেয়ে!)

কুহেলীর চোখ ছেপে পানি আসে, টলমলে হয় চোখের কার্ণিশ।কেন সে সমারোহকে ছেড়ে চন্দ্রিমার সাথে আসতে চাইলো?না আসলে তো চন্দ্রিমা আদর্শের গাড়িতেই যেতো।কেন এই বাসে উঠতে গেল আর কেনই বা চোখ বুঁজে ছিল। চন্দ্রিমাই বা কেনো এতো বেখায়ালি!
চন্দ্রিমা সমানে কতক্ষন চেঁচিয়ে যায়,লাভ হয় না। বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে আরশকে ফোন করতে নিলেই বয়ষ্ক লোকগুলোর মধ্যে থেকে একজন উঠে সজোরে চর মারে চন্দ্রিমাকে।হাতের থেকে মোবাইল,ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।মোবাইলটা মুহুর্তেই বন্ধ করে দিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে, ব্যাগটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।চন্দ্রিমার সাথে একপ্রকার ধস্তাধস্তি হয়ে যায় লোকটার। বোরকা পড়া মহিলাটা আড়ষ্টতায় কাঁদতে কাঁদতে কন্ট্রাক্টরকে বলে,

‘দয়া করে আমাকে ছাইড়া দাও।আমি তোমার মায়ের বয়সী,বাবা।’

ছেলেটা ফোকলা দাঁতে হেসে মহিলাটাকে বলে,
‘ছাড়ি দিতে হন চাই?’

মহিলাটা কাঁদে, হাউমাউ করে কাঁদে। ছেলেটার বোধ হয় মায়া হয়।এদের আবার হৃদয়, মন, আবেগ আছে নাকি?সে বলে,
‘চলন্ত বাস’অত্তু ফাল মারন এব্বে সোজা, ফিচ্চা যার’ত্তাইবান। নইলে কোয়ালত হারাপি আচে।’
(চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে একদম সোজা পিছনের দিকে চলে যাবেন।নাহলে কপালে খারাপি আছে।)

মহিলাটা রাজিও হয়ে যায়।কন্ট্রাক্টর তাকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।মহিলাটা পড়ে হালকা ব্যথা পেলেও পরক্ষণেই পরে উঠে দাঁড়ায়।কুহেলী সম্পুর্ন অবাক হয়ে যায়।অন্য একটা মেয়েকে বিপদে ফেলে কি করে পালিয়ে যায় আরেকটা মেয়ে! মানুষ স্বার্থপর প্রাণী। নিজের স্বার্থে তারা সবই পারে।সব…

তাও ভালো একটা মেয়ের সম্মান তো বাঁচলো।কুহেলী ভয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।হাত পা কাঁপছে তার, ত্রস্ত হাতে সে সমারোহকে ফোন করে। একবার রিং হতেই কল রিসিভ করে সমারোহ। কুহেলী সামনে তাকিয়ে দেখে চন্দ্রিমা লোকগুলোকে আটকানোর চেষ্টা করছে।কুহেলী দ্রুত ফোনটা ব্যাগে রেখে দেয় কল করা অবস্থাতেই। লোকগুলোর থেকে একজন চন্দ্রিমাকে জোরে জোরে কয়েকটা থাপ্পড় মারে।চলন্ত বাসে টাল সামলাতে না পেরে চন্দ্রিমা বাসের একটা সিটে বাড়ি খেয়ে মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে।কুহেলী দ্রুত তাকে ঝাপড়ে জড়িয়ে ধরে। ততক্ষণে চন্দ্রিমার উড়না টেনে নিয়েছে লোকগুলো।কি সব বাজে বাজে কথা বলতে থাকে শুনে বমি পায়,সবটা বুঝেও ওঠে না সে।না বুঝলেই ভালো।কুহেলী চন্দ্রিমার কপালে হাত চেপে ধরে।হাত চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ে।আর্তনাদ করে সে বলে,

‘আপনারা কি মানুষ?ঘৃণা হয়না আপনাদের নিজেদের প্রতি। মানুষ রূপি জানোয়ার।প্লিজ এমনটা করবেন না।এতো পাপ, জাহান্নামেও জায়গা হবেনা। আপনাদেরও মা,বউ বোন আছে,আমরাও তাদের মত একজন মেয়ে।করবেন না এমনটা।আমাদের চলে যেতে দিন।’

কুহেলীর কথা শুনে আনন্দ পায় লোকগুলো। নরপশুদের আত্তা তৃপ্ত হয় অসহায়ত্বের আর্তনাদে।তারা যন্ত্রমানব।কারো চিৎকার শোনার মতো মন তাদের নেই তারা অন্ধ, তারা কালা!
একজন চন্দ্রিমার হাত সজোরে টেনে সামনে নিয়ে যায়। লোকটার শক্তির সাথে পেরে উঠেনা চন্দ্রিমা।চন্দ্রিমার গায়ের এপ্রোন টেনে ছিঁড়ে ফেলে কন্টেক্টর ছেলেটা। একজন পেছনে কুহেলীর কাছে যেতে নিলে চন্দ্রিমা চিৎকার করে বলতে থাকে,

‘প্লিজ আপনাদের যা করার আমার সাথে করুন।কুহেলীকে ছেড়ে দিন।’

অসভ্য শয়তান তুল্য লোকটা পাত্তা দেয় না। বয়স্ক লোকটা কুহেলীর দিকে এগিয়ে গেলে কুহেলী পেছাতে পেছাতে বাসের একদম শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে ।সে স্পষ্ট চন্দ্রিমার চিৎকার শুনতে পায়।হাত পা কাঁপে তার সেই দিনটার কথা মনে করে।সেদিন যা হয়েছিলো আজ সেটার রিপিট হোক কুহেলী চায় না, কিছুতেই চায় না।কুহেলীর হাত-পায়ে কাঁপুনি ধরে।ভয়ে বুক এমনভাবে ধুকপুক করে সেই শব্দ কুহেলী শুনতে পায়। কোথায় সমারোহ!মেসেজটা দেখে সে আসতেছে তো!জায়গাটা কতদূর তাদের মেডিকেল থেকে!লোকটা ক্রমশ এগিয়ে আসে কুহেলীর দিকে।খুশিতে তার চোখদুটো চকচক করে।কুহেলীর মতো ভুবনমোহিনীকে এভাবে পেয়ে যাবে আশা করেনি কোনোদিন, তাই হয়তো মাত্রাতিরিক্ত খুশি হয়ে গেছে।পান খাওয়া কালশিটে দাঁত বের করে সে বলে,

‘ আ, এন সুন্দর চান্দর নান চিয়ারাত ডর মানা নে হচায়?আইও, আর হাচে আইও। বেশি হষ্ট গরা ফইত্তু ন। ছ’ জন, শুধু ছ’ জনে এক্কানা ইউস গরিবো তুয়ারে। তারফরে জংগলত লইজাই হাডি এশসগান টুরা গরি মেডিত গারি ফেলাইওম। বাস, কেউ টের অ ফাইত ন। তর বেইজ্জতিও নইব। চান্দর নান সুন্দরী, ফিইচ্ছা কা জর গই? ডাহে আইও।’
(আহা এতো সুন্দর চান্দের মতো চেহারায় কি ভয় মানায় নাকি বলো?আসো কাছে এসো আমার।খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। ছয়জন, মাত্র ছয়জন ভোগ করবো তোমাকে তারপর জঙ্গলে নিয়ে কেটে একশ টুকরো করে মাটিতে পুঁতে রেখে দিবো।ব্যস,কেউ জানবেই না!তোমার সম্মানহানিও হবে না। এক্কেবারে চাঁদের মতো সুন্দরী।পেছনে যাচ্ছ কেন?কাছে এসো?)

কুহেলীর বমি পায় লোকটার কথা শুনে।রাগে ঘৃণায় থুঁথু মারে লোকটার বিশ্রী মুখে। লোকটা চরম পর্যায়ে ক্ষেপে গিয়ে কুহেলীর দিকে আসতে নিলে কুহেলী নিজের উড়নায় লাগানো সেফটিপিন খুলে লোকটার দুই চোখে ঢুকিয়ে দেয়।

আচমকা এরকম আক্রমণের জন্য লোকটা একদমই প্রস্তুত ছিল না।দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে থাকে।ব্যথায় কাতরে ওঠে নিচে বসে পড়ে সে।কুহেলী সুযোগ বুঝে সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসায় লোকটার ডান পাশের কানে।লোকটা আর্তনাদ করতে করতে অজ্ঞানপ্রায় হয়ে যায়। গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে।বাসের সামনে থেকে কন্ট্রাক্টর আরেকটা আর একজন বয়ষ্ক লোক দৌড়ে আসে লোকটা চিৎকার শুনে কুহেলীকে মারতে।তারা চড় থাপ্পড় দিয়ে চন্দ্রিমাকে ততক্ষণে আধমরা করে ফেলেছে।কন্ট্রাক্টর বাসের মেঝেতে পড়ে থাকা লোকটির চোখ রুমাল দিয়ে চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,

‘চোজ্ঞা নাশ গরি ফেইল্লে এব্বেরে। মায়াফুয়ার এত সাহস। তিয়া তরে আগে আন্দা বানায়োম, তারফর তরে চা। অই বাবুইল্লা ধরচাই, ধরচাই, এন সহস ফা হডে? ধর।’
(চোখটা নষ্ট কইরা ফেলছে একবারে।মাইয়ার এতো সাহস।দাড়া তোরে আগে অন্ধ বানাবো তারপর তোরে…। এ বাবুইল্লা ধরতো এই শালার মাইয়ারে।ধর দেখি এত সাহস থাকে কই, ধর।)

বয়ষ্ক লোকটা সিটের উপরে উঠে সিট টপকে হেঁটে কুহেলীর কাছে গেলে তাকেও ইচ্ছামতো পিন দিয়ে আঘাত করতে থাকে কুহেলী। কিন্তু লোকটা শক্ত হাতে কুহেলীর চুলের মুঠি ধরে দুই তিনবার গাড়ির পেছনের লোহায় আঘাত করে।মাথার ডানপাশটা যেন অবশ হয়ে আসে কুহেলীর।চোখের সামনে সেই ভয়াবহ রাতটার দৃশ্য ফুটে ওঠে।সেই চিৎকার, সেই আর্তনাদ!ড্রাইভার ততক্ষণে গাড়ি থামিয়েছে।চন্দ্রিমা আশেপাশের সবার চিৎকার শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা পুলিশের গাড়ি দাঁড় করানো। খুশিতে কেঁদে ফেলে সে। বিধ্বস্ত চেহারায় কান্না মিশ্রিত হাঁসি বড়ই ভয়ংকর দেখায়। মাত্রই নেতিয়ে পড়া শররীরটাতে দুই তিনগুণ বেশি শক্তি চলে আসে।

‘আআআহ…।’

বলে জোরে চিৎকার করে সামনে থাকা লোকটাকে ধাক্কা দেয়।লোকটা ছিটকে গিয়ে বাসের জানালায় বাড়ি খায়।ড্রাইভার ততক্ষণে দৌড়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এসেছে। ত্রস্ত হাতে ধারালো ছুরি দিয়ে সে চন্দ্রিমার পেটে বড় বড় দুই ঘাই বসিয়ে দেয়। চন্দ্রিমা হতবিহ্বল!পেট থেকে তার ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে।কপালে জমা হয় বিন্দু বিন্দু ঘাম।পুলিশ বাসের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে সবাইকে ইচ্ছামতো মারতে মারতে গাড়ি থেকে বের করতে থাকে।চন্দ্রিমার নাক মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে গড়গড়িয়ে।মেয়েটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মুহূর্তেই,বিরবির করে বলে ,

‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’

গাড়ি থেকে শয়তান লোকগুলোকে নামানো হয়।কুহেলী দেখতে পায় চন্দ্রিমা পড়ে আছে।ডান হাত মাথায় চেপে সামনের দিকে এগোতে থাকে কুহেলী।দু তিনটা ছেলে এসে চন্দ্রিমাকে তুলে নেয়। হসপিটালে নিয়ে যাবে হয়তো।সমারোহ বাসে উঠে তখনি।চন্দ্রিমার দিকে কালক্ষণ দিক ভয়াবহ চোখে চেয়ে থেকে দ্রুত কুহেলীকে দেখে, কেঁদে ফেলে সে।কুহেলীর মাথা থেকে কপাল, চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত,চোখের সামনেই ভয়াবহ অন্ধকার নেমে আসছে। সমারোহ নিজেকে ধাতস্থ করে তড়িৎ গতিতে কুহেলীকে ঝাপটে ধরতেই শরীরের ভাড় ছেড়ে দেয় কুহেলী। বুঁজে আসে দু চোখ।সে কি মারা যাচ্ছে!চন্দ্রিমা ?চন্দ্রিমা বেঁচে যাবে কি?

চলবে.