আমার চন্দ্রাবতী পর্ব-০৫

0
848

#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা

৫.
দুআ বেঘোর নিদ্রায় নিজের মায়ের কোলে শায়িত ছিলো।হঠাৎ আজকের সেই দৃশ্য তার ঘুমের মাঝে উঁকি দিলে চট করে খুলে গেলো দুআর ক্লান্ত নেত্রযুগল। আঁখি মিলতেই প্রথমেই সে দেখতে পেলো গাড়ির ভেতরকার ছাদ।দৃষ্টি একটু সামনে ফেরাতেই গাড়ির বদ্ধ জানালা এবং তা দিয়ে বাইরের চলমান গাড়ি দেখতে পেয়ে দুআ বুঝলো সে এখন তাদের গাড়িতেই আছে।
আজকের সেই ঘটনার পর, দুআ বেশি সময়ের জন্যে অজ্ঞান ছিলো না।মুখে দুই তিনবার পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিলো তার।পরবর্তীতে ধীরে ধীরে দুআর শরীর উন্নতির দিকে ফিরে যায়।তার কাকীমার নির্দেশে দুআ একবার কেবিনে গিয়ে দেখা করে এসেছিলো রিজোয়ানের মায়ের সাথে।এরপর সে এবং তার মা শেষ দেখা করেছে কাকীমার সাথে, এম্বুলেন্সে উঠানোর পূর্বে।রিজোয়ান তার মায়ের সাথে এম্বুলেন্সে এবং দুআ তার মায়ের সমেত নিজেদের গাড়ি করে ফিরছে চট্টগ্রামে।
দুআ মাথা ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে ফিরলো।তার মা আপাতত গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। মায়ের চোখ জোড়া বন্ধ।দুআ মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। সিটে হেলান দিয়ে বসে জানালার পানে বাঁক ফিরলো সে।রাতের ঢাকা শহর যেনো দিনের বেলার চেয়ে আরো বেশি ঝলমলে। বড়বড় অট্টালিকায় বাহারি রঙের লাইটে সজ্জিত।রাস্তায় মানুষ,গাড়ির ভিড়ের পাশাপাশি দোকান,মার্কেট,হাসপাতাল কিছুরই যেনো অভাব নেই।পাশ দিয়ে সজোরে মোটর বাইক শাঁ করে ছুটে গেলে,দুআর আজকের সেই মোটর বাইকের কথা মনে পড়লো।সে ভাবে মনে মনে,
–“ভাগ্যিস,ছেলেটা ব্রেক করেছিলো।নাহলে আজই আমার ঢাকায় প্রথম এবং শেষ দিন হতো।আমাকে বাঁচানোর জন্যে উনাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি।এই বড় ব্যস্ত নগরীতে পুনরায় উনার দেখা পাওয়ার কোনো জো-ই নেই।তবে,আমি সত্যি কৃতজ্ঞতা জানায় আপনাকে।”
দুআ ছোট্ট শ্বাস ফেললো।
–“দুআ,ঘুম ভেঙেছে?”
দুআ ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে ফিরলো।তার মা মাত্রই সজাগ হয়েছে ঘুম থেকে।
–“হুম, আম্মা।”
–“এইদিকে আয়।”
দুআ মায়ের বাহুডোরে চলে এলো।দুআর মা সন্তর্পনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

–“আম্মা,একটা কথা বলি?”
–“বল।”
–“আব্বাকে আজকের ঘটনা বলবে না, দয়া করে।আব্বা যদি জানে এইসব, তবে আমাকে কখনোই আসতে দিবে না ঢাকায় পুনরায়।আমি রিজোয়ান ভাইয়ের সাথে আবারও ঢাকায় বেড়াতে আসতে চাই।এইবার এসেছি দুঃখে,পরেরবার আসতে চাই হাসিখুশীতে।রিজোয়ান ভাই আছে তো আমার যত্ন নেওয়ার জন্য। কাল কাকীর চিন্তায় আমার দেখভাল করতে পারেননি উনি ঠিক ভাবে।কিন্তু,পরবর্তীতে আমি আর ভাই দুইজন মিলে আমাদেরকে সামলে নিবো।”
দুআ একনাগাড়ে বললো।
দুআর মা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো দুআর শরীর,
–“হয়েছে তো,চাঁদ।আমি কিছুই বলবো না তোর আব্বাকে।তুই নির্দ্বিধায় আসতে পারবি ঢাকায় রিজোয়ানের সমেত।শান্ত হয়ে বস।”
–“ওয়াদা করো।”
দুআ তার ডান হাত এগিয়ে দিলো তার মায়ের সামনে।আহেলি মেয়ের বাচ্চামোতে সায় দিতে মেয়ের হাতের উপর হাত রাখলো।মুচকি হেসে জবাব দিলো,
–“ওয়াদা।”
দুআ শান্ত হয়ে বসলো এখন। মাকে মানিয়ে নিতে পেরে ভীষণ খুশি। তার মনে এখন আব্বার সংশয়টা কেটে গেলো।দুআর অন্তরে পরবর্তীতে ঢাকা ভ্রমণের নানান পরিকল্পনা উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। বিনিময়ে মিটিমিটি হাসছে সে।
————————
চট্টগ্রাম এসে পুরো একদিন বিশ্রাম সেরেছে দুআ। জরূরী ক্লাস থাকায় আজ অনিচ্ছা থাকা সত্বেও দুআ তৈরি হয়ে নিলো কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।নাস্তা সেরে সাইড ব্যাগ বাম কাঁধে ঝুলিয়ে,গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।আজ রিজোয়ান আগেই বেরিয়েছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।বিশাল উঠোনের চারিদিকে নজর বুলিয়ে দুআ তার উঠানের পাশে অবস্থিত ছোট্ট ফুলের বাগানে ফুটিত ফুল দেখে মুচকি হাসলো।এই ফুলগুলোর যত্ন স্বয়ং দুআ এবং এইখানকার গৃহকর্মী জেনি করে। দুআ বাগানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পূর্বে তার নজরে এলো রিজোয়ানের মোটর বাইক।দুআ ভ্রুযুগল কুঁচকে ফেললো,
–“গাড়ি ভাইয়া নিয়ে গেলো?আমি যাবো কিভাবে?”
সজোরে সে “আম্মা” ডেকে উঠলো।আরো দুবার “আম্মা” বলে ডেকে উঠলে আহেলি বেরিয়ে এলো,
–“কি হলো?”
–“আমি কিভাবে যাবো?গাড়ি তো ভাই নিয়ে গেলো।”
দুআর চিন্তিত কণ্ঠ।
–“তোর আব্বার সাথে যাবি।গেইটের বাহিরে আছেন হয়তো। উনিই তো বললেন,তোর কলেজের দিকে কাজ আছে উনার।যাওয়ার সময় তোকেও সাথে নিয়ে যাবে।”
দুআ ফুঁস করে শ্বাস ছাড়লো। আহেলি জেনিকে পাঠালো গেইটের বাহিরে ইদ্রিস জমিদারের খোঁজ করতে।
জেনি মিনিট খানেক পর এসে উত্তর দিলো,
–“আম্মাজান,জলিল কইছে জমিদার আব্বা আসবো দশ মিনিট বাদে।”
–“ওহ, যা তুই ভেতরে।”
আহেলি নির্দেশ দিলো জেনিকে। জেনি মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চললো।

দুআ বুকের সাথে দুইহাত ভাঁজ করে প্রধান ফটকের দিকে নজর বুলাচ্ছে একটু পরপর।পাশে থাকা আহেলি দুআকে নরম সুরে বলে উঠলো,
–“ভেতরে আয়।কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি?একে তো মরার মতো গরম পড়ছে তার উপর লাম্বা হাতার জামা পড়লি। হাফ হাতা পড়লে কি সমস্যা?”
–“জানোনা?”
দুআ তার নেত্রযুগল ঘুরালো।
–“কোন বাপের ঝি/বেটা তোর দিকে আঙ্গুল তুলবে আমাকে বলিস।তার আঙ্গুল আমি কুঁচি করবো।আমার মাইয়্যার রূপের আগুনে মানুষ ঝলসে যায়,আর তুই সামান্য দাগে ভাবছিস?তোর উপর কেউ আঙ্গুল তুললে তোর আব্বা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে?”
দুআর মায়ের ক্ষিপ্ত সুর।
–“এইসবই আমি চাই না।আর আমি ঠিক আছি আম্মা।যে আমার এইসব দাগ দেখে মজবে আমি তার ধার ধারবো।আমার রূপ দেখে যে কাছে আসতে চাইবে,
নিঃসন্দেহে আমি তার কাছে যাবো না।যাক,এইসব কথা বলে কি লাভ এখন?আমার তো বিয়ে হচ্ছে না এখনই!”
দুআ হেসে জবাব দিলো।
–“হো।একদম।আমার একমাত্র মাইয়্যা তুই।তোকে আমি বিয়ে দিবো ঢের দেরীতে।”
দুআ চোখ পিটপিট করে মাকে ইশারা দিলে তার মা হেসে কুটিকুটি হলো।
–“ছোট আম্মা,বাইরে আসেন।আব্বাজান ডাকে।”
তার আব্বার এক কর্মচারীর ডাকে দুআ তার মা থেকে বিদায় নিয়ে প্রধান ফটকের পানে এগুচ্ছে।দুআর মন খুশিতে গদগদ।আজ অনেকদিন পর সে তার বাবার ঐতিহ্যবাহী জিপ গাড়িতে উঠবে।আব্বার দেখা পাওয়া মাত্র দুআ সালাম দিলো তার আব্বাকে,
–“আসসালামুয়ালাইকুম,আব্বা।”
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম,আম্মাজান।”
দুআ গাড়িতে উঠে তার বাবার পাশেই বসলো।

জিপ গাড়ি ছাদ নেই।তাই হাওয়া, বাতাস এবং প্রকৃতি বেশ ভালোই উপভোগ করা যায়।জমিদার ইদ্রিস মেয়ের সাথে নানান কথা বলছেন।মাঝে মাঝে তিনি শৈশবের কিছু স্মৃতির কথা জানিয়ে মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় রইলেন।মেয়ে যে তাকে একটু বেশি ভয় পায় এটা তার অজানা নয়।কিন্তু; এর চেয়ে বেশি তার মেয়ে তাকে ভালোবাসে,এটাই ইদ্রিস জমিদারের যতো সুখের কারণ।কিছুদূর যেতেই দুআর চোখে পড়লো গ্রামীণ মেলা।এই মেলার খবর রামিসা,
সঞ্জয় বা মাহি তো তাকে দিলো না!অবশ্য আজ দুআ অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।এইদিকে সচরাচর সে বা তার বন্ধুদের আসা যাওয়া করা হয় না।তাও দুআ ভাবছে,গ্রামের এমন মেলার কথা কিভাবে তার জানা হলো না!
একদিকে ভালোই হলো,দুআ এখন তার বাবার থেকে অনুমতি নিতে পারবে মেলায় যাওয়ার ব্যাপারে।ছুটির সময় বন্ধুদের সাথে এইখানে আসার ইচ্ছা পোষণ করছে দুআ।তাই নির্দ্বিধায় সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“আব্বা,ছুটির পরে কি আমি এই মেলায় আসতে পারি রামিসা এবং বাকি বন্ধুদের সাথে?”
–“নাহ,আম্মাজান।আমাদের ভারী শত্রু আছে।কখন কার নজর কোনদিকে পইড়া যায় বুঝা মুশকিল।তুমি একা যাইও না।রিজোয়ানের সঙ্গে যাইও।আমি ওরে বইলা দিমু।”
–“ঠিক আছে।”
দুআর কণ্ঠে সন্তুষ্টি বিদ্যমান।তার বাবা অনুমতি দিয়েছে যেতে দেওয়ার,এটাই তার কাছে গগণ ছোঁয়া মনে হলো।

কলেজ গেইটে গাড়ি থামলে দুআ নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।দুআকে অবাক করে দিয়ে তার বাবাও তার সাথে নামলো। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দুআকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন উনি।মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হলো সম্মানিত শিক্ষকগণ।দুআ বাবার সাথে চুপ করে স্থায়ী হয়ে রইলো।তার আব্বা এবং শিক্ষকগণ কলেজের ব্যাপারে আলোচনা করছেন।

রাস্তায় দিয়ে বেগমান অন্য গাড়ি ইদ্রিস জমিদার এবং দুআকে দেখে গাড়ি থামালো।গাড়িতে থাকা ভদ্রলোক ইদ্রিস জমিদারের চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ।চোখের পাওয়ারি চশমা খুলে জনাব আবু তার পাশে অবস্থানরত কনিষ্ঠ পুত্রকে প্রশ্ন করলো,
–“কনে হিসেবে ইদ্রিসের মেয়ে কেমন?”
–“ঐ শালার মেয়ে আছে? ঐ বুড়োর মেয়ে কেমন হবে? বুড়োর ম…”
ইশফাক থেমে গেলো।ইদ্রিস জমিদারের পাশে অবস্থানরত কলেজের পোশাক পরিহিত একজন মেয়েই তার দৃষ্টিতে পড়েছে।এতো রূপসী মেয়ে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না ইশফাকের।মুহূর্তেই যেনো দুআকে ঘিরে মনে তার নানান স্বপ্ন উঁকি দিলো!
–“বাবা,তুমি কিভাবে জানো এই মেয়ে ইদ্রিসের কন্যা?”
–“ইদ্রিসের ব্যাপারে খোঁজ আমার আছেই।ড্রাইভার চল।”
ইশফাক আবারও পেছনে ফিরলো।ততক্ষণে গাড়ি অনেক সামনে চলে এসেছে এবং দুআ কলেজ গেইটের ভেতর চলেও গেলো।
–“মেয়েটার নাম কি?”
–“দুআ।”
–“মেয়েটা সুন্দর।”
আবু হেসে উঠলো ছেলের কথায়।
–“কিন্তু তাকে বিয়ে করা অসম্ভব।যতটুক পারবে তা হলো,প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তাকে ধ্বংস করো।সে ধ্বংস হলে তার বাবাও ধ্বংস হবে।এখনো ভুলে যায়নি,আমার থেকে আমার পদ কেড়ে নিয়ে নিজেদের জমিদার বংশের নাম আরো উজ্জ্বল করেছে সে তোরা ছোট থাকাকালীন।লজ্জায় আমি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকা শহরে উঠেছি।মনে হচ্ছে তোর মাধ্যমে সেই পূর্বের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব হবে।”
ইশফাক ক্রোধমাখা চেহারা ফুটিয়ে বললো,
–“অবশ্যই বাবা।তোমার সেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে আমি আছি।এইসব মেয়েকে কিভাবে নিজের জালে ফাঁসাতে হয় আমি বেশ জানি। আফটার অল,আমি আমার বাবার মাথা নিচু হতে দিতে পারি না।”
বাবা ছেলে দুইজনই ভয়ংকর খেলায় নামলো যেনো!
____________________
অনুশীলন শেষে মাঠের বাউন্ডারিতে থাকা সিটে বসে পড়লো ইয়াদ।বোতলের পানি কিছু খেয়ে বাকিটা মাথায় ঢেলে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে একটু পরপর।গরমে অবস্থা একটু টাইট তার।অন্যরা অবশ্য এখনো অনুশীলন করছে।জামালকে দেখতে পেয়ে ইয়াদ উঠে পড়লো।জামালের দৃষ্টিতে ইয়াদ এর অবয়ব চোখে পড়তেই সে স্টেডিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলো।ইয়াদ পিছু নিলো তার।এই ছেলের জন্যে জিয়া দিনের পর দিন এক বদ্ধ উম্মাদে পরিণত হচ্ছে।দেখা গেলো জামাল পার পেলো না ইয়াদের হাঁটার গতি সাথে।জামালের পথ আটকে ইয়াদ তাকে প্রশ্ন করলো,
–“পালাচ্ছিস কেনো?আমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই?”
–“দেখো,ইয়াদ আমি কোনো ঝামেলা করতে চাই না।”
–“কিন্তু আমি তো চাই।আমি তোর সাথেই ঝামেলা করতে চাই।আমার বোনের জীবন থেকে সরে দাঁড়া।নাহলে!”
ইয়াদের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ।
–“নাহলে কি?”
ইয়াদ চারিদিকে চোখ বুলালো।সিসিটিভি ফুটেজের অনুপস্থিতিতে ইয়াদ ধুপ করেই ঘুষি দিলো জামালের নাক বরাবর,
–“আরো খেতে হবে এমন।”
ইয়াদ নিজের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দেখিয়ে বললো জামালকে।
–“তুই আমাকে মেরেছিস?”
জামালের কণ্ঠে একটু হাসলো ইয়াদ,
–“আমি মেরেছি?কই?প্রমাণ দিতে পারবি?”
জামাল সিসিটিভি ক্যামেরা খোঁজার চেষ্টা করলো।কিন্তু দেখতে পেলো না।সে বুঝেছে ইয়াদ সুযোগ বুঝেই কোপ মেরেছে।
–“সিসিটিভি খুঁজছিস?তোর জন্যে এই খোলামেলা জায়গায় সিসিটিভি কে লাগাবে?বেকুব কোথাকার!”
–“এইখানে মানুষের আনাগোনা কম দেখেই আমাকে তুই মারবি?তোর এত সাহস?”
–“আরেকটা দিবো?”
ইয়াদ হাত উঠালে জামাল ভয়ে পিছু হটে।
–“বিড়াল একটা।এসেছে আমার সাথে পাঙা নিতে।আমার বোন থেকে দূরে থাকবি নাহলে কলিজা বের করবো তোর।”
ইয়াদের হুমকি শুনে হিম হয়ে এলো জামালের শরীর।জামাল কিছু বলার পূর্বে ইয়াদ পেছনে বাঁক ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করলো,
–“তোর কথা শোনার সময় নেই।”
জামাল স্থব্দ।এমন ছেলের সাথে পাঙা নিয়ে সে যেনো কুমির ভর্তি পুকুরে গোসল করতে নেমেছে!

লন থেকে বেরুতেই ইয়াদ দেখলো ভলেন্টিয়ার রশিদকে।
–“কি রশিদ, মাইরটাও দেখে নিলে?”
–“হ্যাঁ, স্যার।আমার মুখ কিন্তু বন্ধ থাকবে।”
রশিদ হেসে জবাব দিলো।
–“আমি জানি।আমি তোমার আইডল, এটা আমার অজানা নয়।”
ইয়াদ কিশোর রশিদের মাথায় হাত বুলালো।
–“স্যার,একটা অটোগ্রাফ?”
–“কলম তো নেই আমার কাছে!”
ইয়াদের কথায় রশিদ তার কোমরে গুঁজে রাখা একটা ছোট খাতা বের করলো।পকেট থেকে কলম বের করে সে ইয়াদকে বলে উঠলো,
–“এই নিন,স্যার।”
–“বাহ,তোমার মাথায় ঢের বুদ্ধি।”
রশিদ দাঁত কেলালো।
ইয়াদ নিজের নাম এবং রশিদের নাম লিখে স্বাক্ষর করলো খাতায়,
–“এইসবের পাশাপাশি অবশ্যই পড়ালেখা করবে।”
–“জ্বী, স্যার।ইন শাহ্ আল্লাহ্।”
ইয়াদ মলিন হেসে আবারও মাঠে নামার জন্যে প্রস্তুতি নিলো।
.
সারাদিনের ক্লান্তি মিটিয়ে নিলো সে, এক বিশাল নিদ্রার মাধ্যমে।ঘুম থেকে সজাগ হতেই মারিয়া বায়না করলো বাহিরে খেতে যাবে।ইয়াদের মন না থাকা সত্ত্বেও ছোট বোনের মন রক্ষার্থে সে তৈরি হয়ে নিলো।মারিয়ার খুশির অন্ত নেই।তার ভাইকে রাজি করিয়ে সে যেনো রাজ্য জয় করেছে।
পায়ে বুট জড়িয়ে, গায়ে পারফিউম মেখে ইয়াদ রুম থেকে বের হলো।মারিয়া তার ভাইয়ের হাত ধরে নিচে নামছে।সে তার ভাইয়ের জন্যে রুমের বাইরেই অপেক্ষা করছিলো।নিচে নামতেই মারিয়াকে সে প্রশ্ন করলো,
–“জিয়া যাবে?”
–“বলেছিলাম।কিন্তু আপু বললো, আমাকে থাপ্পড় দিবে আরেকবার যদি তাকে ডাকতে যাই।”
ইয়াদ রেগে গেলো।ছোট বোনের সাথে জিয়া এমন ব্যবহার করবে, এটা সে কখনোই আশা করেনি জিয়া থেকে।ইয়াদ জিয়ার রুমে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই বাঁধ সাধলো ডালিয়া,
–“আব্বা,বাদ দাও।জিয়া সঠিক সময়ে শুধরে যাবে।তোমরা দুইজন যাও।আমি জিয়াকে বুঝিয়ে বলবো এইসব ব্যবহার পরিত্যাগ করতে।”
–“তোমার মেয়েকে সাবধান করবে,মারুর সাথে খারাপ ব্যবহার না করতে। মারু সবার ছোট,এটা কি তোমার মেয়ে ভুলতে বসেছে; আম্মি?”
ইয়াদের রাগী কণ্ঠ।
–“আচ্ছা,আব্বা যাও তোমরা।এইসবের চিন্তা করো না।”
–“যাচ্ছি আমরা। মারু,কাম।”
ইয়াদ মারিয়া সমেত সামনে এগুচ্ছে।মারিয়া হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো তার মাকে।

ইয়াদ গাড়ি চালাতে মন দিচ্ছে।মারিয়া তার পাশে বসে গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে পছন্দের গান চালাতে ব্যস্ত।গানের তালে তালে মারিয়া গা দোলাচ্ছে।ইয়াদ নিজের বোনের অবস্থা দেখে হাসলো,
–“কে-পপ অনেক প্রিয়?”
–“হ্যাঁ,ভাইয়া।ওদের গান আমার অনেক ভালো লাগে।তুমি কোরিয়ান ভাষা বুঝো?”
–“অল্প সল্প।”
মারিয়া ভাইয়ের কথায় হাসলো আবারও।পরক্ষণে গানের সাথে সুর মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।আর ইয়াদ নিজের বোনের খুশিতে শামিল হওয়ার চেষ্টায় রইলো।

ভিআইপি পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে হোটেলে প্রবেশ করছে মারিয়া আর ইয়াদ।সে আজ মাস্ক বিহীন।কারণ,এইখানের ভিআইপি এরিয়ায় নানান সেলিব্রিটি এবং অভিজাত পরিবারের মানুষ বিদ্যমান।এইখানে অটোগ্রাফ এবং সেলফির তেমন বিপদ নেই ইয়াদের।যে যার যার অবস্থায় থাকতে পছন্দ করে।মূলত তারা নিজেদের মতো করে ব্যক্তিগত সময় কাটাতে সবাই এই হোটেলকে বেছে নেয়। কোন পাশে বসবে সেটা মারিয়া নির্ণয় করছে।ইয়াদ আপাতত ফোন কথা বলছে ইয়াসিরের সাথে।
মারিয়া জায়গা নির্ধারণ করে বললো,
–“ঐদিকে ভাইয়া।”
ইয়াদ মাথা নাড়ালে মারিয়া হাঁটতে থাকে,পেছন পেছন আসছে ইয়াদ।
–“আরে,ইয়াদ আর মারিয়া নাকি!”
ইয়াদ মোবাইল পকেটে রাখলো।ইশফাককে দেখে একটু চমকালো সে।তার চাচাতো ভাইয়ের কাজিন ইশফাক। সে হিসেবেই তাদের পরিচয়।ইয়াদ কুশল বিনিময় করলো,
–“কেমন আছো?”
–“এইতো বিন্দাস।কি খবর খেলোয়াড় সাহেব?”
–“আছি আলহামদুলিল্লাহ্।বসো!”
–“নাহ,চলে যাবো।আমি এসেছি অনেক আগেই।মারিয়া,কোন ক্লাসে এখন?”
–“সেভেনে।”
মারিয়া দুইহাত মিলিয়ে সাতটা আঙ্গুল দেখিয়ে বললো।
–“ভালোই তো।আচ্ছা;আমি আসি,পার্কিংয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে।আবার দেখা হবে।”
–“শিউর।”
ইয়াদ হাত মেলালো ইশফাকের বাড়িয়ে দেওয়া
হাতের সাথে।
মারিয়া একে একে অনেক ছবি তুললো।কিছু ছবিতে তার ভাইকেও নিয়েছে সে।ইয়াদ নিজের মোবাইলেই ব্যস্ত সর্বকালের মতো। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ এক বিজ্ঞাপন দেখে ইয়াদের দৃষ্টি স্থির হলো।পানির বিজ্ঞাপনের মেয়েটা দুআর কথা স্মরণ করিয়ে দিলো তাকে।মেয়েটা ঠিক দুআর মতো অর্ধ মাথায় ওড়না পরিহিত।চুলগুলো চারদিকে ছড়িয়ে আছে,ঠিক দুআর ন্যায়।
সেদিন দুআকে সরাসরি দেখার পর,তার সেই অর্ধ চেহারার কথা বারবার ইয়াদের স্মৃতির পাতায় হানা দিয়েছিলো।এইযে এখন, বিজ্ঞাপনের সেই মেয়ের বেশভূষা দেখে এখনো তার দুআর কথা স্মরণে এসেছে।ইয়াদ বুঝলো না এই দুআ মেয়ের অবয়ব কেনো তার পিছু ছাড়ছে না!
ইয়াদ মোবাইল টেবিলের উপর রাখলো।নিজের মসৃণ গালে এক হাত ঘষে গভীর চিন্তায় পড়লো সে।অবাক করার ব্যাপার হলো, যতো বারেই সে পলক ফেলছে ততবারই দুআর সেই নজর কাড়ার মতো নেত্রযুগল ইয়াদের চোখের কোটরে ভাসছে।মস্তিষ্ক যেনো অচল হলো ইয়াদের।হাত মুঠো করে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টায় আছে সে।ইয়াদের সাথে এইসব কি হচ্ছে,ইয়াদ যেনো কিছুই বুঝতে পারলো না।এইসব ইয়াদ বুঝতে চাইছেই না যেনো।সে নির্বিকার ভঙ্গিতে মারিয়াকে বলে উঠলো,
–“চলো,মারু।”
–“ভাইয়া,ডেজার্ট?”
–“বাসায় গিয়ে খাবে।আমি কিনে নিচ্ছি।”
মারিয়া ভাইয়ের এমন গম্ভীরতা বুঝতে পারলো না।বিনা প্রশ্নে মারিয়া উঠে পড়লো।পুনরায় ইয়াদ মারিয়ার হাতের তালু আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ডেজার্ট সেকশনের দিকে।ইয়াদ দুআর প্রতিচ্ছবির সাথে তার মনে এক প্রকার বিনা শব্দের যুদ্ধ আরম্ভ করলো যেনো!
.
পরের দিন মেলায় নিজের সকল সখের,পছন্দের জিনিসপত্র কিনে বাসার দিকে রওনা দিলো দুআ।তার সাথে উপস্থিত আছে রিজোয়ান,মাইশা,রামিসা এবং মাহি।সঞ্জয় মেলা থেকেই তার বাড়ির পথে পাড়ি জমালো।দুআ,মাহি,রামিসা গাড়ির পেছনের দিকে বসেছে।রিজোয়ান ড্রাইভ করছে আর তার পাশেই আছে মাইশা।মাঝের সিটে জিনিসপত্র রাখলো।দুআর পছন্দের একটা বড় ফুলদানি কেনা হয়েছে।মূলত সেটাকে ভালো জায়গায় অবস্থান করাতেই দুআ পেছনের সিটে গিয়ে বসলো।
দুআ নিজের মোবাইল ব্যাগে রেখে, হাতে ছুঁয়ে দেখলো সেই ফুলদানিকে আবারও।মাহি দুআর কাঁধে হেলান দিয়ে আছে।হঠাৎই রামিসা আপনমনে আওড়ালো,
–“ইয়াদ ভাইয়া আবার কই গিয়েছিলো?”
অমনি মাহি লাফ দিয়ে উঠলো,
–“কি বলছিস?দেখি তো আজব?”
রামিসা মাহিকে নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলো।
দুআ নিজেও সেদিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করে নিজেই পৌঁছালো অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে।
–“একটু আগে দিয়েছে আপলোড।ক্যাপশন দিয়েছে,
‘দুইদিন পূর্বে বটবৃক্ষের সাথে আমরা বন্ধুমহল’। মানে দুইদিন পূর্বে গিয়েছিল তারা।এইযে একটু আগেই ছাড়লো ফেসবুকে।তাই দেখিনি আজব।নাহলে ইয়াদের কিছুই কি আমি মিস করি!”
দুআ চিন্তিত হাতে মোবাইল নিলো রামিসার।চারজন ছেলের ছবি বিদ্যমান। কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না হেলমেটের জন্যে।সবাই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে।পেছনে সুন্দর বড় তিনটা গাছের দৃশ্য বিদ্যমান।কিন্তু এক বেশভূষায় নজর আটকে আছে দুআর।এই খয়েরী রঙের শার্ট পরিহিত ছেলেকে দুআ চিনে।সাথে মাথার কালো হেলমেট দুআর ভোলার নয়।কারণ,এই ছেলের জন্যেই দুইদিন পূর্বে দুআকে নিজের প্রাণ খোয়াতে হয়নি।তবে এইখানের সবাই হেলমেট পরিহিত তাই দুআ বুঝলো না আসলে ছেলেটা কে!ইয়াদ বুঝি?দুআর মাথায় প্রশ্নে ভনভন করে উঠলো।
–“এই মাহি,বলতো এইখানের মধ্যে আমার ইয়াদ ভাই কোনটা?”
–“খয়েরী শার্ট,মাথায় কালো হেলমেট সেটা।আজব,
আমি ইয়াদকে চিনবো না?ইয়াদ তার এই চার বন্ধুর সাথেই তো ঘুরে।আর চারজনের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা জনই আমার ইয়াদ।যেকোনো ইয়াদ ভক্ত চোখ বুঝে বলবে,এই লম্বা খয়েরী রঙের শার্টে আবৃত সুঠাম দেহী যুবকই আমাদের ইয়াদ।তবে,উনার বাকি বন্ধুগণও বেশ সুন্দর।উফ কি লোভনীয়!”
–“একদম ঠিক বললি।”
রামিসা মুচকি হাসলো মাহির কথায়।
কিন্তু দুআ নিশ্চুপ।তার বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। নাকে জমলো বিন্দু পানি তথা ঘাম।দুআ নিঃশব্দে কোনো মুখভঙ্গি ছাড়া মোবাইল দিয়ে দিলো রামিসাকে।দুআ নিজের বুকের ওড়না একহাতে শক্ত মুঠে ধরে ভাবতে লাগলো,
–“আমাকে যে ছেলেটা বাঁচিয়েছিলো,সেই ছেলেই তাহলে বিখ্যাত ইয়াদ বিন তেহরান?কিন্তু কিভাবে?আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!এটাও কি আদৌ সম্ভব!”
দুআ গভীর চিন্তায় নিচের ঠোঁটখানা মুখে পুরে নিলো।কেমন যেনো অস্থির লাগছে তার!

চলবে…..