আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-১২+১৩

0
385

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১২

‘এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ! মোট পাঁচ পাঁচটি দাঁতের ছাপ তোর হাতের উপর, তাও আবার মানুষের দাঁতের। আর তুই কিনা বলছিস এটা মশার কামড়!’
রোদ্দুরের থেকে নিজের হাত সরিয়ে আঁড়াল করে নেয় আশ্বিন। রা/ক্ষ/স মেয়ের জন্য আজ এসব কথা শুনতে হচ্ছে তার। কি দারুন লজ্জার ব্যাপার!
এদিকে, রোদ্দুর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই চলেছে। রাগে দুঃখে বানিয়ে কোন মিথ্যাও বলতে পারছে না বেচারা।
‘আরে বললাম তো এটা মশার কামড়।’
‘বললেই হলো মশার কামড়? মেডিকেলে পড়ি আমি। মানুষের দাঁতের ছাপ আর মশার কামড়ে পার্থক্য চিনবো না নাকি? এতো বোকা ভেবেছিস আমাকে?’
দমে যায় আশ্বিন। অধরার কাজে এখন তাকে কীভাবে বিব্রত হতে হচ্ছে। মানছি বজ্রপাত ভয় পায়, তাই বলেই কি এমন কান্ড করতে হবে তাকে?
‘কি হলো? কথা বলিস না কেনো?’
‘না মানে..। আসলে, গতকাল টুসি হাতে কামড়ে দিয়েছে। বুঝিস তো, বাচ্চা মানুষ। কি আর করার?’
‘ওহ আচ্ছা টুসি দিয়েছে। আমি আরও ভাবলাম কি না কি..?’
হাসি চেপে রাখে রোদ্দুর। আশ্বিনের অবস্থা এখন দেখার মতো হয়ে আছে। রোদ্দুর ভালো করেই জানে আশ্বিন তাকে মিথ্যা বলছে। আঁড়ালে সে কোন কথা লুকিয়ে রেখেছে অবশ্যই।

মাঠে গোল হয়ে অধরা বসে আছে তার বন্ধুমহলের সাথে। অনেকদিন হল কোন বিনোদন করতে পারছে না তারা। হাসান স্যারের কড়া নির্দেশ আছে অধরার উপর। তাই বাধ্য হয়ে সবাই চুপচাপ আছে কিছুদিন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
‘চল আশেপাশে কোথাও একটা ট্যুর দিয়ে আসি। এভাবে ভালো লাগছে না কিছুই।’
‘অনিকের কথায় আমিও একমত।’
ইশা আর অনিকের কথায় সম্মতি দেন জারিফ। কিন্তু সালমানের এতে আপত্তি রয়েছে।
‘এভাবে আমরা কয়জন মিলে আশেপাশে কোথায় আর যাবো? তারচেয়ে ভালো হবে আশ্বিন ভাই আর রোদ ভাইকে নিয়ে সবাই রাঙামাটি ঘুরে আসি। পাঁচদিনের ট্যুর হবে।’
‘ভালো বুদ্ধি।’

এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে ছিল অধরা। কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলো না সে।
‘তোদের বলেছে ভালো বুদ্ধি? এই মুহূর্তে কোন ট্যুর সম্ভব না। সামনে পরীক্ষা, পড়ার প্রস্তুতি নে সবাই।’
অধরার কথায় তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলো সবাই। এই মেয়ে সারাজীবন তাদের প্ল্যান নষ্ট করতে ব্যস্ত।
এবারেও তার উদ্দেশ্য তাই। তাই সবাই মিলে একদফা ঝাড়ি দিতে শুরু করে অধরাকে। রাগে অভিমানে অধরা নীরবে সবার থেকে উঠে গিয়ে আলাদা চলে যায়।
অধরার এভাবে চলে যাওয়ায় হতভম্ব সবাই। সে তো চুপ করে থাকার মেয়ে না। তবে কি কষ্ট পেয়েছে তাদের এরূপ আচরণে?
‘একটু বেশিই বলে ফেলেছি আমরা।’
ইশার কথার প্রতিউত্তর দেয়না কেউ। উঠে দাঁড়িয়ে অধরার খোঁজে চলে আসে সবাই।

ক্যান্টিনে একা একা বসে আছে অধরা। সামনে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা। প্রিয় এই খাবারটিও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। হঠাত করেই কেনো জানি মন খারাপ লাগছে। কিছুটা চিন্তিত সে। সকালের ব্যাপার নিয়ে।
‘এভাবে বসে আছো কেনো? কী হয়েছে?’
মাথা ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে আশ্বিনকে দেখতে পায় অধরা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর।
‘কিছু হয়নি।’
আবারও সামনে ফিরে তাকায় সে। কপালে ভাঁজ পড়ে আশ্বিনের। অধরার উপস্থিতি অথচ এমন নিশ্চুপ পরিবেশ, যেনো বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। আবারও কি কিছু করে বসলো অধরা? সর্বনাশ! হাসান স্যারকে তবে কি জবাব দিবে সে? চিন্তিত হয়ে রোদ সহ দুজন বসে পড়ে অধরার পাশে।
‘আবারো কোন অঘটন ঘটিয়ে এসেছো অধরা?’
নির্লিপ্ত ভাবে ফিরে তাকায় অধরা। এই চাহনি অন্যরকম। মুখ খানি তার মলিন।
‘কি হয়েছে বলো আমাকে?’
খানিক নিশ্চুপ ভাবে বসে থাকে অধরা। আশ্বিন তাকিয়ে আছে তার জবাবের অপেক্ষায়।
‘আশ্বিন ভাইয়া, আজ সকালে হোস্টেল থেকে কলেজ আসার সময়..।’

আর কিছু বলা হয়নি তার। বন্ধুমহল দৌড়ে এসে অধরাকে ঝাড়ি দিতে শুরু করে।
‘একটু কি কথা বলেছি, তাই বলে এভাবে রাগ দেখিয়ে চলে আসবি?’
‘আমাদের সাথেই খালি রাগ দেখাতে পারিস..।’
জারিফ সাদমান ইশা আর অনিক এসে বসে পড়ে তাদের পাশাপাশি। আশ্বিন আর রোদ্দুর কি হয়েছে জানতে চাইলে তারা অধরার অভিমানের কথা বলে। তাই তো অধরার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা হালকা করতে চাইছে তারা।
অধরা নিশ্চুপ। মাঝে মাঝে দুচারটা প্রশ্নেরউত্তর দিচ্ছে শুধু।
আশ্বিনের কাছে কেনো যেনো মনে হচ্ছে আসল ঘটনা বন্ধুদের সাথে ট্যুর নিয়ে অভিমান নয়। সে যতদূর অধরাকে চিনতে পেরেছে, উনি এতো অল্পতেই রিয়েক্ট করার মতো কোন মেয়ে না। তবে কি হতে পারে? কেনো বললো হোস্টেল থেকে আসার পথে…?

ক্লাস শেষে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে অধরা আর আশ্বিন যাচ্ছে অধরাকে হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। সকাল থেকেই অধরা আজ চুপচাপ। ব্যাপারটা ভালো লাগছে না আশ্বিনের। তাই মাঝপথেই হাঁটা থামিয়ে দেয় সে।
‘অধরা কি হয়েছে বলো তো আমায়?’
নীরব অধরা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভীতির ছাপ।
‘আশ্বিন ভাইয়া, তিন দিন ধরে হোস্টেল থেকে কলেজ যাওয়ার পথে কারা যেন আমার পিছু নেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আমার মনের ভুল। কিন্তু আজ আমি সরাসরি দেখেছি তাদের। আমাকে ধরতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি কোনরকম দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।’

স্তব্ধ হয় আশ্বিন। কি বললো সে? মেয়েটির সাথে এতকিছু হয়ে গেলো অথচ এতক্ষণ ধরে কাউকে টু শব্দ করেও কিছু বললো না! অধরা নীরবে চোখ মুছে যাচ্ছে, ভয় পেয়েছে নিশ্চয়ই। মায়া হলো আশ্বিনের। নিজেকে যতোই বীর বাহাদুর ভাবুক না কেনো, এমন পরিস্থিতি যে কাউকে ভয় দেখাতে বাধ্য।
অধরাকে নিজের দিকে টেনে তার কাছে গিয়ে চোখ চোখ রাখে আশ্বিন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠস্বরে বলে উঠে,
‘কথাগুলো তোমার এতক্ষণ গোপন করা ঠিক হয়নি অধরা। যাই হোক, ভয় নেই। আমি দেখছি কি করা যায়, ইনশাআল্লাহ কাল থেকে আর কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। তবুও সাবধানতার জন্য এখন থেকে ইশার সাথে কলেজে যাবে, একা বাহিরে থাকবে না। ঠিক আছে?’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় অধরা। ভীত বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশ্বিন তার ভরসার জন্য শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।
শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে। অধরার পিছু করছে, কে হতে পারে? কি তার স্বার্থ? যদি অধরার ক্ষতি করার চিন্তাও করে থাকে তবে তার আর রক্ষে নেই। আশ্বিন যতোই শান্ত প্রকৃতির হোক না কেনো, অন্যায়ের প্রতিবাদ সে কঠোর ভাবেই করে, আর এই বিষয়ে তো তার অধরা জড়িত।
—————-

বর্তমানে,

অধরার ডাকে কল্পনা থেকে ফিরে আসে আশ্বিন। অনেক্ষণ ধরে দুজন বসে আছে পার্কের সেই বেঞ্চটায়। আকাশে মেঘ জমে আছে। দ্রুত বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। তবুও ফিরে যাওয়ার আগে একটা কাজ না করলেই নয়।
‘চা দোকানের মামার সাথে দেখা করে যাই? অনেক দিন হলো যাওয়া হয়নি। আমাদের দেখলে খুশি হবেন উনি।’
মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আশ্বিন। অধরার হাত ধরে হেঁটে যায় চা দোকানের দিকে।

রাত আটটা বেজে বিশ। পড়ার টেবিলে ঝিম মেরে বসে আছে অধরা। যেই উদ্দেশ্যে সে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সেই আসল কাজ এখনও করা বাকি। খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে ফাইলে কিসব দেখতে ব্যস্ত আশ্বিন। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, আবহাওয়া যেন শীত শীত অনুভূতি দিচ্ছে।
টুসি এসে এতক্ষণ অধরার সাথে গল্প গুজব করে গিয়েছে। তাই এখন একা একা লাগছে অধরার। আশ্বিনের দিকে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সে, বুঝে পায় না তার কপালেই কেন এই পানসে মহাশয় জুটলো? সে কি কম রোমান্টিক মেয়ে নাকি?
মাঝে মাঝে তো ভেবে বিশ্বাস হয় না, কিভাবে এই মানুষটিকে পাবার জন্য কতো সব আহাজারি করেছিল সে!

‘অধরা ছাদে যাবে?’
চমকে উঠে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো অধরা। কানে কি ভুল শুনলো সে?
‘হ্যাঁ?’
‘চলো ছাদে যাই, বৃষ্টি বিলাস করে আসি।’
থমকে যায় অধরা। এ কিসব বলছে আশ্বিন? নিজ থেকেই বলছে তো নাকি?
‘বৃষ্টি ভিজে আপনার জ্বর আসবে না?’
‘আসবেই তো।’
‘তবে..?’
‘তখন হাসপাতাল থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে বাসায় শুয়ে বসে আমার স্ত্রীর সেবা যত্ন নিবো।’
ভ্যাবাচেকা খায় অধরা? পাগল হয়ে গেলো নাকি
‘আশ্বিন, মাথা ঠিক আছে আপনার? পাগল হলেন?’
হেসে উঠে আশ্বিন। ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে উঠে এসে অধরার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। অধরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বলে উঠে।
‘আমি প্রেম নামক রোগে অসুস্থ, অধরা। এই রোগ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে এক অদ্ভুত অনুভূতির মায়াজালে বেঁধে ফেলে তাদের পাগল করে দেয়। ডাক্তার এই রোগ ধরতে পারে না, তাই এর চিকিৎসা তাদের কাছে নেই। শুধুমাত্র অনুভূতি জরানো মানুষ এই রোগের চিকিৎসা পারে। জানো কীভাবে?’

উত্তর নেই অধরার। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে। আশ্বিনের শীতল কণ্ঠস্বরে বলা কথা তাকে থমকে দিয়েছে। অনুভূতি খেলে যাচ্ছে তার রম্ভে রম্ভে। নির্বাক সে, হতভম্বও বটে। স্মিত হাসি দেয় আশ্বিন।
‘চলো। একদিনে বেশি কথা বললে মাথা গুলিয়ে ফেলবে তুমি। আবার আমাকে পানসে ভাবো, বোকা মেয়ে।’

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৩

কাক ভেজা অবস্থায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অধরা আশ্বিন। তাদের সামনে দাঁড়ানো রাশেদা খালার চোখ মুখে বিস্ময়! খালার পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে টুসি।
‘এই রাইতের বেলায় ছাদে গিয়া বৃষ্টিতে ভিজা লাগলো কেন? এখন তো অসুখ হইবো।’
লজ্জায় মাথা কা/টা যাচ্ছে অধরার, নতজানু হয়ে আছে সে। আশ্বিন নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে। যেনো কিছুই হয়নি।
অথচ কিছুক্ষণ আগেই কি সাবধানতার সাথে লুকিয়ে অধরা ঘরে প্রবেশ করছিলো, মহাশয়ের জন্য সব ভেস্তে গেলো।
‘খালা, তোমার বউমণীর ইচ্ছে করছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। তাই আমাকেও জোর করে নিয়ে গিয়েছে।’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। কোন কালে সে এরূপ কথা বলেছিলো? এতো বড় মিথ্যা অভিযোগ তার নামে?

মহাশয় কি চতুরতার সাথে নিজেকে বাঁচাতে খালার সামনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
‘আইচ্ছা ব্যাপার না। নতুন নতুন বিয়া হইলে এমনই হয়। যাও ভেজা কাপড় পাল্টায় ফেলো, নাইলে পরে ঠান্ডা লাগবো।’
ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় খালা। টুসি এখনও দাঁড়িয়ে, দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে।
‘মামি আসার পর দেখি মামার ভালোই পরিবর্তন হয়েছে। মামা চালিয়ে যাও..।’
আর বলা হয়নি টুসির। আশ্বিন তাড়া করতেই দৌড়ে পালিয়ে যায় সে।
অধরা তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে কড়া চাহনিতে। এতো বড় মিথ্যে বলেও উনার কোনরকম অনুশোচনা নেই। আশ্চর্য ব্যাপার!

রান্নাঘরে এসেই চুলায় চা বসিয়ে দিয়েছে অধরা। ইতিমধ্যে ঠান্ডা লাগিয়ে ক্রমাগত হাঁচি দিতে শুরু করেছেন আশ্বিন মহাশয়। ছোট থেকেই নাকি উনার অল্পতেই ঠান্ডা জ্বর আসে। অথচ এ কথা জেনেও উনি কি নির্বিকার ভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছেন। অধরা বুঝে পায় না মানুষ কিভাবে জেনে শুনে অসুস্থ হতে চায়?
দুকাপ লেবু চা নিয়ে অধরা রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিন এর মাঝেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা, এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপ তার হাতে দেয়।
‘কি দরকার ছিল বৃষ্টিতে ভেজার?’
মুচকি হাসি দেয় আশ্বিন। চোখ মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই।
‘তোমার সাথে আবারো বৃষ্টি বিলাস করার অনেক ইচ্ছে ছিলো। সেই ইচ্ছে পূরণ করেছি, আর ফল স্বরূপ এই হাঁচি..।’
বিরক্ত হয় অধরা। অসুস্থ হয়েও উনার সাহিত্য কথা যাচ্ছে না। এভাবে জোর করে নিজেকে রোমান্টিক বর সাব্যস্ত করার কি খুব প্রয়োজন?
‘চা খেয়ে নিন। রাতের খাবারের পর ঔষধ খেয়ে নিলে আশা করি জ্বর আসবে না।’
বাধ্য ছেলের মতো চায়ের কাপে চুমুক দেয় আশ্বিন। পাশে বসে অধরা একনজর ফিরে তাকায় তার দিকে। প্রকাশ করছে না তবে তাদের মাঝে সেই ভুল বোঝাবুঝির পর আর একসাথে বৃষ্টি ভেজা হয়নি দুজনের।
অধরারও যে খুব ইচ্ছে ছিল আশ্বিনের হাতে হাত রেখে বৃষ্টি বিলাস করার। তখন অবশ্য ভাবেনি যে তার ইচ্ছে অচিরেই পূরণ হতে যাচ্ছে। আনমনে হেসে উঠে সে।
————-

ভোরের কিরণ এসে হানি দিচ্ছে চারদিকে। জানালা ভেদ করে আসা সেই আলো আশ্বিনের চোখে পড়ার আগেই ঘরের পর্দা টেনে দেয় অধরা। বেচারা শেষ রাতে তীব্র জ্বরে কাতর ছিলো। ঘুমের মাঝে আশ্বিনের গায়ে হাত রেখে সেই তাপমাত্রা অধরাকে চমকে দিয়েছে।
ফল স্বরূপ, মহাশয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী রাত জেগে উনার কপালে রুমাল ভিজিয়ে দিতে হয়েছে অধরার।
মহাশয় তখন অচেতন অবস্থায় থাকলেও অধরার কেনো জানি মনে হয়েছে আশ্বিন মিটিমিটি হেসে যাচ্ছিলো। আচ্ছা জ্বরের ঘোরেও কি কেউ হাসে?

সকাল সকাল রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো সে। রাশেদা খালা এর মাঝেই সকালের নাস্তা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
‘বাজানের জ্বর উঠছে বউমণী?’
‘জি খালা। কাল রাতে জ্বর বেড়ে গিয়েছিলো, এখন একটু সুস্থ আছেন।’
‘আমাকে ডাকলা না কেন? বাজানরে সেই ছোট থেকে দেখতাছি বৃষ্টিতে ভিজলেই অসুখ করে। চিন্তা কইরো না ঠিক হইয়া যাইবো।’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় অধরা। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। আজ আর কলেজ যাওয়া হবে না তার। এই মুহূর্তে আশ্বিনের পাশে থাকাটা তার প্রয়োজন।
তবে ভালো হতো যদি একবার রোদ্দুরের সাথে দেখা করে কথা বলা যেতো। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে কোন কিছু ভাবছে না সে।
‘বাজানের জন্য কি নাস্তা তৈরি করমু?’
একটু ভাবুক হয়ে পড়ে অধরা। তার জানা আছে আশ্বিনের প্রিয় খাবার কি! তাই মুচকি হেসে কাজে লেগে যায় দুজন। কাজের মাঝেই মনে পড়ে যায় অতীতের স্মৃতি…।
——————–

অতীতে,

হোস্টেল থেকে কেউ অধরার পিছু নেয়, ঘটনাটা চরমভাবে ভীতির সঞ্চার করেছে অধরার মনে। যার ফলে আজ দুদিন হলো সে হোস্টেল থেকে বের হয়নি। যদিও ইশা তাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলো হোস্টেল সুপার রুমি ম্যামকে জানানো হয়েছে, আর কোন সমস্যা নেই। তবুও অধরার মন সায় দিচ্ছে না। কারা কেনো এভাবে তার পিছু নিচ্ছে? তাকে কেনো ধরতে চাইছে?

‘অধরা চল আজ কলেজ যাই। ক্লাসগুলো ইমপরটেন্ট, এভাবে মিস দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।’
‘যদি আবারো সমস্যা হয় কোন?’
‘মনে হচ্ছে না আর কিছু হবে। তাছাড়া জারিফ, সাদমান আর অনিক বাহিরে দাড়িয়ে আছে। চল সাহস করে রওনা দেই, বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
সম্মতি দেয় অধরা। সত্যিই তো, এভাবে কদিন সে হোস্টেলে বসে থাকবে? তাই ইশার কথায় তাদের সাথে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে।

‘অধরার সাথে তাদের কিসের শত্রুতা? কেনো এই পিচ্চি মেয়েটাকে এভাবে ভয় দেখাতে চাইছে তারা? কিছু জানতে পেরেছিস তুই?’
‘গতকাল রাতে আমার গার্ড ছেলেগুলোকে ধরে ফেলেছে। তারা নিজ মুখে স্বীকার করেছে, কেউ একজন তাদের টাকা দিয়েছিলো অধরাকে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করতে। ভাগ্য ভালো সঠিক সময়ে তাদের ধরে ফেলেছি। কিন্তু এদের পেছনে আসল অপরাধী কে, সেটা এখনও জানা যায়নি। তিনজনের কেউ তার চেহারা দেখেনি, শুধু একটা মেইল আর কিছু টাকা পাঠিয়ে ছিলো তাই।’
‘অধরার কোন পারিবারিক শ/ত্রু কি এমন করেছে?’
‘জানি না রোদ। তবে আমি সতর্কতার জন্য গার্ড ঠিক করেছি, তারা অধরাকে আড়াল থেকে দেখে রাখবে। বিষয়টা গোপন রাখিস, কেউ যেন না জানে।’
হেসে উঠে রোদ্দুর। প্রিয় বন্ধুর ইদানিং ভালোই পরিবর্তন হচ্ছে। লক্ষণ ভালো না, প্রণয়ের সূচনা নয় তো?
‘কি ব্যাপার বল তো আশ্বিন! কদিন ধরে দেখছি অধরা নিয়ে তুই অনেক সিরিয়াস। আমি কি ধরে নিব যে..।’
থেমে যায় রোদ। কপালে ভাঁজ পড়ে আশ্বিনের। সেদিনের পর থেকে রোদ উঠতে বসতে তাকে আর অধরাকে নিয়ে খোঁটা দিয়েই চলেছে। রাগ হলো তার, কিছু বলতে নিবে তার আগেই..।

‘আশ্বিন ভাইয়া..!’
গেইট দিয়ে প্রবেশ করেই দৌঁড়ে ছুটে আসে অধরা। আশ্বিন মুচকি হেসে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়।
‘এতোদিন পর তাহলে আসা হলো..। আজ কোন সমস্যা হয়নি তো আসতে?’
‘না। সব ঠিকঠাক ছিলো। আমরা সবাই একসাথে এসেছি।’
‘ভালো করেছো। এখন ক্লাসে যাও। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তোমাদের।’
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে চলে যায় অধরা। আশ্বিন তার যাওয়ার দিকে লক্ষ্য করে দূর থেকে মারিয়া তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এই কদিন বারবার আশ্বিনের আশেপাশে ঘুরঘুর করেও কোন পাত্তা পায়নি সে।
মারিয়ার আচরণ তার ভালো লাগে না, তাই যতটুকু সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আশ্বিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে রোদ্দুরও ফিরে তাকায় মারিয়ার দিকে। মারিয়ার চোখ মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।
‘বাই এনি চান্স, এসব মারিয়ার কাজ নয় তো?’
চমকে উঠে ফিরে তাকায় আশ্বিন। খানিক চিন্তা ভাবনা করেও এর পেছনে মারিয়ার কাজ বলে মনে হচ্ছে না তার।
‘আরে না! মারিয়া এমন কেনো করবে? তাছাড়া অধরার সাথে মারিয়ার কিসের শত্রুতা?’
দমে যায় রোদ্দুর। হয়তো ঠিক বলছে আশ্বিন। না জেনেই কাউকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না। তাই সকল চিন্তা বাদ দিয়ে দুজন চলে যায় ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
—————–

ক্লাস শেষে অধরা আর তার বন্ধুমহল যাচ্ছে ফুচকা খাওয়ার উদ্দেশ্যে। কলেজ গেটের বাইরে এসে রোড ক্রস করতেই হঠাত সেদিনের ওই ছেলেগুলো অধরার সামনে এসে হাজির হয়। মুহূর্তেই চমকে যায় অধরা। ভয়ে এক চিৎকার করে জারিফ অনিক আর সাদমানের পেছন গিয়ে লুকিয়ে পড়ে সে।
‘আপু আমাদের আর ভয় পাবেন না। আমরা আসলে সেদিনের আচরণের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
ভয়ে গুটিসুটি হয়ে অধরা তাদের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে তাদের দেখছে। আজ ছেলে তিনজনের চোখ মুখে অনুশোচনা। জারিফ আর অনিক গিয়ে তাদের সাথে ঝামেলা করতে চাইলে..।
‘আমাদের ভুল হয়েছিলো ভাই। তাই আমরা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে এসেছি। আশ্বিন ভাইয়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। আর কখনো এমন হবে না।’
খানিকটা চমকে উঠে অধরা। আশ্বিন! উনি তাহলে এদের ধরেছেন? কিন্তু কিভাবে? আর কি এমন করেছেন যে তারা নিজ থেকে এসে অধরার কাছে ক্ষমা চাইছে? এসব প্রশ্ন ভাবাচ্ছে অধরাকে।

ফুচকার দোকানে বসে সবার কথা শুনে যাচ্ছে অধরা। আশ্বিন তার জন্য এতসব করলো ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খোঁচা দিচ্ছে তাকে। অধরা নীরবে সবটা শুনে যাচ্ছে, যেন তার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। আপনমনে ফুচকা মুখে পুরে যাচ্ছে সে।
‘আরে একা একাই খাবে নাকি তোমরা?’
হঠাত কারো কথা শুনে সবাই পাশে ফিরে তাকায়। রোদ্দুর আর আশ্বিন এসে তাদের পাশে বসেছে।
‘আরে রোদ ভাই, আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম। মামা আরো দুই প্লেট ফুচকা দিয়ে যান।’
সাদমানের কথায় মুহূর্তেই ফুচকার প্লেট হাতে নিয়ে হাজির হয় দোকানের ছোটু।

সবাই নিজেদের মতো গল্প গুজব করে খেয়ে চলেছে। কিন্তু বিপত্তি হয়েছে আশ্বিনের, অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ায় সে কখনো অভ্যস্ত নয়। তাই দুটো ফুচকা খেয়েই সে প্লেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ইশা কয়েকবার লক্ষ্য করে তার গতিবিধি।
‘ভাইয়া, সব ঠিক আছে তো? কোন সমস্যা?’
‘না না। কোন সমস্যা নেই।’
আর কথা বাড়ায় না ইশা। যে যার মতো করে খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে চলে যায়। শুধু থেকে যায় অধরা আর আশ্বিন। বেশি ঝাল খাওয়ায় এর মাঝেই আশ্বিনের চোখ মুখ কাল গরম হয়ে গিয়েছে। তবুও কোন টু শব্দ করছে না সে।
অধরা একনজর তার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসে। আশ্বিনের দিকে তা এগিয়ে দেয়।
‘ধন্যবাদ।’

‘আশ্বিন ভাইয়া, একটা কথা বলি?’
‘হুম বলো।’
‘ওই ছেলেগুলোকে আপনি কিভাবে ধরলেন? আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলো। আপনি কি সত্যিই সিনেমার নায়কদের মতো তাদের মে/রে তক্তা বানিয়ে দিয়েছেন?’
ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। খাওয়া বন্ধ করে অধরার মাথায় আলতো করে বাড়ি দেয় সে।
‘সবসময় মাথায় এসব চিন্তা ভাবনা ঘুরে তোমার? আমি কেনো তাদের মা/র/বো? তাছাড়া তাদের গায়ে কি তুমি আঘাতের চিহ্ন দেখেছো কোন? আমি শুধু তাদের সাথে কিছু জরুরি কথা বলেছি..আর তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছি। ব্যাস, এইটুকুই।’
চোখ ছোট ছোট করে অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে।
এইটুকুই? অথচ কি না কি ভেবে বসে ছিল সে। আর বাস্তবে তার কুল কিনারা পর্যন্ত যায়নি ঘটনা। অবশ্য ঠিকই আছে। আশ্বিন শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ, তার পক্ষে কখনই রাগারাগি, মা/র/ধ/র করা সম্ভব না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুজন পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে রাস্তার পাশ ধরে।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)