আমি মায়াবতী পর্ব-১৭+১৮

0
402

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“আপু, এই লোকটা কে? উনাকে মামা কেন বলছো? উনি তো মামা নন।”
আমি কোনো কথা না বলে মহিলাটির বাচ্চাকে উনার কোলে ফিরিয়ে দিতেই উনি আমাদের কাছে থেকে দূরে চলে গেল।
“বাড়ি চল সাবিহা।”
“ঐ মহিলা কার ছবি দেখালো? উনাকে তুমি মামা বলছো কেন? উনি তো মামা নন।”
“উনি আমার মামা, সাবিহা।”
“কি বলছো এইসব? উনি কেন তোমাকে কিডন্যাপ করাবেন? উনার কি লাভ এতে।”
আমি আনমনে উত্তর দিলাম,”জানিনারে সাবু। কিছুই জানি না। আমার নিজেকেই আমি আজও চিনতে পারিনি। আর উনারা কোন জিনিস।”
“আপু।”
“হুমম, বল।”
“তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?”
“জানিনা। আমি জানিনা সাবিহা। ”
“আপু।”
“হুমম, বল।”
“আমরা কি মা-বাবাকে জানাবো?”
“হুমম। জানাবো।”
“এখন গিয়েই?”
“নাহ, কালকে জানাবো।”
“তুমি বলবে? নাকি আমি?”
“আমি বলবো সাবু।”
“বাসায় যাবে আপু?”
“আর একটু থাকি?”
“মা যে বকবে।”
“আমাকে তো বকবে না। তোকে বকবে। কারণ তুই তার মেয়ে। সে আমাকে বকে না,মারে না। কোনোকিছু নিয়েই আমাকে শাসন করে না। ”
“সেটা তো মজার আপু।”
আমি সাবিহার দিকে চোখ রেখে বললাম,”তোর মনে হয় এইটা মজার?”
সাবিহা অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, “এইটা মজার না আপু?”
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,”আজকের সন্ধ্যাটা সুন্দর না সাবিহা?”
“আপু!”
“আরেহ, বল না।”
“আপু!”
“আপু আপু করছিস কেন?”
“আমার ভয় করছে আপু।”
“কাকে? আমাকে?”
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”
“নাহ। চল বাসায় চল। আম্মা তো তোকে বকবে।”
“আপু।”
“সাবিহা।”
“তোমাকে আমি ভালোবাসি আপু। অনেক ভালোবাসি।”
আমি থমকে গেলাম। ভালোবাসা? তাও আবার আমার জন্য? আমি কি আসলেই ভালোবাসার দাবিদার?
“আজকের পরিবেশ অনেক সুন্দর সাবিহা। অনেক সুন্দর। সবাই সুন্দর। তুই সুন্দর। ঐ চোর মহিলার বাচ্চাটাও সুন্দর। এমনকি চোর মহিলাটাও সুন্দর।”
★★★

আকাশে আজ অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। চারদিকে তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁদের আলো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে সবখানে। আমাদের জানালা দিয়েও রুমে প্রবেশ করছে। সাবিহা ঘুমুচ্ছে। চাঁদের আলোয় ওর শরীর জ্বলজ্বল করছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও একটা রাজকুমারী। ঘুমন্ত রাজকুমারী। যেন যুগযুগ ধরে ঘুমিয়েই যাচ্ছে। হুট করেই হয়তো এক রাজকুমার এসে কপালে চুমু খেয়ে ওর ঘুম ভাঙিয়ে নিবে। ওকে আমার খুব ভালোলাগছে। খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে ওকে। যারা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমুতে পারে, তাদেরকে আমার অনেক সুখি মানুষ মনে হয়। আমি ঘুমুতে পারিনা। আমার নিজেকে মনে হয় দুঃখী মানুষ। আমি জানি রাতজাগা কত কষ্ট। যখন মায়ের মৃত্যু হলো, প্রথমদিকে আমার ঘুম হতো না। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে শুরু করলো। আমিও যথাসময়ে ঘুমাতাম৷ কিন্তু ঘুম ভাঙলেই মনে হতো, কেমন মেয়ে আমি। মায়ের জন্য এতো অল্প কষ্ট পাচ্ছি কেন? আমার তো উচিত মায়ের জন্য দোয়া করা, তারজন্য কান্না করা। তারপর ইচ্ছে করেই রাত জাগতাম। আর এখন, চাইলেই সময়ে ঘুমুতে পারি না। রাতটা যে কত বড় আর ভয়ংকর, রাত জাগা মানুষ গুলোই জানে।
আমার ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো । হাতে নিয়ে দেখলাম কবিতা কল করেছে। আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি জানি আমার মন এখন ভালো হয়ে যাবে। আমি ফোন ধরেই বললাম,”শুরু করো,কবিতা।”
“কি শুরু করবো? তুমি যে কাজটা করেছো, এইটা কি তুমি কোনো ভালো কাজ করেছো?”
“কি করেছি আমি?”
“তুমি জানো না তুমি কি করেছো?”
“জানি তো অনেক কিছুই। অনেক কিছুই জানি আমি।”
“তাই? তা কি কি জানো, বলোতো একটু? আমিও একটু শুনি।”
“শুনবে?”
“হুমম। বলো।”
“আজ সকালে আমার একটা পাগল মেয়ের সাথে কথা হয়েছে। সে আমাকে হুট করেই বলে তুমি, হুট করেই বলে তুই। আবার কখন না জানি আপনি করে না ডেকে ফেলে। বুঝলে তো?”
“উফফ, মায়া৷ থাম তো মেয়ে। আমার কথা ছাড়। তুই আমার ভাইয়ের কথা বল।”
“তোর ভাইয়ের কথা? তোর ভাই আবার কি করলো?”
“আমার ভাই যে তোর এতো বড় উপকার করলো, তুই এতোদিন পর কলেজে আসলি, কিন্তু আমার ভাইয়ের সাথে একটুও পাত্তা দেওয়া তো দূর, ধন্যবাদও দিলি না।”
“আমার আসলেই ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার উচিত ছিল উনাকে ধন্যবাদ দেওয়া। আমি বেঁচে থাকলে আগামী পরশু উনার সাথে দেখা করবো।”
“কেন? কালকে আসবি না? কালকেই দেখা কর না।”
“কালকে না কবিতা। কালকে আমাদের বাসায় গেস্ট আসবে।”
“কারা আসবে?”
“আমার নানা-নানি। ”
“অহ। এই শোন, তোর মামাতো ভাই-টাই আছে নাকি বড়সড়? ”
“হুমম আছে। কিন্তু বড় নেই। আমাদের চাইতে ছোট হবে।”
“অহ।”
“কেন? আফসোস হচ্ছে?”
“হুমম, ভীষণ।”
“বাদ দে। তোর পছন্দের মানুষের কি খবর? তাকে জানাবি কবে?”
“তুই বললে কালকেই।”
“তাই নাকি?”
“হুম।”
“তুই তো জানতে চাইলি না, কে সেই মানুষ। তুই যদি জানতি, তাহলে আর তাকে জানাতে বলতি না। ”
“আমি এখন জানতে চাই না। সরাসরি বলিস।”
“ওকে।”
“কবিতা?”
“হুমম। ”
“তোর কি ঘুম পাচ্ছে?”
“নাহ, কেন?”
“জানিস,যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে, তারা অনেক সুখি মানুষ হয়।”
“আরেহ, আমিও সুখী মানুষ। অনেক সুখী মানুষ। প্রেমে পড়লে ঘুম আসে না এমনিতেই।”
“কিন্তু আমি দুঃখী মানুষ। আমার ঘুম আসে না।”
“তুইও কি প্রেমে পড়েছিস নাকি?”
“কবিতা, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“বুঝি বুঝি। সবই বুঝি। যাও ঘুমাও আমার হবু ভাবি।”
“কিহ?”
“কিছুনা। গুড নাইট।”
কবিতার কথায় আমার রাগ লাগলো না। হাসি পেল। আচ্ছা, এই মেয়েটি যখন আমার অতীত জানবে, তখন কি এই মেয়েটি আমাকে এইভাবেই বন্ধু ভাববে? নাকি ঘৃণা করবে?আমাকে কি মিথ্যাবাদী ভাববে? আর নাকী আমাকে নিজের ভাবি বানাতে চাইবে?
★★★

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পা দোলাচ্ছে মামা। সাবিহা বা সাব্বির এর মামা নয়। আমার মামা। আমার একমাত্র মামা। তার পাশেই নানা-নানি। উলটো দিকের সোফায় বসে আছে বাবা। সাবিহা আর আম্মা রান্নাঘরে। সাব্বির চিপস এর প্যাকেট খুঁজছে এঘর থেকে ওঘর। কিন্তু আম্মার কড়া নির্দেশে সবকিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
রান্নাঘর থেকে আম্মা ডাকলো,”মায়া, চা হয়ে গেছে। নিয়ে যাও।”
আমি ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গেলাম। আম্মা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। আচ্ছা, সে কি সত্যিই স্বাভাবিক আছে? নাকি অভিনয় করছে?এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কোনো স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক থাকার কথা না। সাবিহার চোখেমুখে আতঙ্ক। সে ভয় পাচ্ছে কখন আমি সবাইকে সবকিছু জানাই। আমি এদেরকে উপেক্ষা করে ট্রে হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলাম। সবার আগে মামাকে চা দিয়ে বললাম,”মিষ্টিমুখ করেন মামা।”
নানা বললো,”তোমার আম্মা কিন্তু অনেক ভালো রান্না করে, মায়া।”
“হুমম। আমার আম্মা আসলেই অনেক ভালো রান্না করে।”
চা এর কাপে চুমুক দিয়ে নানী বললো,”আসলে রিজভী বাবা, আমরা এখানে একটা উদ্দেশ্যে এসেছি। বলতে পারো আমাদের শেষ দায়িত্ব পালন করতে।”
বাবা জিজ্ঞেস করলো,”কিসের দায়িত্ব আন্টি?”
“মায়ার মায়ের কিছু সম্পদ আমাদের কাছে পাওনা আছে। সেই অভাগী তো আর বেঁচে নেই। তাই আমরা চাইছি, মায়াকেই সেটা দিয়ে যেতে। আমরা কদিনই বা আর বাঁচবো। ”
“আমি কিছু বলতে চাই নানী।”
“তুমি এই ব্যাপারে কি বলবে? আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে আসছি। তুমি ছোট মানুষ। বুঝবে না এতো কিছু। তোমার মায়ের হক তো আমি নষ্ট করতে পারিনা।” নানা বললো
“আমাকেই তো বলতে হবে নানাভাই। আমার জন্যই তো এতোকিছু। সবকিছুর মূলেই তো আমি। আর আমাকে বাদ দিয়ে কেন সবকিছু করছো?”
“মায়া, কি বলছো এইসব?”
“আমি সবার কাছেই বাড়তি একটা ঝামেলা। আমি এইখানে মানিয়ে নিয়েছি। এইখানে সবাই আমাকে ভালোবাসে। যদিও আমি সেটা অর্জন করেছি। আমি তোমাদের ভালোবাসাও চাই। কিন্তু যে সম্পদের জন্য কারো কাছে আমার পরিবার মরতে বসবে। আমাকে কিডন্যাপ করা হবে, সেই সম্পদ আমি চাই না।”
আমার কথায় যেন বাজ পড়লো ঘরে। আম্মাও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। সাবিহা মায়ের পিছনে ভীতু ভীতু চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে। আমি মামার সামনে গিয়ে সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”আমাকে না হয় কিডন্যাপ করিয়েছিলেন মামা, আমার পরিবারের সাথে এমন কেন করলেন?ওরা তো আর আমার সম্পদে ভাগ বসাতে আসতো না।”
মামা থতমত খেয়ে বললো,”কি সব বাজে কথা বলছো?আমি কেন তোমাকে কিডন্যাপ করাবো?আর কেনই বা তোমার ভাই-বোনকে এক্সিডেন্ট করাবো? আমার কি লাভ?”
আমি একটু মুচকি হাসলাম।
“আপনি কিভাবে জানেন যে ওদের এক্সিডেন্ট হয়েছিল? আমরা তো কেউ জানাইনি।”
মামা হয়তো বুঝলো সে ধরা পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলো সে। আমি সবাইকে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। কালকের কথা, গতবছর সাবিহার কিডন্যাপের কথা। যেখানে আমার কিডন্যাপ হওয়ার কথা ছিল। নানা মাথা নিচু করে রইলো। নানী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মামাকে বকতে লাগলো। বাবা বা আম্মা কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। হঠাৎ মামা দাঁড়িয়ে বলে উঠে,”বেশ করেছি আমি। কাকে সম্পদ দিতে চাইছো তোমরা? তোমাদের সেই বে*শ্যা মেয়েকে?যে সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছিল বিয়ের আগেই। এতোটাই খারাপ আর নিকৃষ্ট ছিল সে। তাকে কেন কিছু দিতে হবে?সারাজীবন ওর জন্য পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। ও তোমাদের কোন দায়িত্ব পালন করেছে যে ও তোমাদের সম্পদের দাবিদার হবে? বলো? জবাব দাও। আমার আর তোমাদের ছোট মেয়ের সন্তানরা আজও সেই বে*শ্যার করা পাপের জন্য শাস্তি পাচ্ছে। তাদের কাছে বলার মতো কোনো ভাষা নেই আমাদের। তারাও ভুক্তভোগী মায়ার মতো। মায়াকে তো তার বাবার কাছে দিয়েই দিয়েছো। আর ওর মায়ের বিয়ের সময় তো রিজভী ভাইয়ের দাবি ছিল সব সম্পর্ক শেষ করতে হবে পরিবারের সাথে।তাহলে এখন ঐ বে*শ্যা কেন সম্পদের ভাগীদার হবে?”
আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ সাব্বির আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”মায়া আপু, বে*শ্যা মানে কি?”

চলবে….

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৮
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ সাব্বির আমার পাশে এসে আমার হাত ধরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,”মায়া আপু, বে*শ্যা মানে কি?”
আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, ওর হাতে চিপসের প্যাকেট। ও খুঁজে পেয়েছে। কিভাবে পেল? মা তো লুকিয়ে রেখেছিল। ও সব খুঁজে পাচ্ছে ধীরে ধীরে। ও তো আলাদা৷ আমাদের সবার থেকে আলাদা। ও তো নিষ্পাপ। আমি চাই না ও সবকিছু খুঁজে পাক।দুনিয়ার নিষ্ঠুর আর নিষিদ্ধ জিনিস ও জানুক, তা তো আমি চাই না। আমি ওকে কিছু বলার আগেই বাবা উঠে এসে সাবিহা আর সাব্বিরকে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিল।
নানাভাই মামার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার ভাগের অংশ তো তোমাকে আমরা দিয়েই দিয়েছি। তাহলে কেন তুমি এইসব করছো?বাবা হিসেবে কি আমি ব্যর্থ?তোমাকে তো সবই দিয়েছি আমি। তোমার কোনো চাওয়াই তো আমি অসম্পূর্ণ রাখিনি।”
আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ” আমার কি দোষ ছিল মামা?আমার সাথে এমন কেন করলেন?আমার কারণে তো আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।”
মামা হুট করেই দাঁড়িয়ে গেল। আমার সামনে এসে বললো,”কে বললো তুমি কোনো ক্ষতি করোনি? তুমি জানো, তোমার আর তোমার মায়ের জন্য কি কি হারিয়েছি আমরা? তোমার মা তো তোমাকে নিয়ে আড়ালে চলে গেল। আর আমরা? আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি এই সমাজ থেকে। কোথাও কেউ তোমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেই তোমার নানা হন্যে হয়ে বাড়ি বদলাতো। ভালোবাসার মানে জানো তুমি?তোমার মা জানে?সে তো একটা নোংরা ভালোবাসার খেলা খেলেছে। যার ফল হচ্ছো তুমি। আর তোমার আর তোমার মায়ের কথা যখন আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই জানলো,আমাদের দিকে ছিছি করতে লাগলো। যে মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,যাকে ছোট্টবেলা থেকে ভালোবাসতাম, যাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম, তোমার মায়ের কুকীর্তির জন্য তাকেও হারিয়েছি। আর তোমার খালামনি। তার বিয়ে দিতে তোমার নানা আর আমার কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে, সেটা কি তুমি জানো?লোকে বলেছে, যার বড় বোনই বে*শ্যা, সে না জানি কেমন হবে। আর তোমার মায়ের মৃত্যুর পর কি এখন সব ভুলে যাবো? ১৮ বছর ধরে যে আগুনে পুড়ছি, সেই আগুন কি তোমার মুখের হাসি দেখেই নিভবে?কি মনে হয় তোমার? কষ্ট শুধু তুমি একাই করেছো? আমরা করিনি? তোমার সুখের দিনের শুরু। এই পরিবার তোমাকে আপন করে নিয়েছে। কিন্তু আমরা যা হারিয়েছি, তা কি আর সারা জীবনেও ফিরে পাবো?তোমার মনে হচ্ছে না, সম্পদ তো দূরের কথা, আমাদের করুনা কিংবা ভালোবাসার দাবিদারও তুমি নও? ভালোবাসার মানে বুঝো মায়া? আমি তোমার মায়ের জন্য সব হারিয়েছি। ”
আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম৷ মামার দিকে তাকিয়ে বললাম,”আমার মায়ের দোষ আমার উপর বর্তালো মামা। কিন্তু আমার পরিবার কি দোষ করলো? আমাকে যা করার করতেন। আমার ভাই-বোনের কি দোষ ছিল?”

মামা মাথা নিচু করে রইলো। নানাভাই বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাদের মাফ করে দিও বাবা। আমার মেয়ে তোমাদের সবার জীবনই নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এক অভাগা বাবা৷ আমার সন্তানদের মানুষ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো বাবা।”
“আমাদের কোনো সম্পদ লাগবে না। আমার মেয়েরও লাগবে না। আমার মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। আমাকে আল্লাহ অনেক দিয়েছেন। আমি ওকে মানুষ করতে পারবো।”
নানী চোখের পানি মোছার চেষ্টা করছে বারবার। আমি ওনার চোখেমুখে অসহায়ত্ব দেখলাম। নানী ধীরে ধীরে আম্মার কাছে গিয়ে বললো,”আমার মেয়ের একটা ভুলের কারণে আজ আমি এখানে মা। তোমার সংসার ভাঙতে গিয়ে নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে সে। কিন্তু কারো পাপ অন্য কারো উপর ফেলা ঠিক না মা। আমার নাতনীকে একটু আগলে রেখো মা। ওকে কষ্ট পেতে দিও না। সারাজীবন অনেক কষ্ট পেয়েছে সে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না আন্টি। মায়াকে আমি আমার বাচ্চার মতোই দেখবো।”
“আমি জানি মা। আমি জানি তুমি দেখবে। মায়ার মায়ের বিশ্বাস ছিল তুমি ওকে ভালোবাসবে। তখন ওর প্রতি রাগ ছিল কেন ও আমাদের কাছে মায়াকে রাখার অনুমতি দিল না। আজ বুঝতে পারছি,কেন দেয়নি।”
তারপর সবাই চলে গেল। প্রথমে মামা। তারপর নানা-নানি। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরেই নানী চলে গেল। আমাকে একবারের জন্য বলেও গেল না তাদের বাড়িতে যেতে। বলবে কিভাবে? তারাই তো এখন ছেলের ঘরের অতিথি। সেখানে আমাকে কেন ডাকবে? আমার আরও একটা আশ্রয় হারিয়ে গেল। এইবাড়ি থেকে কখনো বের হয়ে গেলে আমার পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
★★★
সাগরিকা সাব্বির এর ঘরে বসে আছে। সাব্বির ঘুমুতে চাইছে না। কিছুক্ষণ পরপর এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। হঠাৎই আবার জিজ্ঞেস করলো, “মা, বে*শ্যা মানে কি?”
সাগরিকার মেজাজ গরম হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল মায়ার মামাকে গিয়ে ইচ্ছেমতো থাপড়াতে।কেমন অবিবেচক মানুষ সে। বাসায় ছোট বাচ্চাদের সামনে এইসব বলার কোনো মানেই ছিল না।
সাগরিকার হৃদয় মনে হচ্ছে ২ ভাগ হয়ে গেছে। একভাগে মায়া। আরেকভাগে তার সংসার। মায়ার জন্য একদিকে যেমন খারাপ লাগছে, তেমনি নিজের সন্তানদের জন্য ভয়ও হচ্ছে। মায়ার মায়ের একটা ভুলে সবাই ভুগছে। একবার মায়ার জায়গায় সাবিহা কিডন্যাপ হলো৷ এবার আবার তাদের এতো বড় এক্সিডেন্ট হলো। তার একবার ইচ্ছে হলো, মায়ার বাবাকে বলে মায়াকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে। পরক্ষণেই মায়ার মা আর নানীর কথা মনে হতেই সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে৷ কি করবে সে এখন? কোনটাকে গুরুত্ব দিবে?মায়াকে নাকি তার সন্তানদের?
★★★

“বাবা।”
“কে?”
“আমি। মায়া।”
“অহহ। আসো,মায়া।”
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বাবার কাছে। মুচকি হেসে বললাম,”কি করছো বাবা?”
“কাজ করছিলাম মা।”
“বিরক্ত করলাম বাবা?”
“নাহ। সমস্যা নেই।”
“তোমার কাছে কিছু চাইতাম বাবা।”
“তুমি যা চাও আমি তোমাকে তাই দিব। শুধু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুলেও বলবে না।”
“কিন্তু আমি এটাই চাই বাবা।”
“আমি এটা চাই না মা।”
“আমি হোস্টেল এ চলে যেতে চাই। আমার জন্য সবারই কমবেশি অসুবিধা হচ্ছে। আমার জন্য কেউ কষ্টে থাকুক, তা আমি চাইনা।”
“আমরা কেউ কি তোমাকে কখনো কিছু বলেছি?”
“তোমরা না বললেও তোমাদের সমস্যা হচ্ছে সেটা আমি জানি।”
“মায়া, শোনো মা আমার, তুমি হচ্ছো আমার কাছে না চাইতেই পেয়ে যাওয়া একটা উপহার। আর তোমার মায়ের কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমি তোমাকে তোমার বিয়ে পর্যন্ত দেখে রাখবো। এরপর আমি এমন একজন মানুষের হাতে তোমাকে তুলে দিব, যেখানে তুমি আমাদের এইখানে যেভাবে আছো, তার থেকেও ভালো থাকবে।”
“কিন্তু বাবা…”
“কোনো কিন্তু না মায়া। আমরা তোমাকে হারাতে চাই না। বুঝলে তুমি? এখন যাও, অনেক রাত হয়েছে। গিয়ে শুয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ, আজকে যা হলো, সেটা আমরা সবাই ভুলে যাবো।ওকে?”
আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম আমার রুমে।
★★★
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই কবিতা।”
“আগে খেয়ে নে তো মায়া।”
“আগে আমার কথা শোনো। তারপর।”
“আজকে আবার তুই তুমি তুমি শুরু করেছিস। আগে খেয়ে তো নে। তারপর কথা। আচ্ছা, শোন। আজকে ক্লাস শেষে ভাইয়ার সাথে কথা বলবি। বুঝলি?”
“আমি তোকে কিছু সিরিয়াস কথা বলতে চাই কবিতা।”
“উফফ,বাবাহ। আচ্ছা, বল।”
“আমি তোমার কাছে কিছু লুকিয়েছি কবিতা।”
“কি লুকিয়েছিস?”
“আমার পরিবারের ব্যাপারে।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে আমি যাকে আমার মা বলে তোর কাছে পরিচয় করিয়েছি,সে আমার মা নন। সৎ মা। আর আমার ভাই-বোনেরাও সৎ ভাই-বোন। ”
“মানে কি এইসবের?”
“এইটাই সত্যি।”
“ফান করছো? মায়া?”
“নাহ। আমি সত্যি বলছি।”
আমি হয়তো আরো কিছু বলতাম, কিন্তু তার আগেই কবিতা উঠে আরেকটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। অন্য মেয়েদের সাথে খাবার খেলো। আমাকে ডাকলোও না। আবার আমি আমার দুনিয়ায় সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। সম্পূর্ণ একা। মায়ের উপর ভীষণ রাগ হলো আমার। কেন এমন অঘটন ঘটালো সে? আর কেনই বা আমাকে জন্ম দিলো? এর উত্তর কি এই জীবনে মিলবে?

চলবে…