আর একটিবার পর্ব-২৬+২৭

0
350

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৬

সাঈদ হাত এগিয়ে দিলো ইরিনার দিকে। ইরিনা মুখ বাচ্চাদের মতো করে সাঈদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাঈদ ভ্রু কুঁচকে কোমড়ে হাত রেখে বলল,
“এই মেয়ে, সমস্যা কি তোমার? তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না?”
ইরিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সাঈদ মুচকি হেসে আবার হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি আছি, তুমি ধীরে ধীরে হেটে আসার চেষ্টা করো।”
“না আমি পড়ে যাব।”
ইরিনার কান্না করার মতো অবস্থা। চেয়ার শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা থরথর করে কাঁপছে তার। কিভাবে সাঈদের দিকে এগিয়ে যাবে? পড়ে গিয়ে যদি ব্যাথা পায়? আর মাত্র ১৫ দিন পর তাদের বিয়ে। বিয়ের আসনে আহত রোগীদের মতো বসে থাকতে হবে। সাঈদ এবার বিরক্ত হলো। এগিয়ে গিয়ে ইরিনার চোখে চোখ রেখে বলল,
“কি যেন বলেছিলে তুমি আমাকে? ‘সাঈদ তুমি হুটহাট পাবলিক প্লেসে আমাকে কোলে তুলে নাও আমার খুব লজ্জা করে। যত পর্যন্ত আমি ঠিক মতো হাঁটতে না পারবো আমরা বিয়ে করবো না।’ এখন যেহেতু তুমি ধীরে ধীরে হাঁটতে পারছো তো ভয় পাচ্ছো কেন?”
“তুমি আমাকে বকছো কেন?”
সাঈদ কপালে হাত দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলে খাটে বসলো। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা মন খারাপ করে রেখেছে। সাঈদ ইরিনার হাত ধরে তাকে নিজের পাশে বসালো। ইরিনা এখনো মন খারাপ করে রেখেছে। সাঈদ ইরিনার হাত৷ নিজের এক হাতের মুঠোয় নিয়ে আর এক হাত দিয়ে কান ধরে বলল,
“আচ্ছা সরি, কান ধরে ক্ষমা চাইছি। রাগ করো না প্লিজ।”
ইরিনা সাঈদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর ন্যাকামো করতে হবে না। আমি রাগ করিনি। আমার ভয় করে হাঁটতে। মাটিতে দাঁড়ালে মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।”
সাঈদ দাঁড়িয়ে হেটে গিয়ে ইরিনার দিকে ঘুরলো। ইরিনা সাঈদের কান্ড দেখে তাকিয়ে রইল। সাঈদ দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই দেখো, আমি তোমার সামনে। তুমি হেটে আমার কাছে আসবে। কার কাছে আসবে?”
“তোমার কাছে”
“তো আসো।”
ইরিনা হার মানলো। এই ছেলে তাকে আজ হাঁটিয়েই ছাড়বে। ইরিনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। এক আগাতেই পা কাঁপতে শুরু করলো। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটা সামনে। যে তার খুব খেয়াল রাখে। তার তো যেতেই হবে মানুষটার কাছে। ইরিনা ধীর গতিতে পা বাড়াচ্ছে। সাঈদের মুখে বড়ো হাসও ফুটে উঠল। ইরিনা এলোমেলো পায়ে হেটে সামনে আসতেই পড়ে যেতে নিলো। সাঈদ দ্রুত তাকে নিজে বাহুতে আবদ্ধ করে নিলো। সাঈদ ইরিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“লক্ষী মেয়ে, আমি জানতাম তুমি পারবে।”
ইরিনা সাঈদের বুকে গাল ঠেকিয়ে হাসছে। মাথা তুলে সাঈদকে দেখলো। এত ভালো কেন এই মানুষটা? তার পরিবারটাও খুব ভালো। সাঈদের মা তাদের সম্পর্ক মন থেকে মানলেও বাবা মানেনি। কিন্তু উনি ভীষণ ভালোবাসেন নিজের ছেলেকে। ইরিনাকেও নিজের মেয়ের মতো দেখেন। ইরিনা মেয়ে হিসেবে অনেক ভালো তাই রাজি হয়েছে। সমাজে উনার খুব সুনাম আছে। হয়তো এই বিয়ের পর অনেক কথার সম্মুখীন হবেন উনি। কিন্তু ছেলের জন্য সহ্য করে নিবে। সাঈদ ইরিনাকে ধরে নিয়ে এসে খাটে বসালো। হাঁটু গেড়ে ইরিনার পাশে বসতেই ইরিনা পা খাটের তুলে নিয়ে বলল,
“তুমি কেন সবসময় আমার পায়ের সামনে বসো বলো তো। আমার খুব অস্বস্তি হয়।”
সাঈদ হেসে বলল,
“তুমি বুঝবে না। তো বলো বিয়ের শপিং দেখেছো সব? পছন্দ হয়েছে?”
ইরিনা আর কিছু বলল না। সাঈদ জেদি। মনে যা আসে তাই করে। তাকে ভালোবাসার ইরিনার কাছে হাজারো কারণ আছে। কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধকর কারণ হচ্ছে সাঈদ তাকে ভীষণ সম্মান করে। বসে দুজন গল্প করতে লাগলো। বাসায় তারা ছাড়া আর কেও নেই। আজ শ্রাবণকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং তার শা*স্তি শোনানো হবে। ইর্তেজা আর মাহা সেখানেই গিয়েছে।
.
.
ইর্তেজার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে মাহা। ইর্তেজা কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। শ্রাবণের শা*স্তি শোনানো হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আজ থেকে ঠিক ৭ দিন পর শ্রাবণকে ফাঁ*সি দেয়া হবে। ইর্তেজা অনেক চেষ্টা করেছে যাতে শা*স্তি বেশি না হয়। কিন্তু পারলো না। শ্রাবণের বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। পেয়েছে বললে ভুল হবে। শ্রাবণ নিজেই সব বলেছে। মাহা ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুমি নিজেকে সামলাও প্লিজ। আমরা চাইলেও কিছু করতে পারতাম না। শ্রাবণ নিজেই নিজেকে শা*স্তি দিতে চাচ্ছে।”
ইর্তেজা মাথা তুলে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি না আমার কেন এত খারাপ লাগছে। আমার সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পাশে ছিল শ্রাবণ। আমি এটা কখনো ভুলতে পারবো না। এই মানুষটার মধ্যে খারাপ-ভালো দুটোই দিক আছে। সবাই শুধু খারাপ দিকটাই কেন দেখছে।”
“কারণ তার খারাপ দিকটাই ফুটে উঠেছে সবার চোখে। এটাই নিয়ম, তুমি হাজার ভালো কাজ করলেও কেও দাম দিবে না। একটা খারাপ কাজ করো, তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলবে।”
“ঠিক বললে। কিন্তু মাহা, সাগরিকাকে কি বলবো আমরা? সাগরিকা আমাকে বলেছিল তাকে শা*স্তির সম্পর্কে জানাতে। আমি কিভাবে বলবো?”
“তাকে বলতে হবেই ইর্তেজা।”
ইর্তেজা চিন্তায় পরলো। তখনই একজন পুলিশ এসে ইর্তেজাকে ডাকলো। ইর্তেজা তাকে দেখে দাঁড়াল।
“আপনাকে একটা সাহায্য করতে হবে মিস্টার ইর্তেজা।”
“জি ইনস্পেক্টর বলুন।”
“আমরা শ্রাবণ আহমেদের সকল সম্পত্তির রিসার্চ করেছি। সবগুলো অবৈধ। আমরা তার সব সম্পত্তি সিল করবো। তার বাড়ি, গাড়ি সবকিছুর দলিল লাগবে। আপনি শ্রাবণ আহমেদের সাথে দেখা করে নিন। আজই দেখা করার শেষ দিন। এরপর উনাকে সেন্ট্রাল জেল নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কারো সাথে দেখা করার পারমিশন সরকার দেবে না।”
“জি”
“আপনি আসুন আমার সাথে।”
ইর্তেজা মাহার দিকে তাকাল। মাহা ইশারায় তাকে যেতে বলল। ইর্তেজা মাথা নিচু করে সেই পুলিশের সাথে হাঁটা ধরলো। শ্রাবণের সাথে আজই তার শেষ দেখা। এরপর একেবারে তার লা*শ নিতে আসবে। ভাবতেই ইর্তেজার বুক কেঁপে উঠল।

শ্রাবণ দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কত মাস হয়ে গেল সাগরিকাকে দেখে না। মন ছটফট করছে এক নজর তাকে দেখার জন্য। ইর্তেজা বলেছিল সাগরিকা তার সাথে দেখা করতে চায় না। শ্রাবণ চোখ খুলল। সে জানে সে খারাপ। তাই বলে কি একবারো তার সাথে দেখা করা যায় না। শ্রাবণের মনের কোণায় অভিমান জমলো। যদি মৃ*ত্যুর আগে একবার সাগরিকার দেখা পায় সব অভিমান ভুলে যাবে। তখনই পুলিশ এসে বলল শ্রাবণকে কেও এসেছে তার সাথে দেখা করতে। শ্রাবণ ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কে এসেছে? নিশ্চয়ই সাগরিকা। শ্রাবণ দ্রুত হেটে সামনে আসলো। ইর্তেজা আসলো এগিয়ে। শ্রাবণ ইর্তেজার আশে পাশে দেখে বলল,
“সাগরিকা কোথায়? ও এসেছে তাই না?”
ইর্তেজা ঢোক গিলল। কান্না আসছে তার। মাথা নিচু করে ফেলল। ইর্তেজার ভাবসাব জবাব দিয়ে দিলো শ্রাবণকে। সাগরিকা আসে নি। শ্রাবণের চোখ বেয়ে পানি পরলো। দ্রুত চোখ মুছে বলল,
“কিছু বলবে ইর্তেজা?”
ইর্তেজা মাথা তুলে শ্রাবণের দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনার সম্পত্তি সব সিল করবে। জায়গা জমিনের দলিল চাচ্ছে তারা।”
“ওহ, আমি দলিলপত্র সব সাগরিকার কাছে দিয়েছিলাম। সে-ই সব সামলিয়ে রাখতো। জানতো না সব অবৈধ। আর আমরা যে বাসায় থাকতাম সেটাও অবৈধ এটাও জানতো না।”
বলেই শ্রাবণ শব্দ করে হাসলো। কিন্তু ইর্তেজার হাসি আসছে না। সে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ হাসি থামিয়ে বলল,
“একটা কথা বলি তোমায়? আসলে একটা রিকুয়েষ্ট করতে চাই।”
“জি”
“থানায় আসার পর আমি অনেক গুলো হাদিস পড়েছি। কবরের আজাবের সম্পর্কে পড়ে আমার ভয় যেন বুক থেকে কমছে না। আমি কখনো নামাজ পড়ি নি৷ ফাঁ*সির থেকেও হাজারো গুণ কষ্ট সহ্য করতে হবে। কেও ধর্মের পথে কখনো আসতেই বলেনি। মা বাবা থাকলে হয়তো আমাকে মানুষের মতো মানুষ বানাতো। কি করবো! উনাদের এখন বদদোয়াও দিতে পারবো না জন্মের পর আমায় রাস্তায় ফেলে দেয়ার জন্য। ইর্তেজা, তোমরা সবাই আমার সব ভুলের জন্য আমায় ক্ষমা করে দিও। সাগরিকা যদি দেখা করতে আসে তার কাছ থেকেও মাফ চাইবো। আর যদি না আসে, তাকে বইলো আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়। অনেক কষ্ট দিয়েছি তাকে।”
ইর্তেজা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।মুখ চেপে ধরে কাঁদছে সে। শ্রাবণ হাত বাড়িয়ে ইর্তেজার গালে হাত রেখে বলল,
“কান্না থামাও ইর্তেজা, তোমাকে আমি শুধু ভাই ডাকি নি মেনেছিও। ইরিনা আপু, মাহা সবাইকে বইলো আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়।”
ইর্তেজা শ্রাবণের হাত ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো। শ্রাবণ তার আর এক হাত দিয়ে ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“যাও ইর্তেজা।”
“আমি পারলাম না আপনার শা*স্তি কম করাতে। ক্ষমা করে দিয়েন আমায়।”
“আমি তোমাকে বলেছি আমাকে বাঁচাও ইর্তেজা? না, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। কেন যেন বাঁচতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
ইর্তেজা মাথা তুলে চোখের পানি মুছলো। কি বলবে আর? এখন তার কাছে কিছুই বলার নেই।
.
.
সাগরিকা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। হেরিং এর সময় ছিল ১২ টা। এখন ১ বাজতে চলেছে। ইর্তেজা এখনো কল দিচ্ছে না। সাগরিকা বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করতে লাগলো। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে খুব। সূর্য সাগরিকাকে ডেকে দরজা ঠকঠক করলো। সাগরিকা দ্রুত বিছানায় বসে মোবাইল হাতে নিলো। সূর্যকে বুঝতে দেয়া যাবে না সে শ্রাবণকে নিয়ে চিন্তিত। সূর্য জানতে পারলে রেগে যাবে। শ্রাবণকে একটুও সহ্য করতে পারে না সূর্য। সূর্য দরজা ঠেলে ভেতরে আসলো। সাগরিকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু বলবি?”
“ইর্তেজা ভাই এসেছে।”
সাগরিকা দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো। মোবাইল খাটের উপর ধপ করে দেখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে নিজেকে শান্ত করলো৷ মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“কেমন আছো ইর্তেজা?”
“ভালো, কিছু বলার ছিল আপনাকে।”
“বলো, আর দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
“না, বস বলল সম্পত্তির সকল দলিল আপনি সামলিয়ে রেখেছেন।”
সাগরিকা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।
“বাড়ি-ঘর, গাড়ি, অফিস, ফ্যাক্টরি সব অবৈধ। পুলিশ সব সিল করে ফেলেছে। দলিলপত্র লাগবে।”
“ওহ, সব তো বাসায়। আমাদের.. মানে শ্রাবণের ঘরের আলমারির লক-আপে।”
“ঠিক আছে, আসি তাহলে।”
বলেই ইর্তেজা ঘুরে দাঁড়াল। সাগরিকা সাথে সাথে বলল,
“লক-আপে আমার ফিংগার প্রিন্ট দেয়া। খুলবে কিভাবে তুমি?”
ইর্তেজা সাগরিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি জানি আপনি কি করতে চান?”
সাগরিকা অপ্রস্তুত হলো। বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে। ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আগামী এক সপ্তাহের পর উনাকে ফাঁ*সি দেয়া হবে।”
সাগরিকা যেন তার বুকে ধাক্কা অনুভব করলো। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথা খালি খালি লাগছে।ইর্তেজা আবার বলল,
“উনি মাফ চেয়েছেন আপনার কাছ থেকে। মাফ করে দিয়েন উনাকে। যাতে উনার আজাব একটু হলেও কম হয়।”
সাগরিকার মাথা ঘুরছে। সাথে সাথে সোফা ধরে মাথা নিচু করে ফেলল। হাত পা কাঁপছে। ইর্তেজা ঘড়ি দেখে বলল,
“রাতে উনাকে সেন্ট্রাল জেল নিয়ে যাবে। তারপর আর দেখা করতে পারবো না। আপনি আমার সাথে চলুন। দলিলপত্র সব নিয়ে আমাকে যেতে হবে দ্রুত।”
সাগরিকার গলা যেন কেও চেপে ধরেছে। কিছুই বলতে পারছে না। আর না পারছে কাঁদতে। ধীরপায়ে হেটে ইর্তেজার সামনে গেল। ইর্তেজা কিছু বলল না। ঘুরে হাঁটা ধরলো। সাগরিকা চুপচাপ তার পিছু নিলো। দূর থেকে সূর্য অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণের ফাঁ*সি হয়ে যাবে। সে এইটাই চাইতো। কিন্তু এটা শোনার পর খারাপ লাগছে হঠাৎ।

সাগরিকা চুপচাপ রাস্তায় হাঁটছে। এই সময় তার কী করা উচিত সে জানে না। শ্রাবণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার কি দেখা করা উচিত হবে? দেখা করলে যদি নিজেকে শক্ত রাখতে না পারে? এই সময় তার মানসিক শান্তির প্রয়োজন। শ্রাবণকে দেখলে ভেতরের অশান্তি বেড়ে যাবে। বাসায় পৌঁছে সাগরিকা মাথা তুলে পুরো বাড়িতে চোখ বুলালো। কেও জানতো না এই সুন্দর বাড়ির ভেতরটা কেমন। এই বাড়িতে থেকে সাগরিকা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। শ্রাবণ তাকে মানসিক, শারীরিক সব ধরণের অত্যাচার করেছে। তার তো খুশি হওয়া দরকার শ্রাবণের শা*স্তি পেতে চলেছে৷ কিন্তু না, কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ কষ্ট। সাগরিকা আর ইর্তেজা ভেতরে গেল। বাড়ির দরজা খুলতেই সাগরিকা থমকে গেল। এই কয় মাসে ধুলোয় ভরে গিয়েছে। বাড়ির এক এক কোণা সাগরিকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতো। সাগরিকা এগিয়ে গেল। এই পরিচিত বাড়িটাও হঠাৎ করে অচেনা লাগছে। সাগরিকা দাঁড়িয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ইর্তেজাও থামলো। সাগরিকার মনের অবস্থা সে বুঝতে পারছে। সাগরিকা চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ইর্তেজা তার পিছু পিছু যাচ্ছে। সাগরিকা ঘরের দরজার সামনে গিয়ে চোখ বুলালো দরজায়। দরজায় খুব সুন্দর করে শ্রাবণ ও সাগরিকার নাম লিখা। সাগরিকা নামের উপর হাত বুলিয়ে ধলো মুছে দিলো। দরজা খুলে ভেতরে গেল। ঘর যেমন রেখে গিয়েছিল ঠিক তেমনই আছে। আলমারির সামনে গিয়ে দরজা খুলে লক-আপ থেকে দলিলপত্র বের করে ইর্তেজার দিকে এগিয়ে দিলো। ইর্তেজা সব চেক করে বলল,
“চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আমি থানা যাব।”
সাগরিকা জবাব দিলো না। হঠাৎ একটা কিছু মনে আসতেই আলমারির ভেতরের ড্রয়ার খুলে একটা ফাইল বের করলো। ফাইলটা দেখে সাগরিকার চোখের কোণায় পানি জমে গেল। এটা সেই জমিনের কাগজ যেখানে শ্রাবণ অনাথ আশ্রম বানাতে চেয়েছিল। সাগরিকা ইর্তেজাকে বলল,
“ইর্তেজা একটা হেল্প করবে?”
“জি বলুন”
“এই জায়গাটার সম্পর্কে খোঁজ করতে পারবে? মানে বৈধ না-কি অবৈধ। এটা সেই জায়গা যেটা শ্রাবণ মাহার চাচুর কাছ থেকে কিনেছে।”
“পারবো”
“তাহলে এইটাও নিয়ে যাও। যদি বৈধ হয় প্লিজ আমাকে দিয়ে যেও।”
“ঠিক আছে, আমি বসকে বলবো নি যদি জায়গা বৈধ হয় আপনার নামে করে দিতে।”
সাগরিকা মাথা নাড়াল।

জেলের ভেতর মাটিতে একটা মাদুর বিছানো শুধু। কোনো বালিশও নেই। মাথার নিচে হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে শ্রাবণ। দুপুর বেলা কিছু খায়নি। ক্ষুধা সহ্য করতে পারছিল না বলে জোর করে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয় মানুষটা তার স্বপ্নে হানা দিয়েছে। সাগরিকার হাতে হাত রেখে রাস্তায় হাঁটছে শ্রাবণ। পথ সামনে, কিন্তু তার দৃষ্টি সাগরিকার দিকে। সাগরিকা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তাকিয়ে আছো কেন?”
“আমার প্রিয় মানুষটাকে দেখে মনের পিপাসা মেটাচ্ছি।”
সাগরিকা হেসে দাঁড়াল। শ্রাবণও দাঁড়াল তার দেখাদেখি। সাগরিকা শ্রাবণের আর একটু কাছে গিয়ে বলল,
“কাছে থেকে দেখো, দ্রুত মিটে যাবে।”
শ্রাবণ হেসে সাগরিকার গালে হাত রেখে বলল,
“সাত জন্মেও মিটবে না।”
সাগরিকা শব্দ করে হাসলো।

ইর্তেজার ডাকে শ্রাবণের ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে আশে পাশে দেখলো। সাগরিকা নেই। শ্রাবণের বুক ভারী হয়ে আসলো। পছন্দের স্বপ্ন ভেঙে গেলে খুব কষ্ট হয়। শ্রাবণ উঠে ইর্তেজার দিকে গেল। তার সাথে একজন উকিলও আছে। শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আবার আসলে কেন তুমি? বাসায় যাও। আপুর বিয়ে সামনে আর তুমি থানায় চক্কর লাগাচ্ছো বার বার।”
ইর্তেজা এই কথার উত্তর দিলো না। শ্রাবণের দিকে জায়গার কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পুলিশ খোঁজ করে দেখেছে এই জায়গাটা বৈধ। আপনি এটা সাগরিকার নামে করে দিন। উকিল সাথে নিয়ে এসেছি।”
শ্রাবণ কাগজ হাতে নিয়ে চোখ বুলালো। জীবনে প্রথম খোলা চোখে ভালো স্বপ্ন দেখেছিল৷ সেটা পূরণ করতে পারলো না। খুব আফসোস হলো তার। ইর্তেজা শ্রাবণের দিকে কলম এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ সাগরিকার নামে লিখে দিলো জায়গা। দলিলে চোখ বুলিয়ে মুচকি হাসলো। যাকগে, চলে যাওয়ার আগে ভালো কিছু সাগরিকাকে দিয়ে যেতে পারলো। এখন নিশ্চিন্তে দুনিয়া ছাড়তে পারবে সে।

————

সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে ভয় তত বাড়ছে। এখন রাত ১০ টা বাজছে। সকাল ঠিক ১০ টায় শ্রাবণকে ফাঁ*সি দেয়া হবে। হাতে মাত্র ১২ ঘন্টা সময় আছে। মনের কোনো এক কোণায় আশা বাঁধছে শ্রাবণ। হয়তো এই ১২ ঘন্টা ফুরানোর আগে সাগরিকা আসবে। একবার তাকে দেখতে পারবে শ্রাবণ। মন যে চাচ্ছে এই জেল ভেঙ্গে সাগরিকার কাছে চলে যেতে। সাগরিকার পা ধরে বলতে ইচ্ছে করছে আর একটিবার সুযোগ দাও সাগরিকা। ওয়াদা করছি নিরাশ করবো না এবার। শ্রাবণ চোখ খুলল। আজ সারারাত জেগে থেকে অপেক্ষা করবে। সাগরিকার অপেক্ষা। কারণ ১২ ঘন্টার পর তো সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাবে। পারবে না আর প্রিয় মানুষটাকে দেখতে। তার কন্ঠ শুনতে, তাকে ছুঁয়ে দেখতে, তাকে অনুভব করতে। কারাগারের একদম উপরে ছোট্ট একটা জানালা আছে। সেখান থেকে একটুখানি আকাশ দেখা যায়। শ্রাবণ দেখানে তাকিয়ে রইল। আজ হয়তো আকাশে মেঘ জমেছে। যেমনটা তার মনে জমে আছে। শ্রাবণ গান ধরলো। সাগরিকার প্রিয় গান। যেটা সাগরিকা সবসময় শুনতো ও গাইতো,
“শুধু তোকে ঘিরে
শত স্বপ্নের ভিড়ে
এখন আমার বসবাস,
তুই এলে জীবনে
পাবো বাঁচার মানে
পাবো সুখেরই আভাস।

অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার,
অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার,
তাই বলি আয় রে ছুটে আয়।
ঐ উদাসপুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দু’জনায়।

তোর মন পাড়ায়
থাকতে দে আমায়,
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়।
তুই চাইলে বল
আমার সঙ্গে চল,
ঐ উদাসপুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দু’জনা।

গান শেষ হতেই সাগরিকা চোখ খুলে তাকাল। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে কান্নায়৷ আর কত কান্না করলে বুকের কষ্ট শেষ হবে বুঝতে পারছে না। শ্রাবণের শা*স্তির কথা শোনার পর থেকে সে বলতে পারবে না শান্তির নিশ্বাস ফেলেছে একবারো। এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে ঘুমিয়েছে। কি করবে? যাবে শ্রাবণের কাছে? গিয়ে কি বলবে? ‘মাফ করে দিয়েছি তোমাকে। আমার কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া। ফিরে আসো আমার কাছে’। বললেই কি শ্রাবণ আসতে পারবে। শ্রাবণকে দেখলে সে-ই পারবে না তাকে ছাড়া থাকতে।

সকাল ৯ টা,
ইর্তেজা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহাকে নিয়ে আসেনি। ইরিনার সাথে মাহা রয়েছে। সাঈদ এসেছে ইর্তেজার সাথে। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণকে নিয়ে বাহিরে বের হলো দুজন পুলিশ। ইর্তেজা সোজা হয়ে দাঁড়াল। শ্রাবণ ইর্তেজাকে দেখে এদিক সেদিক চোখ বুলালো। আসে নি সাগরিকা। এত পাষাণ তো ছিল না সে। শ্রাবণ তবুও তার মনের অভিমান শেষ করে ফেলল। কেন অভিমান থাকবে তার মনে? ভালোবাসে সে সাগরিকাকে। সাগরিকা তার জায়গায় একদম সঠিক। শ্রাবণ ইর্তেজার দিকে এগিয়ে গেল। ইর্তেজার চোখে অশ্রু জমে আছে। শ্রাবণ ইর্তেজার গালে হাত রাখলেই ইর্তেজা মাথা নিচু করে ফেলল।
“খেয়াল রেখো নিজের।”
ইর্তেজা মুখ শক্ত করে রেখেছে। শ্রাবণ সাঈদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“আমার কোনো বোন নেই। ইর্তেজার বোন আমার বোনের মতোই। আপুর খেয়াল রেখো।”
সাঈদেরও কষ্ট হচ্ছে খুব। শ্রাবণের কথা শুনে মাথা নাড়াল। শ্রাবণ ইর্তেজার নাম ধরে ডাকতেই ইর্তেজা শ্রাবণকে জাপ্টে ধরলো। শ্রাবণ হেসে ইর্তেজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার কথা মনে আসলেই আমার কবর দেখতে চলে যেও। যদি মাসে একবারো আসো আমার ভালো লাগবে।”
ইর্তেজা শ্রাবণকে ছেড়ে নাক টানতে টানতে বলল,
“প্রতিদিন যাব।”
“তাহলে তো নিজেকে সৌভাগ্য মনে হবে আমার।”
শ্রাবণের মুখের হাসি দেখে ইর্তেজার বুক ফেটে যাচ্ছে। পুলিশ এসে শ্রাবণকে বলল তাদের সাথে যেতে। শ্রাবণ মাথা নাড়িয়ে তাদের সাথে চলে গেল। ইর্তেজা তাকিয়ে আছে শ্রাবণের যাওয়ার পথে।

ঘড়িতে ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট। আইনের নিয়ম, সময়ের মতো সবসময় শা*স্তি দেয়া। সাগরিকা থমকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। গালে অশ্রুের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলকে এক নজর দেখে ধীরপায়ে হেটে গেল। হাতে নিয়ে দেখে ইর্তেজার কল। হৃদয়ের স্পন্দন তো অনেক আগে থেকেই বেড়ে আছে। এখন তো শুধু বিস্ফোরণ হওয়ার অপেক্ষা। সাগরিকা কল রিসিভ করে কানে ধরলো। অপরপাশ একদম স্তব্ধ। সাগরিকা সব বুঝে গিয়েছে। ইর্তেজা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“চলে গিয়েছেন উনি।”
সাগরিকা মোবাইল কান থেকে সরিয়ে ধপ করে খাটে বসলো। চোখ ঝাপসা লাগছে। মাথাটাও ঘুরছে খুব। বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে খুব। সাগরিকা বুকের বা পাশে হাত রেখে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল। না, কষ্ট তো বেড়েই চলেছে। সহ্য করতে পারছে না। কি করবে এখন? কিছু বুঝতে না পেরে শ্রাবণের নাম ধরে চিৎকার করে উঠল।

চলবে…….

#আর_একটিবার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৭

ইর্তেজার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। খুব জোরে জোরে দরজায় ঠকঠক করলো। সূর্য সোফায় বসে ছিল মাথা নিচু করে। এত জোরে শব্দ হওয়ায় চমকে উঠল। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেখে ইর্তেজা এসেছে। ইর্তেজা সূর্যকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কোথায় তোমার বোন?”
সূর্য ইর্তেজার পাশে এসে বলল,
“ঘরে”
ইর্তেজা ধীরপায়ে হেটে গেল সাগরিকার ঘরের সামনে। সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল। সাগরিকা খাটের সাথে হেলান থমকে বসে আছে মাটিতে। ইর্তেজা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“মন শান্তি হয়েছে তোমার? সেলিব্রেট করবে না? ম*রে গিয়েছে শ্রাবণ আহমেদ।”
সাগরিকা ধীরে ধীরে চোখ তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজাকে এক নজর দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। ইর্তেজা হাঁটু গেড়ে বসে সাগরিকার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত পাষাণ তুমি? একটা বার দেখতে গেলে না মানুষটাকে। বুকে কষ্ট নিয়ে চলে গেল।”
সাগরিকা চোখ গড়িয়ে পানি পরলো। সে কি জবাব দেবে জানে না। ইর্তেজা আবার বলল,
“কখনো ভালোবাসো নি তাকে? তুমি না বলতে তার প্রতি অনেক মায়া তোমার মনে? তো শেষ মুহূর্তে তোমার সব মায়া শেষ হয়ে গেল?”
সাগরিকা এখনো চুপ করে আছে। তার কাছে কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। ইর্তেজা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“শেষবারের মতো তোমাকে দেখার জন্য ছটফট করছিল সে। তুমি গেলে না তাকে দেখতে। চলেই তো যেত। একবার যেতে। বেশি না একবার। মনে শান্তি নিয়ে ম*রতে পারতো সে।”
সাগরিকা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তার লা*শ কোথায় ইর্তেজা?”
ইর্তেজা ঝাড়ি মেরে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি জেনে কি করবে?”
“দেখবো তাকে”
“জীবিত যখন ছিল তখন তো দেখতে যাও নি। ম*রে গিয়েছে সে। তার দেহ দেখে কি করবে?”
“একবার দেখবো, কাছেও যাব না। দূর থেকে দেখবো শুধু।”
ইর্তেজা সাগরিকার সামনে আবার বসে বলল,
“তোমাকে একবার দেখার জন্য সে যেমন ছটফট করেছে কিন্তু তুমি তাকে দেখা দাও নি। ঠিক তেমনই তুমি সারাজীবন ছটফট করবে কিন্তু তার দেখা পাবে না। তার লা*শ পর্যন্ত দেখতে দেবো না তোমায় আমি।”
বলেই ইর্তেজা উঠে দাঁড়াল। সাগরিকা তাকিয়ে আছে ইর্তেজার দিকে। ইর্তেজা নিজের চোখ মুছে বলল,
“কংগ্র্যাচুলেশনস সাগরিকা কংগ্র্যাচুলেশনস। আজ থেকে তুমি মুক্ত।”
বলেই ইর্তেজা চলে গেল। সাগরিকা বসে আছে চুপচাপ। ব্যাপার না, কিছু কিছু মানুষকে একা-ই জীবন কাটাতে হয়।

———-

জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না। সময়ের সাথে সাথে জীবন এগিয়ে যেতেই থাকে। ইর্তেজার একমাত্র বোনের বিয়ে। শত কষ্টের মাঝেও সে তার বোনের সুখ পালন করবে। শোক পালন করতে পারবে না। মাহা ইরিনার হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে। ইর্তেজা বাহিরে দাঁড়িয়ে ডেকোরেশন দেখছে। পুরো বাড়ি আজ সাজাবে সুন্দর করে। বিয়ে বাড়িতেই হবে। পরে সাঈদ খুব বড়ো করে বৌভাত করবে। দেখতে দেখতে ৮ দিন হয়ে গেল। সময় কিভাবে যে কেটে যায়। ইর্তেজা লোকদের কাজ করতে বলে ভেতরে গেল। এলাকার অনেক ভদ্রমহিলারা এসেছেন ছোটোখাটো করে মেহেদীর অনুষ্ঠান করতে। ইর্তেজা দূর থেকে বোনকে দেখলো। ইরিনার মুখের হাসি তার সব কষ্ট নিমিষেই শেষ করে দিলো। বোনও নিজের বাসায় চলে যাবে ২ দিন পর। ইর্তেজা থাকবে কিভাবে তাকে ছাড়া? ইর্তেজার বুক ভারী হয়ে আসলো। লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। হাসিমুখে এগিয়ে গেল। ইরিনা মাথা তুলে ইর্তেজাকে দেখে বলল,
“কোথায় ছিলি তুই? অনেকক্ষণ ধরে তোকে খুঁজছি।”
“বাহিরের কাজ সামলাচ্ছিলাম।”
ইর্তেজা ইরিনার পাশে বসে আবার বলল,
“কিছু বলবে?”
“হুম, মাহা মেহেদী পড়বে না। এখন তুই তাকে বুঝা।”
ইর্তেজা ভ্রু কুঁচকে মাহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেহেদী পড়বি না মানে? আপুর বিয়ে, সবাই মেহেদী পড়বে তুই পড়বি না?”
মাহা ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলল,
“তুই জানিস না মেহেদী পড়লে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?”
ইরিনা থতমত খেয়ে বলল,
“এটা আবার কেমন লজিক?”
ইর্তেজা ফিক করে হেসে বলল,
“এই মেয়ে পাগল। ওর কথা সিরিয়াস নিও না। যখন রোকসানা আন্টির মেহেদী হয়েছিল তখনও আমাকে বলেছিল যে তার মেহেদী পড়লে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে।”
ইরিনা হেসে উঠল। মাহা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুই যা তো এখান থেকে। আপুকে হাসাচ্ছিস, মেহেদী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তো।”
ইর্তেজা হাতজোড় করে বলল,
“মাফ চাই জান আমার। তুই মেহেদী পড়া আমি বাহিরে গিয়ে দেখি লাইট লাগানো হয়েছে কি-না।”
মাহা মাথা নাড়াল। ইর্তেজা উঠে বাহিরে গেল। বাহিরে গিয়ে দেখে সূর্য এগিয়ে আসছে। ইর্তেজা হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে দাঁড়াল। সূর্য ইর্তেজাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, তুমি এখানে কি করছো?”
“আপনি তো দাওয়াত দেন নি। তাই আমারই জোর করে আসতে হলো।”
“আসার কারণ?”
“ভাইয়া প্লিজ, আপনি জানেন আমি ইরিনা আপুকে কতটা ভালোবাসি। উনার বিয়েতে আমরা আসবো না?”
“আমরা বলতে?”
“ভাইয়া মাফ করে দিন আমাদের।”
“তোমরা তাকে মাফ করেছিলে?”
“সে ভুল করেনি যে আমরা মাফ করে দেবো। সে পাপ করেছে। আর পাপের শা*স্তিও পেয়েছে।”
ইর্তেজা তালিচ্ছ্যের হাসি দিয়ে বলল,
“একবার মাফ করে দিতে তাকে। খুশি খুশি সব ছেড়ে যেতে পারতো। কিন্তু না, তোমরা তাকে সেদিনই মে*রেছিলে যেদিন সাগরিকা বিয়ের আংটি খুলে তার হাতে দিয়েছিল।”
সূর্য মাথা নিচু করে ফেলল। ইর্তেজা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি তোমাদের মাফ করতে পারবো না সূর্য। কখনো পারবো না। কিন্তু আমার বোনের সুখের অংশ হতেও থামাবো না।”
সূর্য ইর্তেজার দিকে তাকিয়ে মুখে বড়ো হাসি ফুটালো। ইর্তেজা আবার বলল,
“আমি একা পারবো না। সাহায্য করো আমার কাজে।”
“জি করছি”
.
.
মুগ্ধ নয়নে ইরিনা মেহেদীর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক লাল হয়েছে মেহেদী। শুনেছে বিয়ের মেহেদী অনেক লাল হওয়া মানে স্বামী অনেক ভালোবাসবে। ইরিনার লজ্জা লাগলো। সাঈদ সত্যিই তাকে খুব ভালোবাসে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনছে ইরিনা। তার বিয়ে, তাও তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে। সত্যিই কি এত সুখ লিখা ছিল তার কপালে তাই এত কষ্ট সহ্য করেছে জীবনে। আজ মা বাবা থাকলে কতোই না ভালো হতো। ইরিনার কান্না পেলো। জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে উঠল। মাহা গোসল করে বেরিয়ে দেখে ইরিনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। মাহা ধীরপায়ে হেটে ঘর থেকে বের হলো। ইর্তেজা কাজ কর্মে ব্যস্ত ছিল বলে কিছুই খেতে পারে নি। ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে সে। মাহা এসে তার পাশে বসে বলল,
“আপুর মন খারাপ। অনেক কান্না করছে।”
ইর্তেজা খাওয়া থামিয়ে বলল,
“বলো কি? দেখে আসি।”
বলেই ইর্তেজা উঠে দাঁড়াল। মাহা খোপ করে তার হাত ধরে আবার বসিয়ে বলল,
“তুমি আগে খেয়ে নাও। না খেয়েদেয়ে সব কাজ সামলিয়েছো। আপু কিছুক্ষণ একা সময় কাটিয়ে মন হালকা করুক।”
“কিন্তু…”
“চুপ, খেয়ে নাও ইর্তেজা। নিজেকে দেখেছো একবার আয়নায়। আগের থেকেও কত শুকিয়ে গিয়েছো।”
“তাহলে তো তোমার লটারি লেগে গেল। আবারো আমায় শুটকি, শুকনা মরিচ, লম্বা বাঁশ। আর কত কিছু ডাকতে পারবে।”
মাহা হাসলো। সাথে ইর্তেজাও হাসলো। মাহা ইর্তেজার শার্টের কলার ঠিক করে বলল,
“হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। ইচ্ছে করে চুপচাপ তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। আর তুমি হাসতে থাকো।”
ইর্তেজা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এ্যা? কি? নিজেকে ফিল্মের নায়িকা মনে হচ্ছে আমার। কেও আমার হাসির প্রশংসা করছে। বাহ বাহ বাহ।”
মাহা শব্দ করে হেসে উঠল। ইর্তেজা মাহার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে মাহার হাত ধরলো। মাহা হাসি থামিয়ে বলল,
“মাত্র গোসল করে আসলাম আর তুমি ঝুটা হাত দিয়ে আমাকে ধরলে?”
ইর্তেজা মাহাকে আস্তে করে টেনে কাছে নিলো। মাহা দু’বার চোখের পলক ফেলল। হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছে তার। ইর্তেজা ধীরে ধীরে মাহার দিকে এগিয়ে গেল। মাহার লজ্জা লাগছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। ইর্তেজা বাম হাত দিয়ে মাহার গালে আস্তে করে থাপ্পড় মে*রে বলল,
“লুচ্চি মেয়ে কোথাকার। এসব ঘুরে তোর মাথায়?”
মাহা চোখ খুলে হা হয়ে গেল। ইর্তেজা দাঁড়িয়ে বলল,
“তোওবা তোওবা, আমি বাবা ভদ্র মানু্ষ। বিয়ের আগে কিসমিস করতে পারবো না। কন্ট্রোল মাহা কন্ট্রোল।”
“তবে রে ইর্তেজা..”
ইর্তেজা দৌড়ে পালালো। তার পেছনে মাহাও দৌড়ে গেল।
.
.
আজ ইর্তেজার ভীষণ মন খারাপ। বোন চলে যাবে আজ। কিভাবে থাকবে তাকে ছাড়া? কলিজা ফেটে কান্না আসছে তার। নিজেকে সামলে মেহমানদের খেয়াল রাখছে ইর্তেজা। সূর্য সকাল থেকে তার সাহায্য করছে। ইর্তেজা ভাবলো যার কারণে রাগ করে থাকবে সে-ই তো নেই এখন আর রাগ করে লাভ কি। বাড়ি ভরা আজ মানুষ। ফরজ কাজে বাঁধা খুব কম আসে। আল্লাহর রহমতে ইর্তেজার বাড়িতেই সব মেহমানদের জায়গা হয়ে গিয়েছে। সবাই খাবার দাবারের বেশ প্রশংসা করছে। ইর্তেজা হাসিমুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেহমানদের ওয়েলকাম করছে। হঠাৎ তার হাসি উড়ে গেল। সাগরিকা এগিয়ে আসছে। হালকা গোলাপি রং এর জামা পড়ে আছে। কোনো সাজগোছ নেই। সূর্যের মুখে শুনেছে ইর্তেজা। সাগরিকা এখন শুধু হালকা রং এর জামা পড়ে। সাজগোছ একদমই ছুঁয়ে দেখে না। অথচ এই সেই মেয়ে যে সাজগোছ ছাড়া একদমই থাকতে পারতো না। ইর্তেজার মায়া হলো। কিন্তু প্রকাশ করলে চলবে না। সাগরিকা ইর্তেজাকে দেখে সালাম দিলো। ইর্তেজা সালামের উত্তর নিয়ে ভেতরে যেতে বলল। সাগরিকা বলল,
“মন থেকে পারমিশন দিচ্ছো?”
“এখন এসব কথা সাইডে রাখা যাক? আজ আমার বোনের জীবনে বিশেষ দিন। আমি সব ভুলে থাকতে চাই আজ।”
সাগরিকা মুচকি হাসলো ইর্তেজার কথা শুনে।ইর্তেজা তাকে ভেতরে যেতে বলল। সাগরিকা এগিয়ে গেল ভেতরে। অনেকেই জানে শ্রাবণের সম্পর্কে। সাগরিকাকে দেখে অনেকে কানাকানি করছে। সাগরিকা সেদিকে মনোযোগ দিলো না। সে সহ্য করা শিখে গিয়েছে। সাগরিকা ইরিনার ঘরে গেল। ইরিনা বউ সেজে খাটে বসে আছে। সাগরিকার মনে পড়ে গেল তার বিয়ের দিন। কোনো সাজ ছাড়াই তার বিয়ে হয়েছিল। দরজার সামনে সাগরিকাকে দেখে মাহা এগিয়ে আসলো। সাগরিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ফাইনালি আমার ছোট্ট বান্ধবী এসেছে।”
সাগরিকা মুচকি হাসলো। মাহা সাগরিকাকে ছেড়ে গালে হাত রেখে বলল,
“তোমাকে তো পুতুলের মতো দেখাচ্ছে একদম।”
সাগরিকা জবাবে কিছু বলল না। সে জানে মাহা তাকে খুশি রাখার জন্য এসব বলছে। সে জানে, এই পরিবারই একমাত্র তাকে মানসিক অশান্তি থেকে দূর রাখতে পারবে। মাহা সাগরিকার হাত ধরে নিয়ে গেল ইরিনার কাছে। সাগরিকাকে খাটে বসাতেই সাগরিকা সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বলল,
“না থাক, আমি আপুর থেকে দূর থাকি।”
মাহা আর ইরিনার হাসি উড়ে গেল। অবাক হয়ে একে অপরকে দেখে আবার সাগরিকার দিকে তাকাল। ইরিনা বলল,
“কেন জানতে পারি?”
“ওখানে এক আন্টি বলছিল যে বিধবা মানুষের ছায়াটাও খুব অশুভ হয়। আই থিংক আমার বাসায় চলে যাওয়া দরকার।”
ইরিনা বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমার বাড়িতে এসে কার দুঃসাহস হলো এত বাজে কথা বলার?”
মাহা সাগরিকার হাত ধরে বলল,
“এগুলো বিশ্বাস করাও গুনাহ, বুঝলে?”
“আসলে, আমার স্বামীর মৃ*ত্যুর ৪০ দিনও হয়নি আর আমি বিয়ে এটেন্ট করতে এসে পরলাম। আসলে আমার ভালো লাগছিল না একা বাসায়। সূর্যও সকাল থেকে এখানে। তাকে কল দেয়ায় সে বলল এখানে এসে পরতে।”
ইরিনা সাগরিকার হাত ধরে নিজের পাশে বসালো। আলতো করে সাগরিকার গালে হাত রেখে বলল,
“তুমি যেমন আমাদের আপন ভাবো আমরাও তোমাকে আপন ভাবি। নিজেকে কখনো একা ভাববে না সাগরিকা। আমরা সবসময় তোমার পাশে আছি।”
সাগরিকার চোখের কোণায় পানি জমে গেল। ইরিনা তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। মাহাও পাশে বসে দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। সাগরিকার শান্তি অনুভব হচ্ছে। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল এতদিন। এখন তার মনে হচ্ছে সে একা না এই দুনিয়ায়। তার কাছের মানুষ বলতেও অনেকে আছে।

ইরিনার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। সবাই অপেক্ষা করছে তার কবুল শোনার জন্য। সাঈদের বুক কাঁপছে। কবুল বলছে না কেন মেয়েটা? শেষ মুহূর্তে তাকে রিজেক্ট করার প্ল্যান করছে না তো? ইরিনা চোখ তুলে ইর্তেজার দিকে তাকাল। ইর্তেজা মুচকি হাসলো বোনের চাহনি দেখে। ইরিনার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মাথা নিচু করে তিনবার কবুল বলল। সাঈদের কাঁদছে ইচ্ছে করছে। অবশেষে ইরিনাকে পেলো সে। তাকে জিজ্ঞেস করতে সে সাথে সাথে কবুল বলে দিলো। এই দেখে ঝর্ণা বলল,
“যেই গতিতে কবুল কইলেন ওই গতিতে পোপুজ করলে আরো আগে বিয়াডা হইয়া যাইতো।”
সবাই হাসলো ঝর্ণার কথা শুনে। সূর্য ঝর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এটাকে প্রপোজ বলে পোপুজ না।”
ঝর্ণা ভেংচি কাটলো সূর্যের কথা শুনে। সূর্য হাসলো তার কান্ড দেখে।

ইর্তেজা ইরিনার সামনে আসছে না। বোনের চোখে চোখ পরলেই তার কান্না আসে। বিদায়ের সময় কাছে আসবে না ভেবেছে। কিন্তু তাকে না দেখে ইরিনা কখনো যাবে না সে জানে। সূর্য ইর্তেজাকে খুঁজতে খুঁজতে বাহিরে আসলো। ইর্তেজা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য দৌড়ে তার পাশে এসে বলল,
“আপনি এখানে? সবাই আপনাকে ভেতরে খুঁজছে।”
“বিদায়ের সময় হয়ে গিয়েছে?”
সূর্য জবাব দিলো না। ইর্তেজা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সাগরিকাকে ছাড়া তুমি কিভাবে থাকতে সূর্য?”
“খুব কষ্টে।”
“খুব ভালোবাসো বোনকে?”
“খুব, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন না যে কেন আমি শ্রাবণকে এত ঘৃণা করি? কারণ সে আমার বোনকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। জানেন, নেশা করে বাড়ি ফিরে আমার বোনের উপর অত্যাচার করতো। কারণ আপু তাকে মন থেকে মেনে নিচ্ছিল না। আমার বোন চুপি চুপি আমার সাথে দেখা করতে আসতো। আমাকে লজ্জায় কিছু বলতো না। কিন্তু আমি তাকে দেখেই বুঝতে পারতাম তার মনের অবস্থা। সে শ্রাবণের সাথে দেখা করতে যায়নি বলে আপনি ওর উপর রাগ। অথচ এটা ভাবছেন না সে কত সহ্য করেছিল আগে। ভালোবাসি আমি আমার বোনকে খুব৷ সেই অমানুষটা আজ বেঁচে নেই। অথচ আপু কষ্টের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। বলে বুঝাতে পারবো না আমি কেমন অনুভব করি তাকে এই অবস্থায় দেখে।”
ইর্তেজার অপরাধ বোধ হলো। সূর্য ঠিক বলছে। তার সামনেও তো শ্রাবণ বহুবার সাগরিকার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। শ্রাবণ ভালো হয়ে গিয়েছিল বলে ইর্তেজার মনে তার প্রতি সম্মান মায়া খুব বেশি। কিন্তু এটা তো ভাবেই নি শ্রাবণ এক সময় হিংস্র পশু থেকে কম ছিল না। সূর্য বলল,
“আচ্ছা এসব ছাড়ুন, চলুন আপনাকে ভেতরে ডাকছে।”
ইর্তেজা মাথা নাড়িয়ে সূর্যের সাথে বেতরে গেল। সবাই তার অপেক্ষায় ছিল। সাঈদ দাঁড়িয়ে কাজী সাহেবকে বলল,
“নেন কাজী সাহেব, বর এসে পরেছে। এবার দ্রুত দ্বিতীয় বিয়েটা সম্পূর্ণ করুন।”
ইর্তেজা চমকে উঠল সাঈদের কথা শুনে। অবাক হয়ে ইরিনার দিকে তাকাল। ইরিনা হেসে বলল,
“বেচারা ভাই আমার। চোখ বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।”
“দ্বিতীয় বিয়ে মানে?”
সাঈদ বলল,
“আমি বলছি, ইরিনার বিদায় আজ। পুরো বাড়িতে তুই আর মাহা একা থাকবি। আমরা তোদের উপর বিশ্বাস করি। কিন্তু এলাকার লোক? এখনই বাজে বাজে কথা ছড়ায় তখন তো আরো ছড়াবে। তাই আমি আর তোর বোন মিলে প্ল্যান করেছি তোর আর মাহার সারপ্রাইজ ওয়েডিং করাবো।”
“কিন্তু… ”
ইরিনা তাকে থামিয়ে বলল,
“কোনো কিন্তু না, আজ তোর আর মাহারও বিয়ে। ব্যস আমি আর কিছু বলতে শুনতে চাই না।”

অবশেষে মাহা আর ইর্তেজার বিয়েটাও সম্পূর্ণ হয়ে গেল। ইর্তেজার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে মাহার দিকে তাকাল। মাহা আজ থেকে তার বউ। হ্যাঁ, মাহা তার বউ। ইর্তেজার খুশিতে কি করতে মন চাচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না।

বিদায়ের মুহূর্ত আসলো। ইর্তেজার সুখ আবার দুঃখে পরিনত হলো। একপাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। ইরিনা তার দিকে হেটে এসে বলল,
“নিজের ও মাহার খুব খুব খুব খেয়াল রাখবি বুঝলি?”
ইর্তেজা মাথা নিচু রেখেই মাথা নাড়াল। ইরিনা জাপ্টে ধরলো ভাইকে। ইর্তেজাও জড়িয়ে ধরলো বোনকে। দুই ভাই বোন নিঃশব্দে কাঁদছে। সবার চোখে পানি এসে পরলো এই দৃশ্য দেখে। ইর্তেজা ইরিনাকে ছেড়ে সাঈদকে বলল,
“আমার বোনের সব দায়িত্ব এখন থেকে তোর। কিন্তু একজন ভাইয়ের দায়িত্ব আমি পালন করে যাব সবসময়। আর আমার বোন যদি একটু কষ্ট পায়…”
“বুঝেছি বুঝেছি, ওয়াদা করছি কষ্ট ইরিনাকে ছুঁয়েও দেখতে পারবে না।”
“তুই তোর ওয়াদা কখনো ভুলবি না জানি। কারণ তুই জানিস তোর স্ত্রীর ভাই কে।”
সাঈদ ঢোক গিলল। ইর্তেজাকে সে আগে থেকেই ভয় পায়। এখন তো আরো ভয় লাগছে তার।

সব মেহমান চলে গেল। শুধু সাগরিকা আর সূর্য আছে। সাগরিকা মাহার সাথে ঘরে। সূর্য আর ইর্তেজা বাহিরে বসে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর সাগরিকা আসলো।
“সূর্য, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চল বাসায় যেতে হবে আমাদের।”
ইর্তেজা বলল,
“রাত গভীর। বাড়িতে আরো ঘর আছে। আজ তোমরা থেকে যাও।”
“আমরা যেতে পারবো ইর্তেজা।”
ইর্তেজা দাঁড়িয়ে বলল,
“সেটা জানি, কিন্তু আজ চিন্তা হবে।”
সূর্য বলল,
“আমরা পৌঁছে আপনাকে কল দেবো। আর বাসা তো বেশি দূর না। রিকশা নিয়ে আসি। ৫ মিনিটে পৌঁছে যাব।”
বলেই সূর্য বাহিরে চলে গেল। সাগরিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইর্তেজা হঠাৎ বলল,
“এতদিন খুব বাজে ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। ক্ষমা করে দিও।”
সাগরিকা হেসে বলল,
“মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোমার আর শ্রাবণের মাঝে থার্ড পারসন হয়ে এসেছিলাম। এত ভালোবাসা কেন তোমাদের মধ্যে?”
ইর্তেজা হেসে বলল,
“আমি তাকে ভাইয়ের মতো সম্মান করি।”
“আমি মুগ্ধ হলাম ইর্তেজা।”
“আজ থেকে যাও সাগরিকা। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”
“কিছু হবে না ইর্তেজা। আর তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো? আজ তোমার আর মাহার বিয়ে হয়েছে। তোমাদের গুরত্বপূর্ণ সময় এটা। আমাদের কাবাবে হাড্ডি ভেবে না তাড়িয়ে বলছো থেকে যেতে। পাগল কোথাকার।”
ইর্তেজা নিঃশব্দে হেসে বলল,
“একজন যাওয়ার আগে আমার থেকে ওয়াদা নিয়েছে আমি যেন তার আমানতের খেয়াল রাখি। তার সব বিপদে যেন তার পাশে থাকি। আর আমি একজন বন্ধু হিসেবে সবসময় তার আমানতের পাশে থাকবো।”
সাগরিকা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে মুচকি হাসলো। কিছু বলল না সে। সূর্য এসে বলল রিকশা পেয়েছে। তারা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।

ইর্তেজা দরজা বন্ধ করে দিলো। রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাস চেক করলো ঠিক আছে কি-না। বাড়ির সব জানালা বন্ধ করে নিজের ঘরে আসলো। মাহা হেলান দিয়ে বসে ছিল। ইর্তেজাকে দেখে সোজা হয়ে বসলো। ইর্তেজা দরজা বন্ধ করে এসে মাহার পাশে বসলো। মাহার লজ্জা করছে। ইর্তেজা আফসোসের গলায় বলল,
“বিয়ের রাতে স্ত্রীকে উপহার দিতে হয়। যদি জানতাম বিয়ে হবে তাহলে তোমার জন্য কিছু কিনে রাখতাম।”
“আমার কিছুই লাগবে না। তোমাকে পেয়েছি এটাই আমার জন্য অনেক।”
ইর্তেজা হাসলো। মাহা তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইর্তেজা মাহার হাত ধরে বলল,
“আমার সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন ছিল তোমাকে বিয়ে করা। অবশেষে পূরণ হলো আমার স্বপ্ন।”
“বলেছিলাম না, মাহা ইর্তেজার না তো কারো না।”
ইর্তেজা মাহার কথা শুনে মাহাকে টেনে কাছে নিয়ে আসলো। মাহা অপ্রস্তুত হলো। ইর্তেজার চাহনি আজ অন্যরকম। মাহা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইর্তেজা মাহার থুতনি ধরে উঁচু করে এগিয়ে গেল। আলতো করে মাহার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই মোবাইল বেজে উঠল। দুজনই চমকে উঠল। মাহা লজ্জায় সরে বসলো। ইর্তেজা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সূর্য কল করেছে। কথা বলে জানতে পারলো তারা বাসায় পৌঁছে গিয়েছে। ইর্তেজা নিশ্চিন্ত হলো। মোবাইল রেখে মাহার দিকে তাকাল। মাহা বলল,
“মন বলছে আবার কেও কল দিয়ে ডিস্টার্ব করবে। ভালো আইডিয়া দেই। মোবাইল অফ করে দে।”
“দে? তুই করে বলছো তুমি আমাকে?”
“হ্যাঁ তো?”
ইর্তেজা মাহার হাত ধরে টেনে বলল,
“স্বামীর সাথে বেয়াদবি? এর শা*স্তি পাবে তুমি, আমার বেগম।”
“ইর্তেজা আমি চিৎকার করে মানুষ ডাকবো কিন্তু।”
ইর্তেজা শব্দ করে হাসলো। মাহা মায়া মায়া চেহারা বানিয়ে বলল,
“আর বেয়াদবি করবো না। আপনাকে অনেক অনেক সম্মান করবো। মাফ করে দিন।”
ইর্তেজা বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল,
“হায়য়য়, আপনি ডাকটা এখানে গিয়ে লাগলো।”
“ড্রামা কিং”
মাহা ভেংচি কাটলো। ইর্তেজা হেসে মাহার গাল ধরে টেনে বুকের মাঝে ভরে নিলো।
.
.
বেসিনের আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে সাগরিকা। আজকাল নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না। নিজেকে মৃ*ত মনে হয় তার। নিশ্বাস তো চলছে কিন্তু জীবনযাপন করতে পারছে না। মনের ভেতর অশান্তি লেগে থাকে ২৪ ঘন্টা। অতীত মনে পরলেই ইচ্ছে করে নিজেকে শেষ করে দিতে। ম*রে কি সব সমস্যা সমাধান হবে? তার তো বাঁচতে হবে। সূর্যের জন্য বাঁচতে হবে। সাগরিকা বাথরুম থেকে বের হলো। বাহির থেকে বজ্রপাতের শব্দ আসছে। সাগরিকা জানালার পাশে গেল। বাতাস বইছে চারপাশে। আকাশে ঘন কালো মেঘ। জানালা সব খুলে দিলো। দম বন্ধ হয়ে যায় তার। আশে পাশে চোখ বুলালো। কেমন নিরবতায় ঢেকে আছে চারপাশ। হঠাৎ বলে উঠল,
“কেও নেই? কেও নেই যে আমার সাথে.. আমার সাথে কথা বলবে। অস্থির লাগছে আমার। আমার..আমার ভালো লাগছে না কিছু।”
সাগরিকা হেটে এসে খাটে বসলো। চোখে অশ্রু জমে আছে তার। ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। খাটের সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে পরলো। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইল। পুরো শরীর কাঁপছে তার। চোখ গড়িয়ে পানি পরছে বার বার। সাগরিকা মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত আড়াইটা বাজে। গলায় কান্না আটকে যাচ্ছে তার। উঁচু স্বরে বলল,
“সময়.. সময় এত ধীরে কেন কাটে? দ্রুত.. দ্রুত সকাল হয় না কেন? আমি..আমি কি এতোই খারাপ? সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। যাকে আপন মনে হয় সেই একা করে দেয় আমায়। আমি তো কারোর ক্ষতি করি নি। তাহলে..তাহলে আমি কেন শা*স্তি পাচ্ছি?”
সাগরিকার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। ইদানীং একা একা কথা বলে। মনের কষ্ট কারোর সাথে শেয়ার করতে পারে না। কাকে বলবে? সবাই শুধু শান্তনা দেবে। যেটা সাগরিকা চায় না। আবার আকাশ গর্জে উঠল। চমকে উঠল সাগরিকা। কানের পেছনে চুল গুঁজে এদিক সেদিক দেখলো। বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল। খুব জোরে বৃষ্টি পরছে। বার বার আকাশ গর্জে উঠছে। সাগরিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে বলল,
“ইয়াহ আল্লাহ, আমাকে শান্তি দিন। নাহলে মৃ*ত্যু ভাগ্যে লিখে দিন।”

চলবে……..