আসক্তি পর্ব-২৪

0
1523

#আসক্তি
পর্বঃ২৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সিদ্ধান্ত হয় পাখিদের গ্রাম ঘোরার।এরপর বাড়ি চলে আসার। সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাখি সকলকে ওদের গ্রাম ঘোরাতে নিয়ে যায়।গ্রামের ছোটবড় সবাই ওদের সাথে কথা বলছে।কয়েকজন মেয়ে শানের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে।ব্যপার টা পাখির নজর এড়াচ্ছে না।সবাইকে পাশ কাটিয়ে সে শানের কাছে চলে আসে।ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে পাখি মুখে কিছু বলছে না।

শান একটু এগিয়ে যাওয়ার পর দাঁতে দাঁত চেপে পাখি ধমক দেয়,”লজ্জা করে না ওমন করে অন্যের বরের দিক দেখিস?জীবনেও ছেলে মানুষ দেখিস নাই?”
মেয়েগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সবার মধ্যে থেকে একজন বলে,”তোর বর কিন্তু অনেক সুন্দর রে আপু।আল্লাহ্, কি চোখ,খাড়া একটা নাক।চুলগুলো বেশি সুন্দর।আর ঠোঁট জোড়া তো…….”
“থাম থাম থাম,তোর সরম নাই এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলে মানুষ দেখিস!আর উনি সম্পর্কে তোদের দুলাভাই মাথায় ঢুকিয়ে নে কথা টা”-পাখি মেয়েটাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কপোট রাগে জবাব দেয়।
আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় সে।সামন থেকে শানের ডাক পরেছে।
“আসছি”-কথাটা জোড়ে বলে “জান”কথাটা আস্তে বলে মেয়েগুলোকে শোনানের জন্যে।এরপর ভেঙচি কেঁটে চলে আসে।শানের আবার শ্রবণ শক্তি একটু বেশীই কিনা!ছোট্ট করে বলা কথাটাও শুনে ফেলে।

পাখির মাঝে নিজেকে নিয়ে যে হিংসা এটা শানের অবশ্য মন্দ লাগছে না;ভালোই লাগছে।

সারা বিকেল ঘুরে বাড়ি ফিরে সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রেডি হয়।বেঁকে বসে পাখি।দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চেপে বসে তার।
শানের দিকে আড়চোখে চেয়ে মনে মনে বলে,”আমার সাথে দুষ্টুমির মজা টা বুঝাব এবার।বলেছি না লাটাই আমার হাতে!এবার দেখো মজা কাকে বলে!”

“মা আমি আজ রাতটা থাকব এখানে।কাল তো ভাইয়া রংপুরে যাবে।ওর সাথে আবার যাবো”-নীরব শুনশান পরিবেশে পাখির হঠাৎ এমন গলা উুঁচিয়ে বলা কথাটায় সবার নজর পাখির উপর পরে।চোখের মনি এদিক ওদিক সবার দিকে ঘুরিয়ে পাখি আবার বলে,”কি?”
পাখির মা বলেন,”থাকতে চাইছিস থাকবি সমস্যা কি! ”
পাখির মায়ের কথায় শানের মা নিজের ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকান।তিনি ভালো করেই জানেন তার ছেলে পাখিকে কতোটা ভালোবাসে।
“বেয়াইন আজকে না, শানের বন্ধুরা কাল দুপুরে খাবে আমাদের ওখানে।পরে কোন একসময়…..”
“প্লিজ মা থাকি না।আমি দুপুরের আগেই ঐবাড়ি পৌঁছাব”-পাখির অনুনয়ে কথায় ছেঁদ পরে শর্মিলা বেগমের।এর মাঝে একবারও শান কোন কথা বলে নি।
পাখির চোখে চোখ পড়তেই শান ওকে ইশারায় ঘরে যেতে বলে।পাখি দেখেও না দেখার ভান করে। এরপর শানের নজর পরে ওর হাতের ফোনের দিকে।চট করে একটা টেক্সট করে ঘরে আসার জন্যে।মেসেজের টোনে পাখি ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার বলে,”তাহলে ফাইনাল, আমি আজ এখানে থাকব।কাল সকাল ও বাড়ি…..”

পাখির কথা শেষ না হতেই, হাতে টান পরে।হাতের দিকে খেয়াল করে দেখে শান তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।পাখি ভাবতেও পারে নি শান সবার সামনে থেকে তাকে এভাবে নিয়ে আসবে।
ঘরে এনে পাখির হাত ছেড়ে দেয়।নিজের চুল গুলো হাত দিয়ে সেট করতে করতে শান বলে-“কখন থেকে ডাকছি তোমায়।”
শানের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে।পাখি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জবাব দেয়, “আমি তো এমনি”
“এমনি কি হ্যা, এমনি কি?মজা নিচ্ছো আমার সাথে”- রেগে তেড়ে এসে বলে শান।পাখি ভয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেলে।
“চোখ খোলো”-শান্ত ভঙ্গিতে বলে শান
“আপনার চোখ লাল।মাথা ঠান্ডা করেন আগে।তারপর…”
“চোখ খুলতে বলেছি, খুলবা। দ্যাটস ফাইনাল”
পাখি পিটপিট করে চোখ খোলে।
“রেডি হও, বাড়ি যাবো”
“আমি তো নিচে বললাম…”-শানের শক্ত চোয়াল দেখে গলার স্বর নেমে যায় পাখির।আবার মিনমিনে গলায় বলে,”আজ এখানে থাকব”
“কোন থাকা হবে না।আমি যেদিন থাকব সেদিন তুমিও থাকবা”
পাখি আর কিছু বলার সাহস পায় না।মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখে।

“পাখি লিসেন, কাল আমার কাজে আমাকে শাস্তি দেবার জন্যে যদি এরকম ডিসিশন নিয়ে থাকো তো ভুল করছো।কারণ আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না, ড্যাম ইট!নিজ মুখেই বললাম।আর কি শাস্তি দিবা বলো?”-পাখির মুখটাকে আঁজলা ভরে ধরে বলে শান।
পাখি চোখ তুলে তাকায়।শানের চোখে মুখে অসহায়ত্বের স্পষ্ট রেখা প্রজ্বলিত।
পাখির হাবভাব দেখে আবার বলতে শুরু করে,
,”আই প্রমিজ আর কখনো ডার্টি টক বলব না।ওভাবে জ্বালাবো না।তবুও চলো প্লিজ।আমি পারবো না তোমায় এখানে রেখে যেতে।”-শানের দৃষ্টি এবার অবনত।

শানের অসহায় মুখ দেখে পাখির কি যেন হলো দুহাতে জড়িয়ে নিলো শানকে।বুকে মাথা রেখে অস্ফুট স্বরে বিরতিহীন বলতে থাকে,”আই লাভ ইউ।আমিও আপনাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে পারবো না”
নিজের মনে মনে আবার পাখি বলতে শুরু করে,”আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারি নাই আমি কারো প্রতি এতোটাও আসক্ত হয়ে যাবো বা কেউ আমার প্রতি এতোটাও আসক্ত হবে।এতো ভালোবাসা, এতো সুখ কোথায় রাখব আমি!উপচে পরতে পরতে খালি হয়ে যাবে না তো!নাহহ, এই মানুষটাকে ছাড়া আমি আমার জীবনের একটা মূহূর্তও ভাবতে পারবো না,চাইও না।তবে কি একেই বলে “#আসক্তি”!

শান বুঝতে পারে পাখি কাঁদছে।মুখটা তুলে কপালে চুমু এঁকে দেয়।
“আই লাভ ইউ মোর.রেডি হয়ে নিচে চলো।আমি নিচে গেলাম”
“হুমম”-পাখি অস্ফুট স্বরে জবাব দেয়।

🌸🌸
বাড়ি এসে দেখে সামিহা বাড়িতে নেই।সবাই ভাবছে ঈদের সময় হয়ত কোন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে।যে যার যার মতো ঘরে চলে যায়।শান ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে মন দেয়।এটা ওটা কাজে শানের খেয়াল হয় নীরার কথা।

পাখিকে সে নিজের করতে পেরেছে।তা শুধুমাত্র নীরার বদৌলতে।তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়াই উচিত।
কাজগুলো কম্পিলিট করে সন্ধ্যার দিকে নীরার ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রেডি হয় শান।
“কোথাও যাচ্ছেন? “-পাখির কথায় পিছনে ফেরে শান।
এক হাতে পাখির কোমড় জড়িয়ে কাছে নিয়ে আসে।পাখি মুচকি হেসে শানের দুই কাঁধে দুই হাত রাখে।কাঁধে পাখির হাতের দিকে চেয়ে ছোট ছোট চোখে তাকায় শান।
“হুমমম যাচ্ছি তো!”
“কোথায়?”-
পাখির প্রশ্নে শান কিছু বলতে পারে না।গালের উপর পরা চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে ভাবতে থাকে,”তোমার এই আমূল পরিবর্তনটার পিছনে একটা মানুষ উছিলা হিসেবে কাজ করেছে।আমার সাথে তার অতীত ব্যাকগ্রাউন্ড যতো খারাপই হোক।”

“কি হলো, কি ভাবছেন?’-পাখির কথায় শান ভাবনা থেকে বের হয়।নাকের ডগাটা হালকা টেনে জবাব দেয়,”পরে কোন এক সময় বলবো”
“এখন তারাতারি যেতে হবে, আবার তারাতারি আসতে হবে।নইলে আমার ঘুম পাগলি বউ ঘুমিয়ে যাবে।”
“আজ একটা সারপ্রাইজ আছে, ঘুমাইও না।”-শেষের কথাটা কানে ফিসফিসিয়ে বলে শান।

এরপর বেড়িয়ে পরে শান।দোকান থেকে নীরার জন্যে কিছু দামি মিষ্টি আর ফল ফলাদি নিয়ে যায় শান।

নীরার ফ্ল্যাটে এই প্রথম আসা তার।পাঁচ তলার একদম উপরতলার ডান পাশের ফ্ল্যাটটাই নীরার।আর একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নীরার চেম্বার।সেখানে সপ্তাহে ৩ দিন বসে সে।শানের গাড়ি এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়।খোঁজ নিয়ে জানতে পারে নীরা নিজের ফ্ল্যাটেই আছে।ফ্ল্যাটের ঠিকানাও ঐ ডায়গনস্টিক সেন্টারের ছেলেটার কাছ থেকেই জানতে পারে।ঠিকানা অনুযায়ী শান ফল আর মিষ্টি গুলো নিয়ে লিফ্ট বেয়ে উপরে উঠে যায়।শান অনেক খুশি নীরার ট্রিটমেন্টে।
“নীরার জন্যেই আমি আজ এতোটা সুখী।ও যদি চায় অতীতের সবটা ভুলে আমরা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারি। “-ভাবতে ভাবতেই লিফ্ট থেমে যায়।

নীরার ফ্ল্যাট নম্বর দেখে মুচকি হেসে কলিং বেল চাপতে গিয়ে খেয়াল দরজাটা খোলা কিন্তু হালকা ভেড়ানো।
শানের কি করা উচিত,যাবে কি যাবে না। ভাবতে ভাবতেই ইতস্ততভাবে ভিতরে ঢুকে যায়।ড্রয়িং রুমটা একদম ফাঁকা।ফ্ল্যাটে নীরা একাই থাকে।কারণ পুরো পরিবার দিনাজপুরের বাসিন্দা। তারা সেখানেই থাকে।

আশপাশে চোখ বুলিয়েও কাউকে পায় না শান।
“নী….”-নীরার নামে ডাকতেই বাম পাশের ঘরটা থেকে রাগী কন্ঠে কথা বলার শব্দ আসে শানের।কন্ঠটা মেয়েলী।বেশ চেনাচেনা লাগছে।অবস্থা বুঝতেই শান ধীরপায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।
“জানি, এভাবে কারো বাসায় ঢোকা উচিত না।আর এভাবে চুপচাপ কথা শোনা তো একদমই উচিত।বাট আই ভেরি এগারলি ওয়ান্না সি হু’স দেয়ার?”-ভাবতে ভাবতেই শান ঘরটার একদম কাছে চলে আসে।দরজাটা খোলা।দেয়ালের সাথে হালকা ঘেঁষে রুমে তাকাতেই যাকে দেখতে পায় তাকে দেখার জন্যে মোটেও শান প্রস্তুত ছিলো না।চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে শানের।চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে ধীরেধীরে। দুই হাত মুষ্ঠিবদ্ধ বদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে;পারছে না।

দরজা ঠেলে ভিতরে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই নীরার বলা কথায় থমকে যায় শান।নিজের রাগ পুরোদমে নিয়ন্ত্রন করে তাদের সব কথা শোনার জন্যে।

চলবে…