আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-২৩

0
3613

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_23
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটি বিছানায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। মাথাটা ভার হয়েছিল। বুঝে উঠতে পারলাম না আমি এইখানে কিভাবে আসলাম। আর আমি এইভাবে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বা কেন? নিজের মস্তিষ্কে জোড় দিতে লাগলাম আগের ঘটনাগুলো মনে করার জন্য। ধীরে ধীরে দুপুরের ঘটনা গুলো ক্রমাগত মনে পড়তে থাকলো। অতঃপর সব মনে পড়তেই আমার আর বুঝতে দেরি নেই যে কে বা কারা আমায় কিডন্যাপ করেছে। সাথে সাথে আমায় কোন এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরে। এইটা ঠিক কিসের ভয় তা আমার জানা নেই। আমি নিজেকে কিছুটা শান্ত রেখে উঠে বসার চেষ্টা করি। কিন্তু হাত পা বেঁধে থাকার কারণে পারি না। আমি শুয়ে থাকা অবস্থায় চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকি। পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে সোডিয়াম লাইটের হাল্কা আলো আসছে যার কারণে রুমটি আবছা ভাবে পরিষ্কার হয়ে এসেছে। রুমে বিশেষ কোন আসবাবপত্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। মাথায় শুধু এখন এইটাই ঘুরছে পরবর্তীতে কি হতে চলেছে? কি করবা ওরা আমার সাথে? মেরে ফেলবে? নাকি এর চেয়েও বাজে কিছু করবে? আচ্ছা আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয় তাহলে কি কেউ আমার লাশটা পাবে? শেষ দেখা পাবে? ভাবতেই মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে। আমার এমন হারিয়ে যাওয়া কি বাবা-মা মেনে নিতে পারবে? রিয়ানই বা পারবে কি? আচ্ছা রিয়ানকে তো কখনো বলা হয় নি আমার অনুভূতির কথা। সে কি বুঝেছিল আমার অনুভূতি গুলো? সব ভাবতেই কষ্টে বুকটা ভারি হয়ে আসছে। নয়ন দুইটির কার্নিশে নোনা জল এসে ভীর জমতে শুরু করে।

হঠাৎ মনে পড়ে সেইদিন দিনের কথা। যেদিন আমি না চাইতেও এইসবের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। যার জন্য আজ আমার পরিনতি এমন। চোখের সামনে ভাসতে থাকে প্রায় ২ বছর আগের স্মৃতিটি।

_____________________________________

প্রায় ২ বছর আগে,

তখন সবে মাত্র আমার ইন্টারের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এতদিন পড়ার চাপে থাকার কারণে মাথা একদম হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। তাই মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। ঘুরতে যাওয়া মানে ওই রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা দেওয়া আরকি। তো সকলের সাথে আড্ডা দিতে দিতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে আসে। অতঃপর যে যার মত রওনা দেই বাসার উদ্দেশ্যে। আমার বাসা রেস্টুরেন্টটা থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বে ছিল বলে আমি হেটেই বাসার দিকে রওনা দিয়েছিলাম। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার কারণে রাস্তায় প্রায় প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছিল। রাস্তার দুইধার দিয়ে ঘন জঙ্গলের মত গাছগাছালি গিচ গিচ করছি। অরণ্য ও আমার মাঝে এক কঠিন নিস্তব্ধতা কাজ করছিল। বিভিন্ন রাত্রি পোকার ডাক কানে আসছিল। এইখান থেকে আর ৫ মিনিটের রাস্তা পেরুলেই জনবসতি শুরু। আমি দ্রুত পায়ে হাটছি। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামে আমার সামনে। কিছু বুঝার আগেই তারা আমায় টেনে তাদের গাড়ির মধ্যে তুলে নেয়। আমি হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করতেই তারা আমার নাকে ক্লোরোফর্মযুক্ত রুমাল ছেপে ধরে। এরপরে আমার আর কিছুই মনে ছিল না।

যখন নিজের জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে কোন এক মালামাল নেওয়া জাহাজের মালামাল রাখার অংশে আবিষ্কার করি। মাথা পুরো ভার হয়েছিল। হয়তো তখনও ক্লোরোফর্মের রেশ কাটে নি। সামনেই তাকাতে দেখি কিছু মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে কি যেন বলছে। তাদের দেখার সাথে সাথে আমি পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেলি। যাতে তারা বুঝতে না পারে আমার জ্ঞান ফিরেছে। শান্ত হয়ে তাদের কথা শুনার চেষ্টা করি। অতঃপর তাদের কথা শুনে যা বুঝতে পারি এদের শত্রুতা আমার বাবার সাথে। তারা পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে অসৎ পথে তাদের মালামাল বাইরে পাঠাতে নিয়েছিল। আর বাবা তা ধরে ফেলে। এবং মালামাল সহ তাদের সকল কাগজপত্র পুলিশকে দিয়ে দেন। যার জন্য তাদের কোটি কোটি লস হয়ে যায়। আর সেই জন্যই তারা বাবার উপর ক্ষেপে আছে। হয়তো প্রতিশোধ নিতেই আমাকে তুলে আনা হয়েছে।

তাদের কথা শুনে আমার ভয় করার কথা হলেও আমার কেন জানি গর্ব হচ্ছিল বাবার উপর। আমার বাবা যে সৎ তা এতদিন শুনে এসেছিলাম কিন্তু আজ আমি তার প্রমাণও পেলাম। বাবা সবসময় তার জাহাজ দ্বারা যে যে মালামাল দেশের বাইরে যায় তার আগে বাবা নিজ থেকেই সবকিছুর যাচাই বাচাই করেন। এমনকি কাগজপত্রও। যদি এর মাঝে তার চোখে কোন ধরনের ঘাপলা পরে তাহলে সেই মালামাল আর তিনি দেশের বাইরে পাঠান না৷ যতক্ষণ না কাগজগুলো ক্লিয়ার হচ্ছে ততোক্ষণ সেই মাল দেশের বাইরে যেতে পারে না। যদি ঝামেলা বেশি মনে হয় তাহলে বাবা মালামালসহ সকল কাগজপত্র পুলিশের কাছে দিয়ে দেন। এদের বেলায়ও হয়তো তাই হয়েছে।

সেই লোকেরা তাদের মধ্যে কথা শেষ করে আমার দিকে তাকায়। আমাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে মনে করে আমার জ্ঞান এখনো ফিরে নেই। তাই তারা আমার সেখানে রেখেই বাইরে চলে যায়। তারা বাইরে যেতেই আমি উঠে বসি। আমার জ্ঞান যে এত দ্রুত ফিরে যাবে তা হয়তো তারা ভাবে নি। তাই তো আমার হাত পা বাঁধে নি। আমি উঠে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য রাস্তা খুঁজতে থাকি। দরজার কাছে আসতেই দেখি তারা দরজা থেকে কিছু দূরত্বেই উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধীর পায়ে তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে জাহাজের উপরে উঠে আসি। যেহেতু জাহাজগুলো একই লাইনে সারি সারি বাঁধা ছিল। যার জন্য একটা জাহাজের সাথে আরেকটা জাহাজ লেগে লেগে ছিল। আমি আর পালানোর উপায় না পেয়ে খুব সাবধানে সেই জাহাজ থেকে পাশের জাহাজটিতেই উঠে পড়ি৷ এইভাবেই পরপর তিন জাহাজ এইভাবেই পার করি। পঞ্চম নাম্বার জাহাজটিতে উঠে আমি সেটার মধ্যেই লুকিয়ে পড়ি।

এইদিকে এসে লুকিয়ে পড়ার মুখ্য কারণ হচ্ছে তারা যখন জানবে আমি পালিয়ে গিয়েছি তখন তারা সর্বপ্রথম আশেপাশের জাহাজে খুঁজে অতঃপর রাস্তার দিকেই যাবে। আমি যদি এখন রাস্তার দিকে যাই তাহলে তারা নিশ্চিত আমায় ধরে ফেলবে। আর আমি জানি তারা আশেপাশে খুঁজলেও সর্বোচ্চ দুইটা কি একটা জাহাজ চেক করবেন। এরপর আর করবেন না। তাও সেফটির জন্য পঞ্চম নাম্বার জাহাজে এসে আশ্রয় নেই।

বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর আমি বেড়িয়ে আসি। আর জাহাজ থেকে নামার জন্য রাস্তা খুঁজতে থাকি। এমন সময় বিকট এক শব্দ কানে আসতেই আমি কেঁপে উঠি। এই বুঝি তারা আমায় ধরে ফেলেছে। কিন্তু না তেমন কিছুই না। আমি আমার আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি এইবার সর্তক দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলাই। বুঝার চেষ্টা করি কোথা থেকে শব্দ গুলো আসছে। অতঃপর বুঝতে পারি নিচের দিক থেকে শব্দ গুলো আসছে। আমি নিচের দিকে নেমে আসতেই দেখি ৪-৫ জন লোক একত্রিত হয়ে দাঁড়িয়ে হাসা-হাসি করছে। তাদের দেখার সাথে সাথে আমি পিছ পা হয়ে উপরে কয়েক সিড়িতে উঠে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়ি। এমনভাবে দাঁড়াই যাতে তারা আমায় দেখতে না পারে। আমি উঁকিঝুঁকি করতেই দেখি মেঝেতে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। দূরেই একজন ব্যক্তির মৃত দেহ পরে আছে । এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আমি মুখ চেপে ধরি। পুরো শরীর সমানে কাঁপতে থাকে। আমার বুঝতে দেরি নেই তারাই এই লোককে খুন করেছে। কিন্তু কেন? আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকি। কোনমতে যেন এইখান থেকে বেরুতেই পারলি বাঁচি। আমি আবার উপরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই তাদের কথা শুনে থমকে যাই। নড়ার বিন্দু মাত্র শক্তি অবশিষ্ট থাকে না গায়ে৷ আমি সেখানেই দেয়ালে ঘেষে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে শুরু থাকি।

#চলবে