#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
পলকহীন চাহনীতে বিভোর হয়ে আছে অনল। নিহির পথ রোধ করা। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে নিজেও যেন কিছুটা থমকে গেছে। অনলের পেছনে কিছুটা দূর থেকে লিমনের ডাক আসে। নিহির উদ্দেশ্যে বলে,
“নিহি!”
ভাবনায় ছেদ পড়ে দুজনের। ভাবনার অতল গহীন থেকে নিহি নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত সে জায়গা প্রস্থান করে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে সমান তালে লিমনের সাথে হাঁটে। অনল পিছু ফিরে তাকায়। ঘোর কাটেনি তার এখনো। আস্তে আস্তে নিহি দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। সবকিছু আবছা আবছা লাগছে। অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সুমাইয়া ডাকে তখন।
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।”
অনল যায় না। একদৃষ্টে সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাকশক্তিও বোধ হয় লোপ পেয়েছে। সুমাইয়া এবার অনলের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কী হলো?”
“নিহি! নিহিকে দেখেছি আমি।” অস্পষ্ট স্বরে বলে অনল।
সুমাইয়া অবাক হয়। সেই সঙ্গে অবাক বাকি বন্ধুরাও। ওরা সবাই কলেজে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি জানে। তবে নিহি এখানে? এটা কীভাবে সম্ভব? সুমাইয়া তখন হাসার চেষ্টা করে বলে,
“ধুর! মনের ভুল। ইদানীং তুই ওকে নিয়ে বেশিই ভাবছিস।”
“নাহ্। আমি সত্যিই নিহিকে দেখেছি।”
“কোথায় দেখলি?”
“এখানেই!”
হাতের দিকে লক্ষ্য হতেই পানির বোতলটা দেখিয়ে বলে,
“ওই এই পানির বোতলটা আমার হাতে তুলে দিয়েছে।”
সবাই দেখেছে বোরকা পরা একটা মেয়ে যে পানির বোতল তুলে দিয়েছে। কিন্তু সেটাই যে নিহি এতটা শিওর কী করে অনল? সবাই এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছে এই সবকিছু অনলের মনের ভুল। কিন্তু অনল মানতে নারাজ। এত কাছ থেকে নিহিকে চিনতে ভুল করেনি সে। করবেও না! তাছাড়া ঐ ছেলেটির মুখেও তো ‘নিহি’ ডাক শুনেছে। কিন্তু এই ছেলেটাই বা কে? তার সাথে নিহি কেন এখানে এসেছে? প্রশ্নটা জটলা বাঁধছে। নিহির কাছে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়ে। অনলের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে ঘাবড়ে যায় সবাই। নিহির জন্য অনল কেন এমন করবে?
জাফলং-এ কারোরই ঘোরা হলো না। অনলের জন্য বাধ্য হয়ে সকলকে হোটেলে ফিরতে হলো। এত আশা নিয়ে ঘুরতে এসেও ঘোরা হলো না কারোরই। এজন্য মনে মনে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
.
লিমন বাসের সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। কপালে হাত। চোখ বন্ধ। অন্যদিকে নিহি জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অনলকে দেখে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সে কেন এসেছে এখানে? আর এসেছেই যখন দেখা কেন হতে হবে! একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখল নিহির হাত-পা কাঁপছে। এমন হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিহির অস্থিরতা,নড়চড় দৃষ্টি এড়ায় না লিমনের। কতকক্ষণ নিহির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
নিহি থতমত খেয়ে যায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
“কিছু না।”
লিমন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে,
“তুই ভয় পাস না। স্মৃতি তোর কিছুই করতে পারবে না।”
উত্তরে এবারও নিহি মেকি হাসে। স্মৃতিকে নিয়ে নিহির ভয় হচ্ছে না। ইভেন কোনো ভয়ই মনে কাজ করছে না। শুধু প্রচণ্ড পরিমাণে অস্থিরতা কাজ করছে। সেটা কি এতদিন পর অনলকে দেখার কারণেই নাকি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে এসে যাওয়ায় তা স্পষ্ট নয় নিহির কাছে।
.
.
বাড়িতে পৌঁছে নিহি ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। তরু এখনো ফেরেনি বাসায়। ড্রয়িংরুম থেকে লিমনের চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসে। তরুর খোঁজ করে। মামী তখন জানায় তরু দোকানে গেছে। তিনিই পাঠিয়েছেন। লিমনের ক্ষুব্ধ মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে। তরুর ওপর রাগ এড়িয়ে যেতে তিনি মিথ্যে বললেন। লিমন নিজের ঘরে চলে যায়।
নিহির এখন ইচ্ছে করছে আমানের সঙ্গে কথা বলতে। আমানের সঙ্গ পেতে। এক মনে ভাবলো ফোন করবে। আবার ভাবলো সারারাত না ঘুমিয়ে ঢাকায় গেছে। মিটিং করেছে। এখন নিশ্চয়ই একটু ঘুমাচ্ছে। কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে কিছুক্ষণ নাম্বার ঘাটাঘাটি করে উপমাকে ফোন করল। উপমা ফোন রিসিভ করে বলে,
“কীরে কী খবর? ফোন দিতে ইচ্ছে হলো?”
নিহি মৃদু হেসে বলে,
“তুইও তো ফোন দেস না।”
“ইশ! কেন দেবো? তোর রাগ আছে। আমার রাগ নেই?”
“খুব রাগ না? ঢাকায় আসি আগে। তারপর দেখব এত রাগ কোথায় থাকে।”
“সত্যিই? কবে আসবি?”
“পরীক্ষার পর।”
“ধুর! দেরি আছে।” মলিন মুখে বলে উপমা।
নিহি তখন বলে,
“অনলকে দেখেছি আজ।”
উপমা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় দেখেছিস?”
“জাফলং।”
“পরে?”
“পরে আর কিছুই না।”
“তোকে দেখেছে? কথা হয়নি?”
“দেখেছে। তবে কথা হয়নি। দেখে মনে হলো ঘোরের মাঝে আছে।”
“হোক! এরকম আরো অনেকবার তার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে। তুই নিজেকে শক্ত রাখবি।”
“আমি শক্ত আছি। শুধু একটু অস্থিরতা কাজ করছে।”
“দুলাভাইর সঙ্গে কথা বল। ঠিক হয়ে যাবে।”
“হুম। রাতে ফোন করব। দীপ্ত কেমন আছে?”
“ভালো আছে। আগের থেকে অনেক চালাকচতুর হয়েছে।” বলে উপমা হেসে ফেলে। সঙ্গে নিহিও হেসে ফেলে। আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে ফোন রাখে। এর মাঝেই তরু এসে পড়ে। লিমনকে বাসায় দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। নিহি তাকে শান্ত থাকতে বলে।
.
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফোন নিয়ে ছাদে যায় নিহি। প্লে লিস্ট থেকে গান ছেড়ে রেলিং এর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। এই ছাদেই আমানের সঙ্গে খুনসুটির কত স্মৃতি রয়েছে। আমানের কথা মনে পড়ছে ঠিকই। তবে এটাও সত্য মনের এক কোণে অনলের বিষয়টাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যতই ভুলতে চাচ্ছে ততই আরো বেশি করে মনে পড়ছে। একটা সময়ে এই অনলের প্রতিও নিহির ভালোবাসার পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়েছিল। ভুল মানুষকে ভালোবাসাটাই ছিল চরম ভুল। সেই ভু্লটা নিহি সংশোধন করে নিয়েছে। অনলের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তবুও কোথায় যেন একটা কী!
গান বন্ধ হয়ে যায়। ফোনের স্ক্রিনে আমানের নাম্বার ভেসে ওঠে। মনের ওপর থেকে একটা ভার নেমে যায়। ফোন রিসিভ করে নিহি সালাম দেয়। আমান সালামের উত্তর নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভালো আছেন নিহুপাখি?”
‘নিহুপাখি!’ যতবার এই ডাকটা শোনে ততবার মনের ভেতর শীতল হাওয়ায় স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে মন। মনকাননে তখন হাজারও ভালোবাসার ছড়াছড়ি। রাশি রাশি সুখ সেখানে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সলজ্জিত হেসে নিহি উত্তর করে,
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আমি খুবই দুঃখিত।”
“কেন?”
“সারাদিনেও আজ তেমন খোঁজ-খবর নিতে পারিনি আপনার তাই।”
ঠোঁটের হাসি আরও সুদীর্ঘ হয় নিহির। বলে,
“সামান্য কারণেও বুঝি দুঃখিত হওয়া লাগে?”
“নাহ্। সবার ক্ষেত্রে নয়। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।”
“তা এই কিছু কিছু মানুষগুলো কারা?”
“যারা স্পেশাল।”
“আমিও স্পেশাল?”
“জানিনা। শুধু জানি, মায়ের পরে আপনার স্থান!”
বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। এত মোহাবিষ্ট কথা লোকটা কী করে বলতে পারে কে জানে! নিহির লজ্জামিশ্রিত মুখটি চোখ বুজে অনুভব করে আমান। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
“মাঝে মাঝে আমার নিহুপাখিটা বোবা হয়ে যায় নাকি?”
“হু, যায়।”
“কেন? কেন?”
“আপনার ভালোবাসার মোহাবিষ্ট কথায় দগ্ধ হয়ে।”
“তাও ভালো! আগুনে নয়।”
“জানেন কিছুক্ষণ আগেও আমার মন খারাপ ছিল।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“অযথাই। উল্টা-পাল্টা কথা মাথায় আসে।”
“অযথাই কারো মন খারাপ হয় না। আমরা নিজেরাই নিজেদের মন খারাপের কারণ।”
“কীভাবে?”
“এই ধরুন, একটা বিষয় নিয়ে আপনি খুবই আপসেট। আপনি জানেনও বিষয়টা যতবার আপনার মনে হবে ততবার আপনি কষ্টে জর্জরিত হবেন। এটা জানা সত্ত্বেও যখন আবারও সেই একই কথা ভাববেন আর কষ্ট পেয়ে মন খারাপ করবেন। তখন মন খারাপের জন্য নিজেকে দায়ী না করে কাকে দায়ী করবেন?”
“যদি ভুলতে চেয়েও ভুলতে না পারি তখন?”
“ভুলতে চাওয়াটাই হচ্ছে বড় ভুল।”
“মানে?”
“মানে এটাই। কাকে বা কী ভুলবেন আপনি? যেটাই ভুলতে যান না কেন আগে সেটা মনে করতে হবে। আর যতবার আপনি ভুলতে যাবেন ততবার মনে পড়বে। তাহলে ভুলবেন কী করে বলুন তো?”
“তাহলে কী করা উচিত?”
“ড্যাম কেয়ার ভাব নিন। এমন একটা ভাব নিন যাতে,যত বড়োই কষ্টের কথা মনে হোক না কেন তাতে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না। কষ্টকে নিজের শত্রু নয় বন্ধু ভাবুন। যদি এগুলো আপনি করতে পারেন তাহলে ফিফটি পার্সেন্ট কষ্ট আপনার এমনিতেই লাঘব হয়ে যাবে। আর বাকি ফিফটি পার্সেন্ট আপনার নিয়ন্ত্রণে। আপনি নিজেই তার নিয়ন্ত্রক।”
প্রত্যেকটা কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে নিহি। উনি সাথে থাকলে কষ্টও ভয় পাবে কাছে আসতে। এমন একটা মানুষ দুনিয়ার সব প্রিয় মানুষের হোক।
সিঁড়িতে কারো পদশব্দ শুনে কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখে। পিছনে তাকিয়ে দেখে লিমন এসেছে। খাবার টেবিলেও লিমনকে আজ দেখেনি। মুখের অবস্থা করুণ। নিহির দিকে তাকিয়ে লিমন বলে,
“তোর ঘরে গিয়ে দেখলাম তুই নেই। তরু বলল ছাদে এসেছিস। তাই আমিও আসলাম। তোর শীত করছে না?”
“না।” নিহির নির্লিপ্ত উত্তর। সত্যি বলতে লিমনের করুণদশা মুখ দেখে বাকশক্তিও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
লিমন কিছুক্ষণ মৌন থাকে। নিহিও কিছু বলছে না। লিমন কিছু বলার জন্যই এসেছে এটা বুঝতে পারে। তাই বলার সুযোগ দিয়ে নিশ্চুপ থাকে। মৌনতার সংকীর্ণ দূর করে লিমন বলে,
“স্মৃতির বিষয়টা বাড়িতে কাউকে বলিস না। তরুকেও না।”
“তরু তো জানে তুমি রিলেশন করো।”
“হ্যাঁ। বিয়ে করেছি এটা জানে না। ও জানলে কখন মুখ ফস্কে বাবা-মাকে বলে দেবে ঠিক নেই। তখন তারা কষ্ট পাবে।”
“আচ্ছা। আর পরে যখন জানবে? তখন কষ্ট পাবে না?”
লিমন এবার দমে যায়। তার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝে নিহি প্রশ্ন পাল্টে জিজ্ঞেস করে,
“না জানিয়ে বিয়ে করলে কেন ভাইয়া?”
“তোকে পরে সব বলব। তুই কাউকে বলিস না প্লিজ!”
“বলব না।”
লিমন সৌজন্যতার হাসি হেসে বলে,
“ঘরে যা। ঠান্ডা লাগবে।”
নিহিও আর কথা বাড়ায় না। লিমনের সঙ্গেই ঘরের ভেতর যায়। আমানের সঙ্গে বাকি কথা ঘরেই বলে।
_____________________
উদভ্রান্তের মতো নিহির খোঁজ করছে অনল। কেন করছে জানে না। শুধু জানে, নিহির সঙ্গে একবার কথা বলতেই হবে। উপমার ফেসবুক আইডি থেকে নিহির আইডি খুঁজে বের করে। সেখান থেকে ওর কলেজ ফ্রেন্ডের আইডির সঙ্গে এড হয়ে বিভিন্নরকম ছলচাতুরী করে সুমাইয়াকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিহির সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছে। সেটাও আবছা, আবছা! তবে বাড়ির এড্রেস পাওয়া গেছে। আর কলেজে যাওয়ার সময়টাও জেনে নিয়েছে। বাড়িতে তো আর যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলেজে যাওয়ার সময়ই নিহির সঙ্গে কথা বলবে।
অনলের এত বাড়াবাড়ি বিরক্ত লাগছে লিসার। হুট করেই এমন পরিবর্তনের কোনো মানে হয়? এই ছেলের মনের কোনো ঠিক নেই। কখন কী চায়, সেটা সে নিজেও জানে না। বিড়বিড় করে নিজের ঘরে চলে যায়। কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধ সাকিব, মিলন এবং সুমাইয়াও হয়। এত বড় কেলেঙ্কারির পর আবার নিহির জন্য এমন উতলা হওয়াটা অন্তত অনলকে তো মানায় না। সুমাইয়া জিজ্ঞেস করে,
“তুই কেন এমন করছিস?”
“জানিনা আমি।”
“ওর সঙ্গে কথা বলে লাভ কী?”
“তাও জানিনা আমি।”
সুমাইয়া দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
“তুই কি ওর লাইফে ব্যাক করতে চাচ্ছিস?”
অনল এবার যেন একটু হাসলো। হেসে হেসে বলল,
“ধ্যাত! না। শুধু একটু কথা বলব।”
.
.
ফাঁকা রাস্তায় নিহি আর তরু হাঁটছে। উদ্দেশ্য কলেজের গন্তব্য। রাতে আমানের সঙ্গে কথা বলার থেকে নিহির মন ফুরফুরে হয়ে আছে। তরুর সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে যাচ্ছে। তখন সামনে থেকে কয়েকজন ছেলে এগিয়ে এসে ওদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সবার মাঝ থেকে একজন নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনিই নিহি?”
একবার তরুর দিকে তাকিয়ে নিহি উত্তর করে,
“জি।”
“আপনাকে মেয়র সাহেব বাসায় যেতে বলেছেন।”
নিহি অবাক হয়। ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করে,
“কেন? তাছাড়া তিনি আমাকে চেনেন কীভাবে?”
“স্মৃতি আপার মাধ্যমে।”
“স্মৃতি! উনি মেয়রের কী হয়?”
“মেয়ে।”
এবার পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয় নিহির কাছে। উত্তরে তখন নিহি বলে,
“আমি এখন যেতে পারব না।”
কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল অনল, সাকিব, মিলন আর সুমাইয়া। পথ রোধ দেখে ওরাও এগিয়ে আসে। অনলকে দেখে নিহি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ঐদিকে ঐ লোকগুলোও জোড়াজুড়ি করছে। নিহি তখন কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“বললাম তো আমি যাব না! আমার কলেজ আছে এখন। তাছাড়া আমার তাদের কাছে কোনো দরকার নেই। তাদের যদি কোনো দরকার থাকে তাহলে তারা যেন আমার কাছে আসে।”
এইটুকু বলে নিহি তরুর হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। ছেলেগুলো এগিয়ে যেতে ধরলে অনল বাঁধা দিয়ে বলে,
“কী সমস্যা? ওকে বিরক্ত করছেন কেন?”
উত্তর দেওয়ার আগে একজনের ফোন বাজে। সম্ভবত মেয়রের ফোন এসেছে। তিনি ছেলেটির মুখ থেকে সব শুনে ফিরে আসতে বলেন। অশান্তি তার পছন্দ নয়। তাছাড়া গ্রামে তার আলাদা একটা সন্মান আছে। তার কথামতো ছেলেগুলো চলে যায়। ততক্ষণে নিহি আর তরু বড় বড় কদমে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। তরু বারবার জিজ্ঞেস করছে ‘ওরা কারা? মেয়র কেন তোকে যেতে বলেছে?’ নিহি কোনো উত্তর করেনি।
অনল দৌঁড়ে এসে নিহির পথ আটকে দাঁড়ায়। হাঁটুতে হাত রেখে একটু ঝুঁকে হাঁপাতে থাকে। দম নিয়ে বলে,
“পালিয়ে যাচ্ছো?”
নিহি কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়,
“পালাবো কেন? আমি তো চোর নই।”
“তবে পালাচ্ছো কেন?”
“আমি পালাচ্ছি না! আপনি আমার পিছু কেন নিয়েছেন?”
“আমি জানিনা।”
“পাগলের প্রলাপ বকতে যদি পথ আটকে দাঁড়ান তাহলে বলব সরে যান।”
“একটু কথা বলতে আপত্তি কোথায়?”
“আমার রুচিতে বাঁধে।”
“এতটাই ঘৃণা করো?”
“ঘৃণা? আপনাকে? অসম্ভব! ঘৃণা করতে হলেও তো মানুষটিকে মনের মাঝে ঘৃণার ঘরে স্থান দিতে হয়। সেই স্থানও আপনার নেই। আপনি আমার ঘৃণারও যোগ্য নন!”
অপমানে চোখমুখ লাল হয়ে যায় অনলের। যেই দাম্ভিকতা মনের মাঝে পুষে রেখেছিল আজ যেন সব নিহির কঠিন কঠিন কথায় ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তো ছুঁটে আসতে চায়নি সে। তবুও এসেছে। একটুখানি কথা বলতে। আর চাওয়াটাই হয়েছে কাল। তার দাম্ভিকতাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। অপমানিত থমথমা মুখ নিয়ে নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐ চোখের ভাষায় আজ ভালোবাসা নেই। আছে শুধু দগ্ধিত অনল! নিহি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। অনল পেছন থেকে বলে,
“এই কি তবে সেদিনের বলা বুকে আঘাত করার কথা?”
নিহি থমকে পেছনে তাকায়। অগ্নিবর্ধক নয় বরং শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনলের দিকে। এই দৃষ্টিতেও বিচলিত হতে হয় অনলকে। ঠোঁটে প্রশান্তি ও রহস্যের সেই হাসিটা বজায় রেখে নিহি বলে,
“না। অপেক্ষা করুন। সেই আঘাত সহ্য করা আপনার ক্ষমতার বাইরে। পারলে সেই আঘাত মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন। আর হ্যাঁ, এভাবে সেচ্ছায় আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। আমি কথা দিচ্ছি, একদিন আল্লাহ্-র ইচ্ছেতেই আমরা দুজন মুখোমুখি হবো। এবং সেটাও দুজনের অজান্তেই! সেই দিনটার প্রহর গুনুন। আল্লাহ্ হাফেজ।”
চলবে….
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
বাংলা পিরিয়ডের ক্লাস চলছে। জানালার পাশে বসে খাতার মাঝে আঁকিবুঁকি করছে নিহি। কী লিখছে বা কী আঁকছে তা ওর জানা নেই। মূলত হাত শুধু চলছে। মন ভাবছে অন্যকিছু। সেই অন্যকিছুটা কী? অনলের কথা? হতেও পারে! না হওয়ার মতো অনাবশ্যক কোনো কারণ নেই। এত কঠিন কঠিন কথা আজ কেমন লেগেছিল তার? এক পলক চোখ বন্ধ করে অনলের তখনকার মুখটা নিহি কল্পনা করে নিলো। পরমূহুর্তেই চোখ খুলে ফেলল। অনলের ক্লেশমাখা মুখটি দর্শন করে ভালো ঠেকছে না তার। অবাক হবেন না! ভালো ঠেকছে না মানেই নয়, তার জন্য এখনো মনের মাঝে সুপ্ত ভালোবাসা আছে। বরং এজন্যই মন অসন্তুষ্ট যে, এতটুকু কষ্ট তো অনলের প্রাপ্য নয়। এরচেয়েও ঢের বেশি কষ্ট তাকে পেতে হবে।
জানালার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো। এক ঝাঁক পাখি দল বেঁধে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তারা? কাজে? খাবার জোগার করতে? নাকি ঘুরতে বের হয়েছে! আচ্ছা তারাও কি মানুষের মতো শখের বসে ঘুরে বেড়ায়? ঘুরতেই পারে! অসম্ভবের কি কিছু আছে? কিছু অসম্ভব নয়। সামান্য কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে, তাহলে পাখিরা শখ করে কেন ঘুরতে পারবে না?
আচ্ছা অনলের প্রতি এমন ব্যবহার কি ভুল হচ্ছে নিহির? ভুল কেনই বা হবে? সে কি এসবের যোগ্য নয়? নিহি তো কিছু করেনি। অনল তার কর্মের ফল পাচ্ছে। এটা তো একদিন হওয়ারই ছিল। কেনই বা অনল আসলো তার আত্মসম্মান খুইয়ে? তাছাড়া তাকে তো আসতে হতোই। তাই হয়তো এসেছে!
বেঞ্চের ওপর রাখা নিহির এক হাত মৃদু চেপে ধরে তরু। ভাবনার ঘোর কাটে নিহির। তরুর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
“তোর কি মন খারাপ নিহি?”
নিহি হাসার চেষ্টা করল। হাসলোও। মেকি হাসি! হেসে বলল,
“না তো! কেন?”
“দেখে মনে হলো। এত কী ভাবছিস?”
“তেমন কিছুই না। উদ্ভট কথাবার্তা মাথায় আসে।”
“আমি তো বুঝতেছি না মেয়র কেন তোকে যেতে বলেছে?”
“আমি জানিনা।”
“তুই তাকে চিনিস?”
“না রে!”
মনমতো কোনো উত্তর না পেয়ে তরু চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করল,
“ঐ ছেলেটা কে? যাকে তুই এত কঠিন কঠিন কথা বললি!”
“আমায় পরিবর্তন করা মানুষটি।”
“মানে?”
“কিছু না। তার জন্যই আমার সিলেটে পড়তে আসা।”
“কেন? কী এমন হয়েছিল?”
“টিফিন টাইমে বলব।”
“ঠিকাছে।”
মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে নিহি ক্লাসে মনোযোগ দিল। আর মাত্র এক মাস পরই ইয়ারচেঞ্জ পরীক্ষা। সময় নষ্ট করা যাবে না কোনো। ভালোমতো পড়তে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
.
টিফিন টাইমে মাঠের এক কোণে বসে নিহি তরুকে সব খুলে বলে। সব শুনে তরু ক্ষুব্ধ হয়ে যায় অনলের প্রতি। দাঁত কটমট করে বলে,
“ঠিক হয়েছে। একদম ঠিকাছে। প্রতিশোধের জন্য কেউ এমন করতে পারে?”
“পারে হয়তো! পারে বলেই তো করেছে।”
“তার নামের সাথে তার মিল রয়েছে অনেক। তার ভুলের আগুনেই সে পুড়ে মরবে দেখিস তুই।”
“আল্লাহ্-র হাতে ছেড়ে দিয়েছি সব।”
কলেজ ছুটির পর বাইরে অনেক মানুষজন দেখতে পায়। একসঙ্গে সবার ছুটি হয়েছে বলে গেটের সামনে ভীড় হয়ে গেছে। তরু নিহির হাত ধরে রেখেছে। সকালের ঐ ছেলেগুলোও এখানে আছে। একজন এসে বলে,
“মেয়র নিজেই এসেছে। আসুন।”
নিহি আর তরু দুজনই অবাক হয়। দুজন দুজনের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। মেয়র হয়ে তিনি নিজেই আসলেন? নিহি ভয় পেল না। নিজেকে সামলে নিলো। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় সে?”
“গাড়িতে।”
“চলুন।”
নিহি তরুকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়ির সামনে যেতেই গাড়ির কাঁচ নামান তিনি। বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। তবুও চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েনি। শান্তশিষ্ট দেখালো তাকে। নিহিকে দেখে হাসলেন। বললেন,
“গাড়িতে ওঠো।”
নিহি একটু বিচলিত হলো। কিন্তু বুঝতে দিল না। তরু শক্ত করে ধরে রাখল নিহির হাত। মেয়র হেসে বললেন,
“ভয় পেয়ো না।”
এরপর তরুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমিই তরু?”
তরু নিহির দিকে একবার তাকিয়ে মাথা উপর-নিচ করল। তিনি বললেন,
“তুমিও আসো। সমস্যা নেই।”
“আমরা কোথায় যাব?” জিজ্ঞেস করল নিহি।
“আমার বাড়িতে। লিমনকেও আসতে বলেছি।”
নিহি যাবে কি যাবে না কিছু বুঝতে পারল না। পরে ভাবল যা হওয়ার হবে। যাওয়া যাক। এত মানুষের সামনে গাড়িতে উঠবে। এখানে তার বিপক্ষে থাকা লোকজনও থাকতে পারে। কোনো ক্ষতি করার কথা অন্তত তিনি ভাববেন না। তেমন ইচ্ছে থাকলে জোর করেই তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। নিহি গাড়িতে উঠল। সঙ্গে তরুও। গাড়ি চলা শুরু করল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর গাড়ি একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই গাড়ি ভেতরে গেল। সবাই গাড়ি থেকে নামল। তরু বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছে। অসম্ভব সুন্দর বাড়ি। মেয়রের বাড়ি বলে কথা! কিন্তু লিমন কেন এখানে? নিহিকেই বা কেন আনল? ভেতরে গেলেই জট খুলবে।
ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল লিমন সোফায় বসে আছে। নিহি আর তরুকে দেখে অবাক হলো। ওর মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ওদের আসার কথা সে জানতো না। মেয়র ওদেরকে বসতে বলে স্মৃতিকে ডাকলেন। ওদের সম্মুখের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী খাবে তোমরা?”
লোকটি বেশ আন্তরিক বোঝা গেল। নিহি বলল,
“কিছুই না। কী জন্য ডেকেছেন বললে ভালো হতো।”
“বলব। বলার জন্যই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছি।”
স্মৃতিকে তিনি নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
“স্মৃতি আমার একমাত্র মেয়ে। ওর কোনো আবদার কখনো আমি অপূর্ণ রাখিনি।”
সব না শুনে নিহিও কিছু বলবে না ভেবে চুপ করে রইল। তিনি আবার বলা শুরু করলেন,
“ছোটবেলায় ওর মা মারা যায়। আমি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তেমন সময় ওকে দিতে পারিনি। সেদিক থেকে বলতে গেলে, ও বাবা-মায়ের ভালোবাসা, শাসন পায়নি বললেই চলে। তাই বদমেজাজি হয়ে উঠেছে। এর অনেকটা দোষ হয়তো আমারই। রাজনীতির চেয়ে যদি মেয়েকে বেশি সময় দিতাম তাহলে হয়তো উড়নচণ্ডী স্বভাবের হতে পারতো না।”
তিনি একটু থামলেন। থেমে আবার বললেন,
“কালকের ঘটনা আমায় এসে সব বলেছে স্মৃতি। বিস্তারিত বলতে পারেনি কান্নার জন্য। তখন ওর বান্ধবীর থেকেই সব শুনলাম। ওর কাছেই জানলাম, স্মৃতি তোমার আর লিমনের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তুমি ওর ফুপাতো বোন এটা সত্যি। কিন্তু ঐযে আমার মেয়ে এক রোখা স্বভাবের। আমার কাছে উল্টা-পাল্টা বায়না করল। ও অবুঝ হলে কী হবে, আমি তো অবুঝ নই! লিমন এই বিষয়টার পর স্মৃতির ওপর খুবই বিক্ষিপ্ত ছিল। ওর এমন আচার-আচরণ বিশেষ করে তোমার সঙ্গে করা খারাপ আচরণগুলো মানতে পারেনি। ওর কথায় এটা স্পষ্ট, তরুর চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না তোমায়। আর নিজের বোনের মতো ভালো বোনকেই বাসা যায়। লিমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিভোর্সের।”
নিহি এবার চমকে লিমনের দিকে তাকায়। লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। এমনি এমনি তো করেনি! অবশ্যই অনেক বেশি ভালোবাসে। এবং এমন কোনো সংশয় এসেছিল যার কারণে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। মানলাম, স্মৃতির ওমন ব্যবহার ঠিক হয়নি। তাই বলে কি একটা সুযোগ দেবে না?
তিনি আবার বললেন,
“তোমায় আমি তেমন জানিনা। তবে কয়েকজনের মুখে তোমার কথা সব শুনেছি। তুমি অসম্ভব ভালো একটি মেয়ে। তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে আমার মেয়ে। তার জন্য আমি দুঃখিত। তোমার কাছে অনুরোধ, তুমি লিমনকে বোঝাবে।”
এতক্ষণে নিহি মুখ খোলে। বলে,
“এখানে বোঝানোর তো কিছু নেই আঙ্কেল। সাধারণ কোনো রিলেশন হলে ড্যাম কেয়ার ধরা যেত। বিয়ে তো যেই-সেই বিষয় নয়। আমি জানিনা কেন তারা লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। সেসব না হয় পরেও জানা যাবে। তাই বলে তো ছোট্ট একটা কারণে ডিভোর্স দেওয়া ঠিক নয়।”
নিহি লিমনের দিকে ঘুরে বসল। লিমনের হাত ধরে বলল,
“ভাইয়া আজ যদি আমি বা তরু এমন একটা কাজ করতাম। আর আমাদের হাজবেন্ড তখন তোমারই মতো আমাদের ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন তখন তুমি কী করতে? আমাদের সংসার বাঁচানোর চেষ্টা করতে না?”
লিমন নিশ্চুপ। সে আবার বলে,
“ভুল তো মানুষ মাত্রই করে। তুমি তাকে মাফ করে দাও প্লিজ। ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিও না।”
স্মৃতি এবার এগিয়ে আসে। লিমনের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,
“আ’ম স্যরি লিমন! আর কখনো এমন করব না। শুধু একটা সুযোগ আমায় তুমি দাও।”
লিমনের রাগ গলে পানি হয়ে গেল। স্মৃতিকে তুলে নিজের পাশে বসালো। তার চোখেও পানি চিকচিক করছে। শত হোক, ভালোবাসার মানুষ তো! স্মৃতির বাবা-ও চশমার ফাঁকে চোখ মুছেন। এত বড় একজন ক্ষমতাশালী মানুষ। তবুও কত উদার, আন্তরিক। লিমন চেষ্টা করলেই পারবে স্মৃতিকে নিজের মতো গড়ে নিতে।
সব মিটমাট হলে স্মৃতি নিহির হাত ধরে ক্ষমা চায়। নিহি মিষ্টি করে হেসে স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ক্ষমা চাইতে হবে না ভাবি। শুধু একটা অনুরোধ করব, যত যাই হোক, যাই দেখো না কেন আগে তার সত্যতা প্রমাণ করবে।”
“দেখেছেন আঙ্কেল, আমি বলেছিলাম না নিহিই পারবে সব ঠিক করতে? সেই গুণ যে ওর আছে।”
নিহি স্মৃতির পেছনে তাকায়। চমকে যায়। অনল ওর বন্ধুদের নিয়ে পাশের ঘর থেকে বের হচ্ছে। কথাটা অনলই বলেছে। তারা এখানে আসলো কীভাবে? স্মৃতির বাবা হেসে বলেন,
“ঠিকই বলেছিলে তুমি। তাই তো নিজে গিয়েই নিহিকে নিয়ে আসলাম।”
নিহি কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল হেসে বলে,
“একটা কথা তুমি ঠিকই বলেছ নিহি। মানুষ মাত্রই ভুল। আর ভুল ক্ষমা করা উচিত।”
কথাটা যে নিজের দিক থেকেই ইঙ্গিত করে বলেছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না নিহির। সে বাঁকা হেসে উত্তর করে,
“অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমা করা যায়। ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল নয়!”
এরপর ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,
“বাসায় যেতে হবে। অনেক পড়া বাকি আছে।”
স্মৃতি বলে,
“আজ এখানেই থেকে যাও। এখান থেকেই কাল কলেজে যেও।”
তখন মিলনও বলে,
“আরে নিহি থেকে যাও। মামুর বাসায় মজা হবে।”
তাহলে মিলনের মামা হন তিনি! এতক্ষণে পরিষ্কার সব। নিহি স্মৃতির হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলে,
“ছুটির দিনে আসব ভাবি। তখন চুটিয়ে আড্ডা দিবো,গল্প করব আর একসঙ্গে খাব।”
“পাক্কা আসবে তো?”
“পাক্কা।”
“ঠিকাছে।”
নিহি হাসে। লিমনকে বলে,
“ভাইয়া তুমি থাকো। পরে এসো। আমি আর তরু যাই।”
“ওদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলো।” একজনকে বললেন স্মৃতির বাবা।
বাড়ির বাইরে বের হতেই হাতে টান পড়ল। নিহি পিছনে ফিরে তাকালো। অনলকে দেখে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। বিক্ষিপ্তভাবে বলল,
“যখন তখন স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।”
“আমি খারাপ উদ্দেশ্যে হাত ধরিনি নিহি!”
“হাহ্! তা জানা আছে। আপনাকে না বলেছিলাম আপনি সেচ্ছায় আমার সামনে আসবেন না? কেন এসেছেন তাহলে?”
“চলে যাব। তার আগে একটা উত্তর দাও।”
“কী?”
“মানুষ মাত্রই যদি ভুল হয়। তাহলে আমার ভুল কেন ক্ষমা করবে না? কেন আমি ক্ষমা পাব না?”
নিহি কিছুক্ষণ অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখে চোখ রেখেই বলে,
“বললাম না তখন, অনিচ্ছাকৃত ভুল মাফ করে দেওয়া যায়। কোনো ইচ্ছাকৃত ভুলকে নয়। তাছাড়া ক্ষমা করার প্রশ্ন তখনই আসে যখন ভুল শব্দটা আসে। আপনি তো কোনো ভুল করেননি। আপনি যেটা করেছেন সেটা ভুল নয় অন্যায়। আর অন্যায়ের ক্ষমা কখনো হয় না।”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]