#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
জুভান নার্সের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই নার্স হাপাতে হাপাতে বললো,
” আপনার রোগী সুইসাইড করেছেন। ”
বাক্যটা বাতাসে মিশে জুভানের কানে যেতেই সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ঔষধ ডেস্কের উপর রেখেই এক দৌড়ে ঐশীর কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। দুই তলায় আসতেই একজন মেয়ে ওকে দেখে চটজলদি এসে ঘিরে ধরলো। জুভান বিরক্ত হলো। রাগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেয়েটা চমক গলায় বললো,
“ও মাই গড। ও মাই গড। জুভান ? আপনি ? এই হসপিটালে ? আমি কি সত্য দেখছি । আর ইউ হেয়ার ? ”
জুভান ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আধুনিকা মেয়েটা জুভানের পথ আগলে দাড়ায়। জুভানের রাগ লাগে। আশপাশে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে ও। জুভান শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো,
” ক্যান আই গো ? আই অ্যাম বিজি নাও। ”
মেয়েটা কি শুনলো ওর কথা ? লাফাতে লাফাতে নিজের ব্যয়বহুল ব্যাগ থেকে একটা ছোট নোটবুক বের করে জুভানের দিকে এগিয়ে বললো,
” প্লিজ ওয়ান অটোগ্রাফ ? প্লিজ প্লিজ প্লিজ। জাস্ট ওয়ান অটোগ্রাফ।প্লিজ । ”
জুভান মেয়েটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও ফর্সা হাতে ধরে রাখা নোটবুক টার দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে নোটবুক টা হাতে নিয়ে বাম হাত দিয়ে কলম ধরলো। কলমের খসখস আওয়াজ তুলে লিখলো কিছু একটা। শেষ হতেই নোটবুক টা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই পাশ কাটিয়ে ঐশীর কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।
অনিন্দিতা নামক মেয়েটা জুভানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ” হাইই ” বলে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। নোটবুক টা কিছুক্ষন বুকে চেপে ধরে আবার চোখের সামনে ধরলো। এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে নোটবুক টা খুলে দেখল। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা সেখানে,
” কমনসেন্স ব্যাক্তিভেদে পরিবর্তন হয়। কালো , সাধারণ মেয়ের মধ্যে সেই গুন অনেকসময় জ্বলজ্বল করতে থাকে। আবার অনেক সাদা চামড়ার , আধুনিক মনে এই গুন বড়ই দুর্লভ। আফসোস ! কেউ সেটা বুঝতে পারে না। ”
মেয়েটা লেখাটা পড়ে ভ্রু কুচকে ফেললো। বাক্যটা যে তাকেই ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একটু আগে আবেগের জোয়ারে ভেসে যাওয়া মেয়েটার চোখ মুখ রাগে তেজস্বী হয়ে আছে। বুক ভরা নিঃসৃত হতে লাগলো এক সমুদ্র আক্ষেপ। আসলেই তো। আফসোস ! আফসোস !
_________________________
জুভান জলদি ঐশীর কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। ঐশী কে দুজন নার্স ধরে রেখেছে। আর ও বারবার মাথার চুল শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে। চুল ছিঁড়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছে যেনো। বাম হাত থেকে রক্তের ফোঁটা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে হসপিটালের সাদা রঙের মাটিতে। ঐশীর জামায় ছোট ছোট রক্তের দাগ। ঐশী পাগলের মত বিলাপ করছে,
” আমি , আমি… এই তোমরা ধরে রেখেছ কেনো আমায় ? হ্যা ? ছাড়ো বলছি। বাবা কষ্ট পাচ্ছে ত। মা ? মাও ত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের মেয়ে তাদের কাছে নেই। না । আমাকে যেতে হবে। এক্ষুনি যেতে হবে। ছাড়ো বলছি। ছাড়ো আমায়। ছাড়ো। ”
জুভান ঐশীর কান্না শুনে এগিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে বসলো ঐশীর কাছে। ঐশী জুভানকে দেখে ওর শার্টের কলার আকড়ে ধরলো শক্ত করে। জুভান একবার ঐশীর কলার ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী প্রবল জেদ দেখিয়ে বললো,
” ওরা কেনো ছেড়ে দিচ্ছে না আমায়। আমি বলেছি একবার আমি মারা যেতে চাই। আমার বাবা একা আছে না ? খুঁজবে তো আমায়। খুঁজবে না বলুন। ”
জুভান ঐশীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
” শান্ত হও ঐশী। শান্ত হও। ওকে। রিলাক্স। রিলাক্স। ”
শরীর দুর্বল থাকায় একসময় ঐশী জুভানের কাধে লুটিয়ে পড়লো। আবারো জ্ঞান হারিয়েছে ও। ঐশীর মুখ জুভানের কাঁধ স্পর্শ করার জুভান একটু অসস্তি বোধ করলো। জোরে এক হাফ ছেড়ে দিয়ে নার্স এর দিকে তাকালো। দুজন ঐশীকে ধরে এনে বেড়ে শুইয়ে দিল। জুভান এগিয়ে গিয়ে ঐশীর পাশে চেয়ার টেনে বসলো। চোখ গেলো বাম হাতের কাটা জায়গার দিকে। খুব ধারালো ছুরি দিয়ে কাঁটা হয়েছে রগ। জুভান লম্বা এক নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলালো। কি এক ঝামেলার পাল্লায় পড়েছে ও। কাল থেকে এই মেয়ে একটার পর একটা বিপদ খাড়া করেই যাচ্ছে। করেই যাচ্ছে। নার্স দুটো হাতের রক্ত পরিষ্কার করে ডাক্তার ডাকলো। একটুপর ডাক্তার এসে ঐশীকে পর্যবেক্ষণ করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। জুভানের দিকে তাকিয়ে বললেন,,
” মিস্টার মির্জা, রোগী আপনার কে হয় ? ”
জুভান আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকালো। কপাল ভাজ করে বললো,
” কেউ না। ”
ডাক্তার সামান্য হেসে বললেন,
” আপনি এত বড় একজন সেলিব্রেটি। তাই অপরিচিত কাউকে হেল্প করা কেমন যেনো অদ্ভুত শুনালো। ”
জুভান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
” রাস্তায় দেখা হয়েছিল। হেল্প দরকার ছিল। তাই হেল্প করেছি। এর বেশি কিছু না। ”
” ওকে। তাহলে এই হেল্প টা আরো কিছুদিন বজায় রাখেন। কারণ রোগী এখন মেন্টালি খুব ডিপ্রেশনে আছেন। আজ এত গার্ডের ভিতরে সুইসাইড করতে পেরেছেন।আজ একটুর জন্যে রগ কাটেনি উনার। তবে তার মানে হার লাইফ ইজ ইন ডেনজার। আবারো তিনি সুইসাইড এটেম্প করতে পারেন। তাই একটু চোখে চোখে রাখবেন। ”
জুভান মাথা নেড়ে হ্যা বোধক সম্মতি দিল।
ডাক্তার চলে গেলে জুভান আবারও ঐশীর পাশে চেয়ার টেনে বসল। আশপাশটায় তাকিয়ে আবারও ঐশীর দিকে চোখ ফিরালো। একদিনেই মেয়েটা কেমন মিহিয়ে গেছে। জুভান ভাবলো। ভাবলো অতীতের নানা জল্পনা কল্পনার কথা। কিন্তু এই ভাবার কি শেষ আছে ?
_____________________
ঐশীর রিলিজ ডেট আজ। প্রায় দেড় দিন পর। ঐশীর মাথা থেকে সুইসাইডের ভুত নামলেও কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে গেছে মুখখানা। চঞ্চল ঠোঁটে হাসি নেই , প্রগাঢ় অনুভূতি নেই। বেচে থেকেও কেমন যেনো নির্জীব হয়ে গেছে মেয়েটা। জুভান ঐশীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
গাড়ি চলমান। দুপাশে শহরের কৃত্রিমতা নজর কাড়ছে। ঐশী জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। চোখ জোড়া ভেঙে কান্না আসছে। আজই ফিরে যাবে ও নিজের বাড়িতে। আসলে কি হয়েছিল জানার এখন প্রবল ইচ্ছে তার মনে। জুভান গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার ঐশীর দিকে তাকালো। হটাৎ ঐশী মুখ ঘুরিয়ে জুভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি তো প্রায় দুই দিন আপনার কাছে ছিলাম। এত অনুগ্রহ করার জন্যে কৃতজ্ঞ আমি। এখন আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিন। বিকেল হয়ে গেছে। বাসা খুঁজে নিতে পারবো আমি। আপনার আর কষ্ট করতে হবে না। ”
জুভান ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে কপাল চুলকালো। অতঃপর বললো,
” উহু। দুইদিন হয়নি এখনো। দেড় দিন হয়েছে। আমার শর্ত মানো নি তুমি। ”
ঐশী মুখ ভার করলো। চোখ বেটে নিয়ে আবারও জানালার দিকে তাকাল। বললো,
” সরি। আমি নিজের মাঝে ছিলাম না। তাই শর্তের কথা মাথায় ছিল না। ”
জুভান বাকা হাসলো। ভ্রু আঁকাবাঁকা করে ঐশীর দিকে তাকালো।বললো,
” যেহেতু শর্ত মানো নি। সেজন্যে শাস্তি ত প্রাপ্য তোমার।কি বলো ? ”
ঐশী চমকে তাকালো জুভানের দিকে। জুভান বাকা হেসে ড্রাইভ করছে। ঐশী ভাবলো , কি শাস্তি দিবে এই মির্জা ?
#চলবে…