ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-১২

0
1077

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১২( বোনাস পার্ট )
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জুভান ঐশীকে কাচুমাচু করতে দেখে মৃদু হাসলো। নিজের প্রশস্ত বুকে দু হাত গুটিয়ে বললো,

” বি নরমাল। আমি কিছু মনে করি নি। ”

ঐশী নিরুত্তর। তাকিয়ে রইল ঈষৎ লালাভ আকাশের দিকে। হঠাৎ করে ও বলে উঠলো,

” বাবা মাঝেমধ্যে আমাকে টং দোকানে চা খেতে নিয়ে যেতেন। ভালো লাগতো এই ম্যাজিক চা। ”

জুভান ঐশীর মুখশ্রীর দিকে তাকালো। অন্ধকারে বিষাক্ত কালো রং মেয়েটার মুখখানা আরো , আরো স্নিগ্ধ করে তুলেছে। জুভান মুগ্ধ হলো। একজন শ্যাম বর্ণের মেয়ের রূপের মাধুর্য দেখে বিমোহিত হলো।তবে প্রেমে পড়লো না। হুটহাট কি প্রেমে পড়া যায় ? উহু। প্রেম তো গভীর অনুধাবনের ব্যাপার। মন ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে এই প্রেম নামক ছন্দে। কিন্তু জুভানের মন তো কাপল না। তবে কি সে এক অনুভূতিহীন জীব। হবে হয়তো।

চা পর্ব শেষ হলো অনেকক্ষণ। জুভান গাড়িতে উঠে বসেছে। আর ঐশী একটা কথা বলবে বলে কাচুমাচু করছে। জুভান গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ঐশীর নাম ধরে ডাকলো। গাড়িতে উঠার তাগাদা দিয়ে বললো,

” উঠো। দাঁড়িয়ে আছো কেনো ? ”

ঐশী গাড়ি থেকে সাইড ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। কৃতজ্ঞতা চোখে বললো,

” এতদিন আমার পাশে ছিলেন এই জন্যে ধন্যবাদ।আর না। রাস্তায় একটা বাসায় দেখেছিলাম। ভাড়া যাবে । আমি একটি খোঁজ নিয়ে দেখি। ভাড়া পাই কিনা। আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। তাই জন্যে আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”

জুভান একটু অবাক হলো। তবে দ্বিমত করলো না। মাথা নেড়ে হতে জানিয়ে বললো,

” আমি সেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি ? ”

ঐশী তাৎক্ষণিক বলে উঠলো,

” না। লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো। বেশি দূর না। জাস্ট দশ মিনিটের রাস্তা হবে হয়তো। ”

জুভান কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে ঐশীর দিকে এগিয়ে দিল। বললো,

” আমার কার্ড। যদি কখনো দরকার পড়ে নিঃসংকোচে আমাকে জানাবে। আই অ্যাম অলয়েজ দেয়ার ফর ইউ। ”

ঐশী আলতো হেসে জুভানের থেকে কার্ডটা নিয়ে ব্যাগে পুড়ল।

____________________

ঐশী বাসা পেয়ে গেছে। সম্পূর্ণ বাসা গোছগাছ করা শেষ। রাত প্রায় বারোটা বাজে। এখনো অনেক জিনিস কেনা বাকি। আস্তে আস্তে কিনে বাসা সাজাবে ও। কিন্তু তাঁর আগে ওর একবার নিজের বাড়িতে যাওয়া উচিত। কি থেকে কি হলো তা একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। ঐশী শোবার ঘরে এলো। মাটিতে মাদুর পাতা আছে। ঐশী আজ থেকে সেথায় ঘুমাবে। ঐশী মাদুরটাতে বসলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল দিল তাদের বাড়ির কেয়ারটেকারকে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসলো। ওপাশের মানুষটা ” হ্যালো” বলতেই ঐশী গুমরে কেঁদে উঠলো। নাক টানতে লাগলো অনবরত। পুরুষটা নিমিষেই চিনে গেলো ঐশীকে। আর চিনবেই না কেনো ? ঐশীকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে যে । হাসান আকবর উদ্বেগ গলায় বললেন,

” ঐশী মা …. ”

ঐশী নিরুত্তর। তবে কান্নার আওয়াজ ধিমে কণ্ঠে ভেসে আসছে ফোন জুড়ে। হাসান আকবর আবারও বললেন,

” ঐশী মা , কেমন আছো ? ”

ঐশী কাদতে কাদতে হাপিয়ে উঠলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,

” চাচ্চু , ম. মা , বা.বাবা ? ওরা , ওরা …. ”

হাসান আকবর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

” হ্যা রে মা। আজ ওদের কবর দিয়ে এলাম। ”

” কবর” শব্দ শুনে ঐশী আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নার ফোয়ারা বইয়ে গেলো দুনো চোখ জুড়ে। ঐশী নিজেকে খুব কষ্ট সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

” ক. কিভাবে হ. হলো এসব ? ”

” মিডিয়া তো বললো আগুনে পুড়ে। তবে আমার মনে হয় এর পিছনে আগুন নয় কোনো ব্যক্তি আছে। ”

ঐশী চমকে উঠলো। ” ব্যক্তি ” ! ঐশীর কান্না থেমে গেলো। চকিত গলায় বললো,

” ব্যাক্তি ? কি বলতে চাইছো চাচ্চু ? ”

” হ্যা। কাল আমাকে বড় সাব একটু বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমি বাইরে যাওয়ার সময় একটা বড় নোহা গাড়ি তোদের বাসার সামনে রাখা দেখেছি। ওই গাড়ি থেকে অনেক দামড়া ছেলে বের হচ্ছিল। ছেলেগুলো কেমন যেনো ছিল। ওই গগুন্ডা , বেয়াদব এরকম। তবে আমি পাত্তা দেয়নি। পুলিশের বাড়িতে এসব তো আসেই। আমি বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এসে দেখি…. ঘ. ঘর আগুন. আগুনে পুড়ে ঝলসে গেছে। আর বড় সাব…… ”

হাসান আকবর আর বলতে পারলেন না। শব্দের অভাব হতে লাগলো তার ঝুলিতে। কষ্ট হতে লাগলো। জ্বালা ধরলো বুকের চারপাশটায়। ঐশী যেনো হতবাক। মুখে ” রা” কাটার জো নেই তার। কি শুনছে ও ? ওর বাবা , মা খুন হয়েছেন ? ঐশী চোখের জল লেপ্টে আছে পলকের ভাজে ভাজে। পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে দ্বিধাহীন।

” মা , ”

ঐশী সম্বিত পেলো। থমকে কাপা কণ্ঠে বললো,

” তুমি দেখেছো ওই ছেলেদের চেহারা ? ”

” নারে মা। দেখেনি। মাস্ক পড়া ছিল । ”

ঐশী হুড়মুড়িয়ে মাদুর থেকে উঠে দাড়ালো। ব্যাগে কাপড় ঢুকাতে ঢোকাতে বলল,

” চাচ্চু , আমি আসছি। এখনই আসছি বাড়িতে। তুমি থেকো ওখানে । ”

হাসান আকবর ঐশীর আসার কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বললেন,

” না না , মা । এসো না এখানে। বড় সাব তোমাকে একা ঢাকা শহরে পাঠিয়েছেন যাতে তুমি সুরক্ষিত থাকো। এখানে এসে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিও না। ”

ঐশীও নাছোড়বান্দা। সে জেদি গলায় বলল,

” আমি আসবো চাচ্চু। আমার বাবা , মা এর মৃত্যু সম্পর্কে জানার অধিকার আছে আমার । ”

” ঐশী , আমি কিন্তু মানা করেছি তোমায়। বড় সাবের কথা অমান্য করতে পারো না তুমি। ”

চাচ্চুর মুখে নিজের নাম শুনে ঐশীর হাত থেমে গেলো। হাসান চাচ্চু কখনোই ওর নাম ধরে ডাকেন না। কিন্তু যখন ঐশী কথা শুনে না তখনই তিনি নাম নেন ঐশীর। ঐশী রাগে কাপড়ের ব্যাগ দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। ফোন কেটে দিয়ে চিৎকার করে ,” বাবা ” বলে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কান্না করতে করতে চুল ছিড়ে ফেলবে এমন ইচ্ছে হচ্ছে ওর। বুক ফেটে যাচ্ছে। কান্না গুলো দলা বেধে গলায় সূচের মত বিধে আছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেনো ওর ? ঐশী নিজেকে সামলাতে না পেরে গলায় থাকা লকেট গলা থেকে খামচে ছিঁড়ে ফেলে মাটিতে ছুড়ে ফেললো। মাথা নুইয়ে কেঁদে উঠলো চিৎকার করে। আচমকা ওর চোখ গেলো মাটিতে এলোমেলো পড়ে থাকা লকেটটার দিকে। মনে পড়লো বাবার সেই কথা ,

” যখন তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলবে তখন এই লকেট খুলে দেখবে। ”

ঐশীর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক কাজ করা শুরু করলো। ভাবলো , পরিবারের চেয়ে মূল্যবান কিছু ওর জীবনে আর কি আছে ? ঐশী উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো লকেটটার দিকে। ওর কি খুলে দেখা উচিত এই লকেট ?

#চলবে..