#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
মেয়েটা জুভানের কাছে এসে বসলে জুভান ঐশীকে দেখিয়ে বলে,
” মিট। শি ইজ জেনিফার। মাই কল গার্ল। ”
ঐশী লজ্জায় , ঘোর অপমানে মাথা নিচু করে নিল। সাইড ব্যাগ শক্ত হাতে খামচে ধরে কাঁপা গলায় বললো,
” সরি ফর ডিস্টার্বিং। আপনি রেডি হয়ে আসুন। আমি নিচে ওয়েট করছি। ”
ঐশী আর মুখ তুলে তাকানোর সাহস পেলো না। জুভানের উত্তরের অপেক্ষা না করে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দরজার কাছে যেতেই পিছন থেকে জুভান ডাক দিল। ঐশী ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। অতঃপর এক ঢোক গিলে মাথা নিচু করে পিছন ফিরলো । জুভান আড়মোড়া ভাঙলো। জেনিফারের চুল এক হাত দিয়ে পেচাতে পেচাতে বললো,
” জাস্ট ফাইভ মিনিট অপেক্ষা করো। আই অ্যাম কামিং। ”
ঐশী মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিল। তারপর দরজা ধুম করে খুলে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। জুভানের সেদিকে তাকানোর সময় নেই। সে কিছুসময় জেনিফারকে নিয়ে মত্ত থেকে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
ঐশী রুম থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে বসার ঘরে সোফায় এসে বসলো। ব্যাগটা ঝট করে সোফায় রেখে দিয়ে সোফায় গা এলালো। চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। বারবার বন্ধ চোখের পাতায় ভাসছে,
” মিট। শি ইজ জেনিফার। মাই কল গার্ল। ”
কানে ঝংকার করে বাজতে লাগলো এই শব্দগুলো। বিষাক্ত শব্দ শুনে ঐশীর বন্ধ চোখের কার্নিশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়লো এক রঙহীন মুক্ত অশ্রু। ইশ! ভালোবাসা কি যন্ত্রণাদায়ক !
________________________
জায়গাটার নাম বান্দরবান। বাংলাদেশের বিখ্যাত পর্যটন জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। আজ এখানেই শুটিং করা হবে জুভানের মিউজিক ভিডিওর। জুভান একদিকে দাঁড়িয়ে মেকাপ নিচ্ছে। আর একটু দূরে ঐশী এক হাতে জুভানের স্ক্রিপ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের তীব্র ঝাঁজালো আলোতে চোখ মুখ বারবার কুচকে আসছে ওর। কপালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের ফোঁটা চকচক করছে।
শুটিং শুরু হবে আর কিছুক্ষণ পর। জুভান রেডি হয়ে ঐশীর পাশে এসে বসলো। ঐশীর হাত থেকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে সেটায় একবার চোখ বুলালো। ঐশী ঠায় বসে রইলো চেয়ারে। দৃষ্টি অতলে , সুদূরে। একটু দূরে একটা হিজল ফুলের গাছ বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাশি রাশি ফুল ছড়িয়ে পড়েছে ধুলোবালি জমা মাটিতে। ঐশীর লোভ লাগলো। ফুল কানে গুজার লোভ। সে সবাইকে ব্যস্ত দেখে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে গেলো হিজল ফুলের গাছের দিকে।
সামনে লতানো গাছ , ডানে বামে ফুলের সাম্রাজ্য। ঐশী মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। এত বিমোহিত সে আগে কখনো হয়নি। এত সুন্দর ! ঐশী এগিয়ে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলো। মাটি থেকে একটা ফুল হাতে নিয়ে আলতো হাতে কানে গুজে নিল। ঐশী একবার দুবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল সেই কানে গুজা অসম্ভব সুন্দর ফুলদুটো। আর এদিকে জুভান স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে চোখ গেলো মোহিত হওয়া এক নারীর দিকে। কানে লাল ফুল গুঁজে রাখা মোহময় সেই নারী। জুভান স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে আনমনে তাকিয়ে রইলো ঐশীর দিকে।
এসব সম্পর্কে অজ্ঞাত ঐশী ভাবছে, এখন একটা আয়না দেখলে ভালো লাগতো।
কিন্তু এখন আয়না কোথায় পাবে ? ঐশী খুব দুঃখ পেলো এতে। মন খারাপ করে হেঁটে আবার নিজের জায়গায় চলে যেতে নিলে ডিরেক্টর কাউকে ডাক দিয়ে আয়না নিয়ে আসতে বললেন। তবে ঐশী সেটা শুনতে পায়নি। সে তো আনমনে পা চালাতে লাগলো। হঠাৎ ঐশীর সামনে দিয়ে দুজন লোক নিয়ে গেলো এক বিরাট আয়না। খুব বিরাট। ঐশীর সম্পূর্ণ শরীর এই আয়নায় আটকে গেলো। ঐশী বিস্মিত হলো। উজ্জ্বল চোখে চেয়ে রইলো আকস্মিক আসা এই আয়নার দিকে। নিজের প্রতিরূপ কে এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করায় ঐশী মোহিত হলো। আয়নায় দিকে চেয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো।
কিন্তু এই এত সুন্দর মুহূর্তে কি থেকে কি হয়ে গেল ! আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেল ওর বাবার একজন খুনিকে। কার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছে। ঐশী তন্ময়কে দেখে অবাক হয়ে পিছন ফিরে তাকালো। তন্ময়কে চলে যেতে দেখে ঐশী খুব সন্তর্পনে ওর পিছু নিল। তন্ময় এগিয়ে যাচ্ছে । আর ঐশী তাকে ফলো করছে। আজ কিছু একটা ক্লু তো পাবেই ও।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একটু পর তন্ময় কিছু একটা টের পেলো। ফোন কেটে দিয়ে পিছন ফিরলো। সঙ্গেসঙ্গে ঐশী একটা কাপড়ের দোকানের ভিতর ঢুকে গেল। মাথা নিচু করে কাপড় দেখতে দেখতে আড়চোখে আবারও একবার তন্ময়কে দেখে নিল। তন্ময় ভ্রু কুঁচকে তাকালো আশেপাশে। কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে নজরে পড়লো না। তন্ময় মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। ফোন আবারও কানে লাগিয়ে হাঁটা ধরলো ও। এবার ঐশীও তন্ময়ের পিছন পিছন হাটা ধরলো। তবে এবার আরো সাবধানে।
একটা দোকান পার করার সময় ঐশী একটা পুতুলের মাথায় একটা লাল ক্যাপ দেখলো। ঐশী তন্ময়কে অনুসরণ করতে করতে হাত বাড়িয়ে সেই ক্যাপটা পুতুলের মাথা থেকে খুলে নিজের মাথায় ভালো করে পড়ে নিলো। এবার ঐশীকে চেনা একটু দায় হয়ে পড়েছে। ক্যাপের কারণে অর্ধেক মুখ ঢাকা পড়েছে ওর ।
পিছু নিতে নিতে ঐশী একটা বাংলোতে গিয়ে থামলো। তন্ময় ফোন পকেটে রেখে বাংলোর তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। তন্ময় দরজা বন্ধ করার পর ঐশী খুব সন্তর্পনে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। দরজার কাছে লিফলেট টাঙানো দেখলো। ফট করে নিজের মোবাইল বের করে লিফলেট এর একটা ছবি তুলে নিলো। এবার এই বিশাল বান্দরবানে এই খুনিকে খুঁজতে সুবিধা হবে ওর। ঐশী বেরিয়ে গেলো বাংলো থেকে। বাঁকা হেসে আবারও হাঁটা ধরলো শুটিং স্পটের দিকে। এবার সর্বপ্রথম খেলা শুরু। গেম নাম্বার ওয়ান।
__________________________
শুটিং স্পটে পৌঁছাতে দেখলো জুভান কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে আশেপাশে কিছু একটা দেখছে। ঐশী এগিয়ে গেলো জুভানের কাছে। জুভান ঐশীকে দেখে ভ্রু সোজা করে ফেললো। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ঐশীর দিকে রাগী চোখে তাকালো। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে প্রশ্ন করলো,
” কই ছিলে ? ”
ঐশী রাস্তায় সাজানো মিথ্যে ফটাফট বলে দিলো,
” ওয়াশরুমে। ”
জুভান কোমর ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু আঁকাবাঁকা করে বললো,
” ওয়াশরুমে ছিলে ? আর ইউ সিওর ? ”
ঐশী থতমত খেয়ে বললো,
” হুম। তো ? ”
জুভান একটা হাফ ছেড়ে দিয়ে ঐশীর থেকে মনোযোগ সরিয়ে সামনে তাকালো। সূর্যের তীব্র আলোর কারণে চোখ বেটে নিয়ে বললো,
” না কিছু না। যাও বাকি কাজ দেখে নাও। একটু পর বেরোতে হবে। ”
ঐশী মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।
আর জুভান ঐশীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ঐশী মিথ্যা কথা বললো কেনো ? জুভান ঐশীকে ওয়াশরুমে খুঁজেছে। কিন্তু ওখানে ঐশী তো ছিল না। তাহলে ? কোথায় ছিল ঐশী ? জুভান ভাবলো। কিন্তু এই ভাবনার সমাধান স্বরূপ এক আকাশ শূন্যতা পেলো। শুধু এবং শুধুই শূন্যতা।
#চলবে