ইতির সংসার পর্ব-১৫

0
220

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ১৫

-“তুলি আমাদের বিয়েটা ভালোবাসার বিয়ে না সেটা তুইও জানিস, আমিও জানি। অন্তত আমার দিক থেকে তোর জন্য ভালোবাসা নাই। ছোট থেকেই তোকে বোনের মতো দেখে আসছি। নাঈমের বোনকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা আমার কাছে কুরুচিপূর্ণ মনে হইছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমি শুধু চাই নাঈম ভালো থাকুক। আমার শর্ত হল তুই বিয়ের পরে একবারের জন্যও সামান্য কারণেও ভাবির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবিনা। তুই হয়তো বুঝিস না বা খেয়াল করিস না নাঈম ভাবিকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তোর প্রতি অন্ধ ভালোবাসার জন্য কষ্ট পেলেও কিছু বলতে পারেনা। মানসিক চাপে থাকে। একদিন হয়তো এমন মানসিক চাপেই তোর ভাই মরবে। আরেকবার তোকে ক্লিয়ার করে দেই আমি ভালোবেসে তোকে বিয়ে করছিনা। নাঈমের চিন্তা ও কষ্ট কমাতে তোকে বিয়ে করছি। কিন্তু যদি দেখি বিয়ের পরেও নাঈমের কষ্ট যেমন তেমনই আছে তাহলে তোকে ডিভোর্স দিতে দ্বিতীয়বার ভাববোনা। আর যদি তুই নিজেকে শুধরে নিতে পারিস, আমার লক্ষী বউ হতে পারিস তাহলে তোকেও আমি ইউকে নেয়ার ব্যবস্থা করব। ভেবে দেখ কি করবি? আমার এই শর্তে যদি রাজি থাকিস তাহলে বল, পরশু আমাদের বিয়ে হবে। রাজি না থাকলে সেটাও জানা, বিয়েটা হবে না। শপিং যা করছিস তা তোর বিয়ের গিফট হিসেবে রেখে দিবি। আমার কথা শেষ।” ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে মুরাদ।

-“আমি রাজি কিনা তা এখনই জানাতে হবে? চিন্তাভাবনা করার সময় পাবোনা?” বলে তুলি।

-“না বাসায় গিয়ে চিন্তাভাবনা করে ম্যাসেজ দিস। আমি কল দেব।” মুরাদ জানায়।

পাশের টেবিলে বসা নাঈমের মন খারাপ। ইতির হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলে -“আজ আমার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে জানো। সেই ছোট্ট তুলি, আমার তুলতুলি এখন আর কিছু সময় পরে হয়ে যাবে অন্য বাড়ির বউ। আমার আর কোন অধিকার থাকবেনা ওর উপর। আমি কিভাবে থাকব বল? এখনই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি এই আনন্দ নিয়ে যে তোমাদের মুখ দেখব। এখন থেকে তো আর তুলিকে দেখব না। আমি কেমন করে থাকব বল?”

-“আমি যখন তোমার সাথে বিয়ে হয়ে চলে এলাম তখন আমার মা বাবার অবস্থা টা একবার ভাবো। আমি একা। এখন বাসায় আম্মু আব্বু ছাড়া কেউ নাই। তাহলে খালি বাসায় তাদের কেমন লাগে ভাবো একবার। কি করবা বল? এটাই জগতের নিয়ম। তাও তো তুলি বিয়ের পরে এখানেই থাকছে আমাদের সাথে। কিছুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে দেখিও।” নাঈমকে বলে ইতি। -“তুলি যাচ্ছে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের ঘরে আর আমি এসেছিলাম সম্পুর্ন নতুন পরিবেশে। আমার সাথে কম্পেয়ার করলে তুলি অনেক বেশি লাকী জানো? কারণ তুলির একটা বড় ভাই আছে তোমার মতো যে তাকে সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসে। আমার সারাজীবনের দুঃখ আমার একটা বড় ভাই নাই। এটা এমন একটা দুঃখ যেটা কেউই ঘুচাতে পারবেনা।”

ওরা খেয়ে বাসার জন্য খাবার প্যাক করে নিয়ে যায়। তুলি বাসায় গিয়ে মুরাদের বলা কথাগুলো ওর মা কে জানায়। নাজমা বেগম শুনে দাঁত পিষতে শুরু করেন, পারলে ইতিকে রাখেন সেই দাঁতের নিচে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিন্তা করে তিনি মেয়েকে বলেন -“মুরাদকে কল দিয়ে জানা তুই ওর শর্তে রাজি। বাকিটা আমি দেখছি।”

তুলি মায়ের কথামতো মুরাদকে জানায় সে তার শর্তে রাজি।

পরের শুক্রবার জুমার নামাজের পরেই বিয়ে পড়ানো হয় মুরাদ ও তুলির। তার আগেই নাজমা বেগম কাজিকে হাত করে দেনমোহরের টাকা নিয়ে দুই নম্বরি করতে। দশ লাখ টাকা মোহর ধরে বিয়ে পড়ানো হয়, ৫ লাখ উসুল ও বাকিটা বাকি দেখিয়ে। কিন্তু নাজমা বেগমের হস্তক্ষেপে সবার স্বাক্ষর হবার পরে দশ লাখ হয়ে যায় এক কোটি। ব্যাপারটা জানল শুধু কাজি আর নাজমা বেগম।

বিয়ের পরে সন্ধ্যায় তারা স্থানীয় পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনার করে তিন পরিবার মিলে। মুরাদের, নাঈমের আর ইতির পরিবার। ডিনার শেষে ইতি ও নাঈম মিলে মুরাদ ও তুলিকে পৌঁছে দেয় ওদের জন্য বুক করে রাখা হানিমুন স্যুইটে।

পরদিন অনেক সকালে ইতি ঘুম থেকে উঠে নিজের থেকে নানারকম নাস্তা তৈরি করে দুইটা করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে। নাজমা বেগম ঘুম থেকে উঠে এতোকিছু দেখে চিৎকার করে বলে উঠেন -“আমার বাসা খালি হয়ে গেছে আর এই সুযোগে মহারানী এক গাদা খাবার রেডি করছে মায়ের বাড়ি পাঠানোর জন্য। সাহস কত বড়?”

ইতি ওর শাশুড়ির আচরণে অবাক হতেও ভুলে যায়। চুপচাপ খাবার গোছানো শেষ করে হাত মুছে শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে বলে -“আপনার কাছেই শুনেছি মেয়ের বিয়ের পরেরদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নাস্তা পাঠাতে হয়, এটাই ট্রাডিশন। নিজেই বলে নিজেই ভুলে গেছেন? নাকি এই ট্রাডিশন শুধু আমার বাবামায়ের জন্যই প্রযোজ্য ছিল? আপনারই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর জন্য ঘুম নষ্ট করে খাবার বানাইছি, বক্সে তুলেও দিছি। এখন আপনি ট্রাডিশন রক্ষা করবেন কি করবেন না তা আপনার ব্যাপার।”

আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে রুমে গিয়ে নাঈমকে ঘুম থেকে তুলে দেয়। ওকে রেডি হয়ে তুলিদের জন্য নাস্তা নিয়ে যেতে বলে। ইতি ভেবেছিল দুই বক্স করে প্যাক করেছে, একটা শাশুড়ির সাথে উনার বেয়ানবাড়িতে পাঠিয়ে আরেকটা নিয়ে সে আর নাঈম যাবে তুলির ওখানে, একসাথে নাস্তা করবে। কিন্তু শাশুড়ির কথায় মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। নিজের থেকে উঠে নাস্তা বানানোর জন্য রাগ লাগে নিজের উপর। সেইজন্য সে কিছুই না খেয়ে আবারও শুয়ে পড়ে।

নাঈম হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে ইতিকে ডাকে সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু ইতি বলে অনেক সকালে ঘুম নষ্ট করে উঠে খাবার বানাইছি, এখন ঘুম পাচ্ছে। নাঈম আর জেদ করেনা, ইতিকে ঘুমাতে দিয়ে রুমের বাইরে বের হয়। বাইরে এসে দেখে ডাইনিং টেবিলে খুব সুন্দর করে দুইটা পার্সেল রেডি করা। নাঈম বের হতেই ওর মাবাবাও বের হয়ে আসে ডাইনিং এ। একটা নিয়ে নাঈম চলে যায় আরেকটা নিয়ে ওর মায়েরা।

বেলা ১২টার দিকে নাঈম ফিরে এসে জানায় ওর মা বাবা আজ বেয়ানবাড়িতেই লাঞ্চ করে আসবে। তখন ইতির ইচ্ছে করে ওর মায়ের কাছে যাওয়ার, নাঈমকে বলতেই রাজি হয়ে যায়। ইতি ওর মাকে কল দিয়ে জানায় ওরা আসছে। খুশি হন উনি। ওরা দুজন রেডি হয়ে বের হয়।
বিকেলে নাজমা বেগম ফিরে জানান মুরাদের ইচ্ছে ওর যাওয়া পর্যন্ত তুলি ওই বাসাতেই থাকবে। ওর শাশুড়িও এটাই চান। ইতি আর নাঈম যেন তুলির জিনিসপত্র দিয়ে আসে। ইতি শাশুড়িকে সামনে বসিয়ে তুলির সবকিছু গুছিয়ে নেয়। যাওয়ার আগে চট করে তুলির পছন্দের দুইটা আইটেম রান্না করে বক্সে ভরে নেয়। নাজমা বেগম দেখেন, মনে মনে খুশিও হন কিন্তু মুখে কিছু বলেন না।

ইতি আর নাঈম মুরাদের বাসায় গিয়ে দেখে তুলি ড্রইংরুমে বসে আছে কাতান শাড়ি ও গা ভরা গয়না পরে। ভাইকে দেখে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে, মুরাদের ভয়ে ইতিকেও জড়িয়ে ধরে। কুশল বিনিময় করে বসার পরে ইতি বক্স দুইটা বের করে খাদিজা বেগমের হাতে দিয়ে বলে -“আন্টি তুলির পছন্দের খাবার করলাম তাই নিয়ে এলাম একটু। যদিও জানি এই বাসায় তুলি পছন্দ অপছন্দ মাথায় রাখা হবে।”

খাদিজা বেগম খুশি হয়ে যান ইতির ননদের প্রতি ভালোবাসায়। বলেন -“আমাদের তুলি আসলেই অনেক লাকী তোমার মতো একটা ভাবি পেয়ে যে তাকে বোনের মতো আগলে রাখে। নাজমা আপাও লাকী তোমার মতো বউ পেয়ে। এখন দেখা যাক আমার ভাগ্য কেমন হয়।”

ইতি তুলির জিনিসপত্র ওকে বুঝিয়ে দিতে যেতেই ও সবার অলক্ষ্যে দাঁতে দাঁত পিষে বলে………….
চলবে
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ