ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৪৭

0
2

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–47

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট থেকে পরবর্তী গন্তব্যস্থল ছিলো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। ট্যুর গ্রুপের সকলের সঙ্গে বেলা বারোটায় হাল্কা নাস্তা-পানি সেড়ে, সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে সিলেটের ভেতরে তাদের হোটেল ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়৷ আয়নাকে নিয়ে এমন রোলার কষ্টারের মতো ঘুরাঘুরি করা ঠিক হবে না তাদের। ওর রিল্যাক্স দরকার। দুপুর থেকে বাকি সময়টা রেস্টে থাকবে এরপর আগামীকাল জাফলং ঘুরে রাতের বাসে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হবে। আয়নাকে এখন বিশ্রামে রাখা ঠিক বলে মনে করে সে।

সে হোটেলে ফিরে যাওয়ার আগে পিউ আলিয়াকে পইপই করে সাবধানে থাকার নির্দেশ দিলো। শ্রাবণকে দায়িত্ব দিলো ওদের দেখে রাখার জন্য। শ্রাবণ আশ্বাস দিলো ওদের দুজনকে চোখে চোখেই রাখবে। টেনশন নিতে হবে না।

আয়নাকে নিয়ে আরেকটা প্রাইভেট কারে করে দুজনে রওনা হয়। সাদা পাথর যেতে না পারায় আয়নার বুঝি মন খারাপ হয় কিন্তু ও- নিজেও ক্লান্ত। ওর এখন বিশ্রাম দরকার এজন্য আর জেদ ধরে না। গাড়িতেই দুচোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে তার৷ সিলেটে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভর দুপুর। হোটেলের ধারে নেমেই সমুদ্র খাবার অর্ডার দিয়ে উপরে উঠে। আয়নার রুম আলাদা, তার রুম আলাদা। আয়নাকে ওর রুমে রেখে, নিজের রুমে আসে। দরজার লক খুলে গোসল সেড়ে, কিছুক্ষণ ফোনে ঘাটাঘাটি করে আয়নার দুপুরের ঔষধ গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা দিল আয়নার রুমের উদ্দেশ্যে। আয়নার সঙ্গে আলিয়া আর পিউ থাকবে। ওদের রুমের চাবি আছেই তার কাছে। চাবি দিয়ে হোটেল রুমের লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখে আয়না মাত্র স্নান সেরে বেরিয়েছে। ভেজা চুলগুলো থেকে পানি টপটপ করে পরছে মেঝেতে। সাদা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। ওকে এই মুহূর্তে জীবন্ত বেলী ফুল বলে মনে হয়। যার সুবাস সারা ঘরময় মোমো করছে। সমুদ্রকে দেখতে পেয়ে ও পিলে চমকে উঠে। হয়তো ভাবেনি ও বিনা অনুমতিতে এসে পড়বে। পারলে এক জোর গলায় বলে, ” আপনি! আমার রুমে কী করছেন?”

সমুদ্র পকেটে হাত গুজে ভ্রু কুচকে বলে, ” তুমি দেখি আমার কথা একেবারেই সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছো?”

আয়না ভারী বিব্রতবোধ করে বলে, ” কোন কথা?”

–” আমাকে তোমার বয়ফ্রেন্ড ভাবতে শুরু করলে নাকি আয়ুজান?”

–” না তো আপনাকে কেন বয়ফ্রেন্ড ভাবতে যাবো? আজব!

–” তাহলে স্বামী ভাবো তো? ”

–” বিরক্তিকর লোক আপনি! ”

–” আমার আয়ুজানের বিরক্তিকর লোক, ঠিক আছে তো?”

–” আয়ুজান কাকে বললেন?”

–” অবশ্যই তোমাকে।”

আয়না অন্যদিকে যেতে ধরলে সমুদ্র ওর পথ আটকিয়ে বলে, ” এই অবেলায় গোসল করেছো। ঠিকঠাক চুলও মুছোনি। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। দেখি টাওয়াল দেও। আমি চুল মুছিয়ে দিই।”

সমুদ্র টাওয়াল এগিয়ে নিয়ে যেতে ধরলে আচমকা আয়নার আচরণ কেমন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। চোখে করুনতা ও ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ পায়। সে সমুদ্রের হাত এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে চেচিয়ে উঠে বলে, ” আপনার সিমপ্যাথি আমার লাগবে না। এখন কেন এতো যত্ন নিচ্ছেন? আমি পাগল হয়ে গেছি এজন্য মায়া হচ্ছে? পাগল বউয়ের উপর দরদ উতলাচ্ছে? আগে তো আপনার কাছে ভিক্ষা চেয়েও এক সেকেন্ড সময়ও পাই নি। আমার আপনার যত্ন-আত্তি কিছু লাগবে না। চলে যান আপনি। আমি পাগল হয়ে গেলে ঠিকই আপনি আরেকটা বিয়ে করে নিবেন।”

সমুদ্র একদম চুপ থেকে ওর কথাগুলো শুনলো। কোনো রিয়্যাকশন দেখালো না৷ পালটা কিছু বললে ও আরোও বেশি উত্তেজিত হয়ে যাবে। ওর স্বাস্থ্যের জন্য যা ভালো নয়। আয়নার মেন্টাল কন্ডিশন নাজুক অবস্থায় আছে, মেডিসিন চলছে। হুটহাট উত্তেজিত হওয়া অস্বাভাবিক না। ওকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে হবে।

আয়না এতো কড়া কড়া কথা বলে হাপাতে থাকে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে, চোখে পানিও চলে এলো, কান্নাও চলে আসে তার। তাও বলে, ” আপনার চেহারা দেখতে চাই না। যান আপনি! ”

সমুদ্র মুচকি হেসে ওকে হোটেল রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, ” আচ্ছা জান, চেহারা দেখা লাগবে না। তুমি বরং প্রতিবিম্ব দেখো কেমন! ”

এরপর আপনমনে আয়নার চুল থেকে পানি মুছে দিয়ে এক গোছা চুল হাতে নিয়ে নিজের নাকের সামনে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে বলে, ” শ্যাম্পুর গন্ধটা দারুণ।”

আয়না একদম চুপ বনে যায়। থ হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সবকিছুতে ক্লান্তি ভাব কাজ করতে থাকে তার। একটু আগের করা রাগারাগির জন্য তার আফসোস হচ্ছে। নিজের রাগ-ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। হুট করেই খুব উত্তেজিত অনুভব করে। সে সমুদ্রকে ড্রেসিং টেবিলের মিরোর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। গুণগুণ করে গান গাচ্ছিল আর আয়নার চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিচ্ছে। এক গাছি চুল নিজের মুখের দিকে ধরে আয়নার শ্যাম্পু করা চুলে চু-মু খায়। সে হতভম্ব হয়ে ওর প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ বড়বড় হয়ে আসে।
সুধালো, ” আজ পর্যন্ত কাউকে দেখেছেন কাউকে চুলে চু–মু দিতে ?”

–” বউয়ের চুল জন্য দিলাম। আমি আমার বউয়ের চুলে চু মু দেওয়া প্রথম পুরুষ হিসেবে নাহয় গিনেস বুকে নাম উঠালাম।”

সমুদ্র দুপুরে কাচ্চি অর্ডার করেছিলো, অল্প কিছু খেয়ে মেডিসিন নিয়ে আয়না শুয়ে পড়ে বিছানায়। সমুদ্র একটু পর তার কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” আরাম করে ঘুমাও। সন্ধ্যা অব্দি।”

এরপর পাগল ছেলেটা এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটালো৷ আয়না পায়ের পাতায় পাতা ও পায়ের গোড়ালি তে মালিশ করে দিতে শুরু করে। ও কি করে বুঝলো আয়নার পা ব্যথা করছিল? আয়না আরামে ঘুমে ঢুলে পড়ে হয়তো ঔষধের রিয়্যাকশন হচ্ছিলো। আয়না গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গে সূর্য ডোবার পর। চোখ মেলে সে একটা আড়মোড়া ভাঙল। সমস্ত ক্লান্তি ছাপিয়ে শরীরে সতেজতা এসে ভীড় জমিয়েছে৷ নিজের পেটের উপর ভারী কিছু অনুভব করতেই খেয়াল হলো সমুদ্র তার পাশে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে দুজনে অনেক কাছাকাছি এসে গেছে। কাচ্চি খেলে সমুদ্রের ঘুম ভালো হয়। কী নিষ্পাপ ওর চেহারা। আরাম করে ঘুমাচ্ছে। আয়না অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর চুলে পরম যত্নে হাত বুলায়। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সমুদ্রের ঘুম ভাঙ্গে। সমুদ্র আয়নার কপালে ঠোঁট ছু’ইয়ে দেয়। নিশ্চুপ থাকে আয়ু।

–” আরোও ঘুমাবে আয়ু?”

–” না। আমি বাইরে ঘুরতে যাবো।”

সমুদ্র হাল্কা হেসে বলে, ” আচ্ছা। রেডি হও।”

আয়না মুহুর্তের মধ্যে উঠে রেডি হতে চলে গেলো। একটু পর নীল রঙের একটা সুতির কাজ করা কুর্তি পরে বেরিয়ে এসে, নিজে থেকে হাল্কা সাজ-গোছ করে। সমুদ্র ওকে নিয়ে সিলেট শহরের মধ্যেই হোটেলের আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করতে বের হয়। হোটেল লোবিতে একজন স্টাফ জানালো একটু সামনেই নাকি মেলা বসেছে। আয়না বায়না ধরলো ও মেলায় যাবে। সমুদ্র তাকে ইচ্ছা করে তাকে সাদা পাথর ঘুরতে যাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে এজন্য এখন মেলায় নিয়ে গিয়ে সেটা পুষিয়ে দিতে হবে। অগত্যা একটা রিকশা ঠিক করে মেলার দিকে যায়। রিকশায় আয়নার কোমড় ধরে বসে সে। সিলেটে নভেম্বরের দিকে ভালোই শীত পড়েছে৷ আয়না কাঁপতে থাকে। পাতলা সুতির ওড়নায় শীত কাবু হচ্ছে না৷

ওকে শীতে জুবুথুবু হতে দেখে সমুদ্র সুধালো, ” সোয়েটার পরে এলে না কেনাও?”

–” ইচ্ছা নাই তাই। আপনার সমস্যা কী?”

ওর এমন ট্যারা জবাবের বিপরীতে সে কিছু না বলে নিজের গা থেকে ওইদিনের কালো জ্যাকেটটা খুলে পুনরায় ওকে দিলো। আয়না যেন এটারই অপেক্ষায় ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে দিলো। মেলার প্রবেশ পথে রিকশা থামানো হলো। মেলায় ভীড় আছে ভালোই। ভেতর থেকে নাগরদোলা দেখা যাচ্ছে। গান চলছে মনে হয়।

আয়না বলে, ” আমি নাগরদোলায় উঠব।”

সমুদ্র ভাড়া মিটিয়ে ওকে নিয়ে মেলায় প্রবেশ করলো। হরেক রকম শীতের পিঠা-পুলির স্টল বসেছে। একজন আবার মোমোর দোকান দিয়েছে। মোমোর দোকানে ভীড় বেশি। মেলার মাঝে উম্মুক্ত মঞ্চ। পাশেই বায়োস্কোপ নিয়ে বসেছে। সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে বায়োস্কোপের দিকে ছু’টে।

বায়োস্কোপ দেখেই সমুদ্র আয়নার কানে ফিসফিস করে বলে, ” তোমার বাড়ির রঙের মেলায়
দেখেছিলাম বায়োস্কোপ
বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না
বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না।”

ও বড্ড সুন্দর গায়। দু’টো লাইন কানে কানে গাইলো তাতেই কেমন মোহগ্রস্ত লাগে৷ গায়কের মায়ায় পড়ে যেতে ইচ্ছে করে। সমুদ্র গান থামিয়ে বলে, ” বায়োস্কোপের নেশা তো ছাই। তুমি সিগারেটের নেশার চেয়েও বেশি তীব্র।”

আয়নার ওর কথাগুলো বড্ড ভালো লাগে। সত্য বলতে ও সবসময়ই এমন সমুদ্র কেই চাইতো। যে ওকে ভালোবাসবে। সুন্দর করে নকশিকাঁথার সেলাইয়ের ভাঁজের মতো ভালোবাসা প্রকাশ করবে। কেবল দায়িত্ব হতে চায় নি সে!

আয়নাকে নিয়ে বায়োস্কোপ দেখতে বসে ও। বায়োস্কোপ দেখার সময় ঘণ্টা বাজার মতো আওয়াজ করে৷ পর্দায় পদ্মা সেতুর ছবি ভাসে। শাপলা ফুলের ছবি আসে। আয়না এসব দেখে হাসতে হাসতে উঠে পড়ে।

সমুদ্র ওকে নিয়ে অন্যদিকে, নাগরদোলার দিকে হাঁটা দেয়। নাগরদোলায় দিকে ভীড় নেই। কেবল তারা দু’জন উঠে। একটা আসনে বসে, কাঠের হ্যান্ডেল ধরতেই লোকটা নাগরদোলায় ঠেলা মারে অল্প একটু সময়ের ব্যবধানে তাদের আসন একদ। উপরে উড়ে যায়। আয়না ভয় পায়। সমুদ্রের শার্ট আকড়ে ধরে বলে, ” সমুদ্র, নাগরদোলা থামাতে বলেন৷ আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। ”

তখনই মুহুর্তের মধ্যে নাগরদোলা পুনরায় নিচে নামে আবার উপরে উঠে আসে। আয়না চিৎকার দেয় ভয়ে৷ সমুদ্রের বুকে কিল-ঘুষি সব মারতে মারতে বলে, ” থামাতে বলেন প্লিজ।”

–” তোমার না নাগরদোলায় ওঠার ইচ্ছা ছিলো!”

–” ইচ্ছা পালিয়ে গেছে। থামাতে বলেন প্লিজ। এই মামা থামান। ”

নাগরদোলা নিচে নামে আবার ও ভয়ে চিৎকার দেয়। সমুদ্র ওকে ধরে বলে, ” এক শর্তে থামাবো। মানবে সে শর্ত?”

–” কী?”

–” আমাকে আজ থেকে তুমি বলে ডাকবা। এসব আপনি-টাপনি আর না।”

–” থামাতে বলেন আগে প্লিজ।”

–” উহু সে থামাতে বলো।”

আয়না ভয়ে জড়সড় হয়ে বলে, ” তোমার মতো ফাযিল লোক আমি জীবনে একটাও দেখি নি।”

সমুদ্র তখনই লোকটাকে ইশারা করে বলে, ” আপনার ভাবী ভয় পাচ্ছে। নামায় দেন ভাই।”

লোকটা নাগরদোলার গতি কমিয়ে আস্তে করে থামিয়ে দেয়। আয়না নেমে হাপাতে থাকে৷ সমুদ্র হেসে ওকে ব্যঙ্গ করে বলে, ” তোমাকে নিয়ে রোলার কষ্টারে উঠবো একদিন। ”

সমুদ্র হাসিতে আয়নাত পিত্তি জ্বলে যায়। ও রাগ করে সমুদ্র কে ফেলে একা হাঁটা দেয়। সমুদ্র তাজ্জব বনে যায়। আয়নাকে অনুসরণ করে হেঁটে যেতে যেতে বিড়বিড় করে, ” মাইয়া মানুষের মনের দিক বুঝার জন্য একটা কম্পাস আবিষ্কার করা লাগবে। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের পরিবর্তনে থাকবে, রাগ-অল্প রাগ, বেশি রাগ-মধ্যম রাগ।”

আয়না আগে আগে হাঁটছিলো আর স্টল গুলো ঘুরে দেখছিল। চুড়ির স্টলের দিকে আসতেই মহিলা আয়না-সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” ভাবীজানের হাত মাশাল্লাহ কী সুন্দর! ”

সমুদ্র বলে, ” আমার বউয়ের চুলের গোড়া থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটাই সুন্দর।”

–” ভাবীজানের হাতে লাল চুড়ি খুব মানাইবো ভাই
ভাবীর হাত চুড়ি দিয়া ভরায় দেন।”

সমুদ্র এক ডজন লাল কাঁচের রেশমি চুড়ি খুব যত্ন নিয়ে পড়িয়ে দেয়। ডান-বাম দুই হাতেই লাল চুড়ি পড়িয়ে দেয় খুব যত্ন করে।

চূড়ির দোকানদার মহিলা বলে, ” ভাই ভাবীজানরে খুব সোহাগ করেন তাই না?”

সমুদ্র আয়নার দিকে তাকায় এবং ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “বুকের ভেতর পুষা রাখা সব ভালোবাসা ওর নামেই বরাদ্দকৃত। আফটার ওল, আমার একটাই বউ। একমাত্র বউকে বেশি বেশি ভালোবাসবো নাতো কী!”

সেদিন রাত আটটায় মেলা থেকে ফিরে হোটেলে আসে তারা। পরেরদিন জাফলং ঘুরে দেখে। রাতের বাসে ঢাকা ব্যাক করে। ভোরবেলা ঢাকা পৌঁছালে সমুদ্রের ধারণা ছিলো আয়না বুঝি এবার তার ফাঁকা ঘর, শূন্য বুকে ফিরবে। কিন্তু তাকে অবাক করে আয়না নিজের বাবার বাসায় চলে গেলো। সমুদ্রের মন ছোট হয়ে আসে। মুখটা কালো হয়ে যায়। কেন যেন মনে কু ডাকে। মন বলে এই দূরত্ব আর ঘুঁচবে না। কিন্তু আয়ুকে সে কোনোভাবেই নিজের জীবন থেকে যেতে দিবে না।

______________________

ঢাকায় ফিরে আয়না-আলিয়া জানতে পারে শায়লা চৌধুরী নিজের নারায়ণগঞ্জ বাসায় পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যথা পেয়েছেন। হাটতেও সমস্যা হচ্ছে। একপ্রকার বিছানায় পড়ে আছেন। কিন্তু তবুও তাদের বাবার মায়া-দয়া হচ্ছে না। কারো মায়া নাহলেও আয়নার মায়া হয়। এইরকম অসুস্থতার দিনের যন্ত্রণা তাকে পীড়া দেয়। ওর ইচ্ছা হয় শায়লা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার। সিলেট থেকে ফেরার পরেরদিনই আয়না নারায়ণগঞ্জ যায়। শায়লা চৌধুরীর সুন্দর সেই বাসাটাতে। সঙ্গে আলিয়াও যায় আপার সাথে। ওরা দুই বোন আসায় শায়লা খুব খুশি হয়৷ ওদের দুইবোনকে নিয়ে নিজের রুমে অনেক গল্প করেন। নিজের দুঃখের দিনের গল্প শুনান যেগুলো কোনোদিন বলেন নি তিনি। শায়লা চৌধুরী জীবনের একটা পর্যায়ে টাকার অভাবে ভুগেছেন। সেজন্য কমবয়সী থাকতেই বিয়ে হয়। তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন নাকি খুব অত্যাচার করত। আয়না-আলিয়া দুজনেরই ওনার দুঃখী জীবনের কথা শুনে খারাপ লাগে। ভদ্রমহিলা আবার একটু কাঁদলেন ও। আয়না বেশ ভড়কে গেলো। ওনাকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে দু’বোন ভেবে পায় না।

তারপর হুট করে উনি আয়নার হাত ধরে বলে, ” আয়ু মা, আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি।”

আয়না ক্ষণেই চমকে উঠে বলে, ” কি এমন করেছেন যে এখন কাঁদতে হচ্ছে?”

উনি আয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমি তোমার সংসার ভাঙ্গে বসেছিলাম কিন্তু দেখো ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আমারই সংসার ভাঙ্গার পথে।”

আয়না বিচলিত হয়ে যায়। কি বলছেন উনি? শায়লা চৌধুরী তো তার বিয়ের ঘটক। উনি কেন বিয়ে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করবেন?

শায়লা থেমে থেমে বলে, ” সমুদ্র কে আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে চিনি। ইউশার সঙ্গে ওর সম্পর্ক, ব্রেক আপের খবর সবই জানি। ইউশা যখন ওকে প্রতরণা করে বেচারার বেহাল দশাও আমি নিজ চোখে দেখেছি। তারপরও আমি তোমার সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব দিই।”

–” ইউশা সমুদ্র কে চিট করেছিলো?”

–” সেকি! তুমি জানো না? সমুদ্র বলে নি কিছু? ”

–” না।”

–” ইউশা ওদের হাসপাতালের আরেক এস্টাব্লিশ ডক্টরের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে যায়। সমুদ্রকে চিট করে ওই ডক্টরের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে। একারণেই বিচ্ছেদ হয়।”

আয়না থমথমে মুখ নিয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে। ইউশা তাহলে চিট করেছিলো সমুদ্র কে!

শায়লা আরোও যোগ করলেন, ” তুমি আর সমুদ্র যেদিন আমার বাসায় এলে। তোমার বাবার বিয়ের কথা জানতে পেরে, হয়তো তোমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিলো। তুমি সকালে আগেভাগে চলে গেলে, আমি সমুদ্র কে সকালবেলা একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম।”

–” কী বলেছিলেন?’

–” বিয়ের সাতদিনের অন্তর তুমি ডিভোর্স চাও। এসব নিয়ে ফাহাদের সঙ্গে আলাপ করেছো। ডিভোর্সের কথা শুনে সমুদ্র অনেক বেশি আহত হয়েছিলো। আই এম সর‍্যি মা। আমার তোমার প্রতি প্রচুর ক্ষোভ ছিলো। সেজন্য রাগের বশে তোমার ক্ষতি চাইতাম কিন্তু আমি কল্পনাও করি নি, আমার অসুস্থতায় সবার আগে তুমি আসবে আমাকে দেখতে। আমি হয়তো আমার পাপের শাস্তি পাবো। একাই কাটাতে হবে বাকি জীবন। তোমার বাবা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে না। হয়তো দ্বিতীয় সংসার ও আমার ভাগ্যে জুটবে না। তবে, তুমি আমার অসুস্থতার কথা শুনে এসেছো আমি এতেই অবাক খুশি।”

আয়না নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আলিয়া হতভম্ব শায়লার কথা শুনে।মহিলার মনে এতো বিষ ছিলো? কই মধুর বাণীর তোপে বোঝাই দুষ্কর ছিলো।

শায়লা করুন গলায় বলে, ” তোমার সংসার সুখের হোক আয়না। সমুদ্র খুব ভালো। খুব ভালো পরিবারের ছেলে। অনেক ভালো স্বামী ও। তোমার অসুস্থতায় ছায়ার মতো তোমার পাশে ছিলো। হাজার ক্লান্তি নিয়েও বিনা অভিযোগ করে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই তোমার সেবা করে গেছে। তোমরা খুব সুখী হও।”

সেদিন শায়লা আন্টির বাসা থেকে ফিরতি পথে সেই দিনকার ওই টংয়ের দোকানটার কথা মনে পড়ে আয়নার। সমুদ্রকে খুব মিস করে ও। আপনা-আপনি দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরে। সমুদ্র কে ও অনেক ভুল বুঝেছে। ভাবতো সমুদ্র নিশ্চয়ই ইউশার সময় এক্সট্রা ম্যাটেরিয়াল এফেয়ারে জড়িয়েছে। কতো কটু কথাই মা শুনিয়েছে ওকে! আয়নার মনে হলো, সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটা উচিত। সমুদ্র কে ভুল বুঝে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে আর নয়। সংসারে দুঃখ-সুখ থাকবেই। সে ঠিক করলো কালকেই শ্বশুরবাড়ি যাবে৷

বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হলো। ফাহাদ সাহেব অফিসে গেছেন। শায়লা চৌধুরীর জন্য মায়া হলো। নারায়নগঞ্জে একা ফ্যামিলি ছাড়া অসুস্থ অবস্থায় আছে। বাবার উচিৎ ওনার সাথে থাকা বা ঢাকায় আনা ওনাকে। তবে আলিয়া দ্বিমত পোষণ করে বলে, ” ওই কুটনি মহিলার এভাবেই বিছানায় পড়ে থাকা উচিৎ। কেমন অসভ্য! আমার আপার সংসারে আগুন লাগাতে চায়।”

তবে আয়না প্রতিশোধ পরায়ণ হয় না। বিয়ের পর সে বুঝে সংসার কী জিনিস। প্রতিটি নারী ঘর-সংসার চায়। ঘরহীন নারী যেন পাখা বিহীন পাখির মতো অবলা। শায়লা চৌধুরীর জন্য তার মায়াই লাগে৷ মন থেকে আগের মতো আর ক্ষোভ জন্মায় না।

সে সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে সমুদ্র কে আজ অনেক দিন পর কল লাগায়। সমুদ্র দু’বার রিং বাজতেই কল রিসিভ করে বলে, ” আরেএএ আজ সূর্য ঠিক দিকে উঠেছে নাকি?”

–” কেনো ভুল হবে?”

–” মিসেস রহমান কল করেছে এ যেন অষ্টম আশ্চর্য!”

আয়না খুব হাসে। অনেকদিন পর মন খুলে হাসে। এরপর সুধালো, ” একটা কথা ছিলো।”

–” বলো?”

–” না, থাক। তুমি আজকে আমাদের বাসায় রাতে আসবে। আমি আজ রান্না করবো।”

–” আচ্ছা। আসবো। কিন্তু লেইট হবে। গাজীপুর এসেছি। সোজা মিসেস রহমানের কাছে চলে আসবো।”

–” আচ্ছা।”

–” এবার বলো কী বলতে চাইছিলে?”

–” আসো তারপর বলবো।”

–” বলে দাও কী বলবে। পরে যদি শুনতে না পারি।”

–” আসলেই বলবো আসো আগে।”

আয়না কল কেটে দিয়ে আজ রান্নাঘরে ঢুকে অনেককিছু রান্না করে। বিরিয়ানি, রোস্ট, সালাদ, সেমাই রান্না করলো। এসব সমুদ্রের পছন্দের খাবার৷

রাতে বাবা অফিস থেকে আসলো। সবাই ডিনার করে। আয়নার রান্নার প্রশংসা ও করে খুব। কিন্তু সমুদ্র আসে না। আয়না জানতো ওর লেইট হবে। কিন্তু এতো লেইট কেন হচ্ছে কে জানে। সে ডিনার না করে কেবল মেডিসিন নিল। সে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুম ভাব এসে যায়৷ অবচেতন মন বলে সমুদ্র আসছে। খুব কাছে তার। গাড়ির হর্ণ বাজছে, এইতো সমুদ্র এসে তাকে মিষ্টি করে আয়ুজান বলে ডাকলো। কিন্তু বাস্তবে সমুদ্রের অস্তিত্ব নেই। ঘুমের ঘোরেই সে চোখের জল ফেলে। সমুদ্র কী আবারো তাকে অবহেলা করবে?

_______________

রাতের আধারে সমুদ্রের প্রাইভেট কার ছু’টে যাচ্ছে। মহাসড়ক আজ কেমন থমথমে। অনেকগুলো ট্রাক আজ রাত বারোটার আগেই রাস্তায় নেমেছে৷ ট্রাক গুলো কেমন অনিয়মের মধ্য দিয়ে হাই স্পীডে ট্রাক টানছে। সমুদ্রের গাড়ির নাম্বার প্লেট **—- ঢাকা মেট্রো গ। সাদা রঙের গাড়িটা তিনটা ট্রাকের মাঝে পড়ে৷ সমুদ্র তখন ফোনে তাদের বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলো। গাড়ির হর্ণে শব্দে সে ড্রাইভার কে বলে, ” রক সাইড দিয়ে চালান গাড়ি। ট্রাকের সঙ্গে লাগতে যায়েন না।”

ড্রাইভার পাকনামি করে পরপর হর্ণ বাজিয়ে ট্রাকের মাঝ দিয়ে আগায় নিয়ে বলে, ” ভাইজান, আমরা তো ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করি নি।ওরা ভুলভাবে চালাচ্ছে। এমনে কেউ ট্রাক চালায়।”

ড্রাইভার কথা বলা শেষ না করতেই, পেছনে থেকে,গাড়ির বাম্পারে জোড়ে ট্রাক ধাক্কা মারে। দুটো পরিবহনই মহাসড়কে বেশ জোরগতি এগিয়ে চলছিলো। চলন্ত ছোট সাদা প্রাইভেট কার ট্রাকের ধাক্কা সামলাতে পারে না। একদম উলটে যায় রাস্তায় ধারে। প্রবল বেগে ঝাকির তোপে সমুদ্র টাল সামলাতে পারে না৷ মনে হচ্ছিলো ছিটকে পড়ে যাচ্ছে। চারপাশে ভয়ংকর অন্ধকার দেখে। নিজের হাত-পা, মাথা বেয়ে তরল আঠালো পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে। হুট করে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ হতে চলে। সে চায় না চোখ বন্ধ করতে, চোখ বুজলেই যে ধুধু আন্ধার। আদৌ এই আন্ধার থেকে মুক্তি পায়াওয়ার পথ খোলা থাকে?

কোথা থেকে যেন ধোঁয়া উড়ে। তীব্র ব্যথায় কুকিয়ে উঠে। তবে কী তার আয়ু শেষ? নিশ্বাস নেয় সে। চোখ বেয়ে পানি ফেটে পড়ে৷ অসহ্যনীয় ব্যথা৷ তাকে ছাড়া তার পরিবার কীভাবে বাঁচবে? আর আয়ু? আয়ু কী বলতে চাচ্ছিল তা কী এই ছোট্ট এক জীবনে না শুনেই তলিয়ে যাবে শেষ যাত্রার দিকে?

চোখ বুজে ফেলার আগ মুহুর্তে, ঠিক সমস্ত ইন্দ্রিয়, অঙ্গ থেমে যাওয়ার শেষ বেলায়, মস্তিষ্ক সুখ দেয় তাকে। মস্তিষ্ক সমস্ত ব্যথা ভুলিয়ে দিতে খুব সুন্দর একটা স্মৃতি স্মরণ করায়। মনের মানসপটে ভেসে উঠে চমৎকার এক বিকেল। সোনা রাঙ্গা রোদময় বিকেলে এসে থামে স্মৃতির চাকা।

গোলাপী শাড়ি পরা একটা মেয়ে তার চোখের সামনে পরিষ্কার এসে দাঁড়ালো। তার সামনে এসে ঝুঁকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছে। হুট করে মেয়েটার মাথা থেকে ঘোমটা সরে যায়। ওর ঘোমটা সরে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হওয়া চেহারা স্পষ্ট ভাসে চোখের সামনে। কি মিষ্টি সেই চেহারা। সমুদ্রর ওর লাল টকটকে গাল ছু’য়ে দিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। যেন মেয়েটা বাস্তবেই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ লেবুর শরবত ফেলে দিলো তার পায়ে। পা বেয়ে কেমন তরল আঠালো পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করে পুনরায়। হয়তো সাত মিনিট শেষ হয়ে আসে। সব আবছা দেখে ও। গোলাপী শাড়ি পরা তার মেয়েটাকেও অস্পষ্ট দেখে। কোথায় জানি হারিয়ে যায় ও। আদৌ মেয়েটা হারিয়ে যায় নাকি সমুদ্র তলিয়ে যায় বিশাল গহীন এক যাত্রাপথে। যেই যাত্রাপথে কেবল প্রবেশ পথ আছে। কিন্তু ফিরে আসার কোনো পথ নেই। ফিরে আসতে চাইলেও ফিরে আসা যায় না আপনজনদের কাছে। এতো দ্রত সেই সুবিশাল পথের পথিক হবে সে? ভাগ্যের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে লাভ নেই।

সমুদ্র আঁধো কাতর গলায় বলে, ” ভালো থেকো তুমি ।You are my seven minutes. ”

চলবে৷