#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৩
৭.
সরস্বতীর বিয়ে। বিয়ের দিন জেসমিন সকাল সকালই চলে গেছে ওদের বাড়ি। শহড় থেকে বেশ দূরে গ্রামের দিকে বাড়ি ওর। বাইকে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগে।অন্যান্য বান্ধবীদের সাথেই চলে গেছে জেসমিন। যাওয়ার পরই সরস্বতী আমাকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ রেগে যায়। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু সরস্বতী ফোন করে প্রচন্ড রাগারাগি করলো। আবার লোভও দেখালো ওদের বিয়েতে নাকি বেশ মজা হয়। এর আগে কখনো হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা হয়নি। নির্মল আমাকে রেডি হতে বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ঘন্টাখানেক বাদে এসেই দরজায় করাঘাত করতে শুরু করলো। সবে শাড়ির কুঁচি দিচ্ছি তখন এমন ভাবে করা নাড়ছে যে কান ফেটে যাচ্ছিলো। আবার তাড়াহুড়োয় ঠিকভাবে শাড়ি পড়তেও পারছিলাম না। রেগেমেগে চিৎকার করে বললাম,
-‘ তুমি চলে যাও আমি নির্ঝরকে বলবো আমায় পৌঁছে দিতে। তোমার ভীষণ তাড়া তাই তুমি যেতে পারো ‘।
-‘ বড় ভাইয়ের দিকে নজর পড়ে না শুধু ছোটটার দিকে নজর লুচু মাইয়া ‘।
-‘ ওরে আমার সাধু পুরুষ রে ‘।
-‘ সাধু তো হতেই চাইছি সুইটহার্ট সুযোগ টাই তো দিচ্ছো না ‘।
-‘ দেবোও না ‘।
আর কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। পুরো একঘন্টা সময় নিয়ে বেশ ভালোভাবে রেডি হয়ে বের হলাম। নির্মল তখন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সাদা পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোর্ট পড়া চোখে কালো চশমা, হাতে ঘড়ি, দেখতে কোন হিরোর থেকে কোন অংশে কম লাগছে না। মনে মনে একটু ভেঙচি কেটে দিলাম। আমাকে বের হতে দেখেই একহাত বুকের বা’পাশে চেপে ধরে আহত গলায় বলে ওঠলো,
-‘ ওহে পাষণ্ডময়ী এই নির্মল হৃদয়টা আর কতো আঘাতপ্রাপ্ত হবে? ওহে পাষণ্ডময়ী তোমার দিলে কি একটু দয়াও হয় না’?
-‘ ওহে দূর্বত্ত পুরুষ ঝাঁটার বাড়ি খেতে না চাইলে মুখটা বন্ধ রেখে চলো ‘। বলেই পাশ কাটাতে নিতেই আমার হাত টেনে ধরলো। আমি বিরক্ত হয়ে কড়া গলায় বললাম,
-‘ বের হওয়ার সময় এমন বেহায়াপনা না করলেই কি নয় ‘?
-‘ একটি বার কি প্রিয় সম্বোধন করা যায় না মোর প্রিয় ‘?
মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে মামির রুমে গিয়ে মামি কে বলে বেরিয়ে পড়লাম। বাইকে বসার পরও ওর সাথে কথা বলছিলাম না। রাস্তায় অনেক ছেলেমেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নির্মল সাদা পাঞ্জাবি আর আমি সাদা জরজেট শাড়ি যার জমিনে গোল্ডকালার চুমকি দিয়ে কারুকাজ করা ছিলো। শাড়িটা মামিরই নির্মলের ড্রেসআপের সাথে আমার ড্রেসআপের কালার ম্যাচ হওয়াতে অনেকেই আমাদের কাপল ভেবেই হা করে চেয়েছিলো। বিষয়টা নির্মল বেশ এনজয় করলেও আমি চরম বিরক্ত হচ্ছিলাম। ওর মিটিমিটি হাসিতে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো। সহ্য করতে না পেরে শেষে পিছন থেকে ওর চুল বেশ শক্ত করে টেনে ধরি। ব্যাথায় ও শুধু ‘আউচ’ করে ওঠে তবুও মুখের হাসি একটুর জন্যও উধাও হয়নি। ব্যার্থ হয়ে নিজেও হেসে ফেললাম। নির্মল গলা উঁচিয়ে বললো,
-‘ এই সাবা শাড়িতে তোমায় একদম হুরপরীর মতোন লাগে। সাদা শাড়িতে কোন রমণীকে এত্তো অস্থির লাগে তোমায় না দেখলে জানতেই পারতাম না। একদম শুভ্রময়ী আমার শুভ্রময়ী ‘।
আমি ওর পিঠে কিল দিয়ে বললাম,
-‘ ফাউল কথা বাদ দিয়ে চুপচাপ বাইক চালাও নয়তো লাফ দিবো ‘।
-‘ এই না জানেমান বিয়ের আগেই বিধবা হওয়ার শখ নেই আমার ‘।
.
আগে কখনো হিন্দু বিয়ে দেখিনি সেবারই প্রথম। বেশ এনজয় করেছি সরস্বতীর বিয়ে তে। সেই সাথে বিনোদনও নিয়েছি অনেক। এক ঝাঁক মেয়েরা এসে বেশ লটরপটর করার চেষ্টা করে নির্মলের সাথে। কিন্তু নির্মল তাঁদের পাত্তাই দেয়নি সব সময় আমার পিছু ঘুরঘুর করেছে আর বলেছে,
-‘ আহা আমি কত্তো ভালো হয়ে গেছি তবুও আমার প্রেয়সীর মন গলেনা ‘।
আমি ভেঙচি কেটে বলি,
-‘ এ জীবনে আর গলবেও না ‘।
বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময়। বিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলো। আকাশের অবস্থা ভীষণ করুণ। প্রকৃতি যেনো হুট করেই নিস্তব্ধ হয়ে শোক পালন করছে। যা হয়তো কিছু সময়ের ব্যবধানেই উচ্চধ্বনি বাজিয়ে, অশ্রুপাত ঘটাবে।
মামি বার বার করে বলে দিয়েছিলো সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে। অথচ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। বাইক স্টার্ট দেওয়ার দশমিনিটের মাথায়ই শুরু হলো উল্টাপাল্টা বাতাস। নির্মল সহ সামনে পিছনে সবগুলো বাইক থেকে সকলেই হৈহৈ করে ওঠলো। যেনো কোন অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটছে। আমি বিরক্ত হয়ে নির্মলের কাঁধে শক্ত করে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
-‘ ফাইজলামি করার বহুত টাইম আছে আপাতত সিরিয়াস হও বাসায় মামি একা আছে দ্রুত ফিরতে হবে আমাদের ‘।
নির্মল চেঁচিয়ে ওঠে বললো,
-‘ ইয়াহু সুইটহার্ট চারদিকে শশ শব্দে বাতাস বইছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকানোতে মনে হচ্ছে ইহা আমাকে প্রেমের আহ্বান জানাচ্ছে। আহা কি প্রেমময় অনুভূতি রোমান্স টোমান্স করো জান ‘।
-‘ তোমার মতো গর্দভই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রেমের অনুভূতিতে গুলিয়ে ফেলবে। আমার মাঝে মাঝে কনফিউশান হয় তুমি সুস্থ তো ‘?
-‘ উহুম প্রেমরোগে ভুগছি আমি ডাক্তারের হৃদয় বড় পাষাণ। সারাক্ষণ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ছটফট করি কালনাগিনী টা ফিরেও তাকায় না ‘।
কথাটা শোনামাএই রেগেমেগে ওর ঘাড় বরাবর কিল বসাতে যাবো তাঁর আগেই প্রচন্ড শব্দ করে বিদ্যুৎ চমকালো আর আমি ভয়ে আচমকাই ওর পেট শক্ত করে জড়িয়ে পিঠে মাথাটা শক্ত করে চেপে চোখ খিঁচে বসে রইলাম। ঝিরিঝিরি শব্দ করে বৃষ্টিরা নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। নির্মল বাইক থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। যখন বুঝতে পারলাম কি ঘটেছে লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছিলো। এদিকে বাতাসের তীব্র বেগ বৃষ্টির শীতল করা স্পর্শে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠলো। সকলের বাইক এগিয়ে গেছে পেছন পড়ে আছি আমি আর নির্মল। একহাত দিয়ে কপাল থেকে থুতনি অবদি পানি মুছে ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠলাম,
-‘ এসব কি ফাইজলামি মাঝপথে হা করে বসে আছো কেনো ‘?
-‘চারদিকে প্রেমের আলিঙ্গন কবে হবে তোমার আমার মিলন’
অমন একটা বিপর্যস্ত অবস্থায় উতলে ওঠা প্রেমময় বাক্য শুনে মেজাজ আমার তুঙ্গে ওঠে গেলো। ইচ্ছে রকম চড়,থাপ্পড়, কিল,দিতে শুরু করলাম। আর ও হাসতে হাসতে মাফ চেয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। কিন্তু খুব একটা এগোতে পারলো না। আমার মৃদু আর্তনাদে থেমে গেলো। চোখে কিছু পড়েছে আমার। দ্রুত বাইক থামিয়ে ওর বাটন ফোনের লাইট অন করে চোখটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো কিছু পেলোনা।কিন্তু চোখে কেমন ঘা দিচ্ছিলো আমার। হাতের তালুতে বৃষ্টির পানি জড়ো করে করে চোখে দিতে থাকলাম বেশ কিছু সময় পর চোখে আরামও পেলাম। ঝড়, বৃষ্টির মাএা যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলো। সেসময় বৃষ্টির সাথে পড়তে থাকলো বরফ টুকরো। শিলাবৃষ্টি শুরু হওয়ায় আর সম্ভব হলো না বাইক নিয়ে এগোনোর। আশেপাশে বাড়িও নেই কাঁচা রাস্তার দুপাশে চড়াক্ষেত। খানিকটা এগিয়ে দেখতে পেলাম একটি দোকান। নির্মল আর দেরি করলো না বাইক নিয়ে হেঁটে চলে গেলো দোকানের সামনে আমিও ওর পিছু পিছু গেলাম। টিনের বেড়া,টিনের চাল, দশ-বারো হাত লম্বা দোকানটি। ভিতরে এক বৃদ্ধ লোক কুপি জ্বালিয়ে বসেছিলো। বারান্দায় আমি আর নির্মল গিয়ে দাঁড়াই। একপাশে একটি বেঞ্চিতে তিনটে ছেলে বসে গল্প করছিলো। আমাদের দেখে একটি ছেলে টর্চ জ্বালিয়ে আমাদের দিকে ধরে নির্মলকে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি ভাইয়ে ভাবিকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলে নাকি ‘?
নির্মল আমাকে ওদের নজর থেকে আড়াল করে কিছু বলতে নিতেই আমি ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলাম,
-‘ ভাই না জেনে না শুনে আগেই কাউকে ভাবি বলা কি উচিত? আপনি আগে জেনে নেবেন না ওনার সাথে আমার ঠিক কি সম্পর্ক? তারপর না হয় মন্তব্য করবেন৷ আমি ওনার বউ নই তাই ভাবি বলার প্রশ্নই ওঠে না আপু বলতে পারেন ‘।
কথাগুলো বলার সময় নির্মল বেশ অস্থিরতার সাথে আমাকে চুপ করাতে চেয়েছে কিন্তু আমি চুপ করিনি। ছেলেগুলোও কেমন চোখে চেয়ে রইলো আমার কথা শুনে। আমি নির্মলের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ ঠান্ডা লাগছিলো জরজেট শাড়ি পড়েছি, চুপচুপে হয়ে ভিজেও গেছি। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছিলো। শাড়ির আঁচল টেনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নির্মল কে বললাম নির্ঝরকে ফোন করে জানাতে আমাদের পরিস্থিতি। কিন্তু নির্মল রক্তচক্ষু তে চেয়ে রইলো। আবছা আলোতে ওর মুখখানি দেখে বুঝতে পারলাম দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে হাত নেড়ে প্রশ্ন করলাম,
-‘ কি ব্যাপার কাহিনী কি মেজাজ গরম মনে হচ্ছে? খুব তো প্রেম প্রেম পাচ্ছিলো এখন কি ভয় লাগছে নাকি ‘? বলেই মুচকি হাসলাম। তখনো বুঝতে পারছিলাম না কতো বড় বিপদের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি আমরা।
সময় যেনো কাটছিলোই না৷ দোকানদার দাদু দোকানের ঝাপ নামিয়ে দিলেন। আমি খেয়াল করলাম তিনটে ছেলে কেমন চোখে যেনো তাকাচ্ছে বার বার। শুধু আমি না নির্মলও খেয়াল করছিলো। তাই আমাকে বার বার আড়ালে রাখার চেষ্টা করছিলো। একসময় বিদঘুটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে
গেলো। ছেলে গুলোর নোংরা দৃষ্টি বুঝতে খুব একটা সময় লাগলো না আমার। আমি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বার বার শাড়ির আঁচল টানা দেখে নির্মল আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বাইকের কাছে এগিয়ে গেলো। ছেলেগুলোর হাভভাব ভালো ঠেকছিলোনা বিধায়ই সিদ্ধান্ত নেয় ঝড়, বৃষ্টি মাথায় করেই ফিরবে৷ কিন্তু বাইকে ওঠতে পারিনা কেউই। ছেলেগুলোর মধ্যে একটা ছেলে আমার আঁচল টেনে ধরে৷ আমি ভয়ে আঁতকে ওঠে নির্মল বলে দেই এক চিৎকার। নির্মল সঙ্গে সঙ্গে ঐ ছেলেটির কলার চেপে ধরে। বাকি দুজন ছেলে আমার সাথে অসভ্যতামি শুরু করে দেয়। আমি রেগে ঠাশ করে ওদের একজনের গালে চড় বসিয়ে দেই। এদিকে নির্মলের সাথেও ওদের মারামারি লেগে যায়। শুরু হয়ে যায় বিশৃঙ্খল অবস্থা। কেয়ক মিনিটের ব্যবধানেই আরো দশ,বারোজন ছেলের উপস্থিতি ঘটে। তিনজনের সাথেই নির্মল পেড়ে ওঠছিলোনা। ছেলেগুলো আমার শরীরে নোংরাভাবে স্পর্শ করছিলো বারেবার। কোনভাবেই আটকাতে পারছিলোনা নির্মল তারওপর অতোগুলো ছেলে দেখে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেলো আমার। ভয়াবহ কিছু ঘটবে বা ঘটতে চলেছে বুঝতেই নির্মল বাঘের মতো গর্জে ওঠলো। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে ওদের থেকে ছাড়িয়ে নিজের বুকে টেনে নিলো আমায়। চিৎকার করে বললো,
-‘ কেউ স্পর্শ করবি তো খুন করে ফেলবো ‘।
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বিশ্রিভাবে হেসে ওঠলো বললো,
-‘ কি ভাইয়ে মজা শুধু তুমি একাই নিবা আমাদেরও নিতে দাও। রাত,বিরাতে মধু খেতে বের হয়েছো তাও আবার ঝড়,বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে অবশ্যই উন্নতমানের মধু ‘।
বলেই টেনে নির্মলের থেকে সড়ানোর চেষ্টা করে আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নির্মলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকি। বলতে থাকি,
-‘ নির্মল বাঁচাও আমায় মরে যাবো প্লিজ নির্মল আমায় ছেড়ো না ‘।
নির্মলও আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ছেলেগুলো একদিকে নির্মলকে টেনে হিঁচড়ে সড়ায় অন্যদিকে আমাকে। নির্মলের গায়ে পরপর আঘাত করতেই থাকে। আমার শাড়ি টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলে কাঁদায়। নির্মল আমার সেরূপ দেখে ছুটে আসতে নিতেই ওর দুহাত দুদিক থেকে টেনে ধরে বুক বরাবর সমানে লাথি দিতে থাকে একজন। আমার আর্তচিৎকার, প্রকৃতির আর্তচিৎকার ভয়াবহ এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। কুকুরের মতো একজন আমার শরীরের আঁচড় কাঁটছে আরেকজন আমার শরীরের অবশিষ্ট পোশাক অনাবৃত করতে ওঠে পড়ে লেগেছে। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ টির অমন নির্দয়ভাবে অসম্মানিত হতে দেখে পাগল হয়ে যায়৷ নির্মল। চিৎকার করে বলতে থাকে,
-‘ তোরা কেউ বাঁচতে পারবিনা। রোমান চৌধুরী তোদের ছাড়বেনা ‘।
এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো ওদের ভয় পাওয়ার জন্য। আমাকে ছেড়ে দিয়ে নির্মলের দিকে তাকায় ওরা। তখনি একজন বলে ওঠে,
-‘ আরে ভাই বিপদে পড়লে বড় বড় নেতার নাম অনেকেই স্মরণ করে তাই বলে তোরা ভয় পাবি কাজের কাজ কর ‘।
ততোক্ষণে আমি কাঁদা মাখানো শাড়িটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ফেলেছি। ছেলেগুলো আবারো আমার দিকে আসতে নিতেই এক খামচি কাঁদা তুলে ছুঁড়ে দেই মুখের দিকে। নির্মল ওদের থেকে ছুটার জন্য ধস্তাধস্তি করছে আর বলছে,
-‘ বিশ্বাস না করলে একবার ছাড় জাষ্ট একটা ফোন করবো ‘।
ছেলেগুলো ভয়ার্ত মুখে একে অপরের দিকে তাকালো। ততোক্ষণে আমি দোকানের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছি। নির্মল ওদের থেকে ছাড় পেতেই ফোন বের করে ওর চাচা রোমান চৌধুরী কে ফোন করে। জীবনে কখনো চাচার পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনি ওর। এমপির ভাতিজা হয়েও কখনো ক্ষমতার বড়াই করেনি। আজ চরম বিপদগ্রস্ত হয়ে চাচাকে স্মরণ করতেই হচ্ছে। ফোন করে যখন বড় আব্বু বলে লোকেশন জানালো তখনি ছেলেগুলোর পিল চমকে যায়। ভয়ে একেকজনের হাঁটু কাঁপতে থাকে। কতোবড় ভুল করেছে ওরা তা বুঝতে বিন্দু টাইমও নেয় না। এমপির ভাতিজাকে আটকে তাঁর বন্ধু কে রেপ করতে উদ্যত হয়েছিলো। ঠিক কি শাস্তি অপেক্ষা করছে ওদের জন্য?
নির্মল রক্তচক্ষু তে চেয়ে যে দুটো ছেলে আমাকে স্পর্শ করেছিলো সেদুটোকে একের পর এক ঘুষি দিতে থাকলো। সবগুলো ছেলেই হাঁটু গেড়ে বসে নির্মলের পা ধরে বলতে থাকলো, ‘ভাই ভুল হয়ে গেছে’। নির্মল রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের মাথা দিয়ে একজনের মাথায় বাড়ি দিলো। চিৎকার করে বলতে থাকলো -‘ ভুল করেছিস মারাত্মক বড় ভুল শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাক ‘।
কিছুক্ষণ আগে কুকুরের মতো যারা আমাকে খুবলে খেতে এসেছিলো। এখন তাঁরা বিড়ালের মতো মিউ মিউ করছে?
“কি অদ্ভুত! একজন নারীকে অসম্মান করতে ওদের বুক কাঁপে না। একজন নারীর আর্তচিৎকার ওদের বিবেককে জাগ্রত করতে পারেনা। অপরিচিত একজন নারীর শরীর অনাবৃত করতে ওরা লজ্জাবোধ করেনা। ওদের বুক তখন কাঁপে যখন ক্ষমতাসীন কারো সাথে অসম্মানের শিকার হওয়া নারীটির সংযোগ থাকে। ওরা লজ্জা বোধ তখন করে যখন ওদের কৃতকর্মের জন্য ওদের রাজনৈতিক জীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পৃথিবীর বুকে অবস্থান করা প্রতিটি মানুষ কে চিৎকার করে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে নারীর সম্মানের থেকেও ক্ষমতার মূল্য অনেক বেশী? কিসের রাজনীতি কিসের ক্ষমতা। নারী জাতটাই যদি না থাকতো কোথায় পেতে তোমাদের অস্তিত্ব? কোথায় থাকতো এই ক্ষমতা এই দম্ভ? নরপিশাচরা কেনো বুঝেনা নারীরা মায়ের জাত। মা জাতিকে তাঁরা কেনো বার বার কলঙ্কিত করতে আসে? তাঁরা কি বুঝেনা একটি নারীকে কলঙ্কিত করা মানে পুরো পৃথিবীর বুকে হাহাকার সৃষ্টি করা”
ওদের থেকে পা ছাড়িয়ে হন্যে হয়ে আশেপাশে চোখ বুলায় নির্মল। আমাকে দেখতে না পেয়ে বেদনাক্রান্ত গলায় চিৎকার করে ওঠে,
-‘ সাবা’।
ওর চিৎকার শুনে আমি ‘নির্মল’ বলেই ডুঁকরে কেঁদে ওঠি। দোকানের পিছন সাইটে খড়ের পালার চিপায় ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিলাম আমি। অন্ধকারে আমাকে দেখতে পারলোনা নির্মল। তবে কন্ঠ শুনে দ্রুত এগিয়ে এলো।
চলবে…
#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১৪
৮.
ভয়ংকর সেই রাতটির পর সবকিছুই কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলেগুলোর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হলেও আমি বা নির্মল কেউ স্বাভাবিক হতে পারিনি। নির্মলের মা আর ছোট বোন এসে দুদিন থেকে যায়। আমাকে এবং নির্মলকে স্বান্তনা দেয়। স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ইতিবাচক কথাবার্তা বলে তবুও নির্মল গুম হয়ে রুমে দরজা আটকে বসে থাকে। আমিও রুম থেকে বের হইনা। সেরাতে যদি আমি আগবাড়িয়ে কথাগুলো না বলতাম তাহলে হয়তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীই ভাবতো ওরা। খারাপ মেয়েছেলে ভেবে সুযোগের সৎব্যবহার করতে চাইতো না৷ আর না আমরা অমন বিশ্রি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম। দুদিন থাকার পর নির্মলের মা আর ছোট বোন চলে যাওয়ার পরই নির্মল আমার সাথে দেখা করতে আসে। কিন্তু আমি ওর মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলাম না তাই দরজাটা অবদি খুলিনি। অনেক ভেঙে পড়ে নির্মল। সেদিনের সেই ভয়াবহ দৃশ্য এবং সেদিনের পর থেকে আমার অবহেলা। দুটোই ভয়ানক ভাবে আহত করে ওকে। ফলস্বরূপ রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। রাত যখন দু’টো ছুঁই ছুঁই তখন দরজায় টোকা পড়ে দরজা খুলতেই নির্ঝর ভয়ার্ত চোখ,মুখে বলে,
-‘ আপু ভাইয়ার অনেক জ্বর তারাতাড়ি চলো। জ্বরের ঘোরে বার বার তোমাকে ডাকছে ‘।
বুকটা হুহু করে ওঠে আমার জেসমিন কে ডেকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে যাই দোতলায়। গিয়ে দেখি বেচারা জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে কাঁপছে আর বিরবির করে কি যেনো বলছে। জেসমিন ওর কপাল চেক করে আঁতকে ওঠা গলায় বললো,
-‘ সে কিরে গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ‘।
আমিও চেক করে দেখি অবস্থা বেগতিক। নির্ঝর বললো,
-‘ আমি আম্মুকে এখুনি ফোন করছি ‘।
-‘ না নির্ঝর এতো রাতে আন্টিকে ফোন করোনা আমরা আছিতো তয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এসো। জেসমিন তুই যা আমাদের রুম থেকে জ্বরের ওষুধ গুলো নিয়ে আয় ‘।
-‘ আপু ভাইয়া রাতে কিছু খায়নি ‘। বললো নির্ঝর।
আমি চটে গিয়ে বললাম,
-‘ কেনো খায়নি কেনো? এতো বাড়াবাড়ি কিসের ওর নিজেকে কি মনে করে মহাপ্রেমিক? প্রেমিক পুরুষ’?
নির্ঝর মাথা নিচু করে বাথরুম গিয়ে তয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এলো। ততোক্ষণে আমি নির্মলের গা থেকে গেঞ্জি খুলে ফেলেছি। অতি যত্নসহকারে পুরো শরীর মুছে দিয়ে জলপট্টি দিতে থাকলাম। জেসমিনকে বললাম খাবার গরম করতে। নির্ঝর আমার পাশেই নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলো। আর নির্মল জ্বরে পুরোই বেধান্দা। খাবার গরম করে নিয়ে আসার পর নির্ঝরের সাহায্যে নির্মলকে আধশোয়া করে বসিয়ে নিজ হাতে খাওয়িয়ে দেই। বেচারার চোখ,মুখ লাল টকটক করছিলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানিও বের হচ্ছিল। অল্প খাওয়িয়ে ওষুধ খাওয়িয়ে শুইয়িয়ে দিলাম। আরো কিছুক্ষণ জলপট্টি দিতে থাকলাম। জেসমিন সোফায় শুয়েই ঘুমিয়ে গেলো। নির্ঝর বিছানার একপাশে ঝিমাতে থাকলো। শরীরে একটু আরাম পেয়ে নির্মল আমার কোলে মাথা গুঁজে ভারি শ্বাস ফেলতে ফেলতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো। আমি মৃদু হেসে ওর চুলগুলোয় আলতো করে হাত বুলাতে থাকলাম। যখন আমার চোখ জোড়াও লেগে আসছিলো ঠিক তখনি জড়ানো গলায় নির্মল বললো,
-‘ সাবা ‘।
চমকে ওর দিকে তাকাতেই বুকের ভিতর কিছু কামড়ে ধরেছে এমন অনুভূতি হলো আমার। নির্মল অসহায় মুখে আধভেজা চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
-‘ কি হয়েছে খারাপ লাগছে ‘?
নির্মল মলিন হেসে মাথা নাড়িয়ে না বোধক সম্মতি জানালো। আমি চেয়েই রইলাম ওর মুখের দিকে। ও হাত বাড়িয়ে আমার এক গালে স্পর্শ করে অস্ফুট স্বরে বললো,
-‘ ভালোবাসি তো অভিমানীনি। আই এম সরি তো প্রিয় ‘।
সরি বলার সময় বাচ্চা দের মতো অন্যহাতে কানের লতিতে ছুঁয়েছিলো। আমি তখন হেসে ফেললেও আমার চোখ বেয়ে অশ্রুকণারা ঝড়ছিলো। নির্মল গাল থেকে হাত সড়িয়ে চোখ বুজে বললো,
-‘ প্রথম দর্শনে কাউকে দেখে তোমার বুকের ভিতর ধক করে ওঠেছে সাবা বা কিছু তোমার পেট চেপে ধরেছে এমন অনুভূতি হয়েছে ‘?
আমি কিছু বললাম না। কেমন যেনো নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। শরীরে কেমন দূর্বলতা অনুভূত হচ্ছিল। একদম স্থির হয়ে বসে ছিলাম। আমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে কেমন নেশামাখা গলায় বুলি আওড়াচ্ছিলো নির্মল।
-‘ আমার হয়েছে। সেদিন তোমায় দেখে আমার ঠিক এমনটাই অনুভূতি হয়েছিলো। কিন্তু সেটা ছিলো ভালোবাসার পূর্ব মূহুর্ত। ভালোবাসা শুরু হওয়ার পূর্ব মূহুর্ত আমাকে যতোটা সুখ দিয়েছে তাঁর থেকে অধিক যন্ত্রণা দিয়েছে পুরোপুরি ভালোবাসা অনুভব করার পর। ভালোবাসা, Love এর পূর্ণরূপ কি জানো প্রিয় ‘?
L= Lakes Of Sorrows ( দুঃখের সাগর )
O= Ocean Of tears ( অশ্রু মহাসাগর )
V= Veally Of Death ( মৃত্যু উপত্যকা )
E= End Of Life ( জীবন শেষ )
সচকিত হয়ে একহাতে ওর মুখ চেপে ধরলাম। আকুল হয়ে বলে ওঠলাম,
-‘ চুপ নির্মল এসব বলোনা ‘।
নির্মল আমার হাত ছুঁয়ে হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেলো। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে হাত সড়িয়ে ফেললাম আমি। নির্মল শ্লেষমিশ্রিত হাসি দিলো। আমি ভীষণ ইতঃস্তত বোধ করছিলাম। আমার অনুভূতি বুঝতে পেরে ও বললো,
-‘ আমি খুবই তৃষ্ণার্ত সাবা ‘।
-‘ পানি আনছি বালিশে মাথা রাখো ‘।
-‘ সব তৃষ্ণা কি পানিতে মেটে প্রিয় ‘?
আমি নিরুত্তর হয়ে বসে রইলাম। নির্মল আবারো দুর্বল কন্ঠে বললো,
-‘ ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটাতে পারবে না প্রিয়? এ তৃষ্ণা যে ভয়াবহ তৃষ্ণা প্রিয় । এ তৃষ্ণা না মিটলে যে মরেও শান্তি নেই। তোমার ভালোবাসা বিহীন আমার মরণ যে বড় অতৃপ্তকর হবে। তোমার চোখের সামনে তেষ্টায় ছটফট করছি আমি। তোমার হৃদয়ে কি একটুও কম্পন সৃষ্টি করে না? তুমি কি শুনতে পাওনা এই বুকের হাহাকার’?
সহ্য করতে না পেরে দুহাতে কান চেপে ধরে বললাম,
-‘ প্লিজ নির্মল চুপ করো আমি সহ্য করতে পারছিনা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার ‘।
-‘ আমিও পারছিনা সাবা বেলা ফুরিয়ে গেলে আফসোস বিহীন কিছুই রবেনা তোমার মিলিয়ে নিও’।
ওর বলা সে বাক্যটি আমার অন্তরে গিয়ে বিঁধলো। থমকে গিয়ে নিচু স্বরে ডেকে ওঠলাম ‘নির্মল ‘।
আমার সে রূপ দেখে নির্মল নিজেকে সামলে নিয়ে সহাস্যে বললো,
-‘ ওরে আমার দেমাগি সুইটহার্ট পুরো শরীরে না বুকে কম্পন তুলে তবেই আমি ক্ষ্যান্ত হবো। নাকি বুকেও কম্পন ধরেছে জানেমান ‘? বলেই ভ্রু নাচালো।
আমি দূর্বল কন্ঠে বললাম,
-‘ জ্বর সেড়ে গেছে তোমার নির্মল এবার সড়ো আমাকে যেতে দাও ‘।
আমি জোর করে ওকে সড়াতে নিতেই আমার দুহাত আঁকড়ে ধরে মিনতির সুরে বললো,
-‘ ভালোবাসতে বলবো না, কাছে আসতেও বলবো না শুধু একটি বার প্রিয় সম্বোধন তো করতেই পারো সাবা। আমার বুকের হাহাকার থামিয়ে দাও। মরুভূমির বুকে এক ফোঁটা বৃষ্টির ঠাই দাও। আর ফিরিয়ে দিও না ‘।
আমি ওর হাত এক ঝটকায় সড়িয়ে জেসমিন কে ডাকতে শুরু করি। নির্মল গা এলিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে থাকে আমার কার্যকলাপ। যতোক্ষণ না আমি জেসমিন কে নিয়ে বের হচ্ছিলাম ততোক্ষণ সে চেয়েই ছিলো। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর হয়তো দীর্ঘ এক নিঃশ্বাসও ফেলেছিলো।
৯.
শেষরাতেও ঘুম হলো না আমার৷ ভালোবাসার বেড়াজালে আঁটকে পড়েছি আমি। এখান থেকে মুক্ত হতে চেয়েও পারছিনা৷ নির্মলের আকুতি আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না৷ এসবের ভীড়ে পড়াশোনায়ও ভীষণ ক্ষতি হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোন একটা এবার বেছে নেবোই। হয় নির্মলকে চিরতরে জীবন থেকে বিদায় করবো। এর জন্য প্রথম কাজ হবে বাসাটা ছেড়ে দেওয়া। অনার্স শেষ হতে একবছর আছে আর একটা বছর লুকিয়ে হলেও কাটিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে যাবো। এটুকু শিক্ষা নিয়ে যা পারি একটা কর্ম যোগার করবো। নয়তো ওর ভালোবাসা কে গ্রহণ করে নিয়ে বাকি জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেবো। আমার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মা কে আমার ভীষণ প্রয়োজন। মায়ের সান্যিধ্য লাভ করতে পরেরদিনই জামা-কাপড় গুছিয়ে বের হয়েছি এমন সময় নির্মল দৌড়ে আমার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিলো।
সেদিন ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি। নির্মল রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
-‘ তুমি কোথাও যাবে না সাবা প্লিজ। সরি সাবা রাতে জ্বরের ঘোরে কি বলেছি না বলেছি মাথা ঠিক ছিলোনা৷ ক্ষমা করো আমায় ‘।
আমি নিচের দিকে মাথা রেখেই বললাম,
-‘ আমি আম্মার কাছে কদিন থাকতে যাচ্ছি শুক্রবারই এসে পড়বো ‘।
মামি আর জেসমিনও নির্মল কে বোঝালো। জেসমিন আর মামিও যাবে নানাবাড়িতে। ওদের কথা শুনে নির্মল অসহায় চোখ, মুখে চেয়ে কাঁপা গলায় বললো,
-‘ আমিও যাবো ‘।
আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই ও চটপটে গলায় বলে ওঠলো,
-‘ না মানে তোমাকে বাসে ওঠিয়ে দিতে যাবো চলো ‘।
আমি মৃদু হেসে মামি আর জেসমিনের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রিকশায় ওঠার পর নির্মল ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো, সে পাল্টে গেছে, আমি তাঁর জীবনে আসার পর তাঁর সবকিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। আমি, জেসমিন আর সরস্বতী বাদে প্রেজেন্ট তাঁর কোন মেয়ে বন্ধুও নেই। আরো অনেক কথা বললো নির্মল। আমি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ওর কথা গুলো শুনছিলাম। আর মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম ‘ বাড়ি থেকে ফিরে এসে অনেক বড় সারপ্রাইজ দেবো তোমায় নির্মল অতি সুখে তুমি জ্ঞান হারাবে না তো ‘? নির্মল কথা বলার ফাঁকে আড় চোখে আমাকে দেখছিলো কিন্তু আমি সরাসরিই ওর দিকে চেয়ে ছিলাম৷ রিকশা থেকে নামার পর আমি নির্মলকে বলি কফি খাবো। তাই কফিশপে নিয়ে যায় আমায়৷ দুজন মুখোমুখি বসে ছিলাম। আমি চাইছিলাম নির্মল আমার চোখের দিকে তাকাক। কিন্তু ও তাকাচ্ছিলোই না। তাই নিজে থেকেই আবদার করলাম আমার চোখের দিকে তাকাতে। ও যখন তাকালো আমি প্রশ্ন করলাম,
-‘ কি দেখতে পেলে ‘?
-‘ কি আর দেখবো দেমাগি মেয়ের সুইট রূপই দেখতে পেলাম ‘। বলেই সশব্দে হেসে ওঠলো নির্মল।
পুরুষ আর নারীর ভালোবাসায় বিশাল ফারাক। একজন পুরুষ যেভাবে তাঁর ভালোবাসা কে মনের অনুভূতি কে প্রকাশ করতে পারে একজন নারী তা কখনোই পারে না। পুরুষের চোখে ভালোবাসার সরূপ সুস্পষ্ট ফুটে ওঠলেও। নারীর চোখে তা সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে না৷ বা ফুটে ওঠলেও প্রগাঢ় দৃষ্টি ছাড়া তা ধরা সম্ভব নয়৷ পুরুষ মনের কথা চিরকাল প্রকাশিত থাকলেও নারী মনের কথা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রকাশিত থাকে। নারীর ভালোবাসার গভীরতা যতো বেশী তা প্রকাশ করার ক্ষমতা ততো কম।
নির্মলের কথা শুনে সাবা বিরক্তি তে কপালে তিন ভাঁজ ফেলে ওঠে দাঁড়ালো। নির্মল বুকের বা পাশে চেপে ধরে বলে ওঠলো,
-‘ অপেক্ষায় আছি প্রিয় তোমার ফেরার ‘?
ঠোঁটের কোনায় বিশ্বজয়ী হাসি ফুটে ওঠে আমার। নির্মলও তৃপ্তির হাসি হেসে ওঠে দাঁড়িয়ে আচমকাই আমার কপালে চুমু খেয়ে ছুটেই বেরিয়ে যায়। আমি স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে চেয়ে থাকি ওর যাওয়ার পানে। সেদিন টাংগাইল পর্যন্ত নির্মল এগিয়ে দেয় আমায়। বাসে পাশাপাশি সিটে বসে ঢাকা থেকে টাংগাইল অবদি আসে। পুরো সময়টাই আমার মুখপানে একধ্যানে চেয়েছিলো নির্মল। সেদিনই প্রথম আমি ওর দৃষ্টি কে অবহেলা করিনি। সেদিনই প্রথম ওর অনুভূতি কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনি। সেদিনই প্রথম ওর হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করি আমি ওর শুধুই ওর। আমি জানতাম আমার অনুভূতি কে আমার আম্মা অবমূল্যায়ন করবে না। আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিই হচ্ছে আমার আম্মা। আম্মা পাশে থাকলে আমার আর কিছু চাইনা। আম্মার সাপোর্ট পেলে আমার আর কাউকে লাগবেনা৷ বাস থেকে নামার পূর্ব মূহুর্তে নির্মল আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘ বহু তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি প্রেম পিপাসায় মরি মরি জান দ্রুত চলে এসো নয়তো খবর পাঠিও। তোমার সনে আমার ঠাই যতোদিন না হচ্ছে ততোদিন এই তৃষ্ণা মিটবে না ‘।
ও যখন বাস থেকে নেমে যাচ্ছিলো খুব পিছু ডেকে বলতে ইচ্ছে করছিলো,
-‘ ওহে প্রিয় এবার তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটতে চললো বলে ‘।
কিন্তু বললাম না। ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয় বেশী। তিনটে বছর ধৈর্য ধরতে পেরেছে আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরলে দোষ কোথায়?
বাড়ি ফিরতেই খুশিতে আম্মার চোখ চকচক করে ওঠলো। আব্বাও বেশ খাতিরযত্ন করে ঘরে তুললেন। দৌড়ে গেলেন দোকানে আপু আর দুলাভাই কে ফোন দিতে। আব্বার যাওয়া দেখেই আম্মার মুখ টা কালো হয়ে গেলো৷ বললো,
-‘ আবার শুরু হবো অত্যাচার কেনো এলি মা ‘?
আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-‘ আম্মা চিন্তা করো না। আমাদের চিন্তার দিন এবার শেষ ‘। বলেই আম্মাকে সব খুলে বললাম। সব শুনে আম্মা ভয়ে থড়থড় করে কাঁপতে থাকলো আর বলতে থাকলো,
-‘ তুই শহড়ে পড়ার নাম করে ছেলে মানুষের সাথে পিরিত বাজাইলি সাবা তোর আব্বা আমারে খুন কইরা ফালাবো ‘।
আমি আম্মার মুখ ছাপিয়ে ধরে ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,
-‘ আম্মা আস্তে বলো সবাই শুনবে আমি প্রেম করিনি আম্মা তুমি বুঝতে ভুল করছো ‘ বলেই আবারো বুঝিয়ে বললাম। আম্মা শিক্ষিত না গ্রামের বোকা সোকা মেয়ে মানুষ এসবে তাঁর জ্ঞানমূলক ধারনা নেই। তাই খোলামেলা আলোচনা করলাম। কিন্তু শুরুতে দেওয়া আম্মার চিৎকার কান পেতে ঠিক শুনে নেয় আমার চাচি। এবং পুরো বাড়িসুদ্ধ লোকের কানে পৌঁছে দেয় “সাবা শহড়ে গিয়ে ব্যাটাছেলের সাথে পিরিত বাজাইছে”
চলবে..