কন্ট্রাক্ট অফ ম্যারেজ পর্ব-১২

0
911

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi

“পর্ব-১২”

সকাল সকাল মৃধা বাড়ির সামনে এসে হাজির আফরোজ চৌধুরী। গতকাল রাতে মৃধা যখন আয়ানকে তার বাড়ির ঠিকানা বলেছে ঠিক তখনই তিনি সেটা কালেক্ট করে নিয়েছিলেন। এখন তবুও একটু অসুবিধা হচ্ছে বাড়ি খুঁজে বের করতে। পরিশেষে কিয়ৎক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর দেখা মিলল কাঙ্ক্ষিত স্থানের। টিনের দু কামরা বিশিষ্ট ঘর। বাড়িটা বেশ পুরোনো। খুব সন্তর্পণে গৃহের সন্নিকটে পদার্পণ করল সে। ভেতরে প্রবেশ করতে হলে তো আগে নক করতে হবে। অবশেষে সকল দ্বিধা-দন্ড কাটিয়ে দ্বারে হাত ঠুকল সে। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই কেউ এসে দ্বার খুলে দিল। দরজার ওপারে একজন ছেলে দাড়িও। ছেলেটি হলো মুগ্ধ। আফরোজ চৌধুরী মুগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— এটা কী মৃধা মেহরিন এর বাড়ি?

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলল,

— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?

–” আমি তার অফিসের মালকিন

মুগ্ধ এবার তাড়াহুড়ো করে বলল,

— আরে স্যার, আসুন আসুন ভেতরে আসুন। আপুনি তো অফিসে চলে গেছে। আপনি আসুন ভেতরে মা আছে।

আফরোজ চৌধুরী মুগ্ধের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। মুগ্ধ একটা কাঠের চেয়ার টেনে তাকে বসতে দিলেন। তারপর অন্য রুমে গেল তার মাকে ডাকতে। কিছু সময় পরই মুগ্ধ তার মাকে নিয়ে আসল। মুগ্ধের মা খুব ভালো করে মাথায় কাপড় দিয়ে এপাশে আসলেন। তিনি এ রুমে ঢুকেই সর্বপ্রথম সালাম দিলেন।তারপর আগন্তুকের দিকে দৃষ্টি দিতেই তার পৃথিবী যেন থমকে গেল। কতগুলো বছর পর এই ভালবাসাময় মুখের সন্ধান পেল সে।তার দৃষ্টি যেন আর সরতেই চাইছে না, কণ্ঠনালী দিয়ে স্বর বেড়নো দুষ্কর হয়ে পড়েছে,সারা শরীর অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে। ওদিকে আফরোজ চৌধুরীও আজ আবেগে আপ্লূত প্রায়। এতো বছর পর মেয়ের মুখখানা দেখে তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন। তবে মেয়েকে হুইল চেয়ারে সাদা শাড়ি পরিহিত বেশ দেখে নিমেষেই তার বক্ষপিঞ্জরে অজানা ভয় এসে ডানা বাঁধল। এই রুপে সে কখনোই তার কলিজার টুকরোকে আশা করেনি। দুজনের নয়ন বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। এদের এমন অবস্থা দেখে অবাকতা তুমুল বেগে যেঁকে ধরেছে মুগ্ধকে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশেষে সে তার মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,

— কী হয়েছে মা? এমন অস্থির হচ্ছ কেন?

আয়েশা খানম এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বাবা বলে চিৎকার করে উঠে দুচোখের পানি ছেড়ে দিলেন। আফরোজ চৌধুরীও দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন,

— মা আমার, এতগুলো বছর কোথায় হারিয়ে ছিলি? কত খুজেছি তোকে কিন্তু কোনো সন্ধান পাই নি।

আয়েশা খানম কান্নারত অবস্থায় বললেন,

— কী করে দেখা দিতাম তোমায় বাবা, আমি যে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম। তোমার সামনে যাওয়ার মতো মুখ তো আমার ছিল না।

–” ওরে মা বাবা – মায়ের কাছে সন্তানের কোনো অপরাধই অপরাধ থাকে না। সামান্য নতি স্বীকারেই সবটা মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো।

— হ্যাঁ বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও তুমি।

— করেছি মা, তোকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি।

দু’জনের মুলাকাত শেষ হতেই আফরোজ চৌধুরীর চোখ পড়ে মুগ্ধর দিকে। তিনি আয়েশাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

— এটা নিশ্চয়ই তোর ছেলে?

— হ্যাঁ বাবা ও আমার ছেলে মুগ্ধ আর আমার মেয়ে মৃধা সে তো অফিসে গেছে।

— হ্যা মৃধা দিদিভাইকে তো আমি আগেই চিনেছি। ওর জন্যই তো তোকে খুঁজে পেলাম। ওর মুখের সঙ্গে তোর মুখের হুবহু মিল। তাই তো খুঁজতে খুঁজতে তোর দেখা পেলাম।

আফরোজ চৌধুরী মুগ্ধকে নিজের কাছে ডেকে বলেন,

— এসো নানাভাই, এতগুলো বছর তোমাদের খুজে বেড়িয়েছি পাগলের মতো। এখন যখন এতো কাছে এসে পড়েছি তখন দুরে সরে আছো কেন? কাছে এসো।

মুগ্ধ কিছু বলল না চুপচাপ দাড়িয়ে চেয়ে রইল আফরোজ চৌধুরীর দিকে। মুগ্ধের মা ছেলের এমন নিশ্চুপতা দেখে বলে উঠলেন,

— কী রে বাবা নানুভাই এর কাছে আয়। তোরা না বলতি সবার নানুবাড়ি আছে তোদের কেন নেই? তখন তো ধমক দিয়ে তোদের চুপ করিয়ে দিতাম। আজ আর ধমক দিচ্ছি না।

মুগ্ধ মায়ের কথায় আফরোজ চৌধুরীর নিকটে এলো। আফরোজ চৌধুরী পরম স্নেহে নাতিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। নাতির সঙ্গে মিষ্টি মধুর আলাপনের পর আফরোজ চৌধুরী প্রসঙ্গ তুললেন মৃধার বাবার। এই প্রসঙ্গে মৃধার মা কেঁদে কেটে একাকার হলেন। মৃধার বাবার করুণ মৃত্যুর খবর শুনে কেঁপে উঠল আফরোজ চৌধুরীর হৃদয়। তিনিও কাঁদলেন কিয়ৎক্ষণ।

সকল কান্নাকাটির পর্ব শেষ হতেই আফরোজ চৌধুরী প্রস্তাব রাখলেন তিনি মেয়ে, নাতি-নাতনীদের আর এখানে ফেলে রাখবেন না। সবাইকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে সুখে দিনাতিপাত করবেন। কিন্তু আয়েশা খানম তার এই প্রস্তাবে সরাসরি রাজি হতে পারলেন না। তিনি বললেন মৃধা না আাসা পর্যন্ত তিনি কিছুই জানাতে পারবেন না। তারপর শুরু হলো অতীতের কিছু বেদনার সৃতি। সৃতিচারণের এক পর্যায়ে আয়েশা খানম তুলে ধরলেন তার বড় ভাই আসিফ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী আসিকা চৌধুরীর কথা। তাদের প্রসঙ্গ উঠতেই আফরোজ চৌধুরী আরেকদফা কেঁদে নিলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন,

— তুই চলে আসার পর ওদের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করি আমি। আসিফ তখন রাতদিন পার্টি, মদ, ক্লাব এসব নিয়েই থাকত। এই নিয়ে প্রায়ই আসিকার সঙ্গে তার গন্ডগোল হতো। আমি তখন সবটা দেখেও চুপ ছিলাম। হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করি আসিফের সঙ্গে সঙ্গে আসিকার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। সেও আসিফের মতো উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছে। একদিন তুমুল অশান্তির সৃষ্টি হয় দুই জামাই- বৌ এর মধ্যে। আমি তখন দরজার বাহির থেকে সবটাই অবলোকন করি। ঝগড়ার মুল বিষয় ছিল পরকীয়া। জানতে পারি তারা দুজনেই পরকীয়ায় লিপ্ত। তার পরদিন আমি তাদের ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারপর তাদের দু’জনের মত নিয়ে তাদের ডিভোর্সকার্য সম্পাদন করি। সেই থেকে তারা আলাদা হয়ে যায়। আসিফকে আমি বাড়ি থেকে বের করে দেয় কারণ আমার সাজানো সংসার ভাঙার শুরু থেকেই তার অবদান বেশি। আদ্র আর আয়ান দাদুভাই তখন ছোট হলেও সবকিছু বিচার বিবেচনা করার মতো বুদ্ধি তাদের ছিল। তারা তখন তাদের বাবা-মায়ের কার্যকলাপে তাদের ঘৃণা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে আমি আদ্র আর আয়ানকে নিয়ে দিনাতিপাত করতে শুরু করি। আর ওদের বাবা- মা নিজেদের মতো সংসার করছে। একটি বারের জন্য এই ছোট্ট ছেলে দুটো কিংবা এই বুড়ো বাবার কোনো খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন তারা মনে করে নি। সেই থেকে সব এভাবেই চলছে।

কথাগুলো বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন আফরোজ চৌধুরী। এতোদিনের জমে থাকা কষ্টগুলো কাউকে শেয়ার করতে পেরে নিজের কাছে এখন অনেকটা পরিষ্কার তিনি।

,,,, ,,,, ,,,, ,,,,

অফিসে এসে থেকেই আয়ানের এটা ওটা বাহানার স্বীকার মৃধা। কখনো এটা করো তো কখনো ওটা করো। এবারে ডেকেছে তাকে আদ্র। মৃধা আদ্রের কেবিনে নক করতেই ভেতর থেকে মোলায়েম কন্ঠস্বর ভেসে এলো,

— এসো ভেতরে এসো।

মৃধা ভেতর যেতেই আদ্র বলল,

— কনগ্রাজুলেশন মৃধা,,, তুমি আমাদের কোম্পানির জন্য যে নতুন ডিজাইনের ড্রেস পরিকল্পনা করেছ সেটা আমাদের অর্ডারকারী কোম্পানির ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তারা এই পণ্যের অধিক সেল আশা করছেন।

মৃধা নিজের সফলতার কথা শুনে ভীষণ খুশি হলো। আদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে চলল নিজের কেবিনে। এদিকে তার সফলতার খবর ছড়িয়ে গেছে পুরো অফিসে। চলতি পথে সবাই তাকে কনগ্রাজুলেট করছে। সবার মধ্যে নয়ন এসে মৃধাকে কনগ্রাজুলেট করল। মৃধাও হাসিমুখে নয়নকে ধন্যবাদ জানাল। মৃধা চলে যেতে নিতেই নয়ন মৃধার দিকে একটি টকটকে লাল গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,” এটা আপনার জন্য।” নয়নের মুখশ্রীতে লজ্জার আভাস। মৃধার মনে মনে রাগ হলো তবুও জনসম্মুখে কিছু বলতে পারল না। বাধ্য হয়ে হাসিমুখে গোলাপ টা নিয়ে সে চলল নিজের গন্তব্যে। পথিমধ্যে কেউ আচমকা কেউ তার এক হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে তাকে টানতে টানতে একটা ফাঁকা কেবিনে নিয়ে গেল। আকষ্মিক ঘটনায় মৃধা বেশ ভয় পেয়ে গেল। আগন্তুক তাকে খুব জোরে ধাক্কা মেরে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল। মৃধা ভয়ে দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। চোখ মেলে সামনের লোকটির মুখ দেখার মতো সাহস তার হচ্ছে না। সামনে থাকা লোকটির গরম নিশ্বাস তার মুখশ্রীতে আছড়ে পড়ছে। তবুও মৃধা নিরব। কারণ টা হয়তো আগন্তুকটির নিশ্বাস তার ভীষণ চেনা। হয়তো মন থেকে সে উপলব্ধি করতে চাইছে তাকে।

চলবে,