#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi
“পর্ব-১৪(বিয়ে- দ্বিতীয়াংশ)”
Friday আর Saturday এই দুই দিন হলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আজ ফ্রাইডে। নিয়ম মাফিক আজ ছুটির দিন। এজন্য মৃধা অফিসে যায় নি। এই অফিসের চক্করে পড়াশোনা একদম লাটে উঠেছে তার। কলেজ যাওয়া হয় না অনেক দিন। সেজন্য আজ সে তার ক্লোজ ফ্রেন্ড আহিবার বাড়িতে যাবে। আহিবার কাছ থেকে বিগত দিনগুলোর পড়া নোট করে নিয়ে আসবে। খুব শীঘ্রই তাদের ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শুরু হবে। কলেজে মৃধা একমাত্র এই আহিবা বলে মেয়েটার সঙ্গেই বেশি ক্লোজ। মেয়েটির পুরো নাম আজমিরি আহিবা। মৃধার আহিবার সঙ্গে এতটা ক্লোজ হওয়ার একমাত্র কারণ হলো তারা দুজনেই গরিব পরিবারের। বড় লোকদের থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলে সবসময় মৃধা। বড় লোকেরা সবসময়ই গরিবদের নিচু করে দেখে। এজন্য তাদের থেকে দুরে থাকাই ভালো বলে মনে করে সে। আহিবা মেয়েটাও মৃধার মতো কষ্ট করে পড়াশোনা চালায়। বাড়িতে শুধু তার অসুস্থ বাবা ছাড়া আর কেউই নেই। আহিবা নিজে ছোটখাটো একটা জব করে। সেটার দ্বারাই তার বাবার চিকিৎসার খরচ আর তাদের সংসার খরচ চলে। স্টুডেন্ট হিসেবে আহিবা বেশ ভালো।
সকাল সকাল আহিবাদের বাড়িতে এসে হাজির মৃধা। আহিবা তো সেই খুশি। সে মৃধাকে দেখা মাত্র জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘ আরে দোস্ত কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম তোকে। আমার না খুব আনন্দ হচ্ছে। জানিস তোকে না একটা খবর দেওয়ার আছে কিন্তু আমার ফোনে জিরো ব্যালেন্স তাই আগে বলতে চেয়েও বলতে পারি নি।’
মৃধা আহিবাকে নিজের থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
–‘ আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এবার বল তুই কেমন আছিস? আর তোর সেই নিউজ টা কী শুনি?’
আহিবা বলল,
–‘ আগে ভেতরে আয় তারপর সব বলছি।’
–‘ হুম চল। আচ্ছা আঙ্কেলের শরীর কেমন আছে? আগে তার কাছে নিয়ে চল?’
–‘ আচ্ছা চল
তারপর দুই বান্ধবী গেল আহিবার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে কথা শেষ করে তারা আহিবার রুমে গিয়ে বসল। মৃধা উৎফুল্ল কন্ঠে আহিবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–‘ কী রে বল তখন কী যেন বলছিলি?’
আহিবা দু’হাত হাত মোচড়া মুচড়ি করতে করতে বলল,
–‘ আমার বিয়ে খুব শীঘ্রই।’
মৃধা হা হয়ে গেল আহিবার কথা শুনে। সে বলল,
–‘কী বলছিস তুই আহু। তোর বিয়ে? কবে? কখন?কার সঙ্গে? কীভাবে ঠিক হলো?’
আহিবা মৃধাকে এমন উত্তেজিত হতে দেখে বলল,
–‘ আরে এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে উত্তর শুনবি কখন? আগে রিলাক্স হ তারপর বলছি সব।’
মৃধা নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলল,
–‘ আচ্ছা এবার বল।’
আহিবা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল।তারপর বলতে শুরু করল,
–‘ সেদিন আমি বাবার জন্য ঔষধ কিনছিলাম ফার্মেসীতে। ঔষধ নিয়ে বাসায় ফিরে দেখি বাসার সামনে মস্ত বড় এক গাড়ি দাঁড় করানো।কৌতুহল নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকতেই দেখি একজন বয়স্ক লোক আমার বাবার সঙ্গে কথা বলছে। আমি ঢুকতেই লোকটি আমাকে তার কাছে ডাকলেন। আমার হাতে একটি ছেলের ছবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ছেলেটি দেখতে কেমন?আমি বললাম, মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। তিনি তখন বললেন, আলহামদুলিল্লাহ কথা তাহলে পাক্কা। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারলাম না। বৃদ্ধ লোকটি তখন আমাকে আর বাবাকে বিদায় জানিয়ে ওই মস্ত গাড়িতে চড়ে চলে গেলেন। লোকটি চলে যেতেই আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম লোকটির কথা। বাবা বললেন, লোকটি নাকি অনেক বড় কোম্পানির মালিক।খুব ধনী তারা। তিনি আমাকে তার বড় নাত-বৌ করতে চায়। কিন্তু এত বড় লোকরা আমাদের মতো গরিব ঘরে কেন সম্বন্ধ করতে এসেছে এটাই বুঝতে পারছি না। আমার তো ভীষণ খটকা লাগছে। শুধুমাত্র বাবার কথায় আমি রাজি হয়েছি। বাবা ক্যান্সারের রুগী। বড় ঘরে সম্বন্ধ হলে বাবার চিকিৎসা করাতে আর কোনো সমস্যা হবে না। এই আশায় বিয়েতে মত দিয়েছি। এখন তুই বল আমি কী ঠিক করেছি?’
মৃধা এতক্ষণ সবকিছু মনযোগ দিয়ে শুনছিল।তারও বিষয়টা কেমন অদ্ভুত লাগছে। মৃধা আহিবাকে বলল,
–‘ দেখ আহু আমাদের জীবনটা এমনই। প্রিয়জনদের ভালোর জন্য অনেক সময় অনেক বড় বড় রিস্ক নিতে হয়। আবার অনেক বিশালাকার কষ্টও হাসিমুখে গ্রহণ করে নিতে হয়। শুধুমাত্র প্রিয়জনদের মুখের এক টুকরো হাসির জন্য। এখন তুই কী করবি সেটা তুই ঠিক কর। তোর জীবন তোর সিদ্ধান্ত। এখানে আমার বলার মতো কিছু নেই। তবে এতটুকু বলব, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ। ইনশাল্লাহ তিনিই সবকিছু ঠিক করে দেবেন।’
আহিবা চিন্তিত সুরে বলল,–‘ইনশাল্লাহ’
মৃধা এবার কৌতুকের ছলে বলল,
–‘ এই এসব বাদ দিয়ে তোর হবু বরের ছবি দেখা। ‘
আহিবা লজ্জা পেল খুব। লজ্জা রাঙা মুখ নতজানু করে বলল,
–‘ উহুম,এখন না।সবকিছু ঠিক থাকলে একদম বিয়ের আসরে দেখবি।’
মৃধা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল,
–‘ আচ্ছা ঠিক আছে মহারানী। আপনি যেমনটি বলবেন।’
পরমুহূর্তে দুজনেই হেসে ফেলল।
———————
মৃধার মায়ের নম্বর থেকে ফোন আসায় দ্রুত ফোন রিসিভ করল সে। আহিবার কাছ থেকে নোট লিখে নিতে নিতে দুপুর বারোটা বেজে গেছে। মৃধার মা তাকে ফোন করে বলেছে, মৃধা যেন আয়ানদের বাড়িতে চলে আসে। তার নানাভাই এসে নাকি তার মাকে আর মুগ্ধকে ও বাড়িতে নিয়ে গেছে। এখন তাকেও ওখানে যেতে হবে। কী একটা জরুরি দরকার আছে। মৃধা সময় ব্যয় না করে দ্রুত চলে গেল ও বাড়িতে। তার যাওয়ার একদমই মুড নেই তবুও সে নিরুপায়। এই অনিচ্ছার একমাত্র কারণ অবশ্য আয়ান। তার সকল বিরক্তি ওই এক জায়গায়।
চৌধুরী বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই আজ এক অজানা অনুভূতি মৃধাকে ঘিরে ধরল। আগে এটা ছিল তার অফিসের মালিকের বাড়ি কিন্তু এখন এটা তার নানাভাই এর বাড়ি। হয়তো দুদিন পর নিজের বাড়ি হয়ে যাবে। কারণ তার মা গতকাল রাতে তাকে জানিয়েছে তার নানাভাই তাদের এ বাড়িতে এনে রাখতে চান। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃধাও আর অমত করেনি। এখানে থাকলে ভাই,মা অনেক ভালো থাকবে এই ভেবে।
ভেতরে ঢুকে মৃধা দেখল সবাই লিভিং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আদ্র তো রীতিমতো মৃধার মায়ের কোলে মাথা রেখে সোফায় শুয়ে আছে। মৃধা ঢুকতেই আফরোজ চৌধুরী বলে উঠলেন,
–‘ এসো এসো দিদিভাই। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।’
মৃধা গিয়ে আফরোজ চৌধুরীর পাশে বসে পড়লেন। আফরোজ চৌধুরীকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
–‘তাহলে এই সেই কারণ। যার জন্য সেদিন আপনি আমার কাছে আমার মায়ের নাম জানতে চেয়েছিলেন?’
আফরোজ চৌধুরী হেসে জবাব দিলেন,
–‘ হ্যাঁ দিদিভাই, এটাই সেই কারণ।’
ওদের কথার মধ্যে আদ্র বলে উঠল,
–‘ ছোট থেকে আমার একটা বোনের খুব শখ ছিল।কিন্তু আমার কপালে জুটল একটা ভাই। আজ থেকে কিন্তু তুই আমার বোন। আমাকে কিন্তু ভাইয়া বলে ডাকতে হবে।’
মৃধা একগাল হেসে ফেলল।চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল। এমন একটা ভাইয়ের খুব প্রয়োজন ছিল তার জীবনে।
মৃধার চোখে পানি দেখে আদ্র তাড়াতাড়ি করে ওর কাছে গেল। ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘ আরে পাগলী কাদছিস কেন?আমি আছি তো আর কোনো কষ্ট তোদের পেতে দিবো না। আরও আগে তোকে খুঁজে পেলে দেখতি একদম রানির মতো করে রাখতাম। আমি প্রমিস আর কোনো দুঃখ কষ্ট তোকে কখনো ছুঁতে পারবে না।’
মৃধা আদ্রের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ফুপিয়ে কেঁদে দিল। খুব আনন্দ হচ্ছে আজ তার। এই আনন্দঘন মুহুর্তে যদি তার বাবা বেঁচে থাকত তাহলে একেবারে ষোলো কলা পূর্ণ হতো। ওদের দুজনের ভালবাসা দেখে আফরোজ চৌধুরী আর আয়েশা চৌধুরীও আড়ালে চোখের পানি মুছলেন।এদিকে মুগ্ধ গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–‘ হয়েছে হয়েছে সব আদর আপুনিকে দিলে হবে আমার জন্যও কিছু বাচিয়ে রাখো।’
আদ্র এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর মুগ্ধকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
–‘ তোর জন্য তো আমার অফুরন্ত ভালবাসার সাগর রয়েছে ভাই।তুই তো আমার আরেক কলিজার টুকরো। ‘
সবাই খুব খুশি কিন্তু এখানে আয়ানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় নয়। ব্যাপারটা মৃধা খেয়াল করল। এদিক ওদিক চোখের ইশারায় আয়ানকে খুঁজে না পেয়ে মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। কিছুক্ষণ অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবে।
চলবে,