#কাশফুলের_মেলা
#পর্ব_১৬
#Writer_Nusrat_Jahan_Sara
ইশান গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমার মা বাবা কোথায়? আর উনারা কী করেন? ফুল ডিটেইলস চাই আমার।এমন একটা মেয়েকে কেউ কী করে কাজে পাঠাতে পারে?
অনু এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলো।এখন কী করবে সে?তার মা বাবা যে স্বয়ং তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।তারপরও অনু কোনোরকমে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“আমার বাবা মা কেউ নেই,যাওয়ার মতোও কোনো জায়গা নেই। তাই তো মানুষের বাড়িতে কাজের জন্য ঘুরাফেরা করি।তাতে যদি দুমুঠো অন্য আর থাকার জন্য একটু আশ্রয় পাই।
“কিন্তু আমাদের বাসায় আপাতত কাজের জন্য কোনো মানুষের দরকার নেই।তারপরও তুমি যখন এত করে বলছ তাহলে ঘর মুছার কাজ নাহয় তোমায় দেওয়া হল।আশা করি কাজে কোনো রকম ফাঁকিবাজি করবে না।
“জ্বী অবশ্যই!!!
আবির জোড়ে ড্রাইভ করছে আর অনুকে খুঁজে যাচ্ছে।ঠিক যেখান থেকে সে অনুকে এনেছিল সেখান থেকেই ওকে খুঁজে আসছে।এখন গাড়িটা একটা নির্জন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে তাতে হেলান দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস টানছে।পকেটে রাখা ফোনটা বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তবোধ করল সে।ফোনটা পকেট থেকে বেড় করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে তারাতাড়ি কল রিসিভ করল।
“হ্যাঁ বলো আদিল।
“আবির ভাই বাবা কাল তোমায় আমাদের বাসায় আসতে বলেছে।আমার মনে ছিলনা।এখন মনে হল আর ফোন করে বলে দিলাম।কাল সময় করে চলে এসো কেমন?
“ওকে।
সকালে অনু ড্রয়িংরুম মুছছে।আদিল অনুকে গিয়ে বলল আজ আমাদের বাসায় গেস্ট আসবে গিয়ে চা নাস্তার ব্যবস্থা করো।
অনু মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।কলিংবেল বেজে উঠতেই আদিল গিয়ে দরজা খুলে দিল।আবির এসেছে।সে আবিরকে এনে ড্রয়িংরুমে বসালো।আদিল আসাম করে সোফায় বসে আছে।আর আবির নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে।আবিরকে এমন চুপচাপ দেখে আদিল ওর কাঁধে হাত রাখল।
“কী হয়েছে আবির ভাই?আসার পর থেকে দেখছি তোমাকে কেমন চিন্তিত লাগছে?
“আংকেল কে ডাকো উনাকেই বলব।
আদিল গিয়ে আরশি আর ইশানকে ডেকে আনল। ইশান গম্ভীরমুখ করে পাশে রাখা সিঙ্গেল সোফায় বসল।
“আংকেল আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
“হ্যাঁ বলো।
“আসলে আমি অনুর খুঁজ পেয়ে গেছি।ইভেন সে আমার বাসায়ই ছিল,কিন্তু ওকে আমি চিনতে পারিনি।জাস্ট একটু আধটু ডাউট হত।
আবিরের কথা শুনে আরশি আর ইশান ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।অনু চা হাতে ড্রয়িংরুমে ঢুকছিলো।ওর নজর আবিরের দিকে যেতেই সে একেবারে থমকে গেল।তারপরও কোনো রকমে টে টা টি-টেবিলের উপরে রেখে চলে আসতে নিবে তার আগেই আবির ওর হাত খপ করে ধরে ফেলল।এতে ইশান আর আরশি অবাকের আরও চরম পর্যায়ে।
“আর কত লুকোচুরি খেলবে অনু?কী পাচ্ছো এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে?তোমার মা কষ্ট পাচ্ছে, বাবা কষ্ট পাচ্ছে, ভাই কষ্ট পাচ্ছে, ইভেন আমিও কষ্ট পাচ্ছি,।বলো আর কত কষ্ট দিবে সবাইকে?কিসের এত অভিমান তোমার উনাদের প্রতি যে নিজের বাসায় কাজের মেয়ে সেজে এসেছো?
আরশি,ইশান,আদিল সবাই আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।কিন্তু অনু অবাক হয়নি।সে জানত এটা হওয়ারই ছিল।
ইশান অবাক হওয়ার ভঙিতে আবিরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“এসব কী বলছো তুমি আবির?কী প্রমানের ভিত্তিতে তুমি বলছ ওই হল আমাদের অনু?
আবির ফার্স্ট টু লাস্ট সব খুলে বলল ইশানকে।কোথায় থেকে নিয়ে এসেছিল?সব খুলে বলল।
“শুধু তাই নয় আংকেল আরেকটা বিশেষ প্রমাণ আছে যার উপরে ভিত্তি করে আমি সিওর যে ওই অনু।
“কী প্রমাণ আবির?
আবির ওর পকেট থেকে লকেটটা বেড় করল।লকেট দেখে অনু চমকে ওর গলায় হাত দিয়ে দেখল সত্যিই গলায় ওর লকেটটি নেই।আবির আরশির সামনে লকেটটি ধরে বলল,
“আন্টি দেখেন তো এই লকেটটি চিনতে পারছেন কী না?
আরশি কিছুক্ষন লকেটটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“হ্যাঁ এটাতো আমার মেয়ে অনুর।ইশান নিজে ওর জন্য ডিজাইন করে লকেটটি বানিয়ে এনেছিল।কিন্তু তুমি এটা কোথায় পেলে?
“সব প্রশ্নের উত্তর তো অনু দিবে।তাই না অনু?
“দেখুন আবির,আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি দয়া করে অযথা আমাকে সন্দেহ করবেননা। অনু নামের মানুষ কী আমি একাই নাকি?
“না তুমি একা নও।কিন্তু এই লকেটটি শুধু একজনেরই আছে।এত এত প্রমাণ চারিপাশে তারপরও তুমি অস্বীকার করছো যে তুমি অনু নও।কিন্তু কেন অস্বীকার করছো?স্বাভাবিক ছেলে মেয়েরা তার বাবা মাকে বহুদিন পর দেখলে তাদের বুকে ঝাপিয়ে পরে আর তুমি কী না এত শান্ত হয়ে আছো?স্ট্রেঞ্জ!!
“কারণ আমি আপনাদের অনু নই তাই আমি শান্ত।
“অনু এবার বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
“ওয়েট ওয়েট।আমার জানামতে অনুর গলায় জন্মদাগ আছে।যদি এরও থাকে তাহলে তো এমনি প্রমাণ হয়ে যাবে।অনু দেখি তোমার গলাটা।
আরশি কথাটা বলেই অনুর ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল।অনু গলায় জন্ম দাগটা চিকচিক করছে। আরশি মুখে হাত দিয়ে দুকদম পিছিয়ে গেলো।
আবিরঃ”কী অনু এখনো কী মিথ্যা বলবে যে তুমি অনু নও?
“হ্যাঁ!!আমিই অনু।এখন কী হয়েছে?কী করবেন আপনারা?নিজেদের সাথে বেঁধে রাখবেন?দেখাশোনা করবেন? আদর যত্ন করবেন?কী হবে আর এসব কী করে?কী হবে?
“অনু তুমি উনাদের সাথে এভাবে কথা বলছে কেন?
“আপনি চুপ করুন।উনারা আমার বাবা মা নন।যদি হতেনই তাহলে আমাকে একা এত কম বয়সে আরেকজন মহিলার হাতে দিয়ে আসতেননা। উনি যদি সেদিন আমায় না বলতেন সব সত্যিটা তাহলে তো আমি আমার আসল মা বাবা কে সেটা জানতেই পারতাম না। উনার মুখে সত্যিটা জানার পর সেদিন রাতেই রওনা দেই উনাদেরকে খুঁজতে।কিন্তু যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনের ভিতরে অভিমানটা চাড়া দিয়ে উঠছিল।আবিরের সাথে দেখা হওয়ার পর ওর বাড়িতেই থাকি।তারপর চলে আসলাম ওদের বাড়ি ছেড়েও।কিন্তু যখন কিছুটা দীর্ঘপথ অতিক্রম করলাম তখন মনে হল ওর কাছ থেকে চলে এসে খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।এখন কোথায় যাব আমি?কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা।তাই আপনাদের বাসায় এলাম। আর এসে মনে হল এক কাজ ভালোই করেছি।আমার বাবা মায়ের তাদের মেয়ের প্রতি কতটা টান সেটা দেখতে পেয়েছি।এতটাই টান যে বিশ বছর আগে আমায় রেখে এসেছিলো তারপর আর একদিনও দেখতে যায়নি, আমার খুঁজ করতে চায়নি।হয়ত আমি উনাদের বুঝা হয়ে গেছিলাম তাই উনারা আমায় ত্যাগ করে দিয়েছিলেন।
আরশি মেয়ের কথা শুনে নির্জনে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।কিছু বলছেনা।ইশানের চোখেও পানি চিকচিক করছে।অনু নিজের চোখের জল মুছে নাক টেনে আবারো বলল,
“আমায় কেউ ভালোবাসেনি শুধু একজন ছাড়া।আর সে হল আবির। আবির আমায় সব সময় খুঁজ করেছে যা আমার মা বাবাও করেনি।স্বার্থহীন ভাবে ভালোবেসে গেছেন উনি।পৃথিবীতে এখনও সত্যিকারের ভালোবাসা বেঁচে আছে সেটা উনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আর আমরা তোমাকে ভালোবাসি না তাই-না? তুমি জানো তোমাকে রেখে আসার একমাস পর যখন আমরা বুঝতে পারলাম পারলাম আমরা বিপদমুক্ত তখনি আমরা তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়ে পরি।কিন্তু দুর্ভাগ্য তোমাকে যার কাছে রেখে এসেছিলাম উনি নাকি সেখান থেকে অন্য কোথাও একটা চলে গেছেন। প্রথমদিনের মত ফিরে আসি তারপর তোমাকে আবারো একি জায়গায় খুঁজ করি।বাই এনি চান্স যদি তোমায় পেয়ে যাই।কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হলোনা, পাইনি তোমায় খুঁজে।বিলিভ মি আমরা একটা রাতও ভাবিনি তোমাকে নিয়ে সেটা হয়নি।প্রতি রাতে তোমার জন্য চোখের জল বিসর্জন দিয়েছি।আমাদের প্রথম সন্তান তুমি।শুধু তাই নয়।আমাদের প্রথম ভালোবাসা,অনুভূতি সব মিলিয়ে তোমার জন্ম।তোমার জন্মের আগে আমি চেকআপ পর্যন্ত করিনি।ছেলে হোক বা মেয়ে সেটা জেনে লাভ কী?আল্লাহ খুশি হয়ে যে বাচ্চা দান করবে তাকে নিয়েই আমি সন্তুষ্ট।তবে তোমার বাবা তার পরিবার সবাই তোমায় নিয়ে খুব এক্সাইটেড ছিল।
আরশিকে অনু হাত দিয়ে থামিয়ে দিল।কারণ আরশি কথা বলার মধ্যে হাঁপাচ্ছে। অনু আবারো ভাঙা গলায় বলল,
“আমার শুধু একটা কথাই জানার আছে।তোমরা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে কী করে?সেদিন যদি তোমরা তোমাদের সাথে আমাকেও নিয়ে যেতে তাহলে হয়তো এতদিন আমি মা বাবার ভালোবাসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতাম না।বাঁচলে একসাথে বাঁচতাম আর মরলে একসাথে মরতাম।
ইশান অনুর মাথায় হাত রেখে বলল,
“সবই তো জানো দেখছি।তখন আমাদের প্রাণ সংকটে ছিল।আমরা বাঁচব এই আশা আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম।কিন্তু পথে ওই ঘরটা দেখে তোমাকে বাচাঁনোর কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম।তাই তোমাকে বাঁচানোর জন্য রেখে এসেছিলাম এখনো তুমি কী বলবে আমরা স্বার্থপর?কোনো বাবা মাি চাইনা তার সন্তানের ক্ষতি হোক।
অনু কিছু বলল না মাথা নিচু করে নিলো।সত্যি আর তার কিছু বলার নেই।অযথাই নিজের বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছে।অনুর নজর আদিলের দিকে যেতেই দেখল আদিল কাঁদছে।
“একি আদিল তুমি কাঁদছো?
আদিল এসে অনুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপি তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি সত্যি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
“তুমি বুঝতে পেরেছো এটাই অনেক। তবে হ্যাঁ আর কাজের লোকদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবেনা কেমন?
#চলবে…