#কৃষ্ণডাহুক – ২৩
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
অনেকদিন পর আবারো সেই চিরচেনা মুখ দেখে স্তম্ভিত হলো মীরা। বিস্ময়ে যেনো তার পা মাটিতে পড়ছে না। অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। তখনই এক মাঝবয়সী মহিলা এসে মীরাকে বলল,’ তুমিই মীরা না? সাদনানের জন্য যাকে আমার বোন ঠিক করে দিয়েছিলো? আমি অনিতা। সাদনানের মা। ‘
অনিমা-তনিমার যে বড় বোন আছে তা পূর্বে জানতো না। অনিতার কথায় এই মাত্র জানলো তাদের বড় বোন অনিতার ছেলে সাদনানকে পড়ানোর জন্যই অনিমা তনিমা এতো জোরাজুরি করেছে নাহলে এই টিউশনি করাতে নারাজ ছিলো সে। কিন্তু অনিমা তনিমার যুক্তির কাছে না হেরে পারেনি মীরা। তাদের ভাস্যমতে,’ দেখ মীরা, তিনটে টিউশনি করছিস এর মধ্যে একটা টিউশনি নড়বড়ে। কখন চলে যায় ঠিক নেই এরমধ্যে যদি আরেকটা টিউশনি জোগাড় যেহেতু হয়েছেই সেহেতু তুই সেটাও কর। নাহলে ওই টিউশনি আর এই টিউশনি হাতছাড়া হলে নিজের খরচ চালাতে পারবি না। ‘ তাদের কথায় বাধ্য হয়ে পড়াতে এলো মীরা। এসেই এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। মীরা তারমানে আদ্রিকার শশুড় বাড়িতেই এসেছে পড়াতে? এতক্ষণে স্তম্ভিত মীরার দিকে তাকালো আদ্রিকা৷ বিস্ময়ে তার চোয়াল হা হয়ে গিয়েছে। হতবাক নয়নে তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। মীরা চোখ সরিয়ে নিলো, অভিমানে! আদ্রিকা তার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করেনি তবে সে কেনো যেচে কথা বলবে? সে বলবে না! মীরা বলল,’ জ্বী আমি সাদনানকে পড়ানোর জন্য এসেছি ওর ঘরটা দেখিয়ে দিলে ভালো হয়৷ ‘
অনিতা বললেন,’ হ্যাঁ, আদ্রিকা একটু কষ্ট করে সাদের ঘরটা দেখিয়ে দিবে? ‘
আদ্রিকা চমকালো। দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’ আসো। ‘
মীরা চুপচাপ আদ্রিকার পিছনে হাঁটা ধরলো৷ শুরুটা আদ্রিকাই করলো, বলল,’ মীরা? কেমন আছো? ‘
‘ ভালো। ‘ মীরার সোজাসাপ্টা জবাবে আদ্রিকা অবাক হলো! মীরা কি কোনোভাবে রাগ করেছে যোগাযোগ না করায়? করাটাই স্বাভাবিক! আদ্রিকা বলল,’ মীরা, আমি জানি তুমি অভিমান করেছো কিন্তু বিশ্বাস করো যোগাযোগ করার মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম না আমি! অনেক কষ্টে ভাইয়ের….. ‘
নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না আদ্রিকা। মীরা থামিয়ে দিলো তাকে বলল,’ আদ্রিকা আপু, আমাকে বুঝানোর দরকার নেই! আমি বুঝেছি তুমি নিশ্চয়ই বাধ্য হয়ে পারোনি৷ ‘
‘ তুমি হঠাৎ টিউশনি শুরু করলে যে? স্কুলের বেতনে পোষাচ্ছিলো না? ‘
‘ ওই বাড়িতে আমি থাকছি না তাই স্কুলেও চাকরী করার প্রয়োজনবোধ করি নি তাই ছেড়ে দিয়েছি। চাকরী ছেড়ে দিয়েছি এখন পেটেও দানা পড়ার জন্য কোনো কিছু করতে হবে!তাই কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে টিউশন করাচ্ছি। ‘
মীরার কথায় অবাক হলো আদ্রিকা। তার যাওয়ার পরই এতো কিছু হলো? তআর যাওয়ার পরপর দিয়েই কি মীরাকে অবহেলা করা শুরু হয়ে গেলো?
_
‘ মীরা কোথায়? তোমরা ওকে বের করে দিয়েছো? ‘
গম্ভির কণ্ঠে প্রশ্ন করলো আদ্রিক। সবাই তখন উপস্থিত। আদিল হুমায়ূন বললেন,’ সামান্য মেয়ের জন্য আমাদের এইভাবে জড়ো করার মানে কি? ‘
‘ ও সামান্য নয়, বাবা। ‘
মার্জিয়া বেগম বললেন,’ মীরা চলে গিয়েছে এখান থেকে। ওর বান্ধুবিদের সাথে মেসে উঠেছে। ‘
আদ্রিক তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,’ চলে গিয়েছে নাকি বের করে দিয়েছো তোমরা আমার অনুপস্থিতিতে? ‘
মার্জিয়া গম্ভির মুখে বললেন,’ আদ্রিক! আমি তোমার মা! আমার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারো না তুমি। আর তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অরিনের সাথে। অন্য মেয়ের নাম তোমার মুখে শোভা পায়না। ‘
অরিন এইবার মুখ খুললো! ও এইবার কিছু একটা না বললে আদ্রিক ভাববে সবাই মীরাকে বের করে দিয়েছে! হ্যাঁ বের করেছে কিন্তু তা তো আদ্রিককে জানতে দেওয়া যাবে না! আদ্রিক জানলে সব শেষ। অরিন আদ্রিককে বলল,’ আদ্রিক তুই শুধু সবাইকে দোষ দিচ্ছিস। মীরা নিজ ইচ্ছাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। কতোদিন এই বাড়িতে থেকেছে তখন তো কেউ কিছু বলে নি তো হুট করে ও কেনো বাড়ি ছাড়বে? নিশ্চয়ই ওর নিজ ইচ্ছাতেই। ‘
বলেই অরিন দমলো। অরিনের কথা ফেলে দেওয়ার মতো না। তারমানে আসলেই মীরা নিজের ইচ্ছাতে গিয়েছে? কেনো আদ্রিকের অনুভূতির জন্য? আদ্রিকের খারাপ লাগছে! কান্নাও পাচ্ছে। আদ্রিক কিছু না বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো। আদ্রিকের যেতেই সবাই চলে গেলো থেকে গেলো মার্জিয়া আর অরিন। অরিন মার্জিয়াকে বলল,’ আন্টি, আদ্রিক কোনোভাবে সত্যটা জেনে গেলে? ‘
‘ তুমি চিন্তা করো না। যতদিনে জানবে ততদিনে তোমাদের বিয়ে হয়েও যাবে। ‘
অরিন জোরপূর্বক হাসলো।
_
এরমাঝে সাদনানকে পড়াতে পড়াতে অনেকদিন কেটে গিয়েছে মীরার। আদ্রিকার যোগাযোগ না করার কারণও জানে মীরা। শুরুর দিকে তিশানের পরিবারের কেউ মানেনি দেখে মূলত তিশান আর আদ্রিকাকে সবাইকে মানাতে হয়েছে মানাতে মানাতেই তাদের অনেকদিন কেটে গিয়েছে। আদ্রিকা চাইলেও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারতো না! কার সাথে করবে? সবাই যে এখন পর!
মীরা ভার্সিটি শেষ করে সাদনানকে পড়াতে এসেছে আজ। সদর দরজা পেরুয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই মীরার পা দুটো আচানক থমকে গেলো। স্থির হয়ে গেলো সবকিছু যেনো। হৃদস্পন্দনও স্থির হয়ে গেলো। কিন্তু চাহনি অস্থির হয়ে রইলো। বহুদিন পর আবারো চিরচেনা সেই মুখ দেখে মীরা হতবাক হয়ে গেলো। মীরা অনুভব করলো শরীরের অসম্ভব রকমের কাঁপুনি। আবছা হয়ে এলো চোখ! অজানা অনুভূতি নড়ে উঠলো।
#চলবে?
#কৃষ্ণডাহুক – ২৪
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
এতোদিন পরে যে মানুষটার চোখে চোখ রাখতেও যে অস্বস্তি হবে তা ভাবেনি কখনো মীরা। অস্বস্তিতে মীরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আদ্রিকের চোখে তাকানো যাচ্ছে না। কিন্তু মীরা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে আদ্রিক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়েছে নাকি জানা নেই মীরার! কিন্তু আদ্রিকের আগমণ তাকে ভাবাচ্ছে! আদ্রিকা তো কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি তাহলে আদ্রিক? আদ্রিক কিভাবে চিনলো আদ্রিকার শশুড়বাড়ি? তবে কি আদ্রিকা শুধু আদ্রিকের সাথে যোগাযোগ করেছে? আদ্রিক মন্থর কণ্ঠে বলে উঠলো,’ আদ্রিকা, আমি এখানে এসেছিলাম বিয়ের দাওয়াত দিতে। ‘
কথাটা মীরার কর্ণপাত হতেই, মীরার অন্তর কেঁপে উঠলো! চমকে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিকের স্থির দৃষ্টিপাত তখনো তার দিকে। ইতস্ততভাবে নড়েচড়ে উঠলো মীরা। আদ্রিকা তখন বলল,’ হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে যে? ‘
আদ্রিক গলা খেকিয়ে উঠলো বলল,’ হুট করে মানে? বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিলো আমার আর অরিনের। আমার কারণেই না বিয়েটা হচ্ছিলো না। এখন যেহেতু আমার অসুবিধা নেই তাই বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা পড়াতে চাচ্ছে। ‘
আদ্রিকের কথায় খুব একটা খুশি হলো না আদ্রিকা। অরিনকে সে চেনে! তার পছন্দ না অরিনকে, একজন ভাবী হিসেবে! অরিন মীরার মতো এতিম হলেও আদ্রিকার কোনোদিন অরিনের প্রতি টান অনুভব হয়নি। মীরার দিকে তাকালেও যেনো একটা অজানা মায়া, টান এসে পড়ে৷
‘ ভাইয়া আমি বা আমরা কেউ আসতে পারবোনা। আমাকে আর তিশানকে কেউ মেনে নেয়নি কোন মুখে আমি যাবো তোমার বিয়েতে? ‘
‘ কেউ মেনে নেয় তাতে কি? তুই আমার, নিজের ভাইয়ের বিয়েতে যাচ্ছিস কে কিসে মাথা ঘামালো তা নিয়ে তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? তুই আসবি আমার বিয়েতে মানে আসবি। আরেকটা কথা বললে ভুলে যাবি আমি তোর ভাই। ‘
_
এলোমেলো পায়ে আদ্রিকের পাশে হাঁটছে মীরা। আজ সাদনানকে তাড়াতাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসেছিলো! কিন্তু কে জানতো বের হয়েই আদ্রিকের মুখোমুখি হতে হবে। আদ্রিককে দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যেতে নিলো তখনই আদ্রিক আচমকা মীরাকে বলল,’ শোনো মীরা ‘
মীরা থমকে গেলো, নতজানু হয়ে বলল,’ জ্বী?
‘ হাঁটতে থাকো, যেতে যেতে বলছি। ‘
জবাব দিলো না মীরা। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি আদ্রিকও হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমে দুইজনই মৌন। এইবার শুরুটা মীরাই করলো, বলল,’ কি জানি বলবেন? ‘
আদ্রিক কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ ওহ হ্যাঁ! আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতাম তোমাকে। এতোদিনের সম্পর্ক ছিলো আমাদের তারউপর আদ্রিকার ফ্রেন্ড তুমি সেহেতু দাওয়াত তো তোমাকে দেওয়াই লাগে। ‘
বলেই একটা কার্ড বের করে হাতে নিলো মীরা। স্বভাবসুলভ গম্ভির মুখে বলল,’ ধন্যবাদ, আপনার কথা শেষ? ‘
‘ কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? ‘
‘ মানে? ‘
‘ সোজা ভাষায়ই তো বললাম! কি এমন ক্ষতি করেছি যে আমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে? ‘
আদ্রিকের কথায় মীরা মুচকি হেসে বলল,’ ক্ষতি আপনি করেননি আদ্রিক, ক্ষতি তো আমার ভাগ্য করেছে! ‘
‘ কথা না প্যাচালে কি তোমার হয়না? ‘
‘ আমাকে না ভালোবাসলে আপনার হয়না? কেনো এতো ভালোবাসার কাঙাল আপনি? ‘
‘ আমার আর কারো ভালোবাসার প্রয়োজন ছিলো না মীরা, তোমার ভালোবাসা ব্যতীত! আমার আফসোস, শক্ত খোলসে আবৃত থাকা মানবীর কোমল হৃদয়ে আমার জায়গা হয় নি! আমি ব্যর্থ। ‘
‘ আপনি ব্যর্থ নন, ব্যর্থ আমি! আমার ব্যর্থতার জন্যই আজ আপনি আমাকে পাননি। ‘
মীরার কথাগুলো শুনে আদ্রিকের মনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো! সবকিছুর আড়ালে নিশ্চয়ই কিছু আছে যা কিনা সে জানে না! মীরা তার থেকে লুকাচ্ছে কিছু! তা সে জেনেই ছাড়বে যে করেই হোক।
আদ্রিক কিছু বলবে তার আগেই মীরা বলে,’ আজ আসি, আপনার বিয়ের জন্য অভিনন্দন। ‘
বলেই সে জায়গা থেকে মীরা দ্রুত চলে আসলো। কেউ না জানুক সে তো জানে তার কত কষ্ট লাগছিলো আদ্রিককে বিদায় জানাতে! আজ সে আদ্রিকের চেয়েও বড় অসহায়! আদ্রিকের চেয়েও ভালোবাসার বড় কাঙাল সে! বুকে দলা পাকিয়ে কান্নারা ভিড় করেছে।
_
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রটা উলটে পালটে দেখছে মীরা। আগামী সপ্তাহে বিয়ে। খুব দ্রুতই সব হচ্ছে! আদ্রিকের কি এতো তাড়া মীরাকে ভোলার? কোথায় তার তো এতো তাড়া নেই! তবে আদ্রিক কেনো তাকে ভুলতে চায়? এইসব ভেবেই মীরা আনমনে হাসলো।
অনিমা তনিমা মীরাকে দেখছে। মলিন মুখের মীরাকে দেখে তারা অভ্যস্ত নয়, তারা অভ্যস্ত গম্ভির মুখের মীরাকে দেখে! তাদের কাছে মীরাকে একদমই দুঃখী মানায় না!
অনিমা মীরাকে বলল,’ মীরা! কি হয়েছে? মনে হচ্ছে সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া প্রেমিকা। ‘
মীরা মলিন মুখে, হাসলো ‘ হ্যাঁ তাই তো! কিন্তু আমি ছ্যাঁকা খাওয়া নয় ব্যর্থ প্রেমিকা। ‘
মীরার কথায় অনিমা আর তনিমা দুজনই থতমত খেলো। দুজনে এক অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো কিন্তু কেউই কিছু বুঝলো না মীরার কথার অর্থ। মীরাকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। মীরা নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কাউকেই কখনো কিছু বলে না। এই নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করেও না কারণ তারা তো জানে এইসব মীরার পছন্দ না।
_
বৃষ্টিস্নাত এক রাত। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মুখোরিত চারদিক। ঘুম আসছে না মীরার। মন যেনো উশখুশ করছে কোনো কারণে। মীরা ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেলো। বারান্দায় নেট লাগানো, নেট এর মাঝে আবছা আবছা এক মানবকে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখা যাচ্ছে! মানবের দৃষ্টি তখন মীরার দিকে। মীরা পিলে চমকে উঠলো। থরথর কাঁপতে লাগলো হাত পা।
#চলবে?
#কৃষ্ণডাহুক – ২৪
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
এতোদিন পরে যে মানুষটার চোখে চোখ রাখতেও যে অস্বস্তি হবে তা ভাবেনি কখনো মীরা। অস্বস্তিতে মীরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আদ্রিকের চোখে তাকানো যাচ্ছে না। কিন্তু মীরা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে আদ্রিক তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়েছে নাকি জানা নেই মীরার! কিন্তু আদ্রিকের আগমণ তাকে ভাবাচ্ছে! আদ্রিকা তো কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি তাহলে আদ্রিক? আদ্রিক কিভাবে চিনলো আদ্রিকার শশুড়বাড়ি? তবে কি আদ্রিকা শুধু আদ্রিকের সাথে যোগাযোগ করেছে? আদ্রিক মন্থর কণ্ঠে বলে উঠলো,’ আদ্রিকা, আমি এখানে এসেছিলাম বিয়ের দাওয়াত দিতে। ‘
কথাটা মীরার কর্ণপাত হতেই, মীরার অন্তর কেঁপে উঠলো! চমকে তাকালো আদ্রিকের দিকে। আদ্রিকের স্থির দৃষ্টিপাত তখনো তার দিকে। ইতস্ততভাবে নড়েচড়ে উঠলো মীরা। আদ্রিকা তখন বলল,’ হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে যে? ‘
আদ্রিক গলা খেকিয়ে উঠলো বলল,’ হুট করে মানে? বিয়ে আগে থেকেই ঠিক ছিলো আমার আর অরিনের। আমার কারণেই না বিয়েটা হচ্ছিলো না। এখন যেহেতু আমার অসুবিধা নেই তাই বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি বিয়েটা পড়াতে চাচ্ছে। ‘
আদ্রিকের কথায় খুব একটা খুশি হলো না আদ্রিকা। অরিনকে সে চেনে! তার পছন্দ না অরিনকে, একজন ভাবী হিসেবে! অরিন মীরার মতো এতিম হলেও আদ্রিকার কোনোদিন অরিনের প্রতি টান অনুভব হয়নি। মীরার দিকে তাকালেও যেনো একটা অজানা মায়া, টান এসে পড়ে৷
‘ ভাইয়া আমি বা আমরা কেউ আসতে পারবোনা। আমাকে আর তিশানকে কেউ মেনে নেয়নি কোন মুখে আমি যাবো তোমার বিয়েতে? ‘
‘ কেউ মেনে নেয় তাতে কি? তুই আমার, নিজের ভাইয়ের বিয়েতে যাচ্ছিস কে কিসে মাথা ঘামালো তা নিয়ে তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? তুই আসবি আমার বিয়েতে মানে আসবি। আরেকটা কথা বললে ভুলে যাবি আমি তোর ভাই। ‘
_
এলোমেলো পায়ে আদ্রিকের পাশে হাঁটছে মীরা। আজ সাদনানকে তাড়াতাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসেছিলো! কিন্তু কে জানতো বের হয়েই আদ্রিকের মুখোমুখি হতে হবে। আদ্রিককে দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যেতে নিলো তখনই আদ্রিক আচমকা মীরাকে বলল,’ শোনো মীরা ‘
মীরা থমকে গেলো, নতজানু হয়ে বলল,’ জ্বী?
‘ হাঁটতে থাকো, যেতে যেতে বলছি। ‘
জবাব দিলো না মীরা। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি আদ্রিকও হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমে দুইজনই মৌন। এইবার শুরুটা মীরাই করলো, বলল,’ কি জানি বলবেন? ‘
আদ্রিক কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ ওহ হ্যাঁ! আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতাম তোমাকে। এতোদিনের সম্পর্ক ছিলো আমাদের তারউপর আদ্রিকার ফ্রেন্ড তুমি সেহেতু দাওয়াত তো তোমাকে দেওয়াই লাগে। ‘
বলেই একটা কার্ড বের করে হাতে নিলো মীরা। স্বভাবসুলভ গম্ভির মুখে বলল,’ ধন্যবাদ, আপনার কথা শেষ? ‘
‘ কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? ‘
‘ মানে? ‘
‘ সোজা ভাষায়ই তো বললাম! কি এমন ক্ষতি করেছি যে আমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে? ‘
আদ্রিকের কথায় মীরা মুচকি হেসে বলল,’ ক্ষতি আপনি করেননি আদ্রিক, ক্ষতি তো আমার ভাগ্য করেছে! ‘
‘ কথা না প্যাচালে কি তোমার হয়না? ‘
‘ আমাকে না ভালোবাসলে আপনার হয়না? কেনো এতো ভালোবাসার কাঙাল আপনি? ‘
‘ আমার আর কারো ভালোবাসার প্রয়োজন ছিলো না মীরা, তোমার ভালোবাসা ব্যতীত! আমার আফসোস, শক্ত খোলসে আবৃত থাকা মানবীর কোমল হৃদয়ে আমার জায়গা হয় নি! আমি ব্যর্থ। ‘
‘ আপনি ব্যর্থ নন, ব্যর্থ আমি! আমার ব্যর্থতার জন্যই আজ আপনি আমাকে পাননি। ‘
মীরার কথাগুলো শুনে আদ্রিকের মনে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো! সবকিছুর আড়ালে নিশ্চয়ই কিছু আছে যা কিনা সে জানে না! মীরা তার থেকে লুকাচ্ছে কিছু! তা সে জেনেই ছাড়বে যে করেই হোক।
আদ্রিক কিছু বলবে তার আগেই মীরা বলে,’ আজ আসি, আপনার বিয়ের জন্য অভিনন্দন। ‘
বলেই সে জায়গা থেকে মীরা দ্রুত চলে আসলো। কেউ না জানুক সে তো জানে তার কত কষ্ট লাগছিলো আদ্রিককে বিদায় জানাতে! আজ সে আদ্রিকের চেয়েও বড় অসহায়! আদ্রিকের চেয়েও ভালোবাসার বড় কাঙাল সে! বুকে দলা পাকিয়ে কান্নারা ভিড় করেছে।
_
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রটা উলটে পালটে দেখছে মীরা। আগামী সপ্তাহে বিয়ে। খুব দ্রুতই সব হচ্ছে! আদ্রিকের কি এতো তাড়া মীরাকে ভোলার? কোথায় তার তো এতো তাড়া নেই! তবে আদ্রিক কেনো তাকে ভুলতে চায়? এইসব ভেবেই মীরা আনমনে হাসলো।
অনিমা তনিমা মীরাকে দেখছে। মলিন মুখের মীরাকে দেখে তারা অভ্যস্ত নয়, তারা অভ্যস্ত গম্ভির মুখের মীরাকে দেখে! তাদের কাছে মীরাকে একদমই দুঃখী মানায় না!
অনিমা মীরাকে বলল,’ মীরা! কি হয়েছে? মনে হচ্ছে সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া প্রেমিকা। ‘
মীরা মলিন মুখে, হাসলো ‘ হ্যাঁ তাই তো! কিন্তু আমি ছ্যাঁকা খাওয়া নয় ব্যর্থ প্রেমিকা। ‘
মীরার কথায় অনিমা আর তনিমা দুজনই থতমত খেলো। দুজনে এক অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো কিন্তু কেউই কিছু বুঝলো না মীরার কথার অর্থ। মীরাকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। মীরা নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কাউকেই কখনো কিছু বলে না। এই নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করেও না কারণ তারা তো জানে এইসব মীরার পছন্দ না।
_
বৃষ্টিস্নাত এক রাত। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মুখোরিত চারদিক। ঘুম আসছে না মীরার। মন যেনো উশখুশ করছে কোনো কারণে। মীরা ধীর পায়ে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেলো। বারান্দায় নেট লাগানো, নেট এর মাঝে আবছা আবছা এক মানবকে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখা যাচ্ছে! মানবের দৃষ্টি তখন মীরার দিকে। মীরা পিলে চমকে উঠলো। থরথর কাঁপতে লাগলো হাত পা।
#চলবে?