#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৩
সেই কন্ঠস্বর যা রাগিনীর সর্বাঙ্গ অস্থির করে তোলে তা শুনে আর রাগিনীর পক্ষে স্থির থাকা যেন সম্ভব হলো না। নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল। এই কন্ঠের সুর তো সে ভুল শুনতে পারে না। আর দেরি করল না রাগিনী। রিসেপশন থেকে দ্রুত পায়ে চলে গেল লিফটের দিকে। সে যেতে যেতে লিফটের দরজা বন্ধ হলো। রাগিনীর মাথায় পড়ল হাত। অন্যদিকে রিসেপশনিস্ট বার বার তাকে পিছু ডাকছে ফর্মালিটি পূরণ করতে। কিন্তু রাগিনীর ধ্যান যেন অন্যদিকে। কিছুক্ষণ থম মেরে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল রাগিনী। স্মরণে এলো একজনের নাম। আপনমনে বলল,
“ইন্সপেক্টর রায়ান!”
রাগিনী ছুটে এলো রিসেপশনিস্টের কাছে। রিসেপশনিস্ট তাকে দেখেই বলে উঠল,
“ফর্মালিটি পূরণ না করে কোথায় যাচ্ছেন এভাবে ম্যাম?”
রাগিনীর মনে পড়ে ফর্মালিটির কথা। মূহুর্তের জন্য যেন বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল তার। সেই মূহুর্তেই আগমন ঘটে ফাহমিদের। তাকে দেখেই যেন আশার আলো পায় রাগিনী। দ্রুততার সঙ্গে বলে ওঠে,
“ফাহমিদ, র’ক্ত দিয়েছো? এখন কেমন আছে সে? ইমারজেন্সিতে তো ঢোকানো হয়েছিল বাচ্চাটাকে।”
“হ্যাঁ। হি ইজ আউট ওফ ডেঞ্জার। চিন্তা করো না রাগিনী। চোখমুখ শুঁকিয়ে গেছে তোমার।”
“আরেক হেল্প করে দাও প্লিজ! ছেলেটার ফর্মালিটিস্ পূরণ করে দাও। আমার একটা কাজ আছে।”
অনুনয়ের সুরে কথাগুলো শেষ করেই সে রিসেপশনিস্টের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল।
“ই…ইন্সপেক্টর রায়ান কি এই হসপিটালে ভর্তি আছেন? কত নম্বর রুমে আছেন বলতে পারবেন একটু? আমার খুব দরকার। আর ফর্মালিটিস্ ইনি পূরণ করতে হেল্প করবেন আপনাকে।”
বলেই ফাহমিদকে দেখিয়ে দিল রাগিনী। রিসেপশনিস্ট সময় নিয়ে চেক দিয়ে দেখে বলল,
“রুম নম্বর ৩০৭। থার্ড ফ্লোর। গু’লিতে আহত হওয়া পেশেন্ট।”
রাগিনীকে আর পায় কে? দ্রুত পায়ে সে লিফটের কাছে গিয়ে ঢুকে যায়। পেছন থেকে বোকা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফাহমিদ। মেয়েটা কোথায় চলে গেল হঠাৎ? কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সে। অতঃপর চশমা ঠিক করে রিসেপশনিস্টকে ফর্ম ফিলআপ করতে সাহায্য করতে লাগল।
থার্ড ফ্লোরে পৌঁছে আশেপাশে পাগলের মতো খোঁজ করল রাগিনী। কোথাও যদি সেই চেহারার দেখা মেলে! আবারও যদি সেই কন্ঠ কানে ভেসে আসে। কিন্তু তা আর হলো না। তবে কি সে ভুল শুনলো? রাগিনী এটা মানে না। সে ভুল শোনে নি এটা সে বিশ্বাস করে। সে স্পষ্ট শুনেছে সেই কন্ঠ। তার নাকে এসেছে সেই ঘ্রাণ। যা কোহিনূরের জামা থেকে আসতো। এটাও কি ভুল?
রাগিনী হেঁটে এগোতে থাকে ৩০৭ নম্বর কেবিনের দিকে। মাথায় ঘুরছে অসংখ্য প্রশ্ন। যার উত্তর তার কাছে নেই। সবথেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে কোহিনূর কি তবে সুস্থ? সুস্থ হলে তার সঙ্গে এমন করছে কেন আর হসপিটালেই বা পড়ে আছে কেন? মাথা বিগড়ে যাচ্ছে রাগিনীর। আগপাছ আর না ভেবে সে এসে থামলো নির্ধারিত কেবিনের সামনে। কেবিনের দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দেওয়া। রাগিনী হাতটা বাড়িয়ে দরজায় একটু ধাক্কা দিতে চায়। কিন্তু অস্থিরতা বোধ হচ্ছে ভেতর থেকে। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। শুঁকিয়ে শুষ্ক হয়ে গেছে তার ঠোঁট। একটা দম নিয়ে আস্তে করে ধাক্কা দিল দরজায়। ধীর পায়ে প্রবেশ করল কেবিনে। দুই ধাপ হাঁটতেই থামলো সে। পা আর চলতে চাইল না। বেডে অজ্ঞানরত অবস্থায় শুয়ে আছে একটা লোক। রাগিনী তাকে চেনে না। তবে লোকটার বয়স বেশি না। হবে কোহিনূরের বয়সী। চোখেমুখে তার বিশাল ক্লান্তি! বাম হাতে স্যালাইনের সুঁচ ফুটানো। হঠাৎ করেই অচেনা পুরুষালি কন্ঠে পিলে চমকে উঠল রাগিনীর। হুড়মুড়িয়ে তাকালো কেবিনে থাকা একটা সিঙ্গেল সোফার দিকে। এই পুরুষটিকে রাগিনী না চিনলেও তার চেনা চেনা লাগছে এবার। মাথায় ঝাঁকড়া চুলের বাহার, স্টাইল করে কাটা খোঁচা দাড়ি। শার্টের ভাঁজে রেখে দেওয়া তার দামি সানগ্লাস আর হাতে ব্র্যান্ডের ঘড়ি। লোকটির চাহনিও উদ্ভট। তার চাহনি দেখে রাগিনী ভড়কালো। কিছু বলতে উদ্যত হলো। তবে পারল না। তার আগেই সেই সুদর্শন পুরুষ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,
“আ…আরে আপনি এখানে! এখানে কী করে?”
বলেই দাঁড়িয়ে গেল অভিরূপ। রাগিনী এবারও কিছু বলতে চাইলো। তবে মুখ থেকে শব্দ বের হতে সময় লাগছে। অভিরূপ নিজ থেকে বলে উঠল,
“আপনিই তো ওই বাচ্চাটাকে বাঁচিয়েছিলেন। রাইট?”
অভিরূপ বেশ আগ্রহী। তার পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরেছে। কী বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। আবারও এই সাহসী নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। অভিরূপ ভেবেছিল সেই সাহসী দৃষ্টি সে সেই ঝামেলার সাথেই হারিয়ে ফেলবে। মনের মধ্যে এক টান টান উত্তেজনার উদ্ভব হয়েছে যা দমাতে চেষ্টা করছে অভিরূপ। অপরদিকে রাগিনী চিন্তায় মগ্ন। লোকটা কীসের কথা বলছে? সে কি ওই বাচ্চা ছেলেটার কথা বলছে যাকে রাগিনী রেসকিউ করে হসপিটালে নিয়ে এসেছে? তাই হবে হয়ত। এটা ভেবেই সে ঝটপট করে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?”
“আমি তো সেখানেই ছিলাম। সামনের গাড়িতে ছিলাম আমি।”
রাগিনী প্রতিত্তোরে কী বলবে যা ভেবে পায় না। শুধু বোঝার চেষ্টা করে এই লোকটা আসলে কে। মনে আসতেই সে হতভম্ব হয়ে বলে,
“আ…আপনি অভিরূপ চৌধুরী না?”
অভিরূপ হালকা হেঁসে উত্তর দেয়,
“ইয়েস। ইউ আর রাইট। আপনি কী ইন্সপেক্টর রায়ানের পরিচিত কেউ হন?”
রাগিনী থতমত খেয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না, না। আমি রাগিনী তাজরীন। ভুল করে এই কেবিনে ঢুকে পড়েছি। আই এম সরি। এক্সকিউজ মি!”
আর এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না রাগিনী। পেছন ঘুরে দরজা দিয়ে সেকেন্ডেই হাওয়া হয়ে গেল। অভিরূপ তাকে আরো কিছু বলতে গিয়েও পারল না। হতাশ হয়ে বলল,
“আশ্চর্য! মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? নাকি নারীজাতিই অদ্ভুত? এতো এতো আ’তঙ্কবাদীর সামনে সুপারওম্যান হয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচালো অথচ আমার সামনে এক মূহুর্তও টিকতে পারল না? দ্যাটস্ নট ফেয়ার।”
অভিরূপ ফিরে এসে বসল সোফায়। রায়ানের আ’হত হবার খবর শুনে অভিরূপ জেদ ধরেই হসপিটালে এসেছে। তার মতে, যে তার এতো খেয়াল রাখলো তার পাশে না থাকা এক ধরণের স্বার্থপরতা। আর অভিরূপ চৌধুরী এতো স্বার্থপর নয়! নিজের গালে হাত রাখল অভিরূপ। মেয়েটির দৃষ্টির ধরণ আলাদা আলাদা। সেটাই মনে পড়ছে অভিরূপের। আনমনে সে আওড়ালো,
“বাট দ্যাট গার্ল! যখন প্রথম দেখেছিলাম মনে হয়েছিল তার দৃষ্টি থেকে অগ্নি ঝরছে। আর একটু আগে মনে হয়েছিল তার ভয়ার্ত দৃষ্টি দ্বারা কাউকে খু’ন করছে। কী যেন নাম তার। রাগিনী তাজরীন! তার সঙ্গে নামটা আসলেই স্যুট করে। গান গাইতে ইচ্ছে করছে খুব। মিস. রাগিনীকে ডেডিকেট করে!”
বলে কিছু একটা ভেবে নিজের কপালে হালকা করে চাপড় মা’রে সে। আর নিজে নিজেকে বলে,
“অভি! ইউ আর গোয়িং ক্রেজি। তোর সামনে একজন পেশেন্ট ঘুমিয়ে আছে আর তুই সেই সাহসী নারীকে ডেডিকেট করে গান গাওয়ার চেষ্টা করছিস! তুই সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছিস এবার।”
বাচ্চা ছেলেটির কাছে নির্বিঘ্নে বসে ছিল ফাহমিদ। কারোর পায়ের শব্দে পিছু ফিরে তাকায় সে। রাগিনী অন্যমনস্ক হয়ে কেবিনে ঢুকছে। তাকে দেখেই ফাহমিদ প্রশ্ন করে উঠল,
“কোথায় গিয়েছিলে? ছেলেটা তোমায় খুঁজছিল।”
রাগিনী চকিতে তাকায়। আমতা আমতা করতে থাকে। ছোট ছেলেটার মায়াবী মুখশ্রীর পানে চায়। শ্যামলা চেহারা হলে কী হবে? সারা মুখে যেন নূর ছড়িয়ে আছে। মাথায় সাদা রঙের ব্যান্ডেজ। হাতে প্লাস্টার করে দিয়েছে। রাগিনী প্রসঙ্গে কাটিয়ে বলে,
“সে ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হ্যাঁ, তোমার কথা ওকে বলেছিলাম। তারপর থেকে তোমার খোঁজ করছিল। করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ক্লান্ত মনে হয়।”
“হওয়ারই তো কথা। এতটুকু বয়সে ইন’কাম করতে নেমেছে রাস্তায়। অথচ এদের প্রতিই জনগনের কোনো দায়িত্ব নেই।”
ফাহমিদ শান্ত গলায় বলে,
“সবাই তো রাগিনী তাজরীন হতে পারে না!”
রাগিনী চোখ গোল গোল করে তাকায়। একটু ভেবে বলে,
“সবাই ফাহমিদও হতে পারে না। থ্যাংক ইউ ফাহমিদ। শুরু থেকে তুমি আমাকে এতোটাই হেল্প করে এসেছো যে তোমায় যতবারই থ্যাংক ইউ বলি লজ্জা নিজেরই লাগে।”
প্রতিত্তোরে কিছু বলতে চায় ফাহমিদ। তার বিপরীতে রাগিনী আবারও বলে ওঠে,
“আমার জীবনে সবথেকে বড় উপকার তুমি করেছো। যদি তুমি সেই রাতে না থাকতে তাহলে ওই নোংরা ছেলেগুলোর বাজে স্পর্শ হয়ত আমাকে অসম্মানিত করে ফেলতো। আমার সম্মান মাটিতে মিশে যেতো। এখনো মনে আছে আমার! ওইদিন কোহিনূরের সঙ্গে দেখা করে ফিরতে দেরি হয়েছিল। ড্রাইভার চাচা গাড়িতে ছিলেন না। আমি উনাকে খুঁজতে এক ওফসাইডে গিয়েছিলাম। ওটাই আমার কাল হলো। অসভ্য আর মাতাল ছেলেগুলো আমাকে ধাওয়া করল। আমি পড়ে গেলাম দৌড়াতে গিয়ে মাঝ রাস্তায়। কাঁচ পড়ে থাকায় হাতে ফুটে গেল। হাত থেকে র’ক্ত ঝরছিল। পায়ে এতোটা আ’ঘাত পেয়েছিলাম যে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অবধি পাচ্ছিলাম না। সঠিক সময় তুমি এসেছিলে ভাগ্যিস। আর আজকে একটা বাচ্চা ছেলেকে র’ক্ত দিয়ে তার প্রাণ বাঁচালে। ভাগ্যিস তোমার সাথে তার র’ক্তের গ্রুপ ম্যাচ করেছিল। তুমি মানুষটা অনেক ভালো। কখনো তোমার কোনো উপকারে আসতে পারলে অবশ্যই আমাকে মনে করবে।”
ফাহমিদ তার এতো এতো প্রশংসা শুনে কেমন যেন লাজুক হাসি দিল। মাথা চুলকে চমশা ঠিক করল। তা দেখে মুখ টিপে হাসলো রাগিনী। এই ফাহমিদ ছেলেটার সঙ্গে সে আগে কলেজে পড়তো। ক্লাসমেট ছিল তারা। তবে আগে ফাহমিদ রাগিনীকে পছন্দ করতো। কিন্তু আগে তার এমন বোকাসোকা ভাব ছিল না। তবে মিশুক ছিল মানুষদের সঙ্গে। রাগিনীকে প্রেম নামক প্রস্তাব দেওয়ায় রাগিনী তা নাকচ করেছিল। তার কয়েকদিন পর উধাও হয় ফাহমিদ। অনেকদিন পর সেদিন রাতে তাদের দেখা। রাগিনী শুনেছে ফাহমিদদের পারিবারিক সমস্যার কারণে মাঝখানে পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছিল। তবে ছেলেটা বেশ সরল। কোহিনূরের মতো সরল বুঝি? তৎক্ষনাৎ মাথায় নাড়ায় রাগিনী। একদমই না। কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে অন্য কোনো মানবের তুলনা চলে না। মানুষটি অনন্য। ফাহমিদ বলে উঠল,
“তুমি কি কম সাহায্য করেছো? তোমার সঙ্গে এতোদিন পর যেদিন দেখা হলো অনেক রাত ছিল। আমার বাইক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এতো রাত হওয়া সত্ত্বেও তুমি আমাকে এড়িয়ে না গিয়ে সাহায্য করলে। আঙ্কেল বকেছিল না সেদিন?”
রাগিনী মাথা নাড়ায়। মিস্টি হেঁসে বলে,
“আমার বাবা তেমন মানুষ নয়। আমার সঙ্গে উচ্চস্বরে কখনো কথা বলেনি। কোনো ভুল হলে আমাকে আদর করে বুঝিয়ে দেয়। আমার বাবা পৃথিবীর সব বাবার থেকে আলাদা। হয়ত সব সন্তানের কাছেই তার বাবা-মা সবচেয়ে আলাদা!”
ফাহমিদ এবার নিরব রইল। চোখমুখের রঙ হঠাৎ করেই পাল্টে গেল তার। মুখে দেখা গেল লাল রঙের আভা। মুখটা ভার হলো। হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আমার তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি একটু পর আসছি।”
ফাহমিদ বেরিয়ে যায়। রাগিনী সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে টুল নিয়ে এসে এগিয়ে ছেলেটির পাশে বসে। কী মায়াবী মুখখানা। রাগিনী আলতো করে ছেলেটির গালে হাত রাখে। নিচু সুরে বলে,
“চিন্তা করো না। তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।”
কথাগুলো বলতে বলতে রাগিনী খেয়াল করল জানালার থাইয়ের কাঁচের দিকে। দরজার পাশে কারো অবয়ব দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত কোনো পুরুষের। তার হাতের ঘড়ি চকচক করছে। তড়িঘড়ি করে পেছন ঘুরল সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কে? কে ওখানে?”
কারোর আওয়াজ না পেয়ে রাগিনী দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল দরজার কাছে। পর্দা সরিয়ে কারোর অস্তিত্ব পেল না রাগিনী। দরজা দিয়ে বাহিরে এসে সবদিকে ঘুরেফিরে তাকালো। কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তিকে না পেয়ে হতাশ হলো সে। সে কি ভুল দেখলো? কীসব হচ্ছে তার সাথে? সে কি হ্যালুসিনেট করছে?
তড়িঘড়ি করে হাঁটতে গিয়ে কারোর সঙ্গে ধাক্কা খেল নির্জন। ঠোঁট চেপে চাপা গলায় বিপরীত মানুষটিকে বলে উঠল,
“সরি। দেখতে…”
পুরো কথা শেষ না করেই থামলো সে। বিপরীতে মেহরাজকে দেখে চোখ সরু হয়ে এলো তার। এবার কন্ঠে কাঠিন্য ভাব এনে বলল,
“ওহ, তুমি! চোখ কি মাথায় উপরে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও নাকি? দেখতে পাও না?”
মেহরাজ ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বিরবির করে বলে উঠল,
“স্যার, মানুষটা আমি জন্যই এভাবে ধমকাচ্ছেন। অথচ ধাক্কাটা আপনি মেরেছিলেন। যে বলেছিলো ঠিকই বলেছিলো, ‘নরমের উপর মানুষ গরম ঝাড়ে।'”
কথাটা নির্জনের কানে আসতেই চোখ গরম করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মাথা নিচু করল মেহরাজ। দৃষ্টি নিচু হতেই তার নজরে এলো নির্জনের র’ক্তাক্ত হাত। র’ক্ত শুকিয়ে গেছে প্রায়। ফট করে মেহরাজ তার হাত ধরে ফেলে। আর উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
“স্যার, আপনার হাতের অবস্থাও খারাপ। একটু ড্রেসিং করিয়ে নিতে হবে তো। সবার খেয়াল আপনি রাখেন। কিন্তু আপনার খেয়ালও তো রাখতে হবে। আসুন তো আমার সাথে।”
নির্জন ধীর গলায় উত্তরে বলে,
“আমার খেয়াল রাখতে তোমার মতো একটা মাথামোটা থাকলেই চলবে।”
বলেই ঠোঁট চেপে হেঁসে ওঠে নির্জন। মেহরাজ তার হাত ছেড়ে অসহায় ভঙ্গিতে তাকায়। ভাবতে থাকে, মানুষটা তাকে ইনসাল্ট করল নাকি সুনাম করল?
সেদিন ব্যস্ত দিন কাটলো রাগিনীর। ছেলেটার দেখভাল থেকে শুরু করে ছেলেটির মাকে খবর দেওয়া থেকে শুরু করে উর্মিলা থেকে কিছু ফাইলস্ কালেক্ট করা অবধি করে আর কোহিনূরের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। বাবা পৌঁছার আগে যে করে হক বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল সে দ্রুতই। সবমিলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল না খেয়েই। তবুও বাবার যত্ন থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হয়নি তার। ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে তবেই ছেড়েছিলেন রাশেদ সাহেব। এভাবেই চলে গেল রাত। কেটে গেল প্রতিদিনের সাক্ষাৎ ছাড়া একদিন।
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪
“রাগিনী, তোমার নাদিম আঙ্কেলের কথা মনে আছে?”
রাগিনী রাশেদ সাহেবকে সকালের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। তাড়াহুড়ো রয়েছে তার আজ ভীষণ। আবারও হসপিটালে দৌড়াতে হবে। তবে এর মাঝে রাশেদ সাহেবের প্রশ্নে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবুক হয়ে পড়ে রাগিনী। নামটা তার চেনা চেনা লাগছে। একটু ভাবতেই যেন স্মরণে এলো তার। বলে উঠল,
“ইন্ডিয়ায় যিনি থাকেন উনার কথা বলছো?”
“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো। তোমাকে বলব বলব করে বলা হয়ে ওঠেনি। ওর ছেলে তো আমাদের এখানে এসেছে। অভিরূপ চৌধুরী! তোমার চেনার কথা। তো আমি চাইছিলাম না সে আমাদের দেশে এসে কোনো হোটেলে থাকুক। তাই ভাবছিলাম আজ ওকে নিয়ে আসব।”
এবার টনক নড়ে রাগিনীর। খানিকটা চকিতে তাকায়। বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“নাদিম আঙ্কেলের ছেলে দ্যা ফেমাস সিঙ্গার অভিরূপ চৌধুরী?”
“হ্যাঁ। তোমার ভুলে যাওয়ারই কথা। তুমি তখন তো অনেক ছোট ছিলে।”
রাগিনী আর কোনো কথা বলল না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভাবলো গতকালকের ঘটনা। কীভাবে তাড়াহুড়ো আর খাপছাড়াভাবে কথাবার্তা বলে একরকম পালিয়ে এসেছে সে। ব্যাপারটা হয়ত একদম ঠিক হয়নি। এবার মুখোমুখি হলে কী হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই নিজেকে সামলে নিল রাগিনী। যা হবার হবে। এখন এতো কথা ভাবার সময় নেই। তাকে বের হতে হবে।
সিঙ্গেল একটা বেডে উপুড় হয়ে পড়ে থেকে গভীর ঘুমে মগ্ন কোহিনূর। বেডের সাথে লাগানো জানালা দিয়ে তার মুখে রোদের তীব্র আলো পড়াতে মাথার নিচে রাখা বালিশটা মাথার উপরে মুখ ঢেকে রয়েছে সে। বেড ছোট হওয়াতে তার একটা পায়ের অর্ধেক বাহিরে চলে গিয়ে ঝুলছে। হঠাৎই তার তীব্র ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো কেউ। মুখের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো বালিশ। ফোলা ফোলা সেই মুখে এসে পড়ল রৌদ্রজ্বল রেখাগুলো। শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। কোনোরকমে সোজা হয়ে শুয়ে হাতিয়ে কাছে থাকা একটা চাদর নিয়ে মুখ ঢেকে অস্পষ্ট সুরে ধমকের সুরে বলে উঠল,
“মেহরাজ! মাথা গরম করে দিও না সকাল সকাল। এমনি বিগত কয়েকদিন ধরে ঘুম হচ্ছে না। মাঝখান থেকে ঘুম বিগড়ে দিলে একটানা পাঁচ দিন তোমায় রাত জাগিয়ে কাজ করে নেব।”
বলেই কাছে থাকা কোলবালিশ চেপে ধরল কোহিনূর। অতঃপর সেটা দিয়ে মুখ ঢাকল। তার মুখে বিরক্তির ছাপ প্রবল এখনো। তার বিরক্তি বাড়ানোর জন্য যেন কোলবালিশটাও চট করে টেনে নেওয়া হলো। চোখ মেলতে ইচ্ছে করল না কোহিনূরের। তীব্র রেগে বলে উঠল,
“আহহ…এমনি ঠেলায় পড়ে এই গরমে এসি ছাড়া ফ্যানের নিচে ঘুমোতে ঘুমোতে আমি শুঁকিয়ে যাচ্ছি। আর একবার যদি জ্বালিয়েছো মুখের ভেতর পরপর তিনটা গু’লি ঢুকিয়ে দেব। রাবিশ!”
“তা আপনি রি’ভলবার কোথায় পাবেন গু’লি মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য?”
কোহিনূর এবার চুপ থাকে। ঘুমটা ছাড়তে চাইছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবে মেয়েলি কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠল সে। শ্রবণেন্দ্রিয় কি ভুল শুনলো নাকি? বড় একটা হাই তুলে প্রশ্ন করল,
“মেহরাজ! আজকাল কি মেয়েদের কন্ঠস্বর প্র্যাক্টিস করছো? এমন মেয়ে মেয়ে লাগছে কেন?”
“বিকজ, আই এম অ্যা গার্ল। আমি রাগিনী।”
এখনো ঘুমের ঘোর কাটাতে পেরে ওঠেনি কোহিনূর। ঘুম জড়ানো কন্ঠে এবার ফট করেই বলে দিল,
“রাগিনী আবার কে?”
কোহিনূরের মুখ থেকে যখন রাগিনী নামটি বের হলো তখন মস্তিস্ক যেন এক কঠিন আ’ঘাত দিল কোহিনূরকে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটা’তে থাকল। হম্বিতম্বি করে চোখ মেলে তাকালো সামনে থাকা সেই মানবীর দিকে। রাগিনী কোমড়ে হাত দিয়ে সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে। কোহিনূরের চোখেমুখে তখন স্পষ্ট আতঙ্ক দেখতে পায় রাগিনী। কোহিনূর ঘুমের কিছু মূহুর্তের জন্য ভুলে বসেছিল তার বর্তমান জীবন! অনেক কথায় বলে বসেছে সে। ঢক গিলে নিল এবার। চোখটা বড় বড় করে আনন্দিত হবার চেষ্টা করে বলল,
“রা…রাগের রানী, রাগের রানী। তুমি এসেছো।”
বালিশটা বিছানায় রাখল রাগিনী। কোহিনূরকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করল,
“এসেছি তো বটেই। কিন্তু আমাকে কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছিলেন আপনি?”
কোহিনূর থতমত খায় এবার। ঠিক চুরি করার পর চোর ধরা পড়লে যেমন অবস্থা হয় ঠিক তেমন হয়েছে তার চেহারা। সে তার ঘন এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলোতে হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“কার সঙ্গে?”
“মেহরাজ কে?”
কোহিনূর আবারও চুপ থাকে। কপালে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাঁজ। একটু চুপ থেকে বলে ওঠে,
“জানি না তো। তুমি জানো!”
“আশ্চর্য! আমি কী করে জানব? আপনি ঘুমের মধ্যে বলছিলেন তার কথা।”
কোহিনূর এবার বোকা হাসি দিল। রাগিনীর হাতটা টেনে ধরে বলল,
“ঘুমের মধ্যে কত কী বলে! ওসব পাত্তা দিতে নেই। আগে বলো কাল আসো নি কেন?”
রাগিনী এবার বেডের সাইডে বসে। আর ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“কারণ আছে নিশ্চয়। ব্যস্ত ছিলাম।”
“ব্যস্ত ছিলে নাকি থাকার চেষ্টা করছিলে?”
“ব্যস্ত ছিলাম। এখন যদি কাইন্ডলি ফ্রেশ হয়ে আসতেন তাহলে দ্রুত ব্রেকফাস্ট করে আমরা বের হতাম।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকায় কোহিনূর। বিস্ময়ের সুরে বলে,
“কোথায়?”
“আপনার শ্বশুরবাড়ি।”
দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিয়ে আওড়ালো রাগিনী। কোহিনূর তা শুনে মুখ হা করে অবাক হওয়ার ভং ধরে মুখে হাত দিয়ে বলল,
“এতো বড় অপবাদ তুমি দিতে পারলে? আমি বিয়েই করলাম না আর তুমি শ্বশুড়বাড়ি বানিয়ে দিলে।”
সরু চোখে তাকালো রাগিনী। কোহিনূর বালিশ সরিয়ে এগিয়ে রাগিনীর কাছে এসে বসল। রাগিনীর দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“বাই এনি চান্স তুমি আমাকে ফাঁসানোর প্ল্যান করছো না তো? লাইক আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করা? হয়, হয়। আমার মতো একটা ড্যাশিং ছেলেকে সামনে দেখলে সব মেয়েরই এমন ইচ্ছা জাগে। এটা তোমার দোষ নয়। আমার এই হ্যান্ডসাম লুকের দোষ।”
কোহিনূর নিজের মাথার চুল স্টাইলের সাথে ঠিক করতে থাকলো বেশ ভাবসাব নিয়ে। রাগিনী তবুও চুপ রইল। কোহিনূরের কথা শেষ হবার পর সে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসি দিয়ে বলে,
“বর্তমানে আপনার এই অ্যামাজন জঙ্গলের মতো চুল, আলুর থেকে বেশি ফুলে যাওয়া চোখমুখ দেখলে আপনার জন্য পাগল হয়ে যাওয়া সো কলড মেয়েরা দৌড়ে পালাবে। বিলিভ মি!”
তৎক্ষনাৎ কোহিনূরের হাতটা চলে যায় তার মুখে। আসলেই তাকে এমন লাগছে! কি বিশ্রী ব্যাপার। প্রেস্টিজ সব ফুটো হয়ে গেল। রাগিনী মেয়েটা শান্ত ভাবে কী করে বাঁশঝাড় গছিয়ে দিতে হয় সেটা বেশ ভালো করে জানে। সে কথাটুকু বলার পর একেবারে সাইলেন্ট মুডে চলে গেছে। আর কোহিনূর সে আর বিলম্ব না করেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। তার কান্ড দেখে পিছনে বসে থাকা রাগিনীর মুখে ফোটে চাপা হাসি। মুখে হাত দিয়ে হেঁসে ফেলে ঝংকার বয়ে যায় ছোট্ট ঘরে। হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
“পাগল লোকটা একটু বুঝতে পারতেন যে উনার ঘুম থেকে ওঠার পর ফুলিয়ে রাখা চোখমুখে কঠিন স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে ছিল তবে হয়ত এতো তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হতে যেতেন না।”
কোহিনূর তখন টাওয়াল নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করল। টাওয়াল মুখ থেকে সরিয়ে বেডের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই চোখ ছানাবড়া হলো তার। দ্রুত নিকটে এসে বসল ধপ করে। রাগিনী দুটো টিফিনবক্স থেকে একেক পদের খাবার বের করতে আরম্ভ করেছে। খাবারের পদ যেন শেষ হচ্ছে না। দুটোই বড় বড় টিফিনবক্স। কোহিনূর আশ্চর্য হয়ে বলে,
“তুমি কি শুধু আমাকে খাওয়াতে এসব এনেছো নাকি আজকে এখানকার সবাইকে খাওয়ানোর প্ল্যানিং করেছো?”
রাগিনী একটা একটা করে সবচেয়ে শেষের বক্সের পার্ট খুলে রেখে কোহিনূরের দিকে মাথা উঠিয়ে তাকায়। ছেলেটার কপালে এখনো বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। চুলের কিছু অংশ ভিজে নেতিয়ে পড়েছে। রোদের আলোয় পানির ফোঁটাগুলো কেমন চিকচিক করছে। রাগিনীর হাত যেন আপনাআপনি চলে গেল কোহিনূরের চুলে। বেশ উচ্ছ্বাসে সাথে ঝেড়ে দিল চুলের পানি। তার মুখ দেখে মনে হলো বেশ মজা পেয়েছে সে। কোহিনূর নিজের মাথা নিচু করে বেশ কোমল সুরে বলে ওঠে,
“ম্যাসাজে খুব আরাম লাগল। আরো ম্যাসাজ করে দিতে পারো। মাইন্ড করব না। বিনা ফি তে এতো সুন্দর কোমল হাতের ম্যাসাজ কে না চায়!”
রাগিনী ভ্রু আর নাক কুঁচকায়। তারপর হাত বাড়িয়ে কোহিনূরের চুল ফট করে টেনে বলে ওঠে,
“আরো লাগবে?”
মাথা সোজা করে চুলগুলো সযত্নে নেড়ে ঠিক করে কোহিনূর। কিছু বলার আগেই রাগিনী আবারও খাবারের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
“মনে আছে? আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন? ওইতো সেদিন গ্রামের রাস্তায় পুলিশের লোকের এট্যা’ক থেকে। আপনি বলেছিলেন না? আপনার জন্য অন্তত পাঁচ আইটেমের খাবার করে আনতে? আমার মন আবার অনেক বড়। তাই দশ আইটেমের খাবার এনেছি। আজকে এগুলো না শেষ করে উঠলে আমি আপনাকে ধরে বেঁধে খাওয়াব।”
কথাটা কোহিনূরের কর্ণকুহরে আসা মাত্র তার হাত চলে যায় পেটে। দৃষ্টিও নিচু হয়ে পেটে চলে আসে। কত পারফেক্ট তার বডি! কোনো মেদের চিহ্ন নেই পেটে। এই পেটে এতোগুলো খাবার ঢুকলে ঠিক কী কী হতে পারে ভেবেই বিষম খেয়ে ওঠে সে। চেহারা জড়িয়ে তুলে ক্লান্ত আর ব্যথিত ভঙ্গিমায় আধশোয়া হয়ে বলে,
“আমার শরীর আজকে ভালো নেই। মাথাব্যথা, পেট ব্যথা! আজকে না হয় থাক। অন্য একদিন এসব হবে। আমি তো ওসব মজা করে বলেছিলাম।”
রাগিনী একটা খাবারের বাটি হাতে তুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“খুব খাওয়ার শখ আপনার। আপনার আজকে পুরো শরীর ব্যথা করলেও ছাড়ব না। এখনি আজিম আর পলাশ ভাইকে ডেকে আপনার দুহাত বেঁধে মুখে ঠুসে দেব। ডিসিশন ইজ ইউরস।”
কোহিনূর কিছু বলতে গিয়েও পারে না। ফেঁসে গেছে নিজেরই বলা কথায়। সে উঠে সোজা হয়ে বসে বাটি ধরে। লোভনীয় সব খাবারই। তবে এতোগুলো পেটের কোন স্থানে জমা হবে সেটাই সে ভেবে উঠতে পারছে না। কোহিনূর আরো কিছু বলতে উদ্যত হয়। তাকে থামিয়ে রাগিনী আগেই বলে ওঠে,
“খাবার পর কথা হবে। স্টার্ট করুন।”
কোহিনূর খাবার দেখে জোরপূর্বক হাসে। শেষবারের মতো নিজের পেটের দিকে তাকায়। পেট এবার শহীদ হতে চলেছে। একটা খাবার হাতে তুলে খাওয়া শুরু করে সে। বুঝতে বাকি থাকে না মেয়েটা পাকাপোক্ত পরিকল্পনা করে এসেছে কোহিনূরের খাবার আবদার সারাজীবনের জন্য ঘুচিয়ে দেওয়ার। এই প্রথম কোহিনূরের এতো খাবার দেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদলেও এক নারীর সামনে মানসম্মানের দফারফা হয়ে যাবে! সব দিকেই যেন বিপদের অন্ত নেই।
জানালের ধারের সামান্য জায়গায় বেশ ভালোমতো বসেছে অভিরূপ। পরনে একটা চকলেট কালার টিশার্ট আর কালো টাউজার। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে সে। তার চুলগুলো একটু বড় বড় এবং ঝাঁকড়া হওয়ায় শুঁকাতে সময় লাগে কিছুটা। তাই ভেজা গুলো খুব সুন্দরভাবে সামনের সবটা কপাল পড়ে থেকে ভ্রু জোড়াও ঢেকে দিয়েছে। ছোট ছোট দুটো চোখ বন্ধ। মনোযোগ পড়েছে গিটারের সুরে এবং চোখ বন্ধ করে এঁকেছে সেই সাহসী দৃষ্টি। সেই টানা চোখে ভয়হীন এক নজর কেন যেন ভুলতেই পারা যায় না। মন মেতেছে এক গানে।
“Pehli nazar mein
Kaise jaadu kar diya
Tera ban baita hai Mera jiya..”
এই গানটা যেন সেই রাগযুক্ত রাজরানীর জন্যই বানানো। প্রথম নজরেই কাবু করার ক্ষমতা রয়েছে তার। চোখ মেলে আকাশে তাকালো অভিরূপ। স্বচ্ছ সেই মেঘেও যেন সেই নেত্রপল্লবের প্রতিচ্ছবি। অভিরূপ দৃষ্টি বানিয়ে নিল। মুখ খুলে গেয়ে উঠল,
“Jaane kya hoga
Kya hoga kya pata
is pal ko milke Aa jee le zara…”
আর গাওয়া হলো না অভিরূপের। থামালো সে গিটারে সুর তোলা। হাত বাড়িয়ে একটু দূরে থাকা নরম বিছানায় গিটার রাখল। গভীর কিছু চিন্তা করে ভাবল,
“কেন যেন আপনার সেই অস্থির দৃষ্টির থেকে আপনার ভয়হীন দৃষ্টি আমার কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। কেন আমি জানি না। বার বার মন চাইছে সেই দৃষ্টিটাকে যদি কোনোভাবে বন্দি করতে পারতাম। সারাদিন পলকহীন ভাবে সেই দৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দিতে পারতাম।”
“সিউর হলাম। আমি একটা আস্ত পাগলের সাথেই থাকি। এতোদিন একটু হলেও ডাউট ছিল। বাট নাউ আই এম সিউর। একা একা কথা বলতেও শুরু করে দিয়েছে।”
নিজের ভাবনায় মাঝে ব্যাঘাত ঘটায় চোখেমুখ কুঁচকে ওয়াশরুমের দিকে তাকালো অভিরূপ। নোমান সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটা খয়েরী টাওয়াল আর আরেকটা টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে চলেছে অনবরত। এখনো আধভেজা শরীরে ঘরে এলো নোমান। অভিরূপ নোমানের কথার জবাব দিয়ে বলল,
“পাগলের সাথে ঘুরলে তো পাগল হবোই তাই না?”
চুল মুছতে মুছতে থামলো নোমান। ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“আমি তোর মতো নই। তোকে সামলাতে আমি আসলেই কোনদিন যেন পাগল হই।”
অভিরূপ ভেংচি কাটে এবার বাচ্চা ছেলেদের মতো। অতঃপর গিটারে হাত দিয়ে বলে,
“যাহ্। তোকে এবারের মতো তর্কে জিততে দিলাম। শুধুমাত্র আমার গিটারটা আনতে মনে রেখেছিস বলে। তুই কী করে জানলি এটা আমার লাগবে?”
“এটা তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হবার পর থেকে হয়ে আসছে। যে তোর কী কী দরকার তোর নিজের থেকে বেশি আমাকে জেনে নিতে হয়।”
সহজ ভাবে বলে দিল নোমান। এবার সোফায় সেভাবেই গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাড়ে নিজেই জোরে চাপ দিতে থাকল। ঘাড় ব্যথা করছে তার। চোখ একটু মেলতেই অভিরূপের ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মারা চোখে পড়তেই সে তড়তড় করে বলে উঠল,
“ওগুলো তোর কাছেই রাখ। আমার লাগবে না। গার্লফ্রেন্ড বা বউ পেলে তাকে দিস। এসব স্টুপিড জিনিস লাগবে না আমার।”
বলেই একটু থেমে থেমে সে আবার বলল,
“কাল থেকে এতো দখল গেছে যে এখনো ঘাড়ের ব্যথা সাড়েনি।”
এবার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল সজোরে। দুজনেরই নজর দুজনের ফোনের দিকে গেল। অভিরূপের ফোন বাজছে। অভিরূপের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। আন্দাজ করতে পারল কিছু। তবুও সাহস করে উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে ধরতেই স্ক্রিনে নজর পড়তেই বুঝতে পারে সে যা ভাবছিল তাই। কিন্তু কল ইগনর করার উপায় নেই। এর পরিণতি আরো বাজে হতে পারে। সে ফোনটা রিসিভ করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, বাবা।”
ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো বয়স্ক কন্ঠ ভেসে এলো এবার।
“আমি জানতাম। এমন কিছুই ঘটবে। তুমি তো আমার কথা এই জন্মে কোনোদিন শুনবে না বলে ঠিক করে রেখেছো। আমার হেঁসেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। ফলাফল দেখো এখন। কোথাও লেগেছে নাকি তোমার?”
এতো ঝাঁঝ পূর্ণ কন্ঠ হজম হলো না অভিরূপের। ফোনটা কান থেকে একটু দূরে ধরে চুপসানো মুখে নোমানের দিকে তাকায় সে। অভিরূপের উত্তর না শুনতে পেয়ে ওপাশ থেকে আবার কঠিন সুরে ভেসে আসে নাদিম সাহেবের গলা।
“অভি! তুমি শুনেও এন্সার করছো না। আমাকে রাগিয়ে দিও না। ভালো করে বলছি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের এখানে চলে এসো। আমার কথাটা শোনো এবার।”
অভিরূপ এবার বেশ ভেবেচিন্তে কন্ঠস্বর চিকন করে মেয়েদের মতো করে বলার চেষ্টা করল,
“হ্যালো, হ্যালো! হু আর ইউ? কে আপনি? রং নম্বরে ফোন করেছেন। ডোন্ট কল মি এগেইন। আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলেই তড়িঘড়ি করে কল কাটলো অভিরূপ।
ওপাশ থেকে হতভম্ব হলেন নাদিম সাহেব। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন ফোনের দিকে। উনার রাগ বাড়ল এবার। সবে ঘরে প্রবেশ করছিলেম উনার স্ত্রী অর্থাৎ অভিরূপের মা মিসেস. সুরভী। তাকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষনাৎ নাদিম সাহেব কাঠকাঠ গলায় বলে উঠলেন,
“তোমার ছেলেকে দেখেছো? কত বড় সাহস হয়েছে। আমার মুখের উপর কল কেটে দেয়। আর বলে কিনা আমি রং নম্বরে কল করেছি!”
“ও তো ওমনই দুষ্টু ছোটবেলা থেকে। একটু বুঝিয়ে বলছি আমি। ফোনটা আমায় দাও। ওখানে থাকা ওর সেফ নয়।”
মিসেস. সুরভীর বলা কথা নাকচ করলেন নাদিম সাহেব। আবারও অভিরূপের নম্বরে কল লাগিয়ে বলে বললেন,
“তোমার এই নরম সুর শুনলে তোমাকেই উল্টে কনভিন্স করে দেবে। আমিই ওকে বলছি।”
ক্ষ্যান্ত হলো না অভিরূপ। ফোনটা বেজে উঠতেই হাতটাও কেঁপে উঠল তার। কী করবে ভেবে আর পাচ্ছে না। নোমানের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুচকি হাসলো। ছুটল নোমানের দিকে। তাকে পেছন থেকে ধরে মিনতির সুরে বলল,
“ম্যানেজ করে দে এবারের মতো প্লিজ! প্লিজ!”
আকস্মিক ঘটনায় হতবাক হয়ে নোমান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। সেও এখানে থাকতে চায় না। এখানে থাকা মানে বিপদ বয়ে আনা। তাই সে বলল,
“ইম্পসিবল। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বিদায় নেওয়া যায় তত ভালো। পারলে আমি আরো কল করে আঙ্কেল কে বলব যাতে দ্রুত দেশে ফিরতে পারি।”
“এমন করিস কেন আমার সাথে? দ্যাটস্ নট ফেয়ার ইয়ার।”
“ফেয়ার আনফেয়ার বুঝি না। ছাড় তো আমাকে।”
দুজনের একপ্রকার ধস্তাধস্তি লেগে যায়। ফ্লোরে দুজনই শুয়ে পড়ে। অভিরূপ নোমানকে চেপে ধরে বলে,
“দে না ভাই প্লিজ! আমার এদেশে থাকা দরকার। ওই মেয়েটার দেখা না পেলে তোর বন্ধুর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”
“তুই উঠবি আমার উপর থেকে? নাকি খাবি কয়েকটা কি’ল ঘু’ষি? দেখ এই মূহুর্তে আমার উপর থেকে না উঠলে আমার টাওয়াল খুলে যাবে। ইজ্জত রাখ একটু।”
অভিরূপ ছাড়ার পাত্র নয়। টাওয়াল কথা টা শুনে শয়তানি বুদ্ধি মাথায় চাপে তার। ফট করেই নোমানের পড়ে থাকা টাওয়ালে হাত দিয়ে বলে,
“আজ তুই আমাকে বাঁচাবি নয়ত তোর ইজ্জতও বাঁচবে না!”
চলবে..