#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৫
“কী বললে তুমি এখনি? আমাকে দেখে কোন এঙ্গেল থেকে পাগল মনে হয়?”
নিজেকে সামলে নেয় মেহরাজ। এই সেরেছে! কেন যে বার বার মুখ ফসকে চিরসত্য কথাবার্তাগুলো বেরিয়ে যায় কে জানে! ঢক গিলে থতমত খেয়ে কোনোরকমে উত্তর দেয়,
“স্যার, স্যার! আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি সেই পাগলের কথা বলিনি। দেখুন স্যার, পাগল দুই প্রকার। একটা হচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগল আরেকটা হচ্ছে প্রেমে পাগল। আপনাকে সেকেন্ড লিস্টের মধ্যে ফেলেছিলাম।”
“কে বলেছে আমি প্রেমে পাগল?”
“আপনার সঙ্গে এতদিন ধরে কাজ করছি সেই হিসেবে আপনার মনের এইটুকু কথা বুঝে নেওয়া তো আমার দায়িত্ব স্যার।”
নির্জন এবার তড়িঘড়ি করে হাত মুঠো করল। যেন এক্ষুনি মেহরাজের উপর বজ্র’পাত ঘটাতে চলেছে সে। মজা করতে মেহরাজ ঠোঁট চেপে চোখ খিঁচে বন্ধ করে সরে এলো। মৃদু চিৎকার করে বলল,
“একি স্যার নি’র্যাতন করতে লাগলেন কেন?”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিচে নামিয়ে নিলো। আসলে সে লজ্জা পাচ্ছে। আসলেই লজ্জা পাচ্ছে? নির্জন আহমেদ কোহিনূর লজ্জাও পায় বুঝি? কথাটা ভাবতেই আরো বেশি নেতিয়ে পড়ল সে। তবুও লজ্জার মাথা খেয়ে কোনোরকমে নিচু সুরে জিজ্ঞেস করল,
“যাব ওকে দেখতে? বলছ?”
“অভিয়েসলি স্যার। আপনাকে তো এমনি এমনি গাড়ির তেল ফুরিয়ে, নিজের সদ্য জন্মানো ঘুমটাকে বিসর্জন দিয়ে এত রাতে এখানে আনি নি। আপনার রাগিনী ম্যাডামের কাছে যাওয়া উচিত।”
“সত্যি?”
মেহরাজ কনফিডেন্সের সহিত জবাবে বলল,
“তিন সত্যি স্যার।”
রাগিনীর বাড়ির পেছন পাশটা দেখল একবার নির্জন। ফের বলল,
“কিন্তু এত রাতে ওদের বাড়িতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?”
মেহরাজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল এবার। নির্জনকে তো মনে হয় সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। সে বি’স্ফোরিত সুরে বলল,
“আপনি কি মেইন গেইট দিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করে এমন প্রশ্ন করলেন?”
“তাছাড়া কী? আর কোনদিক দিয়ে যাওয়ার রাস্তা আছে? পেছনের রাস্তা তো লক থাকে সবসময়।”
“আরে স্যার, মুভিতে দেখেন নি? মানুষ প্রেমে পড়লে কী কী করে? প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে লুকিয়ে-চুরিয়ে কত জায়গা অতিক্রম করে তবেই তো প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে পারে। আপনি এত সুন্দর ফিট একজন মানুষ। এত ব্রিলিয়ান্ট! আপনার মাথায় এমন কোনো বুদ্ধি নেই যার দ্বারা আপনি রাগিনী ম্যাডাম অবধি যেতে পারবেন?”
“তুমি কি আমাকে চোরের মতো যেতে বলছ?”
ভ্রু কুঁচকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করল নির্জন। তার এমন জিজ্ঞাসা শুনে বেশ হাসতে মন চাইল মেহরাজের। তবে গলা খাঁকারি দিয়ে হাসি চেপে গাড়ির সিটে ভর দিয়ে আয়েশে বসে বলল,
“এতদূর অবধি আপনাকে আমি নিয়ে এসেছি। এখন আপনি বাকিটা করবেন। আমি আর কিছু জানি না।”
নির্জনের ইচ্ছে করল বেশ করে মেহরাজকে কেলাতে। কিন্তু নিজের এমন বাসনা মনের মধ্যে চাপা দিয়ে জলদি করে গাড়ির দরজা খুলে নামল সে। বেশ শক্তি দিয়ে দরজা লাগানোর ফলে জোরেশোরেই শব্দ হলো। চকিতে তাকাল মেহরাজ। নির্জন গিয়ে দাঁড়িয়েছে বড় দেয়ালটার কাছে। এক লাফে দেয়ালটা ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সফল না হলেও দ্বিতীয়বার দেয়াল টপকে চলে গেল ওপারে। মেহরাজ এবার বিস্তর হাসল। বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,
“ওহ গড! এবার যেন অন্তত প্রেমের ছোঁয়া পেয়ে স্যারের শক্ত মনটা গলে।”
নিঝুম এক রাত্রী। বসেছে ঝিঁঝি পোকার মেলা। নৈঃশব্দের রাতটা দীর্ঘ। খোলা জানালার বাহিরে বিদ্যমান সেই কাঠগোলাপের কাছের ডালের ফাঁকফোকর থেকে আকাশে দৃশ্যমান সেই অর্ধ থালার ন্যায় চাঁদের টিমটিমে আলো প্রবেশ করছে মাঝারি আকারের ঘরটায়। ঘর জুড়ে স্নিগ্ধতা খুঁজে পেল নির্জন। নাকে ঠেকল অদ্ভুত মোহময়ী সুভাস। এই ঘ্রাণে সহজেই চোখ বন্ধ করে চেনা যায় তার রাগের রানির ঘর। এসি বন্ধ করে শুধুমাত্র ফ্যান চালানো আজ। ফ্যানের হালকা শব্দ ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। জানালা থেকে আসছে ফুরফুরে বাতাস। দরজা থেকে হেঁটে দুই ধাপ যেতেই থমক গেল সমস্ত শরীর। বিছানায় পাতলা চাদর জড়িয়ে শুয়ে থাকা এক রমনীকে দেখে হৃদয়ে কম্পন ধরল তার। লোচন দুটো যেন বেশ তৃষ্ণার্ত ছিল। কতকাল পর যেন দেখা। এলোমেলো চুল চারিদিকে ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে রাগিনী। গলা অবধি চাদর দিয়ে ঢাকা। মেয়েটা আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে কেন? সবে তো রাত সাড়ে এগারোটা। তার কি শরীর খারাপ? উৎসুক এবং ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সামনে এগোয় নির্জন। বিছানার কাছে থাকা গোল কার্পেট খেয়াল না করায় কিছুটা ভড়কে গিয়ে টেবিলে হাত দিয়ে নিজেকে সামলায় সে। তবে টেবিলে হাত দেওয়া মাত্র অনুভূত করে তীব্র ব্যথা। চোখমুখ খিঁচে যায় তার। হাত সরিয়ে নিজেকে সামলায়। ল্যাম্পশিটের হলুদ এবং সোনালী বর্ণের অল্প আলোয় লাল বর্ণের ছোপ ছোপ কিছু একটা চোখে ধরা পড়ে। র’ক্ত! এইতো কয়দিন আগে ছু’রিঘাতে হাতের অবস্থা কাহিল হয়েছিল। সেই জায়গা শুকাতে না শুকাতে সেখানেই ঘুরেফিরে লোহা জাতীয় ধারালো কিছুর আ’ঘাত লাগল ফের। কী আর করার! মুভির মতো তো রাগিনীর ঘরের সামনে ওঠার কোনো পথ নেই। রান্নাঘরে খোলা জানালা গ্রিল ছাড়া ছিল বলে সেদিক দিয়ে উঠতে গিয়ে এই অবস্থা!
নিজেকে ধাতস্থ করে বড় শ্বাস নিয়ে রাগিনীর বিছানা ঘেঁষে দাঁড়াল নির্জন। চোখেমুখে যেন আগের জৌলুস খুঁজে পেল না সে। সারা মুখমণ্ডল জুড়ে মলিনতা লেগে রয়েছে। নির্জনের ভারি ইচ্ছে করল মেয়েটাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাগিয়ে দিতে। কিন্তু পারল না। সৎসাহস সে হারিয়েছে। আচ্ছা মি. শাহ্ রাশেদ সাহেব কি তার কথা বলেছে? বলেছে তার সত্যতা? তারপর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল রাগিনীর? নিশ্চয় মনে খুব খুব ঘৃণা তৈরি করে নিয়েছে। কেমন ছিল তার ঘৃণাভরা দৃষ্টি? বুক কেঁপে ওঠে নির্জনের। সে এমন চাহনি দেখতে চায় না। ফ্যান এবং বাহিরের সংমিশ্রণের বাতাসের কারণে যখন রাগিনীর চোখেমুখে অবাধ্য চুলগুলো হা’না দেয় আলতো করে নিজের হাতটা রেখে চুল সরিয়ে দেয় নির্জন। কাজটা ভীষণ সাবধানে করে সে। এমন করতে করতে হঠাৎই চোখে পড়ল শক্ত রকম একটা কাগজ। পুরোটা চাদর দিয়ে ঢাকা হলেও অল্প খানিক বেরিয়ে রয়েছে। নির্জনের মনের কৌতূহল জেগে উঠল। হালকা করে চাদর সরিয়ে নিলো সে। দৃশ্যমান হলো এক পুরুষের স্কেচ। কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে স্তব্ধ রইল নির্জন। এ তো স্বয়ং নির্জন নিজেই। কী নিখুঁত স্কেচ তার। কোট পড়ে বেশ গম্ভীর হাবভাব সেই স্কেচ। এ যেন আসল নির্জনের প্রতিচ্ছবি। আর রাগিনী সেটা জড়িয়েই ঘুমোচ্ছে আপনমনে। মনের ধারণাগুলো একে একে মুছতে থাকল নির্জনের। মেয়েটা তাকে ভালোবাসে! শুধু ভালোবাসে না, ভীষণরকমের ভালোবাসে। তবে বলেনি তো কখনোই! হয়তবা, ভালোবাসি না বললেও সুন্দরভাবে ভালোবাসা যায়। কথাগুলো নিজমনে ভাবতে ভাবতেই রাগিনীর গালে হাত রাখল নির্জন। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভালোবাসো আমায়?”
নির্জন জানে সে কোনো উত্তর পাবে না। তবে উত্তর না পেয়েও প্রশান্তি বিরাজমান তার মনে। সে আলতো করে চুমু বসিয়ে দিলো রাগিনীর কপালে। ঢেকে দিলো চাদর দিয়ে আবারও তাকে। মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল আর মুগ্ধপানে চেয়ে রইল রাগিনীর দিকে। মৃ’ত্যুর আগ অবধি চেয়ে থাকলেও ফুরাবে না এই দেখার নেশা। এই দেখার নেশায় মগ্ন থাকতে সে নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে রাজি। অপলক দৃষ্টি সরাতে বাধ্য হলো যখন হাতে জ্বলুনি অনুভব করল নির্জন। মাথায় হাত বুলানো থেকে তড়িঘড়ি হাত সরাতে হলো তার। লম্বা করে কেটে গিয়েছে আঁচ’ড়। লাল হয়ে গিয়েছে হাতের পিঠ। চোখ গরম করে তাকাতেই দেখতে পেলো সাদা তুলতুলে সুইট রিওকে। সামনের একটা পা উঁচিয়ে রয়েছে সে। চোখমুখের অঙ্গিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই নারাজ। নির্জনের এই মূহুর্তে ইচ্ছে করল বিড়াল ছানাটাকে চাপকে সোজা করে দিতে। একবার গালে আরেকবার হাতে! সে মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? রাগিনীকে বিয়ে করলেও দেখি মহা বিপদ। নির্জন যেন চোখের সামনে নিজের ভবিষ্যৎ খানা দেখতে পেলো। সে যখন রাগিনীর নিকট আসছে তখনই একটা করে খা’মচি খাচ্ছে। কয়েকবছর পর দেখা যাচ্ছে শরীরের কোনো অংশ আর বাদ রইল না তার খাম’চি খাওয়ার। নির্জনের সর্বাঙ্গ নড়ে ওঠে। রিও এর চিল্লানি শুনে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায় সে। এই দুই আঙ্গুলের ছানা তাকে আর টিকতে দেবে না। ইতিমধ্যে রাগিনীও নড়েচড়ে উঠছে। বাহিরের দিকে অগ্রসর হলো নির্জন দ্রুত। তবে বিধি বাম। দ্রুত কাজ করতে গিয়েই দরজাটা জোরে বন্ধ করে ফেলে সে। তবে বাহিরে বেরিয়েও শান্তি নেই। এতক্ষণে সবাই ঘুমিয়েছে কিনা সে নিশ্চিত নয়। চোরের মতো পা টিপে টিপে যেতে হলো তাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আওয়াজ এলো কারোর কণ্ঠস্বরের।
“কে ওইখানে?”
ব্যস…এ যেন হাতেনাতে ধরা! নির্জন দাঁড়াল না জোরে নিচে নামল। রাতে সব লাইট অফ করা হয়েছে এর মাঝে। শুধু উপরের দুটো লাইট বাদে। সেগুলো অফ করে সেই সঙ্গে রান্নাঘরের খোলা জানালাটা বন্ধ করার পর ঘুমানোর উদ্দেশ্য ছিল সৈয়দের। কিন্তু নিজের ঘোলা চোখে অচেনা অবয়ব দেখতে ভুল করেন নি তিনি এটা নিশ্চিত। তিনিও কিছুটা ছুটে এলেন করিডোরের অপরপ্রান্ত থেকে। তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলেন। হলরুমে চারিদিকে খুঁজলেন অতঃপর লাইট জ্বালালেন। কেউ নেই। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। হাতে একটা বড় ঝাড়ু নিলেন। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“ভালোই ভালোই সামনে আয় কইতাছি। নাহলে এমন ধো’লাই দিমু চুরি করার সাধ মিটে যাইব।”
“কী হয়েছে সৈয়দ কাকা? এত রাতে হলরুমে লাইট জ্বালিয়ে চেঁচামেচি করছেন কেন?”
রাগিনীর কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে আসামাত্র ফিরে তাকালেন সৈয়দ। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে ক্রোধ নিয়ে বললেন,
“বইলো না। ঘরে চোর ঢুকছে কেমনে জানি! এখনি দেখলাম নিচে আসতে।”
রাগিনী হাত খোঁপা করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। মুখটা ফোলা রয়েছে ঘুমের আবেশে। চোখ থেকে এখনো ঘুম বিদায় নেয় নি। রিও এর রাতবিরেতে চিল্লাপাল্লা আর হুট করেই দরজা জোরে লেগে যাওয়ায় চমকে গিয়ে ঘুমটা ভেঙেছে তার। উদ্ঘাটন করতে পারেনি তার রহস্য। বাহিরে এসে সৈয়দ কাকার মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা সন্দেহ জাগে তার মনে। সে নিচে নেমে বলল,
“আপনি বরং আমাদের গেস্ট রুমের ওদিকে দেখুন। অভিরূপ আর নোমান ভাই তো ওদিকে আছেন। গিয়ে দেখে আসুন। আমি এদিকটা দেখছি।”
সৈয়দ অপেক্ষা করল না। দ্রুত ডান দিকে ছুটে গেল। রাগিনী সন্দিহান হয়ে বাড়ির পেছনদিকটা খোঁজ করল। তবে কিছু পেলো না। ফিরে এসে হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। লাইট অফ করা সেখানকার। আগপাছ ভেবে ওঠার আগেই হাতে টান পড়ল তার। না চাইতেও ঢুকে গেল অন্ধকার রান্নাঘরে। আকস্মিক ঘটনায় চিৎকার দেওয়ার সুযোগও পেলো না রাগিনী। ঢিপঢিপ করতে লাগল ভেতরটা। কারো গা ঘেঁষে এসে পড়েছে বুঝতে পেরেই নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল সে। দম বন্ধ হয়ে এলো। কাঁধে পড়তে থাকল মানুষটির গরম প্রশ্বাস। নাকে এলো এক চেনা ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা মিষ্টি না হলেও অদ্ভুত মোহনীয়। পিটপিট করে মানবটির অবয়ের দিকে তাকাল রাগিনী। দেখা যাচ্ছে না তাকে স্পষ্ট। তবে তার বুঝতে সময় লাগেনি মানুষটির উপস্থিতি। সেই মনেপ্রাণে ভুলতে চাওয়া পুরুষটি আবারও তার সামনে। নাড়া দিয়ে উঠল অনুভূতির মেলা। রাগিনী ছটফটিয়ে উঠল। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা হলো তখনি। খোঁপা করা চুলগুলো বিছিয়ে গেল পিঠে। সুড়সুড়ি লাগল নির্জনের হাতে। ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“চোর খুঁজছ বুঝি? আমিও হেল্প করব?”
“আপনি কী করছেন এখানে? আমার ঘরে আপনি এসেছিলেন তাই না?”
“কেবল বুঝতে পারলে?”
রাগিনীর গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না। একদিকে রাজ্যের ক্রোধ আবার অন্যদিকে মনে আতঙ্ক। এই রাতে কী করতে এসেছে লোকটা? তাকে মা’রতে? তাই হবে! নয়ত কোন উদ্দেশ্য থাকবে? এছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। থরথর করে কেঁপে উঠল সে। নির্জন আবারও বলল,
“আমার স্কেচ নিয়ে ঘুমিয়ে ফিল নিতে পারছ? মনে তো হয় না। আমাকে ডাকলেই তো আমি চলে আসতাম।”
সব মিশ্র অনুভূতির মাঝে থতমত খায় রাগিনী। লোকটা সেটাও দেখে ফেলেছে? ছিঃ ছিঃ! কী একটা অবস্থা! যাকে সে এত করে ঘৃণা করতে চাইছে তার স্কেচ নিয়েই শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল সে। রাগে গজগজ করে সে বলল,
“আপনি আমার কোনোরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আমি কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দেব না বলে দিলাম।”
নির্জন হতবাক হলো। খানিকটা চুপ থেকে বলল,
“ছেড়ে দিতে তো কখনোই বলিনি। ধরে থাকো না আজীবন!”
“নিজের মৃ’ত্যুকে ধরে থাকার শখ নেই আমার। আপনি চলে যান। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
ক্রোধে ভরা রাগিনীর গলা। নির্জনের অন্তর কাঁপিয়ে তুলল এবার। তাকে সহ্য হচ্ছে না। এটা আজ রাগিনী বলল? কানে যেন ভুল শুনেছে সে। বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও সে বলল,
“আমার একটা কথা বোঝার চেষ্টা করল।”
দুটো কানে হাত দিয়ে চেপে ধরল রাগিনী। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনাকে আমি ছাড়ব না। চলে যান, চলে যান। একা থাকতে দিন আমায়। ভালোমতো বাঁচতে দিন। কী পেয়েছেন আমায়? কেন পড়ে আছেন আমার পিছু?”
নির্জন স্তব্ধ রইল। নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল রাগিনীর মুখশ্রীর পানে। মেয়েটা তাকে খুব তাচ্ছিল্য করছে। তার একেকটা কথাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। সে কিছু বলার সুযোগ পেল না। সৈয়দের আওয়াজ পাওয়া গেল।
“রাগিনী মা! চোর পাইলা? আমি তো পাইলাম না। কই তুমি?”
কান থেকে হাত সরাল রাগিনী। কঠিন চোখে তাকাল নির্জনের অবয়বের দিকে। দীর্ঘশ্বাস নিলো নির্জন। নিজেকে ঠাণ্ডা করল। রাগিনীর মাথা দুহাতে ধরে একটু ঝাঁকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“রিল্যাক্স এ্যাংরি কুইন। আমি চলে যাচ্ছি। তোমার মাথা ঠাণ্ডা করো। তোমার পিছু আমি ছাড়ব না ততদিন যতদিন না আমার দিকটা তুমি বুঝবে। এখন যাও। উনাকে চোর খুঁজতে সাহায্য করো। আর বলে দিও তার বাড়ির কিছুই চুরি যায় নি। যদি চুরি যেত তবে বাড়ির সবথেকে দামি রাগিনী তাজরীন চুরি যেত।”
নির্জন এবার রাগিনী সজ্ঞানে থাকতেই নিচু হয়ে নিজের ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া তার প্রিয়তমার বাম গালে লাগিয়ে দেয়। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় রাগিনী। শিথিল হয়ে আসে তার সমস্ত। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে। র’ক্তপ্রবাহ যেন আরো বেশি সচল হয়। সে প্রচন্ড রেগেমেগে আছে ভেতর থেকে। কিন্তু রাগটা বাহিরে বের করার কূলকিনারা পাচ্ছে না। তার থেকে লজ্জা আর সংকোচ বেরিয়ে আসছে। শুষে নিয়েছে সমস্ত শক্তি, কথা, ঘৃণা অনুভূতি। নিজেকে ধাতস্থ করতে খানিকক্ষণ সময় লাগল রাগিনীর। রান্নাঘরের লাইটটা আচমকায় জ্বলে ওঠে। ঘোর কাটে রাগিনীর। চকিতে এদিকওদিক তাকায়। মানুষটা আছে কি এখনো? না নেই! যাক বাঁচা গেল। বন্ধ রান্নাঘরের জানালাটা খোলা দেখতে পেল রাগিনী। সেদিক দিয়েই চলে গিয়েছে তবে। লোকটা বেশ চতুর মানতে হবে! হবে না-ই বা কেন? রাগিনী শুনেছে যারা ক্রি’মিনাল তাদের মাথায় ঘাটে ঘাটে বুদ্ধি! সে-ই বা তার এত চিন্তা করছে কেন? তার তো চাওয়া উচিত ছিল মানুষটা ধরা পড়ুক। অথচ লোকটা পালিয়ে যাওয়ায় সে মনে মনে আরো খুশি? এমনটা কি হওয়া উচিত? নিজের প্রতি ধিক্কার জানায় রাগিনী। সৈয়দের কথায় হকচকিয়ে তাকায় সে।
“অন্ধকারে কী করতাছিলা?”
“আ…আসলে এদিকে চো…চোর এসেছে কিনা দেখতে এসেছিলাম।”
আমতা আমতা করে জবাবে বলল রাগিনী। কিছুটা দম নিয়ে আবার বলল,
“আপনি বোধহয় ভুলে দেখেছেন চাচা। অন্ধকারে কী দেখতে কী দেখে ফেলেছেন ঠিক নেই। যান ঘুমাতে যান।”
সৈয়দ মাথা চুলকালো। সে ভুল দেখেছে? কীভাবে? স্পষ্ট দেখল চোরের তো কাউকে নিচে নামতে। ফট করে জানালার দিকে চোখ পড়তে উনি বললেন,
“জানালা খোলা ক্যান? আমি তো একটু আগেই বন্ধ কইরা দিছিলাম।”
ঠোঁট কামড়ে ধরে রাগিনী। পরিস্থিতি তো সামলানোই যাচ্ছে না। কোনোরকমে বলে,
“আমি খুলেছিলাম। বাহিরের দিকটা দেখতে। আশেপাশে কোনো লোক আছে কিনা। কাউকেই তো দেখলাম না। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান। আমি জানালা বন্ধ করে আমার ঘরে যাব।”
সৈয়দ আর কথা বাড়াল না। চলে গেল সেখান থেকে। রাগিনী হাফ ছেড়ে বাঁচল। সৈয়দ যাওয়ার পরপরই জলদি করে জানালা বন্ধ করে নিলো সে। তারপর হতভম্ব হয়ে গালে হাত রাখল। আফসোস হলো ভীষণ! কেন সে একটা ছোট্ট করে চিৎকার দিতে পারল না! কেন যে চেয়েও সেই জঘ’ন্য মানুষটাকে দূরে সরাতে পারল না কে জানে! গাল থেকে আর হাত সরল না তার। সেভাবেই ধীর পায়ে ঘরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“লোকটা কি সত্যিই আমার পিছু ছাড়বেন না?”
গালটাতে চাপ দিয়ে বৃথা মুছে নেওয়া চেষ্টা করল সে। ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“লোকটা শুধুমাত্র একটা মিথ্যাবাদী আর ঠ’কবাজ নয়। সেই সঙ্গে অসভ্যও। কালই আমি পুলিশের কাছে যাব। নয়ত এর থেকে কোনো পরিত্রাণের উপায় দেখছি না আমি। ফা’জিল লোক জানি কোথাকার!”
বালিশে মাথা দিল রাগিনী। পাশে এসে আহ্লাদের সঙ্গে রাগিনীর গা ঘেঁষে লেপ্টে শুয়ে পড়ল রিও। তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিল রাগিনী। ঘুমানোর চেষ্টা করল। তবে নতুন সমস্যা এসে হাজির হলো এবার। চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে সেই চুম্বনের দৃশ্য। আবেশে মাখিয়ে যাচ্ছে রাগিনীর সর্বাঙ্গ। লজ্জাগুলো ঘিরে ধরছে তাকে।
সকালের ঘুমটা বেশ হয়। মাখো মাখো রকমের। ঘুমটা আরো বেশি আসে তখন। রাগিনীর ক্ষেত্রেও তাই। এত দ্বন্দ্ব, লজ্জার মাঝে ঘুম পেতে পেতে হয়েছিল অনেক রাত্রী। ফলস্বরূপ এখনো ঘুম ভাঙছে না। তবে শান্তির ঘুমটা বেশিক্ষণ টিকল না। শোরগোল ভেসে এলো কর্ণকুহরে। সৈয়দের চিৎকার করা কণ্ঠ। সৈয়দ কাকা তো এভাবে চিৎকার করেন না। কিছু হয়েছে নাকি? টে’রোরিস্ট? কোহিনূর? এসব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই ঘুমটা উড়ে গেল তার। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। বসে থাকার ধৈর্য হলো না তার। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল বাহিরের দিকে। দরজাটা খুলে করিডোর ধরে এগোতেই দৌড়ে আসতে দেখা সৈয়দকে চোখে পড়ল তার। ঘুমটা এখনো চোখে লেগে রয়েছে। ঘোলাটে লাগছে সব। সৈয়দ বলে চলেছে,
“সব শেষ, সব শেষ!”
রাগিনী উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী শেষ? কী বলছেন? কী হয়েছে কাকা?”
চোখ কচলাতেই সৈয়দের মুখটা স্পষ্ট হলো রাগিনীর কাছে। কাঁদো কাঁদো মুখ সৈয়দের। বুকটা ধক করে উঠল রাগিনীর। কাকাকে এমন নীরব দেখে দ্রুত বলল,
“চুপ করে আছেন কেন? বলুন না! সবাই ঠিক আছে তো? আর বাবা? সে ঠিক আছে?”
“স্যারের কী জানি হইছে। উনি তো সকালে এত দেরি করে উঠেন না তাই আমি আজকে চা নিয়া গেছিলাম উনার ঘরে। ডাকলাম অনেকক্ষণ…”
রাগিনীর পুরোটা শোনার মতো ধৈর্য হলো না আর। যেন তার অর্ধেক জীবনটা সেখানেই শেষ। সে ছুট দিল তাড়াতাড়ি করে। বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল শুরু হয়েছে। সব শেষে বাবা নামক মানুষটির কিছু হলে আর বাঁচতেই পারবে না সে।
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৬
সিঁড়ি যেন শেষ হয় না। মাত্র অল্প কয়েকটাই তো সিঁড়ি তবুও যেন কেন তার অন্ত ঘটছে না কে জানে! রাগিনী জোর কদমে ছুটছে। চোখমুখের উজ্জ্বলতা নিমিষেই হারিয়ে বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। দম না ফেলে একাধারে বিড়বিড়িয়ে বলে চলেছে, ‘বাবা! বাবা!’
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাতে কষ্ট না হয় সেকারণে রাগিনী তার বাবাকে নিজে নিচের ঘরে শিফট করে দিয়েছিল। ডান দিক ঘুরে প্রথম ঘরটাই রাশেদ সাহেবের। রাগিনী ঝটপট করে ভিড়িয়ে দেওয়া দরজা খুলতেই দুচোখ ছন্নছাড়া হয়ে খুঁজতে থাকল তার বাবার মুখটা। বিছানায় নেতিয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠল সে। তার পাশে দেখা গেল আরো দুটো চেনা মুখ। অভিরূপ ও নোমান। অভিরূপ নিজের সমস্ত ভর দিয়ে দুহাতের মাধ্যমে রাশেদ সাহেবের বুকে চাপ দিয়ে চলেছে অনবরত। রাশেদ সাহেবের জ্ঞান নেই। নড়চড় নেই। একভাবে পড়ে আছেন বিছানায়। বুক চিনচিন করে ওঠে রাগিনীর। পা আর চলছে না। থমকে রইল দুচোখ। আপাদমস্তক কম্পন দিয়ে উঠল। মুখ থেকে কথা বের হতে চাইল না চাপ দিয়ে তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে বলে ওঠে,
“বাবা! আমার বাবা!”
দ্রুত বেগে এগোতেই রাগিনী টাল সামলাতে না পেরে মুথ থুবড়ে পড়ল বিছানায় তার বাবার পাশে। কোনোমতে উঠে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে বলল,
“কী হয়েছে তোমার বাবা? কথা বলো না একটু! আমি আর তোমার অবাধ্য হবো না। সব কথা শুনব। আমার সাথে এমন করো না।”
অভিরূপ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে জবাব দিল,
“আমার বাবা বলেছিল আঙ্কেলের হার্টের প্রবলেম আছে। সেখান থেকেই হয়ত কিছু একটা ঘটেছে রাগিনী। ইমোশন সামলাও নিজের। কিছু হবে না। প্রে করো, যাতে একটু হলেও আঙ্কেল রেসপন্স করে।”
রাগিনীর বুক ধড়ফড় করছে। সে ছোট থেকেই মাকে পায়নি। বাবা ছিল তার একমাত্র আদর ও আবদার পূরণ করার মানুষ। একা একা মানুষটা কাজ সামলে তাকেও বড় করেছে। আর এত কষ্ট দেখে বড় হওয়ার পর সে কখনোই চায়নি তার বাবাকে কোনো মেন্টাল প্রেশার বা স্ট্রেস দিতে। তাই ছোট ছোট কষ্ট, দুর্ঘটনাগুলো লুকানোর চেষ্টায় থেকেছে সবসময়। তবে শেষমেশ এমন পরিণতি ঘটল, এমন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল যেটার চেয়ে ভয়া’বহ যেন আর কিছুই হয় না। এই টেরো’রিস্টি টিমের সঙ্গে অকারণে রাগিনীর জড়িয়ে পড়া নিয়েই কয়েকদিন চিন্তা করেছেন সেটা বেশ বুঝতে পারছে রাগিনী। গত কয়েকদিন ধরে সে খেয়ালও করেছিল মাঝে মাঝে তার বাবা বুকে হাত দিয়েও কথা বলত। হাঁপাত কথার মাঝে কখনো কখনো। অবশেষে বড় ভয়’ঙ্কর পরিণতি ঘটেই গেল। এভাবে তো সে তার বাবাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। রাগিনী কিছু একটা ভেবে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজল। একহাতে চোখমুখ ঘষে পানি মুছতে মুছতে বলল,
“ফোন কোথায়, ফোন? এম্বুলেন্স ডাকতে হবে।”
“আমি ডেকে দিয়েছি রাগিনী। চিন্তা করো না।”
নোমানের কথা শুনে ক্ষ্যান্ত হয় না রাগিনী। দ্রুত টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে হাতে পানি দিয়ে বারবার পানি ছিটিয়ে দেয় রাশেদ সাহেবের ওপর। লাভের লাভ কিছুই হয় না। রাগিনী ভেতর থেকে মুষড়ে পড়ে। চোখমুখ খিঁচে বাবার দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে দিয়ে বলে,
“বাবার জ্ঞান ফিরছে না। বাবা তাকাচ্ছে না আমার দিকে।”
“হি ইজ রেসপন্ডিং।”
অশ্রু ভরা চোখে অভিরূপের কথায় বেশ আশা নিয়ে বাবার দিকে তাকাল রাগিনী। রাশেদ সাহেব চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। অভিরূপ উনার বুকে হাত রেখে আরো জোরে জোরে বুকে চাপ দিতে থাকল। রাগিনীর প্রাণটাই যেন বেরিয়ে এসেছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে কোনোরকমে বলল,
“বা…বাবা। তাকাও একটু।”
রাশেদ সাহেব তাকালেন না। আবারও নীরব হয়ে গেলেন। বড় বড় শ্বাস নেওয়া বন্ধ করলেন। রাগিনী আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল। টলমল দৃষ্টিটা নিক্ষেপ করল ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকা অভিরূপের দিকে। আশেপাশে পিনপতন নীরবতা। চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অনায়াসে পানি পড়েই চলেছে। সব বুঝি শেষ?
রায়ানের জিপ গাড়িটা এসে থামল আহমেদ মেনশনের প্রধান বড় দরজার সামনে। গাড়ি থেকে চাবি খুলে নিয়ে নিজের পকেটে হাত রেখে বুঝে নিলো নয়নতাঁরার ফোনটা ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর নিচে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে গেটের কাছে গেল। গেট বন্ধ। কেঁচি গেট দিয়ে দেখা যাচ্ছে দারোয়ানকে। সে মৃদু সুরে ডাকল দারোয়ানকে। গেটের ওপারে থাকা লোকটা ডাক শুনে এগিয়ে এসে রুক্ষ গলায় বলল,
“আপনার পরিচয়? কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”
“আই এম ইন্সপেক্টর রায়ান সিকান্দার। বাড়িতে কি কেউ আছে? যেকোনো কেউ থাকলেই হবে। একটা জিনিস ফেরত দেওয়ার ছিল।”
রায়ানের নাম শুনেই যেন তটস্থ হলো দারোয়ান। দ্রুত গেট খুুলতে খুলতে নরম সুরে বলল,
“আসেন, আসেন। বাসায় নয়নতাঁরা ম্যাডাম আছে। স্যার তো সকাল সকাল বের হয়ে গিয়েছেন।”
রায়ান গেট দিয়ে ঢুকে কংক্রিটের তৈরি রাস্তাটা ধরে হাঁটা ধরল। আশেপাশে এক পলক তাকাতেই পুরোনো স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেন এইতো কয়েকবছরের আগের কাহিনী! সে আর নির্জন ছোটো ছিল। সবে ক্লাস ফোরে পড়ত। একই স্কুলে পড়ত তারা। পুরো স্কুল জুড়ে তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ চর্চা হতো। হবে না-ই বা কেন! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কাজ করত তারা। একে অপর পরিপূরক ছিল যেন। নয়নের বয়স তখন দুই বছরের কাছাকাছি ছিল। তবে পড়াশোনার চাপে নয়নতাঁরার সঙ্গে সাক্ষাৎ খুব কমই হয়েছে। তবে ছোটবেলায় রায়ান বেশ কয়েকবার কোলে নিয়েছে। তাকে সেটা তার মা বলেছে। বাড়ির বাহিরে ফাঁকা জায়গায় বাকিদের মতো বিভিন্ন ফুলের বাগান করা নেই। শুধু সরু রাস্তার দুপাশে সৌন্দর্যের জন্য দেওয়া পাতাবাহারের গাছ। তাও চারকোনা করে ছেঁটে রাখা। ডান পাশে ফাঁকা স্থানে ঘাসের উপর সাদা রঙের দোলনা। আর বাম পাশে আহামরি কিছু নেই। শুধু সবুজ ঘাস আর দুটো আমগাছ। ব্যস…তাতেই বেশ সুন্দর লাগে। রায়ান কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করল বাহিরে। ঘড়িতে সময় দেখল। হাতে বেশি সময় নেই। অফিসে ছুটতে হবে আবার।
নয়নতাঁরার ঘুমটা সবেমাত্র ভেঙেছে। আলসেমি ভেঙে মুখে ব্রাশ নিয়ে বাড়ির ড্রয়িংরুমের মিউজিক বক্সে অভিরূপের গাওয়া গান ছেড়ে দিয়ে এপাশ-ওপাশ ঘুরছে আর ব্রাশ করছে। কলিংবেলটা বেজে উঠতেই বেশ বিরক্ত হলো সে। ভোরবেলায় কেউ আসে নাকি? কে জানে মানুষের ঘুম আছে কিনা! বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে,
“মেবি আমার বিগ ব্রাদারের ভোর ভোর উঠে কাজে ছোটার রোগটা সবাইকে অ্যা’টাক করছে! কী ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার!”
অতঃপরই নয়নতাঁরার মনে হলো এটা নিশ্চয়ই লেহেঙ্গা ডেলিভারিম্যান। এত দেরি হলো আসতে? অর্ডার গতকালকেই আসার কথা ছিল! বিরক্তি মাখা চোখমুখ দিয়ে নয়ন গেল সদর দরজার কাছে। হোল দিয়ে না চেক করেই সরাসরি দরজা খুলেই মুখে ফেনা নিয়ে ধমকে উঠল নয়নতাঁরা।
“আক্কেল জ্ঞান নেই? আক্কেল দাঁত ওঠে নি নাকি? কাল থেকে আমি এক্সাইটমেন্টে পাগল হয়ে যাচ্ছি লেহেঙ্গার জন্য আর আপনি…”
কথাগুলো বলার মাঝপথে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে আপনা-আপনি কথা বলা আঁটকে গেল নয়নের। স্বপ্ন দেখছে না তো? নিশ্চয় তাই হবে। ঘুম বাবাজী এখনো তাকে ছাড়েনি। চোখ বুঁজে নিজে নিজে বলল,
“ঘুম বাবা পালাও তাড়াতাড়ি। হুঁশ হুঁশ… ”
বলেই চোখ খুলল নয়ন। একি! এখনো তো একই দৃশ্য দেখছে! কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে মি. ক্রাশ ইন্সপেক্টর তার দিকে। মুখ থেকে আপনাআপনি ব্রাশ খসে পড়ল নয়নতাঁরার। ঘুম থেকে ওঠার পর যে তার অবস্থা ঠিক কেমন আলুথালু মতো হয় সেটা কল্পনা করতেই চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এলো। কোনোকিছু না ভেবেই তড়িৎগতিতে সেখান থেকে উধাও হলো সে। রায়ান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে। যেন কিছুক্ষণ আগের দেখা সেই প্লাজু আর শার্ট পরিধান করা, মুখে বাচ্চাদের ন্যায় ব্রাশ নিয়ে চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি ভ্রম ছিল। এখন তার কী করা উচিত? এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে? নাকি চলে যাবে?
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে ফিটফাট হয়ে চুলে কোনোরকম চিরুনি দিয়ে ঠিক করে ড্রয়িংরুমে এলো নয়নতাঁরা। সে ভুলেই গিয়েছে রায়ানকে ও কিছু না বলেই ঘরে দৌড় দিয়েছিল। কী বিশ্রী কান্ড! এই প্রথম মানুষটা তার বাড়িতে এলো। অথচ সে এরূপ ব্যবহার করল? এটা মানা যায়? এবার নয়নের নিজে নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। ড্রয়িং রুমে এসে দরজা লাগানো দেখতে পেল সে। লক করা নয় ভিড়িয়ে দেওয়া। আশেপাশের রায়ানকে না দেখে দ্রুত বেগে দরজা খুলে চেক করেও রায়ানকে পেল না। লোকটা তবে চলেই গিয়েছে। হতাশ হলো নয়ন। সবই তার দোষ। বিগ ব্রাদার ঠিকই বলে! সে কোনো কাজের না অকাজ ছাড়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ফিরে এসে দরজা লাগাল সে। হঠাৎ চোখ গেল গোল ছোট টেবিলের উপর শোপিচের নিচে চেপে রাখা একটি কাগজ। কলমের মাথাটা খুলে রাখা। ড্রয়িংরুমে রাখা গতকালকের খাতাটাও খোলা। পৃষ্ঠা ছেঁড়া। তার পাশেই তার ফোন। তড়িঘড়ি করে গিয়ে নিজের ফোন হাতে নিলো সে। ফোনের প্রতি তার আগ্রহ নেই। সে দ্রুত শোপিচ সরিয়ে কাগজ হাতে নিলো। কাগজের একটা ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে এলো ছোট ছোট গোছানো কিছু লেখা। ‘না বলে তোমাদের বাড়ির ভেতরে আসার জন্য আর অনুমতি না নিয়ে এখানকার খাতা আর কলম ব্যবহার করার জন্য সরি। ফোনটা রেখে গেলাম। চেক করে নিও তোমার ফোন কিনা। তোমার ফোনটা দেখে আমার সন্দেহ হলো যে ওটা তোমার নাকি আমার ফোন। ওয়ালপেপারে জ্বলজ্বল করছে আমার ছবি! জানার বেশ কৌতূহল হয়েছিল আমার ছবি রেখেছ কেন? জানা হলো না! তবে, অবশ্যই এবার থেকে দরজা খোলার আগে দেখে নেবে দরজার ওপাশে কে! হুটহাট করে কাউকে ঝেড়ে দিয়ে কিন্তু মা’মলাও খেতে পারো।’
ঢল গিলল নয়নতাঁরা। লজ্জায় গুটিয়ে গেল সে। কোন বিষয় নিয়ে লজ্জা পাবে সেটাও বুঝল না। লোকটা তো শুধু লজ্জাজনক কথাই লেখে রেখেছে। ওয়ালপেপার দেখে ফেলার লজ্জা আর এমন ব্যবহারের লজ্জায় ম’রে না যায়। ঠোঁট উল্টে লজ্জায় কাঁদতে ইচ্ছে করল তার। তবে মানুষটির সাথে দুই দন্ড কথাও হলো না! সব পরিকল্পনা পানিতে গেল!
সারাদিনটা পার হলো নির্জনের কাজ করেই। এই ফাইল, সেই ফাইল ধরতে গিয়ে কোনোরকম অন্য বিষয়ে মন দিতে পারেনি সে। সব জায়গা থেকে কেসের ইনফরমেশন কালেক্ট করতে করতে একদম তেতে উঠেছে। সবশেষে বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে তার। যাওয়ার আগে চেয়ারে একটু দম নিয়ে বসে ছিল চোখ বুঁজে। তখনি ঘটল মেহরাজের আগমন। হুড়মুড়িয়ে এসে ঢুকে পড়ল নির্জনের রুমে। ফট করেই চোখ মেলে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“তোমায় কত বার বলেছি আমার পারমিশন না নিয়ে ঢুকবে না রুমে!”
মেহরাজ হাঁপাতে থাকল। একটু দম নিয়ে কোনোমতে বলল,
“স্যা…স্যার মি. শাহ্ রাশেদ সাহেব মানে রাগিনী ম্যাডামের বাবা হার্ট অ্যা’টাক করেছেন!”
নির্জন যেন কানে ভুল শুনল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল,
“হোয়াট?”
“ইয়েস স্যার! আজ সকালের ঘটনা।”
প্রথমেই নির্জনের মাথায় এলো রাগিনীর কথা। কী অবস্থায় আছে মেয়েটা? নিজেকে সামলে উঠতে পেরেছে? কেমন আছেন রাশেদ সাহেব? এই মূহুর্তে মেয়েটার কাছে যাওয়া ভীষণ প্রয়োজন! নির্জন আর এক মূহুর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত হাতে চাবি নিয়ে মেহরাজের পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বের হলো।
চলবে….
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]