#গোধূলির রাঙা আলোয়
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
অন্তিম পর্ব
হসপিটালের করিডোরে মাথা নিচু করে বসে আছে তামান্না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। তামান্নার পাশেই বসে আছে ট্রেনে সাহায্য করা ছেলেটা, নাম তামিম, চট্টগ্রামেই থাকে ঢাকা গিয়েছিল অফিস থেকে। ছেলেটা পুরোটা সময় লক্ষ্য করছে তামান্নাকে।
উৎসার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। ভোরের দিকে শুদ্ধ এসে পৌঁছেছে। তামান্নাকে বারবার ফোন করছিলো উৎসার নাম্বার বন্ধ পেয়ে। অবশেষে তামান্না যখন ফোন রিসিভ করে তখন সব খোলে বলে শুদ্ধকে। তখনই রওনা হয়ে ভোরের দিকে এসে পৌঁছে গেছে। উৎসার বিভিন্ন টেস্ট করা হয়েছে সেগুলোর রিপোর্ট দেখছে ডাক্তার আর শুদ্ধ চিন্তিত হয়ে বসে আছে ডাক্তারের সামনে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে সে যেটা সন্দেহ করছে সেটা যাতে না হয় কিছুতেই। রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের মুখ মলিন হয়ে গেছে দেখে আরো ভয় হচ্ছে শুদ্ধর। নিজে রিপোর্টগুলো দেখবে সেই সাহসও হচ্ছে না।
মধ্যবয়স্ক ডাঃ আব্দুল রহমান চোখের চমশা খোলে টেবিলে রেখে বললো, আপনি রোগীর কী হন ?
শুদ্ধ ঢোক গিলে বললো, উড বি হাসবেন্ড।
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, রোগীর বাবা-মা বা অন্যকোনো অভিভাবক ?
নেই, যা বলার আমাকে বলুন। নাহলে রিপোর্ট দিন আমি নিজেই দেখে নিচ্ছি।
আপনি কীভাবে ?
আমি ডাঃ আরফান সাদিক শুদ্ধ ।
ডাক্তার কপালে ভাজ ফেলে বললো, আপনি ডাক্তার হয়ে রোগীর সাথে থেকেও এতোদিনের অসুস্থতা লক্ষ্য করেননি।
শুদ্ধ বললো, পরিষ্কার করে বলুন।
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন, উনি ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত।
শুদ্ধর পুরো দুনিয়া কেঁপে উঠে যেনো পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারছে না, মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে গলা চেপে ধরেছে।
অনেক কষ্টে কাঁপা গলায় বললো, হ,,,,হোয়াট ?
ব্রেন ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছে রোগী। এটা কোনো একদিনের রোগ নয়। একটু একটু করে অনেকটা সময় নিয়ে এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আপনি একজন ডক্টর, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
শুদ্ধ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, রিপোর্টগুলো।
ডাক্তার আব্দুল রহমান রিপোর্টগুলো এগিয়ে দিলো শুদ্ধর দিকে। কাঁপা হাতে রিপোর্ট নিয়ে একটা একটা পাতা উল্টে দেখছে শুদ্ধ।
ডাক্তার বললো, রোগীর ব্রেনে টিউমার দেখা দিয়েছিলো অনেক আগে। উনি এর অনেক লক্ষণও পেয়েছেন তবে কোনো প্রকার চিকিৎসা গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে না। মাথা ব্যাথা হলেই ব্যাথার মেডিসিন আর ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন। এসবে সাময়িকভাবে কষ্ট কমলেও দিন দিন টিউমারের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে আর এখন লাস্ট স্টেজ চলছে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। উনার মাথা ব্যাথা যখন বেশি হতো তখনই ঘুমের মেডিসিন নিয়েছে মনে হচ্ছে।
ডাক্তারের কথা শুনে শুদ্ধ প্রায় চিৎকার করে বললো, না এটা সত্যি হতে পারে না।
ডাক্তার বললো, আপনি নিজেও একজন ডাঃ তাই আবেগ দিয়ে বিবেচনা না করে বাস্তবতা বুঝার চেষ্টা করুন। নিজেকে শক্ত করুন।
শুদ্ধর চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে। ছেলেদের কাঁদতে নেই সেই নীতি আজ শুদ্ধর ক্ষেত্রে কাজ করছে না। শুদ্ধর ইচ্ছে করছে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে। মেয়েটার এত কাছে থেকেও কখনো সে বুঝতেই পারেনি মেয়েটা এতবড় রোগ পুষে রেখেছে। আজ নিজের ডাক্তারি পেশা ব্যর্থ মনে হচ্ছে শুদ্ধর কাছে। গত এক মাসে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দেখেছে উৎসাকে, তবু বুঝতে পারেনি। এবার কী করবে সে ? কীভাবে বাঁচাবে তাকে ?
শুদ্ধ চোখ মুছে কাঁপা গলায় বললো, ডক্টর অপারেশন করে ?
আপনি অবুঝের মতো কথা বলছেন মিস্টার শুদ্ধ। নিজেই দেখেছেন রিপোর্টগুলো। উনি এখন আর অপারেশন করার মতো অবস্থায় নেই। এখন অপারেশন করলে যেটুকু সময় উনার হাতে আছে সেটুকুও আর থাকবে না। অপারেশন না করলে হয়তো আরো কিছুটা সময় শ্বাস নিতে পারবে এই পৃথিবীতে।
শুদ্ধ কিছু না বলে রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে। নোনাজল ভিজিয়ে দিচ্ছে রিপোর্টগুলো। তখনই দরজায় নক করলো নার্স।
ডাঃ আব্দুল রহমান বললো, কাম ইন।
নার্স ভেতরে এসে বললো, স্যার ৫১২ নাম্বার রুমের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে।
শুদ্ধ চোখ তুলে তাকালো নার্সের দিকে। ৫১২ নাম্বার কেবিনে উৎসা আছে।
১৮.
তীব্র মাথা ব্যাথায় চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু একটু করে দেখার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি আমি। ট্রেনে তীব্র মাথা ব্যাথায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, চোখ খোলেও চারদিকে কেবল অন্ধকার দেখছিলাম। তামান্নাকে ডাকবো এটুকু শক্তিও যেনো ছিলো না শরীরে। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে আবার, এরপর আর কিছু মনে নেই। হালকা চোখ খোলে আশেপাশে ঝাপসা দেখে বুঝার চেষ্টা করছি কোথায় আছি। চোখের দৃষ্টি আগের থেকেও অনেকটা কমে গেছে বুঝতে পারলাম। দেখে বুঝতে না পারলেও ফিনাইলের গন্ধে মনে হচ্ছে আমি হসপিটালে আছি। হসপিটালের গন্ধ চিনতে আমার ভুল হবে না। মাথা ব্যাথাটা আবারো অনুভব হতেই মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসছে। ডান হাতটা কেউ ধরলে আবার তাকালাম। ঝাপসা দেখেও তামান্নাকে চিনতে অসুবিধা হলো না আমার।
উৎসা দূর্বল গলায় বললো, তুই আমাকে হসপিটালে কেনো এনেছিস ? এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি।
তামান্না কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছে। সে মানতে পারছে না উৎসা আর থাকবে না তার সাথে। শুদ্ধ ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই তামান্না তার কাছে জানতে চায় কী হয়েছে উৎসার। শুদ্ধ ছোট করে কেবল বলেছে ব্রেন ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। তামান্না স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কিছুটা সময়। তারপর ছুটে চলে আসে উৎসার কাছে।
উৎসা বললো, তুই কাঁদছিল কেনো ?
তামান্না কিছু বলতে পারছে না কান্নার জন্য। কী বলবে আর কীভাবে বলবে সেই ভাষা তার জানা নেই। এই মেয়েটা ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ, কীভাবে বাঁচবে তাকে ছাড়া।
নার্স বললো, উনার কেবল জ্ঞান ফিরেছে এখানে কান্নাকাটি করবেন না, দয়া করে বাইরে জান।
নার্সের কথা শুনে এক দৌড়ে বাইরে চলে গেলো তামান্না। কেবিনের বাইরে গিয়ে হাটু মোড়ে বসে হাউমাউ করে কান্না করছে। তামিম এগিয়ে এলো তামান্নার কাছে হাঁটু ভেঙে বসলো।
তামিম ইতস্তত হয়ে বললো, মিস এটা হসপিটাল এভাবে কান্না করবেন না প্লিজ, শান্ত হন আপনি।
তামান্না হুট করে জড়িয়ে ধরলো তামিমকে আর কাঁদতে কাঁদতে বললো, ওকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো ? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জীবনের প্রতিটা সময়ের সঙ্গী, বন্ধু কম বোন বেশি। আমি থাকতে পারবো না ওকে ছাড়া।
তামিম কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। গতকাল থেকে অচেনা পরিস্থিতিতে পড়ছে বারবার। তামিম কিছু বলার আগেই তামান্না নেতিয়ে পড়ে যেতে নেয়, ধরে ফেলে তামিম। বড্ড মায়া হচ্ছে মেয়েটার উপর। তাই তো হসপিটালে পৌঁছে দিয়েও একা ফেলে চলে যেতে পারেনি গতরাতে।
শুদ্ধ এলোমেলো পায়ে উৎসার কেবিনে ঢুকলো। সাদা বেডে লেপ্টে আছে দূর্বল একটা শরীর। মায়াবী মুখটা মলিনতা ঘিরে ধরেছে। শুদ্ধ এগিয়ে গেলো উৎসার পাশে। বেডের পাশের চেয়ারে বসে কাঁপা হাতে উৎসার ডান হাতটা নিজের হাতে নিলো খুব সাবধানে। বামহাতে স্যালাইন চলছে।
শুদ্ধ ভেজা গলায় বললো, একটু বেশি সময় নাহয় নিয়েছিলাম তোমার কাছে ফিরতে। তাই বলে এতবড় শাস্তি দিবে মায়াবিনী ?
উৎসা চেনা আওয়াজে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে, কে ?
শুদ্ধকেও ঝাপসা দেখছে উৎসা। এদিকে শুদ্ধ কিছু না বলে চুপ রইলো। টুপ করে এক ফোঁটা চোখের পানি উৎসার হাতে পড়লো।
নড়েচড়ে উঠলো উৎসা আর অবাক গলায় বললো, ডাক্তার সাহেব আপনি এখানে ?
শুদ্ধ নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টায় নেমেছে তখন। উত্তর কীভাবে দিবে উৎসার প্রশ্নের।
আপনার না বিয়ে হয়েছে গতকাল। নতুন বউ রেখে এখানে কী করছেন ?
শুদ্ধ হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বললো, এরিশাকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে, তবেই আমি আমার মায়াবিনীর কাছে এসেছি। একটু বেশি সময় লেগেছে মানলাম, তাই বলে এতবড় শাস্তি কেনো দিচ্ছো মায়াবিনী ?
উৎসা অবাক হলো শুদ্ধর কথায়। এর আগে শুদ্ধ কখনো তাকে এই নাম ডাকেনি। উৎসা কিছু বুঝতে পারছে না শুদ্ধর কথা আর নিজের অবস্থা সম্পর্কেও কিছু জানে না। তবে তার মনে হচ্ছে খুব একটা সময় নেই তার হাতে।
শুদ্ধ হঠাৎ বললো, বিয়ে করবে আমাকে ?
উৎসা চকিত গলায় বললো, আপনি তো বিয়ে।
উৎসাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে শুদ্ধ বললো, করিনি বিয়ে, আমার মায়াবিনী ছাড়া অন্য কাউ ঠাঁই পেতে পারে না আমার বুকের বা পাশে।
উৎসা ঝাপসা চোখেই তাকিয়ে রইলো শুদ্ধর দিকে। উৎসা শুদ্ধকে খুব করে চেয়েছিলো তবে এখন কেনো জানি মন সায় দিচ্ছে না।
ডাক্তার সাহেব আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।
শুদ্ধ কিছু বললো না উৎসার কথার বিপরীতে, চুপ করে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো উৎসার দিকে।
বিয়েটা হচ্ছে উৎসা আর এখন এখানেই হচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব আমার মনে হচ্ছে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমি আপনার জীবনের সাথে জড়াতে চাই না নিজেকে।
শুদ্ধ উৎসার হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো, একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি এখনই।
১৯.
শুদ্ধর জেদের কাছে হার মেনে হসপিটালের বেডে শুয়ে শুদ্ধকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে উৎসা। রাজি না হওয়ায় শুদ্ধ নিজের হাতে চাকু ধরে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছে। সবাই অবাক হয়ে শুদ্ধর কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলার সাহসও পায়নি। তামিমও কাজি ডেকে আনতে বাধ্য হয়েছে। বিয়ে সম্পন্ন হলে সবাই একে একে বের হয়ে গেলো। এই হসপিটালের কেউ হয়তো এর আগে এমন বিয়ে দেখেনি।
উৎসা দূর্বল গলায় বললো, এমন পাগলামি কেনো করলেন ডাক্তার সাহেব ?
শুদ্ধ কিছু না বলে উৎসার পাশে বেডে বসে কপালে চুমু এঁকে দিলো। গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে উৎসার কপালে পড়লো। উৎসা এখনও নিজের রোগের কথা জানে না। তবে সে ঠিকই বুঝতে পারছে বড় কোনো রোগ বাসা বেধেছে তার ভেতরে আর হাতেও খুব বেশি সময় নেই।
শুদ্ধ মনে মনে বললো, স্ত্রীর মৃত্যুর চেয়ে প্রেমিকার মৃত্যু যে বেশি কষ্টকর। না থাকে দেখার অধিকার, না থাকে ছোঁয়ার অধিকার। কিন্তু এখন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সবার আগে তোমার উপর আমার অধিকার।
মুখে বললো, দু’বছরের ভালোবাসা কী একমাসেই শেষ হয়ে গেছে মায়াবিনী ?
উৎসা কিছু না বলে মুচকি হাসলো। সে হাসি দেখে বুক ফেটে কান্না আসছে শুদ্ধর। এই হাসি না দেখে কীভাবে থাকবে সে ? কীভাবে নিঃশ্বাস নিবে ?
শুদ্ধ হঠাৎ উৎসাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললো, আমাকে এতবড় শাস্তি দিও না মায়াবিনী। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। থেকে যাও না, বুকের কোণে সযত্নে লুকিয়ে রাখবো, এক ফোটা চোখের পানি আসতে দিবো না। পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ে এনে দিবো।
উৎসা বললো, জানেন আমি একদিন তামান্নাকে বলেছিলাম যেদিন আমাকে কেউ প্রচন্ড ভালোবাসবে সেদিন আর আমার নিঃশ্বাস পৃথিবীর বাতাসে মিশবে না। দিনটা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে বুঝতে পারিনি। আমি জানি না কী হয়েছে আমার ? আমার জানার ইচ্ছেও হচ্ছে না আর জানতে চাইও না। আমার হাতে যতটুকু সময় আছে আপনার সাথে থাকতে চাই। এই হসপিটাল থেকে নিয়ে চলুন আমাকে। ধরে নিন এটা আমার দেনমোহরের পাওনা।
শুদ্ধ ফেলতে পারেনি উৎসার কথা। সেই দিনটা হসপিটাল থাকে। সারারাত শুদ্ধ উৎসার হাত ধরে পাশে বসে থেকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা সেকেন্ডের জন্যও চোখ বন্ধ করেনি। পরদিন বিকেলের দিকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে নিয়ে আসে তামান্নাদের বাড়িতে। ডাক্তারও বাঁধা দেয়নি কারণ এখন আর তাদেরও করার মতো কিছু নেই। তামান্নাদের বাড়িটা খুব সুন্দর জায়গায়। বাড়িতে কেবল শুদ্ধ, উৎসা আর তামান্না ঢাকা থেকে কেউ ফিরেনি এখনো। তাদের কিছু জানানোও হয়নি উৎসার ব্যাপারে, শুধু বিয়ের কথা আনোয়ারা বেগমকে বলেছে শুদ্ধ, শুনে তিনি নির্বিকার ছিলেন। গোধূলির রাঙা আলোয় ছাঁদে বসে আছে শুদ্ধ আর উৎসা।
শুদ্ধ সামনে দেখিয়ে বললো, ঐ যে দূরে জমিটা দেখছো ওখানে একটা বাড়ি করার ইচ্ছে আছে। এখানকার পরিবেশ আমার ভালো লাগে তাই জায়গাটা কিনেছিলাম জীবনের শেষ সময়টা এখানে কাটানোর জন্য।
শুদ্ধর ডানহাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বসেছে উৎসা। পরনে তার সবুজ রঙের শাড়ি। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ায় উৎসা দেখতে পেলো না জায়গাটা। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে আর উৎসার মাথা ব্যাথা তীব্র হতে শুরু করেছে। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে, তবু শুদ্ধকে কিছু বলতে চাইছে না।
শুদ্ধ কাতর গলায় বললো, থেকে যাওনা উৎসা।
তীব্র ব্যাথায় মাথা চেপে আর্তনাদ করে উঠলো উৎসা। ব্যস্ত হয়ে তাকালো শুদ্ধ তার দিকে। উৎসার মুখটা নিজের দু’হাতের আঁজলে নিয়ে দেখলো নাকমুখ দিয়ে রক্ত আসছে।
শুদ্ধ ব্যস্ত গলায় বললো, উৎসা কষ্ট হচ্ছে ?
নিভু নিভু চোখে তাকালো উৎসা শুদ্ধর দিকে, কাঁপা হাতটা শুদ্ধর গালে রেখে ভেঙে ভেঙে বললো, ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব, আমার ডাক্তার সাহেব।
ডুকরে কেঁদে উঠলো শুদ্ধ বুকে জড়িয়ে নিলো উৎসাকে, কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভালোবাসি মায়াবিনী, আমার মায়াবিনী।
শুদ্ধর কাঁধ থেকে নেতিয়ে পড়লো উৎসার হাতটা। দিনের সূর্যটা ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশে। গোধূলির রাঙা আলো মিলিয়ে গিয়ে পৃথিবী ডুবে গেছে কালো অন্ধকারে। শুদ্ধর জীবনের সূর্যটাও ডুবে গেলো। বিয়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পার হতেই শুদ্ধকে ফেলে চলে গেলো উৎসা। প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা নিয়ে যায়নি সে। পৃথিবীতে সূর্যটা আবার উঠবে তবে শুদ্ধর জীবনের সূর্যটা আর উঠবে না কখনো। উৎসার নিথর দেহটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো শুদ্ধ। তার কান্নার আওয়াজে দৌড়ে ছাদে এলো তামান্না। দরজায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে সেখানেই ধুপ করে বসে পড়লো সে।
২০.
হাস্যজ্জল মায়াবি মুখটায় হাত বুলালো তামান্না। দুই বান্ধবীর বাঁধানো ছবি হাতে বসে আছে সে। উৎসা চলে গেছে আজ ত্রিশ বছর হলো। তামান্না চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পায় উৎসার সাথে কাটনো মুহূর্তগুলো। ভিজে উঠে তার চোখের কোণ।
তাম্বু বলে আর কেউ ডাকে না রে উৎসা। ঐ নামে ডাকার অধিকার আমি আর কাউকে দেইনি কোনোদিন।
কাঁধে হাতের স্পর্শে ঘুরে তাকিয়ে চোখে পড়লো তামিমকে, পাক ধরেছে চুলে, গালের দাঁড়িতে। হ্যাঁ সেই তামিম, উৎসা চলে যাওয়ার পর সেই তো তামান্নাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল তামান্না। তামান্না আর ঢাকায় কখনো পা রাখেনি আর না শেষ করেছে জার্নালিজম পড়াশোনা। তবে নিজের মেয়েকে দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। মেয়ের নামও রেখেছে উৎসা।
তামান্না মুচকি হেসে বললো, দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো তাই না তামিম।
তামিম প্রিয়তমার পাশে বসে বললো, সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সে নিজের মতো চলে।
তামান্না তামিমের কাঁধে মাথা রেখে বললো, উৎসাটা চলে যাওয়ার আগে তোমাকে দিয়ে গেলো আমার জীবনে। এখনো খুব মিস করি ওকে।
তামান্নার গালের নোনাজল মুছে দিলো তামিম। স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে বাইরের দিকে তাকালো তামান্না।
তামিম বললো, উৎসার বাবা-মাকে দেওয়া সেই ডাইরিতে কী লেখা ছিলো আজও বললে না তুমি আমাকে।
তামান্না মুচকি হেসে বললো, সত্যি আমি জানি না কী ছিলো সেই ডাইরি দুটিতে। তবে সেই ডাইরি পড়ে বাকি জীবনটা অনুতাপের আগুন পুড়েছে দুজনেই। হয়তো লেখা ছিলো বাবা-মাকে নিয়ে উৎসার সাজানো স্বপ্ন। যা তারা কেঁড়ে নিয়েছিলো উৎসার থেকে। এমন বাবা-মা কারো না হোক। জীবনের শেষ সময়ে দুজনের কেউই ভালো কাটিয়ে যেতে পারেননি। হয়তো নিজেদের পাপের শাস্তি ভোগ করে গেছে।
তামিম বললো, শুদ্ধ ভাইয়ার কাছে আজ একবার গেলে ভালো হতো।
তামান্না দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আজ কারো সাথেই কথা বলবে না ভাইয়া।
তামিম বললো, উৎসা জীবনের বিশ বছর কষ্ট ভোগ করে গেছে আর সে শুদ্ধ ভাইয়াকে সারাজীবনের কষ্টে ডুবিয়ে গেছে। মানুষটার জীবনের প্রাপ্তির খাতা আজ শূন্য।
তামান্না কিছু না বলে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো শুধু। বলার মতো কিছুই নেই আজ।
আগুন রঙা পলাশ ফুলে ঢেকে আছে সাদা পাথরে বাঁধানো কবরটা। পাশে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটা। বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুড়িয়ে গেছে, শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছে না।
শুদ্ধ কবরের পাশে বসে বললো, তুমি সত্যি মায়াবিনী। তোমার মায়াজাল থেকে আজও বের হতে পারিনি। তোমার সেই মুচকি হাসি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। তোমাকে ছাড়া অনেক তো হলো এই পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া। এবার তোমার কাছে যাওয়ার অপেক্ষা কেবল। দেখো গোধূলির রাঙা আলোয় আবার কী সুন্দর সেজে উঠেছে প্রকৃতি। তবে এর স্থায়িত্বকাল খুবই কম। তুমিও আমার জীবনে গোধূলির রাঙা আলোর মতো, ক্ষণিকের জন্য জীবনটা রাঙিয়ে আবার হারিয়ে গেছো ঘন কালো অন্ধকারে।
বড় আব্বু একটু পরই অন্ধকার হয়ে যাবে, বাসায় চলুন।
তিয়াসের কথায় ঘুরে তাকালো শুদ্ধ। বাড়ি করার জন্য শুদ্ধ যে জায়গা কিনেছিল সেখানেই কবর দেওয়া হয়েছে উৎসাকে। পাশেই দুতলা একটা বাড়ি করেছে শুদ্ধ। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর শুদ্ধ একেবারেই চট্টগ্রাম চলে এসেছে। আনোয়ারা বেগম আবার চেষ্টা করেছিলো শুদ্ধকে বিয়ে করানোর, তবে পেরে উঠেনি। এখানকার পরিবেশ ভালো লাগে মুগ্ধ আর তিয়াসার বড় ছেলে তিয়াসের। তাই মাঝে মাঝেই শুদ্ধর এখানে এসে থাকে। দুই ছেলে নিয়ে মুগ্ধ আর তিয়াসার সুখের সংসার। মিশুর বিয়ে দিয়েছে, সেও ভালো আছে। সবাই ভালো আছে একাকিত্বে ডুবে আছে কেবল শুদ্ধ। সে তার মায়াবিনীর কাছে যাওয়ার প্রহর গুনছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে তার অপেক্ষার প্রহর। গোধূলির রাঙা আলোয় আগুন রঙা পলাশ ফুলের নিচে ঘুমিয়ে থাকা উৎসাকে রেখে তিয়াসের সাহায্যে বাসার দিকে পা বাড়ালো শুদ্ধ। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি শুদ্ধর জায়গা হবে তার মায়াবিনীর পাশে। যেতে যেতে আবার ঘুরে তাকালো শুদ্ধ, চোখে ছিলো অভিমানের ছায়া।
★ সমাপ্ত ★