গোধূলির শেষ প্রণয় পর্ব-০৩

0
12

#গোধূলির_শেষ_প্রণয়
#লেখনিতে_ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি
#পর্ব_৩

বিশাল বড় বিল্ডিংয়ের পাঁচ তালায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে আবরার তেজ। তেজ গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান সিও আবরার তেজ। তার বাবা আনোয়ার হোসেন এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছেন। আনোয়ার হোসেন কে তার বাবা অনেক সাহায্য সহযোগিতা করছেন। তিনি মনে করেন তার বাবা না থাকলে তিনি কখনই এত দুর পর্যন্ত আসতে পারতেন না। তার এত সুনাম শুরু মাত্র তার বাবার জন্য সম্ভব হয়েছে।
এতদিন তিনিই সবকিছু দেখাশোনা করেছেন। তাঁর বয়স বাড়ছে এজন্য ছেলের কাঁধে তুলে দেন। সবকিছু থেকে বিশ্রাম নিতে চান।

আবরার তেজ নামটা শুনলেই অফিসের প্রতিটি স্টাফ ভয়ে কেঁপে ওঠে। অফিসের বস অনেক রাগী গম্ভীর স্বভাবের। তাকে জমের মতো ভয় পায় সকলে। তার চেহারাও যেমন সুন্দর তেমনি খুব সুদর্শন। মুখে খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি। প্রতিটা মেয়েই আবরার তেজ বলতে পাগল। আবরার তেজ কোনো মেয়ের ধারের কাছেও যায় না। দুরত্ব বজায় রেখে চলে। অফিসের মেয়ে স্টাফ গুলো অন্য দের আন্ডারে কাজ করে।

আবরার তেজ কাজ বলতে পাগল। কাজের কোনো গাফিলতি তিনি সহ্য করেন না। নিজের কক্ষে বসে আছেন তিনি। টেবিলে হাতের কনুই দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। দুপুরে খুব ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং আছে তাদের। সেটা তাদের পেতেই হবে না হলে কোম্পানির অনেক বড় লোকসান হয়ে যাবে।

_______

বিকাল চারটা বাজে। মানহা অয়নকে ফোন দেয় বাসায় আসার জন্য । মিরাজও বাসায় আছে। মানহার কিছু ভালো লাগছে না। তাই ভাবলো তিন ভাই বোন ঘুরতে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মানহা আর মিরাজ দুজনে ফন্দি আঁটে অয়নকে বাসায় আসতে বলে। অয়নও বোনের ফোন পেয়ে শো রুম থেকে ছুটে চলে আসে। এমন ভাবে বলছে না এসে পারবে না।

মানহা আর মিরাজ দুজনে বসে আছে মানহার রুমে। অয়ন বাসায় এসে মানহা মানহা বলে চিল্লাতে থাকে। অয়নের চেচামেচি শুনে অয়নের মা ইয়াসমিন সুলতানা বলে,,

” কিরে ষাড়ের মতো চিল্লাচ্ছিস ক্যান? কি হয়েছে?

” কিছু না মা। মানহা কোথায় তাই বলো?

” ও তো ওর রুমেই আছে। কেন বলতো?

” অয়ন কিছু না বলে দৌড়ে চলে যায় মানহার রুমে। দরজা ভিড়ানো বিধায় ঢুকতে অসুবিধা হয়নি।ছেলের কান্ডে ভ্যাবাচিকা খেয়ে যান ইয়াসমিন।

অয়ন মানহার রুমে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, মানহা তোর কি হয়েছে এভাবে আসতে বললি কেন?

ভাইকে এভাবে হাঁপাতে দেখে চমকে যায় মানহা,অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” ভাইয়া তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?

” তোর কিছু হয়নি তো বোন। তুই ঠিক আছিস। ভাইয়ের কথার মানে বুঝতে পেরে মুচকি হাসে মানহা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাইকে।

” আমার কিছু হয়নি ভাইয়া। বাসায় থাকতে ভালো লাগছে না সেজন্য তোমাকে ফোন দিয়ে আসতে বললাম। মানহা যানে তার অয়ন ভাই তাকে খুব ভালোবাসে। কেউ বলতে পারবে না অয়ন তার বড় চাচ্চুর ছেলে। আপন ভাইবোনের মতোই চলে তারা।

আজকাল সবাই কেমন খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আপন জনের থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। ভাই কে ভাই চিনছে না। তাহলে চাস্ত ভাই বোনেরা কিভাবে চিনবে। দুনিয়াটা বড়ই অদ্ভুত! নিজের স্বার্থের জন্য মানুষ সব করতে পারে। ভাই কে তাই ছাড় দিচ্ছে না। ভাইয়ের সম্পত্তির জন্য খুন করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। কিন্তু খান পরিবারকে দেখে সকলে গর্ভবোধ করে। দুই ভাইয়ে কি সুন্দর মিলেমিশে আছে।

অয়ন বোনকে ছেড়ে দুরে সরে গিয়ে বলে, আমার কাছে আসবি না। এভাবে কেউ ভয় দেয়। আমি কি ভয় পাইছি জানিস৷ এখনও বুকের ভিতর ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।

” মানহা ফিক করে হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, ভাইয়া তোমাকে বোকা বানিয়েছি আমরা দুজনে বলে জোরে জোরে হাসতে থাকে।

কতদিন পর বোনকে মন খুলে হাসতে দেখে মনটা জুড়িয়ে যায় অয়নের। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মিরাজও একই কাজ করে। কবে যে মানহা কে হাসতে দেখছে তাদের মনে নেয়।

দুই বছর আগে একটা বইয়ের কালো অধ্যায়ের পৃষ্ঠা মানহার জীবন টা কে এলোমেলো করে দিছে।সেই বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো ছিঁড়ে ফেলবে অয়ন। তার বোনের জীবনে আর আসতে দেবে না। তার বোনটাকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চায়। কোনো অশুভ ছায়া ছুতে দেবে না।

মানহা হাসি থামিয়ে দু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে দুজনে অবাক হয়ে তাকে দেখছে। মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে যায় মানহা। বোনের মুখের ভাব পাল্টে যেতে দেখে অয়ন বলে,,

” ভালোই তো আমাকে বোকা বানিয়েছিস। মিরাজ তোকে আমি পরে দেখে নেব। অয়নের কথা শুনে দৌড়ে মানহার পিছনে দাড়ায় মিরাজ। মানহা এবার বল কেন আসতে বললি।

” ভাইয়া চলো আমরা একটু ঘুরতে যায়। এই গোধূলি বেলার ওয়েদারটা আমার অনেক পছন্দের। বাসায় থেকে বোর হয় যাচ্ছি। বোনের কথায় রাজি হয়ে যায় অয়ন।

” তাহলে রেডি হয়ে নে। আমি রুমে যাচ্ছি বলে চলে যেতে গেলে,মানহার ডাকে থেমে গিয়ে বলে কি হয়েছে,

” ভাইয়া ভাবি কেও আসতে বলো না। ভাবির সাথে ভালো করে পরিচয়টাও হয়ে যাবে আর আমাদের ইনজয় করাটাও হয়ে যাবে।

” আচ্ছা। আমি বলে দিচ্ছি। এবার খুশি।

” অনেক ভাইয়া হাসি মুখে বলে।

” মানহা কালো রংঙের শাড়ি পরে হিজাব বেধে সুন্দর ভাবে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরে ঘুরতে।

______

ঢাকার একটা নামি-দামি রেস্টুরেন্টে বসে আছে মানহা অয়ন মিরাজ। তিনজনে অপেক্ষা করছে অয়নের উডবি নিরার জন্য। অপেক্ষার অবসান শেষ করে রেস্টুরেন্টের গেইট দিয়ে প্রবেশ করে নিরা আর তার ভাই। দুজনে এসে দাড়ায় অয়নদের টেবিলে। এসেই মানহা কে বলে,

” হ্যালো ননদিনী? কেমন আছো আপু? মানহার থেকে বয়সে ছোট নিরার।

” হেই ভাবি চলে আসছো তুমি কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি জানো মুখ ফুলিয়ে বলে,

” আরে বাবা আসব তো। জানোই তো ঢাকা শহরে যা জ্যাম।

” এতক্ষণ ননদ ভাবির কথা শুনছিল অয়ন। এবার নিজেই বলে, আগে বসো তারপর কথা বলো নিরা। ভাইয়া আপনিও বসেন,দাড়িয়ে না থেকে । অয়নের কথায় ফোন থেকে মুখ সরিয়ে টেবিলের দিকে তাকায়। মানহা আর নিরার ভাইয়ের দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মানহা ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। তার মনে পরে যায় সেদিনের ঘটনা তাকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

নিরা বসে পরে অয়নের পাশের চেয়ারে আর নিরার ভাই বসে মানহার পাশের চেয়ারে। সেটা ছাড়া আর কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই।

নিরা মানহা কে বলে,
” আপু কেমন আছো তুমি?
” জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। তুমি কেমন আছো?

” আলহামদুলিল্লাহ। আপু আমি তোমার থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই আমাকে ভাবি বলো না প্লিজ!

” বয়সে ছোট হলে কি হবে সম্পের্ক তুমি আমার বড় ভাবি। আমাকে তো বলতেই হবে তাই না মুচকি হেসে বলে,

” আমি এতকিছু জানি না। তুমি আমার নাম ধরেই ডাকবে।

” আচ্ছা পরে দেখা যাবে।

” ওহ সিট। আমি তো ভুলেই বসেছিলাম।

” কি? অয়ন বলে,

” মানহা আপু কে ভাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব তো। সেজন্যই তো ভাইয়া কে জোর করে ধরে বেধে আনছি,

” ভাইয়া।
বোনের ডাকে নিরার দিকে দৃষ্টি রেখে বলে, কি,
সে ফোনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে এজন্য অন্য দিকে তার কোনো খেয়াল নাই।

” হ্যাঁ এবার বল। নড়েচড়ে বসে বললো কথাটা

” ভাইয়া এটা হচ্ছে মানহা আপু। আমার একমাত্র ননদিনী। আর আপু এটা হচ্ছে আমার একমাত্র ভাই ?

” হাই? আমি আবরার তেজ?
নামটা শুনে চমকে যায় মানহা। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। মুখ স্বাভাবিক রেখে বলে

” হাই? আমি মানহা খান। জাস্ট এতটুকুই কথা হয় দুজনের মাঝে। কেউ কারোর সাথে কথা বলে না। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের।

মিরাজ মুখ গোমড়া করে বলে, আমি তোমাদের কেউ না? এভাবে পর করে দিলে আমাকে? তোমাদের সাথে কথা বলব না আড়ি?

” মিরাজের কথায় টেবিলের সবাই হেসে ওঠে। নিরা ফের বলে,,

” হায় রে! আমার দেবরজি রাগ করো না? আমি তো আছি তোমার জন্য গাল টেনে বলে।

” ছুবে না আমাকে? বলে হাত সরিয়ে দেয়।

তারপর অয়ন খাবার অর্ডার করে। কিছু খেয়ে তারপর হাঁটতে বের হবে। ওয়েটার খাবার দিলে সেটা খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয় পাঁচ জনে।

রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে দুই প্রেমিক প্রেমিকা । অয়ন আর নিরা। তাদের পিছে মানহা মিরাজ আর আবরার আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছে। দুজনকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য আগে পাঠিয়ে দিয়েছে মানহা।

গোধূলির শেষ বিকেলে হেটে চলেছে তারা। সূর্য মামা অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সূর্যের পাশ দিয়ে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে। দেখতে দেখতে নিমিষেই পুরো আকাশে কেমন মেঘ জমতে শুরু করে। ছোট ছোট মেঘ গিয়ে বড় মেঘের সাথে মিলে যাচ্ছে। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। হঠাৎ এমন হওয়ায় চারপাশের মানুষ গুলো ছুটে চলছে নিজ গন্তব্য। অয়ন আর নিরা ফিরে আসে মানহা দের কাছে। নিরা আর আবরার তাদের গাড়িতে আর অয়ন মিরাজ মানহা তাদের গাড়িতে উঠে পরে। দুজন দুজনার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পরে বাসার উদ্দেশ্য।

গাড়ি ছাড়ার পরপরই ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। মানহা জানালার পাশে বসে বাইরের পরিবেশটা দেখছে। ঝুপঝাপ করে বৃষ্টি নেমে যায়। মানহা অনেক দিন পর এত কাছ থেকে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি ছুয়ে দেখতে মন চায় মানহার। তাই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির ফোটা হাতে এসে পরে। মানহা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। মানহা কে বাইরে হাত দিতে দেখে অয়ন চেচিয়ে ওঠে,,

” বেোন হাত সরিয়ে নে। হঠাৎ অয়নের চেচানোই ভড়কে যায় মানহা। তাড়াতাড়ি হাত ভিতরে এনে বলে,,

” কি হয়েছে ভাইয়া। এমন করলে কেন?

” চলতি গাড়িতে কখনও বাইরে হাত দিবি না। যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত তখন কি হতো ভাবতো। আর কখনও দিবি না বোন।

” আচ্ছা ভাইয়া।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। বৃষ্টি ছাড়ানোর কোনো নাম গন্ধ ছিল না। সেই অবস্থায় ভিজে ভিজে বাসায় আসে মানহা রা,,,,,,,,

চলবে ইনশা আল্লাহ।