গোধূলির শেষ প্রণয় পর্ব-০৪

0
10

#গোধূলির_শেষ_প্রণয়
#লেখনিতে_ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি
#পর্ব_৪

সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিস। সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। সময় থেমে থাকে না। নিজ গতিতে চলতে থাকে। তেমনি মানহা দেশে আসছে আজ দশদিন। আর কয়েকদিন পর অয়ন আর নিরার বিয়ে। বিয়েটা শেষ হওয়ার পরেই চলে যাবে। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে খুব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে মানহা। জবের জন্য ট্রাই করছে। কারোর বোঝা হয়ে থাকতে চায় না মানহা। পাশের বাসায় একটা মহিলা আসে মানহাদের বাসায়। মানহা মহিলাকে দেখে ভদ্রতার খাতিরে বললো,,

” আরে আন্টি যে কেমন আছেন?

” এই তো আছি ভালোই । তা তোমার কি খবর মানহা বসতে বসতে উত্তর দেয়।

” জ্বি আন্টি আলহামদুলিল্লাহ।

” তা বিয়ে শাদির কি খবর? করবানা বিয়ে?

” সেসব নিয়ে ভাবিনি আন্টি।

” ওমা ক্যান?
কষ্ট করে সতিনের ঘর করলে কি এমন হতো? কপালডা তো আর পুরতো না? দুই সতিনে মিলেঝুলে কাম কাজ করতে পারতা। তোমারও কষ্ট কম হইতো সাথে তারও?

” দেখুন আন্টি আপনি এখানে আসছেন ভালো কথা। চা বিস্কুট খান। ওইসব কথা বলেন না।

” সত্যি কথাই তো কইলাম। তোমার ভালোর কথা ভেবে। আর তুমিই এই কথা কচ্ছো। কারোর ভালো করতে নেয়।

” মানহা অনেক্ক্ষণ ধরে মহিলার কথা মুখ বুজে সহ্য করছিল কিন্তু আর পারলো না।

” আমাকে কি মনে হয় আন্টি৷ মানুষের হাতের পুতুল। যে যার মতো নাচাবে আর আমি নাচব। আমার কোনো আত্মসম্মান নেই। সতিন নিয়ে সংসার করব। মেয়ে বলে কি পঁচে গেছি। আচ্ছা আপনিই বলুন তো। আমার জায়গায় আপনার মেয়ে থাকলে আপনি তাকেও বলতেন সতিনের ঘর কর। একটু মানিয়ে নে। মেয়েরা কখনও স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। তেমনি আমিও পারিনি তাই জন্যই তো সেদিকে ফিরে তাকায় নি। এখন তো দিব্যি ভালো আছি তাকে ছাড়া তাহলে অতিত কে কেন মনে করিয়ে দিচ্ছেন। একটু ভালো থাকতে দিন না আমায় চিল্লিয়ে বলে ওঠে।

মানহার চেঁচামেচিতে বাড়ির সকলে ড্রয়িংরুমে ছুটে আসে। মানহার মা আর চাচি কিচেন থেকে দৌড়ে আসে। মেয়েকে রেগে যেতে দেখে ধরে বসায়।

” মহিলাটা কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অয়ন এগিয়ে এসে মহিলা কে উদ্দেশ্য করে বললো,

” ফারদার যদি দেখছি আর কখনও আমার বোনকে এভাবে হ্যারাস করতে তাহলে আমি ভুলে যাব আপনি আমার বড়। আপনাকে যে সম্মানটুকু করি সেটা বজায় রাখুন নইলে ভালো হবে না বলে দিলাম আঙু্ল উঁচিয়ে কথাটা বলে অয়ন।

মহিলা সুরসুর করে কোনো কথা না বলে একপর্যায়ে দৌড়ে পালালো৷ সে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলছে। তার একটুও বলা ঠিক হয়নি।

_______

সদর দরজায় দাড়িয়ে সবটা শুনছিল আবরার তেজ। মনে মনে বলে, মেয়েটার আত্মসম্মানবোধ অনেক প্রখর। সাহস আছে বলতে হবে। নিরার থেকে শুনছিলাম মেয়েটার অতিত সম্পর্কে। মুচকি হেসে মনে মনে বলে, এমন মানুষই তো লাগবে। অন্যায় দেখলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করবে। কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করবে না। আই লাইক ইট।

“দরজায় আবরারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইয়াসমিন বেগম এগিয়ে এসে বলেন,

” আবরার বাবা তুমি এখানে। কখন আসলে। বাইরে কেন দাড়িয়ে আছো ভিতরে আসো।

” আন্টি এত উত্তেজিত হবেন না। আমি মাত্রই আসলাম বলে ভিতরে আসে।

” মানহা এক পলক আবরারের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে হনহনিয়ে দোতলায় হাঁটা ধরে। আবরার এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মানহার দিকে।

আবরার সোফায় গিয়ে বসে। অয়ন আবরারের অপোজিট পাশে বসে। ইয়াসমিন বেগম আবরারের জন্য চা নাস্তা আনতে গেছেন। আবরার অয়ন দুজনেই চুপচাপ আছে। অয়ন সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে।

আবরার একবার অয়নের দিকে তাকায়। ছেলেটা মনে হয় বোনের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। আর মানহার ও চোখ ছলছল করছিলো। মেয়েটার সহ্য ক্ষমতা অনেক কঠোর। অন্য কেউ হলে এতক্ষণ কান্নাকাটি করে পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেলতো। অথচ দেখো মেয়েটা চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।।।

অয়ন তাকে আসতে বলছিল। মানহার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। কিন্তু এখানে এসে দেখে এই অবস্থা।

ইয়াসমিন বেগম নাস্তা এনে আবরারের সামনে রাখে। আবরার এতোসব দেখে বলে,

” আন্টি কষ্ট করে এগুলো কেন আনতে গেলেন। আমি মাত্রই খেয়ে আসছি।

” তুমি এই প্রথম বার আসলে তোমাকে খালি মুখে কিভাবে ফিরায় বলো।

” শুধু চা হলেই হতো খামাখা।

” থামো তো।চুপচাপ খাও এগুলো আমি আসছি বলে চলে গেলেন।

আবরার অয়নকে বললো,
“অয়ন
” সোজা হয়ে বসে অয়ন। আবরারের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলে,

” সরি ভাইয়া। পরিস্থিতি এমন হবে জানলে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতাম না। এক্সট্যামলি সরি।

” রিলাক্স অয়ন। এতো সরি বলছো কেন? আমি কিছু মনে করিনি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলে নেব। ওনার এখন মনটা ভালো নেই। উনাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিন।

” উহু ঠিক বলছেন ভাইয়া। আমার বোনটা অনেক নরম মনের। অনেক কষ্ট পেয়েছে ও।

” আচ্ছা অয়ন তাহলে আজ উঠি। অন্য আরেকদিন আসব।
” আচ্ছা ভাইয়া।

” আবরার সবাইকে বলে বেড়িয়ে আসে খান ভিলা থেকে।

_____

মানহা ওয়াশরুমের ভিতর দরজা বন্ধ করে অঝোরে কাদতে থাকে। চার দেয়ালের ভিতরে তার কান্না আটকে আছে। বাইরের কেউ শুনতে পেল না মানহার কান্না। তানিয়া বেগম দরজার সামনে দাড়িয়ে বার কয়েক ডাকলে মানহা বলে দেয় সে একা থাকতে চায় কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। মেয়ের মন মেজাজ ভালো না বলে সবাইকে আসতে বারণ করছে।

ঝর্ণার পানির সাথে মানহার চোখের পানি মিলে যাচ্ছে। ঝর্ণার নিচে বসে হাউমাউ করে কান্না করছে আর বিড়বিড় করে বলছে,,

“আল্লাহ কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে? সবাই আমাকে কটু কথা শোনায়? কেন? কেন? আমিও তো মানুষ? আর কত সহ্য করব আল্লাহ? যার জন্য দুইটা বছর নিজের কাছের মানুষদের থেকে অনেক দুরে থাকলাম। ওই সুদূর আমেরিকাতে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। দিনশেষে সেই ডিভোর্সি শব্দ টা শুনতে হয়। নিজেকে অনেক শক্ত করে গড়ে তুলছি। তাও কেন এমন লাগছে? সবার সামনে নিজেকে কঠোর দেখালেও রাতের গভীরে আর সহ্য করতে পারি না? সবার আড়ালে চোখ থেকে পানি ঝরে? কাউকে দেখাই না? আর দেখাবোউ না? আল্লাহ আমাকে আর ধৈর্য্য দাও? সামনে আরও কঠিন সময় পার করতে হবে। ঝর্ণার নিচ থেকে উঠে দাড়ায়। তার চোখে পানি মানায় না? ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় মানহা।

রুমে এসে আয়নার সামনে দাড়ায় মানহা। নিজেকে আয়নায় খুটে খুটে দেখে। সে কি দেখতে খুব খারাপ। যার জন্য রুপম আমাকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করলো। আমার মাঝে কি নেই যার জন্য পরকীয়া করতে হলো। রুপে গুণে সব দিক দিয়েই তো ছিল। তাও তাকে বেধে রাখতে পারলাম না। মেয়েটা শুধু আমার থেকে একটু ফর্সা। মানে মেয়েটা সাদা ফর্সা আর আমি হলদে ফর্সা। তাতেই বিমোহিত হয়ে গেলো। হায় রে! মানুষ! ত্যাচ্ছিল্য হেসে ওঠে মানহা। বিড়বিড় করে বললো,,

” কখনও কোনো পুরুষ জাতিকে বিশ্বাস করব না৷ আই হেট ইউ। নিজেকে আর কারোর মায়ায় জড়াবো না। আমি ঘৃণা করি পুরো পুরুষ জাতিকে। সবাই সমান। তারা কখনও এক নারীতে আসক্ত থাকতে পারে না। তোমাকে কখনও ক্ষমা করব না রুপম। তোমাকে আমি ছেড়ে দিলেও প্রকৃতি তোমাকে ছাড়বে না। রিভেঞ্জ অফ নেচার বলে একটা কথা আছে সেটাই হবে দেখেনিও। থাকব না এই শহরে চলে যাব অনেক দুরে। সেখানে আমাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। বিষাক্ত শহরে থাকতে চায় না। কেউ ছুতে পারবে না আমাকে। সবাইকে ছেড়ে চলে যাব। সেখানে অন্তত মন খুলে নিঃশ্বাস টা তো নিতে পারব। ভাইয়ার বিয়েটা ভালোই ভালো হয়ে গেলেই চলে যাব আমি। কাউকে না বলে যেমন আসছি তেমনি কাউকে না বলে চলে যাব এই শহর ছেড়ে।

একটা সুতি থ্রি পিস পড়ে নিচে নামে মানহা। সে জানে তার জন্য এখনও কেউ মুখে ভাত তোলেনি। তাই জন্য তাড়াতাড়ি করে নিচে আসে। তার খিদে না লাগলেও বলতে হচ্ছে খিদে লাগছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পুরো ড্রয়িংরুমটায় চোখ বুলিয়ে নেয়। তার দুই ভাই পাশাপাশি সোফায় বসে আছে। মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুচছে। মায়ের পাশে বড় চাচি দাঁড়িয়ে শান্ত্বনা দিচ্ছে। নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় মানহার। আল্লাহ তাকে এত সুন্দর একটা পরিবার দিয়েছে। সিঁড়ি থেকেই চেচিয়ে বলে,,

” আম্মু খুব খুদা লাগছে খেতে দাও।

বোনকে স্বাভাবিক দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অয়ন। অনেক ভয়ে ছিল। যদি কিছু করে ফেলে।

তানিয়া বেগম হাসি মুখে বলে,,

” আয় মা৷ আমি খেতে দিচ্ছি। তোর জন্য না খেয়ে আছে সবাই।

” মানহা জানতো এমনটাই হবে তাই জন্যই তো আসছে। সে না আসলে যে সবাই না খেয়েই থাকতো। মিরাজ উঠে এসে বলে,

” আপু ঘড়ি দেখো তো কয়টা বাজে নিজেরটা এগিয়ে দিয়ে। আমি কখন ভার্সিটিতে যাব। আর কখন খাব। আমি গেলাম ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেব বলে চলে যেতে গেলে মানহা হাত ধরে দাড় করিয়ে দিয়ে বলে তুই দুইটা মিনিট বস আমি আসছি বলে কিচেনের দিকে দৌড় দেয়। মানহার কান্ডে সকলে অবাক কি করছে মেয়েটা।

মানহা প্লেটে ভাত এনে মিরাজের পাশে বসে ভাত মাখাইতে মাখাইতে হা করতে বলে, মিরাজ হা করলে এক লোকমা ভাত মুখে পুরে দেয় মানহা। ইয়াসমিন আর তানিয়া দুজায়ে ভাই বোনের ভালোবাসা দেখে।

মিরাজ কে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে অয়ন মুখ গোমড়া করে বলে আজ একটা বোন নাই বলে অন্যের বোনের ভালোবাসা দেখতে হচ্ছে। একটা যদি,,, আর কথা বলতে পারলো না অয়ন। পারবে কি করে মানহা অয়নের মুখে ভাত ঢুকিয়ে দিছে। তিন ভাই বোন খুনসুটি করে খাওয়া শেষ করে। অয়ন মানহাকে খাইয়ে দেয়। ভাই বোনের এত সুন্দর মুহূর্ত দেখে মুগ্ধ হয় সবাই।








মিরাজ আর অয়ন বাসা থেকে চলে গেলে মানহা বাড়ির ছাদে দোলনায় গিয়ে বসে। মেঘলা আকাশ বিধায় রোদে তেজ নেই। হালকা হালকা রোদে পরিবেশটা ভালোই লাগছে মানহার কাছে। আনমনে আকাশের পানে তাকিয়ে রয়। তখন মানহার ফোনে একটা আননোন নম্বর থেকে কল আসে। প্রথম বার বেজে বেজে কেটে যায় রিসিভ করে না। আবারও ফোন বেজে ওঠে ধরবে কি ধরবে না দ্বিধায় পরে। শেষ মেষ ভাবে এতবার ফোন দিচ্ছে নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ ভেবে রিসিভ করে ,,,,,,

চলবে ইনশা আল্লাহ।