#চৈত্রিকা (২৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
৭১.
কথায় আছে সময় আর স্রোত কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় তার নিজ গতিতেই চলে। সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষ শুধু আফসোস করে। সময় কারো জন্য থমকে নাা থাকলেও জমিদার বাড়ি থমকে আছে একটা জায়গাতেই। ‘চিত্র’! চিত্র নিখোঁজ হওয়ার পর কেটেছে প্রায় ১ মাস। তবুও চিত্রর কোনো রকম খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ প্রহর দিনরাত খুজেই চলেছে কিন্তু চিত্রর কোনো খোঁজই তার কাছে আসেনি। অর্পিতা দিন দিন গুমড়ে ম’রছে। বার বার নিজের কাজের জন্য আফসোসে জর্জরিত হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছে চিত্রকে পাওয়ার। পল্লবীও খুব একটা ঘর থেকে বের হয় না। জমিদার বাড়ির তেজ কমে গেছে এতটুকুতেই। অর্থির আর কয়েকদিন পর পরীক্ষা। নিবিড়,চৈত্রিকা, নীরা অনেক কষ্টে তাকে কোনো রকমে পড়া সম্পূর্ন করায়। একটা মানুষের জন্য তো মাধ্যমিক থেমে থাকবে না। থেমে থাকবে না কারো জীবন! সবাই নিজেদের মতো চলছে ঠিকই তবো কারোর মধ্যেই প্রাণ নেই। জমিদার বাড়িটা এখন হাহাকার করে। চৈত্রিকা চিত্রর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কষ্ট পেলেও মাঝে মাঝে হাসে। জমিদার বাড়িতে সে প্রবেশের কেবল দেড় মাস। এতেই জমিদার বাড়ির হাহাকার হলে চলবে? প্রতিদিনকার মতোই সকাল সকাল উঠে গোসল করে বাড়ির কাজের মানুষকে নিয়ে বাড়ির দুই বউ সব কাজ শেষ করে সবাইকে ডাকে খেতে। পল্লবী আর অর্পিতার জন্য খাবার ঘরে নিয়ে যাবে। চৈত্রিকা প্রথমেই আসে প্রহরের কাছে। শেষ একদিন এই মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেও গত ১ টা মাসে মুখে টু শব্দও করেনি। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে থাকতো তার মুখের দিকে কিন্তু প্রহর তার সাথে কোনো রকম শব্দ না করেই চুপচাপ শুয়ে থাকতো। দুজন দু পাশ হয়ে শুয়ে থাকলেও চৈত্রিকা বুঝতো প্রহর জেগে আছে। কত দিন তো প্রহর বাড়িতেই ফিরতো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চৈত্রিকা ঘরে পা রাখতেই কোথাও প্রহরকে নজরে আসে না। আজও কি প্রহর তাকে না বলেই চলে গেছে নাকি! ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ এলোমেলো বিছানার দিকে তাকিয়ে আবার নিজেই চোখ বন্ধ করে নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘তাতে আমার কি? জমিদার সাহেব যাক মন চায় থাকুক! তাতে আমার কি? আমি উনার এমন কে লাগি যে আমাকে বলে বের হতে হবে? আর আমারই বা এতো যায় আসবে কেনো উনি বলে যাওয়ায় বা না বলে যাওয়ায়! আমি নিজ লক্ষ থেকে সরে কেনো যাচ্ছি বার বার?’
নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বিছানা গোছাতে শুরু করে। পেছন থেকে গোসলখানার দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকায় চৈত্রিকা। প্রহর তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে আয়নার কাছে এগিয়ে আসে। কিন্তু চৈত্রিকার সাথে কোনো কথা বলে না। চৈত্রিকা খানিকটা উসখুস করলেও দৃষ্টি এদিক ওদিক করে নিচে তাকিয়ে বলে,
‘খাবেন না জমিদার সাহেব?’
প্রহর কতক্ষণ চুপ থাকে। তারপর চুল ঠিক করে আলমারি থেকে শার্ট বের করে নেয়। শার্ট গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে, ‘খাবো। নিচে চলো! আর আমি আজ একটু শহরে যাবো। আসতে রাত হতেও পারে আবার রাতে নাও ফিরতে পারি। তুমি চিন্তা করো না। দরজা লাগিয়ে ঘুমাবে। রাতে কেউ ডাকলেও দরজা খুলবে না। মাথায় থাকবে?’
চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে৷ বিড়বিড় করে বলে, ‘কে যেনো তার জন্য চিন্তা করতে যাাবে! আমার কিসের ঠ্যাকা হুহ! তার কথা শুনবোই বা কেনো?’
প্রহর হয়তো শুনলো তবে কোনো রকম কথা বাড়ালো না। চুপচাপ জুতা পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রহর যেতেই চৈত্রিকা চোখ মুখ কুঁচকে নাক ফুলিয়ে বলে,
‘আমি যে ডাকতে আসলাম আমাকে পাত্তাই দিলো না! অন্তত মানুষ তো ভদ্রতার খাতিরেও সাথে যেতে বলে নাকি!’
কোনো রকমে সব গোছগাছ করে মনে মনে প্রহরকে বকতে বকতেই ঘর থেকে বের হয়৷ নিচে এসে বাড়ির ছেলেদের সবার খাওয়া হয়ে গেলে চৈত্রিকা নিজেই প্লেট নিয়ে পল্লবীর ঘরে যায়। পল্লবী তখন নামাজের বিছানায় বসে তজবি পাঠ করছিলো। সারাদিন এখন তার এই জায়গাটাই সবকিছু। এখান থেকে অপ্রয়োজনে সে ওঠেও নাহ। চৈত্রিকা খাবার টেবিলের ওপর রেখে ছোট করে বলে,
‘আম্মা খাবেন না?’
পল্লবী চোখ তুলে তাকায়। চৈত্রিকাকে হাতের ঈশারায় কাছে ডেকে পাশে বসায়। নিস্তেজ গলায় বলে, ‘প্রহর কোথায় বড় বউ?’
‘উনি তো খেয়ে বের হলেন। আজও বোধহয় চিত্র ভাইকে খুঁজতেই গেছে।’
পল্লবী ভাসা ভাসা চোখে তাকায়। চোখের পানি আড়াল করে বলে, ‘ছেলেটা আমার দিনরাত খুঁজে যাচ্ছে! ওকে বলো আর না খুঁজতে! ছেলেটা মনে হয় না আর বেঁ*চে আছে!’
গলা কেঁপে ওঠে পল্লবীর। চৈত্রিকা শক্ত করে পল্লবীর হাত ধরে। আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘আপনি ভুল ভাবছেন আম্মাজান। চিত্র ভাইয়ের কিছু হয়নি৷ দেখবেন আপনার বড় ছেলে ঠিকই চিত্র ভাইকে ফিরিয়ে আনবে।’
পল্লবী চৈত্রিকার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটার বয়স কম হলেও বুঝ, ধৈর্য কতটা বেশি! পল্লবী গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকা একবার খেয়ে নিতে বলে। পল্লবী সে কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে,
‘আমি তোমার মতো আশ্বাস দিতেও পারি না নিতেও পারি না চৈত্রিকা। আমি তোমাকে চিনি৷ তুমি মুখে যতটা আশ্বাস দিতে জানো ভেতরে ততটাই আশ্বাস নিতে জানো না। কিন্তু তুমি জমিদার বাড়ির একটাও মানুষকে চিনো না। এরা নিজ স্বা’র্থে সব পারে। চয়ন রেনওয়াজ নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের ছেলেকে কু’র’বা’নি দিতেও দুবার ভাববে না। আমার প্রহরটা ভীষণ কঠিন , পা’ষাণ। ‘ও’ কাউকে ভালোবাসলেও সেই মানুষটার অন্যায় সহ্য করতে পারে না। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবেসে একটু একটু করে আ’ঘাত করে। তখন সেই মানুষ পানি ছাড়া মাছের মতো ছটফট করে মৃ’ত্যু কামনা করে। ওর মতো পা’ষান, কঠিন ওর বাপও না। পিয়াসটা তো মানুষই না। এক্কেবারে বা’পের মতো জা’নো’য়ার। শুধু আলাদা আমার চিত্রটা। ছেলেটা এসব কিছু থেকে সবসময় দুরে থাকে। চাপা স্বভাবের ছেলেটা আমার ভেতরে ভেতরে ভীষণ সরল। সেই ছেলেটাকেই আমার ওরা কোলহারা করতেছে। যদি আমি একটুও টের পাই আমার ছেলেটাকে এভাবে কেড়ে নেওয়ার জন্য চয়ন রেনওয়াজ দায়ী! কসম আল্লাহর নিজ হাতে ওর বুকে তলোয়ার বসিয়ে সেই র’ক্ত আমি গায়ে মাখবো।’
পল্লবীর শেষ উক্তিতে কেঁপে ওঠে চৈত্রিকা। অজান্তেই হাত চেপে ধরে পল্লবীর। কথাটাই কিছু একটা তো ছিলো! কি ভীষণ রাগ, ক্ষো’ভের বহিঃপ্রকাশ! চৈত্রিকা পল্লবীর তেজী চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ায়,
‘তবে কি আমি একা এই জমিদার বাড়ির ওপর ক্ষো’ভ রাখিনি? জমিদার গিন্নি পল্লবী কেনো এতো রাগ, ক্ষো’ভ পুষে রেখেছে? কি এমন রহস্য আছে এসবের পেছনে!’
৭২.
দুপুরবেলা চৈত্রিকা কাপড় ধুয়ে ছাঁদে রোদে দেওয়ার জন্য যায়। আপনমনে কাপড় মেলছিলো সে সময় ছাঁদের দরজা থেকে মহিলা কন্ঠ ভেসে আসে। চৈত্রিকা ঘাড় বাকিয়ে তাকিয়ে দেখে নাসিমা দাঁড়িয়ে আছে। চৈত্রিকা দাঁতে দাঁত চেপে টান টান হয়ে দাঁড়ায়। নাসিমা তাচ্ছিল্যের সুরে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে চৈত্রিকার কাছে। ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলে,
‘তাহলে কি এখন শ’ত্রুর সংসারই গুছিয়ে দিচ্ছিস চৈত্রিকা?’
চৈত্রিকা বোঝার চেষ্টা করে কথাটা। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে নিজ কাজ করতে করতে বলে, ‘হ্যাঁ। কি করবো? হাজার হলেও সব শ’ত্রুর বিদায়ের পর তো সংসারটা আমারই থাকবে নাকি!’
‘তোর এখনো মনে হয় তুই এই সংসারে টিকতে পারবি?’
‘না টিকার মতো তো কিছু দেখছি না।’
নাসিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকার তাতে কোনো হেলদোল নেই। সে যেনো নাসিমাকে দেখেও দেখছে না, চিনেও চিনছে না। নাসিমা চৈত্রিকার হাবভাব বুঝে উঠে না। কাছাকাছি এগিয়ে আসে। চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘কি সমস্যা? কাজ কাম নাই?’
‘তুই এতো স্বাভাবিক কেনো? চিত্রকে তুই সরিয়েছিস তাই না?’
এপর্যায়ে কপালে ভাজ পড়ে চৈত্রিকার। কাপড়ের বালতি হাত থেকে নিচে রেখে হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়। কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘আমারে কি আপনার নিজের মতো মনে হয়? আমি আপনার মতো নিচু মানসিকতা নিয়ে ঘুরি না। চিত্র ভাইকে সরানোর কথা আপনি, আপনার স্বামী, আপনার ভাসুরই ভাবতে পারেন! আপনারা তো আবার নিজের লো’ভে অ’ন্ধ।’
জ্বলে ওঠে নাসিমা। চৈত্রিকা বালতিটাা হাতে নিয়ে চলে আসতে নিলে হাত ধরে আটকায় নাসিমা। চৈত্রিকা ঘাড় বাকিয়ে তাকাতেই নাসিমা অদ্ভুত ভাবে বলে,
‘তোকেও আগে বলেছি আরো একবার বলছি! এখান থেকে চলে যা। এখানে থাকলে তোর সংসার হবে না৷ যত যায় করিস দিনশেষে তোর ম’রতেই হবে। প্রহরকে যতটা নিষ্পাপ ভাবছিস ‘ও’ কিন্তু অতোটাও নিষ্পাপ না।’
চৈত্রিকা আলগোছে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘সাহস থাকলে আর কলিজা থাকলে আমার গায়ে একটা টোকা দিতে বলিয়েন! দেখবো কার কত বড় কলিজা! আর রইলো বাকি প্রহর রেনওয়াজের কথা! তাহলে শোনেন আমি জানি কে সত্যিই কতটা নিষ্পাপ আর কে কতটা নিষ্পাপ সাজে! তাই আপনার আর কষ্ট করে আমার শ’ত্রুদের কথা আমাকে মনে করানোর দরকার নেই। ধন্যবাদ।’
চৈত্রিকা চলে যায়। নাসিমা চৈত্রিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কিছু ভাবে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ঝুলিয়ে নিজেও স্থান ত্যাগ করে।
৭৩.
বৈশাখ মাস মানেই হুটহাট বৃষ্টি, বাতাস। সন্ধ্যা থেকেই হুট করে বাতাস বয়ছে। চারপাশে নিকষ কালো আঁধার ছড়িয়ে গেছে। জমিদারের বাড়ির সব দরজা, জানালা বন্ধ করে নিজ ঘরে বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছে চৈত্রিকা। যতই মুখে বলুক প্রহরের জন্য সে চিন্তা করে না, করবে না কিন্তু এই ঝড়, বাতাসের রাতে হুট করেই মাথায় চিন্তারা আগমন ঘটায়। এই ঝড়ের রাতে প্রহর কোথায়! হাসফাস হাসফাস করতে করতে পুরো ঘরে পায়চারী শুরু করে। পায়ে প্রহরের দেওয়া নুপুরগুলোর শব্দ হচ্ছে। চিন্তায় বিভোর থাকা চৈত্রিকা নিজের নুপুরের আওয়াজটুকুও খেয়াল করছে না। তাার ভাবনার মাঝেই বেশ কয়েক বার দরজায় কড়াঘাত পড়ে। চমকে উঠে চৈত্রিকা একবার দরজা খুলতে গিয়েও খোলে না। উল্টো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকে বাহিরে কি হচ্ছে তা শোনার জন্য! কিছুক্ষণ পরই জমিদার বাড়ির সার্ভেন্ট এসে চৈত্রিকাকে ডাকতে শুরু করে। মহিলার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেয়। মহিলাটি যেমন তাড়া নিয় এসেছিলো তেমন তাড়া নিয়েই কোনো রকমে বলে,
‘বড় ভাবীজান, বড় গিন্নিমা আপনাকে নিচে ডাকে!’
মহিলাটি চলে যায়। চৈত্রিকা কপালে ভাজ ফেলে মাথায়য় আঁচল টেনে নিচে নামে। ততক্ষণে চেঁচামেচির আওয়াজ তার কান পর্যন্ত চলে গেছে। কোনো শব্দ ছাড়াই নিচে নেমেই শুনতে পায় পল্লবীর কান্না। চৈত্রিকা এ পর্যায়ে ছুটে আসে। পল্লবী তাকে দেখতে পেয়েই হায় হায় করে বলে,
‘বড় বউ রে আমার প্রহরের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। এই ঝড় বাতাসের রাতে ছেলেটাকে আমার একটা গাড়ি র’ক্তাক্ত করে ফেলে গেছে।’
চৈত্রিকা চমকায়। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে নীরা ধরে। ধীরে সুস্থে তাকে বসিয়ে দেয়। শায়লা এক গ্লাস পানি নিয়ে ছুটে আসে। পল্লবী তখনও আহাজারি করছে। এক ছেলে এমনিতেই নিখোঁজ এরওপর আরেক ছেলের এক্সিডেন্ট যেনো পল্লবীর ভেতরের ক্ষ’ত বাড়িয়ে দিয়েছে। চৈত্রিকার মাথা ঘুরপাক খায়। কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্ক কাজ বন্ধ করলেও পরে বুঝতে পারে ঘটনাটা। কিন্তু মেয়েটা কাঁদে না। দুর থেকে নাসিমা এগিয়ে আসে চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকার গা ঘেষে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
‘স্বামী হারাইতে চলেছিস! একটু কাঁদ চৈত্রিকা। নয়তো আবার তোকে অনেক কথা শুনতে হবে।’
চৈত্রিকা দমে না। ক্ষোভ নিয়ে তাকায় নাসিমার দিকে। কন্ঠের তেজ ধরে রেখে বলে, ‘প্রহর রেনওয়াজ এতো সহজে সব ছেড়ে ছুড়ে আপনাদের শান্তি দিয়ে চলে যাবে মনে হয়? উহু একদমই ওইরকম ভাবনা মাথায় আনবেন না। আমি স্বামী হারাবো না।’
চৈত্রিকার আত্মবিশ্বাসে ‘থ’ মে’রে যায় নাসিমা। চৈত্রিকা নিজেই কথাগুলো বলে অবাক হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হয়। নীরা চৈত্রিকার পাশে বসে অসহায় কন্ঠে বলে,
‘এসব কি হচ্ছে ভাবীজান? এমনিতেই চিত্র ভাই নিখোঁজ তারওপর এখন বড় ভাইজানের এক্সিডেন্ট! বাড়ি তো পুরো মৃ’ত্যুপুরী হয়ে উঠতেছে। মানুষগুলো উপরে উপরে বেঁচে থেকেও প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে মা*রা যাচ্ছে!’
চৈত্রিকা কোনো উত্তর দেয় না। সে নিজেই তো চায় জমিদার বাড়ির সাথে এমনই হোক। তবুও মন শান্তি পাচ্ছে না। অনেকটা সময় হলরুমে কান্নাকাটির ধুম থাকে। চৈত্রিকা কোনো টু শব্দও করেনি। চুপচাপ বসেছিলো। সবার ধারণা মেয়েটা স্বামীর শোকে ওমন হয়ে গেছে। বেশ অনেকটা রাতে যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। নীরা রাতে চৈত্রিকার কাছে ঘুমাতে চাইলে চৈত্রিকা না করে দেয়। নিজের ঘরের দরজা আটকে চুপচাপ বিছানার ওপর বসে থাকে। মনের মাঝে কিছুতেই শান্তি নামক জিনিসটার দেখা মেলে না। রাত এভাবেই গভীর হয়৷ বাহিরে ঝড়, বাতাস, বৃষ্টি বাড়ে৷ চৈত্রিকার ঘরের দরজায় কড়া পড়ে। ঘোরে ডুবে যাওয়া চৈত্রিকা দরজার কাছাকাছি গেলে শুনতে পায় প্রহরের কন্ঠ। চৈত্রিকা প্রহরের কন্ঠ শুনেই ভুলে বসে সব। প্রহর যে শহরের হাসপাতালে রয়েছে তা তার মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়। বোকার মতো দরজা খুলতেই দেখতে পায় সামনে দাঁড়ানো পিয়াসকে।
চলবে..
#চৈত্রিকা (২৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
সামনে পিয়াসকে দেখে সব রকম ঘোর কেটে যায় চৈত্রিকার। পিয়াসের মুখে তখন শ’য়’তানী হাসি। চৈত্রিকা কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলেও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। মনের পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় মনে তেমন জোড় আসে না। তবুও দমে না। গলা কোনো রকম না কাঁপিয়ে বেশ জোড়ালো কন্ঠে বলে,
‘কি সমস্যা? এখানে কি করছেন?’
পিয়াস কু’টিল হাসি হাসে। চৈত্রিকার দিকে দুপা এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ‘আপনাকে দেখতে আসলাম ভাবীজান৷ আমি তো ভেবেছিলাম ভাইজানের শোকে বোধহয় আপনার হাল খারাপ! তা এখন তো দেখছি আপনি দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
চৈত্রিকা আপনা আপনিই পিছিয়ে যায়। দরজা শক্ত করে ধরে বলে, ‘দেখা হয়ে গেছে? এখন যান!’
পিয়াস যায় না৷ চৈত্রিকা দরজা আটকাতে নিলে হাত দিয়ে আটকে দেয়। চৈত্রিকা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নেয়। হুট করেই উষ্ণ ঠান্ডা হাত উদরে ঠেকে। চমকে ওঠে চৈত্রিকা। চট করে সরে যায়। রাগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুহুর্তেই সব ভয়, পরিস্থিতি মন থেকে উধাও হয়ে যায়। বাহিরে বৃষ্টি কমে গেছে। তবে বাতাস আছেই৷ বাহিরের বাতাস এসে সরাসরি চৈত্রিকার গায়ে লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। বাতাসে থেকে থেকে চৈত্রিকার শাড়ির আঁচলও নড়ে উঠছে। চৈত্রিকা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। পিয়াসের দৃষ্টি তখন চৈত্রিকার দিকে। যে দৃষ্টিতে চৈত্রিকার গা গুলিয়ে ওঠে। চৈত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে বলে,
‘এক্ষুণি এখান থেকে বের হোন! নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’
‘কেনো ভাবীজান? কি করবেন?’
চৈত্রিকা কোনো জবাব দেয় না। পিয়াস এগিয়ে এসে দাঁড়ায় চৈত্রিকার কাছাকাছি। এবার ভয় পেয়ে সরে যায় না চৈত্রিকা। ঠায় দাঁড়িয়ে রয় নিজের জায়গায়। দৃষ্টি একদম পিয়াস রেনওয়াজের দৃষ্টিতে। পিয়াস এগিয়ে এসে বাঁকা হেঁসে বলে,
‘ভাবলাম বড় ভাইজান তো হাসপাতালে! ভাবীজানকে সঙ্গ দেওয়ার মতো তো কেউ নেই। তাই চলে আসলাম আপনাকে সঙ্গ দিতে। ভালো করেছি না?’
চৈত্রিকা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। পিয়াস দূরত্ব মেটাতে আরো এক পা এগোয়। পিয়াস ভেবেছিলো হয়তো চৈত্রিকা এই রাতের আঁধারে তাকে ভয় পাবে। কিন্তু চৈত্রিকার মতো নারীকে ভীতু ভাবাটাই তার জীবনের চরম ভুল। পিয়াস বেখেয়ালি ভাবে এগিয়ে আসতে নিলেই চৈত্রিকা হুট করেই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয়। পিয়াস তাল সামলাতে না পেরে দু পা পেছোতেই চৈত্রিকা পেছন থেকে ফুলদানি নিয়ে হুট করেই পিয়াসের মাথায় বা’রি মা’রে। চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মাথায় বেশ জোড়ে সোড়ে ব্যাথা পেলেও জ্ঞান হারায় না পিয়াস। কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কই যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে র’ক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় চৈত্রিকার যাওয়ার দিকে। চৈত্রিকা কোনে দিকে না তাকিয়ে ছুটে যায় হল রুমের দিকে। পিয়াসের মনে তখন জিদ জেগে গেছে। চৈত্রিকা তাকে আ’ঘাত করেছে বিষয়টা সে ভালো ভাবে নিতে পারে না। ধুপধাপ পা ফেলে নিজেও ছুটে আসে চৈত্রিকার দিকে। উপর থেকে দেখতে পাায় চৈত্রিকা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেছে। হঠাৎ করে চৈত্রিকাকে রান্নাঘরে যেতে দেখে মনে সন্দেহ জাগে পিয়াসের। তবুও পেছন পেছন যায়। পিয়াস রান্নাঘরে পৌঁছানোর আগেই চৈত্রিকা বের হয়ে আসে। পিয়াস তাকে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে বলে,
‘তোর অনেক দে*মাক তাই না! তোর এই দে*মাক, অ’হং’কার যদি আমি আজ না ভাঙতে পারি তবে…’
‘তবে কি?’
পিয়াস ক্ষো’ভ নিয়ে এগোতে নেয় চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা হুট করেই পেছনে রাখা হাত আনে সামনে। হাতে একটা বড় সড় ব’টি। হুট করে ব’টি সামনে চলে আসায় পিয়াস পিছিয়ে যায়। চৈত্রিকা নিজের তেজ ধরে রেখে বলে,
‘প্রহর রেনওয়াজ নেই মানে চৈত্রিকার তেজ নেই এটা যদি ভেবে থাকেন তবে আপনি ভুল পিয়াস রেনওয়াজ! আমি চৈত্রিকা। চৈত্রের উত্তপ্ত রোদ আমি। একসময় প্রহর রেনওয়াজ ছিলো না তখনও এই চৈত্রিকার তেজ ছিলো এখনো আছে। তাছাড়া প্রহর রেনওয়াজ আমার জন্য তেমন কেউ নাহ যে সে থাকা না থাকায় আমার সাহস, তেজ, কাঠিন্য কমে যাবে! আমাকে ছোঁয়ার সাহস করলে আমি এক কো’পে মাথা নামিয়ে নিতেও দুবার ভাববো না। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে আমি চিৎকার করলে আপনার বাড়ির কেউ শুনতে পাবে হয়তো তবে আমি করবো না চিৎকার। জানি এখানে আপনার মতো জা’নো’য়া’ররা আরো আছে। আমাকে দুর্বল ভাববেন না দেবর সাহেব। আমি নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের শা’স্তি নিজেই দিতে জানি। আর যদি আমাকে ছোঁয়ার বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করেন তবে আমি আপনার এই হাত কে’টে ফেলতেও দুবার ভাববো না।’
পিয়াস চৈত্রিকার এই রুপে হুট করেই যেনো চমকে যায়। যা ভেবেছিলো পুরোটাই তার বিপরীত। তবুও পিয়াস দমবে না। রাগে, জিদ্দে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোকে আমি দেখাচ্ছি!’
পিয়াস সত্যিই চৈত্রিকার কাছে এগিয়ে আসলে চৈত্রিকা ব’টি দিয়েই কো’প দেয়। কো’পটা গিয়ে লাগে সরাসরি পিয়াসের হাতে। পিয়াস ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। চৈত্রিকা রাগে ফুঁসছে। পিয়াস রক্তে মাখা হাত ধরে বসে পড়ে মেঝেতে। সে বুঝতেই পারেনি সত্যি সত্যিই চৈত্রিকা তাকে এভাবে মে’রে দিবে! চারপাশের বাতাস তখন প্রখর। বাড়ির খোলা এক জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে হু হু করে। সেই বাতাসে, হালকা আলোয় চৈত্রিকার রুদ্রাণী রুপ স্পষ্ট। চৈত্রিকা কন্ঠের কাঠিন্যতা ধরে রেখে বলে,
‘আমি দুর্বল নই। নারী মানেই দুর্বলতা নয়। নারীর এক বিশাল ব্যাখ্যা চৈত্রিকা। যার তেজ, সাহস কোনো কিছুরই কমতি নেই শুধুমাত্র দুর্বলতা ছাড়া।’
পিয়াস ফ্যালফ্যাল করে তাকায়৷ চৈত্রিকা হাতের ব’টি শক্ত করে ধরে রেখে দু পা এগিয়ে আসে। চোখ তখন লাল টকটকে হয়ে আছে। পিয়াসের চোখে চোখ রেখে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, সাবলীল ভাবে বলে,
‘সব নারীর সাথে অ’ন্যায় করে পার পাবি না। আমি জানি কিভাবে নিজের ওপর হওয়া অ’ন্যায়ের প্রতিকার করতে হয়! কিভাবে তোদের মতো জা’নো’য়া’রকে সোজা করতে হয়! লজ্জা থাকলে আর আজকের মা’র মনে থাকলে কখনো আমাকে ছোঁয়ার কথা চিন্তাও করবি না কিন্তু লজ্জা না থাকলে আমি লজ্জা এনে দেবো। আর রইলো বাকি প্রহর রেনওয়াজের কথা! মনে হয় না তোরা তার একটা চুলও বাঁকা করতে পারবি! কিরে নিজের ভাইরে চিনিস না? যাক! একটা কো’প আজ খেলি বাকিগুলো দিনে দিনে খাবি। কথা দিলাম।’
৭৪.
পরেরদিন সকালে কিছুই স্বাভাবিক হলো না। পিয়াসের কে’টে যাওয়া হাত দেখেই বাড়িতে একদফা ঝামেলা হয়ে গেলো। অন্যদিকে প্রহরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সকাল সকালই চয়ন রেনওয়াজ, শিমুল রেনওয়াজ আর সাদিক রেনওয়াজ শহরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। পল্লবী থম মে’রে গেছে। রাতে যতুটকু কান্না করছিলো সকালে ততটুকুই শান্ত হয়ে গেছে। পিয়াসের হাতের অবস্থা দেখে নীরা কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি। নিশ্চয় এটা কোনো অ’ন্যায়েরই শা’স্তি। অর্পিতা, অর্থি, নাসিমা, শায়লা, নীরা সবাই হল রুমে বসে আছে। সবার চিন্তা গিয়ে ঠেকে আছে প্রহর আর চিত্র। দুভাইয়ের সাথেই কেনো এমন হলো? চৈত্রিকা স্বাভাবিক। তার এতো স্বাভাবিক আচার আচরণ কারোর হজম হচ্ছে না। অর্পিতা আর নীরা দুজনে এগিয়ে যায় চৈত্রিকার কাছে। অর্পিতা উসখুস করতে করতে বলে,
‘বড় ভাবীজান!’
চৈত্রিকা মাথা তুলে তাকায়। অর্পিতা দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বলে, ‘ঠিক আছেন আপনি?’
চৈত্রিকার স্বাভাবিক জবাব, ‘হ্যাঁ ঠিকই তো আছি। কেনো অর্পিতা আপু?’
চৈত্রিকার খোলাখোলি স্বাভাবিক আচরণে যেমন চমকালো তেমনই অস্বস্তিও হলো৷ সেই অস্বস্তি ধরে রেখেই শুধায়, ‘বড় ভাইজানের তো কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না! তোমার টেনশন হচ্ছে না?’
‘নাহ তো। টেনশন কেনো করবো? আমি জানি উনি ঠিক আছে।’
চৈত্রিকার মুচকি হাসি আর আত্মবিশ্বাসে অর্পিতা অবাক না হয়ে পারে না। এতোটা বিশ্বাস কার প্রতি? নিজের প্রতি! প্রহরের প্রতি! নাকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি! সে তো চিত্র ভাইকে কতগুলো দিন থেকে চেনে, জানে, ভালোবাসে তবুও চিত্রর নিখোজের পর আজ পর্যন্ত সে এই আত্মবিশ্বাসটুকু আনতে পারেনি যে চিত্র ঠিক আছে। অথচ চৈত্রিকার কন্ঠে নেই ভয়, অস্বস্তি কিংবা অস্বাভাবিক কিছু। অর্পিতাকে কিছু ভাবতে দেখে পাশ থেকে নীরা বলে,
‘চৈত্রিকার মতো আমারও কিন্তু মনে হয় বড় ভাইজানের কিছু হয়নি। এতো সহজে হবেও না। বড় ভাইজান এতো সহজে কখনোই হার মানবে না।’
নীরার কথার মানে অর্পিতা না বুঝলেও চৈত্রিকা বোঝে। কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বসে রয়। অর্পিতার মনে প্রশ্ন জাগলেও আর জিজ্ঞেস করে না। চুপচাপ বসে থাকে। জমিদার বাড়ির সবার এ বসে থাকাটাই দুপুর পর্যন্ত চলে। দুপুরের পর দিয়ে বাড়িতে হাজির হয় প্রহরসহ দুজন লোক। তারাই প্রহরকে এনেছে। প্রহরের শুধু পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। প্রহরকে দেখেই বাড়িতে আরেক ধাপ কান্নাকাটি, চেঁচামেচির সৃষ্টি হয়। প্রহর কোনো শব্দ ছাড়াই সবটা দেখে গেলো। চৈত্রিকা হল রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর কয়েক পলক তার দিকে তাকিয়ে আর তাকায়নি। চৈত্রিকা ইতস্তত করছে। কি করবে, কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না। কান্নাকাটি শেষে লোক দুইটিই প্রহরকে ঘরে রেখে আসে। মূলত প্রহর পায়ে ব্যাথা পাওয়ায় পা ভে’ঙেছে। চৈত্রিকাও পিছু পিছু এসেছে। লোক দুজন চলে গেলে চৈত্রিকা ঘরে আসে। ঘরের দরজা হালকা করে ভিজিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে কাছে আসে। পুরো ঘরে তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ আর চৈত্রিকার পায়ের নুপুরের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। চৈত্রিকা প্রহরের সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রহর নিজেও চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে। কতটা সময় এভাবে কাটে তা বোধহয় দুজনের কেউই জানে না। একসময় চোখ বন্ধ অবস্থাতেই প্রহর বলে,
‘কিছু বলবে?’
চৈত্রিকা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে ফাঁকা ঢোক গিলে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কি বলবে সে? যার সাথে মনের দূরত্ব এতোখানি! আদৌও কি তাকে বলার মতো কিছু আছে চৈত্রিকার? চৈত্রিকাকে অনেকক্ষণ যাবত চুপ থাকতে দেখে প্রহর চোখের ওপর থেকে হাত সরায়। সরাসরি চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার কিছু হয়নি। কাল সামান্য একটু এক্সিডেন্টে শুধুমাত্র পা ভেঙেছে আর মাথায় একটুখানি লেগেছে। আর কোনো প্রশ্ন আছে তোমার?’
চৈত্রিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে কখন এসব কিছু জিজ্ঞেস করলো? সে তো এখন অব্দি একটা টু শব্দও করেনি। প্রহর তার ভাবনার মাঝেই ফের বলে,
‘কাল রাতে কি হয়েছে চৈত্রিকা?’
চৈত্রিকা যেনো আকাশ থেকে পড়ে। এতো বেশি অবাক হয় যে তার মুখই হা হয়ে যায়। মাথায় বার বার ঘুরপাক খায় একটাই কথা৷ ‘উনি কেমন করে জানলো কাল যে কিছু হয়েছে!’ এ প্রশ্নের উত্তর পায় না। প্রহরকেও মুখ ফুটে প্রশ্ন করে না। নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
‘কই! কিছু নাহ তো।’
প্রহর আর কিছু বলে না৷ চুপচাপ শুয়ে পড়ে। চৈত্রিকা বড় করে শ্বাস নিয়ে কোনোমতে বলে, ‘আপনি একটু বিশ্রাম নিন। আমি আসছি!’
চৈত্রিকা দ্রুত পায়ে পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। কোনো রকমে ঘর থেকে বের হতে নিলে পেছন থেকে প্রহরের শান্ত গলায় ভেসে আসে,
‘পিয়াসের হাতের ওই আ’ঘাত তুমি করেছো তাই না?’
৭৫.
নীরা হল রুমের সকল কাজ শেষ করে ঘরে এসে দেখে পিয়াস বিছানায় বসে আছে। নীরা দেখলেও তা আমলে নিলো না। নিজের মতো এলোমেলো ঘর গুছিয়ে নিতে শুরু করে। পিয়াস রাগী গলায় বলে,
‘আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছো কেনো?’
‘কিছু সময় কিছু কিছু প’শু পাখিকে এড়িয়ে চলতে হয়।’
পিয়াস ক্ষেপে ওঠে৷ নীরা ভাবলেশহীন ভাবে নিজের সমস্ত কাজ করছে। পিয়াস কিছু বলার আগেই নীরাই বলে,
‘আপনার হাতের এই ক্ষ’ত বড় ভাবীজান করেছে তাই না?’
পিয়াস জবাব দেয় না। নীরা ফের বলে, ‘এই বাড়ির কেউ জানুক বা জানুক আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি বড় ভাবীজানকে কেমন দৃষ্টিতে দেখেন।’
পিয়াস বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। নীরা তা খেয়াল না করেই তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে, ‘অবশ্য ঠিকই আছে। এসব লোকজনকে শুধু একটা হাতের আ’ঘাতে চলবে না। এদের মা’থা থেকে গ’লা আ’লাদা করে দিতে হয়। আর তা যদি হয় আপনার মতো জা’নো’য়া’র তাহলে তো বিনাবাক্যে!’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পিয়াস চেপে ধরে নীরাকে৷ সরাসরি টান দিয়ে পেছনে ঘুরিয়ে গলা চে’পে ধরে৷ ঘটনার আকস্মিকতায় নীরার দম আটকে আসে৷ পিয়াস রাগে বেশ জোড়ে চেপে ধরে থাকে৷ দাঁতে দাঁত চেপে যা তা ভাষা বলতে থাকে নীরাকে৷ নীরা কোনো রকম ধাক্কা দিয়েও যখন ছাড় পায় না তখন করে বসে এক সাহসী কান্ড। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করেই পা দিয়ে জোড়ে লা’থি মা’রে। পিয়াস সরে যায়। নীরা বড় বড় শ্বাস নিয়ে একটুখানি সরে যায়। নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে,
‘আমাকে মে’রে ফেললেও এই সত্যটা কিন্তু সত্যই থাকবে যে আপনি জা’নো’য়ার।’
পিয়াসের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে। হাতের কাছে থাকা ছোট্ট টব আর চেয়ার ঠাস করে ফেলে দেয়। কন্ঠে দ্বিগুণ ক্ষোভ রেখে বলে, ‘তোর গলার এতো জোড়! যে চৈত্রিকার জন্য তোর সাহস বেড়েছে সেই চৈত্রিকাকেই আমি নিঃশেষ করবো। করবোই।’
নীরা তাচ্ছিল্য করে হাসে। সে হাসির রেশ ধরে রেখেই বলে, ‘চৈত্রিকাকে নিঃশেষ করা, ভেঙে দেওয়া এতে সহজ না পিয়াস রেনওয়াজ। চৈত্রিকার দিকে যতবার তাকাবেন মনে হবে সূর্য এসে চোখে হানা দিচ্ছে।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)