#চৈত্রিকা (২৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
৭৬.
সারারাত চৈত্রিকার নির্ঘুমে কেটেছে। বলা বাহুল্য প্রহরের জন্যই তার ঘুম উড়ে গেছে। রাতে পায়ের ব্যাথায় প্রহরের জ্বর এসে গেছিলো যার জন্য চৈত্রিকা জেগে ছিলো৷ সারারাতই প্রহর ছটফট করে কাটিয়েছে। ভালো মতো নড়াচড়া করতেও পারেনি৷ জেগে থাকলে, হুশে থাকলে যে প্রহর কখনো টু শব্দ করে না সে প্রহর জ্বরের ঘোরে শুধু গোঙিয়েছে। চৈত্রিকা প্রহরের এ অবস্থা দেখে নিজের ভেতরের অস্থিরতা টের পেয়েছে। দোমনা হয়েও সারা রাত প্রহরের সেবা করে গেছে। পাশে বসে ছিলো। ভোর রাতের দিকে প্রহরের জ্বর হালকা হলেও চৈত্রিকা আর ঘুমায় নি। ফজরের নামাজ পড়ে ঘর থেকে বের হয়েছে। এতো সকালে কেউ ঘুম থেকে না উঠায় চৈত্রিকা নিজেই একজন সার্ভেন্টকে ডেকে এনে হাতে হাতে দ্রুত কিছু হালকা খাবার, চা বানিয়েছে। তারপর সেগুলো নিয়ে সরাসরি নিজেদের ঘরে এসেছে। চৈত্রিকা সেই সার্ভেন্টের সাহায্যেই সবটা আনে। প্রহর তখন গভীর ঘুমে। একবার আড়চোখে প্রহরের দিকে দেখে তাকিয়ে সব রাখে। সার্ভেন্টটা চৈত্রিকা আর প্রহরের দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। চৈত্রিকা খেয়াল করে ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে নিতেই মেয়েটি চলে যায় দ্রুত। চৈত্রিকা মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর ঘরের দরজা ভিরিয়ে এসে প্রহরের পাশে বসে। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে ইতস্তত মন নিয়েই প্রহরের গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাকে। কয়েকবার ডাকতেই প্রহর চোখ মেলে তাকায়। হুট করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা কিছুক্ষণ ঝিম মে’রে থাকে। চৈত্রিকা গলার স্বর নিচু করে বলে,
‘উঠুন! হালকা খাবার খেয়ে আগে ওষুধটা খান। আপনার জ্বর একবার যাচ্ছে আর আসতেছে। ওষুধ না খেলে তো কমবে না।’
প্রহর কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে প্রথমে নিজেকে স্বাভাবিক করে। তারপর শোয়া থেকে না উঠে অলস গলায় বলে, ‘ক’টা বাজে?’
চৈত্রিকা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বলে, ‘এইতো সাতটা প্রায়!’
প্রহরের চোখ গোল গোল হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চৈত্রিকাকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ভরাট কন্ঠে বলে, ‘এতো সকালে কে খায় চৈত্রিকা? তাছাড়া আমি এতো সকালে খেতে পারি না। এগুলো বসে বসে তুমি খাও!’
চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। কোনো কথা ছাড়াই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে খাবার নিয়ে এসে বিছানার ওপর রাখে। প্রহর কপাল কুঁচকে দেখতে থাকে চৈত্রিকার কান্ড। চৈত্রিকা প্রহরকে অবাক করে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
‘এই উঠুন! আমি আপনাকে উঠতে বলেছি না? এক্ষুণি উঠুন আর এগুলো শেষ করুন। ভালো মতো বলতেছি মানে এগুলো এক্ষুণি শেষ করুন।’
প্রহর ‘থ’। চৈত্রিকার ধমকে সে ভয় পেয়েছে কম অবাক হয়েছে বেশি। এই মেয়ে তাকে ধমকালো? অবাকতার রেশ ধরে অজান্তেই নিজের গায়ে নিজে চি’মটি কা’টে। সাথে সাথেই ‘আহ’ বলে মুখ কুঁচকে নেয়।চৈত্রিকার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি প্রহর রেনওয়াজকে ধমকাচ্ছো? তোমার সাহস বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে না চৈত্রিকা?’
‘মনে হওয়ার কি আছে জমিদার সাহেব? আমার তো সাহস বেড়েছেই এবার চুপচাপ উঠুন আর এগুলো খেয়ে ওষুধ খান।’
চৈত্রিকার স্বাভাবিক, সাবলীল উত্তরে প্রহর ভীষণ রকম অবাক হয়। তবুও নিজের মুখে কোনোরকম অবাকতা প্রকাশ না করে উঠার চেষ্টা করে। চৈত্রিকা নিজেই এগিয়ে যায়। প্রহরের পায়ের নিচের বালিশ ঠিকমতো দিয়ে তুলে বসায় প্রহরকে। চৈত্রিকা নিজ ইচ্ছায় প্রহরকে স্পর্শ করায় প্রহর অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। তবুও কোনো রকম কথা বলে না। চৈত্রিকা নিজেই বলে,
‘আগে তো ফ্রেশ হতে হবে! উঠুন।’
প্রহর বিনাবাক্যে চৈত্রিকাকে ধরেই বিছানা থেকে ওঠে। যদিও এমন ভারী একটা মানুষের ভার চৈত্রিকা রাখতে পারছিলো না তবুও সে কোনোরকম টু শব্দটিও করলো না। প্রহর নিজেও ভারটা কম দেওয়ার চেষ্টা করে। কোনো রকমে প্রহরকে গোসলখানায় নিয়ে আগে ব্রাশ করিয়ে নিজেই মুখ ধুইয়ে দেয়। প্রহর এতো বেশি অবাক যে তার মনে হচ্ছে যেকোনো সময় সে হার্ট অ্যাটাক করেই মা’রা যাবে। চৈত্রিকা প্রহরকে ফ্রেশ করিয়ে এনে বিছানায় বসায়। তারপর বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলে,
‘এতো মোটু কেনো আপনি? দেখলে তো এতো ওজন আছে মনে হয় না! আপনার ওজনে তো একদম আমি নিজেই কাত হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন থেকে কম কম খাবেন জমিদার সাহেব। ওজন কমাবেন।’
প্রহর কোনো কথা বলে না। মূলত তার মুখ থেকে কথাই হারিয়ে গেছে। যে চৈত্রিকা তার থেকে দুরে দুরে থাকতে পারলে বাঁচে সে চৈত্রিকাই নিজ থেকে তার কাছে থাকছে। যে চৈত্রিকাকে একটু স্পর্শ করলেই চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘আপনার স্পর্শ আমার একদম পছন্দ নই।’ সেই চৈত্রিকাই তাকে নিজ থেকে স্পর্শ করছে। এগুলো কি কখনো সম্ভব? সে নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছে নয়তো চৈত্রিকার মাথার দুয়েকটা তার ছি’ড়ে গেছে। প্রহরকে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চৈত্রিকা বলে,
‘তাকিয়ে আছেন কেনো? এবার কি খাবারটাও আমাকে খাইয়ে দিতে হবে নাকি জমিদার সাহেব?’
প্রহর চোখ ফিরিয়ে নেয়। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে আগে চা খাওয়া শুরু করে। চৈত্রিকা সামনে বসে তার খাওয়া দেখে। প্রহর চা শেষ করে খাবার একটু মুখে তোলে। খেতে খেতেই বলে,
‘আজ এতো আদর যত্ন কেনো? কখনো তো এতো ভালোবেসে কিছু করোনি৷ সকাল সকাল আমাকে খাওয়াচ্ছো, নিজ থেকে এতো কথা বলতেছো! প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেলে নাকি জমিদার গিন্নি!’
চৈত্রিকা মুখ বাঁকায়। বলে, ‘আপনার প্রেমে পড়ার চেয়ে আজীবন প্রেমহীন কাটানো ঢেড় ভালো। আর এতো যত্ন করে খাওয়াচ্ছি কি সাধে? সারারাত জ্বরে ঘুমাতে পারেননি। আর পাশে এমন অসুস্থ একটা লোক পড়ে থাকলে কি আমার ঘুম হবে? অসম্ভব। সারারাত বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি। এজন্যই সকাল সকাল উঠে খাবার বানিয়ে এনেছি যাতে খেয়ে ওষুধ খেয়ে একটু হলেও সুস্থ হোন। যত দ্রুত সুস্থ হবেন তত দ্রুত আমি শান্তি পাবো। আপনার সেবা করা লাগবে না আর না এতো কাছে থাকা লাগবে!’
প্রহরের খাওয়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রহর সরাসরি চৈত্রিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও চৈত্রিকা দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে। প্রহর শেষ বার খাবার মুখে নিয়ে ছোট্ট করে বলে,
‘দৃষ্টি না লুকিয়ে চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলে দাও, ‘আপনার অসুস্থতায় আমার অস্থিরতা বাড়ে জমিদার সাহেব!’
চৈত্রিকা চমকে তাকায়। প্রহর মুচকি হাসে। চৈত্রিকা হা করে তাকিয়ে থাকে। প্রহর কোনোমতে হালকা উচু হয়ে এক হাত চৈত্রিকার মাথার পেছনে রেখে ঠোঁট বাড়িয়ে কপালে চু’ম্বন করে। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ড্যাবড্যাব করে তাকায় প্রহরের দিকে। প্রহর হাত বাড়িয়ে বলে,
‘তোমার মুখের ‘জমিদার সাহেব’ শুনলে আমার হার্টবিট থেমে যায়। তোমার মুখের ‘জমিদার সাহেব’ শব্দ আমার ভেতর এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়। তোমার মুখের ‘জমিদার সাহেব’ শব্দ আমাকে এক মুহুর্তে এলোমেলো করে দেয় চৈত্র।’
৭৭.
আর মাত্র ১ মাস পর অর্থির পরীক্ষা। তার মধ্যেই বাড়ির এতো ঝামেলা। একে তো পড়ালেখায় ফাঁকি দেয় তারওপর এসব পরিস্থিতিতে কোনো ভাবেই পড়ালেখা হচ্ছে না। ছোট্ট অর্থি মাথায় চাপ নিয়ে ফেলছে বেশি। ইদানীং নিবিড় সকাল, বিকাল দুবেলায় পড়াতে আসছে। অর্থিও আগের মতো দুষ্টুমি করে না। চুপচাপ পড়া করে দেয়। নিবিড় বোঝে অর্থির দিকটা তবুও সে ভীষণ রকম মিস করে সেই চঞ্চল অর্থিকে। তবে মুখে কখনোই কিছু বলে না। আজও সকালে পড়াতে এসেছে নিবিড়। অর্থির মুখে সে কাল শুনেছিলো প্রহরের কথা। তাই আজ প্রথমে এসেই আগে শুধায়,
‘প্রহর ভাইয়ের খবর পেয়েছো অর্থি? আর চিত্র?’
অর্থি মন খারাপ করে বলে, ‘বড় ভাইজান বাড়িতে। এক্সিডেন্টে মাথায় আর পায়ে অনেক ব্যাথা পেয়েছে। চিত্র ভাইয়ের খোঁজ নেই এখনো।’
চিত্রর জন্য ভেতরে ভেতরে খুব খারাপ লাগে নিবিড়ের। ছেলেটার বয়স কেবল ২১ অথচ জীবনে এখনই বাবার বিশ্বা’সঘাত’কতার কবলে পড়েছে। নিজের ভুলে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে। এখন তো নিজেই হারিয়ে গেলো। নিবিড়ের অন্যমনষ্কতা দেখে অর্থি নিজেই বলে,
‘আজ কি পড়বো মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় পড়া দেখিয়ে দেয়। অর্থি পড়া শুরু করে। নিবিড় আমতা আমতা করে বলে, ‘তোমার তো অনেকদিন থেকে বাড়ি থেকে বের হওয়া হয় না! বাইরে যাবে?’
অর্থি চোখ তুলে তাকায়। নিবিড় চমকায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘না মানে তোমার তো সামনে এক্সাম! এখন একটু ফ্রেশ হাওয়া দরকার তোমার।’
অর্থি নির্জীব কন্ঠে বলে, ‘প্রয়োজন নেই মাষ্টারমশাই।’
নিবিড় দমে যায়। বার বার দৃষ্টি এদিক ওদিক করতে থাকে। তাকে দেখে বোঝা যায় কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না হয়তো। অর্থি নিবিড়ের অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করলেও কোনো রকম কথা বাড়ায় নাহ। অর্থির পড়া প্রায় শেষ দিকে তবুও নিবিড় তখনো হাসফাস করছে। অর্থি তখন ম্যাথ করছে। নিজের ম্যাথে মন দিয়েই বলে,
‘কিছু বলবেন মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘তোমার এমন চুপচাপ স্বভাব ভালো লাগে না অর্থি।’
অর্থি কিছু বলে না। নিবিড়ও আর কিছু বলার সাহস পায় না। পড়া শেষে নিবিড় বের হওয়ার সময় অর্থি ছোট করে বলে, ‘যার প্রাণ ছটফট করতে করতে বেঁচে আছে তার পক্ষে কি চঞ্চল হওয়া সহজ মাষ্টারমশাই?’
নিবিড় শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। অর্থি নিস্তেজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিবিড় সহজ, স্বাভাবিক কন্ঠে বলে, ‘সেই ছটফট করা প্রাণকে আমি স্বযত্নে আগলে রেখে নতুন করে হাতে হাত রেখে আজীবন বাঁচতে চাই। সেই দায়িত্বটুকু কি আমায় দেবে অর্থি?’
বোকা অর্থি ড্যাবড্যাব করে তাকায়। নিবিড়ের ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলা কথাগুলো যে সে বোঝেনি তা দেখে নিবিড় হাসে। দরজার কাছে যেতে যেতে বলে,
‘জমিদারের মেয়ের দিকে তাকানো বারণ। আমি সেই বারণের নিয়ম ভেঙে জমিদারের মেয়ের প্রণয়ে বাঁধা পড়েছি। এবার যদি জমিদারের কন্যাটি আমাকে একটু ভালোবেসে উদ্ধার করতো তবে জীবন বুঝি স্বার্থক হতো!’
নিবিড় দাঁড়ালো না৷ পেছন ফিরে দেখলেও না বোকা অর্থির বিস্মিত চেহারা।
৭৮.
দুপুরের পর বাঁধে আরেক কান্ড। প্রহর গোসল করবে কিন্তু চৈত্রিকা নিষেধ করেছে। প্রহর কতক্ষণ চৈত্রিকার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিলো। তাতে অবশ্য বিশেষ পাত্তা দেয় না চৈত্রিকা। উল্টো ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
‘চোখে রাঙিয়ে লাভ নেই৷ আমি ভয় পাই না আপনাকে। তাছাড়া এখন আপনি যায় ই করেন না কেনো! সাহায্য কিন্তু লাগবে আমারই তাই চোখ রাঙিয়ে শুধু শুধু চোখকে কষ্ট দিয়েন না।’
প্রহর কি বলবে খুঁজে পায় না। আজ মেয়েটা একটু বেশিই কথা বলছে না! হ্যাঁ আসলেই। হয়েছেটা কি চৈত্রিকার? প্রহরকে বসিয়ে রেখে চৈত্রিকা নিজেই গোসল সেড়ে আসে। তারপর নিচে যায় খাবার আনতে। পল্লবী চৈত্রিকাকে নামতে দেখে ব্যস্ত গলায় বলে,
‘প্রহর কোথায় বড় বউ?’
‘উনি ঘরে আম্মা।’
‘গোসল কি করছে? ভাঙা পা নিয়ে কেমনে!’
‘নাহ আম্মা। এই ভাঙা পায়ে গোসল করানোর দরকার নেই। এমনিতেই রাত থেকে উনার জ্বর। তারওপর বাহিরের আবহাওয়া আজও তেমন একটা ভালো না।’
‘আচ্ছা তাহলে দরকার নাই। তুমি বরং ছেলেটার গা একটু মুছে দিও! ওর ভালো লাগবে শরীর।’
চৈত্রিকা চমকায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে ইতস্তত কন্ঠে বলে, ‘আমি?’
‘হ্যাঁ। তুমি! তুমি তো ওর বউ। তাহলে সমস্যা কোথায়?’
চৈত্রিকা কিছু বলে না। পল্লবীর কথায় মাথা নাড়িয়ে খাবার নিয়ে চিন্তিত মনে ফিরে ঘরে আসে। খাবার টেবিলের ওপর রেখে নিচু গলায় বলে,
‘আম্মা বললো আপনার গা মুছিয়ে দিতে! নিজে পারবেন না?’
প্রহর কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে বলে, ‘আমি পারবো কেমনে? আমি যে অসুস্থ দেখো না তুমি? আম্মাজান তো তোমাকে বলেছে তাই না!’
চৈত্রিকা কটমট করে তাকায়। কিছু না বলেই গোসলখানায় ঢুকে তোয়ালে ভিজিয়ে আনে। সাথে বালতিতে করে অল্প একটু পানিও আনে। প্রহরের সামনে এসে হাসফাস করতে থাকে। প্রহর মুখটা গম্ভীর করে থাকলেও ভেতরে ভেতরে মজা নেয় বেশ। চৈত্রিকাকে তাড়া দিয়ে বলে,
‘শুধু দাড়িয়ে থাকবে নাকি নিজের কাজও করবে? আমার তো ক্ষুধা লেগে গেছে নাকি!’
চৈত্রিকা কটমট করে তাকিয়ে মনে মনে বিশাল বকা দেয় প্রহরকে। তারপর ইতস্তত মন নিয়েই হাত বাড়ায় প্রহরের টি-শার্টের দিকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘পা ভে’ঙেছে কিন্তু হাত তো ঠিক আছে! তাও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য এখন ঢঙ করতেছে। এই মা ছেলের কাহিনি আমি বুঝিনা বাপু! কি যে পায় আমারে জ্বালাইয়া!’
প্রহর পুরোটাই শোনে। ঠোঁট চেপে হাসে। চৈত্রিকা যে হাতে তার টি-শার্ট ধরেছিলো সে হাতের ওপরই হাত রাখে। চৈত্রিকা অন্যমনষ্ক আর অস্বস্তিতে ছিলো বলে হুট করেই চমকে ওঠে। প্রহর মুখ এগিয়ে আনে চৈত্রিকার কানের কাছে। ফিসফিস করে বলে,
‘তোমার লজ্জায় রাঙা মুখের দিকে তাকালে আমার ছন্দরাও লজ্জা পেয়ে যায় বউ।’
চৈত্রিকা অবাক হয়। সে কি লজ্জা পেয়েছে? কখন পেলো? প্রহরের থেকে সামান্য সরে পাশে তাকাতেই চোখ পড়ে আয়নার দিকে। সেখানে নিজের প্রতিবিম্বর দিকে তাকিয়ে নিজেই যেনো অবাক হয়। তার চোখ, মুখ, গালে লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। অস্বস্তি কখন লজ্জায় গিয়ে ঠেকেছে তা বোধহয় টেরই পায়নি মেয়েটা। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি লাজুকলতার মতো নুইয়ে পড়ে। মনে মনে নিজেই ভাবে,
‘চৈত্রিকা কবে থেকে জমিদার সাহেবের কাছে আসলে লজ্জা পেতে শুরু করেছে!’
চলবে..
#চৈত্রিকা (২৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
(নোট পড়বেন)
৭৯.
ক’দিন কেটেছে মাঝে। প্রহরের পা এখন আগের থেকে বেশ ভালো। নিজে নিজেই অল্প স্বল্প হাঁটতে পারে। এ ক’দিন পুরোপুরি চৈত্রিকার ওপর নির্ভর করে থেকেছে৷ চৈত্রিকাই সকালে ফ্রেশ হওয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত পাশে থেকেছে। নিজেদের অজান্তেই মেতে উঠেছে খুনশুটিতে। দুজনের মাঝের দূরত্ব যে কিছুটা হলেও কমেছে তা খুব ভালো ভাবেই বোঝা যায়। এ ক’দিন ঘরে বসেও চিত্রকে খোঁজার কোনো রকম প্রচেষ্টা বাদ দেয়নি প্রহর। তবে ফলাফল বরাবরই শূণ্য। প্রহর হাল ছাড়েনি। প্রতিদিনের মতোই প্রহরকে ঘুম থেকে উঠায় চৈত্রিকা। আকাশের অবস্থা আজও খুব খারাপ। যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টিরা এসে হানা দেবে। তবে আজকের আবহাওয়া বেশ ভালোই লাগছে চৈত্রিকার। বৃষ্টির জন্য আলাদা রকম প্ল্যান করাও তার শেষ। প্রহর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে চৈত্রিকা বিছানায় বসে পা দুলাচ্ছে। মন মেজাজটাও যে বেশ ফুরফুরে তা বুঝতে আর বাকি নেই। চৈত্রিকার অজান্তেই মুচকি হাসে প্রহর। তারপর মুখটা গম্ভীর করে চৈত্রিকার সামনা সামনি দাঁড়ায়। ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে বলে,
‘ব্যাপার কি! মন মেজাজ এতো ফুরফুরে কেনো? দেখে মনে হচ্ছে নতুন প্রেমে পড়েছো!’
চৈত্রিকা ভেংচি কেটে নিজের জায়গা থেকে উঠে পড়ে। বলে, ‘প্রেম ট্রেম চৈত্রিকার জন্য না। আজকের আবহাওয়া দেখেছেন! যখন তখন বৃষ্টি আসতে পারে। আর আজ আমি বৃষ্টিতে ভিজবো। শুধু আমি না! অর্থি, নীরা আপু, অর্পিতা আপু আমরা সবাই।’
প্রহর কিছু বলে না। হাত বগলদাবা করে চৈত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চৈত্রিকা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কি!’ প্রহর জবাব দেয় না। চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার চোখের দিকে। চৈত্রিকা চোখ নামিয়ে দিয়ে প্রহরের সামনে থেকে সরে আসে। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে বলে,
‘নিচে চলেন! আম্মাজান ডাকে খাওয়ার জন্য।’
প্রহর ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে। চৈত্রিকা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘ওহ হ্যাঁ! অর্পিতা আপু আর অর্থিকে আবার ভুল বুঝবেন না। ওরা চিত্র ভাইকে নিয়ে খুবই চিন্তায় আর অন্যমনষ্ক থাকে। অনেক কষ্টে আজ ওদের ছাঁদে বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছি।’
‘সমস্যা নেই। ওরা তো ছোট। এতো টেনশন নিলে কবে আবার মানসিক রোগী হয়ে যাবে তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে!’
চৈত্রিকা ঠোঁট চেপে হাসে। পেছনে ঘুরে প্রহরের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। পা উচু করে প্রহরের কানের কাছে মুখ নেওয়ার চেষ্টা করে ছোট্ট করে বলে, ‘ধন্যবাদ জমিদার সাহেব।’
চৈত্রিকা ছুটে ঘর থেকে বের হয়। প্রহর সেদিকে তাকিয়ে হাসে। মেয়েটা তার সাথে মিশে যাচ্ছে দিন দিন। মাঝে মাঝে তার অবাকতার শেষ থাকে না। মানুষ এমনও হয়! চৈত্রিকার হঠাৎ এভাবে বদলে যাওয়ার কারণ চারপাশ হাতড়েও খুঁজে পায় না প্রহর। তার বিশ্বাস আছে চৈত্রিকার ওপর। চৈত্রিকা কখনোই তাকে ঠ’কাবে না। চৈত্রিকা পেছন থেকে আ’ঘাত করার মতো মেয়ে নয়। প্রহর হাজারটা চিন্তা ভাবনা করে যখন এগোচ্ছিলো তখন নিজেদের ঘরের মেঝেতে একটা কাগজের টুকরো পায়। প্রহর ভ্রু কুঁচকে তা হাতে তুলে নেয়। কাগজটা তখন চৈত্রিকার আঁচল থেকে পড়েছিলো। প্রহর হাসি হাসি মুখেই কাগজটা মেলে ধরে। কাগজে থাকা দু লাইনের বাক্যই যথেষ্ট ছিলো প্রহরের মুখের হাসি মিলিয়ে দেওয়ার জন্য। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চোখে মুখে গম্ভীরতার এক অদ্ভুত আবরণ সৃষ্টি হয়। চোখ দুটো মুহুর্তেই লাল টকটকে হয়ে যায়। রাগে কাগজটা মুড়িয়ে ফেলে দিতে নিয়েও আবার সুন্দর করে মেলে ধরে। কাগজে বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট করে লিখা,
‘অনেক তো স্বামীর প্রতি দুর্বলতার নাটক করলে, এবার আসল কাজ করো! নাকি প্রহর রেনওয়াজের সাথে ভালোবাসার নাটক করতে করতে তাকে সত্যিই নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছো! আমি জানি তুমি নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়ার মতো মেয়ে নও। তাই এক এক করে জমিদার বাড়ির সদস্যদের মা’রার প্রস্তুতি নাও।’
প্রহর আলগোছে কাগজটা ভাজ করে নিজের পকেটে রেখে দেয়। চৈত্রিকার ওপর এক আকাশ সমান রাগ নিয়ে এগিয়ে যায়। তবে মুখে টু শব্দটিও করে না।
৮০.
সকাল পেড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় কিন্তু বৃষ্টির দেখা আর পাওয়া যায় না। আকাশে মেঘলা ভাবটা থাকলেও মেঘেরা বৃষ্টির ফোটা হয়ে ঝড়ে পড়ছে না। এ নিয়ে চৈত্রিকার আফসোসের শেষ নেই।, অর্পিতা, অর্থি আর নীরা গোসল করে ফেললেও চৈত্রিকা বৃষ্টির আশাতেই আছে। যেনো বৃষ্টি না আসলে আজ আর সে গোসলই করবে না। বার বার গাল ফুলিয়ে ঘরে আসছে নয়তো ব্যালকনিতে যাচ্ছে। প্রহর গম্ভীর মুখ নিয়ে বিছানায় বসে বসে শুধু দেখে গেছে। মূলত চৈত্রিকার ভেতর বাহিরটা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছে। চৈত্রিকা মিনিটে ২ বার ঘরে আসে আর ব্যালকনিতে যায়। যতবারই ঘরে আসে বাচ্চাদের মতো মুখ করে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘বৃষ্টি আসছে না কেনো জমিদার সাহেব? বৃষ্টি কখন আসবে?’
প্রহর একবারও জবাব দেয়নি। এজন্যই আরো বেশি বিরক্ত চৈত্রিকা। লোকটা কি কথা বলতে পারে না? সামান্য একটা প্রশ্নই তো করছে তবুও তার জবাব দেওয়ার নামমাত্র নেই! এতো গম্ভীর হয়ে থাকতে হবে কেনো? সময় কাটতে কাটতে প্রায় ২ ঘন্টা চলে যায়। তবুও বৃষ্টিও আসে না চৈত্রিকা নিজের জায়গা ছেড়ে নড়েও নাহ। প্রহর নিজেও পুরোটা সময় বিছানায় বসেই কাটিয়েছে। শেষ মুহুর্তে হুট করেই যখন আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হয় আর বাতাস ধেয়ে আসে তখন খুশিতে চৈত্রিকা লাফিয়ে ওঠে। ব্যালকনি থেকে ছুটে এসে প্রহরকে বলে,
‘বৃষ্টি আসার সময় হয়ে গেছে জমিদার সাহেব। যাবেন নাকি ভিজতে? আমি কিন্তু যাচ্ছি!’
চৈত্রিকা ঘুরে যেতে নিলে হাত টেনে ধরে প্রহর। চৈত্রিকা পেছনে ফিরে তাকায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেই ভ্রু নাঁচায়। প্রহর কোনো কথা ছাড়াই চৈত্রিকাকে টেনে নিজের বুকে আনে। ঘটনার আকস্মিকতায় বেশ অবাক হয় চৈত্রিকা। প্রহর হুট করেই চৈত্রিকার সাথে গভীর হয়। হাতের ছোঁয়া ভীষণ দৃঢ় করে। অথচ মুখভঙ্গী স্বাভাবিক করে রেখেছে। প্রহরের কোনো কথা বার্তা ছাড়া এমন ব্যবহারে এতো বেশি চমকায় যে চোখ মুখে তা স্পষ্ট ফুটে ওঠে। চোখে মুখে অস্বস্তির রেখা মিলে। কোনো রকমে বলে,
‘কি করছেন জমিদার সাহেব? হঠাৎ এমন করছেন কেনো? ছাড়ুন!’
প্রহর ছাড়ে না।৷ দূরত্ব মিটিয়ে নিয়ে মুখটা কাছাকাছি আনে। চৈত্রিকা দু হাতে প্রহরের বুকে ধাক্কা দেয়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলে, ‘দেখেন প্লিজ ছাড়েন! আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’
প্রহর আর এগোয় না। ছেড়ে দেয় চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা ছাড়া পেয়েই কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড় লাগায়। ততক্ষণে বাহিরে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। চৈত্রিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে প্রহর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। ঘন ঘন শ্বাস ত্যাগ করে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘কাজটা তুমি মোটেও ভালো করোনি চৈত্রিকা। প্রহর রেনওয়াজের সাথে বিশ্বা’সঘা’তক’তার পরিণাম ভ’য়ং’কর। তুমি ভালোবাসার অভিনয় করতে পারলে আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করিয়ে একটু একটু করে নিঃশেষ করতেও পারি।’
চৈত্রিকা সরাসরি ছাঁদে চলে আসে। বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে। প্রহরের ব্যবহারে সে বেশ সন্দিহান। হঠাৎ করে এমন করার কোনো কারণ চৈত্রিকা খুঁজে পেলো না। বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়ার এতক্ষণের আনন্দ কোথায় যেনো উবে গেলো৷ ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়েও চিন্তায় ডুবে যায় চৈত্রিকা। বৃষ্টির ফোঁটা রা তাকে ছুয়ে যাচ্ছে গভীরভাবে।
৮১.
বাহিরে বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই নিবিড় এসেছে অর্থিকে পড়াতে। ইদানীং অর্থির নিবিড়কে দেখলে ভারী লজ্জা লাগে। নিবিড় যদিও বোঝে অর্থির লজ্জা পাওয়াটা। বাহিরে বৃষ্টি, সামনে নিবিড় এবং পড়ালেখা। অর্থির মন বার বার বৃষ্টির দিকে চলে যাচ্ছিলো। পা দিয়ে মেঝেতে নখ খুঁটতে খুঁটতে দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। নিবিড় অর্থির মুখ ভঙ্গি দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো সমস্যা অর্থি?’
অর্থি প্রথমে চমকে মাথা দুদিকে নাড়লেও পরে মুখটা কাঁদো কাঁদো করে মাথা উপরনীচ নাড়ে। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কি হয়েছে?’
অর্থি আঙুল দিয়ে বাহিরে ঈশারা করে মাথা নিচু করে নেয়। ছোট্ট করে বলে, ‘বৃষ্টিগুলো আমার সমস্যা মাষ্টারমশাই।’
‘বৃষ্টি আবার তোমার সমস্যা হয় কেমনে? তোমার পড়া এটা আর তুমি সমস্যা দেখাও বৃষ্টিতে! পা’গল টাগল হলে নাকি?’
অর্থি ফুঁসে ওঠে। নাক ফুলিয়ে বলে, ‘আমি মোটেও পা’গল হইনি। তাছাড়া আমি কি পড়া শুরু করেছি যে সমস্যা বইয়ে পাবো!’
‘এতক্ষণ থেকে কি করছো তবে?’
‘কেনো! বৃষ্টির শব্দ শুনছি।’
অর্থি দাঁত কেলিয়ে হাসে। নিবিড় কপাল চাপড়ায়। অর্থি মুখটা আবারও কাঁদো কাঁদো করে বলে, ‘আজ আমি উঠে যাই মাষ্টারমশাই? বৃষ্টির শব্দ শুনে ভীষণ ভিজতে ইচ্ছা করছে।’
‘পরে ভিজো! এখন পড়ো।’
‘পরে কি বৃষ্টি থাকবে নাকি!’
‘না থাকলে ভিজবে না।’
অর্থি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে রাখে৷ অনেকটা সময় প্যান প্যান ঘ্যান ঘ্যান করার পর নিবিড় অনুমতি দেয়। পড়ানো বাদ দিয়ে চেয়ার টেনে একটু দুরে বসে। অর্থি খুশিতে নিবিড়কে ঘরে রেখেই দৌড় লাগায়। নিবিড় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। দ্বিধাদন্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্থির যাওয়ার দিকে। অর্থি ততক্ষণে চোখের আড়াল হয়ে গেছে। সাহস নিয়ে নিবিড় নিজেও পিছু পিছু উঠে যায়। অর্থি ছাঁদে এসে চৈত্রিকাকে একা একা দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখে। ছুটে এসে চৈত্রিকাকে ধরে৷ চৈত্রিকা চমকায়। অর্থি খুশিতে চেঁচিয়ে বলে,
‘একা একা ভিজেন কেন বড় ভাবীজান? আমাকে ডাকলেন না কেনো?’
চৈত্রিকা সব চিন্তা ভাবনা ভুলে যায়। মুহুর্তেই বৃষ্টিতে মেতে ওঠে অর্থির সাথে। পেছনে আসা নিবিড় বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা দুটি রমনীকেই দেখে। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেও সরে যায়। সরাসরি জমিদার বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজেও বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে৷ দুরে ভিজতে থাকা ছোট্ট অর্থিকে দেখে হৃদপিন্ডের গতি বাড়ে। তবুও অপলক চেয়ে রয় অর্থির হাসি খুশি মুখটার দিকে। এই চেয়ে থাকাতে নেই কোনো চা’হিদা, লা’লসা। যা আছে পুরোটাই মুগ্ধতা। এক কিশোরীর মিষ্টি হাসির প্রতি মুগ্ধতা।
বেশ অনেকটা সময় পর চৈত্রিকাকে খুঁজতে আসে প্রহর। ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে লাফাতে থাকা চৈত্রিকা আর অর্থিকে দেখে ছাঁদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দুজনের লাফালাফি দেখতে থাকে মন দিয়ে। মুখে জমা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটায় চৈত্রিকার সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়েছে। প্রহর কিছুক্ষণ সে মুখের সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘তুমি ভালোবাসা নও, তুমি ধোঁয়াশা। তুমি বাস্তব নও, কল্পনা চৈত্রিকা।’
বৃষ্টি খানিকটা হালকা হতেই বেশ জোড়ে সোড়ে কিছু পড়ার শব্দ হয়। চৈত্রিকা, অর্থি নিজেরা থেমে গিয়ে ছাঁদের রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়। প্রহর নিজেও আসে দেখতে। কিন্তু ৩ জনই নিচে চোখ রেখে অবাক হয়ে যায়। জমিদার বাড়ির সামনে কাঁদায় মাখামাখি একজন মানুষ পড়ে আছে। অর্থি এ ঘটনায় বেশ ভয় পেলেও প্রহর আর চৈত্রিকা ছুটে যায়। নিবিড়ও দুর থেকে ছুটে আসে। জমিদার বাড়ির পাহারাদাররা তখন বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচার জন্য অন্য জায়গায় বসে ছিলো। প্রহর, চৈত্রিকা, নিবিড়, অর্থি সরাসরি মানুষটির কাছে আসে। বৃষ্টির ফোঁটারা তখনও আছেই। প্রহর জোড়ে জোড়ে দুজন পাহারাদারকে ডেকে পানি আনায়। এক বোতল পানি লোকটার মুখে দিতেই মুখটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আঁতকে ওঠে সবাই। অর্থি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। প্রহর দু পা পিছিয়ে যায়। চৈত্রিকা দ্রুত অর্থিকে আগলে নেয়। প্রহর আর অর্থির অবস্থা দেখে নিবিড় নিজেই চিত্রের পালস রেট চেক করে। বাহিরের চেচামেচিতে জমিদার বাড়ির সকলেই বের হয়ে আসে। চিত্রকে ওমন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে বাড়িতে কান্নার ধুম পড়ে যায়।
চলবে..