#চৈত্রিকা (৩২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
(নোট পড়বেন।)
প্রহরের কথার পিঠে আর কেউ কথা বলে না। চুপ থাকে। ভেতরে ভেতরে ফুসলেও প্রহরের মুখের ওপর কেউ কিছুই বলতে পারে না। প্রহর শান্ত দৃষ্টিতে সবার মুখ দেখে নিঃশব্দে হাসে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে,
‘যেহেতু বাড়ির বড় বউকে আপনারা অ’ন্যায় ভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ছেন তাই ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও আপনাদের।’
‘প্রহর!’
চয়নের চোখ রাঙানিতে বিন্দু পরিমাণ ধ্যান না দিয়ে প্রহর নিজ জায়গা থেকে উঠতে উঠতে বলে, ‘ভুল কিছু বলিনি আব্বাজান। চৈত্রিকা কোনো ভুল না করেও এ বাড়ি থেকে মাথায় মিথ্যা অ’পবাদ নিয়ে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তাই তাকে দেওয়া সকল অ’পবাদ সরিয়ে আপনারা নিজ দায়িত্বে ওকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনবেন।’
ছেলের কথায় চয়ন ফুঁসে উঠলেও নিজেকে শান্ত রাখে। তার নিজের ছেলে তাকে কথা শোনাচ্ছে এটা সে মানতে পারছে না। অথচ সে জানে তার বড় ছেলে এমনই। রক্তের টানের চেয়েও তার কাছে ন্যায় অ’ন্যায়টা বড় বেশি। তার বড় ছেলের হৃদয় যে পাথরে পরিণত হয়েছে এটা কি সে আগে থেকে জানতো না! জানতো। নিজের চোখের সামনেই তো দেখেছিলো ছেলেকে পাথর তৈরী হতে। তখন ভেবেছিলো ‘জমিদারের বংশের ছেলেদের এমনই হতে হবে। প্রহর যেহেতু পরবর্তীতে জমিদার হবে তাই তাকে থাকতে হবে শক্ত। জমিদারদের দয়া মায়া থাকতে নেই। হতে হবে পা’ষাণ। একদম পা’ষাণ।’ সেই পা’ষাণতার কবলে যে তারাও পড়তে পারে হয়তো তা ভেবে দেখেনি। প্রহর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ উঠে সিড়ির দিকে গিয়ে আরো একবার ফিরে তাকায় পেছনে। পল্লবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আম্মাজান! আপনি বাড়িতে থাকেন। চিত্র, অর্থি একা আছে! আর যে যে যাবে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আসো।’
সবাই মাথা নাড়ায়। দুরে কোণায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সাথীকে দেখে প্রহর ভ্রু কুঁচকায়। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি যাবে সাথী? মামী তো মনে হয় না তোমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে!’
সাথী মাথা নিচু করেই থাকে। প্রহর বুঝতে পেরে ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা তাহলে তুমি, মেজো কাকিমা আর আম্মাজান বাড়িতে থাকো। অর্পি, নীরা যাবে তো?’
দুজনেই মাথা নাড়ায়। প্রহর উল্টো ঘুরে চলে যেতে যেতে জোড়েই বলে, ‘আব্বাজান, ছোট কাকা, ছোট কাকি আর পিয়াস সবাই কিন্তু অবশ্যই যাবেন। তাই দেড়ী না করে তৈরী হয়ে আসেন। আর হ্যাঁ! আব্বাজান, ছোট কাকা, ছোট কাকি অবশ্যই কিন্তু নিজেদের অ’ন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবেন। আশা করি এতে কারোর সমস্যা হবে না। আব্বাজানই তো শিক্ষা দিয়েছেন! ভুল ভুলই হয়। অ’ন্যায় অ’ন্যায়ই হয়! আর ক্ষমা ক্ষমা ই হয়! অ’ন্যায় ছোট বড় যার সাথেই করা হোক ক্ষমা চাওয়াটা আবশ্যক! আর পিয়াসের তো বড় ভাবীজান হয় তাই তার ক্ষমা চাইতে নিশ্চয় কোনো ক্ষ’তি নাই।’
প্রহর চলে যায়। চয়ন, সাদিক, নাসিমা, পিয়াস ক্ষে’পে যায়। এখন চৈত্রিকার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ভেবেই সবার রাগ হচ্ছে। তারা জমিদার বংশের হয়ে একটা সাধারণ মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে বিষয়টা তাদের ইগোতে লাগে। এই ইগো থেকে তৈরী হয় রাগ, ক্ষো’ভ, হিং’সা। নিজ মনে চেপেই যে যার ঘরে চলে যায়। কারণ সবাই জানে প্রহর যা বলেছে তা করিয়েই ছাড়বে। সবাই চলে গেলে পল্লবী হল রুমে দাঁড়িয়ে প্রশান্তির হাসি হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘চয়ন রেনওয়াজ! যে জমিদারী বংশ নিয়ে আপনার এতো দম্ভ সেই জমিদার পুত্রই আপনাকে ধ্বং’স করবে। আপনার ধ্বং’স আমি নিজ চোখে এখনই দেখতে পারছি। আপনাকে শেষ হতে দেখে আমি আরো একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিবো আর ওইদিনই হবে আপনার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন।’
৮৭.
চৈত্রিকা বিকেলের দিকে নিজেদের বাড়ির সামনের দীঘির পাড়ে বসে ছিলো। রোদ তেমন না থাকায় তার বসে থাকতে সমস্যা হয় না। তবে মুখ দেখে বোঝা যায় না মনে কি চলছে! দুদিন থেকে সে এই বাড়িতে থাকলেও মন, মস্তিষ্ক পড়ে আছে জমিদার বাড়িতে। সেখানে এখন শুধু তার শ’ত্রুরা না তার প্রাণপ্রিয় ছোট্ট বোন, বান্ধবীও রয়েছে। দুদিন থেকেই সনিয়া বেগমের মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছে না৷ মাঝে মাঝে এতো সব কিছুর জন্য নিজেকে ভীষণ দো’ষী মনে হয়। সে না আসতো প্র’তিশো’ধ নিতে আর না এসব কিছুর মাঝে সাথী ফেঁ’সে যেতো! দীঘির টুইটুম্বর পানিতে চোখ রেখেই আপনমনে কিছু ভাবতে থাকে চৈত্রিকা। সে মুহুর্তে হুট করেই কারো ‘ভাউ’ শব্দে চমকে ওঠে। অন্যমনষ্ক হওয়ায় সহজেই বিষয়টা বুঝতে পারেনি। পড়ে যেতে নিলে নিজেই নিজেকে সামলে পেছনে তাকায়। থমকে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বিড়বিড় করে দুটি শব্দই উচ্চারণ করে, ‘অনিম ভাই!’
সামনে দাঁড়ানো অনিম চৈত্রিকার চমকে যাওয়া মুখ দেখে হেঁসে ফেলে৷ বরাবরের মতো চৈত্রিকার চুল টেনে দিয়ে বলে, ‘ওমন চমকালি কেনো? মনে হচ্ছে আজ আমাকে প্রথম দেখলি!’
চৈত্রিকা নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে জবাব দেয়, ‘তেমন কিছু না অনিম ভাই। তোমাকে অনেক দিন পর দেখলাম তো তাই! এতোদিন পর হঠাৎ এখানে!’
‘তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই দেখতে চলে আসলাম। ভালো করেছি না বল!’
‘হ্যাঁ। অনেক ভালো করেছো। একা এসেছো নাকি ফুপিরা এসেছে?’
‘একাই এসেছি। সেই দু’র্ঘ’টনার পর তোকে কতগুলো দিন পর দেখছি! অনেক বড় হয়ে গেছিস। আর আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছিস।’
বলেই ঠোঁট চেপে হাসে অনিম। চৈত্রিকাও মুচকি হাসে। অনিম সুবাদে চৈত্রিকার ফুপাতো ভাই হয়। চৈত্রিকাদের বাড়িতে আ’গুন লাগার পর অনিম আর তার বাবা মা ধরেই নেয় চৈত্রিকারও জীবন সংকটে। তাই তারা কৌশলে, গোপনে তাকে এই গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। সনিয়া বেগম এবং আজম আলীর সাথে তার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই অনিম তার হাত টেনে ধরে। চৈত্রিকা চমকে হাতের দিকে তাকায়। ছোট থেকে এই অনিম ভাই অজস্র বার তার হাত ধরেছে কখনো কোনো রকম অস্বস্তির সামনে না পড়লেও আজ ১ম বারের মতো তার ভীষণ অস্বস্তি হলো। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ এমন অস্বস্তি অনুভূতির কারণ বুঝলো না। হয়তো এটাই বিয়ের আগের আর বিয়ের পরের আরেকটা তফাৎ। অনিম চৈত্রিকার হাত টেনে সরাসরি সনিয়া বেগমদের বাড়ির মাঝে চলে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে সনিয়া বেগমকে ডাকে। সনিয়া বেগম ঘর থেকে বিষন্ন মন নিয়ে বের হলেও এতোদিন পর অনিমকে দেখে খুশি হয়ে যায়। হাসিমুখেই ছুটে আসে অনিমের কাছে। বলে,
‘এতোদিন পর আমার কথা মনে পড়লো?’
‘তোমার কথা তো প্রতিদিনই মনে পড়ে মামীমা। শুধু সময়ের অভাবে আর আসা হয় না।’
‘থাক থাক আর অজুহাত দেখিও না। সত্যটাই বলে দাও! আচ্ছা বাহিরে না দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে চলো!’
অনিম মাথা নাড়িয়ে চৈত্রিকার হাত ধরেই ঘরে ঢুকতে নেয়৷ সে সময় হাজির হয় জমিদার বাড়ির লোকজন। এতোজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে চৈত্রিকার হাত ধরা অবস্থাতেই অনিম পেছনে ফিরে তাকায়। প্রহর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রথমেই তাকায় সেই ধরে থাকা হাতের দিকে। মাথার রক্ত টগবগ করে ওঠে। চৈত্রিকা হাত ছাড়িয়ে নেয়। অনিম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
‘মামী কারা এরা? এতোজন একসাথে তোমাদের বাড়িতে!’
সনিয়া বেগম অনিমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই প্রহরকে বলে, ‘তোমরা এই অসময়ে! বাড়ির ভেতর আসো বাবা!’
সবাই এক এক করে বাড়িতে ঢুকতে থাকে। অনিম চৈত্রিকার দিকে মাথা এগিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘এরা কারা রে চৈত্রিকা?’
চৈত্রিকাও তার মতো ফিসফিস করে উত্তর দেয়, ‘আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এরা। আর সামনেরটা আমার স্বামী প্রহর রেনওয়াজ।’
অনিমের মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ে। জোড়ে বলে ওঠে, ‘হোয়াট! তুই বিয়ে…’
আর কিছু বলার আগেই জলদি মুখ চেপে ধরে চৈত্রিকা। কন্ঠস্বর নিচু করে বলে, ‘আস্তে বলো! আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। আপাতত চুপ থাকো!’
অনিম চুপ করে গেলেও বিষয়টা হজম করতে পারে না। আজম আলীর বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে সবাইকে বসতে দেওয়া হয়। নাসিমা অনিমকে দেখার পর থেকেই উসখুস উসখুস করছে। সাদিক খেয়াল করে বলে, ‘কি হয়েছে তোমার?’
‘এখান থেকে দ্রুত চলো সাদিক।’
‘চৈত্রিকাকে না নিয়ে কেমন করে যাবো? কি হয়েছে বলবে তো!’
নাসিমা কিছু বলতে পারে না। শুধু হাসফাস করতে থাকে। চৈত্রিকা আর অনিমকে দুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রহর সেদিকেই তাকিয়ে থাকে কড়া দৃষ্টিতে। চৈত্রিকা তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায়। হঠাৎ করে প্রহরের এমন তাকানোতে চৈত্রিকার আত্মা কেঁপে ওঠে। অর্পিতা এগিয়ে যায় চৈত্রিকা আর অনিমের কাছে। চৈত্রিকার হাত টেনে খুশি মনে বলে,
‘বড় ভাবীজান এদিকে আসেন!’
অর্পিতা আর চৈত্রিকা যেদিকে যায় পিছু পিছু অনিমও সেখানেই গিয়ে দাঁড়ায়। চৈত্রিকার পাশাপাশি। সবাই একসাথে হওয়ার পর চয়ন অনিচ্ছা স্বত্বেও বলে,
‘দেখো বড় বউ! একটা ভুল বোঝাবোঝি হয়ে গেছে এবং তাতে তোমাকে আমাদের বাড়ি থেকে চলেও আসতে হয়েছে এজন্য আমরা দুঃখিত। বাড়ি ফিরে চলো!’
অনিম চয়নের কথা শুনছিলো আর আশে পাশে সবাই কে ভালো করে দেখছিলো। নাসিমা বার বার তার থেকে মুখ লুকিয়ে রাখছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় নাসিমাকে চিনতে তার কষ্ট হয় না। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে। চয়নের কথা শেষ হতে না হতেই সে চেঁচিয়ে চৈত্রিকাকে বলতে নেয়,
‘চৈত্রিকা ওটা মামী…’
সাথে সাথে হাত চেপে ধরে চৈত্রিকা। অনিমের দিকে সবাই চেয়ে থাকে। অনিম কথা সম্পূর্ণ করতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। চৈত্রিকা ছোট্ট করে বলে, ‘এইসব কথা তোমাকে আমি পরে বুঝিয়ে বলবো অনিম ভাই। এখন কিচ্ছুটি বলো না।”
অনিম মনের মাঝে হাজারটা প্রশ্ন চেপে রেখে চুপ করে যায়। নাসিমা বড় বড় শ্বাস নেয়। চয়ন তীক্ষ্ণ চোখে অনিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এই ছেলেটা কে? আর কথার মাঝে এমন চেঁচিয়ে ওঠে কেন?’
উত্তরটা চৈত্রিকাই দেয়, ‘এটা আমার ফুপাতো ভাই। অনিম আহসান। আর উনি কথার মাঝে ওমন চেচিয়েই ওঠে। যায় হোক! আপনি যেনো কি বলতেছিলেন আব্বাজান? একটা ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে! এটা কি সত্যই ভুল বোঝাবোঝি? আপনারা সত্যটা জানা স্বত্বেও ইচ্ছে করে আমাকে যা তা শুনিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন! এটা ভুল বোঝাবোঝি না অ’ন্যায়। তাই ভালো ভাবে বলেন ‘আমাদের অ’ন্যায় হয়ে গেছে তার জন্য আমরা লজ্জিত। বাড়ির বউ বাড়িতে ফিরে চলো!’
চৈত্রিকার সুযোগের সদ্ব্যবহার দেখে চয়নরা ক্ষে’পে ওঠে। প্রহর নিজমনে বসে আছে। যেনো সে কিছুই জানেও না বোঝেও নাহ। অনিম চৈত্রিকার কন্ঠের তেজ দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে। চৈত্রিকা মুখের ওপর এমন করে কথা বলতে জানে তা যে তার জানা ছিলো না এটারই বহিঃপ্রকাশ করছে তার মুখের এমন হাল। চৈত্রিকা হাত বগলদাবা করে চয়নের দিকে তাকিয়ে ফের বলে,
‘কি আব্বাজান বলবেন নাকি?’
চয়ন কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আমাদের অ’ন্যায় হয়ে গেছে এবং সেই অ’ন্যায়ের জন্য আমরা লজ্জিত। তুমি বাড়ির বড় বউ! বাড়িতে ফিরে চলো।’
চৈত্রিকা বিশ্বজয়ের হাসি হাসে। প্রহর আড়চোখে একবার চৈত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ গম্ভীর করে নেয়। সনিয়া বেগম বলে,
‘চৈত্রিকা যা তৈরী হয়ে আয়!’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে চলে যায়। অনিম কিছু না বুঝে যেতে নিলে সনিয়া বেগম আটকে দেয়। প্রহর তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে চৈত্রিকার পিছু পিছু যায়। চৈত্রিকা তখন ঘরের দরজা আটকাতে নেয়। প্রহরের হাত চলে আসায় চমকে তার দিকে তাকায়। প্রহর চোখের ঈশারায় সরতে বললে চৈত্রিকা একটু সরে দাঁড়ায়। প্রহর ঘরে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। চৈত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি ঘরে আসছেন কেনো জমিদার সাহেব? আমি তৈরী হবো তো!’
প্রহর হুট করেই কোনো কথা ছাড়াই চৈত্রিকার বাহু চেপে ধরে। একটানে নিজের দিকে টেনে দূরত্ব মিটিয়ে নেয়। চৈত্রিকা ঘাবড়ে গিয়ে সরাসরি প্রহরের চোখের দিকে তাকায়। প্রহরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার মুখশ্রীতেই নিবদ্ধ। কাঁপা কাঁপা হাতে চৈত্রিকা প্রহরের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে,
‘কি করছেন? ছাড়ুন!’
‘তোমাকে বিশ্বাস করি, ভরসা করি মানে তোমাকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে এটা কিন্তু আমি একদম সহ্য করবো না চৈত্র। তুমি আমার জন্য হালাল। স্পর্শ করার হলে আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না করলে নাই। তোমার প্রতি সব রকম অধিকার আমার। তুমি পুরোটাই আমার। তোমার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমি সহ্য করবো না।’
প্রহর নিজেই চৈত্রিকাকে ছিটকে সরিয়ে দেয়। তারপর কোনো কথা ছাড়াই গটগট করে দরজার সামনে যায়। পেছনে না ফিরেই বলে, ‘আমার রাগের সময় খবরদার ‘জমিদার সাহেব’ উচ্চারণও করবে না।’
এরপর দরজা খুলে বের হতে হতে বিড়বিড় করে বলে, ‘তোমার ‘জমিদার সাহেব’ শব্দটা আমাকে বরফের মতো শীতল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চৈত্র।’
প্রহর বের হয়ে গেলেও চৈত্রিকা হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রয়। প্রহরের একেকটা বাক্য সে ২য় বারের মতো নিজ মনেই আওড়ায়। অজানা অনুভূতিতে হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ে। শ্বাস ঘন হয়। প্রহরের বলা ‘তুমি পুরোটাই আমার’ বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে। পেছনে ঘুরে তাকাতেই নজর যায় সরাসরি আয়নার দিকে। ছোট্ট আয়নাতে তার লজ্জায় লাল হওয়া গাল স্পষ্ট।
চলবে..
#চৈত্রিকা (৩৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
৮৮.
চৈত্রিকাকে সত্যি সত্যিই পল্লবী ২য় বারের মতো বরণ করে ঘরে তুলেছে। সবাই খুশি হলেও চয়ন, পিয়াস, সাদিক শুধু পারছে না সবাইকে চোখ দিয়েই ভ’স্ম করে দিতে! কিন্তু প্রহরের সামনে তাদের কোনো কিছুই যে চলবে না এটা তারা ভালো মতোই জানে। নাসিমা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যতটুকু সম্ভব নজড় এড়াচ্ছে অনিমের। কিন্তু অনিম বার বার ওই নাসিমার দিকেই তাকাচ্ছে। ওহ হ্যাঁ! অনিম যেহেতু চৈত্রিকার ফুপাতো ভাই হয় তাই বোনের শ্বশুরবাড়ি হিসেবে সেও এসেছে জমিদার বাড়িতে। এতে কেউ তেমন কিছু না বললেও নাাসিমা সাদিককে বারণ করেছিলো। সাদিক নাসিমার কথা শুনেও কাউকে কিছু বলেনি। নাসিমা ব্যবহার তার কাছে সন্দেহজনক লেগেছে কিন্তু পুরো বিষয়ে তাকে কিছুই বলেনি। এখন সে অযথা কারণে যদি অনিমকে জমিদার বাড়িতে যেতে নিষেধ করে সেটা ভালো দেখায় না। এদিকে অনিমের মাথা হ্যাঙ হয়ে গেছে। চৈত্রিকার বিয়ের কথা শুনে আর নাসিমাকে দেখে সে রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ছে। যতবারই সব ভাবছে ততবারই তার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। নিজের মাথায় এতো প্রেশার না দিয়ে সে ছুটলো চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা তখন কেবলই নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগিয়েছে। অনিম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে চৈত্রিকার সামনে দাঁড়ায়। চৈত্রিকা ভড়কে গিয়ে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। কোনো রকমে বলে,
‘কি হয়ছে অনিম ভাই? তুমি এমন ছুটে এলে কেনো?’
‘তুই আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছিস! তোরা মা মেয়ে মিলে যে আমার মাথার ১২ টা বাজিয়ে দিয়েছিস তার কি হবে শুনি!’
চৈত্রিকা সতর্কিত দৃষ্টিতে চারপাশ নজর বুলিয়ে বলে, ‘এসব কথা বলো না ভুল করেও৷ এটা কিন্তু বাড়ি কম শ’ত্রুবাড়ি বেশি। এখানে একেকটা ইট পাথরও আমাাদের জন্য ভ’য়ং’কর। তাই এসব কথা বলো না এখানে।’
অনিম ফোঁস করে শ্বাস নেয়। গাল দুটো কিছুটা ফুলিয়ে বলে, ‘তো জমিদারের বউ এবার আমাকে নিজের ঘর দেখায় দে! আমি একটু ঘুমিয়ে মাথাটা ঠান্ডা করতে চাই।’
‘ওমা! এই অবেলায় ঘুমাবে? আর একটু পর তো আযান দেবে!’
‘দিক! তুই আমারে ঘর দেখায় দে।’
‘আচ্ছা চলো! নীরা আপুকে ডেকে তোমাকে ঘর দেখাচ্ছি।’
অনিম মাথা নেড়ে চৈত্রিকার পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। তারপর হুট করেই আবার চৈত্রিকার পাশাপাশি এসে বলে, ‘চৈত্রিকা একটা জিনিস খেয়াল করছিস?’
‘কি জিনিস?’
‘ছোট বেলায় তোকে কোনো কাজ দিলে তুই না করলে তখন আমি তোকে ‘জমিদারের বউ’ বলতাম! এখন দেখি তুই সত্যি সত্যিই জমিদারের বউ হয়ে গেছিস। ওয়াও! এই তুইও আমারে জমিদারের মেয়ে জামাই বল! তাহলে আমিও জমিদারের মেয়ে জামাই হয়ে যাবো। হাউ সুইট!’
অনিমের কথার ধরণ শুনে চৈত্রিকা হেঁসে ফেলে। নীরার ঘরের সামনে গিয়ে বলে, ‘আমার কিন্তু একটা ননদিনী আছে অনিম ভাই!’
অনিম লাফিয়ে ওঠে। চৈত্রিকাকে কিছু বলার আগেই চৈত্রিকা নীরার ঘরের ভেতর চলে যায়। অনিম যায় নাহ। সে বাহিরে থাকতেই চৈত্রিকা আর নীরা একসাথে বের হয়ে আসে। অনিম আর কিছু বলতে পারে না। এরপর নীরার সাথে চৈত্রিকা অনিমকে ঘর দেখিয়ে আবার নীরার সাথেই ফিরে আসে। অনিমের পেট গুড়গুড় করা শুরু করে। বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। বিড়বিড় করে বলে,
‘এই মেয়েটা নিজের ননদিনীর কথা বলে গেলো কিন্তু দেখিয়ে গেলো না! আহা জমিদারের মেয়ে জামাই!’
৮৯.
রাতে সবাই খেতে বসার পর পল্লবী খাবার নিয়ে চিত্রর ঘরের দিকে যায়। অর্পিতা অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিলো চিত্রর ঘরে যাওয়ার জন্য কিন্তু কোনো ভাবেই যেতে পারছিলো না৷ মূলত যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। পল্লবীকে খাবার হাতে যেতে দেখে অর্পিতা দৌড়ে আসে। পল্লবী হুট করে অর্পিতাকে সামনে চলে আসতে দেখে খানিকটা চমকালেও নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘কিছু বলবি অর্পি?’
অর্পিতা মাথা নিচু করে দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। ফাঁকা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে, ‘খাবারটা আমাকে দাও বড় আম্মু! আমি নিয়ে যাই?’
পল্লবী প্রথমে না করতে গিয়েও আবার থেমে যায়। অর্পিতার ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পেরে হাসি মুখে খাবারের প্লেট অর্পিতার হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর অর্পিতার থুতনীতে হাত রেখে বলে,
‘দেখ মা! তখন চিত্রকে পাচ্ছিলাম না বলেই টেনশনে তোকে যা তা বলে দিয়েছি। তুই কিছু মনে করিস না কিংবা বড় আম্মুর ওপর রাগও রাখিস না। আমি মা তো! আমার ভেতরটা বুঝবি না। আর চিত্রর ঘরে যেতে এতো ইতস্তত করার কি আছে? মাঝের সবটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। দুজনে আবার আগের মতো হওয়ার চেষ্টা কর!’
অর্পিতা মাথা নাড়ায়। পল্লবী হেঁসে নিচে চলে যায়। অর্পিতা খাবার হাতে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ঘরের সামনে যায়। প্রহর যেহেতু এই সময় বাড়িতে তাই দরজার সামনে আর কোনো পাহাড়াদার নেই। অর্পিতা ঘরের বাইরে থেকে গলা পরিষ্কার করে দরজায় টোকা দেয়। ছোট্ট করে বলে,
‘চিত্র ভাই আসবো!’
শ্বাস আটকে রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্পিতা। হঠাৎ করেই তার কি হয়েছে কে জানে! নিজের অনুশোচনাবোধের জন্য এমন হচ্ছে নাকি অনুভূতির জন্য বুঝে ওঠে না। ওপাশ থেকে এতোগুলো দিন পর অর্পিতার কন্ঠস্বরে থমকায় চিত্র। নিজের অনুভূতিদের সংযত করতেই ঘরের মাঝ থেকে অর্থি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দুরন্ত গলায় বলে,
‘আসো আসো! জলদি আসো! আমি আর চিত্র ভাই একা একা প্রচুর বিরক্ত হচ্ছিলাম। এবার তুমি এসে গেছো আমরা একসাথে আড্ডা দিবো।’
অর্পিতার হাত ধরেই ঘরের ভেতর আনে অর্থি। অর্পিতা একবারের জন্য মাথা উচু করে তাকায় না। চিত্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। অর্থি আরাম করে বিছানার ওপর বসে। অর্পিতা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়। অর্থি অর্পিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ওই আপু! দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এখানে আসো! আর তুমি কি ভাইয়াকে খাইয়ে দেবে?’
অর্পিতা এবারও কিছু বলে না। চিত্র নিজেই অর্থিকে বলে, ‘আপু নিচে যাও! খেয়ে আসো।’
অর্থি কিছু বলতে গিয়েও বলে না। চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। অর্পিতা তখন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মেঝেতে নখ খুটছে। কিছুটা সময় ওভাবে যাওয়ার পরও যখন অর্পিতার কোনো হেলদোল হয় না তখন চিত্র গম্ভীর স্বরে ডাকে,
‘ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি? এদিকে আয়!’
অর্পিতা ছোট ছোট পা ফেলে এগোয়। চিত্রর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে থাকে। চিত্র ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘খাইয়ে দে।’
অর্পিতা চমকে তাকায়। চিত্র চোখ দিয়ে ঈশারা করে। অর্পিতা বিনাবাক্যে বসে পড়ে। কোনো কথা ছাড়াই হাত ধুইয়ে খাইয়ে দিতে থাকে। পুরোটা সময় দুজন চুপ করেই কাটায়। খাওয়ানো শেষে অর্পিতা প্লেট, গ্লাস নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। এতোগুলো দিন পর দুজনেই বুঝতে পারে না একে অন্যকে কি বলা উচিত! কি করা উচিত! অর্পিতা বের হয়ে আসতে নিলে চিত্র পেছন থেকে ডাকে। অর্পিতা ফিরে তাকাতেই বলে,
‘আমাদের মাঝে কবে থেকে এতো দূরত্ব হয়ে গেছে অর্পি?’
৯০.
রাতে চৈত্রিকা খেয়ে আগে এসে বিছানা ঠিক করে। প্রহর তখনো ঘরে আসেনি বলে আলমারি খুলে তা আবার ঠিকঠাক করে গুছিয়ে রাখতে শুরু করে। আলমারি গোছানোর সময়ই চৈত্রিকা কিছু কাগজপত্র আর পুরোনো একটা ডায়েরী পায়। চৈত্রিকা উল্টে পাল্টে কাগজ গুলো দেখার আগে ডায়েরীটা দেখতে থাকে। ভ্রু কুঁচকে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ে প্রহরের নাম। পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই মহুয়ার হাসি মুখের একটা ছবি বেড়িয়ে আসে। চৈত্রিকা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে ছবি। বিড়বিড় করে বলে,
‘মহুয়া বুবুর ছবি এখনো এতো যত্ন করে রেখেছে! এখনো তাকেই ভালোবাসে নাকি? কিন্তু উনি তো নিজেই…!’
চৈত্রিকা নিজের ভাবনা সরিয়ে ফের পরের পৃষ্ঠা উল্টায়। কয়েকটা বাক্যে লেখা নি’ষ্ঠুর বাণী, ‘আমি ভালোবাসাকেও মে’রে ফেলতে জানি। যদি ভালোবাসার মানুষটা বি’শ্বাসঘা’তক হয়! আমি ভালোবেসে আমরণ বিরহ পুষতে পারি যদি ভালোবাসার মানুষ সঠিক হয়। তবে আমি এই পাথর হৃদয়েই বি’শ্বাসঘা’তকতার শা’স্তি হিসেবে মৃ’ত্যু দিতে পারি। কে’টে টু’করো টু’করো করে সেই র’ক্তে গো’সলও করতে পারি। তুমি আমার সাথে বি’শ্বাসঘা’তকতা করার শা’স্তি নিজের মৃ’ত্যু দিয়ে পাবে! তোমার র”ক্তে র’ঞ্জিত হবে জমিদার বাড়ির পুকুর।’
গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। বাক্যগুলোতে এমন কিছু ছিলো যা চৈত্রিকার মনে দাগ কেটে যায়। পরের পৃষ্ঠা উল্টানোর আগেই দরজা খোলার শব্দ হয়। চৈত্রিকা তাড়াহুড়ো করে ডায়েরী আর কাগজগুলো নিজের পেছনে লুকায়। প্রহর ঘরে ঢুকে চৈত্রিকাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে,
‘ওখানে কি করছো?’
চৈত্রিকা প্রথমে নিজেকে শান্ত করে। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘তেমন কিছু না। আলমারিটা অনেক এলোমেলো হয়ে আছে বলে ঠিক করছি।’
‘ঘুমাবে কখন?’
‘এই তো আসছি!’
প্রহর আর কিছু না বলে গোসলখানায় ঢুকে যায়। চৈত্রিকা ডায়েরী আর কাগজপত্র সাবধানে রেখে আলমারি বন্ধ করে এসে বিছানায় বসে। প্রহর বেশ কিছুক্ষণ বাদেই হাত মুখ মুছতে মুছতে বের হয়। চৈত্রিকা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করে,
‘নিবিড় ভাই কোথায়? জানেন কিছু!’
‘হঠাৎ নিবিড় ভাইয়ের খোঁজ?’
‘নাহ মানে উনাকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না।’
প্রহর নিজের কাজে মন দিয়ে বলে, ‘পরশু চলে আসবে।’
দুজনে আবার চুপ। প্রহর চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চৈত্রিকা কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকলে প্রহর হাতে টেনে শুইয়ে দেয়। এক হাতে নিজের বক্ষে টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের এই কাজে চৈত্রিকা হতভম্ব। পরমুহূর্তে নিজেই মুখ গুজে দেয় প্রহরের প্রশস্ত বুকে। প্রহর চোখ বন্ধ অবস্থাতে হাসে। কোনো কথা বলে না।
বেশ অনেকটা সময়ের মধ্যেই প্রহর ঘুমিয়ে পড়ে। চৈত্রিকার নিজেরও ঘুম পেয়ে যায়। কিন্তু হুট করেই সেই ডায়েরী আর কাগজপত্রের কথা মনে পড়তেই ঘুম উড়ে যায়। ভীষণ আলগোছে প্রহরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে। একবার ভালো মতো প্রহরকে পর্যবেক্ষণ করে নিজে উঠে সরাসরি দাঁড়ায় আমলারির সামনে। সাবধানে সেখান থেকে কাগজপত্র আর ডায়েরী নিয়ে চেয়ারে বসে। ডায়েরী পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় আসে। দু পাতায় কিছু না থাকলেও পরের পাতায় ছোট করে লিখা,
‘প্রহর রেনওয়াজের সাথে এই ভ’য়ং’কর গেইম খেলা উচিত হয়নি মহুয়া।’
চৈত্রিকা কপাল কুঁচকে নেয়। প্রহরের সাথে মহুয়া আবার কোন গেইম খেলেছিলো? উত্তর নেই। চৈত্রিকা আবারও পৃষ্ঠা উল্টায়। পরের ৪/৫ পৃষ্ঠা ফাঁকার পর একটা ছোট্ট নোট করা, ‘প’র’কী’য়ার মতো জ’ঘন্য’তম কাজ! আমার বউ হয়েও তুমি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে যে সম্পর্কে জড়িয়েছো এর পরিণতি ভ’য়ং’কর হবে। এতোটাই ভ’য়ং’কর যে তোমার বুক কেঁপে উঠবে শুধু মৃ’ত্যুর কথা ভাবলেই!’
চৈত্রিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাতেই বাকি সব ফাঁকা। চৈত্রিকা ভাালো মতো দেখতেই কানে আসে, ‘এরপর! এরপর তোমার মৃ’ত্যুর দিন। যখন তোমার শিরায় শিরায় ছিদ্র করছিলাম তখন তুমি কা’টা মুরগীর মতো করছিলে! তোমার শিরা উপশিরা দিয়ে যখন র’ক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম। তুমি বাঁচার জন্য ছটফট করছিলে আর আমি তোমার মৃ’ত্যুর জন্য ছটফট করছিলাম! প্রহর রেনওয়াজের সাথে বি’শ্বাসঘা’তকতার পরিণাম দিয়েছিলাম তোমাকে।’
চৈত্রিকা চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। প্রহর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রহরের হঠাৎ এমন নৃ’শং’স রুপের বর্ণনা শুনে হাপাতে থাকে। প্রহর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছোট্ট করে বলে,
‘ভয় পাচ্ছো কেনো? তুমি তো আমার সাথে বি’শ্বাসঘা’তকতা করোনি! তবে ভয়ের কি আছে চৈত্র?’
চৈত্রিকা হঠাৎ করেই স্বাভাবিক হতে পারে না। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে প্রহরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা রহস্যময় ছিলো কিন্তু এতো ভ’য়ং’কর! মহুয়ার মৃ’ত্যু কল্পনা করেই চৈত্রিকার শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে। প্রহর হেঁসে বলে,
‘অতো ভয় পাওয়ার কি আছে চৈত্র? যে খেলায় নেমেছো সে খেলায় এর থেকেও বেশি ভ’য়ং’কর হতে হয়! এর থেকেও বেশি নৃ’শং’স হতে হয়! আর তো ক’দিন তারপর নিজেই কেমন করে ভ’য়ং’কর হয়ে উঠবে নিজেও জানো না!’
চলবে..