#চৈত্রিকা (৩৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
৯৪.
আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আশে পাশে অনেক তাঁরাদের ভীড়। বাহিরটা যেনো আলোয় চকচক করছে। সাথী নিজের ঘরে বসে জানালা দিয়ে সেই চাঁদকে দেখতেই ব্যস্ত। নিজের জীবনটা এতো এলোমেলো কিভাবে হয়ে গেলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদের দিক থেকে চোখ সরাতেই ঘরে প্রবেশ করে পিয়াস। সাথী সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। শক্ত হাতে বিছানার চাদর আঁকড়ে নিজের মনকে শক্ত করে। পিয়াস সাথীর কাছে এগোতে এগোতে বলে,
‘নতুন বউ কি করো!’
সাথী বড় বড় শ্বাস নেয়। কন্ঠের জোড় ধরে রাখার চেষ্টা করে বলে, ‘আপনি এখানে কি করছেন?’
‘বাহ রে! বিয়ে করেছি বউয়ের কাছে আসবো না?’
‘এরকমটা কথা ছিলো না।’
‘ছিলো না তো ছিলো না! তাতে আমি কি করবো?’
পিয়াসের এমন কথাতে সাথী চমকায়৷ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে। পিয়াস গোপনে কু’টিল হাসি হাসে। তারপর সাথীর পাশে বসতে বসতে বলে,
‘জমিদাররা কথার খেলাপ না করলেও আমি করি। বাপের শিক্ষা এটা!’
এক হাতে সাথীর কাঁধ জড়িয়ে নেয়। সাথী চমকে উঠে সরে যেতে নেয়৷ পিয়াস আরো শক্ত করে ধরে। সাথী সরাসরি পিয়াসের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে পিয়াসের থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। পিয়াসের শক্তির কাছে সাথী নড়তেও পারে না। সাথী কোনোরকমে বলে,
‘ছাড়ুন!’
‘না ছাড়লে?’
সাথী ঘন ঘন শ্বাস নেয়। ততক্ষণে পিয়াসের হাতের বিচরণ দৃঢ় হয়। সাথী কি করবে বুঝে ওঠে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। পিয়াসকে যথেষ্ট বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও পিয়াস বাধা মানে না। নিজের শক্তি খাটাতে থাকে। সাথী এক পর্যায়ে শান্ত হয়ে যায়। পিয়াস একটু অবাক হলেও নিজের কাজ থামায় নাহ। সাথীকে বাঁধন মুক্ত করে হাত দেয় তার ব্লাউজে। সে সময়েই সাথী আচমকা ধাক্কা দেয় পিয়াসকে। তারপর বিছানা থেকে দ্রুত পায়ে নেমে টেবিলের ওপর থেকে ফুলের টব ছুড়ে মা’রে পিয়াসের দিকে৷ দৌড়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে৷ তব্দা খেয়ে বসে থাকে পিয়াস। মিনিট দুয়েক পরই তার ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে কু’টিল হাসি। ফুলের টব লাগা পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘ভয় পাও! তোমার ভয় থেকেই আমার জয়।’
সাথী নিজের ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে চলে যায় অর্পিতার ঘরে। রাতের বেলা হঠাৎ আতঙ্কিত অবস্থায় সাথীকে নিজের ঘরে দেখে অর্পিতা নিজেই ভয় পেয়ে যায়। সাথী ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতেই অর্পিতা বলে,
‘কি হয়ছে সাথী? তুমি এ ঘরে কেন?’
সাথী কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় অর্পিতার কাছে। হাত আঁকড়ে ধরে বলে, ‘আপু আমি তোমার ঘরে থাকি? তোমার সাথে তো কেউ থাকে না। আমাকে আজকের রাতটা থাকতে দাও না আপু!’
‘আচ্ছা আগে শাান্ত হও! কি হয়েছে বলো! পিয়াস ভাইজান কিছু করেছে? বড় ভাবীজানকে ডাকবো আমি?’
‘নাহ নাহ। চৈত্রের কাছে যাবো নাহ। ওখানে দুলাভাই আছে। সবাই এক। আমি উনার ওখানে যাবো না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা! তোমার যেতে হবে না। তুমি এখানেই ঘুমাও।’
সাথী জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ে। অর্পিতা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে। সাথীর ভীত মুখ দেখে তার কপালে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে। মনে মনে ঠিক করে সকালেই এ বিষয়ে চৈত্রিকার সাথে কথা বলবে সে।
৯৫.
সকাল সকাল চৈত্রিকা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে এসেছিলো। সেখানে নাসিমাও ছিলো। চৈত্রিকাকে দেখে নাসিমার ভেতরের মৃ’ত্যুভয় ফের যেনো জেগে ওঠে। নিজেকে কোনো রকমে আড়াল করে নেওয়ার চেষ্টা করে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। চৈত্রিকা খেয়াল করে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে নেয়। কিন্তু খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। কাজের মাঝেই বড়রা নিজেদের মাঝে কথা তোলে অর্পিতা আর চিত্রর বিয়ে নিয়ে। পল্লবী শায়লাকে বলে,
‘তোর মেয়েকে আমি আমার বাড়ির মেয়ে থেকে আবার ছোট ছেলের বউ করতে চাই। এবার দিবি তো?’
শায়লা মাথা নিচু করে থাকে। আগের শায়লা হলে হয়তো অহংকারেই নিষেধ করে দিতো কিন্তু এই শায়লার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। চৈত্রিকা আড়চোখে শায়লার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। বড়দের মাঝে কথা বলাটা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে করে না। এর মাঝেই অর্পিতা ডাকে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা হাত ধুয়ে আসলে অর্পিতা তাকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। সাথী ততক্ষণে উঠে চলে গেছে নিজের ঘরে। হুট করে অর্পিতার এমন কান্ডে চৈত্রিকা শুধায়,
‘কি হয়েছে অর্পিতা আপু? হঠাৎ এভাবে টেনে আনলেন!’
অর্পিতা ধীরে ধীরে রাতের ঘটনাটা চৈত্রিকাকে বলে। সাথীর এমন আতঙ্কিত হওয়ার কথা শুনেই চৈত্রিকা রক্ত শীতল হয়ে যায়। সাথীর সাথে আবার কি করছে পিয়াস! কোনো ভাবে পিয়াসের মনে অন্য কিছু চলছে না তো! চৈত্রিকা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়ে। তার কিছু হলে সে মেনে নিবে কিন্তু সাথীর কিছু হলে তার মেনে নেওয়ার কোনো জায়গা নেই। অর্পিতার ঘর থেকে বের হয়ে সরাসরি সাথীর ঘরে যায় চৈত্রিকা। সাথী তখন বিছানার ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেওয়া। চৈত্রিকা ঘরে টোকা দিতেই সাথী লাফিয়ে ওঠে। বার কয়েক ঢোক গিলে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। দু তিনবার টোকা দেওয়ার পরও দরজা না খোলায় চৈত্রিকা ডাক দেয় ‘সাথী!’
সাথী বুঝতে পারে চৈত্রিকা। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েই জড়িয়ে ধরে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা চমকে ওঠে। নিজেকে সামলে সাথীর মাথায় হাত রেখে বলে,
‘কি হয়ছে সাথী? এমন করছিস কেনো?’
সাথী ফুপিয়ে ওঠে। চৈত্রিকা সাথীকে সোজা করে দাঁড় করায়। টেনে ঘরের মাঝে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। তারপর সাথীর থুতনী উচু করে বলে, ‘কি হয়ছে? কাঁদছিস কেনো? পিয়াস রেনওয়াজ কিছু বলছে তোরে?’
সাথী চৈত্রিকার দুহাত জাপ্টে ধরে৷ কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ‘চৈত্র আমারে বাঁচা! ওই লোকটা আমাদের সবাইকে মে’রে ফেলবে। তোকে, আমাকে, আম্মা, আব্বা সবাইরে মে’রে ফেলবে। চল চৈত্র আমরা এখান থেকে চলে যাই!’
চৈত্রিকা জড়িয়ে ধরে সাথীকে। সাথী তখনো কান্না করেই যাচ্ছে। চৈত্রিকা সাথীর পিঠে,মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছোট্ট করে বলে, ‘কিচ্ছু হবে নাহ। কাঁদিস না। তুই সবসময় আমার সাথে থাকবি। রাতে তুই আর আমি একসাথে থাকবো।’
‘দুলাভাই তোকে আসতে দেবে?’
‘তুই এতো ভাবিস নাহ। ভয়ও পাস নাহ। আমি আছি তো!’
সাথী কান্না থামায়। চৈত্রিকা সাথীর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘চল! নিচে যাই।’
‘তোকে একটা কথা বলি!’
‘বল!’
‘এবাড়ির কাউকে বিশ্বাস করিস না চৈত্র। এরা সবাই মনে এক আর মুখে আরেক করে ঘুরে বেড়ায়। এরা সবাই ভেতরে ভেতরে শ’য়’তা’ন।’
চৈত্রিকা চুপ থাকে। সাথী যে কথাটা প্রহরকে নিয়েও বলেছে তা বুঝতে বাকি থাকে নাহ। কিন্তু হঠাৎ করে এমন কথার মানে বুঝে ওঠে না। চৈত্রিকা নিজেকে সামলে আর কোনো কথা না বলে সাথীকে নিয়েই নিচে নামে। কিন্তু মনের মধ্যে খুতখুত থেকেই যায়। কি এমন কারণে সাথী তাকে একথা বললো?
৯৬.
চিত্র যদিও অসুস্থ তবুও অর্পিতা আর চিত্রর বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। চয়ন এই বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও প্রহরের কাছে হার মেনে নিয়েছে। প্রহরের কথা অনুযায়ীয় হল রুমে বৈঠক বসেছে। সবাই হাজির৷ চিত্র প্রহরের পাশে বসে আছে। অর্পিতা এক কোণে চৈত্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে। চয়ন নিজের অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও নিজেই শিমুলকে বলে,
‘দেখ ভাই! এতোদিন যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার ছেলে আর তোর মেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে। আমি তোর মেয়ের হাত চাই আমার ছেলের জন্য৷ তুই দিবি?’
শিমুল চমৎকার করে হাসে৷ সে এতো প্যাচ বোঝে না। তার কাছে সন্তানের মুখের হাসিটাই বড়। চয়ন ইচ্ছায় বলুক কিংবা অনিচ্ছায়! বিয়েটা হলেই সে খুশি। তার মেয়ে আর কষ্ট পাবে নাহ অন্তত। সে বিনা বাক্য ব্যয়েই হাসিমুখে মাথা নাড়ায়। তারপর ছোট্ট করে বলে,
‘তবে আমি একবার অর্পিতাকে জিজ্ঞেস করে নিতে চাই। বিয়েটা ওর তাই ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার। অর্পিতা!’
অর্পিতাকে নিয়ে শায়লা এগিয়ে আসে। অর্পিতা মাথা নিচু করে থাকে। শিমুল শুধায়,
‘তোর বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে আম্মা?’
অর্পিতা হাতে হাত ঘষতে থাকে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে পেতে কার আপত্তি থাকে! কিন্তু বিগত ঘটনার জন্য তার ইতস্তত বোধ হচ্ছে। ওই ঘটনাগুলো থেকে এখনো যে সে বের হতে পারেনি এটাই তার বহিঃপ্রকাশ। অর্পিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রহর গম্ভীর স্বরে শুধায়,
‘আপত্তি আছে তোর?’
প্রহরের প্রশ্নে গলা শুকায় অর্পিতার। কোনো রকমে মাথা দুদিকে নাড়ায়। কমবেশি সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে। প্রহর একই প্রশ্ন চিত্রকেও করে। চিত্রও দু’দিকে মাথা নাড়ায়। বিয়ে পাকা হয়ে যায়। অর্থির মাধ্যমিক শেষ হলেই দুজনের বিয়ে ধুমধাম করে দিয়ে দেওয়া হবে। অর্পিতা আর চিত্র দুজনই নিজেদের দিকে আঁড়চোখে তাকায়। একে অন্যকে ঠিকই ভীষণ ভালোবাসে অথচ দুজনের মাঝেই দাঁড়িয়ে গেছে এক বিশাল দ্বিধার দেয়াল। যা টপকে দুজনের একে অন্যের সামনে যাওয়া হচ্ছে না। বিয়ের সকল কথা বার্তা শেষে বড়রা সবাই নিজেদের মতো চলে যায়। হল রুমে ছোটরা মজা করতে থাকে। সব থেকে বেশি খুশি হয় অর্থি। অর্থির লাফানো দেখে অনিম ভেংচি কেটে বলে,
‘এমন ভাবে লাফাচ্ছে যেনো নিজের বিয়ে!’
কথাটা আস্তে বললেও ঠিকই অর্থির কান অব্দি চলে যায়। কারণ দুজন পাশাপাশিই ছিলো। অর্থি নিজের লাফানো রেখে কোমড়ে হাত দিয়ে অনিমের দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘এই যে পেট মোটা! এটা আমার বিয়ে না তাতে কি! এটা আমার চিত্র ভাইয়া আর অর্পি আপুর বিয়ে। আমি লাফাবোই। আপনার কি?’
কথাটা অর্থি জোড়েই বলে। সবাই তাকায় অনিম আর অর্থির দিকে। অনিম থতমত খেয়ে বলে, ‘আমার আবার কি! তুমি লাফাও। জোড়ে জোড়ে লাফাও।’
অর্থি ভেংচি কেটে লাফানো শুরু করে। সবাই মুখ চেপে হাসে। চৈত্রিকাও এখানেই বসে ছিলো। কিন্তু প্রহর ঘরে যাওয়ার আগে তাকে ডাকে। চৈত্রিকা প্রহরের পিছু পিছু ঘরে আসে। প্রহর নিজের টি-শার্ট চেঞ্জ করে শার্ট পড়তে পড়তে বলে,
‘আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি! তুমি চিত্রর দিকে খেয়াল রাখো আপাতত।’
চৈত্রিকা মাথা নাড়ায়। প্রহর ঘাড় বাকিয়ে একবার চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে নিজের শার্টের শেষ বোতামটা লাগায়। চৈত্রিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মেঝেতে নখ খুটতে ব্যস্ত। প্রহর সামনাসামনি এসে চৈত্রিকার কপালে পড়ে থাকা চুলে ফু দেয়। চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে নেয়। প্রহর ঠোঁট কামড়ে হেসে গম্ভীর গলায় বলে,
‘এতো কি ভাবো সারাদিন?’
চৈত্রিকা কিছু বলে না। চোখ বন্ধ করেই দাঁড়িয়ে থাকে। প্রহর মাথাটা একটু এগিয়ে নিয়ে চৈত্রিকার কপালে চুম্বন করে। চৈত্রিকা কেঁপে ওঠে চোখ মেলে সরাসরি তাকায় প্রহরের চোখের দিকে। প্রহর সরে গিয়ে চুল আচড়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে নেয়। চৈত্রিকা পেছন থেকে বলে,
‘কাল একটু আমাকে শহরে নিয়ে যাবেন?’
প্রহর ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেনো?’
‘কাল আমার বাবার মৃ’ত্যুবার্ষিকী। কবর জিয়ারত করার জন্য হলেও আমার যাওয়া দরকার। একটু নিয়ে যাবেন জমিদার সাহেব?’
প্রহর থমকায়। চৈত্রিকা তাকায় না তার দিকে। ‘বাবার মৃ’ত্যুবার্ষিকী’ বলার সময় তার গলা কেঁপে ওঠে। প্রহর নিষ্পলক কিছুক্ষণ চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে ভীষন শান্ত স্বরে জবাব দেয়, ‘নিয়ে যাবো।’
প্রহর বেড়িয়ে যায়। চৈত্রিকা বসে পড়ে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। এক হাতে বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাতে নিজের শাড়ি চেপে ধরে। চোখ ঝাপটাতে থাকে। কিছুতেই সে কাঁদবে নাহ। অনেকক্ষণ নিজের সাথে লড়াইয়ের পরও যখন পে’রে ওঠে না তখন মুখে হাত চেপে ডুকরে ওঠে। কান্নারত অবস্থাতেই বলে,
‘কালকের দিনটা আমার জন্য বি’ষাক্ত। কালকের দিনেই আমি মা নামক মানুষটার নোং’রা একটা রুপ দেখেছি। কালকের দিনেই আমি আমার ভীষণ প্রিয় বাবাকে হারিয়েছি। নিজ চোখের সামনে নিজের বাবাকে একটু একটু করে নিঃশ্বেস হতে দেখেও কিচ্ছুটি করতে পারিনি। কালকের দিনেই আমি বেচে গিয়েও ম’রে গেছি। তুমি তো আমাকে বাঁচাতে পাঠিয়েছো বাবা! কিন্তু আমি তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারিনি। আমি তোমাকে আর একটিবার দেখতেও পারিনি বাবা। আই মিস ইউ বাবা। আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি বাবা। আমার তোমাকে আরো একটাবার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে বাবা। বাবা!’
বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে চৈত্রিকা। ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে চৈত্রিকার প্রত্যেকটা শব্দ শোনে প্রহর। চৈত্রিকার আক্ষেপের একেকটা বাক্য হৃদয় এফোড় ওফোড় করে দেয়। ফাঁকা ঢোক গিলে চৈত্রিকার কান্নারত মুখের দিকে তাকায়। বুকের বাম পাশে মুহুর্তেই চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়।
চলবে..
#চৈত্রিকা (৩৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
৯৭.
অর্থি নিজের পড়ার টেবিলে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তার ঘামে ভিজে যাওয়া মাষ্টারমশাইয়ের মুখপানে। মাষ্টারমশাই ফ্যানের বাতাসে নিজেকে জিরোনোর সাথে সাথে অর্থির বই দেখতে ব্যস্ত। এদিকে তার ছোট্ট ছাত্রী যে ভীষণ করে তাকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা মিটাচ্ছে এ কি সে টের পেয়েছে? কি জানি! প্রহর দুপুরের পর এসে পল্লবীকে বলে গেছিলো যে নিবিড় আজ আসবে অর্থিকে পড়াতে। তাই সময় মতো যেনো অর্থি পড়ার ঘরে বসে থাকে। সে সময় থেকেই যেনো অর্থির সময় কাটছিলো না। ভেতরটা অস্থির হয়ে ছিলো তার মাষ্টারমশাইকে দেখার জন্য। যখন সকল অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘরে নিবিড় প্রবেশ করে তখন মিনিট খানেকের জন্য থমকে যায় অর্থি। শ্যাম বর্ণের মানুষটার চোখ মুখ কালচে হয়ে আছে। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে আছে গোটা মুখ জুড়ে। অর্থিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিবিড় সরাসরি আগে বলে,
‘ফ্যানের পাওয়ার বাড়াও তো অর্থি! ভীষণ গরম লাগছে।’
অর্থি অস্বাভাবিক হয়ে যায়। হুট করেই অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে যায়। তবে সে নিজেই গিয়ে ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে এসে নিজ জায়গায় বসে পড়ে। তখন থেকেই নিবিড় অর্থির বই দেখছে আর অর্থি নিজের মাষ্টারমশাইকে দেখছে। এই কালচে হওয়া মুখেও সে অদ্ভুত মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে। কি প্রশান্তি নিয়ে দেখছে মেয়েটা! অর্থি গালে হাাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকে। নিবিড় ইংলিশ বইয়ের পড়া বের করে অর্থির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এটা পড়ো! জলদি মুখস্ত করবে।’
অর্থিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে নিবিড় ভ্রু কুঁচকায়। অর্থির সামনে তুড়ি বাজাতেই অর্থি লাফিয়ে ওঠে। চোখ পিটপিট করে বলে, ‘জ্বি মাষ্টারমশাই!’
‘মন কোথায় থাকে? পড়া দিয়েছি। পড়ো!’
অর্থি মাথা নাড়িয়ে বইয়ের দিকে ঠিকই তাকায় কিন্তু পড়ে না। মাথাা উচু করে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে নিবিড় ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। থতমত খেয়ে যায় অর্থি। নিবিড় নড়েচড়ে বসে বলে,
‘সমস্যা কি অর্থি? বইয়ের দিকে তাকিয়ে কি করছো? পড়বে কখন? তোমার এই সপ্তাহ পরেই কিন্তু পরীক্ষা। ভালো করে পড়ো!’
অর্থি মিনমিন স্বরে বলে, ‘পড়বো। তার আগে একটা প্রশ্ন করি?’
‘নাহ।’
নিবিড়ের মুখের ওপর বারণ করে দেওয়ায় অর্থি কষ্ট পায়। কিন্তু দমে না। উল্টো এবার গলার স্বর উচু করে বলে, ‘নাহ বললেই হলো! আমি প্রশ্ন করবোই।’
‘তাহলে অনুমতি নিচ্ছো কেনো?’
নিবিড়ের ভাবলেশহীন ব্যবহার মোটেও ভালো লাগে না অর্থির। তবুও সে নিজের মনকে শান্ত করে বলে, ‘ভুলে গেছিলাম। আপনি এই ৪ দিন কোথায় ছিলেন? আজ কোথা থেকে উদয় হলেন? আপনি জানেন এখানে কত কিছু হয়েছে!’
নিবিড় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অর্থির চোখে মুখে অস্থিরতা। এই অসস্থিরতার মানে বুঝতে খুব একটা সময় লাগে না নিবিড়ের। অথচ এই অস্থিরতা সে গত কয়েকদিন আগেও ভীষণ করে চাইলেও এখন কোনো অনুভূতি নেই। নেই এই অস্থিরতা কমানোর কোনো প্রচেষ্টা। নিবিড়ের উত্তর না পেয়ে অর্থি ফের একই প্রশ্ন করে। নিবিড় শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,
‘তোমার জানার কোনো দরকার নেই অর্থি। নিজের পড়াটা পড়ো।’
‘মাষ্টারমশাই আমি…’
‘তুমি কি চাও আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাই?’
অর্থি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে কেনো চাইবে তার মাষ্টারমশাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাক! নিবিড়ের কথার মানে না বুঝলেও মাথা দুদিকে ঠিকই নাড়ায়। নিবিড় নিজেই বলে,
‘তাহলে পড়ো! তুমি মাধ্যমিকে ফেইল করলে তোমার বাবা আমাকে এই গ্রাম ছাড়া করবে। আমি তোমার পাস করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দয়া করে আমাকে ছোট করো না।’
নিবিড়ের এমন গম্ভীর আচরণ, কথার ধরণে অর্থি নিশ্চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলে। পড়ার দিকে দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ মুখস্থ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মন একজায়গায় আর চোখ একজায়গায় থাকলেই কি পড়া হয়? উহু! নাহ। অর্থি কিছুটা সময় পড়ে গেলেও পড়া মুখস্থ হলো না। বার বার অকারণেই চোখ ঝাপসা হলো। নিবিড় সবটা খেয়াল করেও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইলো। কোনো শব্দও করলো নাহ। অনেক কষ্টে অর্থি পড়া মুখস্থ করে। পর পর পুরোটা সময় পড়িয়ে নিবিড় কিছু হোমওয়ার্ক দেয়। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে,
‘পরীক্ষার আগের ক’দিন আমি তোমাকে সকাল, বিকাল দু বেলাই পড়াবো। এগুলো করে রেখো।’
নিবিড় নিজের কথা শেষ করে চুপচাপ ঘরে ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। অর্থি কিছুক্ষণ সেখানেই বসে রইলো। তারপর ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। নিবিড় তখনো সদর দরজা পার হয়নি। এর মাঝেই অর্থিকে রেলিং এর সামনে দেখে অনিম এগিয়ে আসে। অর্থির চুলে টান দিয়ে বলে,
‘পড়া ফাঁকি দিয়ে এখানে কি করো?’
অর্থি এক পলক তার দিকে তাকায়। মলিন মুখেই বলে, ‘আমার পড়া শেষ পেট মোটা অনিম ভাই।’
অনিম কটমট করে তাকায়। তবে অর্থির মলিন মুখ দেখে কিছু বলে না৷ নিবিড় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে অনিম আর অর্থিকে এক সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ব্যাথা মনেও সে হাসে। হেসেই বের হয় জমিদার বাড়ি থেকে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘তুমি চাঁদ আমি বামণ। তুমি জমিদার কন্যা আর আমি সামান্য মধ্যবিত্ত এক প্রজা। আমাদের কখনো মিল হয়? সম্ভব! উহু নাহ। তবুও এই বেহায়া মন তোমাকে ভালোবাসবে না ভালোবাসবে না করেও তোমার বোকা কথার প্রেমে পড়ে গেলো। মায়ায় পড়ে ভালোবাসায় বেঁধে গেলো। আমার ম’রণ বুঝি এভাবেই হওয়ার ছিলো!’
৯৮.
আজ চৈত্রিকার বাবার মৃ’ত্যুবার্ষিকী। গতদিন থেকেই চৈত্রিকার মুখ মলিন হয়ে ছিলো। প্রহর রাতে বাড়ি আসতে আসতে চৈত্রিকা সাথীর কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মন ভালো না থাকায় প্রহরের জন্য অপেক্ষা করে না। প্রহর তাকে খুঁজবে জেনে ছোট্ট একটা চিরকুটে নিজের ঘুমানোর খবর জানিয়ে দিয়েছে চৈত্রিকা। সকালের কথাগুলো শুনে প্রহরের মনটা বি’ষিয়ে থাকলেও এই ছোট্ট একটা চিরকুটই মন ভালো করে দিয়েছিলো। সকালে খাওয়া দাওয়ার পর চৈত্রিকা আর প্রহর তৈরী হয় শহরে যাওয়ার জন্য। জমিদারের নিজের গাড়ি থাকলেও চৈত্রিকা বলেছে সে বাস ছাড়া যাবে না। হুট করে এমন আবদারে প্রহর চমকেছে ঠিকই। হলরুমে এসে দাঁড়াতেই সামনে পড়ে চয়ন। দুজনকে তৈরী হয়ে বের হতে দেখে ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
‘সকাল বেলাতেই দুজন কোথায় যাচ্ছো প্রহর?’
প্রহরের সহজ জবাব, ‘আজ চৈত্রিকার বাবার মৃ’ত্যুবার্ষিকী। তাই শহরে যাবো কবর জিয়ারত করতে।’
পল্লবী এগিয়ে এসে বলে, ‘তোরা একা যাচ্ছিস কেনো? আমাদের বললে আমরা সবাইও তো যেতাম!’
‘সমস্যা নেই আম্মা। পরবর্তী বছরে না হয় বাড়ির সবাই মিলে গেলেই হবে।’
চৈত্রিকার কথা নাসিমা দুর থেকেই শোনে। চৈত্রিকা তাকায় নাসিমার দিকে। নাসিমার ভেতর মোচড় দেয়। উহু এটা আজকের দিনের স্বামী হারানোর শোকে নয়! এটা মৃ’ত্যুর ভয়ের। চৈত্রিকার যে ভ’য়ং’কর রুপ সে স্বপ্নে দেখেছে এরপর চৈত্রিকার সামনে যেতেই তার কলিজা কাপে। চৈত্রিকা নাসিমার দিকে তাাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসে। অনিম কোনোরকমে ছুটে আসে সিড়ি দিয়ে। চৈত্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘চল! আমাকে রেখেই বের হয়ে পড়েছিস কেনো? ডাকবি না একবার!’
চৈত্রিকা অবাক হয়ে বলে, ‘দুদিন আগেই তো এলে! আজই আবার যাবে আমাদের সাথে?’
অনিম মুখটা মলিন করে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ। আমি তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছিলাম কিন্তু এসে দেখি এখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যায় হোক বাদ দে! আজ যাই। তোর ননদের বিয়ের আগে আগে আবার ঘুরতে চলে আসবো। চল এখন!’
প্রহর কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে অনিমের দিকে। অনিমকে কেনো যেনো তার পছন্দ না। চৈত্রিকার আশে পাশে দেখলেই তার কেমন যেনো রাগ রাগ লাগে! চৈত্রিকা অনিম আর প্রহরকে বলে,
‘আপনারা বের হোন! আমি আসতেছি।’
প্রহর কোনো কথা ছাড়াই হনহন করে বের হয়ে যায়। অনিমও পিছু পিছু যায়। চৈত্রিকা সোজা নীরা আর অর্পিতার কাছে গিয়ে বলে, ‘বুবু আমি সন্ধ্যার মাঝেই চলে আসবো। এতটুকু সময়ের জন্য আমার বোনটাকে আপনাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে গেলাম। একটু দেখে রাখবেন। ভীষণ ভীতু মেয়েটা! শুধু আজকের দিনটার জন্য একটু ওকে আগলে রাখবেন বুবু!’
নীরা চৈত্রিকাকে আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘চিন্তা করবেন না বড় ভাবীজান। আমরা সাথীকে দেখে রাখবো। আপনি নিশ্চিন্তে যান।’
চৈত্রিকা নীরা, অর্পিতা, পল্লবী, শায়লার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়৷ প্রহর আর অনিম বাহিরেই দাড়িয়ে ছিলো। প্রহর যদিও অনিমের সাথে কোনো কথা বলেনি আর বেচারা অনিমও প্রহরের সাথে ভয়ে কোনো কথা বলেনি। চৈত্রিকা আসতেই প্রহর চৈত্রিকার হাত চেপে ধরে হাঁটা লাগায়। চৈত্রিকা, অনিম দুজনেই থতমত খায়। চৈত্রিকা নিচু গলায় বলে,
‘এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেনো জমিদার সাহেব? একটু আস্তে হাঁটুন না! আমি ব্যাথা পাবো।’
প্রহর হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেও হাত ছাড়ে না। অনিম ধরে থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে। প্রহরের চোখ মুখ পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট চেপে হাসে। তার বুঝতে বাকি নেই প্রহর জেলাস! চৈত্রিকা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ফের বলে,
‘অনিম ভাই কি ভাববে জমিদার সাহেব! হাতটা তো ছাড়ুন!’
প্রহর ছাড়েও না কোনো কথাও বলে না। উল্টো আরো শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকে। হতাশ হয়ে চৈত্রিকা চুপ হয়ে যায়। অনিম পকেটে হাত গুজে আরামে মুচকি হাসতে হাসতে হাঁটতে থাকে। ঘাড় ফিরিয়ে সে হাসি দেখে চৈত্রিকা লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।
৯৯.
চৈত্রিকা, প্রহর, অনিম সরাসরি আগে কবরস্থানে আসে। চৈত্রিকা যদিও একটু ভয় পায়। অনিমের বাবা, মা সবাই আসবে আজ। এখানে এসে যখন জানবে তাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তাদেরই অজান্তে তখন তাদের কি অবস্থা হবে এটা ভেবেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে চৈত্রিকার। চৈত্রিকার হঠাৎ এমন চো’রের মতো মুখ করা দেখে প্রহর মাথাটা চৈত্রিকার দিকে এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘এমন চো’রের মতো করছো কেনো? কি হয়ছে?’
চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় শুধু। কিন্তু কিছু বলে না। অনিম সামনে থেকে বলে, ‘চৈত্রিকা বেশি চিন্তা করিস নাহ। আমি বাড়িতে গিয়ে আব্বা আম্মারে সবটা বুঝাইয়া বলবোনি।’
প্রহর শুনলো। তার চতুর মস্তিষ্ক সবটা সহজেই আয়ত্ত্বে নিয়ে আসলো। তবে সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে, ‘আযান তো একটু আগে দিয়ে দিয়েছে। আগে নামাজ পড়ে তারপর তো কবর জিয়ারত করা হবে। হুজুরও তো লাগবে। অনিম মসজিদে যাবে তো?’
অনিম মাথা নাড়ায়। প্রহর চিন্তিত গলায় বলে, ‘কিন্তু চৈত্রিকা!’
‘আপনারা নামাজে যান। আমি পাশের এতিম খানায় বসতেছি। সমস্যা হবে না। সামনেই থাকবো। নামাজ শেষ করে এসে ডেকে নিয়ে আসবেন না হয়!’
চৈত্রিকার কথায় সায় দিলেও প্রহর পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু কিছু করার নেই বলে চৈত্রিকাকে পাশের অনাথ আশ্রেমে বসিয়ে দিয়ে প্রহর আর অনিম চলে যায় নামাজে। নামাজ শেষ করে কয়েকজন হুজুরকে নিয়েই দুজন ফিরে আসে। সবাইকে কবরস্থানের ভেতরে পাঠিয়ে প্রহর চৈত্রিকাকে নিয়ে আসে। কবরস্থানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ থাকায় চৈত্রিকা বাহিরে দাঁড়িয়েই নিজের বাবার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রহর হুজুরদের সাথে কবর জিয়ারত শেষ করে। এর মাঝেই দুজন লোক এসে কিছু খুরমা, মিষ্টি দিয়ে যায়। সেগুলো অনাথ আশ্রম আর মসজিদে দিয়ে দেয় প্রহর। চৈত্রিকার ভাগ্য ভালো থাকায় পুরো সময়ে তার ফুপিদের বাড়ির কেউই আসেনি। চৈত্রিকা বাহির থেকে চোখ জুড়িয়ে নিজের বাবার কবরস্থান দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে সেখানেই সময় কাটে ৪ টা পর্যন্ত। অনিমের বাড়ির লোকজন আসা দেখে চৈত্রিকা আড়াল হয়ে যায়। দুজনে এক ফাঁকে বের হয়ে চলে আসে বাসস্ট্যান্ডে। চৈত্রিকা প্রহরের কাধে মাথা রেখে বসে থাকে বেঞ্চে। প্রহর এক হাতে চৈত্রিকাকে আগলে নিয়ে ছোট করে বলে,
‘শরীর খারাপ লাগছে?’
চৈত্রিকা দুদিকে মাথা নাড়ায়। প্রহর বোঝে চৈত্রিকার বাবার জন্য তার মন খারাপ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মন খারাপ করো না। যার যতটুকু হায়াত সে ততটুকুই বাঁচবে। আল্লাহ হয়তো তোমার বাবাকে অতোটুকুর জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। মন খারাপ না করে দোয়া করো।’
চৈত্রিকা শুনেও কিছু বলে না। চুপচাপ মাথা এলিয়ে পড়ে রয়। এর মাঝে বাস চলে আসে। চৈত্রিকা বাসেও প্রহরের কাঁধে মাথা রাখে। দুজনে নিঃশব্দে নিজেদের ভালোবাসা বিনিময় করে। একজনের মন খারাপে অন্যজন শক্ত হাতে আগলে বসে থাকে। অনেকটা সময় পর চৈত্রিকা শীতল স্বরে বলে,
‘ভালোবাসার শা’স্তি কি জমিদার সাহেব? বিচ্ছেদ নাকি মিলন?’
প্রহর হঠাৎ এমন প্রশ্নে খানিকটা চমকালেও প্রকাশ করে না। ঘাড় বাঁকিয়ে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ভালোবাসার শা’স্তি কেবলই কষ্ট আর মায়া। বিচ্ছেদ কিছু সময় শা’স্তির না শান্তির কাজ করে।’
‘আমার শা’স্তি কি?’
প্রহর মনে মনে হাসে। চৈত্রিকাকে এক হাতে নিজের সাথে জাপ্টে নিয়ে এলোমেলো হওয়া চুলগুলো গুঁজে দেয় কানের পিঠে। কপালের এক কোণে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘তোমার শা’স্তি আজীবন তুমি জমিদার সাহেবের বক্ষে গেথে থাকো। জমিদার সাহেবের প্রশান্তির কারণ হয়ে থাকো আমৃ’ত্যু।’
চৈত্রিকা চোখ বন্ধ করে থাকে। মনে মনে অন্য কিছু ভাবে। সে কি সত্যিই ভালোবাসে জমিদার সাহেবকে নাকি সেও মহুয়ার মতো ছ’লনা করে যাচ্ছে তার জমিদার সাহেবের সাথে! সে যদি ছ’লনাই করে যায় তবে জমিদার সাহেব টের কেনো পেলো না? জমিদার সাহেব তো বিচক্ষণ মানুষ! আচ্ছা সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে নাকি এই বিচক্ষণ পুরুষটি তার ছ’লনাকে ধরতে পেরেও নিজেকে শান্ত রেখেছে! দ্বিধাদ্বন্দ মন নিয়েই প্রহরের কাঁধে মাথা রেখে পুরো রাস্তা পাড়ি দেয় চৈত্রিকা।
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)