তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-১৪+১৫

0
536

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৪

বনলতা,
তোমার প্রশ্ন, আমি কেন তোমাকে বনলতা নামে ডাকি। তুমি যা মেয়ে! এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অবধি যে তোমার মাথার মধ্যে এটাই ঘুরপাক খাবে সে ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত। তাই ভাবলাম উত্তরটা দিয়েই দেই। তুমি বলেছিলে তুমি বনলতা নামের একজনকেই চেনো। জীবনানন্দ দাশের কবিতার বনলতা। হ্যাঁ, তাকে হয়তো সবাই চেনে। কিন্তু আমি আরও একজন বনলতা খুঁজে পেয়েছি। সে কিন্তু জীবনানন্দ দাশের বনলতার থেকে কমও না। আমার উদ্দেশ্যহীন জীবন পথে হঠাৎ করেই তার দর্শন পেয়েছি। প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছিল আমার মনের খাঁ খাঁ ফাঁকা বনে আমি এমন এক লতাগুল্মের সন্ধান পেয়েছি, যা সহসা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই একটা লতাগুল্মই আমার প্রাণহীন জীবন বনে প্রাণ ফিরিয়ে দিবে। সেজন্যই হয়তো তাকে দেখে আমার মনে একটা নামই এসেছিল, ‘বনলতা।’ তার এই নাম পছন্দ না হলেও আমি তাকে এ নামেই ডাকব। এই নামটা শুধুমাত্র তার জন্যই। আমৃত্যু আমি তাকে এক নামেই চিনতে চাই, ‘আমার বনলতা।’

বিঃদ্রঃ আইসক্রিম যখন খেতে চেয়েছিলে তখন খাওয়াতে পারিনি। বাইরের খাবার অস্বাস্থ্যকর, তা তো বুঝেও বুঝতে চাও না। পিচ্চি মানুষ, তাই মায়া করে কিনে আনলাম। এখন মনভরে খাও।

আজ বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই শিয়রের পাশে এই চিঠি আর একটা আইসক্রিমের বক্স পেলাম। এবার আর প্রেরক চিনতে কষ্ট হলো না। দেখেই বুঝে গিয়েছি। দরজা লাগিয়ে এসে চিরকুটটা দ্রুত পড়ে শেষ করে আমি ‘থ’ হয়ে গেলাম। মনে এক অন্যরকম অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠল। এত আবেগ মেশানো চিঠি পড়ে আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। একটা মানুষ এত সুন্দর করেও ভাবতে পারে! কই? তাকে দেখে তো এটা বুঝার উপায় নেই। কিন্তু আজ আমি এটা বলতে বাধ্য যে লোকটার চিন্তা-ভাবনার ধরণ আসলেই অনেক সুন্দর। শুধু সেটা বাইরে প্রকাশ করে না। হঠাৎই আমার মস্তিষ্ক জানান দিলো, চিঠিতে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এই চিঠির প্রেরকের মনে প্রাপকের জন্য সত্যি সত্যিই আলাদা কোনো অনুভূতি আছে। কথাটা মাথায় আসতেই আমি থমকে গেলাম। এর মানে উনি সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন! এবার আর এই ভাবনা ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা মাথায় এল না। আমার হাত-পা কেন জানি ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই মুহুর্তে ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা নিজেরই বোধগম্য হচ্ছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে গেলে যা হয় আর কী। আমি বার কয়েক চিঠিটা পড়লাম। তারপর ঝিম মেরে বসে থেকে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবলাম। আমার ভাবনার সুতা ছিঁড়ল আইসক্রিমের বক্সটার দিকে দৃষ্টি পড়ায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিরকুটটা নিয়ে আমার ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর বিছানায় উঠে পদ্মাসন করে বসে আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। আইসক্রিম খেতে খেতে আবার তাজ ভাইয়ের চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লাম। লোকটা মনের দিকে একরকম আর বাইরে অন্যরকম। আর এটা বোধ হয় শুধুমাত্র আমিই বুঝলাম। বনলতা নামের রহস্য তো পেয়ে গেলাম, কিন্তু উনি যে চিঠিতে আমাকে তুমি বলেন। এটা তো বুঝতে পারলাম না। যাকগে, এটা পরে জেনে নিব। কিন্তু এখন আবার অন্য চিন্তা মস্তিষ্কে কড়া নাড়ল। ওনার সামনে যাব কীভাবে আমি? এই চিঠিটা পড়ে এখন তো কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। আচ্ছা? উনি কি আমাকে শুধুই পছন্দ করেন? না-কি ভালোও বাসেন? বাঁ হাতের চুড়ি জোড়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম উনি হয়তো সত্যিই আমাকে ফুপির পুত্রবধূ করার চিন্তা-ভাবনা থেকেই এগুলো দিয়েছেন। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? সম্পর্কে উনি আমার ফুপাতো ভাই হন। আর তাছাড়া বাবা এটা মানবেও না। তাহলে উনি কী ভেবে এসব মাথায় নিয়ে বসে আছেন? আবার তো বললেন এ বছরই চলে যাবেন। চলে গেলে আমাকে নিয়ে এসব ভাবার মানে কী? আসলে ওনার মনের মধ্যে কী চলছে? কী জানি! লোকটার মনের খবর পাওয়া মুশকিল। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এমন একটা সত্য জানার পরও ওনার প্রতি আমার একটুও রাগ বা বিরক্তি আসছে না। বরং সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা অনুভুতির সৃষ্টি হচ্ছে। ভাবনার মাঝে আমি পুরো এক বক্স আইসক্রিম সাবাড় করে ফেলেছি। এখন আমার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তাজ ভাইয়ের থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর কীভাবে পাব? তখনই দরজায় টোকা পড়ল। আমি উচ্চস্বরে প্রশ্ন করলাম,“কে?”

দরজার বাইরে থেকে আফরা আপু উত্তর দিলো,“আমি, দরজা খোল।”

আমি হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আইসক্রিমের বক্সটা খাটের নিচে লুকিয়ে ফেললাম। তারপর গিয়ে দরজা খুলে আফরা আপুকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিলাম। আপু রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,“দরজা আটকে ঘুমাচ্ছিস কবে থেকে আবার?”

আমি মেকি হেসে বললাম,“আজ এমনিতেই আটকেছিলাম।”

“কথা ছিল তোর সাথে।”

“হ্যাঁ বলো।”

আফরা আপু খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বলল,“তাজ ভাই তো আমাকে সময়ই দিচ্ছে না। কী করি বল তো?”

কথাটা শুনে আমার মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। কেন হলো তা বুঝতে পারলাম না। আমি ভাবলাম আফরা আপু তো তাজ ভাইকে ভালোবাসে। কিন্তু তাজ ভাইয়ের তো তার জন্য কোনো ফিলিংসই নেই। এখন আমার কী করা উচিত? কিছুই তো মাথায় আসছে না। আফরা আপু আবার বলল,“কী হলো? কিছু বল।”

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“এখন কিছু মাথায় আসছে না আপু। ভেবে পরে বলি?”

আপু গোঁ ধরে বসল এখনই কিছু একটা ভেবে বলতে হবে। মাথায় এত চিন্তা নিয়ে বসে থেকে আবার এই আরেক জ্বালায় পড়লাম আমি। এখন আপুকে একটা আইডিয়া না দিলে সে এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না। ভাবতে লাগলাম কী আইডিয়া দিব। কিছুক্ষণ ভেবে পরে চট করে বলে উঠলাম,“পেয়েছি। শোনো আপু, তুমি তাজ ভাইকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাও। তোমার কোনো ফ্রেন্ডের বাড়ি বা অন্য কোথাও। একসাথে অনেকটা সময় কাটাতে পারবে আর আলাদা কথা বলারও সুযোগ পাবে।”

আপু প্রথমে একটু খুশি হলেও পরে মুখ কালো করে বলল,“কিন্তু তাজ ভাইয়া কি তোকে আর অলিকে রেখে যাবে?”

আমি বললাম,“যাবে যাবে। আমি আগেই না বলে দেব যে আমি যাব না।”

আফরা আপু খুশি হয়ে বলল,“আচ্ছা, তাহলে আজ রাতেই যাই। বলব আমার এক ফ্রেন্ডের থেকে ইমিডিয়েটলি একটা নোটস আনতে হবে। ঠিক আছে?”

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। আফরা আপু উৎফুল্ল মনে দুলতে দুলতে রুম থেকে চলে গেল। আফরা আপুকে দেখে আমার মায়া লাগছে। আবার চিঠির কথাগুলোর কথাও ভাবছি। তাজ ভাই কেন এ বিষয়ে আমার সাথে সরাসরি কথা বলছেন না? সমস্যা কী তার? আমার তো অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই। আসরের নামাজ পড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম বাবা আর শ্রেয়ান ভাইয়া একসাথে বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। আমি গিয়ে বাবার পাশ ঘেঁষে বসে অভিমানী কন্ঠে বললাম,“গ্রামে এলে তুমি আমাকে একদম ভুলে যাও বাবা।”

বাবা হেসে আমাকে একহাতে আগলে ধরে বলল,“শুধু আমিই ভুলে যাই? তুমি কী করো আম্মা? গ্রামে এলে তো তুমি সারাক্ষণ এ বাড়ির মানুষের সাথেই ব্যস্ত থাকো। যাই হোক, চা খাবে?”

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“চা কি অপছন্দ না-কি তোমার?”

আমি বললাম,“অপছন্দ না, আবার খুব বেশি পছন্দও না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে খাই।”

“আমি আর তাজ বরাবরই চা পাগল। যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমরা আড্ডায় বসে কাপের পর কাপ চা শেষ করতাম।”

তাজ ভাইয়ের কথা উঠে আসায় আমি প্রশ্ন করলাম,“তাজ ভাইকে দেখছি না যে?”

বাবা বলল,“ও তো একটু বাইরে বেরোলো।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,“শ্রেয়ান ভাইয়াকে রেখেই বাইরে চলে গেল?”

শ্রেয়ান ভাইয়া হাসিমুখে বললেন,“আমি নিজেই যেতে চাইনি। আজ বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেই এই দুদিনে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। বলতে গেলে পুরো গ্রামই চষে বেড়িয়েছি।”

বাবা চায়ের কাপটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“জরুরী একটা কল করতে হবে। ফোনটা রুমে রেখে এসেছি। তোমরা গল্প করো, আমি যাই।”

আমি বললাম,“আমি এনে দিচ্ছি। তুমি বসো।”

বাবা ততক্ষণে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,“না আম্মা। আমিই যাচ্ছি।”

বাবা যাওয়ার পর আমিও উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু শ্রেয়ান ভাইয়া বাঁধা দিয়ে বললেন,“বসো, গল্প করি।”

অগত্যা আবার বসে পড়লাম। মিনিট খানেক চুপ থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“ইলোমিলো, তুমি না রামিশার সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু মনের দিক দিয়ে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাই আমি।”

আমি কিছুটা অবাক হয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার মুখে মেকি হাসি। আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম,“আপনি নিজেকে কীভাবে সামলান ভাইয়া?”

“অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল। তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করেছি।”

“তবুও তো ভুলতে পারেননি।”

শ্রেয়ান ভাইয়া শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“সবাইকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয় না ইলোমিলো। কাউকে মনপ্রাণ দিয়ে যেদিন ভালোবাসবে সেদিন তুমিও এটা বুঝতে পারবে।”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম। তারপর বললাম,“এভাবে কতদিন ভাইয়া? আপনার তো পরিবার আছে। তারা আপনাকে বিয়ের কথা বলে না?”

“বলে কিন্তু আমিই কানে নেই না।”

“বিয়ে করবেন না?”

শ্রেয়ান ভাইয়া ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,“প্রথমে ভেবেছিলাম করব না। তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। ও যখন সুখে আছে তখন আমারও মুভ অন করা উচিত। কিন্তু তার জন্য এমন মেয়ে দরকার যে মেনে নিতে পারবে যে আমি রামিশাকে আজও ভালোবাসি। ধরে নাও তোমার মতো একটা মেয়ে পেলে বিয়ে করে নেব।”

আমি কিছুটা চমকালাম। পরক্ষণেই মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম,“কেউ একজন অবশ্যই পেয়ে যাবেন আশা করি।”

বাইরে থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ কানে এল। বুঝলাম তাজ ভাই এসেছে। উনি এখন বাড়িতে ঢুকলেই ওনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। হঠাৎ করেই আমার প্রচন্ড লজ্জা আর অস্বস্তি লাগল। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললাম,“আমি একটু আসছি ভাইয়া।”

শ্রেয়ান ভাইয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেলাম। তারপর আর রুম থেকে বেরোনোর নামও নিলাম না। সন্ধ্যার খানিক পরে আফরা আপু আমার রুমে এল। আমি তার চুপসানো মুখ দেখে ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলাম,“কী হয়েছে আপু?”

আপু দুঃখী দুঃখী গলায় বলল,“আমি তাজ ভাইয়াকে বলেছিলাম, ভাইয়া আমি একটা নোটস আনতে ফ্রেন্ডের বাসায় যাব। আমার সাথে একটু যাবেন প্লিজ। অথচ উনি উলটা শ্রেয়ান ভাইয়াকে বললেন আমার সাথে যেতে।”

“কেন?”

“ওনার না-কি মাথা ব্যথা করছে।”

আমি খুব ভালো করেই জানি তাজ ভাই মিথ্যা কথা বলেছেন। আসলে উনি আফরা আপুর ধারেকাছেও থাকতে চান না। আমি বললাম,“ওহ্! তো এখন কী করবে? যাবে?”

আফরা আপু গাল ফুলিয়ে বলল,“বলেছি যখন তখন তো যেতেই হবে। তারা তো আর জানে না আমি মিথ্যা কথা বলেছি। আমার ফ্রেন্ডকে কল করে বলে দিয়েছি আমি যাচ্ছি ওদের বাসায়।”

“কখন যাবে?”

“এখনই। ধুর! সব প্ল্যান ভেস্তে যাচ্ছে। ভাল্লাগে না।” কথাটা বলে আফরা আপু গটগট করে হেঁটে চলে গেল। ছোটো কাকি সন্ধ্যার নাস্তা করার জন্য ডাকল তবু রুম থেকে বের হলাম না। আফরা আপু শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে বেরিয়েছে কি না তাও জানি না। বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে ফেসবুকিং করছিলাম। তখনই তাজ ভাইয়ের কন্ঠ কানে এল। সম্ভবত ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছেন। আমি ফোনটা রেখে পাশ থেকে চাদর টেনে মুড়ি দিয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলাম। মিনিট দুয়েক পর রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। বুঝতে পারলাম তাজ ভাই রুমে এসেছেন। উনি এসে বিছানায় বসলেন তাও টের পেলাম। তারপর প্রায় দুই তিন মিনিট কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। কী হলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করেই আমার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরে গেল। আমি প্রচন্ড চমকে লাফিয়ে উঠে বসে পড়লাম। সামনে দৃষ্টি পড়তেই দেখলাম তাজ ভাই ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনাকে দেখেই আমার বিকেলের চিঠিটার কথা মনে পড়ে গেল।‌ সঙ্গে সঙ্গে আমি চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলাম। তাজ ভাই বললেন,“কী সমস্যা?”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। উনি পরপর তিনবার একই প্রশ্ন করলেন। কিন্তু আমি একইভাবে বসে ছিলাম। উনি ধমকের সুরে বললেন,“মুখ কি কেউ সেলাই করে দিয়েছে? নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছিস মনে হচ্ছে? না-কি আলুর নেহালের কথা মনে পড়েছে?”

এতক্ষণ লজ্জা পেলেও এবার আমি বিরক্ত হলাম। কথায় কথায় উনি এই নামটা কেন টেনে আনেন উনিই জানেন। আমি বিরক্ত মুখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“সবসময় এক লাইন বেশি বোঝেন কেন আপনি?”

“বাহ্! নেহালের কথা বলা মাত্র মুখ ফুটে কথা বেরিয়ে এল, আর আমি বললেই দোষ!”

“আপনার না মাথা ব্যথা? তো এখানে কী করছেন? যান তো এখান থেকে।”

তাজ ভাই বললেন,“ও হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার মাথা ব্যথা। মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছিস। এবার কাজে লেগে পড় তো।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“কিসের কাজ?”

উনি হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে বসে পড়লেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ওনার কান্ড দেখতে লাগলাম। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“এদিকে আয় তো। মাথা টিপে দে। একদম বেশি বকবক করবি না। তুই কিন্তু আমার এসিস্ট্যান্ট।”

আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আপনি অযথা মাথা ব্যথার ভান ধরে আছেন তা আমি জানি না ভেবেছেন?”

“ওই পিক আর চিঠির কথা ভুলে গেছিস?”

ওনার কথায় আমার আবার ওনার দেয়া চিঠির কথা মনে পড়ল। আমি আবার অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করলাম। উনি ওদিক ফিরে তাড়া দেখিয়ে বললেন,“শুরু কর তাড়াতাড়ি। আর যেন বলতে না হয়।”

আমি এবার ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিছানায় ওনার সোজাসুজি বসে আলতো করে ওনার কপালে হাত রাখলাম। তারপর আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিতে লাগলাম। বেশ কয়েক মিনিট এভাবেই কাটল। দুজনেই নিশ্চুপ বসে আছি। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে আমি সাহস জুগিয়ে চট করে বলে উঠলাম,“কিছু কথা ছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে উনি আমার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,“আর টিপতে হবে না।”

উনি উঠে দাঁড়াতেই আমি বললাম,“আমি কিছু বলেছি।”

উনি আমার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“পিচ্চিদের সব বিষয়ে বেশি কৌতুহল রাখতে হয় না।”

আমি অবাক দৃষ্টিতে ওনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বেশ বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চাই। সেজন্যই আগেভাগে কেটে পড়েছেন। ওনার মনে যদি সত্যিই আমার জন্য কোনো অনুভূতি থেকে থাকে তাহলে এমন লুকোচুরির মানে কী?

চলবে…………………….🍁

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৫

আজ আবার আফরা আপু আমার পেছনে লেগেছে নতুন প্ল্যানিংয়ের জন্য। আমিও নাচতে নাচতে বলে দিয়েছি তাজ ভাইয়ের পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে। আফরা আপু একদৌড়ে গিয়ে দাদুমনির কাছ থেকে জেনে এসেছে খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা তাজ ভাইয়ের খুব পছন্দের খাবার। উনি না-কি ছোটো বেলা থেকেই ফুপির হাতে রান্না করা খিচুড়ি খেতে ভালোবাসতেন। আফরা আপু মেজো কাকিকে বলে রান্নাঘরে ঢুকেছে। সে রান্না করবে শুনে মেজো কাকি আর ছোটো কাকি অবাকের চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। এখন আফরা আপু ইউটিউব দেখে খিচুড়ি রান্না করছে আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। যা বুঝলাম, খিচুড়ি রান্না করা খুব বেশি কঠিন কাজ না। খিচুড়ি রান্না শেষ করে আপু মাছ ভাজল। তখন আমি দূরে সরে দাঁড়ালাম। মাছ ভাজার সময় আমার ভয় লাগে। যেভাবে তেল ছিটে, বাপরে! রান্না শেষ করে আমরা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলাম। তারপর গোসল, নামাজ সেরে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। মেজো কাকি আর ছোটো কাকি মিলে খাবার পরিবেশন করল। তাজ ভাইয়ের মুখ দেখে মনে হলো খিচুড়ি দেখে সে খুশিই হয়েছে। আফরা আপু আগেই সবাইকে বলে দিলো আজ সে রান্না করেছে। এটা শুনে কাকারাও কাকিদের মতোই অবাক হয়েছেন। খাওয়ার সময় আফরা আপু কিছুক্ষণ পরপরই তাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করল তার কিছু লাগবে কি না, রান্না কেমন হয়েছে। তাজ ভাইও বললেন খিচুড়িটা অনেক মজা হয়েছে। অথচ বাকি সবার মতে খিচুড়ির স্বাদ তেমন মজাও হয়নি, তেমন খারাপও হয়নি। চলে আর কী। ওনার আলাদা মন্তব্যের কারণ বুঝতে পারলাম না। তবে ওনার মুখে নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে আফরা আপু পারলে লুঙ্গি ড্যান্স দেয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি রুমে গিয়ে শুয়ে পরলাম একটা শান্তির ঘুম দেয়ার আশায়। কিন্তু যেখানে অশান্তির রাজা বাস করে সেখানে কী আর শান্তির আশা করা যায়! সবেমাত্র চোখ দুটো বন্ধ করেছি তখনই আমার চুলে হেঁচকা টান পড়ল। ব্যথাতুর শব্দ করে আমি চোখ খুলে তাকালাম। তাজ ভাইকে পাশে বসে থাকতে দেখে বিরক্ত মুখে উঠে বসলাম। রাগত কন্ঠে বললাম,“এভাবে চুল‌ ধরে টান মারেন কেন? ব্যথা পাই না?”

উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,“যেই না চুল। দেখলেই তো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

“আস্ত শয়তান!”

“তোর ঘাড়ে চেপে বসব?”

আমি শক্ত মুখে বললাম,“যান তো এখান থেকে। এই সময় আপনি আমার রুমে কী করছেন?”

উনি কিছুটা অবাক হবার ভান করে বললেন,“তোর রুম মানে! এই রুমটা যখন করা হয়েছিল তখন কি তুই রাজমিস্ত্রীর কাজ করেছিলি? আমার যতদূর মনে পড়ে, তখন তুই ললিপপ খাওয়া বাচ্চা ছিলি।”

“আপনার ফালতু কথা রেখে যাবেন এখান থেকে? আমি ঘুমাব।”

“এই রুমে তোর নাম লেখা নেই। তুই বললেই আমি চলে যাব কেন?”

আমি মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিকর শব্দ করে বললাম,“তাহলে আপনি এখানেই বসে থাকেন। আমি চলে যাচ্ছি।”

কথাটা বলে বিছানা থেকে নামতে নিতেই তাজ ভাই আমার হাত চেপে ধরে আবার বসিয়ে দিলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে উঠলেন,“আফরাকে এসব বুদ্ধি কে দেয়?”

আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“মানে?”

“চা করে আনে, শাড়ি পরে কেমন লাগছে জানতে চায়, ফ্রেন্ডের বাড়ি নিয়ে যেতে বলে, খিচুড়ি রান্না করে মন্তব্য জানতে চায়। অথচ ও কোনোদিন না শাড়ি পরে, না রান্নাঘরে যায়। তো হঠাৎ করে ওর মাথায় এসব এল কোত্থেকে?”

“আমি কীভাবে জানব? আপুকেই জিজ্ঞেস করেন।”

“আমাকে কি তোর মতো মাথামোটা মনে হয়? পিচ্চি মাথায় এত বদ বুদ্ধি আসে কীভাবে? নেক্সট টাইম আবার যদি ওকে এসব ভুলভাল বুদ্ধি দিস, তাহলে পানিশমেন্ট পেতে হবে।”

“বেশ করেছি। আরও বেশি বেশি দেবো। আপনার কী?”

“অতিরিক্ত পেকে গেছিস।” কথাটা বলেই উনি আবার আমার চুল ধরে হেঁচকা টান দিলেন। এবার বেশ জোরেই লাগল। ব্যথায় আমার চোখে পানি চলে এল। আমি ওনার মুঠো থেকে আমার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। বেশ রেগে গিয়ে একপ্রকার জোরেই বলে উঠলাম,“কথায় কথায় ব্যথা দেন কেন? মগের মুল্লুক পেয়েছেন? সুইডেন থেকে ফেরার পর থেকে এমন আচরণ করছেন। এখন তো আবার কথায় কথায় ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ পেয়েছেন। সবসময় শুধু রাগ, ধমক, উলটা-পালটা কথা। কেন ভাই? আপনি কি আমার বয়ফ্রেন্ড, না-কি হাসবেন্ড? বেড়াতে এসেছেন নিজের মতো থাকেন না। অযথা আমার পেছনে কেন লেগে থাকেন? অসহ্য লাগে আপনাকে আমার। আমার আশেপাশেও আসবেন না আর কখনও।”

তাজ ভাই অবাক দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়ালাম না। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সোজা চলে গেলাম দাদুমনির রুমে। নিজেকে সামলে নিয়ে দাদুমনির সাথে গল্প করতে বসলাম। গল্প করতে করতে একসময় দাদুমনির খাটেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল মাগরিবের সময়। আমি উঠে দেখি দাদুমনি নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি বললাম,“আসরের সময় ডাকলে না কেন দাদুমনি?”

দাদুমনি বলল,“ডাকছিলাম। তোর তো ওঠার নামও নাই।”

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের রুমে আসার সময় তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার সামনে পড়লাম। তাজ ভাই কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি গম্ভীর মুখে তাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে নামাজ পড়লাম। তারপর বাবা আমাকে চা খেতে ডাকতে রুমে এল। বাবার সাথে বসার ঘরে এলাম। এসে দেখি তাজ ভাই, শ্রেয়ান ভাইয়া, মেজো কাকা আর আফরা আপুও আছে। আমি গিয়ে আফরা আপুর পাশে বসলাম। আফরা আপু সবাইকে চা দিলো। বাবা আর মেজো কাকা তাদের কাজের বিষয়ে কথা বলছে। আমি চুপচাপ বসে চা খাচ্ছি। শ্রেয়ান ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন ইলোমিলো? কিছু হয়েছে?”

আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,“না ভাইয়া। ঠিক আছি আমি।”

আমি হঠাৎ বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,“আমরা ফিরব কবে বাবা?”

আমার কথায় সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আফরা আপু বলল,“ইলো, তুই চলে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিস! সবসময় তো তুই গ্রামে এলে আর ফিরতেই চাস না। কাকাকে বলে বলে আরও কয়েকদিন থেকে যাস। তাহলে এবার কী হলো?”

মেজো কাকাও বললেন,“তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে মা?”

আমি বললাম,“না কাকা। সমস্যা হবে কেন?”

“তাহলে?”

“এই মাসেই আমার পরীক্ষা কাকা।”

বাবা বলল,“পরীক্ষা নিয়ে তুই আবার এত ভাবতে শুরু করেছিস কবে থেকে?”

শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“আমার মনে হচ্ছে কোনো কারণে তোমার মন খারাপ।”

আমি বললাম,“না ভাইয়া।”

সবার মাঝে তাজ ভাই শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কোনোরকমে চা-টা শেষ করে রুমে গেলাম। ফোন নিয়ে বান্ধবীদের সাথে চ্যাটিং করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আফরা আপু আর অলি এল। আফরা আপু এসেই উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,“ইলো, ঝটপট রেডি হয়ে নে তো।”

আমি প্রশ্ন করলাম,“কেন? কোথাও যাবে?”

“হ্যাঁ, ঘুরতে যাব। তাড়াতাড়ি রেডি হ‌, আমি যাই রেডি হতে।” কথাটা বলেই আফরা আপু দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। তার পেছন পেছন অলিও চলে গেল। আমি ভাবলাম এখন বাইরে থেকে ঘুরে এলে মনটা একদম ভালো হয়ে যাবে। তাই ফোন রেখে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখলাম অলিও রেডি। আফরা আপু এখনও রুম থেকে বের হয়নি। অলি বারকয়েক ডাকার পর আপু বেরিয়ে এল। আপুকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই সন্ধ্যাবেলা বাইরে ঘুরতে যাবে তাতে এত সাজার কী হলো? মেজো কাকিকে বলে আফরা আপু তাড়া দেখিয়ে আমাদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। গেট পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই আমি চোখ বড়ো বড়ো করে সামনে তাকালাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মানে ওনারাও যাবেন। অথচ আফরা আপু আমাকে বলেইনি ওনাদের কথা। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আফরা আপুও দাঁড়িয়ে বলল,“কী হলো?”

আমি বললাম,“আমি যাব না আপু।”

আপু অবাক হয়ে বলল,“যাবি না মানে? রেডি হয়ে রওনা দেয়ার সময় বলছিস যাবি না! কিন্তু কেন?”

“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।”

“হঠাৎ করে তোর শরীরের কী হলো? দেখে তো একদম সুস্থ মনে হচ্ছে।”

“তুমি বুঝতে পারছো না আপু।”

আফরা আপু আমার হাত ধরে বলল,“এমন করিস না বোন। তুই জানিস? তুই চা খেয়ে যখন রুমে চলে গেলি তখন তাজ ভাইয়া নিজেই আমাকে বলল, চল আফরা সবাই মিলে ঘুরে আসি। ভাবতে পারছিস? উনি নিজের ইচ্ছেয় আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছেন। আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। এটা শুধু তোর প্ল্যানের জন্যই সম্ভব হয়েছে। সো, তোকে যেতেই হবে।”

আমি হা হয়ে গেলাম। তাজ ভাই আফরা আপুকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছেন! কিন্তু উনি তো আপুকে পছন্দই করেন না। তাহলে এসবের মানে কী? অদ্ভুত লোক! কখন কী করে ঠিক থাকে না। শ্রেয়ান ভাইয়া উচ্চস্বরে আমাদের বললেন,“ওখানে থেমে আছো কেন তোমরা?”

আফরা আপু মন খারাপ করে বলল,“ইলো যাবে না বলছে ভাইয়া। ওর না-কি শরীর খারাপ লাগছে।”

তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তাজ ভাই গম্ভীর মুখে বললেন,“কী সমস্যা?”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“তোমাকে দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না ইলোমিলো। কী হলো হঠাৎ?”

আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই বললেন,“অযথা কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল।”

আমি বাড়িতে ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললেন। আফরা আপু আর শ্রেয়ান ভাইয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। উনি আমাকে টানতে টানতে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন। আমি হন্তদন্ত হয়ে হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললাম,“আরে, আমি যাব না বললাম না? হাত ছাড়ুন। উফ্, লাগছে তো।”

ততক্ষণে উনি গাড়ির দরজা খুলে আমাকে ঠেলে ভেতরে বসিয়ে দিলেন। আফরা আপু আর অলিও এসে আমার দুপাশে বসে পড়ল। শ্রেয়ান ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে বসল আর তাজ ভাই তার পাশে। গাড়ি চলতে থাকল আর আমি গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। আফরা আপু কনুই দিয়ে আমাকে গুঁতো মেরে বলল,“তোর কী হয়েছে বল তো? এমন করছিস কেন?”

আমি বললাম,“আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না আপু।”

সামনে থেকে তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,“কেন? বিয়ে-শাদী করতে মন চায় না-কি? তাহলে বল, আজই একটা রিকশাওয়ালা খুঁজে বিয়ে দিয়ে দেই।”

ওনার কথা শুনে অলি হি হি করে হেসে উঠল। আমি চোখ পাকিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি আবার বললেন,“বুঝেছি, বুঝেছি। এই আফরা, পরিচিত কোনো রিকশাওয়ালা আছে এখানে? ঠিকানা দে তো। ধরে এনে ওর সাথে বিয়ে দিয়ে দেই।”

আফরা আপু ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“আছে ভাইয়া। কিন্তু তার ঘরে চারটা বউ আছে। ইলো তাহলে পাঁচ নাম্বারে পড়বে।”

আমি এবার আফরা আপুর দিকেও গাল ফুলিয়ে তাকালাম। এদের মিটিমিটি হাসি দেখে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। তাজ ভাই বললেন,“সমস্যা কী? ছোটো বউরা আদর পায় বেশি জানিস না?”

আফরা আপু, অলি আর শ্রেয়ান ভাইয়া এবার একসাথে হুঁ হা করে হেসে উঠল। আমি কটমট চাহনিতে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। শ্রেয়ান ভাইয়া হাসি থামিয়ে বললেন,“ইলোমিলো, তুমি রাগ কোরো না। আজ তোমাকে এক প্লেট বেশি ফুসকা খাওয়াব।”

আমি কোনো কথা বললাম না। গাল ফুলিয়ে বসে বসে এদের তামাশা দেখলাম। প্রায় বিশ মিনিট গাড়ি চালানোর পর শ্রেয়ান ভাইয়া একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢোকার সময় তাজ ভাই কিছুটা পিছিয়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে হাঁটতে নিচু স্বরে বললেন,“নিজে আমাকে একগাদা কথা শুনিয়ে এখন নিজেই গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কোন দুঃখে? এভাবে মুখ ভার করে রাখলে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদব মেয়ে।”

আমি বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। কিছু বলার আগেই উনি দ্রুত পায়ে হেঁটে রেস্টুরেন্টে ঢুকে গেলেন। আমরা একটা টেবিলে বসে পড়লাম। একপাশে আমি, আফরা আপু আর অলি। অন্যপাশে তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া। তাজ ভাই খাবার অর্ডার করলেন। আমি আফরা আপুর সাথে টুকটাক কথা বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এল। আমি খাবার দেখে অবাক হয়ে বললাম,“এত খাবার কে খাবে?”

তাজ ভাই বললেন,“অর্ধেক তুই খাবি আর বাকি অর্ধেক আমরা।”

শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“ভয় পেয়ো না ইলোমিলো। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমরা ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করব। তুমি না পারলে আমি আছি।”

অলি বলে উঠল,“আমিও আছি ইলুপি।”

আমি এবার একটু হেসে বললাম,“হ্যাঁ, তোর মতো পুঁচকি এসব খেয়ে শেষ করবে।”

তাজ ভাই বললেন,“তুই কী? নিজেই তো এক পুঁচকি।”

আফরা আপু বলল,“মেয়েটা এখন বড়ো হয়েছে ভাইয়া। শুধু শুধু খেপান কেন?”

আমরা খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে নিচু স্বরে কিছু কথা বলল, যা আমাদের কানে এল না। আমি আর আফরা আপু অলিকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে খাওয়া শেষ করলাম। খাবার শেষ করতে আমাদের বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি খেয়াল করলাম আমার মনটা এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“ইলোমিলো, তোমার ফুসকা বাকি আছে কিন্তু এখনও। বাইরে একটা দোকান দেখে এসেছি। খাবে?”

আমি চোখ বড়ো করে বললাম,“পেট ফেটে মরে যাব ভাইয়া। পেটে আর একটুও জায়গা নেই।”

শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“আচ্ছা, তাহলে আরেকদিন খাওয়াব।”

তাজ ভাই বিল মিটিয়ে দিলেন। আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করলাম। আফরা আপু সেলফি তুলতে তুলতে অতিষ্ঠ করে দিলো। তবে সময়টা খুব ভালো কাটল। একাকীত্বের সময় আমি সবসময় এমন একটা হাসিখুশি মুহূর্ত চাই। হঠাৎ করে আমার মনে হলো তাজ ভাই আসার পর থেকে আমি এমন মুহুর্তগুলো একটু বেশিই পাচ্ছি। অথচ তার আগে একা একা কতই না আফসোস করতাম। লোকটাকে মনে হয় আমি কোনোদিনও সঠিকভাবে চিনতে পারব না। অজান্তেই আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে আমরা আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরলাম।

চলবে………………….🍁