#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২০
এখন থেকে আমাকে ভার্সিটি দিয়ে আসা আর নিয়ে আসার দায়িত্ব তাজ ভাইয়ের। ওনার সাথে ভার্সিটি যেতে হবে শুনেই আমি বাবার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিলাম। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো সুরাহা হলো না। যমরাজের চোখ পাকানো দেখেই আমায় দমে যেতে হলো। বলা তো যায় না, কখন আবার মাথায় গান ধরে বসে। জীবন বাঁচানো ফরজ। আপাতত নিজের জীবনের কথা ভাবাই উত্তম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাজ ভাইয়ের সাথে ভার্সিটি গেলাম। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম সামনে শ্রেয়ান ভাইয়া দণ্ডায়মান। উনি আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। মিষ্টি হেসে বললেন,“হাই ইলোমিলো। কেমন আছো?”
আমিও হেসে বললাম,“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি?”
“এই তো ভালোই। ক্লাস কখন শুরু হবে তোমার?”
“দশ মিনিটের মধ্যেই।”
“আচ্ছা। ক্লাস শেষ হলে ফুসকা খাওয়াব তোমাকে। রাজি আছো?”
আমি খুশি হয়ে বললাম,“অবশ্যই, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি থাকবেন?”
“আমি তাজের সাথেই আছি। আমাদের কিছু কাজ আছে, সেগুলো সেরে তোমার ছুটির সময় আসব।”
“আচ্ছা। আসি তাহলে।”
তাজ ভাইয়ের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আমি ক্যাম্পাসের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ খেয়াল হলো তাজ ভাইয়ের মুখটা চুপসানো ছিল। আরেকবার দেখার ইচ্ছে হলেও তা পাত্তা না দিয়ে ক্লাসের দিকে ছুটলাম। ক্লাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আনহা আমাকে চেপে ধরল। আর তার একমাত্র কারণ তাজ ভাই। তাজ ভাই আমাকে পছন্দ করেন, এই কথাটা আমাকে বিশ্বাস করাতে ও বদ্ধ পরিকর। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকল না। ক্লাস শুরু হয়ে গেল। আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু ব্রেক টাইমে ক্যান্টিনে গিয়ে বসতেই আবার শুরু হয়ে গেল তাজ ভাইময় আলোচনা। মোহনা তো রীতিমতো তাজ ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে। ফারহা আর ঐশী তাজ ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এদিকে আনহা আমাকে বুঝাতে ব্যস্ত যে তাজ ভাই আমাকে পছন্দ করেন। এদের বিরক্তিকর কথাবার্তা থামানো আমার কর্ম নয়। তাই বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ সিঙাড়ায় কামড় বসালাম। এমন ভাব করলাম যেন আড্ডায় আমার পূর্ণ মনোযোগ আছে। অথচ ওদের কথাবার্তা আমার এক কান দিয়ে ঢুকছে আরেক কান দিয়ে বের হচ্ছে। ঠিক দুপুর দেড়টায় ক্লাস শেষ করে আমি বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলাম। গেটের সামনে এসে তাজ ভাইকে কোথাও চোখে পড়ল না। এদিকে বান্ধবীরা সবাই চলে গেছে। আমি তাজ ভাইকে ফোন করলাম। কিন্তু উনি ফোন তুললেন না। পরপর কয়েকবার ফোন করার পরও উনি ফোন তুললেন না। আমি ভাবলাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় পনেরো মিনিটের মতো ফোন স্ক্রলিং করলাম। তারপর আবার তাজ ভাইকে ফোন করলাম। এবারও রিং হয়ে কেটে গেল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম্বারটা থাকলে তাকে ফোন করতে পারতাম। ধুর! আধা ঘন্টা পার হওয়ার পরও তাদের কোনো খবর নেই। এক জায়গায় একা দাঁড়িয়ে থাকার ফলে কয়েকজন ছেলে অদূরে দাঁড়িয়ে নানা রকম বাজে কথা বলছে। আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম। কিন্তু বখাটে ছেলেগুলোর কথাগুলো এতটাই আপত্তিকর ছিল যে আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। সেই সাথে তাজ ভাইয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ উঠল। অধৈর্য হয়ে বাবাকে ফোন করব ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাজ ভাইয়ের গাড়ি দেখতে পেলাম। বাবাকে আর ফোন করলাম না। তাজ ভাই আমার কাছাকাছি এসে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললেন,“উঠে আয়।”
ওনাকে দেখে আমার রাগটা মাথায় চড়ে বসল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ধুপধাপ পা ফেলে আমি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। তাজ ভাইয়ের পাশের সিটে উঠে বসে সিটবেল্টও বাঁধলাম না। তাজ ভাই বললেন,“সিটবেল্ট বাঁধ।”
আমি ওনার কথা কানেও নিলাম না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। তাজ ভাই আবার বললেন,“কী হলো? কী বলছি শুনছিস না? সিটবেল্ট বাঁধ।”
আমি গাল ফুলিয়ে রাগে ফুঁসছি। বখাটে ছেলেগুলোর কথাগুলো মনে পড়তেই কান্না আসতে চাইছে। তবু শক্ত হয়ে বসে রইলাম। বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখেও বেশ বুঝতে পারলাম তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ তাজ ভাই নিজেই এগিয়ে এসে আমার সিটবেল্ট বেঁধে দিলেন। আমি ফিরেও তাকালাম না। তাজ ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,“শ্রেয়ানের ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ পড়ে গেছে তাই চলে গেছে। একা দাঁড়িয়ে ছিলি? ফ্রেন্ডদের কাউকে বলে দাঁড় করিয়ে রাখতি।”
আমি ওনার কথা শুনেও শুনলাম না। এই মুহূর্তে ওনার কথাগুলো খুব বিরক্তিকর লাগছে। আজ পর্যন্ত কখনও আমায় এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বাবা আমার ছুটি হওয়ার আগেই ভার্সিটিতে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করত। বখাটে ছেলেদের পাল্লায়ও এই প্রথম পড়লাম। তাও শুধু তাজ ভাইয়ের জন্য। ওনার সাথে আর কোনোদিন আসবই না ভার্সিটিতে। আমার ভাবনার মাঝেই তাজ ভাই গান ছাড়লেন। ইংরেজী গান। গাড়ির ভেতরের নিস্তব্ধ পরিবেশে গানের হালকা শব্দও উচ্চশব্দে পরিণত হলো। না চাইতেও গানের লাইনগুলো কানে এল।
I wouldn’t mind being alone
I wouldn’t keep checking my phone
Wouldn’t take the long way home
Just to drive myself crazy
I wouldn’t be losing sleep
Remembering everything
Everything you said to me
Like I’m doing lately
You, you wouldn’t be all
All that I want
Baby I could let go
If I didn’t love you I’d be good by now
I’d be better than barely getting by somehow
Yeah it would be easy not to miss you
Wonder about who’s with you
Turn the “want you” off whenever I want to
If I didn’t love you
If I didn’t love you
I wouldn’t still cry sometimes
Wouldn’t have to fake a smile
Play it off and tell a lie
When somebody asked how I’ve been…..
গানটার মাত্র এক লাইন আমি ঠিকমতো বুঝতে সক্ষম হলাম, If I didn’t love you. এছাড়া পুরো গানটাই আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। অসহ্য হয়ে আমি গানের মাঝপথে এসে হুট করে গান বন্ধ করে দিলাম। তাজ ভাই আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,“অফ করলি কেন?”
আমি এবারও ওনার দিকে তাকালাম না। গাল ফুলিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি ফিরালাম। তাজ ভাই হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষলেন। আমি ভাবলাম হয়তো কোনো প্রয়োজনে ব্রেক কষেছেন। কিন্তু উনি আমার হাতের বাহু চেপে ধরে আমাকে ওনার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,“কী সমস্যা? এমন স্ট্যাচুর মতো বিহেভ করছিস কেন?”
আমি ওনার মুখের দিকে তাকালামও না। রাগটা আবার মাথায় ধপ করে জ্বলে উঠল। আমি ওনার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলাম। উনি আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,“খুব জরুরী একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল তাই লেট হয়ে গেছে। আমি তো আর ইচ্ছে করে লেট করিনি। আর কখনও লেট হবে না। একটু তো দাঁড়িয়েই ছিলি, এরজন্য এত রাগ করা লাগে?”
ওনার কথাটা শুনে আমি তেতে উঠলাম। হুট করে ওনার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠে বললাম,“একটু! আধা ঘন্টাকে আপনার একটু মনে হচ্ছে? শুধু দাঁড়িয়ে থেকে আমি আপনার ওপর ফালতু রাগ দেখাব বলে মনে হয় আপনার? ঐ ছেলেগুলো যে আমাকে ইঙ্গিত করে আজেবাজে কথাগুলো বলল, এটাও কিছু না? আজ পর্যন্ত কোনোদিন তো আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। তাহলে আজ কেন পড়তে হলো? আসলে বাবা বাবাই হয়। তার মতো প্রটেকশন আর কেউ দিতে পারে না। আপনি তো জানেন শুধু ব্ল্যাকমেইল করতে। দায়িত্ব পালন আপনার কর্ম নয়। তাহলে যেচে দায়িত্ব নিতে যান কেন?”
কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাজ ভাইয়ের কুঁচকানো কপাল আরও একটু কুঁচকে গেল। মুখটাও গম্ভীর হয়ে গেল। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“কোন ছেলেরা?”
আমি ওনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। চোখের পানি মুছতে মুছতেই আবার গড়িয়ে পড়ল। তাজ ভাই মিনিট দুয়েক শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর একহাতে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি সরে যেতে চেয়েও পারলাম না। উনি আরেক হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বললেন,“কাঁদে না। আমার সত্যিই খুব ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল। আগে আসার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পসিবল হয়নি। আর কোনোদিনও এমন ভুল করব না, প্রমিস।”
আদুরে কন্ঠ শুনে আমার কান্নার বেগ আরও একটু বেড়ে গেল। নিঃশব্দ কান্নায় শব্দ যোগ হলো। তাজ ভাই একইভাবে বললেন,“প্রমিস করলাম তো বাবা। এবার থাম না। আচ্ছা, ফুসকা খাবি?”
আমি একইভাবে কেঁদে চলেছি। তাজ ভাই এবার আরেকটু আদুরে গলায় বললেন,“ইলোনি, এত কাঁদলে মাথা ঘুরবে। ঐ ছেলেগুলোকে আমি উচিত শিক্ষা দিব। ওকে? আচ্ছা শোন, আমরা এখন বাসায় ফিরব না। একটা জায়গায় যাব চল।”
তাজ ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে দুহাতে আলতো করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,“প্লিজ স্টপ ক্রায়িং। চোখ থেকে আর এক ফোঁটা পানিও যেন না গড়ায়।”
আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে উনি আবার গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি সত্যি সত্যিই কান্না থামিয়ে দিলাম। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলাম। গাড়ি কোনদিকে যাচ্ছে তাও দেখলাম না। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামল। আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলাম এটা অন্য রোড। তাজ ভাইয়ের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি বললেন,“একটু বস, আমি এক্ষুনি আসছি।”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। উনি গাড়ি থেকে নেমে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। প্রায় দশ মিনিট পর বড়োসড়ো কয়েকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। গাড়িতে উঠে ব্যাগগুলো পেছনের সিটে রেখে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি অবাক হয়ে ব্যাগগুলোর দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। তাজ ভাই নিশ্চুপ ড্রাইভ করে কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামালেন। আমাকে নামতে বলে উনি ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে নেমে পড়লেন। আমিও গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম কোথায় এসেছি। তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? আয়।”
আমি ওনাকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলাম। সামনের একটা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একতলা একটা বিল্ডিং চোখে পড়ল। বিল্ডিংটা দেখতে অনেকটা স্কুলের ন্যায়। কিন্তু সামনের খোলা উঠোনে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা-পুরুষকে বেতের আসবাবপত্র বানাতে দেখলাম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন দু একজন। বিল্ডিংয়ের মাঝ বরাবর ওপরের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম এটা বৃদ্ধাশ্রম। হঠাৎ এখানে কেন এলাম বুঝতে পারলাম না। তাজ ভাই এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে ডেকে বললেন,“দাদুরা, কেমন আছো?”
বৃদ্ধরা তাকিয়ে তাজ ভাইকে দেখে হেসে ফেললেন। একজন কাঁপা গলায় বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি দাদু। তুমি কেমন আছো?”
“এই তো ভালো। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?”
আরেকজন বললেন,“নাহ্। হাতের কাজটুকু শেষ কইরা খামু।”
তাজ ভাই হাতের ব্যাগগুলো দেখিয়ে বললেন,“আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। কাজ পরে কোরো। আগে খেতে চলো।”
তাজ ভাই বলা মাত্র সবাই হাতের কাজ ছেড়ে উঠে গেলেন। একজন বৃদ্ধা মহিলা ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বললেন,“দুই দিন পর পর এত টাকা খরচ করে কী পাও ভাই?”
তাজ ভাই জবাবে শুধু মুচকি হাসলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে ভেতরে চললেন। আমি রোবটের মতো চুপচাপ ওনাকে অনুসরণ করে চলেছি। ভেতরের একটা রুমে ঢুকে আরও কয়েকজন বৃদ্ধ মহিলা-পুরুষ দেখলাম। তাজ ভাইকে দেখেই সবাই একগাল হেসে কুশল বিনিময় করলেন। তাজ ভাই সবাইকে বসতে বললে সবাই পাটি বিছিয়ে বসে পড়লেন। আমি শুধু অবাক হয়ে তাজ ভাইকেই দেখছি। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। তাজ ভাই আমাকে বললেন,“নে, সবাইকে এখান থেকে একটা করে প্যাকেট দে।”
আমি ওনার কথামতো ওনার হাত থেকে একটা করে প্যাকেট নিয়ে একজন একজন করে সবাইকে দিলাম। সবাই খুব উৎসাহের সাথে প্যাকেট খুলে বিরিয়ানি দেখে আরও খুশি হলেন। বৃদ্ধরা আমাকে আর তাজ ভাইকেও খেতে বসতে বললেন। কয়েকটা প্যাকেট বাড়তি ছিল তাই তাজ ভাই বিনা বাক্যে আমাকে নিয়ে পাটির একপাশে বসে পড়লেন। আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে উনি নিজেও নিলেন। আমি খাওয়া ভুলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। তাজ ভাই বিরিয়ানি মুখে তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“খাচ্ছিস না কেন? কোনো সমস্যা?”
আমি ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে তাজ ভাই আর বাকি সবার গল্প শুনে বুঝতে পারলাম উনি মাঝে মাঝেই এখানে আসেন। এই বৃদ্ধদের খাবার, জামা-কাপড় দেন। আবার কখনও বসে বসে গল্পও করেন। আমার বিস্ময় যেন বেড়েই চলেছে। উনি নিজের মুখে বলেছেন উনি একজন মাফিয়া। তাহলে এসব করে কী পান? করেনই বা কেন? সত্যিই ওনাকে বুঝা দায়। খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে একজন মহিলা বলে উঠলেন,“তা এটাই তোমার পিচ্চি না-কি দাদু?”
তাজ ভাই কোনো জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলেন। আমি ভ্রুকুটি করে অবাক দৃষ্টিতে একবার ঐ মহিলার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। আরেকজন বৃদ্ধ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“ও মেয়ে, তোমার কপাল তো পাঁচ আঙুল গো। ভাগ্য কইরা এমন সোনার টুকরা পাইছো।”
আমি বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বললাম,“আমার কপাল তো পাঁচ আঙুল না দাদু। আর তোমাদের রূপার টুকরোর সাথে আমার ভাগ্যের কী সম্পর্ক?”
বৃদ্ধ শব্দ করে হেসে বললেন,“সাধে কি আর তোমারে পিচ্চি কয়? এইবার বুঝলাম।”
আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনও মুচকি হাসছেন। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম,“আপনি ওনাদের কাছে আমার কথা কী বলেছেন বলুন তো?”
উনি আমার মতোই ফিসফিস করে বললেন,“বলেছি আমাদের একটা মাথামোটা পিচ্চি আছে, যে খাওয়া আর ঘুম ছাড়া কাজের কাজ কিছুই জানে না।”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। এখানে ঝগড়া করা সমীচিন হবে না ভেবে চুপচাপ খাওয়া শেষ করলাম। পুরোটা সময় বৃদ্ধরা আমার সাথে যেটুকু গল্প করলেন তার পুরোটাই তাজ ভাইয়ের প্রশংসা। আমি শুধু নীরব বিস্ময় নিয়ে শুনে গেলাম। বৃদ্ধদের সবার তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে তাজ ভাইকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা উঠে গেলাম। বৃদ্ধরা তাজ ভাইয়ের সাথে আরও কিছু সময় গল্প করতে চাইলেও তাজ ভাই হাসিমুখে বললেন,“আজ আর থাকতে পারছি না দাদুরা। সময় করে আবার আসব।”
বৃদ্ধরা আমার আর তাজ ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে আমাদের বিদায় জানালেন। বৃদ্ধাশ্রম থেকে যখন বেরিয়ে এলাম তখন আমার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। চমৎকার কিছু সময় কাটিয়েছি আজ। এরজন্য যমরাজের ধন্যবাদ প্রাপ্য হলেও আমি দিব না। কারণ এটা ওনার আজকে করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত। গাড়িতে উঠে তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“সময়টা কেমন ছিল?”
আমি উৎফুল্ল কন্ঠে বললাম,“দারুণ! আমার এখন ইচ্ছে করছে একটা বৃদ্ধাশ্রম করতে।”
তাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,“আচ্ছা। তারপর?”
“তারপর সেখানে যেসব মায়েদের তাদের সন্তানরা অবহেলা করে তাদের আশ্রয় দিব। বৃদ্ধাশ্রমটা হবে আম্মুর নামে।”
তাজ ভাই হেসে বললেন,“বেশ ভালো ইচ্ছে। তো ইচ্ছেটা পূরণ করবি কবে?”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,“তা তো জানি না। আচ্ছা চলুন এক কাজ করি। আপনি আর আমি মিলে বৃদ্ধাশ্রমটা করি। তাহলে সেটা হবে ফুপি আর আম্মুর নামে।”
তাজ ভাই একটু ভেবে বললেন,“ওকে, ভেবে দেখব।”
আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,“এত দেরি হয়ে গেল অথচ বাবা তো একবারও ফোন করল না। আমি বাবাকে ফোন করি আগে।”
তাজ ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,“রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি।”
ওনার কথা শুনে আর ফোন বের করলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললাম,“মাফিয়ারা এত ভালো হয় না-কি?”
তাজ ভাই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,“সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে তুই ইনডিরেক্টলি আমাকে ভালো মানুষ বলছিস।”
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“মোটেও না। আমি বলতে চাইছি মাফিয়া হয়ে এত ভালো মানুষের মতো অভিনয় করেন কীভাবে?”
এবারও উনি হেসে বললেন,“তোর মোটা মাথায় এসব ঢুকবে না পিচ্চি। তুই বরং ললিপপ খা।”
এই মুহূর্তে আমি রাগতে চাই না অথচ এই লোক আমাকে না রাগিয়ে শান্তি পান না। তবু রাগটাকে ধামা চাপা দেয়ার চেষ্টা করে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। এই লোকের সাথে সুন্দর করে কথা বলাই বৃথা।
চলবে…………………..🍁
#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২১
সন্ধ্যার পর একটু আয়েশ করার আশায় বিছানায় সটান শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যমরাজের তো আর আমার আয়েশ সহ্য হয় না। সে এসে আমাকে টেনেহিঁচড়ে তুলে বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। তার মহান বাণী, এক্সামে ফেল করলে খবর আছে। এদিকে আমি বই হাতে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুনগুনিয়ে পড়ে চলেছি। শয়তানটা আমার সামনেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে, বিধায় নড়াচড়া করাও কষ্টকর। কোথায় ভেবেছিলাম গ্রাম থেকে এসেই ওনাকে একটু শিক্ষা দিব। অথচ হচ্ছে তার উলটোটা। গানের ভয়ে ওনাকে শিক্ষা দেয়ার প্ল্যানটা ফ্লপ হলো। অন্যকিছু ভাবতে হবে। দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও আমার মাথায় চলছে অন্যকিছু। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল তাজ ভাইয়ের ধমকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠে বললেন,“গুনগুন করে মন্ত্র জপছিস? ঠিকমতো পড়।”
আমি চমকে উঠে নড়েচড়ে বসলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম,“অনেক পড়েছি তো। আর ইচ্ছা করে না। ”
তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ল্যাপটপে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,“চা নিয়ে আয়।”
আমি অলস ভঙ্গিতে বললাম,“আমি?”
“তুই যে আমার এসিস্ট্যান্ট, এর মাঝেই ভুলে বসে আছিস? চুপচাপ গিয়ে চা কর।”
“খালাকে বলি?”
“ভালোয় ভালোয় কথা শোন।”
এই ঘাড়ত্যাড়া লোক যে আমাকে খাটিয়ে ছাড়বে তা স্পষ্ট। তাই কথা না বাড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে চললাম চা করতে। দরজা পর্যন্ত যেতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“শোন।”
আমি পেছন ফিরে তাকাতেই আবার বললেন,“এদিকে আয়।”
আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিছানার পাশে দাঁড়াতেই উনি আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজে বিছানা থেকে নেমে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছি। উনি হঠাৎ আমার মচকে যাওয়া পা-টা নিজের হাঁটুর ওপর রেখে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষণ করতে লাগলেন। আমি নড়েচড়ে উঠতেই উনি প্রশ্ন করলেন,“ব্যথা আছে এখনও?”
আমি ছোটো একটা শব্দ করলাম,“উঁহু।”
উনি আমার পায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“যা।”
আমি চুপচাপ উঠে চলে গেলাম। রান্নাঘরের সামনে এসে দেখলাম মারজিয়া খালা চলে যাচ্ছেন। আমি চুপচাপ চা করতে লেগে পড়লাম। কাপে চা ঢালার সময় তাজ ভাই এসে উপস্থিত। পেছন থেকে বললেন,“এতক্ষণ লাগে চা করতে।”
আমি বিড়বিড় করে বললাম,“নিজে করে খেতে পারেন না? হুকুম জারি করায় পটু।”
কথাটা এতটা আস্তে বললাম যে ওনার কান অবধি পৌঁছল না। এক কাপ চা ওনার দিকে এগিয়ে ধরতেই উনি বললেন,“শ্রেয়ান এসেছে। ওর জন্যও নিয়ে আয়।”
উনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দুই কাপ চা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িংরুমে যেতেই শ্রেয়ান ভাইয়া একগাল হেসে বললেন,“সো সরি ইলোমিলো। ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল তাই তোমাকে ফুসকা খাওয়ানো হলো না।”
আমি দুজনের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললাম,“সমস্যা নেই ভাইয়া। অন্য একদিন খাব।”
“অন্য একদিন না। আজই চলো। এখন তো ফ্রী আছি।”
তাজ ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললেন,“এখন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“হ্যাঁ। কেন? কোনো প্রবলেম আছে?”
সন্ধ্যাবেলা বাইরে থেকে ঘুরে আসার চান্সটা আমি কোনোভাবেই মিস করতে চাই না। তাই তাজ ভাই কিছু বলার আগেই আমি ফট করে বলে উঠলাম,“একদম না। কোনো সমস্যা নেই। আমি যাব।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“তাহলে রেডি হয়ে আসো। তিনজন মিলে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরব।”
তাজ ভাই বললেন,“মামু আসার সময় হয়ে গেছে।”
আমি বললাম,“বাবাকে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আপনারা চা খান, আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি।”
তাজ ভাই হয়তো আরও কিছু বলতেন। তাই ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে রুমে চলে এলাম। আমাকে রেডি হতে দেখে জেমি চোখ বড়ো করে মিয়াও মিয়াও গান শুরু করে দিলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,“ফুসকা খেতে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তুই চুপচাপ ঘুমা।”
ও কী বুঝল কে জানে? ধপ করে শুয়ে পড়ল। আমি মৃদু শব্দ তুলে হেসে ফেললাম। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে এলাম। এরমধ্যে বাবাকেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। আমি গিয়ে দেখলাম তাজ ভাইও রেডি, কিন্তু মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওনার যাওয়ার ইচ্ছা নেই তবু যাচ্ছেন। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম পায়ে হেঁটে। কারণ আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি সন্ধ্যাবেলা গাড়ি নেয়ার দরকার নেই। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগবে। তাজ ভাই আপত্তি জানালেও শ্রেয়ান ভাইয়া থামিয়ে দিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমার অনেক কথা হলো। কিন্তু তাজ ভাই নিশ্চুপ ছিলেন। প্রায় বারো মিনিট হাঁটার পর একটা ফুসকার দোকানে ঢুকলাম। তাজ ভাই খাবেন না তাই শ্রেয়ান ভাইয়া দুই প্লেট ফুসকা অর্ডার করলেন। আমি আর শ্রেয়ান ভাইয়া দারুণ উল্লাসে ফুসকা খেলাম আর তাজ ভাই পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে অবশ্য আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়েছেন। কিন্তু আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে হাসি-গল্পে ফুসকা শেষ করেছি। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর শ্রেয়ান ভাইয়া প্রশ্ন করলেন,“আরেক প্লেট খাবে?”
আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই কড়া গলায় বললেন,“একদম না। এক প্লেট খেয়েছে তাতেই হবে। বেশি খেলে পরে শরীর খারাপ হবে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“ঠিক আছে। আর খেতে হবে না ইলোমিলো। আরেকদিন আবার খাব।”
আমি চুপসানো মুখে মাথা নাড়লাম। ফুসকার দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার মাঝখানে আমি হাঁটছি। আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে গল্পে মেতে উঠেছি। কিন্তু তাজ ভাই প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলছেন না। সাধে কি আর বলি এই লোকের জন্মের পর ফুপি তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছে? শ্রেয়ান ভাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,“ইলোমিলো, আইসক্রিম খাবে?”
আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“তাজ, চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
তাজ ভাই বললেন,“আমি খাব না।”
“কিছুই খাবি না?”
“উঁহু।”
“আচ্ছা, তাহলে এমনিতেই চল।”
আইসক্রিম পার্লারটা রাস্তার বিপরীত পাশে। তাই রাস্তা পার হয়ে তবেই যেতে হবে। আমরা তিনজন রাস্তা পার হতে ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই আমার হাত ধরার জন্য নিজের হাতটা বাড়েতেই আমার অপর হাতটা শ্রেয়ান ভাইয়া ধরে ফেললেন। উনি অবশ্য তাজ ভাইকে খেয়াল করেননি। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি শান্ত দৃষ্টিতে শ্রেয়ান ভাইয়ার মুঠোয় বন্দি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্রেয়ান ভাইয়া তাড়া দিতেই আমি ওনার সাথে রাস্তা পার হলাম। তাজ ভাইও পেছন পেছন চলে এলেন। আমরা আইসক্রিম পার্লারে ঢুকলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া পুরো এক বক্স আইসক্রিম কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি সেখান থেকে একটা আইসক্রিম বের করে খেতে শুরু করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে ধরতেই উনি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,“আমাকে এখন যেতে হবে ইলোমিলো। তুমি খাও এটা।”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“সবসময় এত তাড়া দেখান কেন আপনি? মাফিয়াগিরি ছাড়া কী আর এত কাজ আপনার?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার কথায় কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন। উনি অবাক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালেন। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি জেনে গেছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া মাথা চুলকে বললেন,“তুমি এসব………..।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শেষ করতে না দিয়েই তাজ ভাই বললেন,“তোর লেট হয়ে যাচ্ছে শ্রেয়ান। এক মিনিট, তুই বাইক আনিসনি কেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“এমনিতেই। আমি আসলে এমনিতেই বাইরে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ইলোমিলোকে ফুসকা খাওয়াতে পারিনি তাই চলে এসেছি।”
আমি উৎসুক হয়ে বললাম,“আপনি বাইক চালান? কই? একদিনও তো দেখলাম না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“পরেরবার তোমাকে পিছনে বসিয়ে বাইক চালাব, তখন দেখো।”
আমিও হেসে ফেললাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদেরকে বিদায় জানিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে গেলেন। এবার শুধু আমি আর স্বয়ং যমরাজ। আমি আইসক্রিম খেতে খেতে আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল। কারণ যমরাজ আমার দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণ বুঝতে না পেরে আমি এলোমেলো দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,“কী হয়েছে?”
উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই আছেন। আমি হাতের আধখাওয়া আইসক্রিমটা ভয়ে ভয়ে ওনার দিকে এগিয়ে ধরে বললাম,“আইসক্রিম খাবেন?”
উনি সঙ্গে সঙ্গে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেললেন। উনি আমার হাতটা এতটা জোরে চেপে ধরেছেন যে আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। হাতের আইসক্রিমটুকুও পড়ে গেল। উনি দাঁতে দাঁত পিষে কঠিন গলায় বললেন,“খুব ফুসকা খাওয়ার শখ না? খাওয়াচ্ছি তোকে ফুসকা। চল, দেখি তুই কত ফুসকা খেতে পারিস।”
আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে আবার উলটো পথে পা বাড়ালেন। আমি থামার চেষ্টা করেও পারলাম না। উলটো আমার অপর হাতের আইসক্রিমের বক্সটাই রাস্তায় পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,“আরে, আমার আইসক্রিম পড়ে গেছে। থামুন, আমার আইসক্রিম।”
উনি থামলেন না। আমার সাধের আইসক্রিমের দুঃখে শয়তানটার মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করছে। উনি গিয়ে থামলেন সেই ফুসকার দোকানে। কিন্তু আমার হাত ছাড়লেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি দোকানিকে বললেন,“মামা, পাঁচ প্লেট ফুসকা দিন তো।”
আমি হা করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,“পাঁচ প্লেট ফুসকা কে খাবে?”
উনি বাঁকা হেসে বললেন,“কেন? তোর না খুব ফুসকা খাওয়ার শখ? অবশ্যই তুই খাবি।”
আমি চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে বললাম,“কী? আমি এইমাত্র ফুসকা আর আইসক্রিম খেয়েছি। এতগুলো ফুসকা খাওয়ার মতো জায়গা নেই পেটে।”
“তবুও খাবি।”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,“পারব না। আপনি তো আমাকে ফুসকা খেতে দিতেই চান না। তাহলে এখন এমন করছেন কেন?”
“কেমন করছি? কখনও খেতে দিতে চাই না বলেই তো এখন মনভরে খাওয়াব।”
শয়তানটার মাথায় আবার কোন শয়তান চেপেছে আল্লাহ্ জানে। আমি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললাম,“আমি খাব না, বাড়ি যাব। হাত ছাড়ুন, লাগছে।”
উনি আমার হাতটা আরেকটু চেপে ধরে ধমকে উঠে বললেন,“আমি ধরতে না ধরতেই ছাড়ুন ছাড়ুন শুরু হয়ে গেছে। আর শ্রেয়ান যখন ধরল তখন? তখন খুব ভালো লেগেছিল বুঝি?”
আমি হতবিহ্বল হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কী বললেন উনি? শ্রেয়ান ভাইয়া তো আমার ভালোর জন্যই হাত ধরেছিলেন। অথচ উনি এমনভাবে বলছেন যেন নিজের বন্ধুকেই হিংসা করছেন। আমি বিস্ময় নিয়েই বললাম,“উনি তো আমাকে রাস্তা পার করে দেয়ার জন্য হাত ধরেছিলেন।”
তাজ ভাই আবার ধমকে উঠলেন,“কেন ধরবে? রাস্তা পার করানোর জন্য আমি ছিলাম না? ও কেন ছুঁবে? কোন অধিকারে ছুঁবে?”
আমি মনে মনে বললাম,“তো আপনি কোন অধিকারে ছুঁয়েছেন?” কিন্তু কথাটা কন্ঠনালি দিয়ে বেরোনোর আগেই গিলে ফেললাম। নইলে যে এই যমরাজ আমাকেই আস্ত গিলে খাবে। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে অসহায়ের মতো মুখ করে বললাম,“ব্যথা পাচ্ছি।”
উনি শক্ত মুখে বললেন,“আর কোনোদিন কাউকে ছুঁতে দিবি?”
আমি দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। উনি আবার বললেন,“মনে থাকবে?”
আমি এবার ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। উনি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,“যদি না থাকে?”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। হাতের ব্যথায় ইতোমধ্যে আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছে। উনি আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেন,“আজকের পর যদি নিজেকে কোনো ছেলেকে ছুঁতে দিয়েছিস, একদম শুট করে দিব। মাইন্ড ইট পিচ্চি।”
উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি অপর হাত দিয়ে ঐ হাত ঘষতে লাগলাম। হাতের কব্জি লাল হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে। চোখে টলমলে পানি নিয়ে মুখ কালো করে আমি অন্যদিকে মুখ ফিরালাম। তাজ ভাই দোকানিকে বললেন,“মামা, ফুসকা দেয়ার দরকার নেই। যারা অপেক্ষা করছে তাদের দিয়ে দিন। অন্য একদিন আবার আসব।”
দোকানি তাজ ভাইয়ের কথায় কী উত্তর দিলেন তা আমার কানে এল না। ততক্ষণে আমি দিক-বিদিক ভুলে সোজা হাঁটা শুরু করেছি। কিন্তু কয়েক পা সামনে এগোতেই হঠাৎ আমার বাঁ হাতটা কেউ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। আমি খুব ভালো করেই জানি এটা কার কাজ। তাই পাশ ফিরে না তাকিয়েই হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাজ ভাই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে পাশাপাশি হাঁটছেন। আমি কিছুক্ষণ হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে তারপর নিজেই থেমে গেলাম। থমথমে মুখে নিঃশব্দে হেঁটে চললাম। একসময় তাজ ভাই নীরবতা ভেঙে বললেন,“পিচ্চিদের এত রাগ ভালো না। ভুল করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।”
ওনার কথায় রাগটা আরও বেড়ে গেল। এখানে আমার ভুলটা কোথায়? আমি তো একা রাস্তা পার হতে পারি না। শ্রেয়ান ভাইয়া তো শুধু হেল্পই করেছে, আর তো কিছু করেননি। শ্রেয়ান ভাইয়া ছুঁতে না পারলে উনি কেন ছোঁবেন? এতে কোনো ভুল নেই? হাঁটতে হাঁটতে উনি আমাকে খেপানোর জন্য অনেক কথাই বললেন। কিন্তু আমি নিশ্চুপ ছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা টিভিতে খবর দেখছেন। সামনের টি-টেবিলে একগাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাবা হেসে বলল,“আমি তো ভাবলাম তোরা ডিনার করে ফিরবি।”
তাজ ভাই পাশের সোফায় ধপ করে বসে বললেন,“নাহ্। ডিনার বাড়িতেই করব।”
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। রুমে এসেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জেমি আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আমার গায়ের সাথে ঘষাঘষি শুরু করে দিলো, তবু চোখ খুললাম না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকে কিছু একটা ভেবে উঠে বসলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে আফরা আপুকে কল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পরই আফরা আপু ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলল। আমি বললাম,“কেমন আছো আপু?”
ফোনের ওপাশ থেকে আফরা আপু বলল,“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো। তুমি আমাদের বাড়িতে আসছো কবে?”
“আমি ভেবেছি তোর এক্সামটা শেষ হওয়ার পর যাব।”
“কেন?”
“আমি গেলে তোর পড়াশোনায় ডিস্টার্ব হবে।”
“আমি কখনও এমনটা বলেছি না-কি?”
“তুই বলবি কেন? আমি নিজেই ঠিক করেছি। তোর এক্সাম শেষ হলেই আমি চলে যাব।”
আফরা আপুকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারলাম না। তার এক কথা, সে আমার এক্সামের পরেই আসবে। কোথায় ভাবলাম আপু এলে তাকে দিয়ে শয়তানটাকে একটু শিক্ষা দেওয়াব, তা আর হলো না। রাগে দুঃখে ফোনটা ছুঁড়ে মারলাম বিছানার একপাশে। তারপর কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলাম। পরীক্ষার চিন্তাটা মাথায় কড়া নাড়তেই বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলাম না। বই সামনে রেখে ফোনে ডুব দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর বইয়ের পাতায় একটু উঁকি ঝুঁকি মারলাম। এভাবেই সময় পার করে রাত দশটা বাজালাম। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না। আমার পূর্ণ মনোযোগ তখন ফোনের স্ক্রিনে। হঠাৎ কেউ আমার ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। আমি হন্তদন্ত হয়ে ফিরে তাকাতেই তাজ ভাইয়ের রাগত মুখটা চোখে পড়ল। ওনাকে দেখে আমি আর কথা বাড়ালাম না। মুখ ফিরিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই বললেন,“ডিনার করতে চল।”
আমি কোনো কথা বললাম না। চুপচাপ বিছানার দিকে পা বাড়ালাম। তাজ ভাই এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন,“কথা শুনতে পাচ্ছিস না? ডিনার করতে চল।”
আমি ওনার দিকে না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বললাম,“ক্ষুধা নেই।”
উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,“জিজ্ঞেস করিনি তোকে। চুপচাপ খেতে চল।”
খাবার টেবিলের সামনে এসে আমি চুপ মেরে গেলাম। কারণ সামনে বাবা বসে আছে। বাবার প্রশ্নের মুখে পড়তে চাই না বিধায় বিনা বাক্যে খেতে বসলাম।
চলবে…………………….🍁