#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ১৬
-ভাবিজান,ভাবিজান উঠেন। আপনার কি শরীর খারাপ?
চুমকির ডাকে নড়েচড়ে উঠলো তুরা, তবুও চোখ খুলার নাম গন্ধ নেই দেখে চুমকি বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠলো
-ও ভাবিজান,, আর কত ঘুমাবেন!
চুমকির ফ্যাসফ্যাসে গলার চেঁচামেচি শুনে ধরফরিয়ে উঠলো তুরা।
-ক কে? কি হয়েছে?
-আমি ভাবিজান,চুমকি
ঘুমের ঘোরে চুমকির চেঁচানিতে উঠে খানিকটা চমকে গেলেও অল্প কিছু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো সামনে দাঁড়ানো হাস্যজ্বল চেহারার চুমকির দিকে
-ওহ তুমি,,কিছু হয়েছে কি?
-না ভাবিজান কি হইবো। আপনি সেই দুপুরে এসে যে ঘুম দিলেন বিকাল পেরিয়ে যাচ্ছে তাও উঠার নাম নেই দেখে আপনারে একটু ডাকতে এলাম
এটাকে ডাকা বলে? এভাবে মাইকের মতো গলা ফাটিয়ে ডাকাকে একটু ডাকা বললে বেশি ডাকা কোনটা। মেয়েটা ভারি অদ্ভুত। তুরা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে ছোট করে ওহ বলে ওয়াসরুমের দিকে হাঁটা ধরলো। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় আহান বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই তুরা দৌড়ে ভেতরে চলে এসেছিলো সে। আর পেছনে দেখেনি। বাড়ি এসে গোসল করে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছিলো। সেই ঘুম ভাঙলো চুমকির ডাকাডাকিতে, ফ্রেশ হয়ে মুখটা মুছেই ঘর থেকে বেরোলো তুরা। চুমকি মেয়েটা ঘরে নেই, তাকে ডেকে তুলেই আবারও উধাও হয়ে গেছে, ভীষণ চটপটে মেয়ে দুদন্ড স্থির বসে নাহ। সিড়ি বেয়ে নেমে এলো তুরা ডাইনিং রুমে আপাতত কেও নেই সোফার সাইড থেকে টিভির শব্দ আসছে। সেখানে পুরোনো মিউজিক সিস্টেমের গান বাজছে ‘ও আমার বন্ধু গো চিরসাথী পথচলা’ তুরা উঁকি দিয়ে দেখলো চুমকি বত্রিশ ইঞ্চির স্ক্রিনের একদম সামনে বসে হা করে অপলক চেয়ে আছে, টিভির পর্দায় চলছে সালমান শাহ আর মৌসুমির জনপ্রিয় হিট সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। চুমকি মেয়েটা বাংলা সিনেমা প্রচুর দেখে, বাড়ির কাজের বাইরে যেটুকু সময় পাই তুরা চুমকিকে বাংলা সিনেমা নিয়েই বসে থাকতে দেখে।
সেদিকে আর মাথা দিলনা তুরা, পেটের ভেতর খিদেই ডাকাডাকি শুরু হয়েছে, সেই সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছে। তাই চুপচাপ খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খেয়ে নিলো। খাবার শেষে প্লেট ধুয়ে হাত মুছে বেরিয়ে দেখলো বিকেল প্রায় পাঁচটা। নিচে কেও ই নেই।
রুবি এই সময়টাতে হাঁটতে বেরোয়। মিনু ফুফুর দুপুরের খাবার খেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস আছে, দিদুন তো হাঁটুর ব্যাথার কারণে খুব বেশি বেরই ও না, আর রাইমা গিয়েছে তার কোনো এক বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াতে। তাই আপাতদৃষ্টিতে তুরা এখন একাই। পায়চারি করতে করতে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকটাই এলো। মাঝের কয়দিন আসা হয়নি এখানে। হেলে যাওয়া সূর্যমুখীর গাছগুলো বেশ তাজা হয়েছে, ফুল ও ফুটেছে বেশ অনেক গুলো। তুরা হাঁটতে হাঁটতে আরও ভেতরে ঢুকলো বাগানটার,ফুলগাছ গুলোতে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলো। চোখ আটকে গেলো সামনের গাছটাতে, বেশি বড় না তবে ছোটও না, মাঝারি সাইজের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, লাল টকটকে ফুলগুলোতে ভর্তি ডালপালা গুলো ছড়িয়ে আছে, আহানের রুমের বারান্দার একদম সামনে হওয়ায় বেশ কয়েকবার দেখেছিলো এই গাছটা। তবে কাছে এসে দেখা হয়নি
-ভাবিজান আপনি এখানে কি করেন?
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকালো তুরা, সামান্য হেসে বললো
-কিছু না চুমকি এমনেই গাছ গুলো দেখছিলাম।
-এই বাগানটা ভাইজানের খুব শখের জানেন, অল্প কয়েকটা গাছ রাইমা আপা লাগাইলেও বেশিরভাগ ই ভাইজানের লাগানো। উনি নিজে হাতে পরিচর্যা করে এগুলোর।
আপনমনেই বলতে শুরু করলো, চুমকি। কৃষ্ণচূড়া গাছের পেছনের দিকে দেখিয়ে বললো
-এই যে এই গোলাপ গুলোও ভাইজান লাগিয়েছে, লাল গোলাপ ভাইজানের অনেক পছন্দের।
তুরা চুপচাপ হেসে চুমকির কথা গুলো শুনছে, চুমকি এবার তুরার কাছে এসে বললো
-আপনার আর ভাইজানের বিয়েটা তো এমন হুট করেই হয়েছে, তা ভাইজান আপনারে নিশ্চয় অনেক ভালোবাসে? অবশ্য বাসবেই না কেনো,আপনে যেই সুন্দরী আমারই তো তাকাই থাকতে মন চাই
একদমেও হড়বড়িয়ে বললো চুমকি। তুরা চুমকির এতগুলো কথায় বিরক্ত হয়নি তবে কেনো যানি হাসি পেলো খুব। মৃদু হেসে জবাব দিলো
-আমি এত সুন্দর কই,আর পাঁচটা মেয়ের মতই তো আমার চেহারা
-এমা কি কন,আপনি জানেন আপনারে কত সুন্দর লাগে, ভাইজান যেমন নায়কের মতো আপনিও দেখতে একদম নায়িকা,এক্কেরে সালমান শাহ আর মৌসুমির জুটি।
বলেই গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। তুরাও হেসে দিলো চুমকির কথা বলার ভঙ্গি দেখে। চুমকির এটা ওটা বলার মাঝেই তুরা পেছন ঘুরে বললো
-চুমকি তুমি একটা মোটা দড়ি আর কাঠের তক্তা বা এইরকম কিছু এনে দিতে পারবে?
-কেনো পারবো না ভাবিজান, আপনে দাঁড়ান এক্ষুনি আনতাছি
বলেই দুলতে দুলতে চলে গেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটা দড়ি আর কাঠের তক্তা এনে হাজির হলো।
-এই নেন ভাবিজান, কিন্তু এইগুলা দিয়ে আপনি করবেন কি?
-দোলনা বাধবো
বলেই গাছটার নিচে এসে একদম নিচু হওয়া ডালটার সাথে দড়িটা বাধানোর চেষ্টা করল,কিন্তু ডালটা তুলনামূলক নিচু হলেও তার উচ্চতা অনুযায়ী বেশ উঁচু, তাই বারবার লাফিয়েও নাগাল পেলো না তুরা।
-ভাবিজান আপনে এক মিনিট খাড়ান আমি এক্ষুনি রান্নাঘর থেইকা টুল আনতাছি
বলেই আবারও গা দুলিয়ে চলে গেলো চুমকি,তুরা ঘাড় উচু করে তাকিয়ে আছে গাছটার দিকে, তার উচ্চতা যে বেশিনা সেটা সেও জানে, কিন্তু এখন নিজেকে একটু বেশিই খাটো মনে হচ্ছে। বেশ বিরক্ত হলো তুরা, জল্লাদ লোকটার গাছ জল্লাদটার মতোই খাম্বা হয়েছে, বলে আবার লাফঝাপ দিয়ে ডাল অব্দি পৌঁছানোর চেষ্টা করলো।
ঘরে ঢুকেই খাটের উপর ব্যাগটা থপ করে রাখলো আহান, শার্টের উপরের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে এসির পাওয়ার বাড়ালো। কাজের প্রেশারে বেশ ক্লান্ত সে, তার উপর তখন ওভাবে হাইপার হয়েও আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেছিলো। পরে নিজেরই মনে হয়েছে যে তুরার উপর ওভাবে চেঁচানো উচিত হয়নি। ও যার খুশি তার সাথে গল্প করুক ঢলে পরুক তার কি, সে তো আর তাকে বউ মেনে বসে নেই। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মনে হলো বউ মানে না তো কি বউ তো, তুরাকে তো আহান বিয়ে করেছে, সে কি করে অন্য একটা ছেলের উপর পরে গেলো,কিসের কথা মাহিদের সাথে এতো?
উফ মেজাজ টা আবারও বিগড়ে গেলো আহানের। নিজের উপর ই বিরক্ত সে,ইদানীং নিজের সাথে কি হয় ও নিজেই বুঝে উঠতে পারে নাহ। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে টাওয়াল টা হাতে নিতেই বারান্দার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চোখ যেতেই দেখলো একটা দড়ি মতো কিছু একটু পরপর উপরে উঠে আবারও পরে যাচ্ছে। কৌতুহল বশে কপালে ভাজ পরলো আহানের, ভ্রুকুটি করেই পা বাড়ালো বারান্দার দিকে, গিয়ে নিচে তাকাতেই অবাকের সীমায় পৌঁছে গেলো আহান,তুরা দড়িটা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে গাছের ডাল অব্দি পৌঁছাতে, তুরা দড়ি দিয়ে কি করবে, হুট করেই আহানের বুকটা চরম ভাবে কেঁপে উঠলো, তখন ওভাবে বকার জন্য তুরা সুই’সাইড? নাহ,,আর ভাবতে পারলো না আহান। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে নাহ। হাতের টাওয়াল টা ফেলে এক ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে, দ্রুতপায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে বাগানের দিকে ছুটলো।
দড়িটা হাতে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুরা,এতবার চেষ্টা করেও পারলো না সে,আর চুমকি টাও যে টুল আনতে গেলো এখনো আসার নাম নেই। চরম বিরক্ত হয়ে এক হাত তুলে আবার দড়িটা উপরে উঠাতে নিলেই কেও হাত থেকে দড়িটা এক টানে নিয়ে ফেলে দিলো। আকস্মিক ঘটনায় তুরা অপ্রতিভ হয়ে তাকাতে নিলেই আবারও হ্যাচকা টানে কেও তুরাকে নিজের খুব কাছাকাছি টেনে নিলো। বাকরুদ্ধ তুরা বিহ্বলিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,,নাকে খুব কড়া একটা পুরুষালি গন্ধ আসছে, যেনো পারফিউম আর ঘামে মিশ্রিত ঘ্রাণ। কানের কাছে প্রচন্ড ভাবে ঢিপঢিপ শব্দ বাজছে, নিজের অবস্থান পুরোপুরি বোঝার আগেই চড়া ধমকে কেঁপে উঠলো তুরা
-কি করতে যাচ্ছিলে তুমি। তোমার সাহস কি করে হলো এই ধরনের দুঃসাহসিক কাজ করার, মাথা ঠিক আছে?
চিরচেনা ধমকে ঘামড়ে গেলেও তুলনামূলক অবাক বেশিই হয়েছে তুরা, মুখ তুলে সুদর্শন চেহারায় ঘর্মাক্ত ক্রুদ্ধ ভাব দেখেই সরে এলো। আহান আবারও গলা শক্ত করে বললো
-তোমাকে বকেছি বলে তুমি এই ধরনের একটা কাজ করবে? মন চাচ্ছে দুটো বসাই গালে।
বলেই খানিক এগিয়ে আসলো তুরার দিকে। তুরা ভীত শঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রইল সে এখনো বুঝতে পারছে না যে হলোটা কি? আহানের এভাবে রেগে যাওয়ার কারণ কিছুতেই তার বোধগম্য হলো না সামান্য মিনমিনিয়ে গলা নামিয়ে বলল
-কিন্তু আমি করেছি টা কি আপনি কেন এমন করছেন
আহান মাঝখানে দূরত্ব আরেকটু কমিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে তুরার দুবাহু ধরে বলল
-তুমি গাছে দড়ি বেধে কি করছিলে?
-আ আমিতো দোলনা বা..
-ইয়া মাবুদ,আমি কিছুই দেখিনাই কিছুই দেখিনাই
পুরোটা বলার আগেই পেছন থেকে চুমকির গলা শুনে থেমে গেলো তুরা, আহান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো চুমকি ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে, এক হাতে টুল নিয়ে। চুমকির দিকে তাকিয়ে, আরেকবার তুরার দিকে তাকিয়ে বাহু থেকে হাত নামিয়ে দাঁড়ালো। তুরা কাচুমাচু মুখ করে এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে হাত ডলছে, এমন কিছু হবে তার ভাবনার বাহিরে ছিলো।
-তোরা এখানে কি করছিস চুমকি
ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে চুমকি মুখ থেকে ওড়না নামিয়ে লাজুক লাজুক মুখ করে বলল
-আসলে এই গাছটার সাথে ভাবিজান দোলনা বাধতে চেয়েছিলো, উঁচু ডালে নাগাল পাচ্ছিলো না বলে আমি টুল আনতে গেছিলাম। কিন্তু ভুল সময়ে এসে গেছি, সরি আমি কিচ্ছু দেখিনাই ভাইজান
বলেই টুলটা হাতে নিয়েই দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো, আহান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুরার দিকে। এখন নিজের উপর ই রাগ হচ্ছে তার, কি হচ্ছিলো আর সে কি ভাবলো। ধ্যাত,মাথাটাই গেছে। বলে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে।
আহান যেতেই তুরা মাথা তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আহানকে আবারও উল্টো ফিরে আসতে দেখে চুপ করে গেলো। আহান এগিয়ে এসে তুরার হাত ধরে গটগট করে ভেতরের দিকে গেলো। কোনো দিক না থেমে টেনে নিজের ঘরে এনে খাটের উপর থপ করে বসিয়ে দিলো। তুরা হাফাচ্ছে রীতিমত। এইরকম বড় বড় পা ফেলে কি সে আসতে পারে? যেভাবে ধরে টেনে আনলো তুরা তাল মিলাতে না পেরে রীতিমতো দৌড়েছে। বসে জোরে জোরে দম ছেড়ে নিজেকে ধাতস্ত করে তাকালো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া শরীরের লোকটার দিকে, যে আপাতত ট্রেডমিল ছাড়াই ফিক্সড ওয়াক করে চলেছে। বিরক্তিতে তুরার কপালে অসংখ্য ভাজ পরে আসে,এই লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি! এক তো কি না কি ভেবে তার দোলনা বানানো টা ভেস্তে দিলো। এখন আবার পাগলের মতো পায়চারি করছে। তুরার এ মুহূর্তে ভীষণ ইচ্ছে হলো আহানকে দুটো শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে, কিন্তু তারপরে তার নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করে চুপ করেই থাকলো।
-এই তোমার জন্য, তোমার জন্য আমি কোনদিন পাগল হয়ে যাবো
নীরবতা ভেঙে আহানের এমন উদ্ভট কথায় তুরা গোলগোল চোখ করে চেয়ে রইলো, আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে, এখন তো নিজেকেই তার পাগল মনে হচ্ছে। ঘনঘন পলক ফেলে হা করে তাকিয়েই রইল।
তুরার এমন হ্যাবলাকান্তর মতো তাকিয়ে থাকা দেখে আহান আরও কিছু বলতে গেলেও থেমে গেলো, একে কিছু বলা আর দেওয়ালের সাথে কথা বলা সমান। নিচে পরে থাকা তোয়ালে টা হাতে নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো, আর তার আগে শুনিয়ে গেলো তার নামকরা ডায়লগ ‘ডিজগাস্টিং’
আহান যাওয়ার পরেও তুরা হা করে চেয়ে রইলো বাথরুমের দরজার দিকে,যেনো দরজার ওপারে কোনো রাক্ষস আছে
-রাক্ষস,আস্ত রাক্ষস লোকটা। শুধু জল্লাদ ই না, ভীষণ ব’জ্জাত আর উদ্ভট এই লোক। এর খপ্পরে থেকে কোনদিন অক্কা পেয়ে আকাশে ঝুলে যাবো আমি।
গত কিছুক্ষণের ঘটনায় কি থেকে কি হলো তা নিয়ে এখনো কনফিউজড থাকলেও এই লোকটার মাথা যে ভাগাড়ে গেছে এ নিয়ে কনফার্ম তুরা।
-নাহ এখানে আর এক মুহূর্ত নাহ,এরপর বেরিয়ে আবার কোন হম্বিতম্বি করবে আল্লাহ যানে
বলেই এক ছুটে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। আপন মনেই বিড়বিড় করে আহানকে হাজারটা গালি দিতে দিতে যাচ্ছিলো তুরা, রাইমার ঘর কাটিয়ে আসার সময় পেছন থেকে আসা ডাকে পা থামিয়ে দাঁড়ালো
-বউ, এদিকে আসো তো
মিনু ফুফুর ডাকে তুরা আবারও উল্টো ফিরে রাইমার ঘরে ঢুকলো।
-কিছু বলবেন ফুফু আম্মা?
-হ্যাঁ বলব,এসো এখানে আমার কাছে বস তো দেখি
তুরা স্মিত হেসে এগিয়ে গিয়ে বসলো মিনুর পাশে। মিষ্টি মুখে বলল
-জ্বি ফুফু আম্মা, বলুন
-তোমাকে সেদিন কি কি বলেছিলাম বউ, মনে আছে তো?
মিনুর কথায় তুরার হাস্যজ্বল চেহারা মুহুর্তেই চুপসে গেলো। সেদিন রাতে তুরাকে ডেকে মিনু ফুফু আস্ত পান্ডুলিপি মাথায় ঢুকিয়েছে যেনো। কত কি শিখিয়েছিলো। আহানের সাথে সাথে থাকতে হবে, কখন কি দরকার দেখতে হবে, না চাইতেই জিনিস এগিয়ে দিতে হবে, সুন্দর করে ডাকতে হবে আরও হাবিজাবি এত্ত এত্ত কথা। কিন্তু ফুফু তো জানে না সে কোন জল্লাদের সাথে বসবাস করছে। যাই বলুক না কেনো উনার হম্বিতম্বি করতেই হবে
-আ,আম হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে তো?
-শুধু মনে রাখলেই কি হবে, মানতেও হবে তো
এক হাতে রাখা পানটা মুখে পুরে বলল মিনু। তুরা এবার বেশ অসহায় মুখ করল। সে আবার কি মানবে? তাও ওইরকম একটা দস্যি লোকের সাথে। কিছু বললেই তো রেগে যায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দেয়।
-শোনো বউ, বর হলো আদরের জিনিস। তাকে সবসময় আদর ভালোবাসা দিবে তাইলে সেও তোমায় সোহাগ করবে মাথায় তুলে রাখবে
-কিন্তু আদর ভালোবাসা কি করে দেয় ফুফু আম্মা?
নিজের কথার পৃষ্ঠে তুরার থেকে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন যেনো নেহাৎ অপ্রত্যাশিত ছিলো মিনুর। মুখ খানায় ভীষণ অবাকের ছাপ ফেলে বলল
-সেকি বরকে কি করে আদর ভালোবাসা দিতে হয় বিয়ের এতদিনেও যানো নি তুমি?
উত্তরে নিশ্চুপ রইলো তুরা। তুরার প্রত্যুত্তর না পেয়ে মিনু নিজেই আবারও বলল
-বরের আশেপাশে থাকবে। তার কি লাগবে কি না সেটা জানবে, তার সব কথা বাধ্য মেয়ের মতো শুনবে। সুন্দর নামে ডাকবে আরও কত কি
-কিন্তু উনাকে স্বামী ডাকলেই তো রেগে যায়,বলে এসব ডিসগাস্টিং কথা কোত্থেকে শিখেছো
-তো তুমি স্বামী বলেই কেনো ডাকবে সবসময়
-উনিতো বয়সে আমার অনেক বড় নাম ধরে তো ডাকতে পারিনা। আর তাছাড়া স্বামীকে স্বামী ই তো বলব তাইনা?
তুরা ভীষণ অসহায় মুখ করে বলল। মিনু ফুফু আরেকটু সরে এলো তুরার কাছে। এই মেয়ে যে বলদের বলদ তা তার ঢের বুঝা হয়েছে, একে সব হাতে কলমেই শেখাতে হবে
-শোনো এসব বোকা বোকা কথা বললেই তো হবে না,স্বামীকে নিজের হাতে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয়। সেখানে আমার বাবু তো একটু চাপা স্বভাবের, ও তো বেশি কথা বলে নাহ। তোমাকেই বুঝে নিতে হবে
হুহ,আপনার বাবু চাপা স্বভাবের কম জল্লাদ, ব’জ্জাত আর দস্যি স্বভাবের বেশি, কোত্থেকে এনেছিলেন এই উগান্ডার মালটাকে?
কথাগুলো বলার ভীষণ ইচ্ছে হলো তুরার,কিন্তু মনের ইচ্ছে মনেই চাপা দিলো,কারণ ওই দস্যি লোকটা যে এনাদের আদরের দুলাল তা তুরা বেশ জানে শেষে কিছু বলে নিজেই শহীদ হবে। তাই চুপচাপ মিনু ফুফুর কথা গুলো গলাধঃকরণ করল,,যদি এই টেকনিকেই জল্লাদটাকে বাগে আনা যায় ক্ষতি কি।
দীর্ঘ বিশ মিনিট ধরে ঠান্ডা পানির শাওয়ার নিয়ে এখন বেশ হালকা লাগছে আহানের, মাথা মুছে বেরিয়ে এলো। ওয়াসরুমের দরজা টা লাগিয়ে পেছনে ঘুরতেই আবারও থেমে গেলো। বিরক্তিতে চোখ কুচকে নিলো। এই মেয়ে এমন সং হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? মুখে আবারও সেই ফিক্সড স্মাইল টা, আবারও নিশ্চিত কোনো ঘাপলা করবে। তুরা যতবার এইরকম লুক দিয়ে হাসে ততবারই আহানের নাকানি চুবানি খাওয়ার মতো কান্ড হয়। একদম বিশ্বাস নেই একে দিয়ে। এর চেয়ে যত দূরে থাকা যায় তত ভালো। তাই আহান তুরার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, আয়নার সামনে যেতেই তুরা ও এসে পেছনে দাঁড়ালো
-আপনার জন্য শরবত এনেছি প্রিয়
-হোয়াট,,হোয়াট ডিড ইউ সেইড?
প্রচন্ড বিরক্ত আর বিহ্বলিত হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে কপালে আর চোখে অসংখ্য ভাজ ফেলে বলল আহান।
-আপনার জন্যে শরবত এনেছি গো,দয়া করে খেয়ে নিন
-তোমার উপর কি জ্বিন ভূতের আছড় আছে? আর তারা কি ঠিক করেই রেখেছে আমায় পাগল বানিয়ে তবেই দমবে?
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
Humu_♥
#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব-১৭
-কি বলছেন স্বামী,এখানে জ্বিন ভূত আছে?
বলেই তড়িঘড়ি করে আহানের কাছে সরে এলো তুরা,গোল গোল চোখ এদিক ওদিক চেয়ে বলল
-আপনার ঘরে জ্বিন ভূত থাকে আপনি আমাকে আগে কেন বলেননি
আহান বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে বলল -যেখানে স্বয়ং তোমার মত একটা পেত্নী থাকে সেখানে ভূত কি করে আসবে
তুরা এবার চোখ ছোট করে আহানের দিকে তাকালো ব’জ্জাত লোকটা যে তাকে হেনস্থা করছে তা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে সে
-নিন আপনার শরবত
বলেই আানের সামনে শরবতের গ্লাসটা ধরল আহান আড়চোখে চেয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল
-উদ্ধার করেছ আমাকে
তুরা একটা মুখ ভেংচি দিয়েই গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, এর সামনে থেকে অপদস্ত হওয়ার কোনো মানেই হয়না
সময়টা রাত দশ টা পেরিয়েছে,বসার ঘরে সকলে বসে আছে। রুবি খাবারগুলো টেবিলে এনে একে একে সাজাচ্ছে, রাইমা ফিরেছে সন্ধ্যার পর মিনু ফুপু আর ইনসাফ সবাই সোফাতে বসেই কথোপকথন করছে আর চুমকি রুবিকে হাতে হাতে সাহায্য করছে
আজ সবাই সবার আলোচনা বিষয়বস্তু হলো রাইমার বিয়ে যে ব্যাপারে কথা বলতেই বাবা সবাইকে ডেকেছে। ইনসাফ গলা খাকারি দিয়ে বলল
-মানের বাসা থেকে ওর বাবা ফোন করেছিল। খুব শীঘ্রই নাকি ফিরবে ইমান, তাই ওরা আর দেরি করতে চায় না যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাজটা শেষ করতে চাই। ইমানের দাদীর শরীরটাও নাকি ইদানিং ভালো যায় না সে মৃত্যুর আগে ইমানের বিয়ে দেখে যেতে চাই তাই তারা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের কাজ শুরু করার প্রস্তাব জানিয়েছে
উপস্থিত সকলেই চুপচাপ শুনছে ইনসাফের কথা,দিদুন চোখের চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে বলল
-এত বেশ ভালো কথা, অনেকদিনই তো হল এখন ওদের বিয়েটাও হওয়া উচিত
মিনু ফুফুও বেশ প্রফুল্ল চিত্তে বলল
-এ তো অনেক ভালো কথা, আমিতো রুবিকে বলেই ছিলাম মেয়ের বিয়ের কথা।
বলে আবারও বলল
-তাহলে উনারা বিয়ের দিন তারিখের কথা কিছু বলেছে ভাই?
ইনসাফ মিনুর দিকে ফিরে বলল
– হ্যাঁ ওরা বলল ওরা কালকে আসতে চায় এখানে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে। আমিও বলেছি আমাদের পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই,
বলে দিদুনের দিকে তাকিয়ে বলল
-মা তোমার কোন সমস্যা নেই তো?
দিদুন বার কয়েক ঘার নাড়িয়ে বলল
-সমস্যা কেন হবে মাশাআল্লাহ আমার দিদি ভাইয়ের বিয়ে হবে সে তো অনেক ভালো কথা
রুবি টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে বলল
-তা ওরা কাল কখন আসবে সে বিষয়ে কিছু বলেছেন?
-হ্যাঁ, ওরা কাল দুপুরেই আসবে
-তাহলে তো অনেক কাজ আন্টি। ও বাড়ি থেকে অনেক মেহমান আইবো অনেক রান্নাবান্না ও করতে হইব
চুমকির কথায় রুবিও বেশ ব্যাস্ত হয়ে পরলো এ নিয়ে। মেয়ের বিয়ের ব্যাপার কোনো খামতি রাখা চলবে না।
সবার এতক্ষণে কথোপকথনে নীরব শ্রোতা তুরা আর রাইমা। তুরা মনে মনে বেশ খুশি হয়ে শুনলেও রাইমার মুখে লজ্জার ভীষণ ছাপ। সারা মুখ জুড়ে একটা আনন্দের রেখা ছুঁয়ে আছে তুরা পাশ থেকে রাইমাকে একটা খোঁচা দিতেই রাইমা কপট রাগ দেখিয়ে তুরার দিকে তাকালেও তুরার মুখভঙ্গি দেখে ফিক করে হেসে ফেলল। তবে আহান এত কিছুর মাঝেও নিচে নামেনি সে এখনো উপরে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, মাঝে একবার তুরা তাকে ডাকতে গেলেও তাকে ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই তোর আর যায়নি। লোকটা ভারী ব’জ্জাত। সব সময় হম্বিতম্বি করে আজব লোক একটা।
সকলে নানান আলোচনার সাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ ঘরে গেল, সবাই বেশ উৎফুল্ল চিত্তে আছে, রাইমার বিয়ে বছর দুয়েক আগে ঠিক থাকলেও এবার কবুল বলার পালা। ইনসাফ মাহবুব এর একমাত্র মেয়ে বলে কথা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই যে সবকিছু হবে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
খাওয়া শেষে রুবির সাথে সবকিছু গুছিয়ে রেখে তুরা একটু দেরিতেই ঘরে গেল, হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ নিয়ে। ঘরে ঢুকে আশপাশ তাকিয়ে কোথাও আহানকে দেখতে পেলো না। কফিটা টেবিলে রেখে এগিয়ে গিয়ে দেখলো আহান বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে, তার দিকে পিঠ করে থাকায় তুরাকে দেখতে পাইনি। তুরা নিঃশব্দে ওখান থেকে এসে ওয়াসরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে কফির কাপটা না দেখে বুঝলো মহাশয় এসে নিয়ে গেছেন তার কফি। তাই আর কোনো কথা না বলে বিছানা গুছিয়ে শুতে নিলো। শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না তুরার৷ আহান এখনো ফেরেনি ঘরে। তুরার এবার বেশ ভয় ভয় লাগলো,, ছোট থেকেই ভীষণ ভীতু স্বভাবের মেয়ে তুরা,একা কখনোই ঘুমাতে পারেনা। তার উপর বারান্দায় আহানের ও কোন সাড়াশব্দ নেই। উঠে বসে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করল,কিন্তু বারান্দার লাইট টাও নেভানো, এই লোকটা এত অন্ধকার করে রাখে কেনো সবকিছু তুরা বুঝে না। আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে মানুষের চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে নাহ। ঘরের লাইট টাও নেভানো। অন্ধকারে হাতরে এগিয়ে গেলো তুরা হুট করেই তুরার ভীষণ ভয় হতে লাগলো এখানেই তো ছিল লোকটা কই গেল?
-আ আপনি কোথায়?
আমতাআমতা করে বলে আরেকটু এগিয়ে গেলো তুরা,কোনো উত্তর ও আসছে নাহ দেখে তুরার এই মুহূর্তে সব ভয় জুড়ে বসলো। অন্ধকারে কোন দিকে হাঁটছে বুঝতে না পেরে এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ নিজের কাধের উপর গরম নিঃশ্বাসের আছড়ে পরা অনুভূত হলো তুরার। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও গরম উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা ক্রমেই গাঢ় হলো। যেনো সুচের মতো ঢুকে যাচ্ছে ঘারে কাধে। ভয়ে শুকনো ঢক গিললো তুরা, এই গরমেও সারা শরীরে হীম হাওয়া বয়ে গেলো, পদক্ষেপ দুকদম পেছাতেই শক্ত কিছুর সাথে পিঠ ঠেকলেই তুরা ঘাবড়ে চেঁচিয়ে উঠতে নিলে কেও পেছন থেকে মুখটা চেপে ধরলো,,তুরা হাত পা এলোপাতাড়ি ছুড়াছুড়ি করলে, কানের কাছে এসে কেও হিসহিসিয়ে বলল
-হুসস,একদম চেঁচামেচি করবে না। এত রাতে এখানে কেনো এসেছ
আহানের কণ্ঠস্বর শুনে যেনো তুরার জানে পানি ফিরলো। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো সে। আহানের হাত সামান্য আলগা হতেই তুরা পেছন ফিরে ঝাপটে ধরলো আহানকে। এমন আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় আহান কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তুরা, বেশ ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে আলতো ভাবে হাত রাখলো তুরার পিঠে
-ভয় পেয়েছ?
নরম কণ্ঠে শুধালো আহান। তুরা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল
-আমি আপনাকে কতবার ডাকলাম। আপনি কেন উত্তর দেননি আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম
বলেই দু’হাতের আচড় আরও গাঢ় করে বসিয়ে দিল আহানের পিঠে,আহান চোখ জোড়া বন্ধ করে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। মেয়েটার এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরা ইদানীং আহানের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। শক্ত পুরুষালি মনের খোলস টা নরম হাতের স্পর্শে যেন চুড়চুড় হয়ে যায়। মেয়েটা কি বোঝে না এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরতে নেই,ছুঁয়ে দিতে নেই! নিজের ভেতরে আঁছড়ে পরা সকল প্রবল উচ্ছ্বাসকে দমিয়ে কণ্ঠের খাদ আরও নামিয়ে বলল
-চলো ঘরে যাই
তুরা তাও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো উত্তরহীনা। প্রত্যুত্তর না পেয়ে আহান ঘাড় টা নামিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল
-এই মেয়ে বারান্দা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেব কিন্তু,ঘরে চলো!
আহানের নরম কণ্ঠের ধমক যেনো নিতান্তই অদ্ভুত ঠেকলো তুরার নিকট, এভাবে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে ও আবার কেও ধমক দেয় বুঝি? নিকষ অন্ধকারেও মুখ উচিয়ে বলল
-আপনি সবসময় কেনো বকাবকি করেন, আমায় তো চাচীও এত বকা দেয়নি
বাচ্চা বাচ্চা গলায় তুরার কথা শুনে,আহান নিঃশব্দে হাসলো। যে হাসির শব্দ হয়না। রাতের শান্ত পরিবেশে আহানের নিঃশব্দের হাসিটাও যেনো এক রূপ ঝংকার তুললো। তুরাকে বুক থেকে সরিয়ে হাত ধরে ঘরে এনে বলল
-শুয়ে পরো,রাত হয়েছে
-আপনি ঘুমাবেন না?
আহানের কথার সাথে সাথেই বলল তুরা, আহান খানিক থমকে তুরার দিকে চেয়ে কিছু একটা ভেবে ছোট করে হু বলেই ওয়াসরুমের দিকে গেলো। তুরা আহানের যাওয়ার পানে চেয়ে আবারও খাটে এসে শুয়ে পরল। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরলো আহান। তুরা ওপাশে মুখ করে শুয়ে আছে, ওর কোনো নড়চড় না দেখে নিঃশব্দে এসে শুয়ে পরল পাশে, ডিম লাইটের মৃদু আলোতে তুরার ছোট্ট মুখ খানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আহান খানিকটা সময় নিয়ে চেয়ে রইলো তুরার ঘুমন্ত চেহারার দিকে। ইদানীং নিজেকে কেমন খাপছাড়া লাগে তার, সাজানো গোছানো গম্ভীর স্বভাব টাও যেনো চূড়ান্ত বেইমানি করে, না চাইতেও হাজারো বেনামি চিন্তাভাবনা ঘিরে ধরে থাকে, যার সবটাই এই মেয়েটাকে কেন্দ্র করে। ফট করে মুখ ফিরিয়ে অন্যপাশে ঘুরলো আহান। সে কোনো ভুল করতে চাইনা। এই অহেতুক চিন্তাভাবনা গুলোকে পশ্রয় না দেওয়াটাই উত্তম। পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করার মিনিট খানেক বাদে একটা ছোট হাতের খামচি আঁকড়ে ধরল তার পিঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরলে দেখল তুরা ঘুমের ঘোরেই আরও সরে এসেছে আহানের দিকে। এক হাত দিয়ে খামচে ধরে আছে আহানের টি-শার্ট। আস্তে ধীরে হাত ধরে সরানোর চেষ্টা করলেও তুরা ছাড়লো না বরং আরও কাছে সরে এলো। মেয়েটাকে আহান যতই দূরে সরাতে চাই ততই কাছে চলে আসছে, এই যে আহানের পিঠে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে আছে, আহান ইচ্ছে করলেও সরাতে পারছে না। কেমন একটা ঘোর লাগা কাজ করলো। এদিকে ঘুরে তুরাকে এক হাতে আগলে নিয়েই চোখ বুজলো।
বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরোলে আহানের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসতেই চোখ খুললো তুরা। ঘাড় টা সামান্য তুলে তাকালো মৃদু টিমটিমে আলোতে আহানের মায়া ভরা মুখ খানার দিকে। ইচ্ছে করেই ঘুমের ভান ধরে সরে এসেছে সে, ইদানীং এই গম্ভীর স্বভাবের লোকটাকে তার ভীষণ অন্যরকম লাগে, নাম না জানা হরেক রঙে রাঙা অনুভূতি গুলো এই লোকটার নামেই ডানা ঝাপটাচ্ছে। আহানকে জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত শান্তি লাগা কাজ করে তুরার মনে। নিজেকে সুরক্ষিত লাগে বুকটার মাঝে।
চিকন আঙ্গুলের হাত টা আহানের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আবৃত গালটাতে রেখে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে আবারও আহানের বুকে মাথা রাখলো। হোক না একটু ছলনা করে, বা ঘুমের ঘোরে তাতে যদি হৃদয়ে প্রশান্তি জুড়ানো স্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য মিলে তাতে ক্ষতি কি!
~~
উষ্ণ মৌসুমে সকালের হাল্কা ঠান্ডা বাতাসে পর্দার উড়াউড়ি আর পাখিদের কিচিরমিচির কলধ্বনিতে ঘুম হালকা হয়ে এলো আহানের। চোখ খুলে তাকাতেই রোদের নরম আলোতে চোখ মুখ কুচকে এলো। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে দেওয়ার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। বেশ বেলা করে ঘুমিয়েছে সে। ভার্সিটি থাকলে এত বেলা করে উঠা হয়না। রাইমার শ্বশুরবাড়ি থেকে মেহমান আসার খবরটা তাকে কালই দিয়েছে বাবা,এ ব্যাপারে আলোচনা করে সে ভার্সিটির অফিসিয়াল সাইটে মেইল করে আজকে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপার টা জানিয়েছে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ঘর টা ফাঁকা।তুরা নেই,পাশেই বেড সাইড টেবিলে কফির মগটা রাখা। আহানকে বিরক্ত করার মতো সকল কাজ মেয়েটা করলেও তার সাথে আরেকটা কাজ ও অনেক ভালো মতো করে,,আহানের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে তার টাইম টু টাইম কফিটাও তুরাই দেয়, যার কারণে ইদানীং নিজের কিছুই করা লাগে না আহানের। ফ্রেশ হয়ে এসে কফিটা হাতে নিয়ে কাপে চুমুক দিয়ে বারান্দায় গেলো।
এক হাতে দড়ি নিয়ে আবারও কালকের মতো লাফাচ্ছে তুরা, উদ্দেশ্য তার দোলনা বানানো, ব্যস অনেক হয়েছে, খাম্বা গাছটা পেয়েছে কি আজ তুরা দোলনা বেধেই ছাড়বে, দড়িটা গুছিয়ে হাতে নিয়ে ওড়না পেচালো কোমরে, দুই হাত দিয়ে গাছটা আঁকড়ে ধরে উপরে উঠতে লাগল।
এতক্ষণ বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে তুরার কাজকর্ম দেখছিল আহান,এবার তুরাকে গাছে উঠতে দেখেই ভ্রু কুচকে এলো,কফির মগটা রেখে নিচে নেমে এলো। আহানকে এভাবে নেমে বাইরের দিকে যেতে দেখে আমেনা খাতুন বলেন
-এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছো দাদুভাই
-বাড়িতে একটা বাঁদর এনে রেখেছ,ওইটার বাঁদরামি থামাতেই যাচ্ছি।
বলে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো।
তুরা অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করে গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটাই উঠতে পেরেছে, ব্যস এবার দড়িটা বাধতে পারলেই তার কাজ শেষ। গাছের মোটা ডালটাতে দড়িটা বাধা হলেই তুরা আনন্দে খিলখিল করে ওঠে, এবার সে মহা আনন্দে দোলনা চড়তে পারবে। কিন্তু তুরার এ আনন্দ বেশিক্ষণ ধরলো নাহ। নিচে তাকাতেই যেন মাথাটা চক্কর দিল। দোলনা বাধার জন্য হইহই করে গাছে তো উঠে গেল,এখন নামবে কি করে, নিচে তাকালেও তো মাথা ঘুরছে। এখান থেকে পরলে নিশ্চিত ঠ্যাং দুটো ভাংবে। দু একবার পা নামিয়ে নামার প্রচেষ্টা করলেও ব্যার্থ হলো। তুরার বেশ কান্না পাচ্ছে, নামবে কি করে এখন!
-কি হলো, বাঁদরের মতো লাফঝাপ করে উঠে তো গেলে এখন নামো!
চিরচেনা পুরুষালি গলার আওয়াজে তুরা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো আহান একদম তার সামনের আমগাছটাতে হেলান দিয়ে দু হাত বুকে গুজে দাঁড়িয়ে। আহানকে দেখে তুরার চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে গেল,এক তো গাছ থেকে নামতে পারছে না আর নামলেও এই ব’জ্জাতটা যে কি করবে যে ভেবেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে
.
.
.
চলবে ইনশাআল্লাহ
Humu_♥