#তুমি_আমি_দুজনে
#লেখিকা_হুমাইরা_হাসান
পর্ব- ৬১ (অন্তিম পর্ব)
হসপিটালের করিডরে বসে আছে কয়েকটা উদ্বিগ্ন মুখ। চেহারায় আতংক,আকাঙ্খা, উত্তেজনা সব কিছু মিলিয়ে ভারসাম্যহীন অবস্থা।
রাইমাকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। ডাক্তার ডেট আরও এক সপ্তাহ পরে দিলেও আজ সকাল থেকে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। এ বাড়িতেই ছিল যার দরুন আহান আর ইনসাফ তৎক্ষনাৎ হসপিটালে এনেছে। প্রায় ঘন্টা খানেকের বেশি সময় হয়ে গেছে এখনো কোনো খবর আসেনি।
চিন্তায় আতংকে সকলের নাজেহাল অবস্থা। ইমান এক মুহূর্ত বসতে পারছে না, করিডর জুড়ে পায়চারি করছে। আজমেরি চৌধুরী আর রুবি খাতুন বসে দোয়া দরুদপাঠ করছে। মাঝে মধ্যে চোখের পানিও ফেলছে। ইনসাফ আর ইসহাক চৌধুরীর কপালেও চিন্তার প্রগাঢ় ভাঁজ পরে আছে।
তুরা এক কোণায় বসে আছে আহানের হাত ধরে। ওর নিজের শরীর টাও ভালো নাহ। আগের তুলনায় ভারি হয়েছে যার দরুন হাঁটা চলা করতে ভালই অসুবিধা হয়। তারপর মাথা ঘোরা, বমি লেগেই আছে। এমতাবস্থায় আহান ওকে বাড়িতেই রেখে আসতে চেয়েছিল তুরা নিজে এক প্রকার জিদ করেই এসেছে। রাতে যে মানুষ টার সাথে কথা বলে ঘুমাতে গেল সকালে উঠে সেই মানুষটার যন্ত্রণা চিৎকারের আহাজারিতে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠেছে তুরার। এভাবে অনিশ্চিত খবরের অপেক্ষায় বাড়িতে বসে থাকতে পারেনি।
আহান নিজে হাজারো দুশ্চিন্তার মাঝেও বারবার তুরার দিকে খেয়াল রাখছে। তুরা বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রাইমার অবস্থা শেষ মুহূর্তে আশঙ্কাজনক হয়ে পরেছিল। তাই ডক্টর এক সপ্তাহ আগেই সিজারের জন্য ইমারজেন্সিতে নিয়েছে।
-দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেল বাবা, এতক্ষণে সিজারের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা,ডাক্তার বেরোচ্ছে না কেন। আমার রাইয়ের কিছু হয়নি তো
ইমানের কথা শুনে কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় হলো উপস্থিত সকলের। ইসহাক চৌধুরী থমথমে গলায় বলল
-তুমি অযথাই দুশ্চিন্তা করছ ইমান। কিছুই হবে নাহ রাইমার। এরেকটু ধৈর্য ধরো
তবুও ক্ষান্ত হলো না ইমানের মন। অনবরত অস্থিরচিত্তে পায়চারি করতে লাগল। আহান কোনো কথা বলল না। হাঁটুর উপর কনুই ভর করে বসে রইল। বোনের অবস্থায় ওউ নিজেকে সামলে রাখতে পারছে নাহ।
অবশেষে ওটি থেকে বেরিয়ে এলো ডক্টর। সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডক্টর একফালি হাসি মাখা মুখে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। রাইমার অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল হয়ে যাওয়ায় ওটিতে বেশ আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ছোট একটা প্রাণ ভূমিষ্ট হলো। তোয়ালে তে পেচিয়ে ছোট্ট একটা কন্দনরত শরীর এনে তুলে দিল ইমানের কোলে। সকলের চোখে মুখে প্রাপ্তির হাসি খেলে গেল। হবেই বা না কেন, ঘর জুড়ে একটা ছোট্ট প্রাণোচ্ছল অস্তিত্ব এসেছে যে। চিকন সরু কণ্ঠের চিৎকারে যেন সকলের খুশি বাধ ভেঙে গেল। রুবি খাতুন কেঁদেই ফেললেন।
ব্যস্ত হয়ে গেল ছোট্ট একটা সদস্যকে নিয়ে।
আহান আলতো ভাবে পিচ্চিটার হাত ছুঁয়ে দিয়েই ছুটে আসল তুরার কাছে কেমন করে বলে উঠল
-তুরা! বাবু একদম ছোট্ট, এই যে এতটুকু!
বলেই হাত তুলে দেখাল। আবারও হাসতে হাসতে বলল
-ওকে তো ধরতেও ভয় করছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পরে যাবে মনে হচ্ছে। আমাদের বাবুটাও কি এতটুকুই হবে তুরা!
কেমন শিশুসুলভ শোনালো আহানের কণ্ঠস্বর। তুরার কি হলো বুঝল না। আহানের এমন প্রতিক্রিয়াতে ও কেঁদে ফেলল। কোনো চক্ষুলজ্জার তোয়াক্কা না করেই জড়িয়ে ধরল আহানকে।
………………
দেখতে দেখতে একটা মাস কি করে কেটে গেল।
এসবের মাঝে সবাই নিজ নিজ কাজ সামলে দিনশেষে ছোট্ট সদস্য টাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। ইমান তো হসপিটাল থেকেই বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইনসাফ মাহবুব আর রুবির অনুরোধে নেয়নি। তাই রোজ কাজের ফাঁকে দু তিনবার করে এসে দেখে যায় বাবুকে। রাইমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও আসে কয়েকদিন পরপরই।
বাচ্চাটা সঠিক সময়ের আগেই হওয়াই শরীরের কন্ডিশন বেশ নাজুক ছিল। গত একমাসে বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। ইনসাফ মাহবুব বেশ কয়েকদিন ধরেই চাচ্ছিল বাবুর উপলক্ষে বাড়িতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান করবে। তাই আজই সব আয়োজন করা হয়েছে। সিলেট থেকে তনু,রুহি,জায়মা,আরমান বিহান সহ বাকিরাও এসেছে। মিনু ফুফু আর তার সাথে ফুয়াদ ও তার স্ত্রী প্রিয়তা ও এসেছে। সব মিলিয়ে বাড়ির অবস্থা একেবারে আনন্দ উল্লাসে টইটম্বুর।
তুরা প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে তার দ্যা গ্রেট মাস্টার মশাইয়ের স্ট্রিক্টনেস চক্রবৃদ্ধির হারে বেড়েছে। উঠতে বসতে নিয়ম নিষেধ। তার উপর রাইমার সেই অবস্থা দেখার পর থেকে সকলের মাঝে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। আহান তো পারে না তুরাকে বিছানার উপর ফিক্সড করে রেখে দিতে। আর শুধু আহান একাই নয় রুবি, ইনসাফ, রাইমা সকলে তাকে একশোটা বাধা নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছে। তহমিনা তো একদিন পরপরই আসে তুরাকে দেখতে।
-এ কি অবস্থা করেছ ঘরের!
ঘরে ঢুকেই হযবরল অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বলল আহান। তুরা সারা বিছানায় জামা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্তুপ করে তার মাঝে বসে আছে। মুখটা ভীষণ রকম কুচকে রেখেছে। আহান এক এক করে জামা কাপড় গুলো সরাতে সরাতে এসে তুরার পাশে বসে বলল
-কি হয়েছে, এমন করে আছ কেন? আর তুমি চেঞ্জ করবে না?
-কি চেঞ্জ করব আমি? কি পড়ব। আমিতো কিছুই পড়তে পারব না
-কেন? কেন পারবে না
-এই যে, পেটের মধ্যে বসে আছে। কি পড়ব আমি। যাই পরি দেখতে আলুর মতো লাগে। আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি আমাকে আর কোনো কিছুতেই সুন্দর লাগেনা
কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল তুরা। আহান ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। এই শুরু হয়েছে আবার, যতদিন তুরার পেট ফুলেছে একটু মোটাসোটা হয়েছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে এসব কাহিনি।
দিনে পঁচিশ বার আহানকে বলে ‘আমাকে আর ভালো লাগে নাহ তাইনা? আমি এখন অসুন্দর হয়ে গেছি? হ্যাঁ তাই তো! আমি জানি এখন আমি মটু হয়ে গেছি,আমার পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে’
আহান বিব্রত হলো না। বরং হাসল। এগিয়ে এসে তুরার কোলের উপর মাথা রেখে পেটের কাছে মুখ নিয়ে বলল
-দেখলে প্রিন্সেস, তোমার পিচ্চি আম্মুটার একটুও বুদ্ধি নেই। একটা কথা তো শুনবেও না বরং কিছু বললেও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিবে। তার উপর উলটা পালটা ভাবাই এক্সপার্ট। শিগগির বাইরে চলে আসো তো তারপর আমি আর তুমি মিলে তোমার পিচ্চি আম্মুটাকে বড় করব
-এই আমাকে আবারও পিচ্চি বলেছেন আপনি? কোন দিক থেকে পিচ্চি মনে হয় আপনার।৷ দুইদিন বাদে একটা বাচ্চার মা হবো তাও পিচ্চি বলছেন!
তুরার ঝগড়ুটে টাইপ কথা শুনে আহান হাসল। পরক্ষণেই চোখ দু’টো ছোট ছোট করে তুরার দিকে আড়চোখে তাকাল। আহানের এরূপ বেশরমের মতো দৃষ্টি দেখে তুরা ধাক্কা দিয়ে আহানকে সরিয়ে বলল
-সরুন, অসভ্য কোথাকার। একদম তাকাবেন নাহ। আমাকে পিচ্চি বলছেন পিচ্চিকে মা বানিয়ে দেওয়ার সময় মনে ছিল না?
হড়বড় করে কথাগুলো বললেও আহানের চোখে মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি দেখে বিব্রত হলো তুরা। নিজের কথার মর্মার্থ বুঝে দমে গেল। হাসফাস করে এদিক ওদিক তাকালে আহান ফিচেল গলায় বলল
-কি করব বলো। আমার মতো হ্যান্ডসাম, হট অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ একটা ছেলেকে দেখে তুমিতো আর কন্ট্রোল করতে পারলে নাহ। দিন দুপুরে আমার ইজ্জত লুটে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে। এখন আবার আমার দিকে উলটা পালটা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছ। যাহ দুষ্টু মেয়ে!
তুরা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল তুরার দিকে। লোকটা এখনো আগের মতই ঠোঁট কাটা স্বভাবেরই রয়ে গেলো। আহানের কথায় তুরা এখনো লজ্জায় লাল নিল হয়ে পরে। মনে হয় রোজই যেন নতুন লাগে আহানের এসব টুসকি।
লজ্জায় নতজানু হয়ে ওড়না খামচে ধরলো তুরা, আহান এগিয়ে এসে ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওর গালে অধর ডুবিয়ে দীর্ঘসময় ধরে চুমু খেলো।
তুরার মুখের সামনে মুখ এনে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিল। তুরা এখনো চোখ দু’টো বন্ধ করে আছে, তুরার লজ্জা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে আহান বলল
-ইশশ,এত লজ্জা পেয়ো না তো। তুমি লজ্জা পেলে তো আমার আরও অসভ্য হতে ইচ্ছে করে তুরা রাণী।
বলেই আস্তে আস্তে তুরার ঠোঁটের দিকে নিজের অধর যুগল এগিয়ে নিতে লাগল।
-সারপ্রাইজজজজ
একসাথে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে ছিটকে সরে গেল তুরা। সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলো একদম ফিক্সড পোজ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ভীষণ ভুল সময়ে
আগমনে তাদের অভিব্যক্তি শূন্য হয়ে আছে। আহান ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করল। কোনো মতে খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে বিহান বলল
-ইয়ে মানে ব্রো, সরি রং টাইমে এন্ট্রি করে ফেলেছি আরকি
এক তো ভুল সময়ে উদয় হয়ে মুডের বারোটা বাজানোর সাথে ওকে ভীষণ অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে তার উপর এমন ছিচকে টাইপ কথা শুনে আহানের মেজাজ চড়ে গেল। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল
-কারো ঘরে ঢোকার সময় যে নক করতে হয় এই ম্যানার টুকু ও তোর এতদিনে হলো না ষ্টুপিড!
বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেল। তুরা লজ্জায় মাটির ভেতর ঢুকে যেতে পারলে বেঁচে যায়। এতগুলো লোকের সামনে কি না এইরকম পরিস্থিতিতে পরতে হলো!
-হ্যাঁ রে তুরা, ডিয়ার? আমরা তোদের রোমান্সে ব্যাঘাত ঘটিয়েছি বলে কি দুলাভাই স্যার কি রেগে গেল?
ফারিহা এসে তুরার পাশে বসতে বসতে বলল। তুরা একবার আড়চোখে তাকালো ফারিহার দিকে। মুখটা এমন করে রেখেছে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা শোনবার জন্যে আগ্রহী হয়ে আছে। এই মুহুর্তে ওকে দুটো থা’প্পড় বসিয়ে দিলেও হয়তো রাগ কমত নাহ। এখানে সবার সামনে তুরার বিব্রতবোধ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছে বেয়াদব টা!
-আরে ভাই তো রাগতেই থাকে। ভাইয়ার মাথা টা অলয়েজ হট হয়েই থাকে ও নিয়ে প্যারা নাই
রুহি লাফাতে লাফাতে এসে বসল তুরার পাশে। ঘরের মধ্যে বিহান,আরিমান, তনু,জায়মা,রুহি, ফারিহা এমনকি সাদমান ও আছে। জায়মারা সকলে তো কাল সিলেট থেকে এসেছে। কিন্তু তুরার প্রেগন্যান্সির পর থেকে সাদমান আর ফারিহা প্রায় ই আসে ওকে দেখতে। এখন তো আহান ওকে ভার্সিটি ও যেতে দেয়না। সবগুলো একই কোয়ালিটির হওয়াই একদিনেই গলায় গলায় ভাব হয়েছে
-এই তোরা সর তো সর। অল্প বউ দেখ আবাদের আপকামিং প্রিন্সেসের জন্য কি এনেছি। রাইয়ের বাবুর জন্যে আনতে গেছিলাম তাই ভাবলাম ঘাপুসের জন্য যখন আনবো ঘুপুস বাদ যাবে কেন
বলেই কতগুলো খেলনার বক্স বিছানার উপর রাখল। এই ঘুপুস নামটা রাইমার দেওয়া। রাইমা প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় তুরা ওর বাচ্চাতে ঘাপুর বলত বলে রাইমাও এখন তুরাকে ঘুপুসের মা বলে।
-আচ্ছা ও যে প্রিন্সেস এটা কি করে সিউর হয়ে বলছ তোমরা। ছেলেও তো হতে পারে!
-না না, আহান ভাই বলেছে যে বেবি গার্ল হবে। তাই প্রিন্সেস ই।
তুরা আর কিছু বলল নাহ। কারণ আহান যা বলেছে এরা সবগুলো সেটা নিয়েই মাতামাতি করবে তা ও ভালো করেই যানে। এর মাঝে সাদমান কে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুরা বলল
-সাদমান তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন, এদিকে আসো?
এক কোণায় কাচুমাচু মুখ করে রাখা সাদমান মৃদু পায়ে এগিয়ে আসল। আরমান ওকে উদ্দেশ্য করে বলল
-তুমি এমন চুপ করে আছ যে? এ্যানি প্রবলেম ব্রো?
-আ আমি তোমাদের বললাম একবার নক করে ঢুকতে, তাহলে তো স্যারকে হেসিটেশনে পরতে হত না
-এহহ আসছে ফরমালিটি ম্যান। তুই চুপ থাক। বউ কি স্যারের একার? আমাদের বান্ধবী আমরা যখন খুশি আসব
ফারিহার কথায় সাদমানের রাগ হলেও ও কিছু বলল নাহ। তবে ফারিহার সাথে তাল মিলিয়ে তনু ও বলল
-সেডাই তো। এই এক মিনিট, তোমরা তো ফিয়ন্সে তাই না?
তনুর কথা শুনে ফারিহা খুশিতে গদগদ হয়ে লজ্জা লজ্জা ভাব ধরে বলল
-হ্যাঁ, শুধু ফিয়িন্সে নাকি। আমরা তো গার্লফ্রেন্ড, ববয়ফ্রেন্ড। কিছু দিন পর হাসব্যান্ড ওয়াইফ ও হবো তাই না সাদু বেবি?
-শাট আপ৷ তোর মত বেশরম, ড্রামাবাজ মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারব না
সাদমানের কথা শুনে ফারিহা চোখ বড় বড় করে, খাট থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল
-এই ভদ্দরলোকের ছা, কি বললি হ্যাঁ? এটা আরেকবার বললে তোকে কিডন্যাপ করায়ে বিয়া করুম আমি। সারা পাড়া মহল্লায় বলে বেরিয়েছি যে তুই বলদ আমার জামাই।এবার কোনো ছকিনকি করলে তোরে আমি কিমা বানাব।
-এইই থামো থামো। ফাইট করো নাহ। কি বলো তো প্রেম করার সময়ে তোমরা ঝগড়া করছ
জায়মার কথা শুনে ফারিহা মেকি আফসোসের স্বরে বলল
-হুহ প্রেম, কপাল আমার পুড়ছে এই বেদ্দপ টার সাথে পিরিতি করাত স্বপ্ন দেখে। খবিইসসা বই ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখে না, এতই যখন বই নিয়ে পরে থাকতে মন চাই তাহলে আমাকে জোর করে আংটি কেন পরিয়েছিল বলো তো। আমি এখন অন্য একটা ছেলের সাথে চুটিয়ে প্রেম করতে পারতাম
ফারিহার এহেন কথা শুনে সাদমান এগিয়ে এসে বলল
-এই খবরদার, একদম মিথ্যা যদি বানিয়েছিস। তুই আমাকে ডস দিয়ে এই কাজ করিয়েছিস। তুই একটা মিথ্যুকের জাহাজ। মামাতো ভাইয়ের এঙ্গেজমেন্ট কে নিজের এঙ্গেজমেন্ট বলে আমাকে ভড়কে দিয়ে তুই নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছিস
-হুহ, স্বার্থসিদ্ধি করেছি। কেন রে আমি নাহই বললাম ই। তুই আমার কথা বিশ্বাস করে ঢ্যাং ঢ্যাং করে আমার বাপের কাছে এসে কেন বলেছিলি আমাকে ভালোবাসিস, তখন হিরোগিরি উতলে পরেছিল তাই না? এখন আমার মতো লক্ষি,হিরা সোনার টুকরো মেয়ে পেয়ে কদর করছিস না
-এইইই থামো বাবা থামো। তোমাদের ঝগড়া দেখে এবার লিটিল প্রিন্সেস ও বিরক্ত হয়ে যাবে। থামো ভাই থামো।
জায়মা ওদের থামিয়ে দিয়ে তুরার কাছে গিয়ে বসে বলল
-ভাবি তুমি রেডি হবে না?
-হ্যাঁ গো, কিন্তু আমারতো কিছু পছন্দই হচ্ছে নাহ।
জায়মা টেবিলের উপরে কিছুক্ষণ আগে একটা প্যাকেট রেখেছিল। ওটা হাতে নিয়ে বলল
-এটা পরো, এই শাড়িটা তোমার ভাই কিনেছে তোমার জন্যে। নিচে কাজে ব্যস্ত আছে বলে নিজে এসে তোমাকে দিতে পারেনি
-হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, ভাই দিক আর ভাইয়ের বউ একই তো
তুরা শাড়িটা বের করে হাতে নিয়ে বলল। জায়মা লজ্জা পেলো বেশ। নিচু স্বরে বলল
-কি যে বলো ভাবি। ভাইয়ের বউ কোথায় হলাম
-ওমাহ হতে আর দেরি কই। বাগদান তো হয়েই আছে, এবার ফুফা দেশে ফিরলেই তো তোমাকে চট করে বউ সাজিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসব
-সবারই প্রেমিক জুটে গেল, বিয়েও হলো। আমার আর কিছুই হলো নাহ। এখন আমার থাল হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে ‘বাবা আমার কি বিয়ে হবে না’
রুহির কথা শুনে উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বিহান, আরমান, আর সাদমান আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে গেলে জায়মা আর ফারিহা মিলে তুরাকে শাড়িটা পরিয়ে দিয়ে তৈরি করে নিচে নামিয়ে আনলো সাথে করে। বসার ঘরে এসে তুরার চোখ মুখ,মন খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। এতগুলো মানুষ, এতগুলো কাছের মানুষ মিলেমিশে আজ বাড়ি ভরে গেছে। খুশিরা যেন বাধ ভেঙেছে। এই তো মনে হলো সেদিন সে বউ সেজে অবিন্যস্ত সাজে এসেছিল প্রথম এ বাড়িতে। আর আজ এই বাড়িই তার সব। এই বাড়ি, এখানকার প্রত্যেকটা মানুষ সব কিছু অবিচ্ছেদ্য অংশের মতো মিশে গেছে ওর সাথে।
বাবা মা, বোন, দিদুন, ফুফু, ভাই, এতগুলো ভাই বোন, ফারিহা, সাদমানের মতো নিঃস্বার্থ বন্ধু সকলে আজ তার। সবাই মিলে একসাথে চোখের সামনে গল্প করছে হাসছে ঘুরছে। এত আনন্দ কি করে সইবে তুরা! এতো সুখ রেখেছিল সৃষ্টিকর্তা তুরার ভাগ্যে?!
তাই হয়তো বলে রব যা করেন ভালোর জন্যেই করেন, প্রত্যেকটা পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধরে রবের নিকট আর্জি রাখা উচিত। তিনি যা তোমার থেকে নিয়েছের তার দ্বিগুণ দিয়ে তোমাকে ভরিয়ে দেবেন। বাবাকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ বিধ্বস্ত অবস্থায় যেদিন এ বাড়িতে এসেছিল সেদিন কি তুরা এতটুকুও ভেবেছিল যে আজকের মত দিনটাও তার কপালে আসবে। স্বামী রূপে যাকে কবুল করেছিল তার অপমান, প্রত্যাখ্যান দেখেও কি কখনো ভেবেছিল সেই মানুষটাই আজ তার সুখের সর্বোচ্চ মাধ্যম হবে!
-কাম হেয়ার মাই হাইনেস।
আহানের ডাকে ধ্যান ভাংলো তুরার, আহান ভীষণ সযত্নে তুরার এক হাত ধরে সোফাতে রাইমার পাশে বসিয়ে দিলো। রাইমার কোলে এক মাসের ফুটফুটে একটা বাচ্চা।হাত পা নাড়িয়ে খেলা করছে, তুরা কোলে নিতেই কেমন গাল বাকিয়ে দিল।
-আপুউ,দেখলে ঘাপুস আমাকে দেখে হাসছে
-ঘাপুর তোকে দেখে না, তোর পেটের মধ্যের ঘুপুসকে দেখে হাসছে বুঝলি
রাইমার কথায় খিলখিল করে হেসে দিল তুরা। পরম আদরে ছোট্ট বাচ্চাটার কপালে একটা হামি এঁকে দিল।
•••••••••••••••••••••
সময় ভারি অদ্ভুত, এর ছুটন্ত গতিতে থামানো বা মন্থর করার সাধ্যি কারো নেই। একবার চলতে শুরু করলে অবিন্যস্ত ধারায় বইতে থাকে। এইতো সেদিন জানতে পারল তুরা প্রেগন্যান্ট, এইতো হাসি খুশি দিয়ে সময় গুলো যাচ্ছিল। কেমন করে পানির মতো হাতের ফাঁক দিয়ে নয় টা মাস বেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল নাহ।
আজ সকালেই আহান ভার্সিটির জন্য বেরিয়েছিল। ইদানীং খুব জরুরি কাজ ছাড়া বেরই না, তুরার সাথে সাথেই থাকে সারাটা সময়
তখনি বাড়ি থেকে ফোন এলো। এক লহমা দেরি না করেই ছুটলো আহান হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে করিডরে উপস্থিত হলেই রুবির কান্নারত মুখটা দেখতে পেল। তহমিনা পাশেই বসে তসবিহ জপ করে যাচ্ছে। ঘোলাটে হয়ে আসা ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকালো লাল বাতি জ্বলা ওটির ঘরের দিকে। নিমিষেই বুকের ভেতরটায় আগুন জ্বলে উঠলো। তুরা! তুরার কিছু হলে আহান বাঁচবে নাহ৷ বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রিনার তোলপাড় শুরু হলো আহানের।
যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চোখে ভর করা রাশি রাশি চোখের পানি মিশ্রিত তুরার নিষ্পাপ চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, নিদারুণ কেঁপে উঠলো অন্তরের অন্তঃস্থল। এই ভয়টার জন্যেই এক মুহুর্ত তুরাকে চোখের আড়াল করত নাহ। আর আজ বেরোতেই এই ঘটনা ঘটতে হলো।
চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসল নিমিষেই, অজানা ভয়ে গ্রাস হতে থাকলো সমগ্র দুনিয়াটা আহানের!
~
টিপটিপ করে চোখ খুলল তুরা। রক্তহীনতায় আক্রান্তদের মতো ফ্যাকাসে মুখ খানাতে নিমিত্ত অক্ষিকোটর প্রসারিত করল বহুকষ্টে।
সারা শরীর অবস হয়ে আছে, ভাবশূন্য লাগছে সবকিছু। বার কয়েক পলক ঝাপটে ধাতস্থ হতেই জিলিক দিয়ে উঠলো ভেতরে। আহান! আহান কোথায়? আর ওর কি হয়েছিল? বাচ্চা ঠিক আছে তো?
অজানা আশঙ্কায় আতংকিত হয়ে ঘাড় উচিয়ে উঠতে গেলেই একটা হাত খুব যত্নে তুরার মাথার উপরে রাখল। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো তুরা।
এ যেন দুনিয়ায় সবচেয়ে স্নিগ্ধ, সুন্দর দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে। আহান ঠিক তার পাশেই বসে। এক হাতে তোয়ালে পেচানো ছোট্ট একটা শরীর আগলে রেখে আরেক হাতে তুরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তুরার সাথে চোখাচোখি হতেই ও শিশুসুলভ গলায় বলল
-ও তো এইটুকুনি তুরা,মনে হচ্ছে হাতের ফাঁক দিয়ে পরে যাবে
বলেই সশব্দে হেসে দিল। কিন্তু তুরা হাসল নাহ, চোখ বেয়ে জলের ফোয়ারা বইল। কেন যানে না কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না। সুখানুভূতি এতো সুখের হয়? ভালোবাসার মানুষটার সাথে প্রাপ্তি এত আনন্দের কেন হয়! বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, এত সুখে কিরকম অভিব্যক্তি দেওয়া উচিত ওর জানা নেই।
আহান থামালো না তুরাকে,, তোয়ালে জড়ানো ছোট্ট শরীর টাকে রাখলো তুরার বুকের উপর, আলতো করে বাচ্চাসহ জড়িয়ে ধরলো, তুরার কপালে শীতল,উষ্ণ মিশ্রিত প্রগাঢ় স্পর্শে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বলল
-সুহাসিনী শ্রেয়সী প্রিয়তমা আমার, তুমি আমার হাসি মাখা চাঁদ। আমার স্বর্গীয় প্রাপ্তি, আনন্দ,ভালোবাসা। আমার শরতের প্রস্ফুটিত নির্মল কাশফুল,আমার বসন্তের সুর তুমি। তোমার স্পর্শে, ভালোবাসায় পূর্ণতা আজ। দেখো ভেঙেছে সকল খুশির বাধ। সারাজীবন রবো তুমি আমি দুজনে শুধুই দুজনার।
~~সমাপ্ত❤️~~
#Humu_❤️