তুমি নামক অনুভূতি পর্ব-৪১+৪২

0
939

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪১
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]
— ওপেন দা ডোর।

সমুদ্রের কথা শুনে মেহের থতমত হয়ে পড়ে। অহনা এসে নিশ্চিত তাকে খারাপ ভাববে। তাই মেহের নিম্ন কন্ঠে সমুদ্রকে বলে উঠে,

–আপু কী ভাববে?

মেহেরের বলা বাক্যটা সমুদ্রের কর্ণপাত হতেই তার মুখ হাতে বিরক্তির ‘চ’ শব্দ নির্গত হয়। অতঃপর সমুদ্র পুনরায় বলে উঠে,

–পুচকি, তোমাকে না আমি বেশি ভাবতে নিষেধ করেছি। নাও গো,,

তৎক্ষণাৎ মেহেরের ধীরগতিতে পা জোড়া সংকুচিত করলো।‌সীমান্ত পর্যন্ত ওড়না দ্বারা আবৃত করে দরজার কিছুটা নিকটবর্তী এসে তড়িৎ বেগে খুলে দিলো। অহনার মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে মাথা নিচু করে ফ্লোরের উপর দৃঢ় দৃষ্টিপাত আবদ্ধ করে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।

বিছানার উপর সমুদ্রের অবস্থান মোটেও প্রত্যাশা করেনি অহনা। সমুদ্রকে আয়েশ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে তার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা দেখা দিলো। ফলে মুখশ্রীতে পাংশুটে ভাবের উপস্থিত রেখে,শান্ত ভঙ্গিমায় সোফার উপর গিয়ে বসলো। প্রায় সেকেন্ড পাঁচেক সমুদ্রের দিকে তিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,

–ওই শয়তান তুই এখানে কি করছিস? আমি বলেছি না আন্টি আসার আগ পর্যন্ত তুই মেহেরের সামনে আসবি না! তাহলে কেন এলি?

অহনার কথাগুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। তার মুখে বিরক্তির ভাবটা স্পষ্ট! অতঃপর মোবাইল ফোন হতে দৃষ্টিতাত সরিয়ে অহনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। স্বল্প গম্ভীর গলায় অহনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— জাস্ট সাট আপ! আই নো আমি সাংঘাতিক অন্যায় করেছি। বাট এখন আমি অনুতপ্ত। সো স্টপ ইউয়ার মাউথ।

সমুদ্রের বলা বাক্যের প্রত্ত্যতুরে এক গাল হাসি উপহার দিলো অহনা। অহনাকে আকস্মিক হাসতে দেখে মেহের থতমত হয়ে উঠলো। খানিক ক্ষণ প্রাণ খুলে হাসলো সে। কষ্ট করে হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

— যাই হোক। তুই এই রুমে এলি কী করে?

অহনার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সমুদ্র। কন্ঠস্বর রাগের আবির্ভাব বজায় রেখে কর্কশ গলায় বলল,

— হাও ফানি! এতো অদ্ভুত ডিজাইন করে তোদের বাড়ি করতে কে বলেছিল? আই আম সিউর তোদের বাড়িটা করতে গিয়ে আর্কিটেকচারের মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল! বাই দা ওয়ে, তুই এই রুমে মেহেরকে থাকতে দিয়েছিস কেন? এই রুমে ইজিলি প্রবেশ করা যায়। তাও তুই ওকে এখানে রেখেছিস?

সমুদ্রের কথার প্রেক্ষিতে অহনা তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করলো মেহেরের মুখশ্রীতে। ফির মুচকি হেসে বলল,

–এসেছিস ভালো কথা। তাই বলে চোরের মতো বেলকনি ঝাঁপিয়ে। আমাকে বলতি আমি ড্রোর খুলে দিতাম। আর আমাদের বাড়িতে অনেক গুলো রুম আছে। তুই চাইলে অন্য রুমে থাকতে পারতি।‌‌ মাঝরাতে মেয়েটার ঘুম ভেঙে তুই একদমই ঠিক করিস নি।

অহনার কথাগুলো শুনে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল সমুদ্র। নিজ মাথার সিল্কি চুলগুলোতে আলতো স্পর্শ করে বলে উঠলো,

–বেশি কথা বলবি না। তোর কথা বলার ধরন আমার কাছে মোটেও সুবিধাজনক লাগছে না। আর একধাপ ও বাড়াবি না। তোর সামনে মেহের রয়েছে এটা ভেবে কথা বলবি। ইডিয়েট! মেহের কাম উইথ মি। তোমার স্কুল আছে। চলো।

বলেই রুম থেকে প্রস্থান করতে পা বাড়াল সমুদ্র। কিন্তু তার যাওয়ার পূর্বে অহনা বিরক্তির কন্ঠে বলে উঠলো,

–আরে কোথায় যাচ্ছিস তোরা। আমি বুঝিনা তোর এতো রাগ কেন? আমার তো মনে উইথ আউট মি তোকে দেখে সবাই ভয় পাই। ইনফ্যক্ট তোর পুচকিও। এতো রাগ ভালো না সমুদ্র। তুই এখনো মুখ ই ধুস নি। তাও আমি তোকে যেতে নিষেধ করব না। তুই যা।

সমুদ্র পা জোড়া থামিয়ে অহনার মুখশ্রীতে দৃষ্টি ফেললো। প্যান্টের দু পকেটে হাত রেখে বলে উঠলো,

— গাড়ি নিয়ে এসেছি। সো বাসায় গিয়ে সব করতে পারব। আমি থাকবো না তোর মতো স্টুপিডের বাসায়।

সমুদ্রের কথা শুনে অহনার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠলো। তৎক্ষণাৎ দ্রুত নিকটবর্তী মেহেরের হাত জোড়া আগলে ধরে বলল,

–তোকে যেতে নিষেধ করেছে কে! তুই যা। কিন্তু মেহেরকে নিতে পারবি না। দেখ দু দিন ও হয়নি। আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই ওকে সময় দিতে পারি নি। সো তুই কাঁদলে ও আমি মেহেরকে যেতে দিবো না।

অহনার কন্ঠস্বর হতে নির্গত শেষোক্ত বাক্যটা কর্ণপাত হতেই সমুদ্র মেহের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। তার চোখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এমন করুণ দৃষ্টি দেখে মেহেরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। শুকনো ঢোক গিলল সে। অবশেষে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে অহনার উদ্দেশ্যে বলল,

–আপু আমার অনেক পড়া বাকি আছে। বাসায় যেতে হবে। স্কুল ও আছে। আজ বরং আসি। তুমি ভালো থেকো। পড়া একটু চাপিয়ে তারপর নাহয় আয়ানকে দেখতে আসব। তখন কমপক্ষে এক মাস থেকে যাব।

মেহেরের কথা শুনে অহনার মন খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই মুচকি হেসে মেহেরের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলল,

–গুড গ্যাল। পড়ালেখা মনোযোগ দিয়ে করো। আর এতো ভয় পেও না।‌ এখন তুমি বড়ো হয়েছে। এতো ভয় পেলে কি চলে! এ রণক্ষেত্রে এতো ভয় পেলে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া ভীষণ মুসকিল। ভালো থেকো।‌ না খেয়ে তোমাদের যেতে দিবো ভাবলে কি করে!এখন ড্রইং রুমএ যাও তো প্রিন্সেস, দেখো ওখানে বুয়া রয়েছে। তোমার নিরব ভাইয়া সেই সাত সকালে অফিসে চলে গিয়েছে। ড্রইং রুমে আয়ানকে ওর দাদু খাইয়ে দিচ্ছে। আই থিংক তুমি ফজরের সালাত আদায় করেছো। সো তোমার মুখ ধোয়ার প্রয়োজন নেই। সমুদ্র তো ফ্রেশ হয় নি। তাই ফ্রেশ হয়ে আসবে। তুমি যাও, আমি আসছি।

অহনা কথা শুনে মেহের কন্ঠস্বর হতে ‘হুম’ শব্দটি নির্গত করে ভদ্র মেয়ের ন্যায় ড্রইং রুমের জন্য ধাবিত হলো।
——-
সমুদ্রের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অহনা। সমুদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় উপর বসে ফোন স্কোল করছে। লহমায় অহনা সমুদ্রকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

— ওই তোর ভাবভঙ্গি আমার কাছে ঠিক লাগছে না। নিজেকে সাবধানে রাখিস। তুই মেহেরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিস। তা আমি জানি। সো কন্ট্রোল!

অহনার প্রত্ত্যতুরে সমুদ্র গম্ভীর গলায় বলল,
–দেখ খেজুরে আলাপ বাদ দে। কি বলবি বল?

লহমায় অহনার মুখশ্রীতে একরাশ ঘন কালো মেঘের দেখে দিলো। মন খারাপ করে ভৎসনা স্বরে,

–তুই এটা একদম ঠিক করিস নি। কালকে নিরবের কাছে থেকে শুনলাম তুই বর্তমানে যে কেসটা হেন্ডল করছিস সেটা নাকি ছয় বছর পুরনো কেস। এই কেসটাকে যে যে অফিসার স্লভ করতে গিয়েছে তারা সবাই নাকি মারা গিয়েছেন। তাহলে কেন জেনে শুনে তুই কেসটা হেন্ডেল করছিস?

অহনার কথাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সমুদ্র। অহনা ফির বলতে লাগলো,

— তুই কী জানিস এখন তোর লাইফ কতোটা রিক্সে আছে? যেকোনো সময় তোকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হতে পারে। সব কিছু জেনে শুনেই তুই বাচ্চাটার মন নিয়ে খেলা করছিস কেন? তোর কি একবার মনে হয় না, তোর পুচকির মনেও বসন্তের আগমন ঘটে। একবার ভেবেছিস তোর অনুপস্থিতিতে এই বাচ্চা মেয়েটা কি পরিস্থিতির স্বীকার হবে? তোর নিঃশ্বাস যেদিন এই ধরণীর বাতাসে আর পাওয়া যাবে না সেদিন ওই মুহূর্ত হতে মেয়েটার কী হবে তুই কি ভেবেছিস? সেদিন থেকে তোর পুচকির জীবনে কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হবে। প্রথমত বাল্য বিবাহ দ্বিতীয় স্বামী হীনা অর্থাৎ বিধবা মেয়ের সঙ্গে সমাজ কেমন আচরণ করবে তা তো তুই জানিসই! আমাদের সমাজটা যে ভীষণ মারাত্মক। এখানে মানসিকভাবে সুস্থ থেকে জীবন যাপন করতে গেলে সঙ্গি হীনা বাঁচা যায় না। সমাজ সেই বিধবা মেয়েকে জীবন্ত লাশে পরিণত করে তুলে। তুই কি চাস তোর পুচকিকে তিলে তিলে শেষ করতে?

অহনার বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই সমুদ্রের অন্তরালের ঝড় হওয়া বইতে লাগলো। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল সে। মুহূর্তেই অসহায় কন্ঠে বলল,

–এরকম কথা বলিস না অহনা। আমি যে আমার কলিজাকে আঘাত দিয়ে বাঁচতে পারব না। আমার পুচকিকে ছাড়া আমি মরতে চাই না। আমি চাই আমার শরীরের চামড়া কুঁচকে যাওয়া পর্যন্ত ওর সঙ্গে বাঁচতে। আমার প্রার্থনা পুচকি যেন আমাকে আরো অনেক গুলো পুচকি উপহার দেয়। আমি সেদিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই।

কথাগুলো বলেই মাথার চুল গুলো মুঠো বন্ধি করে, অহনার সামনে থেকে প্রস্থান করল সমুদ্র।
___________
ঘড়ির কাঁটাতে ছুঁই ছুঁই একটা। খানিক পূর্বে অহনার বাসা থেকে তারা বাসায় এসেছে। মিনিট পাঁচেক পূর্বে সমুদ্র খাবার কিনতে বাইরে গিয়েছে। থেট সহকারে মেহেরকে দুপুরের রান্না করতে নিষেধ করে দিয়েছে সমুদ্র। এখনো অবধি সকিনা বেগমদের আগমন ঘটে নি। অবশ্য মেহের তাদের কথা জানেও না। কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পেরেছে সমুদ্রের অহনার বাসা থেকে আসার পর থেকেই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।

সমুদ্রের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহের রান্না ঘরে পা রেখেছে। সমুদ্রের চিন্তায় মগ্ন থেকে মুচকি হেসে কাজে ব্যস্ত ছিলো সে। হঠাৎ তার কর্ণপাত হলো কলিং বেলের ধ্বনি। সমুদ্র চলে এসেছে ভেবে দ্রুত গিয়ে ড্রোর খুলে দিলো সে। তৎক্ষণাৎ ওয়েস্ট পোশাক পরিহিত মেয়ে খোপ করে মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা কান্নার মাখা কন্ঠে বলতে লাগলো,
— সমুদ্র কোথায়? আই নিড সমুদ্র,,

(চলবে)

#তুমি_নামক_অনুভূতি
#পর্ব:৪২
#Lutful_Mehijabin (লেখা)
[কপি করা নিষেধ]

সমুদ্রের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহের রান্না ঘরে পা রেখেছে। সমুদ্রের চিন্তায় মগ্ন থেকে মুচকি হেসে কাজে ব্যস্ত ছিলো সে। হঠাৎ তার কর্ণপাত হলো কলিং বেলের ধ্বনি। সমুদ্র চলে এসেছে ভেবে দ্রুত গিয়ে ড্রোর খুলে দিলো সে। তৎক্ষণাৎ ওয়েস্ট পোশাক পরিহিত মেয়ে খোপ করে মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা কান্না মাখা কন্ঠে বলতে লাগলো,
— সমুদ্র কোথায়? আই নিড সমুদ্র,,

আচমকা জড়িয়ে ধরাতে অপ্রস্তুত হয়ে উঠেছে মেহের। অপরিচিত মেয়েটার থেকে এমন আচরণ মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে। মেয়েটার গায়ের ভর সামলাতে না পেরে বিপাকে পড়েছে মেহের। মেয়েটার বাহুবন্ধন হতে নিজেকে ছাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রায় মিনিট পাঁচেক মেয়েটা মেহেরকে আঁকড়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। খানিক বাদে নিজেকে সামলে, মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–ভয় পেয়ো না। আমি সমুদ্রের ফেন্ড হাফসা। খুব প্রয়োজনে ওর সঙ্গে মিট করতে এসেছি।‌ ওকে একটু ডেকে দেও, প্লিজ।

মেয়েটার কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই মেহের আন্দাজ করতে পারলো মেয়েটা কান্না বন্ধের প্রয়াস চালাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে বড্ড মায়া হলো তার। অচেনা অজানা সত্ত্বেও ভয় দ্বিধা, সংকোচ কোন অনুভূতি হচ্ছে না। শুধু মাত্র মেয়েটা কান্না মাখা মুখশ্রী দেখে খারাপ লাগছে। মেহের মেয়েটার কথার প্রত্ত্যতুরে ভদ্রতার সহিত বলল,

–উনি তো খানিক পূর্বে খাবার কিনতে বেরিয়েছেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না, এক্ষুনি চলে আসবেন। আপনি বরং উনার রুমে চলুন।

মেয়েটা চোখের পানি মুছতে মুছতে মেহেরের পিছু পিছু পা চালাল। মেহের দু হাতের আঙুল একত্র স্বল্প সংকোচের সহিত হাফসাকে বেড রুমে নিয়ে এলো। হাফসা রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দ্রুত সোফার উপর গিয়ে বসলো। অতঃপর মেহের হাফসার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

–আপু আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আপনার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসি।

বলেই মেহের বিপরীত মুখী হয়ে পা জোড়া খানিক সংকুচিত করলো। তৎক্ষণাৎ মেয়েটা মেহেরের হাত তার পাশ্ববর্তী সোফার উপর বসিয়ে বলল, সে কিছু খাবে না। মেহের ভদ্র মেয়ের ন্যায় মাথা নিচু করে সোফায় উপর বসলো। মেয়েটা মন যে ভীষণ বিষাদময় আন্দাজ করে মেহের আর তাকে খাবারের জন্যে জোর করলো না। প্রায় মিনিট পাঁচেক নিজ সম্বন্ধে মেহেরকে তথ্য দিলো। সমুদ্র তার কেমন বন্ধু হয় তা পরিষ্কার করে খুলে বলল। পরিশেষে মেয়েটা আবেগে আপ্লুত হয়ে মেহেরের নিকট তার দুঃখ প্রকাশ করলো। আকস্মিক মেহেরকে বলে উঠলো,

–সমুদ্রের তো তদন্ত বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার, নিশ্চিত ওর কাছে ভালো লয়ারের পরিচয় রয়েছে। তাই আমি ওর কাছে এসেছি ভালো লয়ারের খোঁজ নিতে।

হাফসার কথা শুনে গভীর চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়লো মেহের। তদন্ত বিভাগের সিনিয়র অফিসার বলতে কি বোঝায় তা তার নিকট অজানা নয় বটে কিন্তু তার জানা মতে সমুদ্র একজন হাইস্কুলের শিক্ষক। বিষয়টা বেশ সন্দেহ জনক লাগছে মেহেরের কাছে। মেয়েটার বলা কথাটা তার নিকট গ্রহণযোগ্য হলো না। সে ভাবলো হয়তো সমুদ্র আইন বিষয় নিয়ে স্টাডি করেছে! লহমায় মেহেরের চিন্তার মাঝে ব্যাঘাত ঘটালো হাফসা। গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মেহেরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–আমার হাজবেন্ডকে ডিভোর্স দিবো। তাই লয়ার খুঁজছি। অনেক হয়েছে আমি আর সহ্য করতে পারব না।

বাক্যগুলো বলেই ক্রোধের বসে ফুঁসতে লাগল হাফসা। মেয়েটা এমন কথা শুনে অত্যধিক অবাক হয়ে উঠেছে মেহের। অবাকের ফলে তার ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গিয়েছে আপনা আপনি। তার বড্ড জানাতে ইচ্ছে করলো আপুটা কেন তার স্বামীকে ডিভোর্স দিবে? মেহেরের হৃদয় গহীন বলে উঠলো, মেয়েটার প্রশ্ন করতে। কিন্তু পরক্ষণে তার মস্তিষ্ক বলে উঠলো, ছিঃ মেহের বড়ো আপুদের প্রশ্ন করতে তোর লজ্জা করে না ! এই আপুটা তো তোর শিক্ষকের সমান বয়সি। একরাশ অস্তিত্ব উদ্ভাবন ঘটেছে মেহেরের অন্তরালে। অতঃপর সে সিদ্ধান্ত নিলো হাফসার সঙ্গে কথা বলার। অবশেষে ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

–কেন আপু? আপনার স্বামী কী করেছেন যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? সে কি আপনার প্রতি অন্যায়, অত্যাচার করেন?

মেহেরের কথা কর্ণপাত হতেই হাফসা দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বলে উঠলো,

–ইউ নো, তিন মাসও হয়নি আমাদের বিয়ের। ওই বাড়িতে আমার শান্তি নেই। পরিবারের সবাই আমার সঙ্গে বাজে বিহেব করে। তুমি জানো, আমি আমার মায়ের সঙ্গে আলাদা একটু কথাও বলতে পারি না। আমার শাশুড়ি সর্বদা আমার পিছু পিছু আঠার লেগে থাকে। তারপর আমার বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে আমার স্বামীর কান ভারী করে। তুমি বিশ্বাস করবে না এ কথা যে আমার হাজবেন্ডকে আমাকে অবিশ্বাস করে। প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন আমাকে দু চোখের পাতায় দেখতে পারে না।

কথাগুলো বলে অশ্রু বিসর্জন দিলো হাফসা। অতঃপর চোখের পানি মুছে ফির বলে উঠলো,

— তুমি জানো আমার বাড়িতে আমি রাজকন্যার ছিলাম। আমার বাবা মা ভীষণ ভালোবাসতো তারা আমাকে কোন কাজ করতে দিতো না। বাড়িতে সবার চোখের মনি ছিলাম। এককথাই সবাই আমাকে মাথায় তুলে রাখতো। কিন্তু বিয়ের পরে শ্বশুর আমাকে বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে থাকতে হয়। তারা আমাকে ঘর বলে, কাপড়ে খাচতে বলে, রান্না করতে বলে,ইনফ্যাক্ট একটা পর একটা ওডার দিতে থাকে। তুমি বলো আমি কি এগুলোতে অভ্যস্ত? আমার শাশুড়ি আবার আমার পোশাক বরাবরই অপছন্দের। এই নিয়ে শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য শেষ নেই। আর ননদের কথা না বললেই, আমার সব কিছুতেই ওর নজর থাকবেই। তুমি জানো, এখন আমার হাজব্যান্ড আমাকে বিছানায় ঘুমাতে দেয় না। আমাকে ফ্লোরে ঘুমতে হয়। এতো কিছু সহ্য করেও সেদিন আমার হাজবেন্ড আমাকে থাপ্পর মেরেছে। সে এখন রাত্রি বেলা দেরি করে ফিরে। আমাকে সময় দেয় না। ট্যাস্ট মি আমি তার সঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলাম।

কথাগুলো বলেই মেয়েটা টেবিলের উপর হতে স্বচ্ছ এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস ত্যাগ করতে লাগলো। মেয়েটা পরিস্থিতি বেগতিক। বর্তমানে তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। সে এখনো আবেগ আপ্লুত। ফলে তার বোধগম্য হচ্ছে না যে তার সামনে বাচ্চা একটা মেয়ে বসে রয়েছে। মেয়েটার সামনে কথাগুলো বলা উচিত হবে কিনা বিষয়টা একবার তার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে না। হাফসা এখন নিজ কষ্ট তুলে ধরতে ব্যস্ত। অন্যদিকে মেহের মনোযোগ সহকারে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর ন্যায় কথাগুলো কর্ণপাত করছে। মেয়েটা বুঝার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। মিনিট পাঁচেক পর স্তব্ধ থেকে হাফসা ফির বলতে লাগলো,

–বিলিভ মি আমি সংসার করতে চাই। কিন্তু তারা আমাকে বোঝাতে চাই না। তাদের তো বোঝা উচিত আমি বাড়িঘর ত্যাগ করে নতুন পরিবেশে এসেছি। আমি চেয়েছি তাদেরকে আমার মনের মতো গড়ে তুলতে। কিন্তু তারা আমাকে তাদের মতো গড়ে তুলতে ব্যস্ত ! আমি চাই বাবার বাড়িতে আমি যেমন রাজকন্যা হয়ে ছিলাম ঠিক তেমনি শুশুড় বাড়িতে রাজারানী হয়ে উঠতে। আমি চাই তারা সবাই যেন আমাকে মাথায় তুলে রাখে। কিন্তু তারা আমার মনের মতো গড়ে উঠতে নারাজ। তুমি বলো, তাদের তো আমাকে বোঝা উচিত। ত্যাগ নামক বিষয়টা তো তারা করেন নি। এই আমি হাফসা করেছি।

হাফসার বাগযন্ত্র হতে নির্গত বাক্য গুলো মেহেরের কণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সে। সে হাফসা মন এবং মস্তিষ্কের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মেয়েটা সংসার করতে চাই। কিন্তু ত্যাগ করতে চাই না। হাফসা কথা সে ত্যাগ করেও কেন তার শুশুড় বাড়ির সবাই তাকে ছাড় দিচ্ছে না?কেন তাকে মাথায় তুলে রাজারানী করে রাখছে না? বিষয়টা ভেবে শুকনো ঢোক গিলল মেহের। অতঃপর মেহের হাসসার চোখে দৃঢ় দৃষ্টিপাত ফেলে বলল,

–আচ্ছা আপু, কিছু মনে না করলে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন প্লিজ।

মেয়েটা মেহেরের কথার প্রেক্ষিতে কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,

–আচ্ছা বলো। কিছু মনে করব না।

মেহের পরপর দুটো স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। অবশেষে ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে নিম্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

— মনে করুন আপনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে চীন দেশে বসবাস করতে গেলেন। এখন কি আপনার আগমনের উপলক্ষে পুরো দেশবাসী অথবা আপনি যে অঞ্চলের মানুষ আপনার জন্যে নিজেরা সেক্রিফাইস করে তাদের নিজস্ব ভাষা ত্যাগ করে বাংলায় কথা বলতে শুরু করবে? তারা কী আপনার জন্যে আপনার মনের মতো হবার চেষ্টা করবে?

মেহেরের প্রত্ত্যতুরে হাফসা পরিষ্কার জবাব দিলো,

–একদমই না। তারা কেন আমার জন্য ছাড় দিবে?

হাফসার কথা শুনে মুচকি হেসে উঠলো মেহের। ফির বলল,
–কারন আপনি তো নিজ দেশ ছেড়ে চীনে গিয়েছেন। ত্যাগ তো আপনি করেছেন। তারা তো করে নি। এখান তো আপনার কষ্টটা তাদের বোঝা উচিত!

মেহেরের বলা বাক্য গুলো শুনে হাফসার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের রেখা ফুটে উঠলো। মেয়েটা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছে , মেহের হয়তো কী বলতে চাইছে। হাফসা নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে রইলো। তৎক্ষণাৎ মেহের পুরনায় বলে উঠলো,

–আমার কথাই কিছু মনে করবেন না আপু। আপনি যেমন চীন দেশে গিয়ে এতগুলো মানুষকে নিজ আয়ত্তে আনতে পারবেন না ঠিক তেমনি শুশুড় বাড়িতে গিয়ে পরিবারের প্রতিটি সদস্যেকে নিজের মতো গড়তে চাইলেও পারবেন না। কারণ সবসময়ই মনে রাখবেন তারা সংখ্যায় অধিক। এবং আপনি সংখ্যায় একা। তাই আপনাকেই ত্যাগ করতে হবে। এই যে আপনি খানিক পূর্বে বললেন, আপনি আপনার বাবার বাড়িতে কোন কাজ করেন নি। আপনার বাবা মা আপনাকে রাজকন্যা করে রেখেছিল কিন্তু আপনার স্বামী, শাশুড়ি আপনাকে রাজারানীর আসন দিতে নারাজ ! একটা কথা বলি উপদেশ মনে করবেন না। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করুন। নিজেকে তৈরি করুন তাদের মনের মতো। তাদের আদেশ উপদেশ মেনে চলার প্রয়াস করুন। আপনার স্বামী যদি আপনাকে ফ্লোরে ঘুমতে বলে, আপনি ফ্লোরে ঘুমান। শাশুড়ি যদি আপনাকে ঘর মুছতে বলে , আপনি মুছুন। কখনোই স্বামী শাশুড়ির মুখে মুখে তর্ক করবেন না। সর্বদা মুখ বুজে সহ্য করবেন। কমপক্ষে এক মাস কাজগুলো মুখ বুজে কষ্ট করে করুন। প্রথমত এতে কিছুটা কষ্ট হবে। দেখবেন খুব শীঘ্রই আপনি এর প্রতিদান পাবেন। আপনি চান তো রাজকন্যা থেকে রাজারানী হয়ে উঠতে! আপনার চাওয়া পূর্ণ হবে। পরিবারের প্রতিটি সদস্যে আপনাকে ভালোবাসবে স্নেহ করবে এবং আপনাকে শ্রদ্ধা করবে। শুধু আপনি ত্যাগ করুন। লোকে বলে মেয়েরা নাকি কাঁদার মতো কোমোল।তারা চাইলেই যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

কথাগুলো বলে থেমে গেলো। একটা শুকনো ঢোক চেপে ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে বলল,

–আপু আপনি দয়া কয়েকটা দিন তাদের কথা মতো চলার চেষ্টা করুন। ননদের কথাই কিছু মনে করবেন না। প্রতিটি সংসারে কম বেশি সব ননদরা আদর চাই। আপনার নদনকে নিজ ছোট বোনের নজরে দেখুন। কারণ ছোট বোনরা সবসময়ই আপনার প্রতিটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। কখনোই তাদের থেকে আড়াল হবেন না। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হলে শাশুড়ি মায়ের সামনে বলুন। কখনো তাদের অগোচরে যাবেন না। আপনার স্বামী সন্দেহ করে এমন কর্ম করা থেকে বিরত থাকুন। প্লিজ আপু আপনি চেষ্টা করুন, জীবনে তো মেয়েদের একটা বিয়েই হয়। মাস খানিক পরেও যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন না হয় তাহলে না হয় কোন সিদ্ধান্ত নিবেন।

মেহেরের কথাগুলো অধিক মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করলো হাফসা। তার বলা প্রতিটি বাক্য যে তীরের ন্যায় ধারালো। যা হাফসার অন্তরালকে ঝড় রাত্রি উত্তাল উদ্যম সমুদ্রের ন্যায় তৈরি করেছে। বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। হাফসা মেহেরকে উপেক্ষা করে সজরে কেঁদে উঠলো। এ যেন দুঃখের কান্না নয় বরং অনুতপ্তের। আসলেই তো মেয়েদের জীবন তো স্বামী শাশুড়িকে ঘিরেই।

মেহের মনে হলো হাফসাকে একা কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। তাই হাফসার জন্য খাবার তৈরি করার উদ্দেশ্যে বেডরুম হতে প্রস্থান করল। মেহেরের ছোট মস্তিষ্ক বলে উঠেছে হাফসা অনুতপ্ত !
_____
ড্রইং রুমে উপস্থিত হতেই মেহের লক্ষ্য করল মেইন ডোর খোলা। মুহূর্তেই কিছু ভেবে উঠার পূর্বে তৎক্ষণাৎ সমুদ্র মেহেরকে রান্না ঘরে টেনে নিয়ে এলো। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

— বাহ্, আমি তো ভাবতাম আমার পুচকি ছোট মানুষ। এখন আপনি আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন।

সমুদ্র কন্ঠেসর ব্যতিক্রম।এক অদ্ভুত চাহনি এককথাই তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে রয়েছে মেহেরের মুখশ্রীতে। যার ফলে মেহের অযথাই থরথর করে কাঁপছে ! তার মনে সমুদ্র তার বলা প্রতিটি বাক্য আড়াল থেকে শুনেছে। সমুদ্র খানিকটা এগিয়ে এলো মেহেরের নিকটবর্তী! মেহের সঙ্গে সঙ্গে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল। সে পারল না সমুদ্রের তীর্যক চাহনি সহ্য করতে। তৎক্ষণাৎ সমুদ্র অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

–আমার পুচকি সবকিছু বুঝে। কিন্তু আমাকে বুঝে না। আচ্ছা পুচকি এর শাস্তি আমি আপনাকে এখন দিতে চাচ্ছি।আপনি প্রস্তুত তো!
(চলবে)
[#রিচেক_দেইনি। ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]